রোদ শুভ্রর প্রেমকথন পর্ব ৪৫
#লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা
সারা শহর যখন শৈত্য প্রবাহের প্রকোপে দিশেহারা ঠিক তখনই ঢাকার পথে ছুঁটে চলেছি আমরা। বাসের জানালা দিয়ে বিকেলের নরম আলো আসছে। সেই সাথে আসছে হিমময় তীক্ষ্ণ বাতাস। বাসের জানালা আটকে দিয়েও বাতাসের কামড় থেকে রক্ষা পাওয়া যাচ্ছে না। চুলগুলো ছন্নছাড়ার মতো উড়ছে। শরীরটা থেকে থেকেই কাঁপছে। বিষাক্ত মনটা বিরক্তিতে চিমসে আছে। কলি আপুর বিয়ে উপলক্ষে বাধ্য হয়েই গোষ্ঠীসুদ্ধ ছুটতে হচ্ছে ঢাকা। গাড়িতে সিট নেই। বড় এবং ছোটরা দুই গাড়িতে ভাগাভাগি হয়ে গিয়েছে। কাজিনরা সব এক বাসে থাকলেও সিটের যাচ্ছে তাই অবস্থা। একজন সামনে তো একজন পিছনে। একজন মাঝখানে তো একজন ড্রাইভাইরের কোলে। উফ! এটাকে কি ফ্যামিলি ট্রিপ বলে?
গাড়ির সর্বশেষ সিটটির দু’সিট সামনেই বসেছি আমি আর রাফিয়া। দু’জনের মুখই থমথমে। বমি বমি ভাব। ঠিকঠাক এক ঘন্টাও হয় নি গাড়িতে ওঠেছি এর মধ্যেই বমি টমি করে বিদিগিস্তা কান্ড। রাফিয়ার অবস্থাটাও বেশ খানিকটা নুইয়ে এসেছে ততক্ষণে। আরো কিছুটা পথ এগিয়ে, হঠাৎ ব্রেক কষার ধকলটা সামলে উঠতে না পেরে আবারও বমি হলো আমার। বাসে থাকা অধিকাংশ চোখ আমার ওপর এসে পড়ল। আমাদের এই অবস্থা দেখে সামনে থেকে ওঠে এলেন শুভ্র ভাই। বিরক্ত গলায় বললেন,
‘ গাড়িতে উঠতে না পারলে উঠেছিস কেন? যে হারে বমি করছিস মনে তো হচ্ছে বিয়ে বাড়ি নয় মৃগী রোগী নিয়ে ডাক্তার বাড়ি যাচ্ছি। ইচ্ছে তো করছে চড়াইয়া- থাপড়াইয়া বাস থেকে নামিয়ে দেই, বেয়াদব।’
আমি দুর্বল চোখে উনার দিকে তাকালাম। মাথাটা এমনিতেই ধপধপ করছিল। উনার কথায় সেই ধপধপ ভাবটা আরো একটু জ্বলে উঠল। অপমান আর দুর্বলতার যৌথ প্রয়োগে মুখে কথা জুগাতে পারলাম না। গাড়ির সিটে গা এলিয়ে চোখ বন্ধ করলাম। এই অসহ্যকর লোকটিকে এতোটা গুরুত্ব দেওয়ার কোনো মানেই হয় না। শুভ্র ভাই কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে নরম গলায় বললেন,
‘ রাফিয়া, তোমার শরীর খারাপ লাগছে?’
রাফিয়া খুশিতে ঝলমল করে উঠল। কন্ঠস্বর যথাসম্ভব দুঃখী করার চেষ্টা করে বলল,
‘ জ্বী ভাইয়া।’
‘ পেছনের দিকে বসলে তো আরো খারাপ লাগবে। তুমি বরং একটা কাজ করো। উঠে গিয়ে সামনে আলিফের সাথে বসো। ওটা আমার সিট।’
রাফিয়া বিস্ময় চাপা দিয়ে বলল,
‘ তাহলে আপনি?’
শুভ্র ভাই নির্বিকার গলায় বললেন,
‘ আমাকে নিয়ে সমস্যা নেই। আমি তোমার সিটেই বসতে পারব। তুমি যাও, সামনে গিয়ে বসো। এখানে প্রবলেম হবে।’
রাফিয়া খানিকক্ষণ ইতস্তত করে উঠে গেলো। যাওয়ার সময় উচ্ছ্বাসিত কন্ঠে ধন্যবাদও জানাল। শুভ্র ভাই বেশ আয়েশ করে আমার পাশে বসলেন। আমার পাশে বসার সাথে সাথেই উনার রং পরিবর্তন হলো। রাফিয়ার সাথে করা অমায়িক ব্যবহারের ইতি ঘটিয়ে নিজস্ব রূপে অবতরণ করলেন। বিরক্ত গলায় বললেন,
‘ মেয়ে মানুষ মানেই সমস্যা। সিম্পল একটা বাস জার্নি করতেই নাকে-মুখে রক্ত উঠে যাচ্ছে। তোদেরকে এসব সভ্য দুনিয়ায় মানায় না, বুঝলি? তোরা বংশগত ভাবেই আমাজনের বাসিন্দা। তোদের উচিত গোষ্ঠীসুদ্ধ আমাজনে গিয়ে বসবাস করা। পৃথিবীর সভ্য বাসিন্দারা তো তোদের যন্ত্রণায় বাঁচতে পারছে না।’
উনার অদ্ভুত কথাগুলো বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ সহ্য করলেও এবার একটা তীক্ষ্ণ দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। উনার দিকে ঘুরে বসে ধারালো গলায় বললাম,
‘ আপনার সমস্যাটা কি? সবসময় এমন উদ্ভট কথা কোথায় পান আপনি? আজাইরা যত্তসব। আমার গোষ্ঠী বাদ দেন। আপনার মতো শুভ্র দুটো থাকলেই এই পৃথিবী রসাতলে যাবে। মানুষ সেচ্ছায় সুইসাইড করবে।’
শুভ্র ভাই ভ্রু উঁচিয়ে তাকালেন। বাঁকা হেসে বললেন,
‘ করতেই পারে। আজকালকার টিনেজ মেয়েরা প্রেমে পড়ে সুইসাইড টুইসাইড করে, এটা স্বাভাবিক। তাদের জন্মই হয় সুইসাইড করে মরে যাওয়ার জন্য।’
আমি দুইহাতে নিজের মাথা চেপে ধরে ঘন নিঃশ্বাস ফেললাম। রাগ মাখা থমথমে কন্ঠে জবাব দিলাম,
‘ আপনি যে কতটা হার্টলেস আর বিরক্তিকর সেই সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা আছে আপনার?’
উনি ভাবাবেগশূন্য গলায় বললেন,
‘ হয়ত আছে।’
‘ আপনি নিজেকে একটু বেশিই গুরুত্বপূর্ণ ভাবেন শুভ্র ভাই।’
‘ ভাবাভাবির কি আছে? আমি আসলেই গুরুত্বপূর্ণ।’
কথাটা বলে মৃদু হাসলেন উনি। আমার দিকে ঘন হয়ে বসে হাতে পানির বোতল ধরিয়ে দিলেন। কানের কাছে ফিসফিস করে বললেন,
‘ পাশের সিটের মেয়েটাকে দেখ। বারবার তাকাচ্ছে। আই থিংক শী ক্রাশড অন মি।’
কথাটা বলে সোজা হলেন উনি। একটু সরে বসে স্বাভাবিক গলায় বললেন,
‘ পানি খেতে খেতে ঝগড়া করো ছকিনার মা। তোর মতো ক্যাঙ্গারুর শরীরে পানি, রক্ত হেনতেন সবরকম শূন্যতা দেখা দেয়। পানি খা, ঝগড়া কর। ঝগড়া ছাড়া তো আর কিছু পারিসও না। ফাজিল!’
আমি পাশের সিটের মেয়েটির দিকে তাকালাম। আমার সাথে চোখাচোখি হতেই তাড়াহুড়ো করে চোখ ফিরিয়ে নিলো সে। রাগে শরীরটা জ্বলে উঠল আমার। বাসে কি ছেলের অভাব আছে নাকি? সবাইকে রেখে এই অদ্ভুত মানুষটার দিকেই এতো তাকানো কেন? আর তাকাতেই যদি হয় তাহলে এই মুহুর্তেই তাকাতে হলো কেন? আমাদের ঝগড়াটা শেষ হলে তাকাতে পারত না? আমি রাগে বোতলের সম্পূর্ণ পানি এক নিঃশ্বাসে শেষ করলাম। মেয়েটির দিকে কয়েকবার রক্তচক্ষু দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সন্দিহান গলায় বললাম,
‘ পানির স্বাদটা এমন লাগল কেন?’
শুভ্র ভাই ততক্ষণে ফোনের স্ক্রিনে মনোনিবেশ করেছেন। আমার কথায় কপাল কুঁচকালেন। নির্বিকার গলায় বললেন,
‘ কেমন লাগল?’
‘ কেমন যেন। অন্যরকম।’
‘ তাহলে খেলি কেন?’
আমি চোখ বড় বড় করে তাকালাম। মৃদু আর্তনাদ করে বললাম,
‘ আপনি কিছু মেশান নি তো?’
‘ তাতে আমার লাভ?’
উনার প্রশ্নের প্রেক্ষিতে হঠাৎই কোনো উত্তর খুঁজে পেলাম না আমি। সত্যিই তো, পানিতে কিছু মিশিয়ে উনার কি লাভ? আমি ঢোক গিলে বললাম,
‘ অনেক লাভ হতে পারে। পানির বোতলটা তো আপনার, তাই না?’
শুভ্র ভাই আমার দিকে পূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। উনার ভ্রু জোড়া খানিকটা কুঁচকে এলো। তীব্র বিতৃষ্ণা নিয়ে বললেন,
‘ তোর ধারণা আমি তোকে উল্টাপাল্টা কিছু খাইয়ে খারাপ কিছু করতে চাই?’
উনার বলা কথাটা নিজের কানেই ভীষণ বিদঘুটে শোনাল। আৎকে উঠে বললাম,
‘ ছি! না। কক্ষনো না। আমি ওভাবে বুঝাই নি।’
উনার নির্বিকার প্রশ্ন,
‘ তো কিভাবে বুঝিয়েছিস?’
আমি জবাব দিলাম না। উনি কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে বাঁকা হাসলেন। বাম চোখটা টিপে দিয়ে বললেন,
‘ আসলেই মিশিয়েছি।’
আমি কপাল কুঁচকে অন্যদিকে তাকালাম। উনি আবারও বললেন,
‘ আরেহ! বিশ্বাস করলি না? কি একটা যন্ত্রণা, তুই তো দেখি আমার সত্য মিথ্যা কোনোটাই বিশ্বাস করিস না রে বাপ।’
আমার থেকে কোনোরূপ জবাব না পেয়ে আলিফ ভাইয়াকে ফোন লাগালেন শুভ্র ভাই। আলিফ ভাইয়া ফোন পেয়ে পেছনের দিকে তাকালেন। শুভ্র ভাই ঠোঁটের ইশারায় বললেন,
‘ ব্যাগ থেকে আমার চাদরটা দে।’
উনার ঠোঁটভঙ্গি বেশ কিছুক্ষণ নিবিষ্ট দৃষ্টিতে নিরক্ষণ করে চোখ বন্ধ করলাম আমি। কিছুক্ষণের মধ্যেই তন্দ্রচ্ছন্ন ভাব হলো আমার। তার মধ্যেই একটা উষ্ণ পরশ অনুভব করলাম। এতোক্ষণের শরীর কাঁপানো ঠান্ডাটা ধীরে ধীরে কমে এলো। নারীকণ্ঠী আবছা একটা কন্ঠ কানে এলো,
‘ উনি কি আপনার ছোট বোন, ভাইয়া?’
শুভ্র ভাইয়ের গরম নিঃশ্বাস আমার মুখের ওপর আছড়ে পড়ল। শুভ্র ভাই গম্ভীর গলায় বললেন,
‘ না।’
‘ তাহলে নিশ্চয় গার্লফ্রেন্ড বা ওয়াইফ।’
শুভ্র ভাই প্রথমেই কোনো উত্তর দিলেন না। উনার প্রকৃতি অনুযায়ী নারীকন্ঠীর অতিরিক্ত কৌতূহল উনার পছন্দ হওয়ার কথা নয়। শুভ্র ভাই কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,
‘ ওয়াইফ বা গার্লফ্রেন্ড কিছুই না।’
উনার উত্তরে নারীকণ্ঠী হয়ত বেশ অবাকই হলো। বিস্ময় নিয়ে বলল,
‘ তাহলে?’
শুভ্র ভাই মৃদু গলায় বললেন,
‘ খুব আকাঙ্ক্ষিত কেউ।’
‘ জ্বি?’
শুভ্র ভাই দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
‘ কিছু একটা হয়।’
তারপর গাড়ির চাকা আর রাস্তার ঘর্ষণের শব্দ। মুখের ওপর অদ্ভুত সেই মানুষের আছড়ে পড়া উত্তপ্ত দীর্ঘশ্বাস। তারপর নিমগ্ন এক ঘুমের জগৎ। এরপর যখন ঘুম ভাঙলো তখন বাস ঢাকা শহরে ঢুকে পড়েছে। শুভ্র ভাই নিবিষ্ট চিত্তে ফোন ঘাটছেন। উনার ফোনের স্ক্রিনে রঙ-বেরঙের শাড়ি আর পাঞ্জাবির ছবি। আমি ভ্রু কুঁচকে খানিকটা বিস্ময় নিয়েই বললাম,
‘ আপনি শাড়ির ছবি দেখছেন কেন?’
আমার কন্ঠটা কানে যেতেই আমার বাহু থেকে বাম হাতটা সরিয়ে নিলেন শুভ্র ভাই। একটু নড়ে চড়ে বসে হালকা কাশলেন। চাদরটা টেনে নিয়ে বললেন,
‘ সোজা হয়ে বস। বাসে উঠে ঘুমানো কোন ধরনের অভ্যাস? এক তো ঘুমিয়ে পড়েছিস তারওপর অন্যের গায়ে ঢলে পড়ছিস। দিন দিন বেয়াদব হচ্ছিস। চরম বেয়াদব। সরে বস।’
আমি কপাল কুঁচকে সরে বসলাম। প্রতিবাদ করে বললাম,
‘ আমি মোটেও ঢলে টলে পড়ি নি। নিশ্চয় এর মধ্যে কোনো কাহিনি আছে।’
‘ তাই তো বলবি এখন। বাপের মতো ধান্ধাবাজ হলে যা হয় আরকি।’
আমি রাগে নাক-মুখ লাল করে বললাম,
‘ আপনি আবার বাবাকে টানছেন!’
শুভ্র ভাই বিরক্ত গলায় বললেন,
‘ তোর বাপকে টানতে হয় না। ব্যাটা জোরপূর্বক চলে আসে। এইযে এতো করে বললাম, আমি ঢাকা ফাকা যাব না কিন্তু তোর ধান্ধাবাজ বাপ আমাকে জোরপূর্বক নিয়ে এলো। ক্যান বাপ? অন্যের মেয়ের বিয়েতে টেনে হিঁচড়ে আমার জ্বালা বাড়ানোর পায়তারা করছে নাকি বুড়ো?’
‘ এটা কখনোই বাবার দোষ নয়। কণা আপুরা আপনাদের দাওয়াত দিয়েছিলেন। মামু-মামানি যেহেতু আসতে পারছেন না সেহেতু দাওয়াত রক্ষার দায়ভারটা তো আপনারই নাকি?’
শুভ্র ভাই ঠেস লাগা গলায় বললেন,
‘ আমার কোনো দায়ভার নেই। কোথাকার কে দাওয়াত দিল। এর আগে কখনো দেখি নি পর্যন্ত, সেই দাওয়াত রক্ষা করার জন্য আমাকে টেনে হিঁচড়ে ঢাকা পর্যন্ত আনা হলো। মানে, বাড়াবাড়ির একটা লিমিট আছে। এর পেছনে নির্ঘাত কোনো ধান্ধা আছে।’
‘ আশ্চর্য! এভাবে বলছেন কেন? বাবা আপনাকে স্নেহ করে বলেই আসতে বলেছেন। আর জোরটা বাবা নয় মামানি করেছে।’
শুভ্র ভাই কিছুক্ষণ গুজগুজ করে চুপ করে রইলেন। চোখ-মুখ বিরক্তিতে থমথম করছে। কণা আপুর বিয়েতে জোরপূর্বক ধরে আনায় বাবার প্রতি রাগটা তার কয়েকগুণ বেড়েছে বলেই বোধ হচ্ছে। তার মুখভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে, বড়দের মুখের ওপর ‘না’ করতে পারার গুণটা না থাকায় তিনি নিজের ওপরই ভয়ানক রুষ্ট এবং বিপন্ন। কিছুক্ষণ চুপ থেকে মুখ কাঁচুমাচু করে জিগ্যেস করলাম,
‘ আপনার না মেয়েদের জিনিসের ওপর কোনো ইন্টারেস্ট নেই? তাহলে এতো মনোযোগ দিয়ে শাড়ির ছবি দেখছিলেন যে?’
শুভ্র ভাই আমার দিকে তাকালেন। আমি একটা ঝাঁঝালো উত্তরের জন্য মনে মনে প্রস্তুত হচ্ছিলাম। কিন্তু উনি আমাকে অবাক করে দিয়ে আমার দিকে ফোনটা এগিয়ে দিলেন। থমথমে গলায় বললেন,
‘ একটা শাড়ি পছন্দ করে দে তো। আমি কনফিউজড।’
আমি বিস্ফারিত চোখে উনার দিকে তাকালাম। ফোনটা হাতে নিয়ে বললাম,
‘ শাড়ি? হঠাৎ শাড়ি কেন?’
‘ তোকে যা করতে বলেছি কর। অতিরিক্ত প্রশ্ন করবি তো দিবো এক থাপ্পড়।’
উনার ধমকে খানিকটা নিভে গেলাম আমি। কিছুক্ষণ ঘেটে একটা লাল শাড়ি দেখিয়ে বললাম,
‘ এই শাড়িটা অনেক বেশি সুন্দর।’
শুভ্র ভাই তাকালেন। কপাল কুঁচকে কিছু একটা ভেবে আমার উচ্ছ্বাসিত মুখের দিকে তাকালেন। বললেন,
‘ আম্মু এমন লাল শাড়ি পরবে বলে মনে হয় না। আম্মুকে এমন শাড়ি পরতে দেখি না তো।’
‘ মামানির জন্য নাকি?’
‘ হু। আর কার জন্য হবে?’
আমি ঠোঁট কামড়ে ফোন স্ক্রল করতে লাগলাম। আর উনি সিটে গা এলিয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন, অপলক।
‘ এই শাড়িতে মামানিকে বেশ মানাবে। কিন্তু হঠাৎ শাড়ি কেন?’
শুভ্র ভাই আমার হাত থেকে ফোনটা নিয়ে শাড়ি অর্ডার করলেন। মুখে বললেন,
‘ পঁচিশ তারিখ আম্মুর ম্যারেজ ডে। এই দিনটি না এলে এই পৃথিবীতে আমার আসাটাই হতো না। সো, এই দিনটা আমার জন্য স্পেশাল হওয়া উচিত, তাই না?’
উনার কথাটা বেশ ভাবালো আমায়। সত্যিই তো, বাবা-মার বিবাহ বার্ষিকিটা আমাদের জন্য স্পেশাল হওয়াই উচিত। শুভ্র ভাই লাল শাড়িটা অর্ডার করতেই তাড়াহুড়ো করে মনে করিয়ে দিলাম আমি,
‘ আরে, এটা কোনো অর্ডার করছেন? এটা মামানি সত্যিই পরবে না।’
শুভ্র ভাই অর্ডার দেওয়া শেষ করে ফোনটা পকেটে রাখলেন। আমার দিকে তাকিয়ে ভীষণ মিষ্টি করে হাসলেন। থুতনিতে থাকা তিলটা মাদকের মতো আভা ছড়ালো। সিট থেকে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন,
‘ শাড়িটা তোর মামানি না পরলেও মামানির পূত্রবধূ পরবে। শাড়িটা তার পছন্দ মানেই অনেক কিছু্। সবাই নেমে যাচ্ছে, জলদি নাম।’
আমি কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে উঠে দাঁড়ালাম। শুভ্র ভাই সিট থেকে উঠে খানিকটা পিছিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি সিট থেকে বেরিয়ে দরজার দিকে হাঁটতেই পেছন পেছন হাঁটতে লাগলেন উনি। দু’পাশে উনার শক্তপোক্ত হাতের বেড়ি। এতো এতো মানুষের মাঝেও উনার গায়ের পরিচিত গন্ধটা নাকে এসে লাগতে লাগল। মুহূর্তেই মোহিত হয়ে উঠলো চারপাশ!
_____________________
রাত দশটা নাগাদ কলি আপুদের বাসায় গিয়ে পৌঁছালাম আমরা। কলি আপুদের বাসায় তখন হুলস্থুল অবস্থা। আগামী কাল গায়ে হলুদের প্রোগ্রাম হবে বিধায় ঘরভর্তি জানা-অজানা মেহমান। শান্তিতে দাঁড়ানোর মতো অবস্থা এখানে নেই। শুভ্র ভাই পুরোটা সময় বিরক্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইলেন। আমাদের থাকার জন্য যে রুমটা বরাদ্দ করা হলো সেখানে সারিবদ্ধ তোশক আর কম্বল বিছানো। আমরা যে যেখানে পাই সেখানেই গা এলিয়ে দিলাম। ক্লান্ত মনে বারবার একটা কথায় ভাসতে লাগল, ‘ আরো দু’দুটো দিন থাকতে হবে এখানে। উফ!’ সকাল বেলা সবাই মিলে রাস্তা হাঁটতে গেলাম। আমরা বোনেরা সামন সামনে হাঁটছি। আমাদের পেছনেই হাঁটছেন ভাইয়েরা। তাদের পেছনে, বেশ খানিকটা দূরত্ব রেখে হাঁটছে বড়রা। আলাপ চারিতার এক পর্যায়ে আলিফ ভাইয়া গদগদ গলায় বললেন,
‘ স্নিগ্ধা নামের মাইয়াটাকে দেখছ শুভ্র ভাই? হেব্বি দেখতে। এইটাকে কিভাবে পটানো যায় বলো তো?’
শুভ্র ভাই হেসে বললেন,
‘ তার আগে কিভাবে পেটানো যায় সেটা বলি। আমাদের নিচের তলার নতুন ভাড়াটিয়ার মেয়েকে দেখে নাকি ‘ বুঝে না সে, বুঝে না’ গান গাস তুই?’
আলিফ ভাই হতাশ গলায় বললেন,
‘ কি বলো এসব শুভ্র ভাই? আমি কত্তো ইনোসেন্ট পোলা তুমি জানো না? গানটা আসলে আমি না ভাইয়া গাইছিল।’
অদুত ভাই লাফিয়ে উঠে বললেন,
‘ আস্তাগফিরুল্লাহ! বড় ভাইয়ের নামে অপবাদ দিতে লজ্জা করে না তোর? শালা, আব্বা-আম্মায় তোরে যে ক্যান ডাউনলোড করছিল আল্লাহ মালুম। তুই সবদিক থেকেই বেজাল। ডাউনলোড হওয়ার সময়ও সীন করেছিলি নির্ঘাত।’
অদুদ ভাইয়ের কথায় হুহা করে হেসে উঠলেন সবাই। মিলাদ ভাইয়া আমোদিত গলায় বললেন,
‘ আলিফ ছোটবেলা জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে থাকত। আর রাস্তা দিয়ে যাওয়া কোনো মধ্যবয়স্ক পুরুষ দেখলেই ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ করে চিল্লাতো। আর এখন যুবতি মেয়ে দেখতেই ‘বউ’ ‘বউ’ করে চিল্লায়। আলিফকে তোরা আন্ডারেস্টিমেট করতে পারিস না।’
ঠিক ওই সময়ই আমাদের অপজিট রাস্তার কোণে একটি মেয়েকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেলো। আমার ভাইজাতি তাকে দেখে হঠাৎ করেই ‘বউ’ ‘বউ’ করে চেঁচিয়ে উঠল। মেয়েটি চমকে তাকাতেই সব কটা নিশ্চুপ হয়ে এদিক ওদিক তাকাতে লাগল। চোখে-মুখে ভারী নিষ্পাপ ভাব। মেয়েটি আকস্মিক ঘটনায় হতভম্ব চোখে তাকিয়ে থেকে দ্রুত পায়ে রাস্তার বেগে হারিয়ে গেলো। সাথে সাথেই হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেলো সবাই। আপু ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাল। বিস্ময় নিয়ে বলল,
‘ তোমরা কি ফাজিল!’
অদুত ভাই বিরহী গলায় বলল,
‘ থাপড়া না খাইতে চাইলে সামনে তাকা। এখানে ভাইদের সিক্রেট কথাবার্তা চলছে। বোনেরা এখানে এলাউট নয়। চোখ-কান বন্ধ করে চুপচাপ হাঁট।’
আলিফ ভাইয়া অদুত ভাইয়ের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললেন,
‘ এইসব বাদ দে তো। এখন স্নিগ্ধাকে কিভাবে পটানো যাবে সেটা বল। এই মাইয়াকে পটানো না গেলে এই দুইটা দিনই নষ্ট। এক্কেবারে ওয়েস্ট!’
‘ ওহ। আরেকটা কথা তো বলতেই মনে নাই। কলির ফ্রেন্ড, ওই চ্যাংড়া ছেলেটা আছে না? শ্যামা করে, লম্বা ছেলেটা? ওই পোলায় কাল রাতে এসে রাফিয়ার বয়ফ্রেন্ড আছে কিনা জিগ্যেস করছে। শালার, আমার ছোট বোনের বয়ফ্রেন্ড আছে কিনা সেটা আমাকে এসেই জিগ্যেস করছে, ভাবা যায়? মেজাজটা যে কি পরিমাণ খারাপ হয়েছিল।’
রাতুল ভাইয়ার কথায় আবারও হুহা করে হেসে উঠলো সবাই। রাফিয়া উৎসাহ নিয়ে বলল,
‘ কোন ছেলেটা ভাইয়া?’
অদুত ভাইয়া ধমক দিয়ে বললেন,
‘ ভাইদের কথাবার্তায় নাক গলাইতে মানা করলাম না? যা, সামনে তাকা। নয়ত নগদে থাপ্পড় খাবি। নো বাকি ছাকি।’
রাফিয়া মুখ কালো করে সামনের দিকে তাকাল। আলিফ ভাই উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলল,
‘ আমি তো ভাবছি, রাহাত ভাইকে রোদ,রুহির কথা জিগ্যেস করলে তার কেমন রিয়েকশন হবে। রাহাত ভাই? কি করবা?’
ভাইয়া কোনো উত্তর দেওয়ার আগেই রাতুল ভাইয়া বললেন,
‘ ধুর! রাহাত ভাই না। এটা ভাব শুভ্র ভাইকে রোদের কথা জিগ্যেস করলে তার কেমন রিয়েকশন হবে।’
আলিফ ভাইয়া লাফিয়ে উঠে বললেন,
‘ ইশ! কি একটা সীনই না হতো তাহলে। শুভ্র ভাই? পোলা ভাড়া করে হলেও আমি রোদের পেছনে লাগাব দেইখো। টাকা যায় যাক তবু মুভি মিস করা চলবে না।’
শুভ্র ভাই চাপা গলায় বললেন,
‘ ধুশ্ শালা। থামবি? নাকি মুভিটা তোকে দিয়েই শুরু করব?’
ভাইজাতির ভয়ানক সব কান্ড কারখানা সহ্য করতে করতে রাস্তার একপাশে গিয়ে থামলাম আমরা। ঘন কুয়াশার চাদর ছিঁড়ে আগুণ জ্বলছে। সেই আগুণে হাঁড়ি চাপিয়ে বিরস মুখে পিঠা বানাচ্ছেন এক বৃদ্ধা। আমরা হৈ হৈ করে পিঠা নিলাম। আমি পিঠা হাতে খানিকটা দূরে পাকা ডিপির ওপর গিয়ে বসলাম। আমার পায়ের কাছে এক টুকরো সোনালি রোদের আভা। ফোনের স্ক্রিনে সময় তখন আটটা চল্লিশ। আমি বসার কয়েক মিনিট পরই শুভ্র ভাই এলেন। আমাকে আগাগোড়া নিরক্ষণ করে বললেন,
‘ কি রে? শীতের কাপড় কই? সুয়েটার টুয়েটার তো কিছুই পরিস নাই। তোর বাপ যে এমন হার পর্যায়ের কিপ্টা জানা ছিল না।’
আমি বিরক্ত গলায় বললাম,
‘ সকালে ঘু্ম থেকে উঠেই আমার বাবার নিন্দা না করলে চলছে না আপনার? আমার বাবা কিপ্টেমির কি করল শুনি?’
উনি নির্বিকার ভঙ্গিতে পিঠায় কামড় দিলেন। পিঠা চিবোতে চিবোতে বললেন,
‘ এইযে খরচের ভয়ে মেয়েকে সুয়েটার কিনে দিচ্ছে না। এর থেকে বড় কিপ্টেমি কিছু হয় নাকি?’
‘ বাসা থেকে বের হওয়ার সময় সুয়েটার আনতে ভুলে গিয়েছি। এর মানে এই নয় যে বাবা আমায় সুয়েটার কিনে দেয় না।’
‘ ওহ্। তারমানে কিনে দেয়।’
‘ অবশ্যই দেয়।’
শুভ্র ভাই ধীরে সুস্থে নিজের পিঠাটা শেষ করলেন। আমার ওড়নায় জোরপূর্বক হাত মুছে উনার গায়ে থাকা চাদরটা আমার গায়ের উপর ছুঁড়ে মারলেন।
‘ আমার ভীষণ গরম লাগছে। চাদরটা তোর কাছে রাখ। বাসায় ফিরে নিয়ে নেব।’
আমি অবাক হয়ে বললাম,
‘ এই ভয়ানক ঠান্ডায় আপনার গরম লাগছে?’
‘ কেন? লাগতে পারে না?আমি কি তোর মতো ক্যাঙ্গারু নাকি? আমি হলাম দূরন্ত যুবক। আমার শরীরের রক্ত অলওয়েজ গরম।’
আমি পূর্ণ দৃষ্টিতে উনার দিকে তাকালাম। উনার গায়ে সাদা রঙের পাতলা একটা শার্ট আর ডেনিম জিন্স। মুখের ফর্সা চামড়ার লাল আভা আর হাতের লোমের দাঁড়িয়ে থাকাটা উনার ঠান্ডার তীব্রতার প্রমাণ দিচ্ছে। তবুও কি অদ্ভূতভাবে মিথ্যা বলছেন উনি। আমাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভ্রু নাচালেন শুভ্র ভাই।
‘ এভাবে আহাম্মকের মতো তাকিয়ে আছিস কেন? চাদরটা হাতে নিয়ে বসে না থেকে গায়ে জড়িয়ে রাখলেও তো পারিস। নাকি চাদর কি করে গায়ে দিতে হয় সেটাও জানিস না?’
আমাদের কথার মাঝেই গুটি গুটি পায়ে দুটো বাচ্চা এসে দাঁড়ালো সামনে। গায়ে ময়লা জামা-সুয়েটার। শুভ্র ভাই তাদের দিকে তাকাতেই ফুল এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘ ভাইয়া ফুল কিনবেন? এক্কেবারে তাজা ফুল।’
শুভ্র ভাই মেয়েটিকে ভালো করে নিরক্ষণ করে বললেন,
‘ নাম কি?’
‘ ছন্দা।’
‘ আমার নাম রাণি।’
শুভ্র ভাই গম্ভীর গলায় বললেন,
‘ সুন্দর নাম। তবে, ছন্দা রাণী দুটো একজনের নাম হলেই বেশি মানাতো। দুটো আলাদা নাম বলে মনে হচ্ছে না। কেন মনে হচ্ছে না বল তো?’
মেয়েদুটো জবাব দিল না। তাদের নাম নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা আছে বলেও মনে হচ্ছে না। শুভ্র ভাই ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে ফুলগুলোকে ইশারা করে বললেন,
‘ হাতে এগুলো কি ফুল?’
‘ গোলাপ ফুল। ২০ টাহা কইরা।’
শুভ্র ভাই রাণীর হাতের দিকে ইশারা করে বললেন,
‘ আর এগুলো?’
ছন্দা উত্তর দিল,
‘এগ্লা বকুল ফুলের মালা। আপনে তো দেহি কোনো ফুলই চিনেন না।’
শুভ্র ভাই হাসলেন। ঠোঁট উল্টে বললেন,
‘ আম্মু আমাকে একটা বউফুল এনে দিয়েছে। ওই ফুল ছাড়া আর কোনো ফুলই চোখে পড়ে না আমার। সব ফুলই একরকম লাগে।’
ছন্দা রাণী অবাক হলো। বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থেকে প্রশ্ন ছুঁড়ল,
‘ বউফুল দেখতে কেমন? এমন ফুল সত্যসত্য আছে?’
শুভ্র ভাই হাসি হাসি মুখে বললেন,
‘ একদম সত্য সত্য আছে। আমি কেন মিথ্যা বলব বলো? আমার বউফুলটা তো পৃথিবীর সব থেকে সুন্দর ফুল। গোলাপ, জবা কোনো ফুলই এর সামনে কিছুই না। তা, বকুলের মালা কত করে?’
বিস্মিত ছন্দা কোনোরকম উত্তর দিল,
‘ পাঁচ টাহা কইরা। লইবেন একটা মালা?’
‘ একটা নিবো না। সবগুলোই নিবো। তোমার হাতের গোলাপ গুলোও নিবো। সব মিলিয়ে কত চাই?’
ছন্দা কিছুক্ষণ ভাবল। খানিকক্ষণ পর দ্বিধাভরা গলায় বলল,
‘ ১০০। উহু, ২০০। ‘
শুভ্র ভাই হেসে বললেন,
‘ আচ্ছা। আমি তোমাদের তিনশো টাকা দেব। তার আগে তিনজনে মিলে চুপিচুপি একটা কথা বলবো, এদিকে এসো। কানে কানে বলতে হবে। চুপিচুপি বলা কথাগুলো কানে কানে শুনতে হয়। জোরে বলার নিয়ম নেই।’
ছন্দা-রাণী একে-অপরের সাথে দৃষ্টি বিনিময় করে শুভ্র ভাইয়ের মুখের দিকে তাকাল। দ্বিধাভরা পায়ে এগিয়ে গিয়ে বলল,
‘ কন।’
শুভ্র ভাই মুচকি হেসে ওদের কানে কানে কিছু একটা বললেন। আমি খানিকটা ঝুঁকে শোনার চেষ্টা করতেই রাম ধমক দিয়ে সরে বসতে বললেন। উনার ধমকে ঝুঁকাঝুঁকি বন্ধ করে চুপ করে বসে রইলাম। কয়েক মুহূর্ত পর ধীর পায়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো ছন্দা। গোলাপ ফুলগুলো আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘ আমি তোমাকে আকাশের সমান ভালোবাসি। তুমি কি আমার বউ হবে?’
ছন্দার কথায় হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম আমি। হতভম্ব ভাবটা কেটে যেতেই একঝাক লাল, নীল লজ্জায় লাল হলাম আমি। সাথে সাথেই বকুলের মালাগুলো এগিয়ে দিয়ে বলে উঠলো আরেকটা কন্ঠ,
‘ আমি তোমাকে আকাশের সমান ভালোবাসি রোদপাখি। তুমি কি আমার বউ হবে?’
আমি ফুলগুলো হাতে নিয়ে মাথা নিচু করলাম। লজ্জায় চোখ-মুখ অন্ধকার করে আসছে আমার। শুভ্র ভাই এবার একটু পাশ ঘেঁষে বসলেন। ফিসফিস করে বললেন,
‘ একটা লাইন বাদ পড়েছে। সেটা আমি বলে দিই? তোমাকে ভীষণ আদরও করব। সত্যি বলছি, বউ হবে?’
উনার কথায় নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো আমার। আমাকে এভাবে শক্ত হয়ে বসে থাকতে দেখে খুব হাসলেন শুভ্র ভাই। ফিচেল গলায় বললেন,
‘ শ্বাস নে, শ্বাস নে। মজা করছিলাম আমি। তোর বাপ তো আমার ওপর এট্যাম্প টু মার্ডারের কেস লাগিয়ে দেবে রে। সেখানে বড় বড় করে লেখা থাকবে,” শুভ্র নামক এক নির্দয় যুবকের, কথার ফাঁদে ফেলে কোমলমতি শিশুকে শ্বাসরোধ করে মারার চেষ্টা”। তোর বাপের পক্ষে সব সম্ভব। সব মানে সব।’
উনার কথার প্রত্যত্তুরে কিছু বলার আগেই আম্মুর কন্ঠ কানে এলো। চেঁচিয়ে উঠে বললেন,
‘ শুভ্র-রোদ? কি করছিস ওখানে?’
আম্মুর কন্ঠে শুভ্র ভাই খানিকটা তটস্থ হলেন। পকেট থেকে টাকা বের করে পিচ্চিদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে আমার হাতে থাকা ফুলগুলো নিয়েও তাদের হাতে ধরিয়ে দিলেন। তারপর কি ভেবে বকুল ফুলের মালাগুলো ফিরিয়ে নিয়ে আমার হাতে দিলেন। ওদের দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করে বললেন,
‘ এগুলো থাকুক। সব দিয়ে দিলে এই মহিলা আমার ঘাড় মটকে ফেলবে। একে দেখতে পেত্নীর মতো লাগে না?’
ছন্দা-রাণী শুভ্র ভাইয়ের কথার ভঙ্গিতে হেসে ফেলল। ততক্ষণে আম্মুসহ প্রায় সবাই আমাদের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। আম্মু আমার হাতে এতোগুলো মালা দেখে ভ্রু কুঁচকালেন।সন্দিহান গলায় বললেন,
‘ এতোগুলো মালা কোথায় পেলি রোদ?’
আমি ফট করেই উত্তর দিলাম,
‘ শুভ্র ভাই কিনে দিয়েছেন।’
শুভ্র ভাই হতাশ গলায় বললেন,
‘ তোমার মেয়ে ফুলের মালা কেনার জন্য মারা যাচ্ছিল। তাই কিনে দিলাম। নয়ত মানুষ ভাববে এতো বড় মেয়ে ফুলের জন্য কান্নাকাটি করছে অথচ কেউ কিনে দিচ্ছে না। বিষয়টা চোখে লাগতো। মান-সম্মানের ব্যাপার। ঠিক কাজ করেছি না ফুপ্পি?’
আম্মু আমার দিকে একবার রক্তচক্ষু দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। তারপর মুগ্ধ গলায় বললেন,
‘ তুই সব সময় ঠিকই করিস বাবা।এখন ওঠ। নয়টার বেশি বাজে। চল চল।’
কথাটা বলেই ফেরার পথে হাঁটা দিলেন আম্মু। ফুপ্পিরাও গল্পে মগ্ন হয়ে আম্মুর পাশে পাশে হাঁটতে লাগলেন। আম্মু খানিকটা সরে যেতেই পাশ থেকে ফোঁড়ন কাটলেন আলিফ ভাই,
‘ আমরা কান্দে কাইটা মরে গেলেও তো ফুল কিনে দাও না শুভ্র ভাই। গায়ের চাদরও দিয়ে দিয়েছ দেখছি। বোনদের প্রতি এতো ভালোবাসা আর ভাইদের ভাগ্যে ফুটা কলস! ভাইদের প্রতি একটু বেশিই না-ইনসাফি হয়ে গেল না শুভ্র ভাই?’
শুভ্র ভাই চোখ কটমট করে তাকালেন। আমি অনুভূতিশূন্য পায়ে আম্মুর পিছু নিলাম। হঠাৎ করেই উপলব্ধি করলাম, আমার মনটা আসলে ভালো নেই। শুভ্র ভাইয়ের ফালতু মজাটা আমার ভালো লাগে নি। একটুও না।
#রোদবালিকা
রোদ শুভ্রর প্রেমকথন সম্পূর্ণ গল্পের লিংক
https://kobitor.com/rodsuvro/
[ প্রায় পাঁচদিন পর গল্প দিলাম আজ। আরশিযুগল প্রেম আজও দিতে পারলাম না বলে দুঃখিত। আসলে কিছু ফ্যামিলি প্রবলেম চলছিল। ফোনটাই হাতে পাই নি এই ক’দিন। গ্রুপে ব্যাপারটা জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল কিন্তু পেইজে জানানো হয় নি বলে দুঃখিত। আজকের লেখাটাও কেমন আবেগশূন্য, মুখস্থ লেখার মতো মনে হচ্ছে আমার। তবুও দিলাম। কাল আরশিযুগল প্রেম দেব ইনশাআল্লাহ। শুভ রাত্রি।]