এক মুঠো রোদ .
# writer :নৌশিন আহমেদ রোদেলা
# পর্ব -৩৬
৬৬.
রৌদ্রতপ্ত সকাল। সবুজ পাহাড়ের মাথায় সূর্যের লেলিহান শিখার মাদকীয় রূপ। সেই জ্বালাময় সূর্যকে পেছনে ফেলে চারজন যুবক-যুবতী এগিয়ে চলেছে মোহনীয় এক গন্তব্যে। থানচি থেকে নৌকায় যেতে হবে পদ্দমুখ। তারপর সেখান থেকে পায়ে হেঁটে থুইসাপাড়া। রোজা নেভিব্লু রঙের লেডিস শার্টের সাথে থ্রী কোয়াটার প্যান্ট পড়েছে। পায়ে ট্রেকিং শো। পিঠে ছোটখাটো ব্যাগ ঝুলিয়ে চোখে পড়েছে কালো চশমা। লম্বা চুলগুলো পেঁচিয়ে শক্তপোক্ত খোঁপায় আটকানো। তীর্থ কালো টি-শার্টের উপর আকাশী রঙের চেকশার্ট আর থ্রি-কোয়াটার প্যান্ট পড়ে ক্যামেরা হাতে গাইডের সাথে কয়েক পা এগিয়ে। তাদের ঠিক পেছনেই পাশাপাশি হাঁটছে মৃন্ময়-রোজা। হোটেল ছেড়ে থানচি বাজার পেরিয়ে সাঙ্গু নদীর ঘাটের দিকেই চলেছে তারা। চারপাশে অস্বস্তিকর নীরবতা। এই নীরবতা কাটিয়ে মৃন্ময়ই কথা বলে উঠলো প্রথম,
—” মিস. রোজা? থানচির পর থেকে কিন্তু নেটওয়ার্ক পাবেন না। বলতে গেলে, থানচিতে ফেরার আগমুহূর্ত পর্যন্ত এই লোকালয়ের সাথে কোনোরকম যোগাযোগই করতে পারবো না আমরা। আপনার যদি বাসায় বা অন্য কারো সাথে কথা বলার থাকে তাহলে এখনই বলে নিতে পারেন। নয়তো পরে রিপেন্ট করতে হতে পারে।”
রোজা হেসে বললো,
—” কথা বলা হয়েছে।”
—“ওহ্ গুড।”
আবারও একরাশ নীরবতা চেপে ধরলো তাদের। রোজা খানিক চুপ থেকে ইতস্তত গলায় বলে উঠলো,
—” আপনি কাউকে কল দিবেন না?”
মৃন্ময় মৃদু হেসে শান্ত গলায় জবাব দিলো,
—” ফোন করার মতো আমার কেউ নেই,মিস.রোজা।”
মৃন্ময়ের শান্ত শীতল গলাটাতেও যেন দীর্ঘ এক অসহায়ত্বের ছোঁয়া পেলো রোজা। কয়েক সেকেন্ড একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে নজর ঘুরিয়ে চুপচাপ হাঁটতে লাগলো। আমাদের জীবনটা ভারি অদ্ভুত এক রঙ্গমঞ্চ। দূর থেকে যার জীবন, চাকচিক্য, সুখ দেখে আমরা আফসোসে পুড়ে মরি। দিনশেষে সে ও একা, অসহায়। হয়তো আমাদের থেকেও বেশি অসহায়! রোজা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মৃন্ময়ের প্রতি প্রচন্ড মায়া লাগছে তার। মনে হচ্ছে, ছেলেটা ভালো নেই। ওর কাউকে চায়। খুব আপন কাউকে চায়। আচ্ছা? একা একা কি ভালো থাকা যায়? রোজা কি পারে না মৃন্ময়কে একজন আপন কাউকে খুঁজে দিতে? নিশ্চয় পারে। সাঙ্গু নদী থেকে যে নৌকা ভাড়া করা হয়েছে তার ভাড়া ঠিক করা হলো পাঁচ হাজার টাকা। ভাড়া শুনেই হেঁচকি উঠে গেলো রোজার। যদিও ফেরার পথেও এই নৌকাতেই ফিরবে তারা তবুও মাথায় শুধু একটা প্রশ্নই ঘুরতে লাগলো —-” একটা নৌকায় এতো ভাড়া!” এ তো ডাকাতি! ঘোর ডাকাতি!
সীমাহীন সৌন্দর্যে মাখা সাঙ্গু নদী। যে নদীর নাম ভূগোলের বই আর মানচিত্র ঘেঁটে আত্মস্থ করেছে রোজা আজ সেই নদীতেই পাড়ি জমাচ্ছে ভাবতেই সারা শরীরে উষ্ণ-আর্দ্র শিহরণ জাগছে তার। নৌকার বেগ স্রোতের অনুকূলে হওয়ায় সাঙ্গু নদীর ভয়াবহতাটা ঠিক চোখে পড়ছে না তাদের। দু-ধারে উঁচু সবুজ পাহাড় আর তার বুক চিঁড়ে বহমান অসম্ভব সুন্দর নদী। নদীর একধারে উপজাতি মেয়েরা মাছ ধরছে। রঙিন বাহারি কাপড় আর পিঠে ঝুলানো বেতের তৈরি ঝুড়ি। রোজা বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে মনের ভুলেই মৃন্ময়ের ডান হাতটা চেপে ধরলো। উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বললো,
—-” ওয়াও! পাহাড়ী নদীতে পাহাড়ী কন্যা! সৃষ্টিকর্তা সূক্ষ্ম জিনিসেও এতোটা সৌন্দর্য ছড়িয়ে দিয়েছেন কেন?কেমন জানি পাগল করা সৌন্দর্য! “
মৃন্ময় হাসলো। মনের মধ্যে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে খুব সাবধানে ছাড়িয়ে নিলো তার হাত। ৩০ মিনিটের মাথাতেই পদ্মমুখ এসে পৌঁছালো তারা। নৌকা থেকে নেমেই ঘড়ি দেখলো মৃন্ময় —- ১০ঃ০৫।
৬৭.
বিছানায় চুপচাপ বসে আছে আরু। ঘোর বিষন্নতায় ছেয়ে ধরেছে তাকে। নিজেকে যুদ্ধে পরাজিত দুর্বল সৈনিকের মতোই বোধ হচ্ছে তার। যার বেঁচে থাকা এবং মরে যাওয়া দুটোই অর্থহীন। কিছুক্ষণ থম ধরে বসে থেকে বারান্দার দিকে এগিয়ে যায় সে। বারান্দাটা আগের মতো ফাঁকা নেই আর। বিভিন্ন গোলাপের গাছে ছেয়ে আছে পুরোটা বারান্দা। ব্ল্যাক প্রিন্স, মিরিন্ডা,পাপা মিলাঁ, রোজ গুজার্ড, বেংগলি, হাজারী গোলাপ আরো কতো জাতের ফুল। গোলাপেরই যে এতোগুলো জাত থাকতে পারে ভাবতেই পারে নি আরু। শূন্য দৃষ্টিতে ব্ল্যাক প্রিন্স গাছটির দিকে তাকালো আরু। গাছটায় আলতো হাত বুলিয়ে রেলিঙে হাত রেখে নিচের দিকে ঝুঁকে তাকালো সে। নিচের দিকে ঝুঁকে পড়ায় চুলগুলোও ঝুঁকে পড়লো মুখে। আরু মাথা নেড়ে চুলগুলো ঝাঁকিয়ে নিয়ে আরো একটু ঝুঁকে দাঁড়ালো। আচ্ছা? এখন থেকে পড়ে গেলে কি মরে যাবে আরু? পড়ার সময় চুলগুলো কি এভাবেই ঝুঁকে থাকবে? নাকি উড়ে যাবে বাতাসে? আরুর ভাবনার মাঝেই কেউ একজন হেঁচকা টান দিয়ে সোজা দাঁড় করালো তাকে। আরু চোখ পিটপিট করে তাকালো। রাফিন কপাল কুঁচকে রাগী গলায় বললো,
—” এই মেয়ে? পাগল নাকি তুমি? নিজের ভালো তো পাগলও বুঝে রে বাবা। যে পজিশনে দাঁড়িয়ে ছিলে আরেকটু হলেই তো নিচে গিয়ে পড়তে। ন্যূনতম কমন সেন্সটাও কি তোমার নেই? বাড়িতে ঢুকার সময় বারান্দার দিকে যদি না তাকাতাম তাহলে কি হতো জানো?”
আরু বেশ কিছুক্ষন চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে কপাল কুঁচকে বিরক্তি নিয়ে বললো,
— শশশশ…. আস্তে।
রাফিন থমকে গেলো। আরু খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে রাফিনকে পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকে বিছানায় বসলো। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে কাঁথা টেনে শুয়ে পড়লো। রাফিন শান্ত দৃষ্টিতে সবটা পর্যবেক্ষন করে পাশে রাখা ফুল টপটাই লাথি বসালো। রাগে শরীর রি রি করছে তার। আরুকে টেনে তুলে তার গালে চার-পাঁচটা চড় বসাতে পারলে বেশ শান্তি লাগতো রাফিনের। মেয়েটা পেয়েছেটা কি? এভাবে চুপ করে থাকার মানে কি? পাগল হয়ে যাচ্ছে নাকি দিন দিন? রাফিন বেশ কয়েকবার জোড়ে শ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করে চুপচাপ বেরিয়ে গেলো। দরজার বাইরে গিয়েও কি মনে করে দাঁড়িয়ে পড়লো সে। পেছনে ফিরে আবারও রুমে ঢুকলো রাফিন। জানালার ভারি থাইগুলো সরিয়ে দিয়ে পর্দাগুলো টেনে দিলো সে। রুমটা যে কেন এতো অন্ধকার করে রাখে মেয়েটা, কে জানে? জানালার সামনে থেকে সরে বিছানার দিকে এগিয়ে গেলো রাফিন। কাঁথাটা ভালো করে টেনে পা’দুটো ঢেকে দিয়ে মাথার উপর থেকে বালিশটা সরিয়ে পাশে রাখলো। দরজাটা হালকা চাপিয়ে দিয়ে আসিফকে ফোন লাগালো,
—” আসসালামু আলাইকুম ভাই। “
—” ওয়ালাইকুম আসসালাম। শোন, তোর ভাবির বারান্দার রেলিংটাকে আরেকটু উঁচু করার ব্যবস্থা কর।”
আসিফ অবাক হয়ে বললো,
—” মানে? জি.. আসলে… কেন ভাই?”
—” সবকিছুর উত্তর এখন তোকে দেওয়া লাগবে নাকি? যা বলছি তা কর।”
আসিফ ভীত গলায় বললো,
—” কতোটুকু উঁচু করবো ভাই?”
—” ততটুকুই করবি যতটুকুতে বারান্দা থেকে অসাবধানতাই নিচে পড়ার ঝুঁকি না থাকে। আর শোন? আরুর রুমের ঠিক নিচে গার্ডেন সাইডে কাউকে নজর রাখতে বলবি, বুঝলি?”
আসিফ তাড়াতাড়ি জবাব দিলো,
—” জ্বি আচ্ছা ভাই।”
# চলবে…
(ছোট হয়েছে জানি। সরি ফর দেট।নেক্সট পার্ট বড় হবে। ইনশাআল্লাহ!)