রোদ শুভ্রর প্রেমকথন পর্ব ৩৬
#লেখিকা- নৌশিন আহমেদ রোদেলা
____________________
বৃষ্টি আর ঘুমের মাঝে অদৃশ্য এক বন্ধন আছে। বৃষ্টি হলেই ঘুম ভালো হবে, এ যেন চিরন্তন সত্য। বৃষ্টি আর ঘুমের মাঝের এই নিগূঢ় প্রেমের লজিক্যাল কারণটা সঠিক জানা নেই আমার। তাই বলে আমি তাদের প্রেমবিরোধী নই বরং পক্ষপাতী। আশ্বিন মাসের নয় তারিখ। এ সময় প্রকৃতির ঢালা বর্ষন খুব একটা চোখে পড়ে না। তবে এবার পড়ছে। রাত-দিন অন্ধকার করে বৃষ্টি হচ্ছে। এই বৃষ্টিময় সকালে সারা শরীর কাঁথায় মুড়িয়ে শুয়ে আছি আমি। ঘুমটা তখন মাখোমাখো হয়ে এসেছে। এমন সময় কাঁথা টেনে ধরে বিকট শব্দে ডেকে উঠল কেউ। আমি বিরক্তি নিয়ে চোখ পিটপিট করে তাকালাম। সাথে সাথেই চাওড়া হাসল রাফিয়া। লাফিয়ে বিছানায় ওঠে তুমুল ঝাঁকুনি দিয়ে বলল,
—-” এই রোদু? ওঠ! আমি শেরপুর থেকে চলে এলাম আর তুই ঘুম থেকেই উঠতে পারলি না? এগারোটা বাজল বলে। জেঠীমণি এখনই ঝাড়ু নিয়ে আসবেন তোকে মারতে।”
আমি ভ্রু কুঁচকে তাকালাম। হঠাৎ ঘুম ভাঙায় রাফিয়ার অনবরত বলা কথাগুলো বুঝতে খানিক বেগ পেতে হল আমায়। চোখ-মুখ কুঁচকে বললাম,
—-” সকাল সকাল কই থেকে টপকাইলি রে তুই? আর কোনো কাম কাজ নাই? সুযোগ পেলেই দৌঁড়ায় দৌঁড়ায় চলে আসিস। মেজো কাকি এত সহজে আসতে দিল তোকে?”
রাফিয়া দাঁত কেলিয়ে বলল,
—-” আসতে দিবে না মানে? আম্মা তো নিজেই চলে আসছে।”
আমি বিস্ফারিত চোখে তাকালাম। সটান ওঠে বসে বললাম,
—-” মেজো কাকিও এসেছে নাকি?”
রাফিয়া বালিশে ঠেস দিয়ে বসল। ফোনে ব্যস্ত হয়ে বলল,
—-” শুধু আম্মা কেন? ভাইয়া আর বাবাও এসেছে।”
রাফিয়ার কথায় বেশ অবাক হলাম। কোলের ওপর বালিশ টেনে নিয়ে বললাম,
—-” বলিস কি? হঠাৎ সপরিবারে আগমনের কারণটা কি বল তো? তাও আবার এমন বৃষ্টির দিনে?”
রাফিয়া আড়চোখে আমার দিকে তাকাল। ফোনটা পাশে রেখে বলল,
—-” আজকে যে রুহি আপুকে দেখতে আসছে জানিস না তুই? এবার বোধহয় বিয়েটা হয়েই যাবে। ছেলেটা দেখতে ভালোই। আব্বুর অফিসের কলিগের ছেলে। সোনালী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার।”
আমি হঠাৎ করেই চেঁচিয়ে উঠে বললাম,
—-“কি?”
রাফিয়া নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল,
—-” হুম। আপুও হয়ত জানে না। আরাফ ভাইয়ার সাথে আপুর প্রেমটা সাকসেসফুল হওয়ার চান্স এখন ১% হয়ে গেল রে। বিষয়টা কষ্টের!”
আমি বিরক্ত চোখে তাকালাম। হঠাৎ করেই উপলব্ধি করলাম রাফিয়ার কথায় ভয়ানক বিরক্ত হচ্ছি আমি। বিরক্তিটা মাথার নিউরনে নিউরনে রিনরিন করে বাজছে। আমার বিরক্তির মাঝেই দরজা থেকে দমফাটা গলায় ডেকে উঠলেন আম্মু,
—-” রোদু? উঠলি না এখনও? প্রতিদিন দুপুর অব্দি ঘুমানোটা কেমন স্বভাব? যেমন ভাই তার তেমন বোন। বাপের আস্কারা পেতে পেতে লাটে উঠছে। কিছু বলতে গেলেই বলবে, আহা! ডেকো না। রাত জেগেছে মেয়েটা। বলি, রাত জেগে কোন দুনিয়া উদ্ধার করেছে সে? মানুষের ছেলেমেয়েরা সারারাত পড়াশোনা করেও কাকভোরে ঘুম থেকে উঠছে। নামায পড়ছে। আর আমার ছেলেমেয়েদের দেখো? এসব আর সহ্য হয় না আমার। বিরক্ত হয়ে গিয়েছি এই সংসারে। মাঝে মাঝে নিজের মাথায় কুপ মেরে মাথাটা দু’ভাগ করে ফেলতে ইচ্ছে করে।”
এটুকু বলে দম নিলেন আম্মু। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে সুর বদলে বললেন,
—-” বাবু ওঠ। ঘরটা একটু গুছা মা। বাবু? এই রোদু? উঠলি না?”
আমি বিরক্তি নিয়ে বললাম,
—-” উফ মা! উঠেছি তো।”
—-” বিছানায় বসে থাকলে তাকে উঠা বলে? বিছানা থেকে নেমে হাঁটাচলা করলে না ঘুম ভাঙবে। তাড়াতাড়ি ওঠ।”
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাফিয়াকে পাশ কাটিয়ে বিছানা ছাড়লাম। ফ্রেশ হয়ে চুলগুলোকে হাতখোঁপা করতে করতে বসার ঘরে আসতেই চোখ পড়ল মামানির ওপর। হাতে একটা খাতা নিয়ে বসে আছেন উনি। আম্মুর সাথে মিলে কিছু একটার লিস্ট বানাচ্ছেন। আমাকে দেখেই মুচকি হাসলেন মামানি। হাসিমুখে বললেন,
—-” একটু আমাদের বাসায় যা তো রোদু। ফ্রিজে মশলা বাটা আছে। ওখান থেকে লাল আর নীল রঙের বাটিটা আনবি। নরমালে কিছু কাঁচা মরিচ আছে ওগুলোও আনিস।”
আম্মু বাঁধা দিয়ে বললেন,
—-” কাঁচা মরিচ কিনে আনলেই হবে ভাবি।”
—-” অতগুলো মরিচ থাকতে কিনবে কেন? এমনিতেও দু-একদিন পর নষ্ট হয়ে যাবে সব।”
এটুকু বলে আমার দিকে তাকালেন মামানি। তাড়া দিয়ে বললেন,
—-” কি রে? দাঁড়িয়ে পড়লি কেন? জলদি যা। আর শোন? শুভ্রকে বলবি তোর মা ডেকে পাঠিয়েছে। রাহাত ওর জন্য অপেক্ষা করছে। একসাথে বাজারে পাঠাব দু’জনকে। জলদি যা।”
আমি বিরস মুখে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে নড়েচড়ে উঠলাম। দরজার পাশে রাখা ছাতাটা নিয়ে রাফিয়াকে ডাকলাম। শুভ্র ভাইদের বাসায় যাব শুনেই লাফিয়ে রাজি হয়ে গেল রাফিয়া। মনে মনে চরম বিরক্ত হয়ে প্যাচেপ্যাচে কাঁদায় পা রাখলাম। বৃষ্টির দিনে এই একটা সমস্যা, কিছুক্ষণের জন্য বেরুলেও জামা কাপড়ের অবস্থা থাকে না । মামানিদের বাসায় গিয়েই সোজা রান্না ঘরে চলে এলাম আমরা। ফ্রিজ খুলতে খুলতে বললাম,
—-” তুই গিয়ে শুভ্র ভাইকে ডেকে আয় রাফিয়া। আমি কাঁচা মরিচ আর মশলা বের করছি।”
রাফিয়া খুশি হয়ে শুভ্র ভাইয়ের রুমের দিকে এগিয়ে গেল। কিছুক্ষণের মাঝে ফিরেও এল। আমি ফ্রিজের দিকে দৃষ্টি রেখেই বললাম,
—-” বলেছিস?”
রাফিয়া মুখ কাঁচুমাচু করে বলল,
—-” শুভ্র ভাইয়া ঘুমোচ্ছে। তুই গিয়ে ডেকে তোল। আমি পারব না। পরে যদি রেগে গিয়ে ধমক দেয়?”
—-” ধমক দিলে তুইও ধমক দিবি। ধমকে ধমকে কাটাকাটি।”
—-” শুভ্র ভাইয়াকে ধমক দিবো আমি? পাগল হয়েছিস? উনি আমার দিকে তাকালেই তো ভয় লাগে আমার। তুই যা বোন। আমি এগুলো ব্যাগে ভরছি…..তুই বরং উনাকে ভর থুক্কু উনাকে তোল।”
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাফিয়ার দিকে তাকালাম। রাফিয়া অসহায় মুখ করে বলল,
—-” প্লিজ!”
আমি কিছু না বলে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম। শুভ্র ভাই কম্বল পেঁচিয়ে ঘুমোচ্ছেন। ফুল স্পিডে ফ্যান চলছে। আলো নেভানো। চারপাশে কেমন ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব। এই ঠান্ডা দিনে ফ্যানের কি প্রয়োজন, কে জানে? আমি কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকেই সুইচ টিপে আলো জ্বালালাম। ফ্যানটা অফ করে বিছানার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। মৃদু গলায় ডাকলাম,
—-” শুভ্র ভাই? শুভ্র ভাই?”
আমার ডাকে উনার মধ্যে কোনো হেলেদুল দেখা গেল না। খানিকটা ঝুঁকে এসে আবারও ডাকলাম,
—-” শুভ্র ভাই?”
উনি এবার কম্বলের ভেতর থেকে উঁকি দিলেন। আমাকে দেখেই ভ্রু কুঁচকে বললেন,
—-” কি সমস্যা ছকিনার মা?”
আমি তেতে উঠে বললাম,
—-” ছকিনার মা মানে?”
উনি নির্বিকার ভঙ্গিতে বললেন,
—-” তা নয়ত কি? সত্যি করে বল তো, তোর কি আর কোন কাজ নেই? আমি ঘুমালেই দৌঁড়ায় দৌঁড়ায় ডিস্টার্ব করতে চলে আসিস। আমি তো আর সাধে বলি না যে, তুই তোর বাপের মত হয়েছিস। দু’জনেই সেইম। একজন শান্তি নষ্ট করে তো অন্যজন ঘুম।”
আমি নাক ফুলিয়ে বললাম,
—-” খবরদার বাবাকে নিয়ে কিছু বলেছেন তো। খাবারে বিষ মিশিয়ে মেরে দেব একদম।”
শুভ্র ভাই বিস্ফারিত চোখে তাকালেন। বিস্ময় নিয়ে বললেন,
—-” কি ভয়ানক মেয়ে রে তুই। মুখের ওপর মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছিস। তাও আবার বাড়ি বয়ে এসে? ফাজিল মেয়ে।”
—-” আপনার সাথে ফাও ঝগড়া করার কোন ইচ্ছে আমার নেই। আম্মু আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছে। আর আমি হলাম তার পেয়াদা।”
শুভ্র ভাই কপাল কুঁচকে তাকালেন,
—-” কেন? ডেকে পাঠাল কেন?”
আমি দাঁত কেলিয়ে বললাম,
—-” জামাই আদর করতে।”
উনি আগ্রহী গলায় বললেন,
—-” সত্যি?”
—-” আপনার মাথা! ভাইয়াকে আর আপনাকে বাজারে পাঠাবে বলে লিস্ট হাতে বসে আছে। তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে কামলাগিরি করেন গিয়ে যান।”
আমার কথা শেষ না হতেই মুখ-চোখ ডেকে আবারও শুয়ে পড়লেন শুভ্র ভাই। আমি বিস্ময় নিয়ে বললাম,
—-” আরেহ্ শুয়ে পড়লেন কেন আবার?”
উনি কম্বলের ভেতর থেকেই উত্তর দিলেন,
—-” প্রথম কথাটা পছন্দ হয়েছে। দ্বিতীয় কথাটা পছন্দ হয় নি। এই ছ্যাতছ্যাতে দিনে বাজারে যেতে পারব না আমি।”
—-” উফ! ঢং করবেন না তো। আজ আপুকে দেখতে আসবে। মামানি আপনাকে আর্জেন্ট যেতে বলেছে।”
শুভ্র ভাই এবার কম্বল সরিয়ে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন। খুশি খুশি গলায় বললেন,
—-” সত্যি? কিন্তু, তার জন্য আমাকে বাজারে যেতে হবে কেন? সত্যি করে বল তো? তোর বাপ কি আমাকে বৃষ্টির পানিতে ডুবিয়ে, নিউমোনিয়া বাঁধিয়ে খুন করতে চায়ছে? মেয়ে বিষ খাওয়াবে আর বাপ নিউমোনিয়ার রোগী বানাবে। কি সাংঘাতিক বুদ্ধি রে বাবা! যেমন মেয়ে তার তেমন বাপ।”
আমি দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,
—-” আপনি জাস্ট অসহ্য একটা লোক।”
এমন সময় দরজার কাছে এসে দাঁড়াল রাফিয়া। ভেতরে উঁকি দিয়ে বলল,
—-” ওগুলো ব্যাগে ভরে নিয়েছি। শুভ্র ভাইয়া উঠেছে?”
শুভ্র ভাই দরজার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন। উঠে বসতে বসতে বললেন,
—-” বাহ্ আমাকে নিতে এতগুলো পেয়াদা? নিজেকে খুব স্পেশাল স্পেশাল লাগছে আজ। তো, কেমন আছ রাফিয়া?”
রাফিয়া খুশি খুশি গলায় বলল,
—-” ভালো আছি ভাইয়া।”
আধাঘন্টাময় নানা ঢং সং করে আমাদের বাসায় যাওয়ার জন্য তৈরি হলেন উনি । কিন্তু গেইটের কাছে এসেই বাঁধল আরেক বিপত্তি। ফ্ল্যাট থেকে নেমে আসার সময় ছাতা আনতে ভুলে গিয়েছেন শুভ্র ভাই। অথচ, বাইরে রাত-দিন অন্ধকার করা বৃষ্টি। উনি চাইলেই উপরে গিয়ে ছাতা আনতে পারেন। চারতলা উঠা আহামরি কোন ব্যাপার নয়। কিন্তু উনি যাবেন না। আমাদের দুটো ছাতার মধ্যে থেকেই একটি উনার চায়। আমি বিরক্তি নিয়ে বললাম,
—-” আপনি একা একটা ছাতা নিয়ে নিলে আমরা ভিজে যাব না?”
উনি নির্বিকার ভঙ্গিতে বললেন,
—-” ভিজলে ভিজলি। তাতে আমার কি? তবে চাইলে আমার ছাতায় আশ্রয় নিতেই পারিস। আমি মাইন্ড করব না।”
উনার কথাটা শুনেই মেজাজ চটে গেল আমার। গেইটের পাশে পড়ে থাকা ইট নিয়ে মাথা ফুটো করে দেওয়ার তুমুল ইচ্ছে জাগল। নিজেকে কোনরকম শান্ত করে রাফিয়াকে উদ্দেশ্য করে বললাম,
—-” রাফিয়া? তুই শুভ্র ভাইয়ের সাথে যা। আমি একাই যাব।”
রাফিয়া খুশি মনে রাজি হলেও শুভ্র ভাই রাজি হলেন না। চোখে-মুখে অসন্তোষ ফুটিয়ে তুলে বললেন,
—-” তোরা লেডিস লেডিস এক ছাতায় যা। আমি কারো সাথে ছাতা শেয়ার করব না।”
কথাটা বলে এক মুহূর্ত দাঁড়ালেন না উনি। আমাদের রেখেই গটগট করে গেইট পেরিয়ে গেলেন। আমি রাগে দুঃখে কুঁকড়ে গেলাম। বিরবির করে বললাম,
—-” শালা ফাজিল কোথাকার। আস্ত একটা গন্ডার।”
আমার কথাটা কানে যেতেই অনুযোগের সুরে বলে উঠল রাফিয়া,
—-” ধুর! শুধু শুধু বকছিস কেন? গায়ে গা লাগবে ভেবেই হয়ত সাথে নিলেন না। কতটা ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ ভাবতে পারছিস?”
আমি বিরক্ত চোখে তাকালাম। ছাতা খুলতে খুলতে বললাম,
—-” ব্যক্তিত্বসম্পন্ন না ছাতা। কয় দিন চিনিস তুই উনাকে? দেখতে ভদ্র মনে হলেও পেট ভরা শয়তানী। আরেকবার যদি ‘শুভ্র ভাইয়া’ ‘ শুভ্র ভাইয়া’ করতে শুনেছি তো ইট তুলে মারব। শুভ্রর চামচা কোথাকার।”
রাফিয়া হেসে বলল,
—-” আচ্ছা যা। এখন থেকে শুধু শুভ্র বলব। তাহলেই আর শুভ্র ভাইয়া ডাকটা শুনতে হবে না তোকে। হ্যাপি?”
রাফিয়ার কথায় রাগী চোখে তাকালাম। আমার রাগ দেখেই হাসতে লাগল রাফিয়া। তার খিলখিল হাসির শব্দেই যেন মুখরিত হল চারপাশ।
______________________
রান্না ঘরের দরজা আর আমাদের শোবার ঘরের দরজার মধ্যবর্তী জায়গাটুকুতে দাঁড়িয়ে আছি আমি। আপুকে দেখতে আসা আর রাফিয়াদের আগমনে ধীরে ধীরে সব কাজিনগুলোই জুটে গিয়েছে বাসায়। আলিম ভাইয়া থেকে শুরু করে তনিমা আপু পর্যন্ত দুপুর নাগাদ হাজির। আমরা সবাই এখানে দাঁড়িয়েই ফিসফাস করছি। মাঝেমাঝে বড়দের চোখ রাঙানোর শিকারও হচ্ছি। বসার ঘরে মেহমানরা বসে আছেন। তাদের বলা কথাগুলোও মাঝেমাঝে উঁকিঝুঁকি দিয়ে শোনার চেষ্টা চালাচ্ছি। হঠাৎ করেই তনিমা আপুর মাথায় চাটি মেরে বলে উঠলেন শুভ্র ভাই,
—-” ওই? খালি হাতে এসেছিস কেন? ক’দিন পর তো এটা তোর মামা শশুড়ের বাড়ি হয়ে যাবে। দেবর, ননদদের জন্য কিছু আনাটা তোর নৈতিক দায়িত্ব।”
তনিমা আপু কিছু বলবেন তার আগেই দ্রুত পায়ে এদিকে এলেন মামানি। নিচু গলায় বললেন,
—-” রুহিকে তৈরি থাকতে বল। একটু পরেই ডাকবে ওকে।”
এটুকু বলেই আবারও দ্রুত পায়ে বসার ঘরের দিকে চলে গেলেন মামানি। আপু ততক্ষণে দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। কেঁদে কেটে চোখ ফুলিয়েছে, ফর্সা নাকটাও টুকটুকে লাল হয়ে আছে। আমরা সবাই আপুর মলিন মুখের দিকে তাকালাম। শুভ্র ভাই আপুর মাথায় হাত রেখে বললেন,
—-” কি রে? চোখ ফুলিয়েছিস কেন? তোর সাথে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে আমার। মনোযোগ দিয়ে শুনবি, ওকে?”
আপু চোখ তুলে তাকাল। শুভ্র ভাই গম্ভীর ভাব নিয়ে বললেন,
—-” আমরা এখানে যে কয়টা দাঁড়িয়ে আছি সবকটায় কিন্তু তোর ভাই-বোন। আমাদের সবারই তোর ওপর একটা হক আছে। আমাদের প্রতি তোরও কিছু দায়িত্ব আছে। আর আজকে সেই মহৎ দায়িত্ব পালন করার পালা। আর সেই দায়িত্বটা হল টাকা আদায়। মেয়ে দেখার পর টাকা দেওয়ার রেওয়াজ আছে জানিস তো? সেই টাকার ভাগীদার আমরা। আজকে ওদের দেওয়া টাকায় সন্ধ্যাপার্টি করব আমরা। দেখাদেখি শেষ হলে সরাসরি বলবি, ওই? টাকা দিবি কিনা বল। ২/৩ হাজার টাকার নিচে দিলে ডিরেক্ট অনশন করবি, বুঝলি? দরকার পড়লে আমরা তোকে সাপোর্ট দিব। কোন সমস্যা নাই।”
শুভ্র ভাইয়ের কথায় হেসে ফেলল সবাই। আপুও মৃদু হাসল। শুভ্র ভাই কপাল কুঁচকে বললেন,
—-” হাসলে চলবে না। অধিকার আদায় করতে হবে। এবারের সংগ্রাম টাকা আদায়ের সংগ্রাম। তোরা কি বলিস পোলাপানস্?”
সবাই হেসে বলল,
—-” ইয়েসসসস্।”
বিকাল ৩ টা। কিছুক্ষণ আগেই মেহমান বিদায় হয়েছে। মেহমানদের যাওয়ার পর পরই সব কাজিনরা মিলে খাবার টেবিল অধিকার করে বসেছি। খাওয়া-দাওয়ার পাশাপাশি তুমুল আড্ডা চলছে। আড্ডার বিষয়বস্তু হল ‘ ছেলেপক্ষের এক হাজার টাকা’ শুভ্র ভাইয়ার অসহযোগ আন্দোলন খুব একটা সুবিধা করতে পারে নি। আপুর হাতে এক হাজার টাকা গুঁজে দেওয়ার পর আপু আর প্রত্যুত্তর করে নি। ফলে, সেই এক হাজার টাকাকে পুঁজি করেই জমবে আড্ডার আসর। আড্ডার একপর্যায়ে ‘এক হাজার টাকা’ থেকে ‘সেই মেয়েটা’ বিষয়বস্তু হল। আলিফ ভাইয়া আফসোসের গলায় বললেন,
—-” তোদের পাশের বাসার ওই স্টাইলিশ মাইয়াটাকে পটানোর চেষ্টা করলাম রে রোদু। কিন্তু লাভ হল না। ভাইয়াও ট্রাই মারছে কিন্তু পুরাই ফ্লপ।”
তনিমা আপু ভ্রু কুঁচকে বললেন,
—-” ভাইয়াও ট্রাই মারছে মানে?”
আলিফ ভাইয়া দাঁত কেলিয়ে হাসল। আলিফ ভাইয়ার পিঠে ধুম করে একটা কিল বসিয়ে বলে উঠলেন অদুত ভাইয়া,
—-” বিভীষণ কোথাকার। নিজের ভাইয়ের সংসারে আগুণ লাগাস। ওর কথা বিশ্বাস কর তুমি তনিমা? হি ইজ আ বিগ লায়ার।”
রাফিয়া জ্ঞানী জ্ঞানী ভাব নিয়ে বলল,
—-” আমার মনে হয় তোমাদের দু’জনের মধ্যে কিছু চলছে আলিফ ভাই। ওই মাইয়া তোমাকে কিছু ইঙ্গিত করছে।”
আলিফ ভাইয়া অবাক হয়ে বললেন,
—-” তাই নাকি?”
—-” হু। ওই মাইয়া তোমার পোস্টে লাভ রিয়েক্ট দেয়। কিন্তু সব পোস্টে দেয় না। প্রথম বার এক পোস্ট অন্তর রিয়েক্ট দেয়। তারপর চারটা পোস্ট অন্তর রিয়েক্ট দেয়। তারপরের বার তিনটা পোস্ট অন্তর রিয়েক্ট দেয়। বুদ্ধি আছে। বুঝলা কিছু?”
আলিফ ভাইয়া গোল গোল চোখে তাকিয়ে বললেন,
—-” তো?”
রাফিয়া অত্যন্ত বিরক্ত গলায় বলল,
—-” আরে? একটা রিয়েক্ট চারটা রিয়েক্ট তিনটা রিয়েক্ট…. বুঝলা না? ইট’স মিন আই লাভ ইউ।”
আলিফ ভাইয়া বিস্ফারিত চোখে তাকালেন। খুশি খুশি গলায় বললেন,
—-” বলিস কি? কি সাংঘাতিক!”
আমি হেসে বললাম,
—-” একটা রিয়েক্ট চারটা রিয়েক্ট তিনটা রিয়েক্ট দিয়ে কিন্তু আই হেইট ইউ ও হয়। ধোঁকা খেও না আলিফ ভাই।”
আলিফ ভাই বিমর্ষ চোখে তাকালেন,
—-” নব প্রেমিক হৃদয়টাকে ভেঙে চুরমার করে দিলি রে বইন। আহ্ গ্যাস্টিক গ্যাস্টিক ফিলিংস হচ্ছে। ”
আলিফ ভাইয়ার কথায় হেসে উঠল সবাই। রাফিয়া প্রতিবাদ করে বলল,
—-” হেইট ইউ বুঝাতে লাভ রিয়েক্ট কেন দিবে? অবশ্যই এ্যাংরি দিবে।”
আপু হাসল। রাফিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলল,
—-” তোর ভাষ্যমতো মেয়েটার বুদ্ধি আছে। সুতরাং, একটা স্পেশাল কোডে নিশ্চয় এতো ইজি সলিউশন দেবে না সে। লাভ এর উল্টো এংরি এমনও হতে পারে।”
অদুত ভাই কপাল কুঁচকে বললেন,
—-” আহারে! কত ট্যালেন্ট তগো। মাইয়ার রিয়েক্ট নিয়ে এমন আলোচনা লাগাইছিস মনে হচ্ছে “মিশন ইম্পসিবল” এর সক্রিয় কর্মী তোরা। রাফিয়া, বইন? তোর কি আর কোনো কাম কাজ নাই? কে, কখন, কয় সেকেন্ড পর কার পোস্টে রিয়েক্ট দিল, উল্টা রিয়েক্ট দিল নাকি তক্তা রিয়েক্ট দিল এগ্লাও খেয়াল রাখিস তুই? তোরে একটা ১০ টাকা দামের দিস্তা খাতা গিফ্ট করব আমি। ওটা তোর পুরস্কার। ওখানে সাজিয়ে গুছিয়ে লিখে রাখবি সব। হেল্প হবে। রাতুল? তোর বোনের কি ট্যালেন্ট দেখছিস? এই ট্যালেন্টকে তো ভেস্তে দেওয়া যায় না।”
অদুত ভাইয়ের কথায় ঠোঁট টিপে হাসতে লাগল সবাই। রাতুল ভাইয়া হারে কামড় বসাতে বসাতে বলল,
—-” হু। খুব ট্যালেন্ট। একদম গাধার মত ট্যালেন্ট।”
রাতুল ভাইয়ার কথায় হুহা করে হেসে উঠল সবাই। রাফিয়া নাক-মুখ ফুলিয়ে বলল,
—-” ভাইয়া? তুই অলওয়েজ আমায় অপমান করিস কেন বল তো?”
রাতুল ভাইয়া নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল,
—-” অপমান কাহাকে বলে না জানি আমি।”
—-” আমি বাবাকে বিচার দেব।”
—-” আমিও আম্মাকে বিচার দেব।”
রাফিয়া নাক ফুলিয়ে বলল,
—-” কুত্তা, হারামি, ফাজিল।”
—-” হ। ওইটাই বলতাছি। সব তুই।”
আলিফ ভাইয়া বিরস মুখে বললেন,
—-” ঝগড়া থামিয়ে আমাকে সান্ত্বনা দে। ফিলিং বহুত কষ্ট।”
রাফিয়া খুশিতে গদগদ হয়ে বলল,
—-” আমি তোমাকে সান্ত্বনা দেব। শুধু সান্ত্বনা নয় সান্ত্বনার সাথে এক ডাম ইংরেজি স্যামপেথিও দিব। তার আগে বল, শুভ্র ভাইয়ার গার্লফ্রেন্ডের নাম কি?”
আলিফ ভাইয়া ভ্রু উঁচিয়ে বললেন,
—-” সুবিধাবাদী মহিলা।”
—-” প্লিজ আলিফ ভাই বল না। প্লিজ…প্লিজ।”
অদুত ভাই হেসে বললেন,
—-” তোর না বহুত বুদ্ধি? বুদ্ধি খাটা।”
—-” অনেক খাটিয়েছি ধরতে পারছি না। একেক সময় একেক জনের প্রতি সন্দেহ লাগে। আলিফ ভাইয়া? ও আলিফ ভাইয়া? বল না প্লিজ।”
আলিফ ভাই দাঁত কেলিয়ে বললেন,
—-” বড় ভাইয়ের বউয়ের নাম মুখে নিতে নেয়। পাপ লাগে, তাই না রোদ?”
আলিফ ভাইয়ার কথায় থতমত খেয়ে গেলাম আমি। রাফিয়া অবাক হয়ে বলল,
—-” এটা আবার কবে কার হাদিস?”
রাতুল ভাইয়া ধমকে উঠে বললেন,
—-” তোরে এখন বই বের করে দেখান লাগবে? বেশি কথা কস কেন?”
রাফিয়া মুখ ফুলিয়ে বলল,
—-” তাহলে ছবি দেখাও।”
—-” বড় ভাইয়ের হবু বউয়ের ছবি রাখাটা পাপের ওপর পাপ, মহাপাপ। তবে, আমি তোকে ক্লু দিতে পারি।”
রাফিয়া উৎসাহ নিয়ে বলল,
—-” বেশ বল তাহলে।”
আলিফ ভাইয়া সোজা হয়ে বসলেন। মুখে গাম্ভীর্যতা এনে বললেন,
—-” মনোযোগ দিয়ে শুনবি ওকে? খুবই ক্লোজ একটা ক্লু দিব।”
রাফিয়া আগ্রহ নিয়ে মাথা নাড়ল। আলিফ ভাইয়া গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন,
—-” শুভ্র ভাই যেদিকে তাকাবে তুইও ঠিক সে দিকেই তাকাবি। শুভ্র ভাই বায়ে তাকাতে পারে, তারপর ডানে, আবার বায়ে… সামনে, পিছে বিভিন্ন জায়গায় তাকাতে পারে। তোর কাজ হল ভাইয়ের সাথে তাকান। বায়ে, ডানে যেদিকেই তাকাক না কেন তুইও তাকাবি। তারপর যখন ভাই স্থির চোখে কোন রমণীর দিকে তাকাবে তখনই বুঝে যাবি সেই রমনীই তাহার হৃদয় হরণকারিণী। বুঝেছিস?”
রাফিয়া কনফিউজড হয়ে মাথা নাড়ল। সাথে সাথেই হাত বাড়িয়ে বলে উঠলেন আলিফ ভাই,
—-” তাহলে দশটা টাকা দে।”
অদুত ভাই হেসে বললেন,
—-” যদি এই ব্যাপার হয় তাহলে আমি আরেকটু ক্লিয়ার করে বলি। শুভ্র যার দিকে একটু তেমন তেমন নজরে তাকাবে সেই হল সেই নারী। পানির মত সহজ বুঝলি। একবার নামটা জানলেই ছাদ থেকে লাফিয়ে মরে যেতে ইচ্ছে করবে তোর। এত ক্লোজ মানুষটাকে না চেনার অপরাধে তোর নিজেকে আংশিক মৃত্যুদন্ড দিতে ইচ্ছে করবে। তবে, শুভ্র না চাইলে তোর বুঝাটা একটু মুশকিল। আমরাও বুঝি নাই। কিন্তু জানার পর মনে হয়েছে কত ক্লু ছিল। এত বলদ কেন আমরা? তোরও সেইম ফিল হবে… অপেক্ষা। এখন বিশটা টাকা দে।”
রাফিয়া মুখ ঝামটি দিয়ে বলল,
—-” তোমরা সব কয়টা ছেঁচড়া।”
অদুত ভাই কিছু বলবে তার আগেই শুভ্র ভাইয়ের আগমন ঘটল। ভাইয়ার সাথে কোথাও পাঠান হয়েছিল উনাকে। শুভ্র ভাই ক্লান্ত ভঙ্গিতে আমার পাশের চেয়ারে বসলেন। পাশে বসেই প্লেটের সবচেয়ে বড় মাংসটা নিয়ে মুখে পুড়ে নিলেন। আমি রাগী গলায় বললাম,
—-” এটা কি হল?”
উনি আমার কথার পাত্তা না দিয়ে বললেন,
—-” কি নিয়ে আলাপ হচ্ছিল তোদের?”
আলিফ ভাই বাঁকা হেসে বললেন,
—-” তোমার ‘তাকে’ নিয়ে। রাফিয়া তাকে চিনতে চায়। এজন্য সবাইকে ঘুষ দিচ্ছে।”
শুভ্র ভাই হেসে বললেন,
—-” এত কষ্ট করার কি ছিল? আমাকে জিগ্যেস করলেই বলে দিতাম।”
আমি আর রাফিয়া দু’জনেই চোখ বড় বড় করে তাকালাম। শুভ্র ভাই টেবিলের দিকে ঝুঁকে এসে বললেন,
—-” আমি তোমাকে একবার বলব। এই একবারে বুঝে যাওয়ার দায়িত্ব তোমার। সেকেন্ড টাইমের কোন অপশন নেই, ওকে?”
রাফিয়া মাথা নাড়ল। আপু আর তনিমা আপুও উৎসাহ নিয়ে তাকাল। শুভ্র ভাই মুচকি হেসে বললেন,
—-” তোমার ভাইয়ের বাবার ভাবির ভাতিজার ফুপির ছোট বাচ্চা।”
চোখের পলকে কথাটা বলে শেষ করলেন শুভ্র ভাই। আলিফ ভাইয়ারা হাসিতে ফেঁটে পড়লেন। রাফিয়া ‘হা’ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,
—-” এটা কি হল?”
শুভ্র ভাই চোখ টিপে বললেন,
—-” এটাই সায়েন্স।”
আবারও হাসল সবাই। নতুন উদ্যমে শুরু হল গল্পের আসর। উনাকে ঘিরেই কত গল্প, কত ঠাট্টা, কত মায়া!
#রোদবালিকা
রোদ শুভ্রর প্রেমকথন সম্পূর্ণ গল্পের লিংক
https://kobitor.com/rodsuvro/