# এক মুঠো রোদ .
# writer :নৌশিন আহমেদ রোদেলা
# পর্ব ৩৮
____________
ড্রয়িং রুমের সোফায় মুখোমুখি বসে আছেন আনোয়ার হোসেন আর রাফিন। দু’জনের হাতেই চায়ের কাপ। আনোয়ার হোসেন চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে নিঃশব্দে কাপটি নামিয়ে রাখলেন টেবিলে। চোখের চশমাটা ঝকঝকে সাদা রুমালে মুছতে মুছতে বললেন,
—-” ডক্টর চৌধুরী? এজ আ ডক্টর, আপনি খুব ভালো করেই জানেন যে শরীরের সুস্থতায় মূখ্য নয়। তারসাথে জড়িয়ে আছে মানসিক সুস্থতা। কিন্তু আনফরচুনেটলি আমরা মনের দিকটাকে একদমই গুরুত্ব দেই না। দেখুন, সব মানুষের সহ্য ক্ষমতা এক নয়। সবার চিন্তার সীমাও এক নয়। কারো প্রেশার নেওয়ার ক্ষমতা বেশি তো কারোর খুবই কম। আমাদের আশেপাশে ঘটে যাওয়া স্বাভাবিক সত্যগুলো আপনি যতটা স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারবেন তা হয়তো আমি পারবো না। এটাই হলো মেন্টাল স্ট্রেন্থ। আপনার ওয়াইফ “পোষ্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার” এ ভুগছেন। এটা একটা মানসিক সমস্যা। সাধারণত, কেউ যদি আতঙ্কজনিত কোনো ঘটনার সম্মুখীন হয় অথবা, ফ্ল্যাশব্যাক, ডিপ্রেশন, কোনো বিষয় নিয়ে অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা করতে থাকে তাহলে ধীরে ধীরে পোষ্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত হয়। এক্ষেত্রে পেশেন্ট অতিমাত্রায় ডিপ্রেশড থাকে, মাঝে মাঝে হ্যালুসিনেশন হয়, ধীরে ধীরে মনমরা হয়ে পড়ে, নিজেকে দুর্বল ভাবতে থাকে। তাদের ধারনা হতে থাকে তারা মূল্যহীন এবং বাড়তে থাকে হীনম্মন্যতা আর রাগ। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দুশ্চিন্তার পাশাপাশি তারা প্রচন্ড ভয় পেতে থাকে। এন্ড..এই ধরনের পেশেন্টদের মাঝে সুইসাইড করার প্রবনতাটা বেশি দেখা যায়। বর্তমান বিশ্বে প্রতি মিনিটে লক্ষ মানুষ মারা যাচ্ছে শুধুমাত্র সুইসাইডের মাধ্যমে। এদের মধ্যে ৯৯% মানুষ ম্যান্টালি ডিপ্রেশড থাকে। তাদের আশেপাশের মানুষ তাদের ম্যান্টাল প্রবলেমটা ধরতে পারে না বা তাদের ম্যান্টালি সাপোর্ট দিতে এগিয়ে আসে না বলেই তারা এমন ভয়ঙ্কর একটা স্টেপ নেয়। ডক্টর. চৌধুরী? আপনার কাছে এখনও সময় আছে। সেইভ ইউর ওয়াইফ। আপনার স্ত্রী কোনো একটা কারনে আপনাকে ভয় পান। ভয়ানক ভয় পান। কিন্তু কেন?”
রাফিন জবাব দিলো না। আগের মতোই শান্ত ভঙ্গিতে বসে রইলো সে। আনোয়ার হোসেন হালকা হেসে চশমাটা নাকের উপর ঠেলে দিয়ে বললেন,
—” ওয়াইফকে ভালোবাসেন ডক্টর.চৌধুরী? “
রাফিন উত্তর না দিয়ে উল্টো প্রশ্ন ছুড়লো,
—” ভালোবাসাটা কি খুব জরুরি ডক্টর.হোসেন? স্বামী হিসেবে ওর প্রতি সব রকম দায়িত্বই পালন করছি আমি। এটা কি এনাফ নয়?”
আনোয়ান হোসেন এবার নড়েচড়ে বসলেন। ঠোঁটে মৃদু হাসি ঝুলিয়ে বললেন,
—” না, এনাফ নয়। কারণ স্বামী মানে শুধু রেসপন্সিবিলিটি হতে পারে না। “স্বামী” শব্দটা উচ্চারণ করতেই প্রতিটি মেয়ের মনে ভালোবাসাময় একজন পুরুষের চিত্র ফুঁটে ওঠে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, মিসেস.চৌধুরীর মনে আপনাকে নিয়ে কোনো ভালোবাসাময় চিত্র ফুটে উঠছে না। আপনার জায়গায় অন্য এক আপনি বসবাস করে চলেছে দিনের পর দিন।
রাফিন ভ্রু কুঁচকে বললো,
—” আরেকজন আমি?”
—” হ্যাঁ। আরেকজন আপনি। কিন্তু সেই আপনার সাথে বাস্তবিক আপনার তেমন কোনো মিল নেই। উনি বিভিন্ন কারণে নিজের মধ্যে একটি কাল্পনিক জগৎ তৈরি করে নিয়েছেন। আর সেই কাল্পনিক জগৎটা হয়তো সম্পূর্ণই আপনাকে ঘিরে। আমি যদি ভুল না হই তাহলে আপনার স্ত্রী ছোট থেকেই কল্পনাপ্রবন। উনি বাস্তবতাটাকে আপনার বা আমার মতো সহজে মেনে নিতে পারেন না। অতিরিক্ত ভালোবাসা পেয়ে অভ্যস্ত মানুষগুলো হঠাৎ বিচ্ছেদটা মেনে নিতে পারে না। আর তাদের এই ছোটখাটো দুর্বলতাগুলোই ধীরে ধীরে বিষন্নতা,হীনম্ম
ণ্যতা, ডিপ্রেশন,হ্যালুসিনেশন বা ডিলিউসন ইত্যাদির কারণ হয়ে উঠে।”
রাফিনের কুঁচাকানো ভ্রু আরো খানিকটা
কুঁচকে এলো। আনোয়ার হোসেন হালকা কেশে গলা পরিষ্কার করে বললেন,
—” আপনি কি অন্যকাউকে ভালোবাসেন ডক্টর.চৌধুরী? সামওয়ান এল্স?”
চায়ের কাপটা টেবিলে রেখে সামনের দিকে খানিকটা ঝুঁকে বসলো রাফিন। শীতল গলায় বললো,
—” আরু এই ট্রমা থেকে বেরুবে কিভাবে? কোনো মেডিসিন?”
রাফিন আনোয়ার হোসেনের প্রশ্নটাকে কৌশলে এড়িয়ে যাওয়ায় নিজের মনে হাসলেন ডক্টর। মৃদু হেসে বললেন,
—” এরজন্য মেডিসিন আছে বৈকি তবে…”
আনোয়ার হোসেনের কথার মাঝেই উঠে দাঁড়ালো রাফিন। আসিফকে ইশারায় দেখিয়ে স্পষ্ট গলায় বললো,
—“ওর নাম আসিফ। মেডিসিনের লিস্টটা ওকে দিয়ে দিবেন । আমার একটা জুরুরি মিটিং থাকায় আমায় উঠতে হচ্ছে।”
কথাটা শেষ করে সামনের দিকে পা বাড়াতেই পেছন থেকে বলে উঠলেন আনোয়ার হোসেন,
—” মেডিসিনটা তো অপশনাল ডক্টর রাফিন। আসল ঔষধ তো আপনি।”
রাফিন ঘুরে দাঁড়ালো। কপাল কুঁচকে বিরক্তি নিয়ে বললো,
—” মানে?”
—” মানেটা নিজেই বুঝে যাবেন ডক্টর. চৌধুরী। আমার কাজ ছিলো সমস্যাটা ধরে পরামর্শ দেওয়া, আমি দিলাম। এখন সমাধানটা খোঁজার দায়িত্ব নিতান্তই আপনার৷ এনিওয়ে, আমি ঔষধগুলো প্রেসক্রাইব করে দিচ্ছি। হোপ, শী উইল বি অল রাইট।”
_____________
তুমুল বর্ষন হচ্ছে। আরু মন খারাপ করে তাকিয়ে আছে ওই দূরে। বারান্দার রেলিংটা উঁচু করে দেওয়ায় বারান্দাটা পাখির খাঁচার মতো লাগছে। বন্দী এক খাঁচা। আরু রেলিঙের স্টিল গুলোতে হাত রেখে বৃষ্টি ধরার চেষ্টা করলো। ধরা যাচ্ছে না। আবারও মন খারাপ হয়ে গেলো আরুর। হঠাৎই পেছনে থেকে একটি কন্ঠ ভেসে এলো,
—” বউমনি?”
আরু ফিরে তাকাতেই মাথা নিচু করে বলে উঠলো বুয়া,
—” ঘুমাবেন না,বউমনি? আপনার তো ঔষধ খেয়ে ঘুমানোর কথা। ভাইজান আপনাকে ঘুমাতে বলেছেন।”
আরু ভ্রু কুঁচকালো। আরেকবার অন্ধকার আকাশের দিকে দৃষ্টি রাখলো। খানিকবাদে বুয়ার দিকে তাকিয়ে শক্ত গলায় বললো,
—” আপনি দাঁড়িয়ে আছেন কেন?চলে যাচ্ছেন না কেন?”
বুয়া ইতস্তত গলায় বললো,
—” আমি এখানেই থাকবো বউমনি। আপনার রুমে…”
আরু বিরক্তি নিয়ে বললো,
—” কেন? এখানে ঘুমাবেন কেন? আগে যেখানে ঘুমোতেন সেখানেই ঘুমাবেন… যান।”
বুয়া মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। আরু রাগান্বিত স্বরে বললো,
—“আশ্চর্য! আপনি যাচ্ছেন না কেন? যান… যান বলছি।”
শেষ কথাটা বেশ জোরেই বললো আরু। আরুর হঠাৎ রেগে যাওয়ায় হতবুদ্ধির মতো দাঁড়িয়ে রইলো বুয়া। আরুর সুইসাইডাল টেনডেন্সির জন্য বুয়াকে আরুর সাথেই থাকতে বলেছিলো রাফিন। বুয়াকে চমকে দিয়ে বুয়ার হাত টেনে দরজার বাইরে দাঁড় করিয়ে রাগী গলায় বলে উঠলো আরু,
—” চলে যান। যান বলছি।”
রাফিন তখন উপরে উঠছিলো। আরুর কন্ঠ শুনে রুমে না ঢুকে আরুর দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। সারাদিনের বিভিন্ন ঝামেলায় এমনি মেজাজ খারাপ ছিলো রাফিনের। আরুর এমন বিহেভ দেখে মেজাজটা আরো চড়া হয়ে উঠলো তার। আরুর গালে বেশ কয়েকটা থাপ্পড় লাগানোর জন্য হাতটা নিশপিশ করতে লাগলো। নির্দয় রাফিনের যেখানে বাচ্চা পুড়াতে মায়া লাগে না সেখানে আরুর প্রতি মায়া জাগাটা নিহাতই হাস্যকর। “চৌধুরী বাড়ির বউয়েরা মর্যদাসম্পন্ন হয়। চৌধুরীরা নিজের অর্ধাঙ্গিনীকে ন্যায্য সম্মান দিতেই অভ্যস্ত।”— বাপের এই একটা কথার জন্যই নিজের রাগটাকে গিলে ফেলার চেষ্টা করে রাফিন। নিজেকে শান্ত রেখে আরেকটু এগিয়ে গিয়ে বুয়ার দিকে তাকালো। শীতল কন্ঠে বললো,
—” কি সমস্যা,বুয়া?”
বুয়া ঢুক গিলে নিয়ে বললো,
—” বউমনি আমাকে চলে যেতে বলছে ভাইজান।”
রাফিন ভ্রু কুঁচকে আরুর দিকে তাকিয়ে বললো,
—” আপনি যান বুয়া।”
বুয়া মাথা হেলিয়ে সরে যেতেই চেঁচিয়ে উঠলো রাফিন,
—” আসিফ? আসিফ?”
আসিফ নিচেই ছিলো। রাফিনের রাগমাখা কন্ঠ শুনে ছুঁটে এসে বললো,
—” জি ভাই?”
আরু হঠাৎ চিৎকারের শব্দ ভয় পাওয়া চোখে রাফিনের দিকে তাকালো। রাফিন আরুর চোখের দিকে তাকিয়েই বললো,
—” তোর ভাবির জিনিসপত্র আমার রুমে শিফট করার ব্যবস্থা কর। ও আজ থেকে আমার রুমেই থাকবে।”
কথাটা শেষ করে আরুর হাত টেনে নিজের রুমে নিয়ে বিছানায় বসিয়ে দিলো। দেয়ালের দিকে ফিরে নিজেকে শান্ত করলো। “মেয়েটা অসুস্থ!” কথাটা বার কয়েক বিরবির করে আরুর সামনে চেয়ার টেনে বসলো। আরুর মাথায় ডানহাতটা রেখে শান্ত চোখে তাকালো। আরু চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। রাফিন নরম গলায় বললো,
—” তোমার বাবার কাছে যাবে?”
আরুর মুখে সেকেন্ডের জন্য হাসি ফুটলেও মুহূর্তেই মিলিয়ে গেলো সেই হাসি। ভাইয়া বলেছে ও গেলে বাবার ভালো হবে না। একটুও ভালো হবে না। আরু টলমলে চোখে তাকিয়ে মাথা নাড়ে। যার অর্থ — সে যাবে না। রাফিন কপাল কুঁচকে তাকায়। এই মেয়ে কি তবে নিজের বাবাকেও ভুলে গেলো? অদ্ভুত! রাফিন উঠে দাঁড়ালো। স্বাভাবিক কন্ঠে বলে উঠলো,
—” শুয়ে পড়ো। যাও..”
আরু কিছুক্ষন থম ধরে বসে থেকে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে পড়লো। রাফিনের সাথে ঘুমাতে চাই না আরু, এই ছোট্ট কথাটাই মুখ ফুটে বলতে পারলো না আরু। রাফিনকে প্রচন্ডরকম ভয় পায় সে। তার দৃঢ়বিশ্বাস, রাফিনের কথা না শুনলে সবাইকে মেরে দিবে সে। তার বাবা,ভাই এবং তার প্রিয় মানুষটিকেও। রাফিন ছোট্ট করে শ্বাস টেনে ওয়াশরুমে যায়। ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এসেই বিছানায় তাকায় । আলোথালো হয়ে শুয়ে আছে আরু। গায়ের প্লাজুটা সরে গিয়ে বেরিয়ে আছে সাদা পা। রাফিন তোয়ালেটা পাশে রেখে কাঁথা টেনে দেয় আরুর গায়ে। বিছানায় বসে দৃষ্টি রাখে আরুর মুখে। এই মেয়েকে নিয়ে কি করবে এবার রাফিন? কেমন অদ্ভুত একটা ঝামেলায় জড়িয়ে গেছে সে। এই ঝামেলা থেকে কি করে বেরুবে রাফিন? আরু সুস্থ থাকলে আর কিছুদিন পর ডিবোর্স দিয়ে নিজের পরিবারের কাছেই রেখে আসতো সে। কিন্তু অসুস্থ আরুকে ডিবোর্স দেওয়াটা রাফিনের পুরুষত্বে বাঁধছে। তারমানে কি এই নয় যে, আরু অসুস্থ বলেই আরুকে ছেড়ে দিচ্ছে রাফিন?
৬৯.
শাইয়াম চাং এর ঘরে বসে আছে মৃন্ময়,রোজা আর তীর্থ। থুইসাপাড়াতে মাত্র পনেরটা পরিবার বসবাস করে বিধায় শাইয়াম চাং-কে খুঁজে পেতে বেশ একটা বেগ পেতে হয় নি তাদের। শাইয়াম চাং-এর ঘরের মেঝেটা বাঁশের তৈরি। বাঁশ দিয়ে মাথা সমান উঁচু করে তার উপর তৈরি হয়েছে ঘর। মৃন্ময়-রোজা বসে আছে বেতের তৈরি মোড়ায় আর তীর্থ বসেছে পাশে থাকা কাঠের চৌকিতে। শাইয়াম চাং আধবোজা চোখে তাকিয়ে আছে। ভীষণ অসুস্থ শরীর তার। লোকটির হাড্ডিসার শরীর দেখেই বুঝা যাচ্ছে দীর্ঘদিন ধরেই বিছানা নিয়েছেন তিনি। ইতোপূর্বেও একবার নিজেদের পরিচয় দিয়েছে মৃন্ময়। কিন্তু লোকটি তাকে চিনতে পেরেছি বলে মনে হচ্ছে না। মৃন্ময় হাঁটুতে ভর করে সামনের দিকে কিছুটা ঝুঁকে এসে বললো,
—” আমি আরিয়ান মৃন্ময়। আরিয়া আহমেদ ফয়সালের ছেলে।”
শাইয়াম চাং-কে শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে আবারও বললো মৃন্ময়,
—” কণ্ঠশিল্পী আরিয়া আহমেদকে চিনেন না? গান গাইতেন উনি। চিনতে পারছেন?”
“আরিয়া আহমেদ” নামটা শুনে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালো লোকটি। তারপর মৃন্ময়কে অবাক করে দিয়ে হুট করেই হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন। রোজা-তীর্থ দু’জনেই হতবাক। রোজা বিস্মিত কন্ঠে বলে উঠলো,
—” উনি কি মেন্টালি স্টেবল? আমার তো মনে হচ্ছে না। একজন সুস্থ মানুষ হঠাৎ করে এভাবে কান্নাজুড়ে দেবে না।”
তীর্থ বিরবির করে বললো,
—“নির্ঘাত স্ক্রু দুইডা ঢিলা।”
মৃন্ময় জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে নরম গলায় বললো,
—” কাঁদছেন কেন আপনি? কোথাও কষ্ট হচ্ছে আপনার? কি সমস্যা হচ্ছে বলুন…”
লোকটির কান্নার বেগ কমলো না। কান্না জড়ানো কন্ঠেই আটকে আটকে একটা নামই বলতে লাগলেন বার বার,
—“সানচি। সা..ন..চি।”
মৃন্ময়ের ভ্রু দুটো হালকা কুঁচকে এলো। তীর্থ বিরক্তি নিয়ে বলে উঠলো,
—” এটা আবার কোন পদার্থ? “
রোজা খুড়িয়ে খুড়িয়ে বৃদ্ধের খাটের পাশে বসলো। শুকনো হাড্ডিসার কালো হাতটিতে ডানহাতটা রেখে অত্যন্ত নরম গলায় বলে উঠলো,
—” সানচি কে?কি হয়েছে তার? কাঁদছেন কেন আপনি? বলুন…”
লোকটি রোজার দিকে তাকালো। কান্না থামিয়ে রোজার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
—” আমার মেয়ে। তোমার মতো যুবতী মেয়ে। সানচি!”
তীর্থ রোজার দিকে ঝুঁকে ফিসফিস করে বললো,
—” দোস্ত? আরিয়া সাহেবের কি এই আদিবাসী মেয়ের সাথে চক্কর ছিলো নাকি? মেয়ে নিয়ে পালিয়ে গেছে টাইপ কেইস?”
রোজা দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
—” শাট আপ।”
মৃন্ময় অনুসন্ধানী গলায় বললো,
—” এখন কোথায় আপনার মেয়ে? আর আমার বাবা মানে গায়ক আরিয়াকে কি চিনেন আপনি? চৌদ্দ বছর আগে আপনার সাথে দেখা করেছিলেন উনি, মনে আছে আপনার?”
বৃদ্ধ মাথা নাড়লো। চোখটা বন্ধ করে কিছুক্ষণ চুপ থেকে চোখ মেলে তাকালো সে,
—” হুম মনে আছে। সিলেটে আমার সাথে দেখা করেন উনি।”
—” কেন? কেন দেখা করেছিলেন উনি? আপনার সাথে কি সম্পর্ক ছিলো বাবার?”
শাইয়াম দুর্বল গলায় বললেন,
—” বলছি। ধীরে ধীরে সবটা বলছি।”
________________
২০০৬, জুলাই ৯
মালনীছড়া চা বাগানের ফটকে দাঁড়িয়ে আছে আরিয়া আহমেদ ফয়সাল। পরনে এ্যাশ রঙের স্যুট। কপালে সূক্ষ্ম চিন্তার ভাজ। চিন্তিত ভঙ্গিতেই বার দুয়েক ঘড়ি দেখলো সে — ২ঃ৩০। খানিকবাদেই হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে এলো রোদে পুড়া তামাটে বর্ণের এক লোক। কাছাকাছি আসতেই বিনয়ে হাতজুড় করে বললো,
—” সালাম স্যার। অপেক্ষা করানোর জন্য মাফ করবেন।”
আরিয়া চিন্তিত গলায় বললো,
—” ওসব ছাড়ো। তোমার মেয়েকে কি ফিরিয়ে দিয়েছে ওরা, শাইয়াম?”
শাইয়াম টলমলে চোখ মাথা ঝাঁকিয়ে বললো,
—” না স্যার। দেয় নি।”
—” দেয় নি? কিন্তু কেন? ডাকাতদের যথেষ্ট পরিমাণে টাকা দেওয়া হয়েছে তবু এমনটা করার কারণ কি?”
শাইয়াম মাথা নিচু করে বললো,
—” ওরা আপনার সাথে দেখা করতে চায়। কলেজের কাজ চলবে কি চলবে না তা নিয়ে আলোচনা করতে চায়।”
আরিয়া ভ্রু কুঁচকে বললো,
—” আলোচনা?কিসের আলোচনা শাইয়াম? জায়গা আমার…কলেজ তৈরির প্রতিটি ইটের কণাও আমার আর রেজার টাকায় কেনা তবে ওদের সাথে আলোচনা কেন? আর ডাকাতদের মতো অশিক্ষিত বর্বরদের কলেজ তৈরি হওয়া বা না হওয়া নিয়ে কি সমস্যা হতে পারে?”
—-” আমি জানি না স্যার। তবে আপনি না গেলে
ওরা আমার মেয়েটাকে মেরে ফেলবে স্যার। মেরে ফেলবে।”
কথাটুকু শেষ করেই আরিয়ার হাত ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লো শাইয়াম। একজন বাবার হাহাকার মাখা কান্না!
এইটুকু বলে থামলো শাইয়াম। মৃন্ময় ঠান্ডা গলায় প্রশ্ন করলো,
—” তারমানে বাবা একটা কলেজ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলো? কিন্তু কোথায়? এই বান্দরবানে? আর বাবার কাজের সাথে আপনার মেয়েরই বা কি সম্পর্ক?”
—” ১৪ বছর আগে বান্দরবানের যাতায়াত ব্যবস্থা আরো খারাপ ছিলো। তখন একটা দুটো হাইস্কুল থাকলেও কলেজ ছিলো না বললেই চলে। আপনার বাবা আর তার বন্ধু রেজাউল চৌধুরীর খুবই প্রিয় একটা জায়গা ছিলো এই বান্দরবান জেলা। প্রায়ই আসতেন… ঘুরতেন আর আমি থাকতাম তাদের গাইড। মাঝে মাঝে আমার বাড়িতেও আসতেন উনারা। সানচির বয়েস তখন পনেরো। আমার মেয়ের পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ ছিলো প্রচুর। একটা কিছু একবার শুনেই মুখস্থ করে ফেলতে পারতো সে। সানচির মেধাশক্তি দেখে বেশ অবাক হয়েছিলেন দুই বন্ধু। তারপর হঠাৎ করেই সিদ্ধান্ত নেন কলেজ বানানোর। আদিবাসী ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লাগেন। কিন্তু তাতে বাঁধ সাধে ডাকাত সর্দার।”
মৃন্ময় অবাক হয়ে বললো,
—” এতে ডাকাতদের কি সমস্যা?”
—” ডাকাতদের কোনো সমস্যা ছিলো না। সমস্যা ছিলো অন্যকারো। ডাকাতদের বুঝানো হয়েছিলো, এখানে কলেজ হলে সহজ সরল আদিবাসীরা সচেতন হয়ে যাবে। সেই সময় ডাকাতরা দিনে দুপুরে লুটপাট করতো। মানুষ খুন করতো। আদিবাসীরা সচেতন হয়ে গেলে তাদের কাজে ব্যাঘাত ঘটার তুমুল আশঙ্কা ছিলো। এছাড়াও তৃতীয় শক্তি তো আছেই যারা বিরাট অঙ্কের টাকা দিয়ে আপনার বাবাকে মারার পরিকল্পনা করছিলো। কলেজের নাম করে ওদের পর্যন্ত নিয়ে যাওয়াটা ওদের পরিকল্পনারই অংশ। আর আমিও ছিলাম সেই পরিকল্পনারই অংশ।”
—” মানে?”
মৃন্ময়ের প্রশ্ন।
শাইয়াম চাং কিছুক্ষণ নীরব থেকে আবারও বলতে লাগলো,
—” সেদিন সেই পরিকল্পনা সম্পর্কে আগে থেকেই জানতাম আমি। আরিয়া স্যার আর সার্জন রেজাউল চৌধুরীর জন্য যে মৃত্যু অপেক্ষা করছে সেটাও আমি জানতাম। কিন্তু আমার হাত বাঁধা ছিলো। নিজের মেয়েকে বাঁচানোর জন্য উনাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে হয়েছে আমায়। আর সেই অনুতাপ আজও কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে আমায়।”
রোজা শক্ত গলায় বললো,
—” নিজের মেয়ের জন্য দুটো মহৎপ্রাণ মানুষের সাথে এভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারলেন আপনি? উনারা নিজের কথা না ভেবে আপনাদের কথা ভেবেছিলেন৷ সত্যিই, কারো ভালো করার প্রতিদান এই হয়। তা কোথায় আপনার মেয়ে?”
লোকটি ডুকরে উঠলো,
—” নেই। কেউ নেই।”
তীর্থ বললো,
—” নেই মানে?”
—” আরিয়া আর রেজাউল স্যারকে ওদের হাতে তোলে দেওয়ার পর ওরা বলেছিলো পরের দিনই মেয়েকে পৌঁছে দিবে। কিন্তু দেয় নি। আমার মেয়েটা…আমার মেয়েটার ক্ষতবিক্ষত উলঙ্গ মৃতদেহটা ওরা সাঙ্গু নদীতে ফেলে দেয়। খুব কষ্ট দিয়ে মেরেছে ওরা আমার মেয়েকে। ওর শরীরে কত ক্ষতচিন্হ! আমার ছোট্ট মেয়েটাকে তিলে তিলে মেরে ফেলেছে ওরা। ওরা মানুষ নয়….জানোয়ার! জানোয়ার!”
বলতে বলতেই উম্মাদের মতো হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন বৃদ্ধ। তার বুক ফাঁটা হাহাকার রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে হারিয়ে যাচ্ছে অনেক দূরে। মৃন্ময়ের চোখ দুটো টলমল করছে। এই প্রথম চেঁচিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে তার। না জানি মৃত্যুর সময় কতটা অসহায় ছিলো তার বাবা। আজ তার ছেলে বড় হয়েছে। বাবাকে রক্ষা করার শক্তি হয়েছে অথচ বাবাকেই পাওয়া হলো না তার। আল্লাহর প্রতি অনেক অভিযোগ মৃন্ময়ের। অনেক! বাবাকে বাঁচানোর একটা সুযোগ কি তার পাওনা ছিলো না? ছেলে হিসেবে ব্যর্থ মৃন্ময়। ব্যর্থ! এই গহীন জঙ্গলের কোনো এক কোণে তিলে তিলে মরতে হয়েছে বাবাকে৷ আচ্ছা? বাবার ভাগ্যে কবরটা কি জুটেছিলো? নাকি বন্য পশু-পাখিই কামরে-ছিঁড়ে খেয়েছে তাকে? মৃন্ময়ের বুক ভারি হয়ে আসছে। শাইয়াম চাং এর মতো তারও বাবার জন্য চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু কান্নারাও বড্ড বেইমান। বাবা-মার মতো কান্নাগুলোও তাকে ছেড়ে গেছে ওই ছোট্ট বেলায়।
# চলবে…
(রি-চেইক দেওয়া হয় নি। দয়া করে ভুল-ভ্রান্তিগুলোকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। ধন্যবাদ)