এক মুঠো রোদ ..
# লেখিকাঃ নৌশিন আহমেদ রোদেলা
# পর্বঃ ৪৭
৮৩.
চোখ বন্ধ করে খুব মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা শুনছিলো রিদ। রোজা দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে মাথা হেলিয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। কৌতূহলী গলায় প্রশ্ন করলো,
—” এই আইনস্টাইন?কাহিনী কি রে? ওভাবে কি শুনছিস?”
হঠাৎ ডাক পড়ায় চমকে উঠলো রিদ। বুকে ফুঁ দিয়ে হাসিমুখে বললো,
—” ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে আপু। ভেতরে আসো। আরিয়ান মৃন্ময় আজ রেডিও-তে লাইভ গান গাইছেন। উনার বাবার গাওয়া গান। তিনটা গান অলরেডি শেষ। গানগুলো জাস্ট অসাধারণ ছিলো আপু। জলদি আসো।”
রিদের তাড়া আর মৃন্ময়ের নাম শুনে নিজেকে আর আটকে রাখতে পারলো না রোজা। ধীর পায়ে বিছানায় গিয়ে বসলো। মৃদু হেসে বললো,
—” রাত দুটোই তুই এফএম শুনছিস?”
—” তো শুনবো না? মৃন্ময় গান গাইবে আর আমি শুনবো না? ইম্পসিবল! তুমি অনেক লেইট করে ফেলেছো আপু। অনুষ্ঠান শেষের দিকে। বিজ্ঞাপন চলছে তারপর শুধু একটা গান গাইবে। কোন একজনকে ডেডিকেট করে গাইবে। কে হতে পারে বলো তো আপু?”
রোজা ঠোঁট উল্টে বললো,
—” আমি কি জানি? হবে হয়তো কেউ।”
ওদের কথার মাঝেই শুরু হয়ে গেলো অনুষ্ঠান। উপস্থাপকের অনুরোধে গান ধরলো মৃন্ময়। মৃন্ময়ের কন্ঠটা শুনেই কেঁপে উঠলো রোজা। শরীরে বয়ে গেলো অদ্ভুত এক শিহরণ,
—” সেই তুমি আজ দূরে
খুঁজে খুঁজে কোথা পাই,
সেই আমি ঘুরে ঘুরে
ধোঁয়া হয়ে মিশে যাই।
কথা ছিল দেখা হবে
রোজ ভোরে দুজনায়,
কেন থেমে গেছে নদী
মন বুঝেও বোঝেনা।
ব্যথা জমে, কালো চোখে
নিদ্রা আসে না,
ঠিক তোর মতন কেউ ভালোবাসে না,
বাসে না,
ঠিক তোর মতন কেউ ভালোবাসে না।
শূন্যময়, এই হৃদয়ে
তাইতো এতো যন্ত্রনা,
লোক দেখানো মিথ্যে হাসি
আর অযথা স্বান্তনা।
প্রিয় কবি, কত ছবি
কত স্বপ্ন দুজনার,
মুছে যাওয়া, শেষ পাওয়া
কত অল্প দুজনার।
ব্যথা জমে, কালো চোখে
নিদ্রা আসে না,
ঠিক তোর মতন কেউ ভালোবাসে না,
বাসে না, বাসে না, বাসে না,
আর কেউ অতোটা কাছে আসেনা।
আসেনা, আসে না,
ঠিক তোর মতন কেউ ভালোবাসে না।”
গানটা শেষ হতেই দু’চোখ ভরে এলো রোজার। মৃন্ময়ের আকুতি ভরা কন্ঠটা খুব টানছে তাকে। মনে হচ্ছে, মৃন্ময় বুঝি তাকেই ডাকছে। শুধু তার কথায় ভাবছে। রোজার ভাবনার মাঝেই বলে উঠলেন উপস্থাপক,” অসাধারণ এই গানের পর নিয়ে নিচ্ছি একটা কল।”
—” হ্যালো, বন্ধু? আপনার না…”
উপস্থাপকের কথার মাঝেই বেজে উঠলো নারী কন্ঠস্বর,
—” হ্যালো? আমি শান্তনা সরকার বলছি। আরিয়ান মৃন্ময়ের অনেক বড় ফ্যান আমি। উনার সাথে কথা বলতে চাই । প্লিজ প্লিজ! “
উপস্থাপক হাসিমুখে বললেন,
—” অবশ্যই। কথা বলুন।”
কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর একটি হাস্যোজ্জ্বল ভারি কন্ঠ ভেসে এলো কানে। সাথে সাথেই কেঁপে উঠলো রোজা।
—” হ্যালো? শান্তনা সরকার, কেমন আছেন আপনি?”
মেয়েটি উচ্ছ্বাসিত কন্ঠে বলে উঠলো,
—” ওহ্ মাই গড। আই কান্ট বিলিভ। আপনি সত্যিই আরিয়ান মৃন্ময়? আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। আমি সত্যিই আপনার সাথে কথা বলছি? আমি কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছি না কেন? আমার হাত-পা কাঁপছে মৃন্ময়।”
এটুকু বলেই অঝোরে কেঁদে উঠলো মেয়েটি। রোজা-রিদ আগ্রহ নিয়ে বসে রইলো। মেয়েটি হেঁচকি তুলতে তুলতে বললো,
—” আই লাভ ইউ মৃন্ময়। অনেক অনেক বেশি ভালোবাসি আপনাকে।”
কথাটা শুনেই মুখটা কালো হয়ে গেলো রোজার। মেয়েটার কন্ঠে আকুলতা স্পষ্ট। রোজা থম ধরে বসে রইলো মৃন্ময়ের উত্তর শোনার আশায়। কয়েক সেকেন্ড পরই শান্ত গলায় বলে উঠলো মৃন্ময়,
—” শান্ত হোন মিস.শান্তনা। আমার পক্ষ থেকে আপনার জন্য রইলো অসংখ্য ভালোবাসা। কাঁদবেন না প্লিজ। এতো মিষ্টি মেয়েকে কি কাঁদলে মানায় বলুন?”
এটুকু শুনেই জ্বলে উঠলো রোজা। রেডিওটা ঠাস করে বন্ধ করে চোখ-মুখ অন্ধকার করে বসে রইলো। রিদ অবাক চোখে বোনের দিকে তাকালো। কিছুক্ষণ চুপ থেকে ভয়ে ভয়ে আবারও চালু করলো রেডিও। রেডিও অন করতেই কিন্নরকণ্ঠে বলে উঠলো একটি মেয়ে,
—” উইল ইউ ম্যারি মি, মৃন্ময়? আই এম জাস্ট ম্যাড ফর ইউ। প্লিজ?”
মৃন্ময় হেসে ফেলে বললো,
—” আমি আপনাকে বিয়ে করে নিলে আপনার হবু বর কষ্ট পাবে মিস.ঈশিতা। ছেলে হয়ে অন্য একটি ছেলেকে কষ্ট দিতে একদমই রাজি নই আমি।”
মৃন্ময়ের এই উত্তরটা খুব একটা অপছন্দ হলো না রোজার। খুশি খুশি ভাব নিয়ে আবারও মনোযোগ দিলো সে। লাস্ট কলে মিহিকা নামের মেয়ে প্রশ্ন করলো,
—” স্যার? আপনার কি কোনো স্পেশাল পার্সন আছে? আই মিন, এমন কোনো মেয়ে যাকে আপনি ভালোবাসেন।”
মৃন্ময় হালকা হেসে স্পষ্ট গলায় বললো,
—” অধিকাংশ মানুষেরই ভালোবাসারও কেউ না কেউ থাকে। হোক তা প্রকাশিত বা অপ্রকাশিত। আমারও আছে।”
মেয়েটি উৎফুল্ল গলায় বললো,
—” নাম কি তার? কোনো হিরোইন বা মডেল? বা গায়িকা?”
মৃন্ময় শান্ত গলায় জবাব দিলো,
—” সরি! আমি আমার পার্সোনাল লাইফটা পার্সোনালই রাখতে চাই। তাই নামটা বলতে পারছি না তবে সে খুবই সাধারণ একটা মেয়ে। মিডিয়ার কেউ নয়।”
এবার উপস্থাপক উৎফুল্ল গলায় বললেন,
— ভাইয়া? তার সম্পর্কে কিছু তো বলুন। অল্প একটু হলেও বলুন। আপনার ফ্যানরা এভেন আমিও জানতে চাই সেই লাকি গার্ল সম্পর্কে। প্লিজ, ভাইয়া।”
মৃন্ময় হেসে বললো,
—” এমনিতেও কাল সকালে বিশাল খবর ছেপে যাবে। আমার পেছনে গোয়েন্দা লেগে গেলেও অবাক হবো না। তাকে নিয়ে কিছু বলে বেচারিকে ঝামেলায় ফেলতে চাইছি না। একটা গান শুনেছেন?
হাজার লোকের ভিড়ে অনন্যা
যে নিজে নিজের তুলনা
হাজার লোকের ভিড়ে অনন্যা
যে নিজে নিজের তুলনা
সেই মেয়েটি এমন………….
সেই মেয়েটি এমন………….
চোখ দুটো আকাশের নীলে সাজানো
ঠোঁটের হাসি তার চাঁদ রাঙ্গানো…
সেও অনেকটাই এমন। অনন্যা!”
শেষ কথাটা যেন রোজার মনে একঝাঁক ভালোবাসার পরশ ছুঁয়ালো। নিজের মনেই লাজুক হাসলো সে। কিন্তু পরমুহূর্তেই মুখ কালো হয়ে এলো তার। মৃন্ময় আর সে —- আদৌ কি সম্ভব?
__________________
টেবিলে একগাদা ফাইল ছড়িয়ে চিন্তিত মুখে বসে আছেন রাদিব সাহেব। কপালে সূক্ষ্ম চিন্তার ভাজ। এমন সময় দরজা ঠেলে মিষ্টি কন্ঠে বলে উঠলো রোজা,
—” বাবা আসবো?”
রাদিব সাহেব চোখ তুলে তাকালেন। চশমাটা ঠিক করে নিয়ে হাসিমুখে বললেন,
—” আয় মা।”
রোজার দু’হাতে দু কাপ কফি। হাতের কনুই দিয়ে দরজা ঠেলে কোনোরকম ভেতরে প্রবেশ করলো সে। টেবিলে ছড়ানো ফাইলগুলোর দিকে তাকিয়ে বললো,
—” খুব বিজি?”
রাদিব সাহেব মৃদু হেসে মাথা দুলিয়ে বললেন,
—” আমার মা’টা সামনে থাকলে কি ব্যস্ততা দেখানো চলে?”
রোজা হাসলো। জেদ ধরা গলায় বললো,
—” তাহলে ছাদে চলো। একসাথে কফি খাবো।”
—” রুমে খেলে চলে না? ছাদে যেতেই হবে?”
—” না, চলে না। যেতেই হবে।”
রাদিব সাহেব উঠে দাঁড়িয়ে কুঁচকানো শার্টটা ঠিক করার চেষ্টা করতে করতে বললেন,
—” তাহলে আর কি করা? চল।”
আকাশটা বড্ড মেঘলা আজ। ঘন মেঘে ঢেকে আছে অন্ধকার এই রাত। থেকে থেকে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। সেই আলোতেই বাবার কাঁচা-পাকা চুলগুলোর হালকা নড়ে উঠা উপলব্ধি করতে পারছে রোজা। রোজা কিছুটা সরে এসে বাবার পাশ ঘেঁষে দাঁড়ালো। রাদিব সাহেব মেয়ের ছটফট ভাবটা বুঝতে পেরেই বামহাতে সস্নেহে বুকে টেনে নিলেন। ডানহাতে রাখা কফি কাপে হালকা চুমুক দিয়ে আদুরে গলায় বললেন,
—” কি হয়েছে আম্মু? “
রোজা মৃদু গলায় বললো,
—” আমার কান্না পাচ্ছে বাবা। আমি একটু কাঁদি?”
রাদিব সাহেবের কপালে চিন্তার ভাজ পড়লো। অন্ধকারে সেই ভাজটা চোখে পড়লো না রোজার। রাদিব সাহেব আদুরে গলায় বললেন,
—” আচ্ছা, কাঁদো।”
রোজা বাবার বুকে মুখ গুঁজে ফুপিয়ে উঠলো। রাদিব সাহেব মেয়ের মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে দিতে দিতে কফি শেষ করলেন। রোজার কান্নার তেজ কিছুটা কমে আসতেই দু’হাতে মেয়েকে আগলে নিয়ে বললেন,
—” তুই কিন্তু একটু কাঁদতে চেয়েছিস। অলরেডি দশ মিনিট হয়ে গেছে। এবার কান্না থামিয়ে বাবাকে বল কি হয়েছে।”
রোজা নাক টেনে বললো,
—” তুমি বুঝি ঘড়ি দেখছিলে?”
রাদিব সাহেব হেসে ফেললেন,
—” তোর বাবার কি দৈব দৃষ্টি আছে নাকি রে? এতো অন্ধকারে ঘড়ি কিভাবে দেখবো? অনুমান করছিলাম। এবার বল তো, আমার স্ট্রং গার্লের কাঁদতে ইচ্ছে করছে কেন?”
রোজা একহাতে চোখ মুছে নিয়ে বললো,
—” তুমি বলেছিলে কান্না মানে ভয়,পরাজয়,দুর্বলতা। সেদিনের পর থেকে আমি কাঁদি না। কিন্তু বাবা? তোমার মেয়ে ততটাও স্ট্রং নয় যতটা তুমি মনে করো। তাইতো আজ কেঁদে গা ভাসালাম।”
রাদিব সাহেব মেয়ের চুলগুলোতে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,
—” পাগলী! তুই শুধু এটুকুই মনে রেখেছিস? এটা মনে রাখিস নি যে, কান্না মানে আনন্দ, জয় আর একরাশ ভালোবাসা। তুই যতটুকু স্ট্রং ততটুকুই এনাফ মা। এর বেশি স্ট্রং হওয়াটা মেয়েদের মানায় না।”
রোজা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
—” আচ্ছা, বাবা? কখনো যদি সামর্থ্যের বাইরে কিছু চেয়ে ফেলি তাহলে কি খুব ক্ষতি হয়ে যাবে?”
রাদিব সাহেব শান্ত গলায় বললেন,
—” সেটা তো চাওয়ার উপর নির্ভর করছে। কি চাই তোর?”
রোজা সোজা হয়ে দাঁড়ালো। মাথা নিচু করে বললো,
—” ভালোবাসা!”
রাদিব সাহেব কপাল কুঁচকে বললেন,
—” তুই কাউকে ভালোবাসিস আম্মু? ভালোবাসা কি সামর্থ্য দেখে হয় নাকি? দুজন দুজনকে ভালোবাসতে পারাটাই ভালোবাসার সামর্থ্য। ভালোবাসায় একমাত্র জিনিস যেখানে সামর্থ্যের প্রয়োজন হয় না। শুধু বিশ্বাস আর অকৃত্রিম ভালোবাসাটাই প্রয়োজন। তবে, ৭০% ভালোবাসাগুলো মানুষের দীর্ঘশ্বাস হয়ে পড়ে থাকে। তাদের পরিণতি আসে না, ভালোবাসাটা থামিয়েও দেয় না।”
রোজাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আবারও বলে উঠলেন রাদিব সাহেব,
—” যেমন আমার কথাটাই ধর। যখন ভার্সিটিতে পড়তাম তখন একটা মেয়েকে প্রচন্ড ভালোবাসতাম। খুব বেশি সুন্দরী ছিলো তা নয়। তবুও কেন জানি ভালো লাগতো। সেও আমায় ভালোবাসতো। পুরো ভার্সিটি লাইফটাই রমরমা প্রেমে কাটিয়ে দিয়েছি আমরা। ভার্সিটি থেকে বেরিয়েই তো আর চাকরী সম্ভব না। তবুও একটা সংবাদপত্রে যোগ দিলাম। মাসে মাত্র ৪ হাজার টাকা বেতন। অন্যদিকে তার বাড়ি থেকে বিয়ের প্রেসার। ও বাড়ি থেকে পালিয়ে আসার জন্য পাগল হয়ে গিয়েছিলো। আমাকে হারানোর ইনসিকিউরিটি থেকে সুইসাইড এট্যাম্পও করেছিলো। কষ্টে আমার বুকটাও কেঁপে কেঁপে উঠতো কিন্তু বাস্তবতা কি আর ভালোবাসা মানে? তাই হারাতে হয়েছে ওকে। বিয়ের পরও পাগলীটা আমার কাছে আসার জন্য পাগলামো করেছে অথচ এখন তার দুটো ছেলে আছে। পুরো ফ্যামিলি নিয়ে ইউএস থাকে। আর আমিও তোদের বাবা।”
রোজা কৌতূহলী কন্ঠে বললো,
—” তুমি এখনও উনাকে ভালোবাসো, বাবা?”
রাদিব সাহেব কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন,
—” হ্যাঁ,বাসি। হয়তো মেয়েটাও বাসে। কিন্তু আমাদের এই ভালোবাসা ওই ৭০% এর মতো দীর্ঘশ্বাসেই লুকায়িত থাকে, থাকবেও। সত্যিকারে ভালোবাসলে ভালোবাসাটা কখনো কমে না। শুধু আমরা অভ্যস্ত হয়ে পড়ি এই আরকি।”
রোজা দুঃখী গলায় বললো,
—” তাহলে মা? তুমি মাকে ভালোবাসো না?”
রাদিব হেসে মেয়েকে কাছে টেনে নিয়ে বললেন,
—” কে বলেছে বাসি না? তাকেও ভালোবাসি। সে আমার আম্মুটার মা বলে কথা। তোর মায়ের প্রতি আমার ভালোবাসা আর আমার প্রক্তোনের প্রতি আমার ভালোবাসা দুটো আলাদা জায়গায় থাকে। আমি তোকে এটা বুঝাতে চাইছি যে, একবার ভালোবাসতে শিখে গেলে ভালোবাসা ছাড়া উপায় নেই। আমি এখন মাঝে মাঝে ভাবি কি জানিস? ভাবি, বেশ হয়েছে যৌবনের ভালোবাসাটা পাইনি আমি। ওকে পাইনি বলেই তো তোদের পেয়েছি আর পেয়েছি একরাশ দীর্ঘশ্বাস। ভালোবাসাময় দীর্ঘশ্বাসটাও বেশ উপভোগ্যকর বুঝলি?”
রোজা মন খারাপ করে বললো,
—” তাহলে কি তুমি আমায় ৭০% মানুষের মতো দীর্ঘশ্বাসের ক্যাটাগরিতে চলে যেতে বলছো?”
রাদিব সাহেব হেসে ফেললেন,
—” তা কেনো বলবো? কিছু বলার আগে সমস্যাটা তো জানতে হবে। সমস্যাটা এক্সপ্লেইন কর। আমার প্রক্তোনের মতো কি গরিব হতভাগাকে ভালোবেসে ফেলেছিস?”
রোজা গম্ভীর গলায় বললো,
—” তার থেকেও মারাত্মক কিছু।”
রাদিব সাহেব চিন্তিত গলায় বললেন,
—” তাহলে তো ভারি চিন্তার বিষয়। কোনো কানা বাবা টাইপ ভিক্ষুককে পছন্দ করে ফেলেছিস বুঝি?”
রোজা ক্ষুব্ধ কন্ঠে বললো,
—” বাবা!”
রাদিব সাহেব হাসতে হাসতে বললেন,
—” আচ্ছা ঠিক আছে, ঠিক আছে। এবার সিরিয়াসলি বলছি। কাকে পছন্দ করিস বল। নাম,ঠিকানা দে। আচ্ছা, একতরফা ভালোবাসা জনিত সমস্যা?”
—” না। তেমন সমস্যাও নয়। উনি আমায় ভালোবাসেন। হি প্রোপোজড মি।”
রাদিব সাহেব কপাল কুঁচকে বললেন,
—” তো সমস্যা কোথায়? হতদরিদ্রও নয়, নিশ্চয় অশিক্ষিতও নয়, ভালোও বাসে। তাহলে?”
রোজা ঢোক গিলে বললো,
—“পয়েন্ট বুঝো বাবা ৷ সামর্থ্যের বাইরে তারমানে হলো অতিরিক্ত ধনী।”
রাদিব সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন,
—” কি করে ছেলে? দু নম্বারী কর্মকান্ড?”
রোজা মাথা নেড়ে অসম্মতি জানালো। রাদিব সাহেব অধৈর্য গলায় বললেন,
—” তবে?”
রোজা চোখ বন্ধ করে এক নিঃশ্বাসে বলে ফেললো,
—” গান গায়, অভিনয় করে।”
—” কে?”
কিছুক্ষণ চুপ থেকে বিস্ময় নিয়ে বললেন,
—” তুই কি কোনোভাবে আরিয়ান মৃন্ময়ের কথা বলছিস?”
রোজা মাথা নাড়িয়ে বললো,
—” হ্যাঁ।”
রাদিব সাহেব কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে সিঁড়ির দিকে হাঁটা দিলেন। রোজা আৎকে উঠলো। পেছন থেকে করুণ গলায় বললো,
—” কিছু বললে না বাবা? আমি কি ৭০% এ চলে যাবো?”
রাদিব সাহেব হাঁটতে হাঁটতেই বললেন,
—” নাথিং টু ছে আম্মু। হি ইজ আ গোল্ডেন ওয়ান। বিয়ে করতে চাইলে জানাস আমায়। হাতের কাজগুলো ম্যানেজ করতে হবে।”
রোজা বেশ কিছুক্ষণ অবাক চোখে বাবার যাওয়ার পথে তাকিয়ে থেকেই ধপ করে বসে পড়লো। চোখ দুটো ঘোলা হয়ে আসছে তার। আনন্দে হাত-পা কাঁপছে। মেঘের গর্জনগুলোকেও আজ সুমিষ্ট সুর বলে বোধ হচ্ছে। প্রেমটা সত্যিই অদ্ভুত!
________________
দেয়ালে আরুর মস্ত এক ছবি টানানো হয়েছে। ছবিতে পুকুরে পা ডুবিয়ে মুচকি হাসছে আরু। ছবিটা আসিফকে দিয়ে জোগাড় করিয়েছে রাফিন। আরুকে ছাড়া রুমটা বড্ড ফাঁকা ফাঁকা লাগছিলো তার। তাই বেডরুমের দেয়ালেই ঝুলিয়ে দিয়েছে আরুকে। সেই ছবিটার সামনেই মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রাফিন। কি অসম্ভব সুন্দর সেই হাসি। এই হাসিটাকে ক্যাপচার করতেই একঘন্টা সময় লেগেছে আসিফের। গ্রামে যেতেই আবারও চঞ্চল হয়ে উঠেছে মেয়েটা। আসিফ বলছিলো, গাছে উঠে জামরুল পাড়তে গিয়ে নাকি হাত-পায়ের চামড়াও উঠিয়ে ফেলেছে সে। রাফিন মুচকি হাসলো। মেয়েটা এতো পাগল কেন? রাফিনের ভাবনার মাঝেই টোকা পড়লো দরজায়। রাফিন ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। উঁচু গলায় বললো,
—” কে? কাম ইন।”
অনুমতি পেয়ে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো আসিফ। হাতে একগাদা কাগজ পত্র নিয়ে ব্যস্ত গলায় বললো,
—” ভাই? ওই ইঞ্জিনিয়ার তো টাকাটা দিচ্ছে না।”
রাফিন কপাল কুঁচকে বললো,
—” কোন ইঞ্জিনিয়ার?”
আসিফ বললো,
—” রাশেদ, আমাদের কন্সট্রাকশনের কাজ করলো যে।”
রাফিন মনে করার ভঙ্গি করে বললো,
—” ওহ্। তো কি বলে?”
—” বলে কি না বাপ অসুস্থ। দেশের বাইরে নেওয়া লাগবো। টাকা নাই। দু’মাস ওভার হয়ে গেছে ভাই। কি করবো এখন?”
রাফিন বিছানায় বসে জুতোর ফিতা খুলতে খুলতে বললো,
—” কতো টাকা?”
—” পাঁচ কোটি ভাই।”
—” এক কাজ কর, ইঞ্জিনিয়ারকে ধরে এনে কিডনি,চোখ যা যা বিক্রি করা যায় সব বিক্রি করে দে। তাতে পাঁচ কোটি চলে আসবে। তাতেও না হলে বাড়ি দখল করে নে।”
আসিফ মাথা নাড়িয়ে বললো,
—” আচ্ছা ভাই।”
রাফিন একটু থেমে আবারও জিগ্যেস করলো,
—” তোর ভাবি কি বেশি ব্যাথা পেয়েছে? “
আসিফ হেসে বললো,
—” না ভাই।পলাশ যেটুকু বললো তাতে হালকা একটু চমড়া উঠে গেছে। তেমন কিছু হয় নাই।”
রাফিন আশ্বস্ত হয়ে বললো,
—” আচ্ছা ঠিক আছে। আমি বাইরে যাবো গাড়ি বের কর। উত্তরায় কাজ আছে।”
আসিফ মাথা নাড়লো। আড়চোখে একবার রাফিনের দিকে তাকালো। নির্বিকার এই চোখ-মুখ দেখে কে বলবে ছেলেটা এতো ভয়ানক? প্রেয়সীর পায়ের হালকা ব্যাথা যাকে দু’বার ভাবালো। সেই ব্যক্তিটিই অন্য একটা পরিবারের স্বামী,বাবা,ছেল
ে এবং একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষটিকে নির্মমভাবে মেরে ফেলার হুকুম দিতে গিয়ে একবারও ভাবলো না। একবারও ভাবলো না, সেই ঘরটিতেও একজন আরু আছে। সহজ-সরল, ভালোবাসাময় আরু!
# চলবে….
(সরি ফর লেইট। আর না পড়ে কমেন্ট করে কি লাভ? দয়া করে পড়েই কমেন্ট করবেন। ধন্যবাদ)