রোদ শুভ্রর প্রেমকথন পর্ব ১৪
#নৌশিন আহমেদ রোদেলা
আমার একমাত্র মামুর একমাত্র ছেলে শুভ্র ভাই। উনার সাথে আমার সাপে-নেউলে সম্পর্কটা জন্মগত নয়। আর উনাকে “আপনি” বলে ডাকাটাও আমার জন্মগত অভ্যেস নয়। মার কাছে শুনতাম, ছোট সময় শুভ্র ভাই আমাদের বাসায় এলে সারাটা দিনই নাকি উনার গলায় ঝুলে থাকতাম আমি নয়তো পেছন পেছন ঘুরে বেড়াতাম সারাক্ষণ । বলতে গেলে অনেকটাই “শুভ্র ভাই পাগল” টাইপ ছিলাম আমি। কিন্তু ধীরে ধীরে সবকিছুই পরিবর্তন হলো। আমরা থাকতাম শেরপুর শহরে আর উনারা থাকতেন ময়মনসিংহ।
আমি যখন মাত্র প্লে তে ভর্তি হই তখন উনি ক্লাস ফাইভের স্টুডেন্ট। ধীরে ধীরে উনার পড়ার চাপ বাড়ে আর ধীরে ধীরে আমার সাথে উনার যোগাযোগটাও কমে আসে। সাথে কমে আসে শুভ্র ভাইয়ের প্রতি আমার পাগলামোও। একসময় বাবা ডিসিশন নিলেন ময়মনসিংহে বাড়ি কিনবেন। মা তো অনেক খুশি যখন ইচ্ছে ভাইয়ের বাসায় ছুটতে পারবেন।
যায়হোক, বাবার সিদ্ধান্ত মতে শেরপুরের নিজের বাড়ি রেখে পাড়ি জমালাম ময়মনসিংহ। তখন আমি ক্লাস থ্রী তে পড়ি আর শুভ্র ভাইয়া ক্লাস এইটে কি নাইনে পড়েন। শুভ্র ভাই এজ ইউজাল ভালো স্টুডেন্ট তাই অলওয়েজ পড়াশোনা নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। আমরা ময়মনসিংহ থাকলেও তার সাথে আমার দেখা হয় নি বললেই চলে। আমরা তখন তৃষালে একটা ভাড়াবাড়িতে থাকতাম আর উনারা থাকতেন চড়পাড়ায় নিজস্ব বাড়িতে।
তৃষাল আর চড়পাড়ার মাঝে দূরত্ব অনেক। এতো টাইম নষ্ট করে এখানে আসা মানেই উনার পড়াশোনার লস। বলতে গেলে ব্যাপক লস। আমিও ছিলাম ঘরকুণো টাইপের মেয়ে তাই আর মামুর বাড়িতেও যাওয়া হয়ে উঠে নি তেমন । ততদিনে শুভ্র ভাই আর আমার পরিচিয়টা হয়েগিয়েছিলো নামে মাত্র পরিচয়। আমি শুধু এটাই জানতাম আমার একটা মামাতো ভাই আছে।যে কিনা অনেক বেশি টেলেন্টেট। উনিও হয়তো আমার সম্পর্কে এতোটুকুই জানতেন!
তারপর ২০১৫ সাল, আমি তখন জিএসসি এক্সাম দিয়েছি মাত্র। সেই সময়ই চড়পাড়ায় মামুর বাসা থেকে দশ -পনের মিনিটের দূরত্বে জায়গা কিনে বাসা কমপ্লিট করলেন বাবা। আমরাও উঠে পড়লাম নতুন বাড়িতে। নতুন বাড়িতে উঠার পর সবাইকে যখন দাওয়াত করা হলো তখনও শুভ্র ভাই এলেন না। উনি তখন সুদূর চট্টগ্রামে চুয়েটের কোনো একটা ক্লাসে ইঞ্জিনিয়ারিং এর বই মুখস্থ করছেন। মার কাছে শুনেছিলাম, উনার মনটাও নাকি তখন ছিলো ব্যাপক খারাপ। বেচারা এডমিশনের আগে আগে অসুস্থ হয়ে পড়ায় বুয়েটে চান্স পায় নি বলে তখন সে ছিলো ব্যাপক হতাশ। তার কি আর তখন এসব মিলাদ -মাহফিলে মন দেবার সময় আছে?
একদম না। এর পরের দু’বছর উনি আমাদের বাসায় বেশ কয়েকবারই এসেছেন কিন্তু কাকতালীয়ভাবে আমার সাথে দেখা হয়ে উঠে নি। উনি যখন এসেছেন দেখা গেল আমি স্কুলে বা কোচিং এ নয়তো ঈদের ছুটিতে চলে এসেছি গ্রামের বাড়ির দিকে। আবার আমি যখন মামুদের বাসায় গিয়েছি তখন দেখা গেছে শুভ্র ভাই তখন চট্টগ্রামে। বছরের বেশির ভাগ সময় উনি চটগ্রামেই পড়ে থাকতেন। ভার্সিটিতে ভারি রকমের ছুটি পেলেই বাড়ি ফিরতেন উনি নয়তো না।
এভাবে দু’দুটো বছর কেটে যাওয়ার পর এলো উনার সাথে আমার দেখা হওয়ার দিন। একই শহরে থাকার পরও পুরো ১১ বছর পর উনার সাথে আমার দেখা হতে চলেছিলো সেদিন । ব্যাপারটা সত্যিই অদ্ভুত। আমি নিজে যখন ভেবেছি নিজের কাছেও ব্যাপারটা ভীষণ অদ্ভুতই লেগেছে। এনিওয়ে এবার মেইন পয়েন্টে আসা যাক, উনার সাথে যখন আমার দেখা হয় তখন ২০১৭ সাল, আমি মাত্রই দশম শ্রেনীতে উঠেছি। জানুয়ারি মাসের প্রথমদিকের
শীতের রাত ছিলো ওটা। আমি চুলগুলো দুই বেনী করে মাথায় লাল টকটকে একটা শীতের টুপি পড়েছিলাম। গায়ে ছিলো একটা সাদা টি-শার্টের সাথে কালো জিন্সের জ্যাকেট তারসাথে ছিলো কালো রঙের প্লাজু। সবাই মিলে ড্রয়িং রুমে লুডু খেলছিলাম ঠিক তখনই কলিং বেলের শব্দ কানে এলো। একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারা করতে করতে শেষ পর্যন্ত আমাকেই উঠতে হলো দরজা খোলার জন্য। ধীর পায়ে হেলে দুলে দরজা খুলে তাকাতেই দেখি মামানি। মামানি মানেই আমার জন্য এক্সট্রা আদর। তাই মামানিকে দেখেই খুশিতে লাফিয়ে উঠে দৌঁড়ে গিয়ে মামানিকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলাম,
— কেমন আছো তুমি মামানি? কতোদিন আসো না। আমাকে তো ভুলেই গেছো।
মামানি শুধু হেসে কপালে চুমু খেয়েছিলেন সেদিন। আমিও হেসে মামানিকে ছেড়ে দাঁড়াতেই চোখে পড়েছিলো একটি ছেলে। মামনির পেছনে একটু দূরেই পকেটে হাত রেখে স্ট্রেট দাঁড়িয়ে আমার দিকেই তাকিয়ে ছিলেন উনি। গায়ে এ্যাশ রঙের টি-শার্টের সাথে ব্লু জ্যাকেট। আমি অবাক চোখে তাকিয়েই ছিলাম শুধু। প্রথমত, ছেলেটাকে আমি চিনি না। দ্বিতীয়ত, ছেলেটা একটু বেশিই সুন্দর ছিলো কিনা! হা হা হা এখন ভাবলেই হাসি পায় তখন কতো বুদ্ধুরাম ছিলাম আমি। সেদিন মামানি ঘরে ঢুকে বলেছিলো, “কি রে শুভ্র? ভেতরে আয়।” তখনই বুঝতে পেরেছিলাম এটাই আমার বিখ্যাত মামাতো ভাই, আমার শুভ্র ভাই। আমি সেদিন দৌঁড়ে আমার রুমে চলে গিয়েছিলাম। কি ভীষণ লজ্জাটায় না পেয়েছিলাম সেদিন,উফফ!
কিছু মুহূর্তের জন্য ভেবেছিলাম আর উনার সামনেই যাবো না আমি কিন্তু মার চেঁচামেচিতে সেদিনও বের হতে হলো আমায়। আমি যখন বের হলাম ড্রয়িংরুমে শুভ্র ভাইয়া ছিলেন না। সেই সুবাদে সবার সাথে আবারও হাসি ঠাট্টায় মেতে উঠেছিলাম আমি। শুভ্র ভাইয়ার কথাটা একরকম ভুলেই গিয়েছিলাম। গল্পের মাঝেই আম্মু হঠাৎ বলে উঠছিলো,
— রোদ? ছাদ যে আচঁড়ের বয়াম শুকাতে দিয়েছিলাম সেটা তো আনা হয় নি রে। চট করে গিয়ে নিয়ে আয় তো। তোর মামানিকে এক বয়াম আচঁড় দিয়ে দিবো। যা যা,, জলদি যা।
আমিও আর দেরী করি নি। মার কথায় দৌড়ে গিয়েছিলাম ছাদে। ছাদে গিয়ে বয়ামগুলো হাতে নিবো তার আগেই পেছন থেকে কারো কন্ঠ ভেসে এলো কানে,
— এই পিচ্চি? এদিকে তাকাও।
নির্জন ছাদে অপরিচিত কারো কন্ঠ শুনে আমি তো ভয়ে মরি মরি অবস্থা। মনে মনে দোয়া দুরুদ পড়ে পেছনে না ঘুরেই দৌড় দিবো দিবো অবস্থা ঠিক তখনই ডানহাত ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে দাঁড় করালেন আমায়। আমি চোখ মুখে একরাশ ভয় ভাসিয়ে সামনে তাকাতেই দেখি কোনো ভূত নয় শুভ্র ভাই । যদিও তখন তিনি ভূতের চেয়েও বেশি ভয়ঙ্কর ছিলেন আমার জন্য।
শুভ্র ভাইয়া একদম ফর্সা একজন মানুষ তারসাথে ঠোটগুলোও কালচে লাল।আমার আপু,ভাইয়া,আম্মু, মামানি,মামু সবাই একদম সাদা ফর্সা তাই ফর্সা মানুষ দেখে আমি অভ্যস্ত কিন্তু উনি একদমই অন্যরকম ছিলেন। সাদা মুখের সাথে খোঁচা খোঁচা দাঁড়িগুলো খুব মানিয়েছিলো সেদিন। সুঠাম বড়সড় শরীর ছিলো উনার ওই হিসেবে আমি ছিলাম পিঁপড়া টাইপ। আর হওয়ারও ছিলো তাই আমি তখম মাত্র দশম শ্রেনীর স্টুডেন্ট আর উনি ইঞ্জিনিয়ারিং তৃতীয় বর্ষের ধামড়া ছেলে। আমি যখন উনার দিকে চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে থাকতে ব্যস্ত তখন উনি হাত ছেড়ে দিয়ে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন,
— কোন ক্লাসে পড়ো তুমি পিচ্চি? নাম কি? বাসা কোথায়?
উনার কথায় চরম অবাক হয়েছিলাম আমি। আমার বাসায় দাঁড়িয়ে থেকেই আমার বাসার কথা জিগ্যেস করছেন উনি, কি অদ্ভুত! আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আবারও একই কথা জিগ্যেস করেছিলেন উনি। আমি ভয়ে ভয়ে আস্তে করে বলেছিলাম,
— আমার নাম রোদ। এটাই আমার বাসা।
এটুকু বলতেই চোখ বড়বড় করে তাকিয়েছিলেন উনি। আবারও হাত টেনে ধরে নিজের একদম কাছে দাঁড় করিয়ে বিস্ময় মাখা কন্ঠে বলে উঠেছিলেন,
— তুই রোদ? ওই পুচকিটা? আই কান্ট বিলিভ!
#চলবে,,
(বাকিটুকু পরে লিখবো। এখন আর লিখতে ইচ্ছে করছে না)
রোদ শুভ্রর প্রেমকথন সম্পূর্ণ গল্পের লিংক
https://kobitor.com/rodsuvro/