রোদ শুভ্রর প্রেমকথন পর্ব ১৭
#writer: নৌশিন আহমেদ রোদেলা
৪.
সেদিন একঘন্টা চল্লিশ মিনিটে আমি মাত্র ৯ টা অংক করতে পেরেছিলাম বাদবাকি ১১ টায় বাকি পড়ে ছিলো। ভয়ে আমার আত্মা শুকিয়ে যায় যায় অবস্থা। শুভ্র ভাই তখন একদৃষ্টিতে আমার দিকেই তাকিয়ে ছিলেন আর আমি ব্যস্ত ছিলাম ক’টা মার খাবো তার হিসেব করতে।সেদিন ভেবেছিলাম আজই হয়তো এই পৃথিবীতে আমার শেষ দিন। শুভ্র ভাইয়ের যে শক্তি তাতে দুটো মারলেই আমার এই জগতে থাকার ইচ্ছে ঘুচে যাবে তার উপর অতোগুলো মার! মরণ তো আমার নিশ্চিত। হা..হা.. হা.. কিন্তু সেদিন শুভ্র ভাইয়া আমাকে মারেন নি। তার থেকেও ভয়ানক কাজ করেছিলেন। ফোনের ক্যামেরা অন করে বলেছিলেন,
— মোট একশোবার কান ধরে উঠবস করবি৷ আমি এটা ভিডিও করে সবাইকে দেখাও। নে, শুরু কর।
আমার অবস্থা তখন “ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি” টাইপ।এর থেকে তো মারই ভালো ছিলো আপাতত মানসম্মানটা বেঁচে যেতো। আমি আবারও মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে নিলাম জীবন গেলেও কান ধরে উঠবস করবো না। এজ ইউজাল, আমার এই প্রতিজ্ঞাটাও বেশিক্ষণ টিকে নি। শুভ্র ভাই এতো জোড়ে টেবিলে আঘাত করছিলেন যে চমকে ওঠে দৌঁড়ে গিয়ে কানে ধরে দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম আমি। সেদিন যদি জানতাম যে, আমাকে মারতে গেলে উনার হাত কাঁপে তাহলে কখনোই কান ধরে উঠবস করতাম না আমি। কখনোই না। কিন্তু ভাগ্য খারাপ হলে যা হয় আরকি। আবারও হারতে হলো আমাকে আর শুভ্র ভাই আমার বিরুদ্ধে আরেকটা অশ্র পেয়ে গেলেন খুব সহজেই। সেদিনের পর থেকে দুটো বছর আমি এই ভয়েতেই আড়ষ্ট ছিলাম, না জানি কখন সবাইকে ভিডিওটা দেখিয়ে দেন শুভ্র ভাই । এরপর আরো পাঁচদিন ময়মনসিংহ ছিলেন উনি। প্রতিটি দিন নতুন নতুন পদ্ধতিতে জ্বালিয়েছেন আমায়। মূলত এই ছয় দিনেই আমার লাইফে জমরাজের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে গিয়েছিলেন উনি। ১৫ জানুয়ারির দিকে উনি আবারও চট্টগ্রাম ফিরে যান। উনার যাওয়ার খবর শুনে সেদিন কি খুশিই না হয়েছিলাম আমি। পারলে সবাইকে মিষ্টি বিতরণ করবো এমন অবস্থা হয়েছিলো আমার। প্রায় একঘন্টা বিছানায় উঠে লাফালাফি করে বাইরে বের হতেই খেয়েছিলাম এক বাঁশ। দরজার বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিলেন শুভ্র ভাই। আমাকে বের হতে দেখেই আম্মুকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠেছিলেন,
— ফুপ্পি? আম্মু রোদকে একটু ডাকে। আমাকে পাঠালো ওকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আমি ওকে নিয়ে যাই? এক দু’ঘন্টার মাঝে আবার দিয়ে যাবো।
— কেনো ডেকেছে?
— আজ তো আমি চলে যাবো। মা কতোকিছু রান্না করেছে। রোদকে তো একটু বেশি ভালোবাসে হয়তো সেগুলো টেষ্ট করানোর জন্যই ডেকেছে ওকে। নিয়ে যাবো ফুপ্পি?
— তোর বোন তুই নিয়ে যাবি, তাতে বলার কি আছে? নিয়ে যা। তা তোর বাস কয়টায়?
— রাত বারোটায় বাস ফুপ্পি। আসি তাহলে…
কথাটা বলেই আমাকে টেনেটুনে বাসা থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন উনি। উনাদের বাসায় এসে বাসার ভেতরে না ঢুকে চুপচাপ টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন ছাঁদে। ভয়ে আমার আত্মা ধুরুধুরু করছিলো তখন। উনি যখন পেছন ফিরে ছাদের দরজা লাগিয়ে দিয়েছিলেন তখন আমার হাত-পা চলা বন্ধ হয়ে গেছে প্রায়। মনে মনে শুধু একটা কথায় ভাবছিলাম, এই ছেলেটা নিশ্চয় এখন ছাদ থেকে ফেলে দিবে আমায়। কিন্তু কেনো ফেলবে? কি করেছি আমি? উনার জিন্সের পকেটে আচার ঢুকিয়ে দিয়েছি বলে ? কিন্তু জিন্সটা তো পরে আমাকে দিয়েই পরিষ্কার করিয়েছেন উনি। তাহলে? এতো এতো চিন্তা যখন কানের কাছে ভো ভো করছিলো ঠিক তখনই আমার দিকে তেঁড়ে এলেন উনি। আমি তখন ভয়ের চোটে শুকনো গলায় বারবার ঢোক গিলে চলেছি। উনি আমার দুপাশে ছাঁদের রেলিং-এ হাত রেখে দাঁতে দাঁত চেপে বলেছিলেন,
— ওই ছেলেটা কে?
উনার কথায় অবাক হয়েছিলাম আমি। মুখ কাঁচুমাচু করে বলেছিলাম,
— কোন ছেলে?
— যার সাথে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলছিলি তুই। রণিত বলছিলো ওটা নাকি তোর বয়ফ্রেন্ড। এই বয়সে বয়ফ্রেন্ড পালিস?
উনার চোখ-মুখ রাগে লাল হয়ে ছিলো তখন৷ কি বলবো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। উনি কোন ছেলের কথা বলছেন তাই তখন বোধগম্য হচ্ছিলো না আমার৷ ভয় পাওয়া চোখে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কোনো কাজই ছিলো না আমার। উনি আবারও ধমকে উঠে বলেছিলেন,
— কথা বলিস না কেন? কে ওই ছেলে? তোর বয়ফ্রেন্ড? এতো প্রেম করার শখ? নাকি আরো কিছু করার শখ আছে? ফুপ্পিকে বলে বিয়ে দিয়ে দিই তাহলেই সব সমস্যার সমাধান। রাস্তায় রাস্তায় প্রেম করে বেড়াবি আর আমাদের বংশের নাম খারাপ করবি তা তো হবে না।
— কককোন ছেলে ভাইয়া? আ আ আমার কোনো বয়ফ্রেন্ড নেই। আমি তো ছেলেদের সাথে তেমন একটা কথাও বলি না । বিলিভ মি..আমি সত্যি বলছি।
আমার কথায় তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়েছিলেন উনি। ব্যাথা পাওয়া আমার সেই ডান হাতটা আবারও চেপে ধরে যন্ত্রনার শেষ সীমানায় নিয়ে গিয়ে রাগী গলায় বলেছিলেন,
— তাহলে আজ দুপুরে স্কুল থেকে ফেরার সময় কার সাথে কথা বলছিলি তুই?লাল শার্ট পড়নে ছিলো ছেলেটার।
— ওহ ওটা? আমি তো ওই ছেলেকে চিনিই না ঠিকঠাক। আমাকে হঠাৎ করে এসে জিগ্যেস করলো স্কুল ছুটি হয়েছে কি না? সাথী নামের কোনো মেয়েকে চিনি কি না? এবং মেয়েটা স্কুল থেকে বেরিয়েছে কি না। ব্যস! এটুকুই।
— তাহলে রণিত কেন বললো ওটা তোর বয়ফ্রেন্ড?
— আজব তো! রণিত কে তাই তো চিনি না আমি।
আমার কথায় দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিলেন উনি। কিছুক্ষণ আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে বলে উঠেছিলেন,
— নেক্সট টাইম রাস্তাঘাটে এসব দেখলে ডিরেক্ট ফুপ্পিকে জানাবো। আমি চলে যাচ্ছি বলে এটা ভাবিস না খবর পাবো না আমি। এলাকার সব ছেলেদের বলা আছে। এসব কিছু দেখলেই ডিরেক্ট আমাকে জানাবে ওরা। বুঝেছিস?
সেদিন উনার সেই ধমকিতে পুরো দু’দুটো বছর আমি রাস্তা ছাড়া বামে ডানেও তাকিয়ে দেখি নি কখনো। সেদিন রাতে উনি আমাকে কিছু একটা গিফ্ট দিয়েছিলেন। গিফ্টটা কি ছিলো ঠিক খেয়াল নেই আমার। তবে এটা মনে আছে জিনিসটা আমি নিবো না বলে ছাদ থেকে ফেলে দিয়েছিলাম। আর তার শাস্তি হিসেবে পুরো দু’ঘন্টা উইথআউট সোয়েটার ছাদের ফ্লোরে বসে থাকতে হয়েছে আমায়। তখন জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি, কি ঠান্ডাটায় না ছিলো তখন। তারপর প্রায় একমাস উনার সাথে কোনোরকম যোগাযোগ ছিলো না আমার৷ সেই একমাস আমার জীবনের সবচেয়ে সুখের দিন ছিলো। উনার ওই ঠান্ডা থেরাপির পর প্রায় এক সপ্তাহ জ্বরে ভুগেছিলাম আমি। কি ভয়ানক ছিলো সেই দিনগুলো। তারপর ফেব্রুয়ারি মাসের চৌদ্দ তারিখ রাত ১১ টা ৫৫ মিনিটে দীর্ঘ একমাস পর উনি ফোন দিলেন আমায়।এতো রাতে উনার ফোনটা পেয়ে বেশ অবাকই হয়েছিলাম আমি।অবাকের পালা শেষ করে ফোনটা কানে নিয়ে সালাম দিয়েই বলেছিলাম,,
— শুভ্র ভাই এতো রাতে?
— ওয়ালাইকুমুস সালাম,,নিচে আয়।
— মানে??(অবাক হয়ে)
— মানে হলো।।তোরা যে দু’ তলায় থাকিস।।তার সিঁড়ি বেয়ে তর তর করে নিচে নেমে আয়।।আমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি।
— মানে কি?এতো রাতে আপনি রাস্তায় কি করছেন??
— মশাদের সাথে পিকনিক করি,,ডাফার।।এতো কথা বলিস কেন??নিজে নামতে বলছি নিচে নাম ব্যস
— আমি পারবো না।।এতো রাতে নিচে ইম্পসিবল।
— সবই পসিবল।।দুই মিনিটের মধ্যে নিচে আয়,,
— পারবো না।
— তুই পারবি,,,তোর বাপসহ পারবে
— তাহলে বাবাকেই বলুন,, রাখছি
— খবরদার রোদ,,,দুইমিনিটের মধ্যে নিচে না নামলে তোর অবস্থা যে আমি কি করবো,,তুই চিন্তাও করতে পারবি না।
কথাটা বলেই ফোনটা কেঁটে দিয়েছিলেন শুভ্র ভাই।কি একটা ঝামেলা ,,শুভ্র ভাইকে তখন আমি যথেষ্টই ভয় পেতাম,,আম্মুকে তারচেয়েও বেশি ভয় পেতাম।।তবুও ভয় ভয় পায়ে আম্মুর রুমে উঁকি দিলাম,,আম্মু তখনো ঘুমায় নি।।কি করবো এখন?অনেক ভেবে আম্মুকে বললাম,,নিচ তলার মাহিমা আপুর কাছ থেকে ক্যালকুলেটার আনতে যাচ্ছি আমারটা কাজ করছে না।।
আম্মু কিছুক্ষণ আমার দিকে নিরব দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে নিজের কাজে মন দিলেন।।আমিও দোয়া দুরুদ পড়ে বেরিয়ে এলাম রাস্তায়।সোডিয়ামের আলোতে স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছিলাম এলোমেলো চুলে,, একরাশ ক্লান্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন শুভ্র ভাই।।গায়ে ব্রাউন টি-শার্ট,,একটা ব্ল্যাক জ্যাকেট,,ব্লু জিন্স,,কেটস আর ঘাড়ে একটা ব্যাগ।।আমাকে দেখেই ক্লান্তিমাখা হাসি দিয়েই বলে উঠলেন,,
— এসেছিস??
— হুম,,এখানে কোনো ডেকেছেন??বাসায় চলেন।।
— নাহ,,এতো রাতে বাসায় গেলে ফুপি সন্দেহ করবে।
— কেনো??
— তুই বুঝবি না হাদা,,
কথাটা বলেই একগুচ্ছ টকটকে লাল গোলাপ বাড়িয়ে দিলেন আমার দিকে।।।কোনো ফর্মালিটি না করেই বলে উঠলেন,,,
— ফুলগুলো হাতে নে।।তোর জন্য।।খবরদার রোদ ছুড়ে ফেলবি না বা এটা বলবি না যে নিবি না।।নিজের টিউশনির টাকায় কিনেছি,,টাকার মায়া বড় মায়ারে পিচ্চি,,সো ছুড়াছুঁড়ি করবি তো এক চড়।
— কিন্তু এগুলো কেন??(কনফিউশড হয়ে)
— দেখ রোদ,,,তুই আমার দিকে ভাই ভাই নজরে তাকালেও আমি কিন্তু তোর দিকে ওলওয়েজ প্রেম প্রেম নজরেই তাকাই।।বুঝছিস??বুঝিস নি??
আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম যে বুঝি নি।।উনি চরম বিরক্তি নিয়ে আমার হাতে একটা উপন্যাসের বই গুঁজে দিয়ে বলে উঠলেন,,,
— তোর বুঝা লাগবে না।।এখন উত্তর দক্ষিণ না তাকিয়ে সোজা রুমে যা।।
— কিন্তু??
— দেখ রোদ,,পুরো আট ঘন্টা জার্নি করে আসছি।।এখন বাসায় গিয়ে রেস্ট নিবো কাল আবারো বেক করতে হবে।। সো কাহিনী না করে যা এখান থেকে…
আমিও আর কিছু না বলে ঘুরে দাঁড়ালাম।।দুই কদম ফেলতেই পিছে থেকে ডাক পড়লো,,
— রোদ??
— হু(পিছু ফিরে)
— এদিকে আয়…
আমি উনার কাছে আসতেই নিচে বসে আমার পায়ের দিকে হাত বাড়ালেন। আমি ওমনি লাফিয়ে উঠলাম,”,করেন কি শুভ্র ভাই??” তার উত্তরে বিরক্তিমাখা চাহনী দিয়ে বলে উঠলেন,,”এতো লাফাস কেন??চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাক।।তোর পা কেটে নিয়ে যাবো না।” আমিও এবার চুপচাপ মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে রইলাম।।উনি আমার পায়ে একটা কিছু পড়িয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েই কানের কাছে ফিসফিস করে বলে উঠলেন,,”ভালোবাসি তোকে,, এটা বুঝতে এতোক্ষণ লাগে??”
কথাটা শুনে দুই মিনিট হ্যাং মেরে দাঁড়িয়ে থেকে বোকার মতে বলেছিলাম,,” আপনি কি আমায় প্রোপোজ করছেন শুভ্র ভাই?”আমার কথাটা কানে যেতেই ধমকে উঠেছিলেন উনি ।।সেদিন উনার এক ধমকে দৌড়ে পালিয়েছিলাম ।। হি হি হি। সেই দিনের কথা এখনও মনে পড়লে হাসিতে লুটোপুটি খাই আমি। সেদিন উনার কথার ভাবার্থ না বুঝলেও এখন বুঝি। কিন্তু উনার কাছে এখনও অনেকটাই অবুঝ আমি। উনার বুঝানো এতো এতো কেমিস্ট্রিও আমি বুঝতে নারাজ। তাই নিয়ে কতো আফসোস তার…আহা! কতো হতাশা। এখানেই উনার হার আর আমার জিত।
রোদ শুভ্রর প্রেমকথন সম্পূর্ণ গল্পের লিংক
https://kobitor.com/rodsuvro/