# এক মুঠো রোদ ..
# writer :নৌশিন আহমেদ রোদেলা
# পর্ব -২৩
৪৩.
কাল থেকে ঘরে দরজা দিয়ে মন খারাপ করে বসে ছিলো বলে লীনা আরুকে একরকম জোড় করেই কলেজে পাঠিয়েছে। তাতে বেশ কাজও হয়েছে। প্রিয়ন্তীর সাথে আড্ডা দিতে দিতে কালকের সেই ভয়ানক সময়গুলো অনেকটাই ভুলে গিয়েছি আরু। কিন্তু কথায় আছে না? অভাগা যেদিকে তাকায় সাগর শুকিয়ে যায়।আরুর ক্ষেত্রেও ঠিক তাই ঘটলো। ক্লাস শেষে বাড়ি ফেরার পথেই পথ আটকে দাঁড়ালো মিলন আর লিমন। এদের মধ্যে একজনকেই সেদিন মেলায় চড় মেরেছিলো রাফিন। ভয়ে গলা শুকিয়ে এলো আরুর। চোখ-মুখ খিঁচে দৌঁড় লাগাতে ইচ্ছে করছে তার কিন্তু এই মুহূর্তে তা সম্ভব নয়। সামনে ছেলেগুলো আর পেছনে কলেজের গেইট।যাওয়ার জায়গা নেই বললেই চলে। মনে মনে দোয়া দুরুদ পড়ছে সে। সেদিন তো রাফিন বাঁচিয়ে ছিলো, কিন্তু আজ! আজ কোনো গন্ডগোল হলে ভাইয়া নিশ্চয় বাসা থেকে বের করে দিবে ওকে। তখন কোথায় যাবে আরু? এসব কথা ভেবে কান্না পেয়ে গেলো তার। ছেলেগুলো কি বিশ্রীভাবে হাসছে! আরুকে পিছুতে দেখে দাঁত কেলিয়ে বলে উঠলো লিমন,
— কি গো সুন্দরী? সেদিন তো খুব বাড় বেড়েছিলো, আজ কি হলো? এই কলেজ ক্যাম্পাসে শুধু মিলন আর লিমনের রাজত্ব চলে। আজ কে বাঁচাবে তোমায়? এখন যদি তোমায় তুলে নিয়ে যায় তাহলে কেমন হবে বলো তো?
আরুর এবার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু তাকে সেই সু্যোগ না দিয়েই লিমনদের পেছন থেকে বলে উঠলো কেউ,
— আর আমরা যদি তোকে তুলে নিয়ে যাই তাহলে?
আরু চোখ বড়বড় করে তাকালো। লিমন মিলন পেছনে তাকাতেই লিমনের মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে উঠলো। পেছনে আসিফ আর রাফিনের কয়েকটি ছেলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। লিমন এর আগেও আসিফের হাতের মার খেয়েছে। মার খেয়ে টানা সাতদিন জ্বরে ভুগেছে সে। লিমন ভাবতেও পারে নি এখানেও টপকে পড়বে আসিফ নয়তো কখনোই আরুর সামনে কেন পেছনেও আসতো না সে। আসিফ আরুর দিকে তাকিয়ে অত্যন্ত ভদ্রভাবে বললো,
— ম্যাডাম? ভাই গাড়িতে আছেন। আপনি গাড়িতে গিয়ে বসুন। আমরা ওদের দেখছি। শ্যামল-পলাশ?
— জি ভাই?
— ম্যাডামকে ভাইয়ের গাড়িতে নিয়ে বসা। কুইক!
আরু ভয়ে কাঁপছে। খুব দ্রুত ডিসিশন নিতে হবে তাকে কিন্তু কি অদ্ভুত! কান্না ছাড়া কোনো বুদ্ধিই আসছে না মাথায় । আচ্ছা? রাফিনের লোকগুলো ভদ্রলোকের বেশে ওকে কিডন্যাপ করে নিচ্ছে না তো? ছেলেগুলো ওকে যাওয়ার জন্য তাগিদ দিতেই কাঁদো কাঁদো মুখ নিয়ে এগিয়ে গেলো আরু । মনের মধ্যে ভয়ানক সব প্রশ্ন ঘুরছে তার। আচ্ছা? রাফিন কি আরুর সাথে উল্টা-পাল্টা কিছু করে ফেলবে? আরুর মন একবার বলছে, না কিছু করবে না কিন্তু পরমুহূর্তেই বলছে অবশ্যই করবে। সেদিন রাস্তায় যা করলো! কথাটা মনে পড়তেই আবারও কান্না পেয়ে গেলো আরুর। শুধু শুধু কান্না নয় হাত-পা ছুঁড়ে কান্না করতে মন চাইছে তার। আপাতত কান্না করার পরিকল্পনা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে গাড়িতে উঠে বসলো সে। কিন্তু গাড়িতে কোথাও রাফিনকে খুঁজে পেলো না। তবে কি তাকে মিথ্যে বললো ওরা? এবার যেন মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো আরুর। রাফিন যতই খারাপ হোক না কেন তাকে আশেপাশে পেলে অনেকটা স্বস্তি পায় আরু। কিন্তু এখন কি হবে? কিছুক্ষণ পর আসিফ আর দু’জন ছোকরা গাড়িতে এসে উঠলো। তাদের দেখে আরুর জ্ঞান হারানোর মতো অবস্থা কিন্তু কেউ তাকে কিছু বললো না। যার যার মতো বসে গেলো চুপচাপ। এমনকি আরু যে সিটে বসেছে তার আশেপাশেও বসলো না কেউ। আরু যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো কিন্তু অতিরিক্ত ভয়ে এটাও জিগ্যেস করতে পারলো না আসলে সে যাচ্ছেটা কোথায়? গাড়িটা একটা বিরাট বাঙলোর সামনে এসে দাঁড়ালো। আরুকে নিয়ে যাওয়া হলো দু’তলার এক কোণায় বিরাট একটা রুমে। আরু ভয়ে ভয়ে চারপাশে তাকালো। রুমটা নিঃসন্দেহে একটি অফিস রুম। আরু আরো খানিকটা এগুতেই কোথাও একটা “খুট” করে শব্দ হলো। আরু পারে তো দৌড়ে পালায় কিন্তু তার আগেই রাফিনকে চোখে পড়লো তার। রাফিন আরুকে দেখে অবাক হয়ে বললো,
— তুমি এখানে?
আরু কি বলবে বুঝতে পারছে না। কি আশ্চর্য, নিজের লোক দিয়ে তুলে এনে এখন নিজেই জিগ্যেস করছে আরু এখানে কেন? আরুকে চুপ করে থাকতে দেখে আবারও জিগ্যেস করলো রাফিন,
— কি হলো? কথা বলছো না কেন? এখানে কি?
আরু আমতা আমতা করে বললো,
— আ আপনার লোকেরা এনেছে আমায়। আমি ইচ্ছে করে আসি নি।
রাফিন টেবিলের উপর বসে তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বললো,
— কেন? ওদের চড় মেরেছো?
আরু হন্তদন্ত করে বললো,
— আমি কেন চড় মারতে যাবো? ওনারা তো হঠাৎ করেই কলেজের সামনে চলে এলেন। আর বললেন আপনি গাড়িতে আছেন আমি যেন গাড়িতে গিয়ে বসি।
রাফিন ভ্রু কুঁচকে তাকালো। বললো,
— ওরা বললো আর তুমি চলে এলে? অদ্ভুত! এনিওয়ে, এসেছো যখন, তখন বসো। চা কফি খাও। কলেজ গেইটে তো ভয়ে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিলে প্রায়।
আরু অবাক হয়ে বললো,
— আপনি ওখানে ছিলেন?
রাফিন তোয়ালেটা সোফায় রেখে চেয়ারে বসতে বসতে বললো,
— না। হসপিটাল থেকে আসছিলাম হঠাৎ দেখলাম কাঁপাকাঁপি করছো তাই আসিফকে বললাম তোমাকে একটু গ্লুকোজ খাইয়ে আসতে কিন্তু ডাফারটা কি বুঝলো কে জানে? তোমাকে একদম আমার বাড়ি বয়ে নিয়ে চলে এলো। আচ্ছা?কাঁপাকাঁপ
ি কমেছে? নাকি গ্লুকোজ খাবে?
আরু কিছু বললো না। এদিক- ওদিক তাকাতে লাগলো। রাফিন ধমকে ওঠে বললো,
— এই মেয়ে? দাঁড়িয়ে আছো কেন? বসো।
রাফিনের ধমকে চমকে উঠলো আরু। ঝটপট গিয়ে বসে পড়লো সোফায়। রাফিন ফাইল উল্টে নিজের কাজে মন দিলো। সেই কখন থেকে বসে আছে আরু নিজেকে এই মুহূর্তে গাছ গাছ লাগছে তার। নো নড়াচড়া চুপচাপ বসে থাকো একদম গাছের মতো। যদিও গাছ দাঁড়িয়ে থাকে তাতে কি? ফিলিংস তো এক। আরুর আবারও গলা ছেঁড়ে কান্না পেয়ে যাচ্ছে। রাফিনের ভয়টা শিরা থেকে উপশিরা এমনকি রক্তে রক্তেও ঘুরে বেড়াচ্ছে এখন। কি সাংঘাতিক! রাফিন এবার উঠে দাঁড়ালো সাথে সাথেই গলা শুকিয়ে গেলো আরুর। রাফিন আরুর ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে ভ্রু কুঁচকে বললো,
— এই মেয়ে কাঁপছো কেন?
আরু ভয় পাওয়া গলায় বললো,
— ভয় পাচ্ছি।
রাফিন এবার চেয়ার টেনে বসলো। আরুর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে উঠলো,
— ভয় কেন পাচ্ছো? আগে তো পেতে না।
আরু কিছু বললল না। চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে রইলো। রাফিন আবারও ধমকে উঠে বললো,
— কি হলো? কথা বলো।
আরু বললো,
— বাসায় যাবো।
রাফিনের কথাটা ঠিক পছন্দ হলো না। সে স্পষ্ট গলায় বললো,
— আমি আসতে বলেছিলাম? আসছো কেন? এখন যেতে দিবো না।
আরু এবার কেঁদেই দিলো। কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠলো,
— প্লিজ, যেতে দিন আমায়। নয়তো ভাইয়া বাসা থেকে বের করে দিবে আমায়।
রাফিনের মুখের ভাবে তেমন কোনো পরিবর্তন দেখা গেলো না। বিরক্ত গলায় বললো,
— একদম ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে কাঁদবে না। বাসা থেকে বের করে দিলেই কি? রাফিন চৌধুরী যা বলে তাই হয়, তুমি যেহেতু আসছো এখন যেতে দেওয়া হবে না ব্যস!
আরু কান্নামাখা গলায় বলে উঠলো,
— এসব শুনলে বাবা একদম মরে যাবে। আমার বাবাটা এমনি অসুস্থ। প্লিজ!
রাফিন ভাবলেশহীন গলায় বললো,
— মরলেই কি? আরেকটা বাবা কিনে দিবো তোমায় আর বাপ না থাকলেই কি?আমার তো কেউ নেই আমি তো বেশ আছি।
আরু কি বলবে বুঝতে পারছে না। রাফিনের সামনে বলার মতো কোনো কথায় খুঁজে পায় না সে। রাফিন তীক্ষ্ণ গলায় বললো,
— আবার চুপ করে গেলে কেন? আগে তো চড় দিয়েও বকবক থামানো যেতো না। এখন এমনিতেই চুপ। আমার আজকে কিছু ভালো লাগছে না। কথা বলো নয়তো শুট করে বুড়িগঙ্গায় ফেলে আসবো।
আরু এবার ঘামতে শুরু করলো। মাথায় কোনো কথায় আসছে না তার। কি বলবে সে? রাফিন আবারও ধমকে উঠতেই কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,
— আ আমি ককথা খুঁজে পাচ্ছি না।
রাফিনের গম্ভীর মুখটা মুহূর্তেই চকচক করে উঠলো। উৎসাহ নিয়ে বলে উঠলো,
— কি বলবে বুঝতে পারছো না রাইট?
আরু মাথা নেড়ে সম্মতি জানাতেই আবারও বলে উঠলো রাফিন,
— আমারও সেইম সমস্যা হচ্ছে। বলার মতো কোনো কথায় খুঁজে পাই না আমি। একদম চুপ হয়ে যাই। নিজেকে তখন বুদ্ধিপ্রতিবন্ধ
ী লাগে আমার। কি বিশ্রী একটা ঝামেলায় পড়লাম, বলো তো?
আরু চোখ বড় বড় করে তাকালো। মৃদু গলায় বললো,
— সরি?
“সরি” শব্দটি শুনেই আরুর মুখের দিকে তাকালো রাফিন। বিরক্ত গলায় বললো,
— সরি! সরি! আমার নিজেকে আস্ত এক বলদ মনে হচ্ছে। কি অদ্ভুত! বাপে আমার কোটি টাকা নষ্ট করছে আর তারই মেয়ে এসে আমাকে “সরি” বলা শেখাচ্ছে। আর আমি আরেক ডাফার, তার কথামতো শিখেও নিচ্ছি। এই মেয়েটার কপাল বরাবর শুট করতে পারলে বেশ হতো বুঝলে? কিন্তু আফসোস, পারছি না। মনটা সায় দিচ্ছে না।
আরু রাফিনের কথার আগামাথা কিছুই বুঝলো না। ড্যাবড্যাব চোখে তাকিয়ে রইলো শুধু। রাফিন একটু থেমে আবারও বললো,
— এই তুমি শাড়ি পড়ো না?
আরু অবাক হয়ে বললো,
— আমার কি বিয়ে হয়েছে যে শাড়ি পড়বো।
রাফিন খানিক ভেবে বললো,
— বিয়ে না হলে শাড়ি পড়া যায় না? রোজা তো পড়ে। এনিওয়ে, চলো তোমাকে আসিফের সাথে বিয়ে দিয়ে দিই। তারপর এতোগুলো শাড়ি কিনে দিবো। শাড়ি পড়ে টুকটুক করে ঘুরে বেড়াবে। শাড়ি পড়লে মেয়েদের স্নিগ্ধ লাগে।
আরু চোখ বড়বড় করে তাকালো। রাফিন ভ্রু কুঁচকে বললো,
— এভাবে তাকাচ্ছো কেন? আসিফকে পছন্দ হয় নি? তাহলে আমিই বিয়ে করে নিই। আমাকে তো পছন্দ হয়। হয় না? নয়তো তোমার ওই আধভাঙা হবু বর। একটা কাজ করি,ওই ছেলের নামটা যেন কি? তাকে তুলে এনে তোমার সাথে বিয়ে দিয়ে দিই। কি বলো,রাজি?
আরু মুখ ভার করে বললো,
— আমি কাউকেই বিয়ে করবো না। বাসায় যাবো। যেতে দিন আমায়।
— বাসায় যাবে? ওকে ফাইন। তার আগে সরি বলো আমায়। একজন বলেছে দোষ করে স্বীকার করে নেওয়াটা দোষের কিছু না।খুবই সিম্পল একটা ব্যাপার। সেদিন তুমি আমায় চড় মেরেছিলে এটা তোমার দোষ ছিলো কিন্তু তুমি তোমার দোষ স্বীকার করো নি। সেজন্য এখন একশোবার কান ধরে উঠবস করবে আর “সরি” বলবে। নয়তো যাওয়ার কথা ভুলে যাও।
আরু কিছুক্ষণ অসহায় দৃষ্টিতে রাফিনের দিকে তাকিয়ে রইলো। কিন্তু তাতে তেমন একটা লাভ হলো না। রাফিনকে আজ কেমন পাগল পাগল লাগছে তার। কেমন অদ্ভুত অদ্ভুত বিহেভ করছে! আরু দীর্ঘশ্বাস ফেললো, চরম অনিচ্ছায় উঠে দাঁড়িয়ে মুখে করুণ ভাব ফুটিয়ে উঠবস করতে লাগলো। তবুও যদি বাসায় ফিরতে পারে সে!
৪৪.
মালনীছড়া চা বাগানের ফটকে দাঁড়িয়ে আছে রোজা,তীর্থ আর মৃন্ময়। সাথে আছে গাড়ির ড্রাইবার আলী। অল্প বয়স্ক ছিপছিপে তরুন সে। রোজার ধারনা ছেলেটি অতিরিক্ত কথা বলা জনিত রোগে ভোগছে। অযথা হাজারও কথায় মাথা পাকিয়ে দেবার মতো স্বভাব তার। তবে ইতোমধ্যেই রোজার সাথে বেশ ভাব জমে গেছে তার। চারজনেই মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মালনীছড়ার উঁচু নিচু টিলায় ছেয়ে থাকা সবুজের গালিচায়। রোজা মালনীছড়া চা বাগানের কাহিনী প্রথম জানতে পারে কথাসাহিত্যিক রাবেয়া খাতুনের ‘বাগানের নাম মালনীছড়া’ উপন্যাস থেকে। তখন থেকেই চা বাগানের বাহারী রূপ দেখার বড় লোভ তার। অবশেষে তার লোভাতুর মন যেন খানিক শান্ত হলো। প্রকৃতির প্রতি আকুল মমতায় চোখদুটো বন্ধ করে বুক ভরে শ্বাস টেনে নিলো রোজা। বাতাসে যেন পাগলাটে এক উম্মাদনা। ঝিরিঝিরি বাতাসে কেঁপে উঠে কপালে পড়ে থাকা চুল। রোজা চোখ মেলে তাকায়। অসম্ভব সৌন্দর্যের বেড়াজালে শ্বাসটুকু যেন আটকে আসছে তার। হুট করেই মেঘকন্যার আগমনে ছেয়ে যায় সবুজ চায়ের বাগান। দূর মেঘালয় থেকে হিম বাতাস বয়ে নিয়ে আসে অতিথি মেঘকন্যাকে। তারপরই চা বাগানের আকাশ সাজে শুভ্র মেঘমালায়। একসময় মেঘকন্যা বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে কচি চা পাতায়। বৃষ্টির পরশে চায়ের পাতা রং বদলায়। তার সাথে বদলায় রোজার মুগ্ধ চোখের দৃষ্টি। বৃষ্টি শুরু হতেই চা বাগানের স্টাফ রুমের দিকে দৌঁড়ে যায় ওরা। কথা বলে ঢিলাঢালা শার্ট গায়ে নিরশ মুখ নিয়ে বসে থাকা এক কর্মচারীর সাথে। মৃন্ময় নিজের পরিচিয় দিতেই বাগানের দেখাশোনা করার কাজে নিযুক্ত লোকটি এগিয়ে আসেন। বিরক্ত মুখে তাদের নিয়ে যায় সহকারী ব্যবস্থাপকের বাঙলোয়। তখনও বৃষ্টি পড়ছে। তাদের হাতে দুটি ছাতা। একটির নিচে গুটিশুটি হয়ে আশ্রয় নিয়েছে তীর্থ আর চা বাগানের কর্মী। অন্যটিতে মৃন্ময়-রোজা। আলী থেকে গেছে স্টাফ রুমেই। বৃষ্টির ছাঁটে রোজা- মৃন্ময় দু’জনেই গুটিশুটি হয়ে সরে আসে কাছে। সাথে সাথেই ছুঁয়ে যায় দু’জনের শরীর। শিউরে ওঠে রোজা। অদ্ভুত এক শিহরণ ছেয়ে যায় সারা প্রাণজুড়ে। রোজা আড়চোখে মৃন্মের মুখের দিকে তাকায়। মৃন্ময় নির্ভীক। চোখে-মুখে কোনো ভাবাবেগ নেই তার। রোজা নিজেকে সামলে নিয়ে সামনে তাকায়। শরীরটা থেকে থেকে কেঁপে উঠছে তার। এর থেকে তীর্থের সাথে এলেই বেশ হতো। কেন যে মৃন্ময়ের সাথে আসতে গেল, কে জানে? রোজা চারপাশে চোখ ঘুরায়। চা বাগানের গাঁ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে জল। বৃষ্টির পানির সাথে নাকে আসছে পাহাড়ী মাটির গন্ধ। বেশকিছুক্ষণ হাঁটার পর সহকারী ব্যবস্থাপকের বাঙলোয় পৌঁছায় তারা। সহকারী ব্যবস্থাপক আজীম আলী সাদরে গ্রহণ করলেন তাদের। শক্তপোক্ত চেহারার মধ্য বয়সী লোক। মুখে তার গদগদ হাসি। তীর্থ বামহাতের শার্ট ঝাড়ছে। এক সাইডের প্রায় পুরোটায় ভিজে গেছে তার। চোখে-মুখে বিরক্তি স্পষ্ট। এই বৃষ্টির মাঝেই মৃন্ময়ের বেরিয়ে আসাটায় চরম রকম বিরক্ত সে। মৃন্ময়ের গায়ের কালো শার্টের অর্ধেকটাই ভিজে গেছে প্রায়। তাতে বিন্দুমাত্রও ভ্রুক্ষেপ নেই তার। সবসময় স্বাভাবিক থাকা মুখভঙ্গিতে মিষ্টি হাসি খেলা করে দিনের অধিকাংশ সময়। রোজা নিজের দিকে তাকায়, স্কার্টের নিচের দিকের কিছু অংশ ব্যতীত আর কোথায় পানির ছোঁয়া পড়ে নি । রোজা বেশ আশ্চর্য হয়। আবারও একবার মৃন্ময়ের দিকে আড়চোখে তাকাতেই আজিম আলী বলে উঠেন,
— ওকি! আপনারা দাঁড়িয়ে কেন? বসুন! বসুন!
ওরা ভদ্রতার হাসি নিয়ে সোফায় গিয়ে বসে। আজিম সাহেব স্মিত হেসে বলেন,
— আমার ছোট মেয়েটা আপনি বলতে পাগল মৃন্ময় সাহেব। সেদিন দেখলাম দেয়ালে বিশাল এক ফটো লাগিয়ে রেখেছে। কি সাংঘাতিক! আজকালকার ছেলে-মেয়েদের চক্ষুলজ্জা বড্ড কম।
মৃন্ময় হাসে। আজিম সাহেব খানিকটা ধম নিয়ে আবারও বলে উঠেন,
— আপনি আসছেন শুনে খুব খুশি হয়েছি। এই বয়সে তো আর টিভিতে সিনেমা, গান দেখা হয় না। তবে হতদরিদ্র মানুষের জন্য আপনার মায়ার কথা অনেক শুনেছি আমি। এই স্বার্থপরতার যুগে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুর্লব।
মৃন্ময় জোরপূর্বক হাসে। ভীষণ অস্বস্তি লাগছে তার। মানুষের এসব অহেতুক প্রসংশায় বড্ড বিরক্ত হয় সে। এজন্যই কারো দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়েই নিজেকে আড়াল রাখার চেষ্টা করে সে। তবু কিভাবে যে ছেপে যায় সব, কে জানে? আজিম আলি আবারও মুখ খোলার আগেই হালকা হেসে বলে উঠে মৃন্ময়,
— আপনার কাছে একটা সাহায্যের জন্য এসেছিলাম স্যার।
এমন একজন বিখ্যাত মানুষের মুখে “স্যার” শব্দটা শুনতে খুব ভালো লাগল আজিম সাহেবের। খুশি মনে বললেন,
— অবশ্যই। কিভাবে সাহায্য করতে পারি বলুন।
মৃন্ময় বললো,
— চৌদ্দবছর আগে আপনাদের এখানে কাজ করতো এমন একজনের সম্পর্কে কিছু তথ্য জানতে চাই আমরা। এই ব্যাপারে খানিক সাহায্য চাই আমাদের।
আজিম সাহেব অবাক হলেন। বিস্মিত গলায় বললেন,
— চৌদ্দ বছর! এতো পুরনো কোনো রেকর্ড তো জমা থাকার কথা নয় মৃন্ময় সাহেব। তাছাড়া আমার চাকরি এই চা বাগানে নয় বছর। প্রতিবছর প্রায় দেড়শো লোক নিয়োগ দেওয়া হয় এই চা বাগানে। কখনো কখনো তারও বেশি। এই নয় বছর আগের রেকর্ড পেতেই বেশ বেগ পেতে হবে বলে আমার ধারনা। তারওপর চৌদ্দবছর! তাছাড়া, চা বাগানে এতো বছর পুরোনো রেকর্ডের কোনো প্রয়োজন হয় না বলে তেমন যত্ন সহকারে রাখাও হয় না।
আজিম সাহেবের কথা কেঁড়ে নিয়ে বলে উঠে রোজা,
— অযত্নে রাখা অনেক কিছুও টিকে যায়, আজিম সাহেব। আমাদের একবার রেকর্ডগুলো চেইক করার সুযোগ দিন।
রোজার কথার রেশ ধরেই বলে উঠে মৃন্ময়,
— আমরা শুধু স্টাফদের রেকর্ডটাই চেইক করবো। আর সেটাও পুরোনো রেকর্ড। ব্যবস্থাপক হিসেবে এটুকু সাহায্য তো আমাদের করতেই পারেন, স্যার।
আজিম সাহেব চিন্তায় পড়ে গেলেন। এভাবে চা-বাগানের নিজস্ব তথ্য কাউকে ঘাটতে দেওয়া নিয়ম সংগত নয়। কিন্তু মুখ ফুটে না শব্দটা উচ্চারণ করতে পারছেন না উনি। মৃৃন্ময়ের কথা বলার ভঙ্গি এবং ভদ্রতা বেশ পছন্দ হয়েছে উনার। এই জাতীয় ছেলেদের মুখের উপর চট করে “না” বলা যায় না। ইনিয়ে বিনিয়ে “না” বলতে হয়। কিন্তু আজিম সাহেব খুব অবাক হয়ে খেয়াল করলেন কোনো কৌশলেই ছেলেটাকে হতাশ করার মতো কিছুই বলতে পারছেন না উনি। অবশেষে মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানালেন। নিজেই ওদেরকে সাথে নিয়ে অফিসের স্টোর রুমের দিকে রওনা হলেন। স্টোর রুমের পুরাতন কাগজের ভীরে চৌদ্দবছর আগের রেকর্ডগুলো পেয়েও যেতে পারে, আজিম সাহেবের কাছে কোনো কিছুই আশ্চর্যের নয়। বৃষ্টি কমে এসেছে এখন। পিঠে ঝুড়ি ঝুলিয়ে আবারও চায়ের পাতা তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে কয়েকদল তরুনী আর মধ্যবয়স্কা মহিলা। রোজা অবাক হয়ে চারদিকে তাকায়। জিগ্যেসু কন্ঠে বলে,
— চা-পাতা সংগ্রহকারীরা অধিকাংশ সময় মহিলা হয় কেন, আজিম সাহেব?
আজিম সাহেব হাসেন৷ চোখের চশমাটা ডানহাত দিয়ে ঠিক জায়গায় ঠেলে দিয়ে বলেন,
— চা পাতা সংগ্রহ করা যতটা সহজ মনে হয় ততটা সহজ নয়। সবই হাতের কসরত। চা গাছের সব পাতায় কিন্তু চা হয় না। চা-গাছের দুটি পাতা ও একটি কুঁড়িই হলো চায়ের মূল উৎস। দুটি পাতা থেকে আসে লিকার এবং কুঁড়ি থেকে আসে ফ্লেভার। আর এসব হাতের কসরতে মেয়েরাই সাধারণত বেশি এক্সপার্ট হয় । তাই পাতা সংগ্রহকারী হিসেবে মেয়েদেরকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়।
রোজা মাথা দুলায়। চা-বাগানের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া পাকা রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে আবারও বলে উঠেন আজিম সাহেব,
— প্রায় নয়বছর যাবৎ চাকরি করছি এখানে। কেমন একটা মায়া পড়ে গেছে জায়গাটার উপর। বুঝলে মা, চা বাগান মানেই হলো দিগন্তপ্রসারী সবুজের মাঝে ছায়াবৃক্ষের মিলনমেলা। এখন ঘুম ভেঙে এই বাহারী চা বাগান চোখে না পড়লে বুকটাই যেন ভার হয়ে আসে। প্রতিমুহূর্তে নিজেকে ভাগ্যবান মনে হয়।
সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত হ্যারি কে টমাস প্লেন থেকে নেমে বাগানের রাস্তা দিয়ে যাওয়ার পথে বলেছিলেন, “পৃথিবী এতো সুন্দর যে মালনীছড়া বাগান না দেখলে তা বোঝা যাবে না। ” আর আমি সেই সৌন্দর্যেরই এক সাক্ষী হয়ে আছি ভাবতেই গর্বে বুক ফুলে ওঠে।
কথা বলতে বলতে স্টোর রুমের সামনে এসে দাঁড়ান উনি। মৃন্ময়ের হাতে চাবি দিয়ে বলেন,
— নিয়মের বাইরে গিয়েই পারমিশন দিচ্ছি তবে দু’ঘন্টার বেশি দিতে পারছি না।
মৃন্ময় হাসে। অসম্ভব সুন্দর সে হাসিতে মুগ্ধ হন আজিম সাহেব। মৃন্ময় কৃতজ্ঞমাখা চাহনী দিয়ে বলে,
— এটুকুর জন্যই অসংখ্য ধন্যবাদ, স্যার।
আজিম সাহেব কিছু বলেন না। দরজার সামনে একটা ছেলেকে দাঁড় করিয়ে মাথা দুলিয়ে সেখান থেকে সরে যান। মৃন্ময়, তীর্থ, রোজা —- তিনজনই ধীর পায়ে ঘরে ঢুকে। ঘরটির চারদিকে চাপা অন্ধকার সেইসাথে ধুলাবালির স্তর ও পুরনো কাগজের গন্ধ। রোজা ভেবেছিলো এতো ধুলো দেখে মেয়েদের মতো ন্যাকামি করে বেরিয়ে যাবে মৃন্ময়। হাজার হলেও “হিরো” বলে কথা! কিন্তু রোজাকে অবাক করে দিয়ে মুহূর্তেই কাজে নেমে যায় মৃন্ময়। ধুলো ঝেঁড়ে লাল মলাটে ঢাকা বড় বড় রেকর্ড বুকগুলো মোবাইলের ফ্ল্যাশের আলোয় ঘাটতে লাগে। যেখানে তীর্থ-রোজাও কপোকাত সেখানে মৃন্ময় শান্ত, স্বাভাবিক। রোজা কাজের ফাঁকে ফাঁকে মৃন্ময়ের দিকে তাকায় আর বিস্মিত হয়। আবারও কাজে মন দেয়। তীর্থও বেশ মনোযোগ দিয়ে রেকর্ডবুক ঘাটছে। এতোগুলো রেকর্ডবুকের মাঝে সেই ছোট্ট নামটা কোথায় আছে কে জানে? প্রায় একঘন্টা খুঁজাখুঁজির পর ভ্রু কুঁচকে বলে উঠে তীর্থ,
— এই রেকর্ড বুকগুলোতে ২০০১ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত সব রেকর্ডই আছে তাহলে মাঝের ২০০৬ সালের রেকর্ডটি নেই কেন? এটা কি সম্পূর্ণই কাকতালীয়? নাকি কারো পরিকল্পনা?
মৃন্ময় কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায়। দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে আসে তার। জানালার পাশ থেকে এইমাত্র একটি ছায়া সরে যেতে দেখেছে সে। যদিও জানালাটা মৃন্ময়ের পিঠ বরাবর তবুও মেঝের উপরের আলো ছায়ার সূক্ষ্ম হেলদুলে বিষয়টা বুঝতে এক সেকেন্ডও সময় লাগে নি তার। তবে কি কেউ তাদের উপর নজর রাখছে? কিন্তু কে সে?
# চলবে….