এক মুঠো রোদ ..
# writer :নৌশিন আহমেদ রোদেলা
# পর্ব -৩২
৫৯.
চট্টগ্রামের ট্রেনে বসে আছে রোজা-মৃন্ময় আর তীর্থ। ট্রেনে চট্টগ্রাম পৌঁছে সেখান থেকে গাড়ি করে বান্দরবান পৌঁছানোর প্ল্যান তাদের। তীর্থের হাতে পানির বোতল। কিছুক্ষণ পর পর ঢকঢক করে পানি গিলছে সে। রোজা জানালার পাশে বসে ট্রেনের সাথে সাথে ছুটে চলা গাছপালা দেখতে ব্যস্ত। মৃন্ময় কানে হেডফোন লাগিয়ে চোখ বুজে গান শুনছে। তীর্থের কাঁচুমাচু ভাবে চোখ মেলে তাকালো মৃন্ময়। ভ্রু কুঁচকে তীর্থকে দেখে নিয়ে বললো,
—” কোনো সমস্যা তীর্থ? তোমাকে এমন রেস্টলেস লাগছে কেন?”
তীর্থ উত্তর না দিয়ে এক নিঃশ্বাসে বোতলের বাকি পানিটুকু শেষ করলো। রোজা মুচকি হেসে চুলগুলো হাত খোঁপা করতে করতে বললো,
—” ওর কোনো সমস্যা নেই নায়কসাহেব। সমস্যাটা হলো ওর গার্লফ্রেন্ডের।”
মৃন্ময়ের কুঁচকানো ভ্রু আরো খানিকটা কুঁচকে গেলো,
—“মানে?”
রোজা দাঁত বের করে হাসলো। ঠোঁট টিপে হাসি থামিয়ে বললো,
— “মালিহার কাল রাত থেকে জ্বর তাই এমন অস্থির অস্থির লাগছে ওকে। যতক্ষণ না পর্যন্ত মালিহা নিজে ফোন দিয়ে বলবে তার জ্বর কমেছে ততক্ষণ পর্যন্ত ওর মুখের অবস্থা এমনই থাকবে। এটা প্রায় ২ বছর ধরে দেখে আসছি। খুবই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার।”
মৃন্ময় বেশ অবাকই হলো। তীর্থের মতো একটা ছেলে গার্লফ্রেন্ডের সামান্য জ্বর হয়েছে বলে এমন রেস্টলেস হয়ে পড়েছে ভাবতেই বিস্মিত হচ্ছে সে। রোজা সিটে পা তুলে আরাম করে বসলো। ট্রেনের সিটে গা এলিয়ে দিয়ে বললো,
—“লাস্ট মুহূর্তে প্ল্যান চেঞ্জ করলেন কেন? কাল নীলকন্ঠীতে থাকাকালীন তো বলেছিলেন আমরা গাড়ি করে যাবো তাহলে হঠাৎ ট্রেনে কেন?”
মৃন্ময় হাসলো। জবাব না দিয়ে ফোনের স্ক্রিনে চোখ রাখলো। রোজা আবারও প্রশ্ন করলো,
—” আচ্ছা? বান্দরবান গিয়ে শাইয়াম চাং কে খুঁজে পেয়ে গেলে কি করবো আমরা?”
মৃন্ময় মুখ তুলে তাকালো। স্বাভাবিক গলায় বললো,
—“কিছুই করবো না। তাকে বাবার কথা জিগ্যেস করবো। সে কোনো ক্লু দিতে পারলে সেই অনুযায়ী নেক্সট টার্গেট ফিক্সড করবো। আমাদের উদ্দেশ্যটা শুধু বাবার হঠাৎ গায়েব হওয়ার কারণটা জানা আর কিছু না।”
—“ওহ্”
আবারও নীরবতা ঘিরে ধরলো তাদের। ট্রেনের ঝকঝক শব্দের সাথে পাল্লা দিয়ে বাতাসের শাঁ শাঁ শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দই কানে আসছে না তাদের। মৃন্ময়ের অবচেতন মন রোজার সাথে কথা বলতে চাইছে,কাছাকাছি আসতে চাইছে। কিন্তু সেই ইচ্ছেটাকে বিন্দুমাত্র পাত্তা দিচ্ছে না মৃন্ময়। রোজাকে পছন্দ করলেও তার কাছাকাছি যেতে নারাজ সে। তার মতে, পছন্দ করলেই যে পেতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই। তাছাড়া মৃন্ময় আর রোজার লাইফস্টাইল ভিন্ন। দু’জন আলাদা দুটো জগতে বসবাস করে এসেছে সেই ছোট থেকে। মৃন্ময় যেমন হঠাৎ করে সেই জগৎ থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে না ঠিক তেমনি উড়ন্ত রোজাও মৃন্ময়ের বন্ধী জগতে খাপ খাওয়াতে পারবে না। এসব কারণেই রোজাকে নিজের সাথে জড়াতে চায় না মৃন্ময়। মৃন্ময়ের ভাবনার মাঝেই প্রশ্ন করলো রোজা,
—“আচ্ছা? এই থুইসাপাড়াটা কোথায়? বান্দরবানের পাশেই? “
মৃন্ময় জবাব দেওয়ার আগেই বলে উঠলো তীর্থ,
—” আরে না। বান্দরবান থেকে থানচি যেতে হবে। থানচি থেকে সাঙ্গু নদী পাড় হয়ে ১৭ কি.মি হাঁটার পর থুইসাপাড়া। ধরতে গেলে অনেক দূর। “
রোজার চোখদুটো যেন চিকচিক করে উঠলো। কৌতূহলী গলায় বললো,
—“ওয়াও!এডভেঞ্চার টাইপ। আচ্ছা?থুইসাপাড়াটা কি পাহাড়ের ওপর? আমাদের কি পাহাড়ে উঠতে হবে? আই মিন ট্রেকিং করতে হবে?”
মৃন্ময় মৃদু হেসে বললো,
—” অনেকটা তেমনই মিস.রোজা। থুইসাপাড়া যেতে তিনটা পাহাড়ের গা বেয়ে উঠে আবারও নামতে হবে। তারমধ্যে দুটো পাহাড় বেশ বড়।”
রোজা ভ্রু কুঁচকে বললো,
—“আপনি এতোকিছু কি করে জানেন? শুটিং আর গান ছাড়া তো দুনিয়ার কিছুই চিনেন না আপনি!”
মৃন্ময় হেসে ফেললো।
—” কে বললো? আমারও বাবার মতো হুটহাট হারিয়ে যাওয়ার রোগ আছে। তবে, বাবার মতো একবারে হারিয়ে যেতে পারি নি কখনো।”
মৃন্ময়ের শেষ কথাটায় যেন হাজারও কষ্টের ছোঁয়া পেলো রোজা। অনুভূতিমাখা দৃষ্টিতে মৃন্ময়ের দিকে তাকালো সে। ততক্ষণে চোখদুটো আবারও বন্ধ করে নিয়েছে মৃন্ময়। মৃন্ময়ের বন্ধ চোখদুটো যেন স্বস্তি দিলো রোজাকে। সিটে ঠেস দিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মৃন্ময়কে দেখতে লাগলো সে। রোজার সেই চাহনী মৃন্ময়ের তীক্ষ্ণ মস্তিষ্কে আঘাত হানছে বারবার। সে বুঝতে পারছে রোজার দুর্বলতা কিন্তু মৃন্ময় তো তা চায় না। কখনোই না।
৬০.
— ” বান্দরবান যাওয়ার কারণটা কি আসিফ?”
রাফিনের অফিসরুমের জানালার পাশে জানালার দিকে ফিরে দাঁড়িয়ে আছে রাফিন। তার থেকে বেশ খানিকটা দূরত্ব রেখে কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে আসিফ। রাফিনের প্রশ্নে মাথা তুলে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলে উঠলো আসিফ,
—” মৃন্ময় স্যার কাউকে খুঁজতেছে ভাই।”
রাফিন ফিরে তাকালো। ভ্রু কুঁচকে বললো,
—“কাউকে খুঁজছে মানে? কাকে খুঁজছে? আর ও যাকেই খুঁজুক তাতে রোজার সম্পর্ক কি? রোজা আর ওর বন্ধু মৃন্ময়ের সাথে কেন?”
—“সেটা ঠিক জানি না ভাই। ওদের পেছনে লাগানো ডিরেক্টরের ওই পোলাডারে তুলে নিয়েছিলো পলাশ।কিন্তু সেই পোলাও কিছু জানে না। ওরে ডিরেক্টর টাকা দিয়ে ওদের পিছু নিতে বলেছিলো। টাকার লোভেই টিকটিকিগিরি করতাছিলো ওই পোলায়।”
—“পলাশটা কে?”
—” পলাশ আমাদের গ্যাং এর লোক। সিলেটেই থাকে। “
—“ওহ আচ্ছা। তারপর? আর কিছুই বলে নি ছেলেটি?”
—” তেমন কিছুই বলে নি ভাই। যেটুকু বলেছে তা হলো মৃন্ময়রা “শাইয়াম চাং” নামে কাউকে খুঁজছে। যার বাড়ি বান্দরবানে। ভাই? বান্দরবানে আমাদের লোক পাঠাইছি।ডিরেক্টরের কথামতো এক্সিডেন্ট কেইস সাজিয়ে ওদের সরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থাও হয়ে গেছে। আপনি যদি বলেন তো কাজটা করে ফেলি?”
রাফিন জবাব দিলো না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
—” উহুম। ওদের পিছু নে। এমনভাবে লেপ্টে থাক যেন ডিরেক্টর বিশ্বাস করতে বাধ্য হয় যে কাজটা করতে প্রস্তুত আমরা। ডিরেক্টরকে বিশ্বাস করানোর জন্য ছোট খাটো দুর্ঘটনা ঘটা…”
আসিফ অবাক চোখে তাকালো। বিস্ময় নিয়ে বললো,
—” ভাই? তাহলে কি কাজটা আমরা করবো না?”
—” করবো কিন্তু তার আগে মৃন্ময় কোন গুপ্তধনের অনুসন্ধান করছে তা জানতে চাইছি আমি। কি উদ্দেশ্য ওর? আর যে উদ্দেশ্যই থাকুক না কেন তাতে রোজারই বা কি স্বার্থ?”
আসিফ দ্বিধাভরা চেহারা নিয়ে রাফিনের কথাগুলো গিলে চলেছে। এই প্রথম কোনো কাজ করার আগে এতোকিছু ভাবছে রাফিন। আসিফ রাফিনের মতিগতি বুঝতে পারছে না ৷ কি করতে চাইছে সে? রাফিন আর যায় করুক কথা রাখায় পাক্কা। কিন্তু আজ? এটা কি বিয়ের সাইডএফেক্ট? নাকি রাদিবের মেয়ের প্রতি আকর্ষন?কথাগুলো ভাবতেই কপাল কুঁচকে এলো আসিফের। রাফিনের কোনো কথায় কানে ঢুকছে না তার। নিজেকে কেমন পাগল পাগল লাগছে। মাথায় ঘুরছে একটাই প্রশ্ন, কি চাইছে রাফিন? আসিফের ভাবনার মাঝেই দরজা থেকে বুয়ার ভয়মাখা গলা ভেসে এলো,
—“ভাইজান?”
রাফিন আসিফ ফিরে তাকালো। বুয়াকে দেখেই ভ্রু কুঁচকে বলে উঠলো রাফিন,
—“কি চাই?”
—“জে,বউমনি তো খাইতে চায় না। দুপুর থেকে কিছুই খায় নাই।”
রাফিনের ভ্রু আরো খানিকটা কুঁচকে এলো। কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললো,
—” বউমনিটা কে?”
রাফিনের কথায় কেশে উঠলো আসিফ। বিমর্ষ গলায় বললো,
—” ভাবির কথা বলতাছে ভাই।”
—“ভাবি?”
আসিফ এবার অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো। বললো,
—“ভাই? আমার ভাবি আর আপনার বউ আরু ভাবি। সকালেই তো বিয়ে করলেন এখনই ভুলে গেছেন?”
সারাদিনের ব্যস্ততায় বিয়ের কথাটা মাথা থেকেই বেরিয়ে গিয়েছিলো রাফিনের। আসিফের কথায় আরুর কথা মনে পড়লো তার। বিরক্তি নিয়ে বুয়ার দিকে তাকালো,
—” খাচ্ছে না কেন? ওর অপছন্দের খাবার রান্না করলে খাবে কি করে ও? আগে জিগ্যেস করুন কি খেতে চায় তারপর রান্না করুন।”
বুয়া অসহায় গলায় বললো,
—” জিগাইছি কিন্তু কয় না। বলে খাবো না।”
রাফিন কপাল কুঁচকে তাকালো। আসিফের দিকে তাকিয়ে অধৈর্য গলায় বললো,
—” খায় না কেন? মেয়ের সমস্যাটা কোথায়?”
আসিফ মুখ কাঁচুমাচু করে বললো,
—” আমি কেমনে কমু ভাই? আপনার বউ আপনার জানার কথা।”
রাফিন এবার চেয়ার গা এলিয়ে বসলো। চোখ বন্ধ করে বললো,
—“যা। তোরে দশমিনিট টাইম দিলাম ওকে খাইয়ে রেখে আয়।”
আসিফ দ্বিধাভরা গলায় বললো,
—“আমি কিভাবে খাওয়াবো ভাই? কপালে বন্দুক ঠেকাইয়া খাওয়াবো?”
রাফিন চোখ রাঙিয়ে বললো,
—” অদ্ভুত! এই তোর ভাবি হয় না আরু? আমার বউয়ের মাথায় বন্দুক ঠেকাবি তুই? এক থাপ্পড়ে দাঁত ফেলে দিবো। বাচ্চাদের যেভাবে খাওয়াস তেমনি ভুলিয়ে ভালিয়ে খাইয়ে আয়।”
আসিফ বিমর্ষ দৃষ্টিতে তাকালো।মিনমিন করে বললো,
—” ভাবি কি বাচ্চা ভাই? কত্তবড় মেয়ে। আর আমার কথা শুনবো না তো। আপনি গিয়ে খাইয়ে দিলে নিশ্চয় খাবে ভাই।”
রাফিন সরু চোখে তাকিয়ে বললো,
—” পাগল তুই? এনিওয়ে, বুয়া? আপনিই গিয়ে খাইয়ে দিন আপনার বউমনিকে। বাচ্চা মেয়ে তো হয়তো তুলে খেতে পারে না। আর তবুও না খেলে…. (খানিক ভেবে) তবুও না খেলে আপনি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন। ক্ষুধা লাগলে ঠিকই খাবে।আমাকে ডিস্টার্ব করবেন না প্লিজ। যান ।”
বুয়া মাথা দুলিয়ে বেরিয়ে যেতেই চোখ বন্ধ করলো রাফিন। হাজারও দ্বিধা নিয়ে আগের জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছে আসিফ। চলে যাবে নাকি দাঁড়িয়ে থাকবে তা নিয়ে চরমরকম দ্বিধান্বিত সে….রাফিন কে কি ডেকে জিগ্যেস করবে?
# চলবে….