রোদ শুভ্রর প্রেমকথন পর্ব ১৯
#নৌশিন আহমেদ রোদেলা
৭.
বিশ বিশটা বার কান ধরে উঠবস করে যখন বাসায় ফিরলাম তখন রাত বাজে —- ৯ঃ১৫। বাসায় এসে রুমে ঢুকতেই দেখি বিছানায় বেশ আয়েশ করে বসে আছে আপু। তারহাতে সাদা একটি কাগজ। আমাকে দেখেই কিছুটা ভাব নিয়ে কাগজটা মুখের উপর ধরে উচ্চকন্ঠে পড়তে লাগলো সে।
শ্যামলতা,
তুমি কি জানো? বর্ষাকাল প্রেমে পড়ার জন্য একটি আদর্শ সময়। এই সময় বৃষ্টির প্রাণোচ্ছ্বলতার সাথে মিশে যায় প্রেয়সীর মন মাতানো রূপ। শান্ত,স্নিগ্ধ ঘোর ধরানো সব। কিন্তু আমার ক্ষেত্রেই সবকিছু ব্যতিক্রম। আমি কোনো ঢালা বর্ষায় নয়, কোনো এক শীতের কুয়াশাচ্ছন্ন রাতে প্রেমে মত্ত হয়েছি। বাচ্চা বাচ্চা চেহারার বড় বড় চোখ! অবাক করা চাহনী আর দুই ঠোঁটের মায়াবি হাসি। কি ভয়ানক একটি দিন ছিলো সেদিন! সেই রাতের কথা ভাবলেও কেঁপে উঠি আমি। “ভালোবাসা” — নামক শব্দটা যে এতো যন্ত্রণা ধরায় সেদিনই জানতে পারি আমি। একটুতেই ভয় পেয়ে কেঁপে উঠা।
আমাকে দেখেই চোখে-মুখে পালিয়ে যাওয়ার আকুতি, আরো বেশি পাগল করে তোলে আমায়। তাকে দেখার পর থেকেই দুটো রোগে আক্রান্ত হয়েছি আমি। প্রথমত প্রেমরোগ যার ঔষধ শুধুমাত্র সে-ই। অন্যটি হলো কালোরোগ। অবাক হচ্ছো? হলেই বা কি? রোগের উৎপত্তি তো তুমিই, শ্যামলতা। সেদিন রাতে কি পড়েছিলে মনে আছে তোমার? কালো রঙের জ্যাকেট আর কালো প্লাজু…সেই মুহূর্ত থেকে “কালো” রঙটাকেই পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর রঙ বলে মনে হয় আমার। অন্যকোনো রঙ যেন চোখেই পড়ে না।
কি একটা সর্বনাশ করে দিলে আমার! এখন দিন নেই রাত নেই হুটহাটই কালো রঙে মোড়ানো শ্যামলতাটাকে দেখতে ইচ্ছে হয় আমার। আরো কিছু ইচ্ছে করে… বলবো? না থাক, তুমি লজ্জা পাবে। আমি চাই না, তুমি চিঠি পড়ে লজ্জা পাও। তাহলে এই কাগজের টুকরোটির উপরও খুব হিংসে হবে আমার। লজ্জা পেলে আমার সামনে পাবে। দেখতে হলে শুধু আমিই দেখবো। দেখেছো? কি পরিমান হিংসুটে হয়ে গেছি আমি। তুমি খুব খারাপ শ্যামলতা।
খুব খারাপ!এই যে দেখো, মায়ের এই লক্ষ্মী ছেলেটাকে কিভাবে নষ্ট করে চলেছো তুমি। তোমাতে এতো নেশা কেন শ্যামলতা? প্রতিটি মুহূর্তে এতো দমবন্ধ অনুভূতি নিয়ে কেনো আসো তুমি? জ্যোস্না ভরা রাতে ঠিকরে পড়া চাঁদের আলোয় আবারও কালো শাড়িতে মোড়ানো শ্যামলতাকে দেখতে চাই আমি। তার জন্যই আমার দমবন্ধকর সব প্রস্তুতি।
আমি…
চিঠিটা পড়ে চোখ তুলে তাকালো আপু। চোখদুটো চিকচিক করছে ওর। আপুর মতি গতি তেমন একটা সুবিধার ঠেকছে না আমার। আর শুভ্র ভাইয়ের দেওয়া চিঠিটাই বা কোথায় পেলো আপু? আমি একটা ঢোক গিলে নিজেকে স্বাভাবিক রেখে ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। আপু বিছানা থেকে লাফিয়ে নেমে আমার সামনে দাঁড়িয়ে ভ্রু নাচিয়ে বললো,
— কি? এই আমি টা কে?
আমি না বোঝার ভান করে বললাম,
— আম্মুর বড় মেয়ে।
আপু অবাক হয়ে বললো,
— মানে?
আমি চুড়ি খোলে রাখতে রাখতে বললাম,
— তুমি কি জিজ্ঞেস করেছো?
— আমি জিগ্যেস করেছি, আমি কে?
— আমিও তো সেটাই বলছি। তুমি হলে আমার বাবার জ্যেষ্ঠ কন্যা, আমার ভাইয়ের দুইমাত্র বোনের বড়জন, আরাফ ভাইয়ার হবু বউ এবং আমার হবু বরের হবু বড় আপা।
আপু কনফিউজড হয়ে বললো,
— কিসব ফালতু কথা বলছিস তুই? এই চিঠিটা কে লিখেছে সেটা বল।
আমি অবাক হওয়ার চেষ্টা করে বললাম,
— আমি কি জানি? চিঠি তোমার হাতে। চিৎকার করে করে পড়ছিলেও তুমি তাহলে আমি কি করে জানবো?
আপু রেগে বললো,
— এই একদম আমাকে ওভারটেক করার চেষ্টা করবি না। তলে তলে এসব করে বেড়াস তুই? আর আমি কিচ্ছু জানি না?
আমি শাড়ির পিন খুলতে খুলতে বললাম,
— আমি তলে তলে কিচ্ছু করি না।তাই তুমি কিছু জানো না আপু। আমি যা করি সব প্রকাশে।
আপু আমার দিকে অবিশ্বাস্যের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
— মিথ্যুক!একদম মিথ্যে কথা বলবি না। আরাফ আমাকে বলেছিলো, ” রুহি? আমার বিশ্বাস রোদ অবশ্যই কারো সাথে রিলেশনে আছে।” কিন্তু আমি? এই অধম! বোনের প্রতি অগাধ বিশ্বাস রেখে তাকে ঝাড়ি দিয়ে দিয়েছি, অথচ আজ?
আমি ওয়াশরুমের দিকে হাঁটতে হাঁটতে বললাম,
— আহারে! কষ্ট!
— এই , একদম চুপ। ফাজিল মেয়ে। শুভ্র ভাইও বলেছিলো তোর ওপর নজর রাখতে। আমি তো ভেবেছিলাম তুই শুভ্র ভাইয়ের প্রতি ঝুঁকে আছিস কিন্তু এখানে তো টোটালি অন্য কাহিনী….তলে তলে “আমি-তুমি” চলছে অথচ আমি এক বান্দা যে কিনা কিচ্ছু জানি না?কিচ্ছুটি না? এই শাড়িটাও নিশ্চয় ওই ছেলেটাই দিয়েছে? মামানির বাসায় যাওয়ার নাম করে নিশ্চয় ওই ফাজিল ছেলেকে কালো শাড়ি দেখিয়ে এলি?
আমি ওয়াশরুম থেকে বের হতেই চুপ করলো আপু। ইমোশনাল হয়ে বললো,
— নিচে যে ছেলেটার সাথে কথা বললি সেই ছেলেটাই বুঝি তোর বয়ফ্রেন্ড? আমি বারান্দা থেকে দেখেছি। দেখতে তো ভালোই, আমাকে এটলিস্ট বলতে পারতি। ইউ হার্ট মি রোদু!
আপুর কথায় ভ্রু কুঁচকে তাকালাম। নিচে কোন ছেলের সাথে কথা বলেছি মনে করার চেষ্টা করলাম। কয়েক সেকেন্ড ভাবতেই ইভা আপুর ভাই ইভান ভাইয়ার কথা মনে পড়লো আমার। উনি শুভ্র ভাইয়ের বন্ধু। গেইটের কাছে দেখা হয়ে যাওয়ায়, “কেমন আছি?” এটুকুই জিগ্যেস করেছিলেন শুধু। পাশে শুভ্র ভাইয়াও ছিলেন হয়তো অন্ধকারে দাঁড়ানোতে তাকে চোখে পড়ে নি আপু। আমি গায়ে কাঁথা টেনে চোখ বন্ধ করে বললাম,
— যত বকবক করার করতে থাকো বাট আম্মুর কানে গেলে খবর আছে। আরাফ ভাইয়ার নামে এমন বাজে বাজে কথা বলবো… তোমার বিয়েটা খট করে ভেঙে যাবে, হুম।
— কিহ! তুই আমাকে থ্রেড দিচ্ছিস? এই দিনটিও দেখতে হলো আমায়? দাঁড়া, কালকেই শুভ্র ভাইকে তোর রিলেশনের কথা বলবো আমি। উনি তো চৌদ্দ দুনিয়ার সবাইকে বলে দিবেন। তখন বুঝবি মজা…বিএফের জন্য বোনকে ধমকি? নাহ, এটা আমি মানবো না। কিছুতেই না।
সেদিন রাতে চুপ করলেও পরের দিক বিকেলে যথারীতি শুভ্র ভাইকে বিচার দিয়ে দিলো আপু। বাসার কম্পিউটারে কিছু প্রবলেম দেখা দেওয়ায় শুভ্র ভাইকে ডেকে পাঠিয়েছিলো ভাইয়া। তখনই সুযোগ বুঝে শুভ্র ভাইয়ের হাতে চিঠিটা ধরিয়ে দিয়ে ইচ্ছে মতো বকবক শুরু করে দিলো সে।
শুভ্র ভাই চিঠিটা দেখে হতবাক। বিস্ময় নিয়ে একবার আমার দিকে তাকিয়ে পরমুহূর্তেই হালকা কেশে উঠলেন উনি। আমিও খানিকটা অস্বস্তিতে পড়ে গেলেও হাসি চেপে রাখতে পারলাম না। লজ্জা আর হাসি দুটোকে ঢাকতেই অন্যদিকে মুখ ফেরালাম । শুভ্র ভাইয়ের অবস্থা তখন “ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি!” টাইপ লজ্জায় মাথায় উঠাতে পারছে না বেচারা। চিঠিতে যায় লেখা হোক না কেন, আমার সামনে কখনো এই টাইপের কথা বলেন না উনি তাই হয়তো এতো লজ্জা উনার।
এদিকে আপুর মুখের দোলাই তো আছেই। আপু যদি জানতো ওর এতো সুন্দর সুন্দর কথাগুলো সামনে বসে থাকা মানুষটার জন্যেই তাহলে নির্ঘাত এখানেই হার্ট অ্যাটাক করতো সে। কারন শুভ্র ভাই শুধু আমার নয় আপুর জন্যও ভয়ের জম। এক পর্যায়ে, আপুর কথার মাঝেই উঠে দাঁড়ালেন শুভ্র ভাই। আমার হাতে চিঠিটা গুঁজে দিয়ে হালকা কেশে আপুকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
— বোন রে? চুপ যা। এভাবে ছেলেটাকে গালি দিলে তোর বোন বিয়ের আগেই বিধবা হয়ে যাবে। প্রেমই তো করতাছে করতে দে না। তুই তোর ফার্মের মুরগীরে সামলা। দয়া করে আমার কান খাস না।
আপু অবাক হয়ে বললো,
— শুভ্র ভাই? আপনি এ কথা বলছেন? রোদকে কিছুই বলবেন না আপনি?
— আমি কি বলবো? তুই যে সারাদিন ফার্মের মুরগী নিয়ে থাকিস তোরে কিছু বলেছি? তাহলে ওকে বললে কেমন দেখায় না? প্রেকটিক্যালি চিন্তা কর। তোর বোন এখন বড় হয়েছে ক’দিন পর বিয়ে হয়ে বাচ্চার মা ও হয়ে যাবে, এখন কি আমার কিছু বলা সাজে? তার থেকে তুই তোরটার কাছে যা আর তোর বোন…তোর বোনের কোথাও যাওয়ার দরকার নেই সে ঘরেই থাকুক কিন্তু আপাতত তুই সামনে থেকে যা বোন। প্লিজ…
হাসিতে পেট ফেটে যাচ্ছিলো আমার। শুভ্র ভাইকে এই প্রথম লজ্জা আর অস্বস্তিতে পড়তে দেখলাম আমি। কোনোরকম ঠোঁট কামড়ে নিজেকে সামলে নিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে ফোনে মুখ গুঁজে বসে রইলাম। আপু যেতেই শুভ্র ভাইয়া দাঁতে দাঁতে চেপে বললেন,
— আই সয়ার! এতো গালি জিন্দেগীতে কেউ দেয় নি আমায়। তোর বোনটাকে কবে যে চান্দে পাঠাবো আমি আল্লাহই ভালো জানে।
আমি কিছু বললাম না। শুভ্র ভাই রুম থেকে বেরুতেই হাসিতে ফেঁটে পড়লাম আমি। হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যাওয়ার অবস্থা আমার। তবে, শুভ্র ভাইকে লজ্জা পেলে ততটা খারাপ লাগে না বরং একটু বেশিই কিউট লাগে!
#রোদবালিকা
রোদ শুভ্রর প্রেমকথন সম্পূর্ণ গল্পের লিংক
https://kobitor.com/rodsuvro/
(এক মুঠো রোদ আজ দিবো। লেখিকার সামান্য মন খারাপ তাই লেট হচ্ছে বাট পেয়ে যাবেন আজই। তবে তোকে চাই হয়তো কাল দিবো। ধন্যবাদ)