# এক মুঠো রোদ .
# writer :নৌশিন আহমেদ রোদেলা
# পর্ব -৮
আরু রাফিনের দিকে সরু চোখে তাকালো। একটা ঢোক গিলে আবারও বলে উঠলো,
— বসতে পারি ডক্টর?
রাফিন কিছু বললো না। তার আগেই দরজায় ধাক্কা পড়লো। আরু দ্রুত দরজার কাছে গিয়ে দরজাটা লক করে দিয়ে আবারও রাফিনের কাছে এসে দাঁড়ালো। ভ্রু কুঁচকে রাফিনের দিকে তাকিয়েই বলে উঠলো,
— আপনি কি বোবা হয়ে গেছেন? কথা বলছেন না কেন?
আরুর কথায় উঠে দাঁড়ালো রাফিন। এপ্রোনটা খুলে রেখে কব্জির কাছের বাটনগুলো খুলে হাতা গুটাতে গুটাতে এগিয়ে এলো রাফিন। আরু রাফিনের দিকে ভয়ে ভয়ে তাকিয়েই ধীরে ধীরে পিছুতে লাগলো। রাফিন কাছে এসে একটানে আরুকে টেবিলের উপর বসিয়ে দিলো। টেবিলে দু’ হাত রেখে ওর দিকে খানিকটা ঝুঁকে পড়ে শীতল কন্ঠে বলে উঠলো,
— কি চাই তোমার? রাত কাটাতে চাও ?
রাফিনের কথায় চোখ বড় বড় হয়ে গেলো আরুর। এক ধাক্কায় রাফিনকে সরিয়ে দিয়ে আমতা আমতা করে বলে উঠলো সে,
— কককি বলছেন এসব? ছিহ! আ আমি তো ডক্টর দেখাতে এসেছি। আপনি প্যাশেন্টদের সাথে এমন বিহেভ করেন? মাই গড!
রাফিন চোখ দুটো ছোট ছোট করে আরু থেকে খানিকটা ডিসটেন্সে হাত ভাজ করে দাঁড়ালো। গম্ভীর মুখে বলে উঠলো,
— ডক্টর দেখাতে এসেছেন? তো এপয়েন্টমেন্ট কোথায়? তাছাড়া আমি কোনো প্যাশেন্টকে এভাবে আমার কেবিনে ঢুকতে দেখি নি। কোনো পেশেন্ট কেবিনে ঢুকে দরজায়ও লাগায় নি। এভাবে তো বাজারের মেয়েরাই আসে। তাদের প্রয়োজন থাকে টাকা আর…..
আরু আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। রাফিন যে খুব ঠান্ডা মাথায় তাকে অপমান করছে তা বেশ বুঝতে পারছে সে। আচ্ছা? একটা গুন্ডারও এতো এটিটিউট থাকে বুঝি? আরু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠলো,
— আমি সার্জারী করাতে চাই ডক্টর। মাথার সার্জারী। আমার ধারনা খুব বাজে ধরনের একটা ছেলে আমার মাথার মধ্যে ঢুকে গেছে। আমি কিছুতেই বের করতে পারছি না তাকে। ছেলেটা মাথা থেকে ধীরে ধীরে হার্টেও চলে এসেছে। এখন আমি শ্বাস নিলেই হার্টটা দ্রুত কাঁপে,, খুব দ্রুত। ছেলেটা আস্ত একটা অসুখ ডক্টর! সে আমায় সিগারেটের আগুনে পুড়িয়ে দেয়, কথার আগুনে জ্বালিয়ে দেয় তবু আমার তাকেই ভালো লাগে। অসম্ভব রকম ভালো লাগে। আপনি কি মাথা থেকে ছেলেটাকে বের করে দিবেন প্লিজ?
রাফিন চুপচাপ শুনে চলেছে। এর বিপরীতে কি বলা যেতে পারে জানা নেই তার। এই প্রথম কারো করা প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাচ্ছে না সে। এই ২৮ বছরের জীবনে আজ প্রথম রাফিন ভাষাহারা হয়ে পড়েছে। হয়ে পড়েছে নীরব, নিস্তব্ধ। আরু ধীর পায়ে এগিয়ে এসে রাফিনের ঠিক সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। কাঁপা হাতটা আরো একদফা কাঁপিয়ে নিয়ে ছুঁয়ে দিলো রাফিনের গাল। রাফিন যেনো চমকে উঠলো। অনেকটা ছিটকে দূরে সরে গেলো সে। চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকেই গম্ভীর স্বরে বলে উঠলো,
— গেট লস্ট। এই মুহূর্তে বেরিয়ে যাবে তুমি। আর হ্যা, নিজের নামটা ধর্ষিতার লিস্টে লেখাতে না চাইলে আমার সামনে আর এসো না। রাফিন চৌধুরীর কথার নড়চড় হয় না…. দেখা গেলো পরেরবার তোমার শরীরটায় থাকলো না। নাও গেট লস্ট…আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু সী ইউ এগেইন।
রাফিনের কথায় আরুর চোখটা ভিজে এলেও কি ভেবে মুচকি হাসলো সে। রাফিনের দিকে পূর্ণদৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে উঠলো,
— মিষ্টার ভিলেন? দেখা আমাদের অবশ্যই হবে আর আপনার কথার নড়চড়ও হবে। কারণ আমি জানি আপনি পারবেন না। না পারবেন আমাকে আটকাতে আর না পারবেন আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে। জানেন?মাঝে মাঝে আমি নিজেই অবাক হয়ে যাই এটা ভেবে যে, একজন ভিলেনের প্রতি এতোটা বিশ্বাস কি করে আসে আমার? উত্তরটা আগে না জানলেও এখন জানি আমি। উত্তরটা হলো ” ভালোবাসা “। মনের মাঝে ভালোবাসা নামক শব্দটা একবার দানা বেঁধে গেলে বিশ্বাসটা তো আপনা আপনিই আসে। আমার ভালোবাসাকে অপমান করার মতো সাহস আপনার নেই মিষ্টার ভিলেন। আর কখনো হবেও না।
কথাটা বলেই দরজার দিকে এগিয়ে গেলো আরু। কি ভেবে দরজার সামনে গিয়ে থমকে দাঁড়ালো। ঘাড় গুড়িয়ে রাফিনের দিকে তাকিয়ে টলমলে চোখে বলে উঠলো সে,
— যেদিন থাকবো না। সেদিন খুব করে মিস করবেন আমায়। তখন খোঁজার সময় হয়তো আপনার থাকবে কিন্তু আসার সময় আমার থাকবে না। সেদিন আপনি বুঝবেন ভালোবাসা নামক অসুখটা কতো ভয়াবহ কিন্তু সেই ভয়াবহতাটা দেখানোর জন্য আমায় আপনি পাবেন না।
তারপর আর এক সেকেন্ডও দাঁড়ায় নি আরু। দৌঁড়ে বেরিয়ে গেছে কেবিন থেকে। প্রিয়ন্তী বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিলো। আরুকে এভাবে বেরিয়ে আসতে দেখে অবাক হলো সে। কিন্তু কিছু বললো না। আরুকে অনুসরণ করে হসপিটাল থেকে বেরিয়ে এলো চুপচাপ। রাফিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চেয়ারে গিয়ে বসলো।সে কেনো জানি মেয়েটার শেষ কথাগুলো কানে বাজছে খুব। এই দীর্ঘজীবনে এই প্রথম আরুর মতো সাধারণ কোনো মেয়ে ভালোবাসার বাণী শুনিয়ে গেলো তাকে। এর আগেও ভালোবাসার কথা শুনেছে সে। অনেক অনেকবার শুনেছে কিন্তু সেই কথাগুলোতে মানুষিক নয় দৈহিক চাহিদাটায় বেশি গুরুত্ব পেয়েছিলো। আর প্রতিবারের মতোই রাফিন তাদের ছুঁড়ে ফেলেছিলো। কিন্তু আরু! এই মেয়েটা তেমন নয়। রাফিন ওর কাছে চেয়েও কেনো জানি কঠিন হতে পারছে না। আরু কেন যে জেনেশুনে এতোবড় ভুল করছে বুঝতে পারছে না রাফিন। হয়তো বাকি মেয়েদের মতো সেও রাফিনের চেহেরায় মুগ্ধ।। কি আশ্চর্য! রূপই কি তাহলে সব? চরিত্র কিছুই না? রাফিনের মতো বাজে একটা ছেলেকে আরু ভালোবাসে। রূপের মোহে ভালোবাসে… কথাটা ভেবেই তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো রাফিন। ঘড়িতে এগারোটার ঘন্টা বাজায় চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো রাফিন। অটিতে যেতে হবে তাকে। অটির ড্রেসআপ ঠিক করতে করতে আবারও আরুর কথাগুলো মাথায় টোকা দিয়ে গেল। রাফিন হাতে গ্লাভস পড়তে পড়তে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বিরবির করে বলতে লাগলো,
— তুমি জানো না আরু কতোবড় ভুল করছো তুমি। রাফিন চৌধুরী নিজের ফর্মে চলে এলে তুমি বড্ড আফসোস করবে আরু। আজকের এইদিনটার জন্যই বড্ড আফসোস করবে। সাচ আ ফুল লেডি।
১৫.
তীর্থ হাঁপাতে হাঁপাতে অবাক বিস্ময়ে বলে উঠলো,
— তুই এতো ইজিলি ওই বুড়োটাকে পটিয়ে ফেললি? কিন্তু কিভাবে?
— রহিম চাচা টাইপ মানুষরা একটু বেশিই ইমোশনাল হয় বুঝলি? উনার বাজারের ব্যাগটা জোড় করে হাতে নিয়ে বললাম তাকে ঠিক আমার বাবার মতো দেখতে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো আমার বাবা হঠাৎই আল্লাহ পেয়ারা হয়ে গেছে যার ফলে আমি আজ কর্মহীন অনাথ বালিকা। ব্যস কেল্লা ফতে।
— তুই আঙ্কেলকে মৃত বানিয়ে দিলি?
— উহুম! তোর বাপকে বানাইছি। কারণ বাপের নামটা তাজমুল আহমেদ বলেছিলাম।
কথাটা বলেই চারপাশ কাঁপিয়ে হেসে উঠলো রোজা। তীর্থ রাগে গজগজ করতে করতে বলে উঠলো,
— শালা বাটপার!!
তীর্থের কথায় রোজার হাসির গতি বাড়ছে বয় কমছে না। অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে তীর্থের কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে উঠলো সে,
— কি রে? তোর মনিকা বেপ্পির কি খবর জানু?
— আর বলিস না। হেতি মাইয়া তো নয় আরেক আলামত। জীবনের প্রথম মেয়ে পটাতে আমার দুই দুটো ঘন্টা লাগছে। তবে প্ল্যান সাকসেসফুল। আমার সামনে বসেই আমার সিভি পাঠিয়ে ন্যাকা কান্না করে চাকরী কনফার্ম করিয়েছে সে। আসার সময় বোন ডেকে আমার হারিয়ে যাওয়া শেফালিকে খুঁজে পেলে বিয়ের দাওয়াত দিবো বলে কথা দিয়ে এসেছি।
কথাটা বলেই আরেক দফা হেসে নিলো দুজনে। পার্কের একটা বেঞ্চিতে বসে আছে ওরা। রোজার গায়ে মিষ্টি রঙের শাড়ি। লম্বা চুলগুলো আজও বেণী করে রেখেছে সে। যা এখন মাটি থেকে আধহাত উপরে ঝুলাঝুলি করছে। তীর্থ ঘড়িটা একবার দেখে নিয়েই উঠে দাঁড়ালো। এখন বারোটা বাজে ঠিক দুপুর দুটোই সোহেল আর সিকিউরিটি চিপের সাথে দেখা করতে হবে তাকে। রোজাকে বিদায় দিয়ে একটা রিক্সা নিয়ে চলে গেলো সে। মালিহার সাথেও দেখা করতে হবে আজ। প্লেবয় টাইপ ছেলে হয়েও এই মালিহা নামক মেয়েটাতে কিভাবে যেনো আটকে গেছে সে। মালিহা সামনে থাকলে অন্যান্য মেয়েদের মতো তার শরীরের বিভিন্ন ভাজে তাকাতে ইচ্ছে করে না তীর্থের। বিরামহীনভাবে মালিহার হাসিমাখা মুখটায় শুধু দেখতে ইচ্ছে করে তার।
কথায় আছে না? সব পাখিরই নীড় আছে। তেমনই তীর্থের মতো বেপরোয়া পাখিটির নীড় হলো মালিহা! রোজা চুপচাপ বসে বাদাম চিবুচ্ছে। এই দুপুরের প্রচন্ড গরমে রোজার তুলতুলে গাল দুটো কেমন গোলাপী আভা ছড়াচ্ছে। দুপুরের দিকে পার্কে তেমন একটা মানুষ থাকে না। আজও নেই…কেমন একটা জনশূন্য চারপাশের পরিবেশ! রোজার দৃষ্টি পার্কের বাইরে একগুচ্ছ পথশিশুর উপর। ওরা বল ছুঁড়াছুঁড়ি করে কিছু একটা খেলছে আর খিলখিল করে হাসছে। রোজার মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে এই শিশুগুলো পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ। সবচেয়ে সুখী মানুষ! রোজা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাচ্চাদের দিকে এগিয়ে গেলো। এই বাচ্চাদের খুশিটুকুতে ভাগ বসানোর কি লোভটায় না হচ্ছে তার।
মৃন্ময় একমনে ড্রাইভ করে চলেছে। চোখদুটো রাস্তার দিকে স্থির থাকলেও মনটা খুবই বিক্ষিপ্ত তার। তাই সব কাজ ফেলে একটু তাজা নিশ্বাস নিতেই গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছে সে। আজকের এই দিনটাতেই মাকে হারিয়েছিলো মৃন্ময়। তখন সে তের বছরের ছোট বাচ্চা। এই ছোট্ট বয়সেই কতো কিছু বুঝে নিতে হয়েছে তাকে। তার শৈশবটাকে একগাদা দুশ্চিন্তা ধাবিয়ে দিয়েছিলো কতো নির্মমভাবে!! হঠাৎই গাড়ির সামনে কিছু পড়ায় মনের অজান্তেই ব্রেক কষলো সে। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই একরকম ছুটে বেরিয়ে এলো। একটা পিচ্চি মেয়ে তার গাড়ির সামনে থেকে বল উঠাচ্ছে। গায়ে ময়লা ছেঁড়া জামা। আরেকটু হলেই গাড়ির নিচে পিষে যেতো মেয়েটা। মৃন্ময় ব্যস্ত হয়ে মেয়েটিকে কোলে তুলে নিলো। হাত-পা চেইক করে দুশ্চিন্তামাখা কন্ঠে বলে উঠলো,
— কোথাও লেগেছে তোমার?
মেয়েটা কিছুক্ষণ পিটপিট করে তাকিয়ে থেকে হাত দিয়ে ডান পা টা দেখিয়ে দিলো। মৃন্ময় হাতের ইশারা লক্ষ করে পায়ের দিকে তাকাতেই দেখলো ডানপায়ের হাঁটুর নিচে খানিকটা ছিলে গিয়ে রক্ত বেরিয়ে এসেছে। মৃন্ময় গাড়ি থেকে ফার্স্ট এইড বক্সটা নিয়ে পিচ্চিটিকে বসিয়ে দিলো পার্কের একটি ব্রেঞ্চে। বোতলের পানি দিয়ে জায়গাটি ধুয়ে এন্টিসেপটিক লাগিয়ে খুব যত্ন করে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিলো। ততক্ষনে বাকি বাচ্চারাও ঘিরে ধরেছে তাকে। সবাই খুব বিস্ময় নিয়ে মৃন্ময়কে পর্যবেক্ষন করে চলেছে। এই লোকটির ছবি কতো দেখেছে তারা। ওইতো পার্কের বাইরেই একটা বিল বোর্ডে আইসক্রিম নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে লোকটি। কি সুন্দর দেখতে! ব্যান্ডেজ শেষে হাসিমুখে বাচ্চাটির দিকে তাকালো মৃন্ময়। মেয়েটির উশকুখুশকু চুলে একটু হাত বুলিয়ে নরম কন্ঠে বলে উঠলো,
— ব্যাথা করে?
মেয়েটি মাথা নেড়ে না জানালো। যার অর্থ ব্যাথা করে না। বাচ্চাটির দু’হাত মুঠোতে নিয়ে আবারও বলে উঠলো মৃন্ময়,
— ক্ষুধা পেয়েছে? কিছু খাবে?
মেয়েটি কিছু বললো না। বড়লোকদের ভালো ব্যবহারে অভ্যস্ত নয় তারা। বড়লোকদের ভালো ব্যবহারে বুক কাঁপে তাদের। মৃন্ময় মেয়েটিকে কোলে তুলে নিয়ে বাকি বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
— তোমরা কি আমার সাথে সামনের ওই রেস্টুরেন্টে যাবে?
বাচ্চারা কিছুক্ষণ দ্বিধাদ্বন্দে ভুগে মাথা নাড়িয়ে হ্যা বললো। মৃন্ময় মুচকি হেসে বললো, “চলো।”
রোজা কিছুটা দূরেই দাঁড়িয়ে ছিলো। বাচ্চাদের সাথে খেলায় মেতেছিলো ও। বাচ্চাটাকে পড়ে যেতে দেখে সেদিকে যেতে নিয়েও থেমে গিয়েছিলো বাচ্চাটাকে কোলে নিতে দেখে। এতোবড় একজন শিল্পী কতো সহজেই রাস্তার এই পথচারী শিশুটিকে কোলে তুলে নিলো। কিছু কিছু মানুষ তো ওদের দেখলেই নাক সিটকায় সেখানে মৃন্ময় কতো নিঃসংকোচ! রোজা কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে অবাক বিস্ময়ে মৃন্ময়ের কাজগুলোই দেখে চলেছিলো সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে। ওদের হাঁটতে দেখেই পা চালালো রোজা। মৃন্ময়ের ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে বলে উঠলো,
— আমায় নিয়ে যাবেন না নায়কসাহেব? আমিও তো আছি ওদের দলে। কি আছি না? (বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে)
রোজার কথায় বাচ্চারা হৈহৈ করে উঠলো। রোজাকেও তাদের সাথে চায়। চায়ই চায়। এই কিছুক্ষণের মধ্যেই রোজা নামের মেয়েটাকে বেশ পছন্দ হয়ে গেছে তাদের। কি সুন্দর করে হাসে মেয়েটা। আর কি সুন্দর কথা বলার ভঙ্গি! বাচ্চাদের চেঁচামেচিতে হেসে উঠলো মৃন্ময়। হাসিমুখেই বলে উঠলো,
— ম্যাডাম আবার নিউজ বানিয়ে দিবেন না তো? আপনাকে বেশ ভয়ই লাগে আমার।
— আমাকে সাথে না নিলে অবশ্যই বানাবো।( ভাব নিয়ে)
— মাফ করুন ম্যাডাম। সেই রিস্ক আর নিতে চাচ্ছি না আমি। তার থেকে না হয় সাথেই চলুন।( মুচকি হেসে)
রেস্টুরেন্টের দিকে হাঁটা দিয়েও গাড়ির কাছে এসে থেমে গেলো মৃন্ময়। গাড়ি থেকে ক্যাপ,মাস্ক আর সানগ্লাস নিয়ে যতোটা সম্ভব নিজেকে ঢেকে নিলো সে। তারপর আবারও হাঁটা দিলো রেস্টুরেন্টের দিকে। রেস্টুরেন্টে গিয়ে মৃন্ময়কে থামিয়ে নিজেই একটা আস্ত কেবিন বুক করে নিলো রোজা। খাবারও অর্ডার করা হলো বাচ্চাদের ইচ্ছেমতো। ওয়েটার খাবার দিয়ে যাওয়ার পর রোজা দরজাটা চাপিয়ে দিতেই মাস্ক আর ক্যাপ খুলে রাখলো মৃন্ময়। বাচ্চারা খাচ্ছে, রোজাও তাদের সাথে কতো আজগুবি কথায় মেতে উঠেছে। রোজাকে দেখে মনে হচ্ছে এই পিচ্চিগুলো তার কতো দিনের চেনা!! মৃন্ময় গালে হাত দিয়ে তাকিয়ে আছে চুপচাপ। যেন পৃথিবীর এক অনিন্দ্য সুন্দর দৃশ্য দেখছে সে।। এই বাচ্চাগুলো সামান্য কিছুতেই কতোটা সুখ খুঁজে পায়।। মন খুলে হাসে। সুখটা আসলেই আপেক্ষিক। মানুষভেদে এর অস্তিত্বও ভিন্ন। খাওয়া শেষে পিচ্চিগুলো আবারও চিৎকার চেঁচামেচি করে বেরিয়ে গেলো। রোজা হাসিমুখে সেদিকে তাকিয়ে থেকেই বলে উঠলো,
— থেংকিউ নায়কসাহেব। প্রচন্ড সুন্দর কিছুসময় উপহার দেওয়ার জন্য, থেংকিউ।
— সেই হিসেবে থেংক্স তো আপনাকেও জানাতে হয়। ওদের খুশিটা আপনার উদ্ভট কথাবার্তায় আরো অনেকটা বেড়ে গিয়েছিলো বলেই মনে হয়। (মুচকি হেসে)
রোজা হাসলো। আঁচল দিয়ে নাকের ঘাম মুছে নিয়ে বলে উঠলো,
— বাচ্চারা ওসব উদ্ভট কথায় পছন্দ করে নায়কসাহেব। এনিওয়ে, আপনি আমাকে সুন্দর কিছু সময় উপহার দিলেন তার বদলে আমারও উচিত আপনাকে কিছু দেওয়া। আপনি যদি চান তো আমি আপনাকে আমার খুব প্রিয় একটা জায়গায় নিয়ে যেতে পারি। কি যাবেন?
মৃন্ময় সরাসরি রোজার চোখের দিকে তাকালো। তারপর কিছু না ভেবেই বলে উঠলো,
— হুম যাবো।
— রিয়েলি? ওকে চলুন। জায়গাটা খুব আহামরি কিছু নয়। খুবই কমন! তবু মনে হয় এটা যেন একরাশ ভালোবাসা। তবে একটা শর্ত আছে…জায়গাটায় আমরা রিক্সা দিয়ে যাবো। আপনার ওই মঙ্গল গ্রহের গাড়ি নিয়ে যাওয়া চলবে না।
— কিহ? রিক্সা? রিক্সা কি খুব জরুরি?
— হুম। খুব জরুরি। এবার বলুন যাবেন নাকি না?
— যাবো।
রোজা হাসলো। মৃন্ময় ক্যাপ,মাস্ক পড়ে বিলটা মিটিয়ে দিয়ে রোজাকে নিয়ে বেরিয়ে এলো। রোজা দরধাম করে রিক্সায় উঠে একটু চেপে বসে মৃন্ময়কে বসার জায়গা করে দিলো। মৃন্ময় মুখ কাঁচুমাচু করে রোজার পাশে বসে পড়লো। মৃন্ময়ের খানিক রিক্সাভীতি আছে। জীবনে এটাই তার দ্বিতীয় রিক্সাযাত্রা। আর কখনো রিক্সার প্রয়োজনই পড়ে নি তেমন। রিক্সায় উঠলেই তার মনে হয় এই বুঝি পড়ে যাবে সে,,এবার বুঝি শেষ রক্ষা হলো না তার। মৃন্ময়ের এমন অবস্থা দেখে খিলখিল করে হেসে উঠলো রোজা। নিজের অজান্তেই মৃ্ন্ময়ের হাতটা শক্ত করে টেনে ধরে বলে উঠলো,
— ধরেছি। এবার আর পড়বেন না আপনি। ভয় না পেয়ে বিষয়টা ইঞ্জয় করুন। রিক্সায় চড়ার মতো মজা আর কিছুতে নেই।
রোজার বিহেভিয়ারে অবাক হলো মৃন্ময়। রোজার বলা সেদিনের কথাটা মনে পড়ে গেলো তার।। তাকে ছুঁলে নাকি ঘৃণা লাগে রোজার…অথচ আজ কতো নিঃসংকোচে এই হাতটায় ধরে আছে রোজা। সময় ভেদে মানুষের কথাগুলো কেমন আশ্চর্য রকমভাবে পরিবর্তন হয়। কথাগুলো ভেবেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো মৃন্ময়।নিজের কাজের কারনেই অনেক মেয়ের সংস্পর্শে যেতে হয়েছে তাকে কিন্তু কখনো কিছু ফিল হয় নি তার। কিন্তু আজ? রোজার ছোঁয়ায় কেমন দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। বুঁকের ভেতরে কি ভীষন কাঁপছে আজ। কিছুটা ফাঁকা রাস্তায় আসতেই একরাশ মিষ্টি হাসি নিয়ে বলে উঠলো রোজা,
— এইযে নায়কসাহেব? এবার মাস্কটা খুলে ফেলুন। আশেপাশে দেখার মতো কেউ নেই। এভাবে কি প্রকৃতিকে অনুভব করা যায়? প্রকৃতিকে অনুভব করতে হবে খোলা মনে। এমন মাস্ক পড়ে একঝাঁক টেনশন নিয়ে বসে থাকলে ছাঁই হবে।
রোজার সেই টোল পড়া হাসি দেখে মনে মনেই হাজারটা তপ্তশ্বাস ফেললো মৃন্ময়। মাস্কটা খুলে ফেলে ক্যাপটাও খুলে ফেললো সে। চোখদুটো বন্ধ করে এই খোলা হাওয়াটা উপভোগ করতে লাগলো সে। বাবা-মা মারা যাওয়ার পর মৃন্ময়ের পাশে এমন করে কয়েক মুহূর্তের অতিথি করেও কাউকে পায় নি সে। মৃন্ময়ের হৃদপিণ্ড নামক পাখিটা খুব দ্রুত ডানা ঝাপটাচ্ছে আজ। সেই ডানা ঝাপটানোর শব্দটা একটা কথায় বলে চলেছে বার বার, ” আপনাকে খুব সুন্দর লাগছে রোজা। অনেক অনেক সুন্দর লাগছে আজ।”
১৬.
মাত্রই অটি থেকে বেরিয়েছে রাফিন। বরাবরের মতো এবারও অপারেশন সাকসেসফুল। অটি থেকে বেরিয়েই প্যাশেন্টদের কান্নামাখা মুখ দেখছে সে এমনকি সে বেরুতেই তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে মেলোড্রামার যেটুকু করার সবটায় করেছে তারা। বিষয়টাতে প্রতিবারের মতো এবারও বিরক্ত রাফিন। এদের অতিরিক্ত আবেগ দেখে মেজাজ খারাপ হয়ে যায় রাফিনের। কেউ কি অমর থাকে নাকি? মরার জিনিস মরবে না? এর জন্য এতো কেঁদে কেটে নদী বানানোর কি আছে বুঝে না রাফিন। তার থেকে বড় কথা যখন শুনলিই অপারেশন সাকসেসফুল তবু এতো মেলোড্রামা কেন? হুয়াই? সব কটা ব্লাডি ফুল! কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই চেঞ্জ করে নিজের কেবিনে গিয়ে বসলো রাফিন। কিছুক্ষণ পরই দরজায় টোকা পড়লো। অনুমতি পেয়ে ভেতরে ঢুকলো আসিফ। রাফিনকে দেখে হাসিমুখে বলে উঠলো সে,
— ভাই? সিঙ্গাপুরের মাল তো এসে গেছে। সঙ্গে একটা মাইয়াও আসছে। দেখতে কিন্তু হেব্বি ভাই।
আসিফের কথায় হাসলো রাফিন। সামনে রাখা ফাইলটা পাশে রাখতে রাখতে বলে উঠলো সে,
— মানুষের মেলোড্রামা দেখে বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলাম। তোর কথায় বিরক্তিটা কিছুটা কমে এসেছে। এরজন্য কিছু দেওয়া উচিত তোকে। বল কি চাস?
— ভাই একটা প্রশ্ন করি? (চেয়ারে বসতে বসতে)
— হুম কর।
— আপনি এতোবড় ডাক্তার হয়েও গ্যাংস্টার কেন আর গ্যাংস্টার হয়েও ডাক্তার কেন? বিরাট কনফিউশান ভাই! আমার মাথায় তো ঢুকে না।
আসিফের কথায় বাঁকা হাসলো রাফিন। হাতের কলমটা আসিফের কপাল বরাবর ছুঁড়ে দিয়ে বলে উঠলো সে,
— ডাক্তারিটা আমার শখের বশেই করা। মানুষকে কেঁটে ছিঁড়ে আবার জোড়া লাগিয়ে বাঁচিয়ে তোলার মতো ম্যাজিক পাওয়ারটা হাতে থাকাটাও বেশ মজার বুঝলি?সবাই তো পারে না। এইজন্য মেডিক্যালে বেশ মনোযোগী স্টুডেন্ট ছিলাম আমি। আর রাফিন চৌধুরী সবসময় তার বেস্টটায় করে। বাংলাদেশের ক্ষমতার বড়াই দেখানো লোকগুলো অন্ধকার জগতে তো আমায় ভয় করেই তারসাথে যখন চিকিৎসার জন্যও আমার কাছে রিকুয়েষ্ট করে তখন একটা পৈশাচিক আনন্দ হয় বুঝলি? এরজন্যই দুটো একসাথেই করি। আরো কিছু কূটনৈতিক কারণ আছে…. এনিওয়ে অনেক শুনে ফেলেছিস আর শুনতে হবে না। (চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে) এবার যা। আর শুন… মালগুলো গোডাউনে পাঠিয়ে দিয়ে ওই মোটা ইবরাহিমকে ফোন করে বলবি, সোনার সাপ্লাইয়ের জন্য তাকে জাস্ট একদিনের সময় দিয়েছি আমি। নয়তো শুট!!
— জি আচ্ছা ভাই।
— আরেকটা কথা।
— জি ভাই?
— আবিদ হাসান নামে এক লোকের মেয়েকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ২৪ ঘন্টার মধ্যে তাকে খুঁজে বের কর আসিফ। আমার ধারনা ঠিক থাকলে মালীবাগে রমজানের আড্ডাতেই পেয়ে যাবি মেয়েটাকে। রমজানকে বলিস এসব মেয়েদের ব্যবসা বন্ধ করতে। মেয়েরা ব্যবসার কোনো জিনিস নয় ওরা ঘরের জিনিস ঘরেই মানায়। কথাটা বুঝতে পারলে ভালো নয়তো ওর জন্য তোর রিবলভারের একটা গুলিই যথেষ্ট। আশা করি বুঝতে পেরেছিস?
— জি ভাই। বুঝতে পারছি। আপনি টেনশন নিয়েন না। আমি দেখতাছি…আসি ভাই।
কথাটা বলেই বেরিয়ে গেলো আসিফ। রাফিন কিছুক্ষণ চোখবুঁজে শুয়ে থেকেই উঠে দাঁড়ালো। সোফা থেকে কোটটা নিয়েই হসপিটাল থেকে বেরিয়ে গেলো। গাড়িটা জ্যামে গিয়ে আটকাতেই গাড়ির কাঁচে নক করলো কেউ। ঘাড় ঘুরিয়ে সেদিকে তাকিয়ে একটা বাচ্চাকে দেখতে পেলো সে। বাচ্চাটাকে দেখে মনে হচ্ছে খুব ছোট সে। গাড়ির জানালা পর্যন্ত পৌঁছানো তারপক্ষে সম্ভব নয় বললেই চলে। কিন্তু অবাক করা ব্যাপার হলো, পিচ্চিটা জানালায় নক করছে। অদ্ভুত! ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকেই জানালার কাঁচ নামালো রাফিন। কাঁচ নামাতেই একগুচ্ছ বেলীফুলের মালা এগিয়ে দিয়ে বলে উঠলো,
— নিবেন সাহেব?
বাচ্চাটির কথার সাথে তাল মিলিয়ে বাচ্চাটির কাঁধের পাশ থেকে মাথা বের করে বলে উঠলো একটি মেয়ে,
— নিয়ে নিন না সাহেব।
কথাটা শুনে মেয়েটির দিকে তাকিয়েই অবাক হলো রাফিন। তার মতোই অবাক ওপাশের মেয়েটিও। মেয়েটি অবাক বিস্ময়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকেই দাঁত কেলিয়ে হেসে দিলো। বাম চোখটা টিপে দিয়ে বলে উঠলো সে,
— নিয়ে নিন না মিষ্টার ভিলেন।
# চলবে….