রোদ শুভ্রর প্রেমকথন পর্ব ৪৬
#লেখনীতে – নৌশিন আহমেদ রোদেলা
ঘড়িতে কয়টা বাজে জানা নেই। ঘুম ভেঙেই ঘড়ি দেখার বাতিকও আমার নেই। অলস মানুষেরা প্রায়শই ড্যাম কেয়ার ভাব নিয়ে চলাচল করার চেষ্টা করে। সময়,খাওয়া, সমালোচনা কোনো কিছুতেই তাদের পাত্তা পাওয়া যায় না। যাওয়ার কথাও নয়। অলস মানুষ উদাসীন থাকবে এটাই প্রকৃতির নিয়ম।
সময় নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করার মত কঠিন কর্মটা তাদের জন্য নয়। আমিও অনেকটা সেই শ্রেণীরই মানুষ। চারপাশের সমালোচনায় মাথা খাটানোর সময় নেই। কিন্তু আজ খাটাতে হল। ঘুমন্ত আমিকে কেন্দ্র করে এতোগুলো কন্ঠের ফিসফিস শুনে চুপচাপ শুয়ে থাকা গেল না। সকাল সকাল কানের পাশে ভয়ানক রহস্য ঝুলিয়ে রেখে ঘুমের ভাব ধরা যায় না। আমি চোখ মেলে তাকালাম। চোখের সামনে ভেসে উঠল কয়েকজোড়া কৌতূহলী চোখ। আমাকে চোখ খুলে তাকাতে দেখেই তীব্র কন্ঠে চেঁচিয়ে উঠল সবাই,
‘ সারপ্রাইজ।’
আমি সারপ্রাইজড হলাম না। কানে হাত চেপে ওঠে বসলাম। এরা সবাই আমার স্কুল জীবনের বন্ধু। দু’বছরের মাঝে দেখা সাক্ষাৎ হয় নি বললেই চলে। আমি কপাল কুঁচকে বললাম,
‘ তোরা কোথা থেকে টপকালি?’
অরিন উৎসাহ নিয়ে বলল,
‘ সারপ্রাইজড হয়েছিস?’
আমি বিরস মুখে বললাম,
‘ সারপ্রাইজড হওয়ার কি আছে? তোরা যদি দুই তিনটা জামাই সঙ্গে করে আনতিস তাহলে নাহয় সারপ্রাইজড হওয়ার মতো কিছু হত। আসছিস তো সেই আগের মতই। সারপ্রাইজড কেন হব?’
ছামি ঠোঁট উল্টিয়ে বলল,
‘ ধুরু! আমি আগেই বলেছিলাম এসব নাটক ফাটক করার দরকার নেই। এই হারামি সারপ্রাইজড হবে না। কিন্তু কে শুনে কার কথা? এই রোদু? তুই এই ঢঙীদের লাত্থি দিয়ে বিছানা থেকে ফেলে দে তো। এদের জ্বালায় সকালের খাওয়াটা পর্যন্ত জুটে নি আমার। ভাব-ভঙ্গী দেখে মনে হচ্ছিল আমি এখানে না এলে এদের বিয়ে টিয়ে হবে না। জামাই হারিয়ে বিধবা হয়ে যাবে। বেয়াদব। আন্টিকে খেতে দিতে বল তো, ফ্যাস্ট।’
আমি আড়মোড়া ভেঙে হাসলাম। অলি লেপের ওপর হাত পা ছড়িয়ে দিল। ক্লান্ত গলায় বলল,
‘ হিমির নাকি স্যারের সাথে জবরদস্ত প্রেম চলছে? স্যারকে বলে একটা গাড়ি কেন পাঠাল না বল তো? কত্ত জার্নি করতে হলো, উফ!’
আমি ফিচেল গলায় বললাম,
‘ আরে…স্যারের গাড়ি তোর জন্য কেন পাঠাবে? স্যার পার্সোনাল, গাড়িও পার্সোনাল। সেখানে হিমি পার্সোনালি জার্নি করবে। আমাদের মতো আমজনতার সেখানে অধিকার নেই। এতোবড় আবদার করে ফেলাই তোকে ভয়ানক শাস্তি দেওয়া উচিত অলি।’
স্পৃহা গম্ভীর গলায় বলল,
‘ একদম। তোর উচিত ক্ষমাপত্র জমা দেওয়া। তাও যেনতেন ক্ষমাপত্র নয়। লেফাফায় মোড়া ক্ষমাপত্র।’
কথাটা শুনেই খিলখিল করে হেসে উঠল সবাই। আমি বেশ সিরিয়াস মুখভঙ্গি নিয়ে বললাম,
‘ দেখ হিমি। দেবর ছাড়া ছেলে পছন্দ করে এমনিতেও তুই ভয়ানক অপরাধ করে ফেলেছিস। আমরা দয়ালু বলে ক্ষমা করেছি। কিন্তু বিয়ের সময় ক্ষমা টমা করব না। তোর বিয়েতে সবাই ভয়ানক সাজব। হলুদ আর বিয়েতে আমাদের শাড়ি,গহনা, সাজগোজ সবকিছুর দায়িত্ব তোর জামাইয়ের। ব্যাটা এতো টাকা দিয়ে করবেটা কি?’
ছামি পানি খেতে খেতে বলল,
‘ আমার জন্য হাই হিলটা মাস্ট। ওই জুতো দিয়ে তোর জামাইয়ের পায়ে পাড়া দেব। এটা তার ছোট ভাই না থাকার শাস্তি।’
স্পৃহা বলল,
‘ হলুদের গাজরাটা একদম তাজা ফুলের হওয়া চাই। এই রোদু? গেইটে কত ধরা হবে?’
আমি গম্ভীর কন্ঠে ঘোষণা করলাম,
‘ সব মিলিয়ে পনেরো হাজার,হবে না?’
বিস্মিত হিমি উত্তর দিল,
‘ স্যার আমাকে প্রোপোজই করল না আর তোরা গেইট ফেইট সাজিয়ে ফেললি? সাংঘাতিক।’
‘গেইট কি রে? আমি তো আঠারো প্লাস কথাবার্তাও সাজিয়ে ফেলেছি। শোন হিমি, বিয়ের কনের এভাবে গেইটের সাথে ঝুলাঝুলি করাটা মানায় না। টুপ করে বাসর ঘরে ঢুকে যা। তোকে শুনাবো বলে বেশ কিছু আঠারো প্লাস গল্প সিলেক্ট করেছি আমি। আজ থেকে সব আঠারো প্লাস চলবে। খাওয়া,ঘুম, গোসল সবসময়। ননস্টপ চলবে।’
ছামির কথার ভঙ্গিতে হাসিতে গড়াগড়ি খেলাম সবাই। ছামি স্বাভাবিক মুখে বলল,
‘ এই রোদু? তোকে খাওয়ার কথা বললাম না? পাত্তাই তো দিচ্ছিস না রে মামা। ক্ষুধায় মরে গেলাম।’
তারপর হঠাৎই গলার স্বর খাদে নামিয়ে বলল,
‘ শোন, আন্টির সামনে আমি খুবই ভদ্র,শান্ত, লক্ষ্মী মেয়ের ভং ধরে থাকব। ভদ্রতা বজায় রেখে বলব, আর না আন্টি। প্লিজ প্লিজ। তুই তখন বলবি, আরে নে। আম্মু ওকে দাও তো। বেশি করে দাও। বুঝছিস? ভদ্রতা দেখাতে হবে। আই হেভ প্রচুর ভদ্রতা। এবার যা।’
ছামির কথায় আবারও অট্টহাসিতে মেতে উঠল প্রত্যেকটি কন্ঠস্বর। সারাদিন হৈচৈ করে বিকেলে শহর ঘুরতে বেরিয়ে পড়লাম। অনেকদিন পর আবারও একসাথে একই তালে হাঁটছি ভেবেই সবার কি উথালপাথাল আনন্দ। চরপাড়া থেকে শুরু করে সার্কিট হাউজ চষে বেড়ানোর সেই পুরাতন উন্মদনা। কখনও পার্কের ব্রেঞ্চে বসে আড্ডা তো কখনও নৌকায় ওঠে চিল্লাপাল্লা।
আইসক্রিম হাউজে ঢুকে একজন আরেকজনের আইসক্রিমে কি বিভৎস হামলা। প্রায় দু’বছর পর আবারও ফুসকার রেস্টুরেন্টে ছয়টি উচ্ছল কিশোরীর আনন্দিত কন্ঠস্বর। প্রচন্ড ঝাল ফুসকার সাথে বর্তমান ক্রাশ আর বয়ফ্রেন্ডদের নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা সমালোচনা। আমাদের আড্ডার মাঝেই শহরে সন্ধ্যা নামল। রাস্তায় রাস্তায় জ্বলে উঠল সোডিয়ামের আলো।
অলি, অরিন, হিমি, ছামি সবাই এসেছ ভিন্ন সব শহর থেকে। আজ রাতে আমার বা স্পৃহার বাসাই হবে তাদের একমাত্র আবাসস্থল। ফুসকা শেষ করে সবাই মিলে স্পৃহাদের বাসায় থাকার পক্ষে যুক্তি দিল অলি। রাতভর হৈচৈ করার জন্য এর থেকে ভালো জায়গা হওয়ার নয়। আমরাও রাজি হলাম। বাসায় ফোন দিয়ে জানালাম আজ আর ফিরছি না। আপু কিছুক্ষণ গুজগুজ করে বলল,
‘ জন্মদিনের আগের রাতে অন্যের বাসায় থাকবি এটা কেমন কথা?’
আমি বললাম,
‘ অতি সুন্দর কথা।’
আপু কৃত্রিম রাগ নিয়ে ফোন কাটল। বান্ধবীদের ফিসফাস শুনে বুঝতে পারলাম তারা কিছু একটা পাকাচ্ছে। হয়ত সারপ্রাইজ টারপ্রাইজের ব্যবস্থা করছে। আমার সমস্যা হল কখনই ঠিকঠাক সারপ্রাইজড হতে পারি নি। কেউ সারপ্রাইজ দিতে গেলে চট করেই বুঝে যায়। কিন্তু এমনটা বাঞ্চনীয় নয়। কেউ একজন সারপ্রাইজ দিতে চাইলে সারপ্রাইজড হতে হয়।
সারপ্রাইজড না হলেও সারপ্রাইজড হওয়ার ভব ধরতে হয়। আমিও সারপ্রাইজড হওয়ার ভব ধরব বলে সিদ্ধান্ত নিলাম। স্পৃহাদের বাসায় পৌঁছেই শাড়ি পড়ার ধুম পড়ল। আমাদের থেকে আন্টির উৎসাহই বেশি। কাকে কোন শাড়ি, কোন গহনায় মানাবে তা নিয়ে হুলস্থুল অবস্থা করলেন। রাত সাড়ে ১১ টার দিকে চায়ের ট্রেটা রুমে আসতেই অলি ঘোষণা করল ছাদে গিয়ে চা খাবে। শীতের রাতে ছাঁদে চা না খেলে মজা নেই। অতএব সবাই মিলে ছাঁদে চললাম। সিঁড়ির আলো নেভানো।
চারপাশের গাঢ় অন্ধকারটা কাটিয়ে দিচ্ছে সিঁড়ির গোড়ায় থাকা মোমের আলো। আমি বিস্ময় নিয়ে সিঁড়ির ধাপ অতিক্রম করছি। সাথে সাথেই আমার গা ঘেঁষে পেছন থেকে দৌঁড়ে সামনে এল অরিন আর অলি। হাতে থাকা লাল ওড়নার এক কোণা ধরে রেখে অপর দিকটা ছুঁড়ে দিল আমার পেছনে থাকা হিমি আর ছামির হাতে। আমার বিস্ময় যেন আকাশ ছুঁলো। মাথার ওপরের ওড়নার সামিয়ানাটা একবার দেখে নিয়েই চোখ ঘুরিয়ে অলি-অরিনের দিকে তাকালাম। সাথে সাথেই মিস্টি হেসে চেঁচিয়ে উঠল অলি,
‘ সং প্লিজ।’
গান বাজল। সাউন্ড বক্স ফাটিয়ে গেয়ে উঠল ‘হ্যাপি বার্থডে’ গান। তার সাথে সুর মেলাল বান্ধবীরাও। সামিয়ানার নিচে ধীর পায়ে সিঁড়ি অতিক্রম করতে করতে নিজেকে এক মুহূর্তের জন্য অচিনপুরের রাজকুমারী বলে বোধ হল। বিস্ময়ে বোবা বনে গেলাম। ছাঁদ জুড়ে লাল গোলাপের পাপড়ি। মোমের হলদে আলো। অরিন গানের সুরকে ছাপিয়ে দিয়ে চেঁচাল,
‘ এবার সারপ্রাইজড হয়েছিস?’
আমি দু’হাতে মুখ চেপে ধরলাম। ছামি রাজকীয় ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল। মাথা নুইয়ে ঢং করে বলল,
‘ রাজকন্যাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা। রাজকন্যার ঠোঁটে হাসি ফুটলে কৃতার্থ হব। নয়তো রাজকুমার আমাদের গর্দান নেবে।’
ছামির কথায় হেসে ফেললাম আমি। সেই সাথে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল এক ফোঁটা জল। অলি মাত্রাতিরিক্ত বিরক্ত হয়ে বলল,
‘ ন্যাকা কান্না করে মেকাপটা খারাপ করিস না তো। ছবি তুলব।’
স্পৃহা,অরিন দুই হাতে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘ হ্যাপি বার্থডে দোস্ত। লাভ ইউ মোর দেন ইউ লাভ আছ।’
আমি হাসলাম। হিমি দু’কদম এগিয়ে এসে বলল,
‘ এই এরেঞ্জমেন্ট কিন্তু আমাদের একার নয় রোদবালিকা। প্ল্যান, খরচ সবই অন্যকারো। কিন্তু সে কে তা আমরা বলব না। প্রমিজ ইজ প্রমিজ, ইউ নো? তবে তুই গেইস করে ফেললে সেটা অন্য ব্যাপার। গেইস ইট!’
আমি গেইস করতে পারলাম না। কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে আকাশ পাতাল ভাবতে লাগলাম। সাউন্ড বক্সে গান বদলানো হল। সবার গায়েই নাচের পোকা ছুটল। আমিও চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। নাচের ধাপে ধাপে চিন্তাটা আর চিন্তা রইল না। চিন্তাগুলো যেন ঠান্ডা বাতাসে ভেসে গেল। প্রায় আধাঘন্টা লাফলাফি করার পর সাউন্ড বক্সে ফোনের রিংটন বাজল। স্পৃহা দৌঁড়ে গিয়ে ফোন রিসিভ করল। আবারও দৌঁড়ে এসে বলল,
‘ রুহি আপু ফোন দিয়েছিল। তোকে নাকি ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না? তোর মামানি তোর সাথে কথা বলবে। ফোন অন করতে বলল আপু।’
এবার টনক নড়ল আমার। এতো হৈ-হল্লোড়ের মাঝে ফোন যে কোথায় রেখেছি মনে পড়ছে না। সবাই নাচ-গান বন্ধ করে ফোন খোঁজায় মন দিলাম। অনেক খুঁজাখুঁজির পর ফোন পেলাম কার্পেটের তলায়। ফোনটা অন করতেই শুভ্র ভাইয়ের কল এল। ফোনটা রিসিভ করতেই উনার বাজখাঁই ধমকে পিলে চমকে উঠল,
‘ ঠাডাইয়া চড় দিয়ে দাঁত ভেঙে ফেলব। বাপের মতো মতলববাজ হয়েছিস। বড়রা ফোন দিলেই ফোন অফ করে রাখছিস। তুই যে দিন দিন চূড়ান্ত বেয়াদব হচ্ছিস সে সম্পর্কে ফুপ্পিকে জানান উচিত। তার আগে তোকে ইনস্ট্যান্ট ব্রহ্মপুত্র নদে চুবানো উচিত।’
আমি হতাশ নিঃশ্বাস ফেললাম। জন্মদিনের ঠিক এক মিনিট আগে কেউ কাউকে ঠাডিয়ে চড় মারার হুমকি দিতে পারে জানা ছিল না। শুধু চড় নয় প্রয়োজনে যে ব্রহ্মপুত্র নদে চুবাতেও পারে সেটাও জানা ছিল না। আমি দুর্বল গলায় বললাম,
‘ আপনি আমাকে জন্মদিনের দিন চড় মারতে চাইছেন? জন্মদিনে কি কেউ কাউকে চড় মারে?’
উনি বিরক্ত গলায় বললেন,
‘ কেউ না মারলেও আমি মারি। তুই এমনভাবে জন্মদিন জন্মদিন করছিস যেন জন্মদিন একটা ভয়ানক দিন। এই দিনে চড় মারলে হাত খসে পড়ে যাবে। শোন, জন্মদিন ইজ জন্মদিন। গরু, ছাগল,ভেড়া, মানুষ সবারই জন্মদিন থাকে। এটা নিয়ে আবেগে মরে যাওয়ার কিছু নেই। যেসকল মানুষ তোর মতো বলদ তারাই শুধু জন্মদিন জন্মদিন করে মুখে ফেনা তুলে ফেলে। তোর কথাবার্তার ধরণ দেখে মনে হচ্ছে এই পৃথিবীতে তুই একাই জন্মেছিস আর সবাই আকাশ থেকে টুপটুপ করে পড়েছে। ডাফার।’
আমি ক্লান্ত গলায় বললাম,
‘ আপনি কি আমার সাথে ঝগড়া করতে ফোন দিয়েছেন শুভ্র ভাই?’
‘ অবশ্যই না। তুই কি নিজেকে দুনিয়াদারীর প্রেসিডেন্ট মনে করিস যে তোর সাথে ঝগড়া করতে হবে আমায়। তুই অতিকায় বাচ্চা মেয়ে। দি শুভ্র তোর মতো পুচকু মেয়েকে ঝগড়া করার মত গুরুত্বপূর্ণ মনে করে না।’
উনার কথায় ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙল আমার। দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,
‘ গুরুত্বপূর্ণ মনে না করলে ফোন দিয়েছেন কেন? ফোন রাখুন। আপনার সাথে বাজে বকার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে আমার।’
‘ দিব এক থাপ্পড়। এতো মুখ চলে কেন তোর? মুখটা এত না চালিয়ে পা চালা। তরতর করে নিচে নেমে আয়। দরকার আছে।’
‘ আমি বাসায় নেই।’
‘ তুই যেখানে আছিস সেখান থেকেই নিচে নাম।’
‘ আমি কোথায় আছি আপনি জানেন?’
শুভ্র ভাই বিরক্ত কন্ঠে বললেন,
‘ কথায় কথায় এত প্রশ্ন করিস কেন? নিচে নামতে বলেছি নিচে নামবি ব্যস। এতো প্রশ্ন-উত্তরের প্রয়োজন কি? তোর কী ধারণা? আমি রাতদুপুরে তোর সাথে দাদাগিরি খেলছি?’
আমি স্পষ্ট কন্ঠে উত্তর দিলাম,
‘ আমি এখন নামতে পারব না।’
‘ নামিস না। এখন ১২ বেজে ৫ মিনিট। ঠিক বারোটা দশে তুই রাস্তায় এসে দাঁড়াবি। আর যদি না দাঁড়াস তাহলে যা হবে তার জন্য আমি দায়ী নই।’
আমি বিরক্ত গলায় বললাম,
‘ এতো রাতে কি করে বেরুব আমি? স্পৃহাদের বাসায় আছি। আন্টি কি ভাববে?’
শুভ্র ভাই দায়সারাভাবে বললেন,
‘ উনি কি ভাববে সেটা উনিই ভালো জানেন। আমাকে জিগ্যেস করছিস কেন? আমি তোকে নামতে বলেছি তুই নামবি ব্যস।’
‘ আমি পারব না।’
‘ না পারলে নেই। ফোন রেখে বারোটা দশ পর্যন্ত অপেক্ষা কর।’
কথাটা বলেই ফোন কাটলেন শুভ্র ভাই। আমি যেন অথৈজলে পড়লাম। শুভ্র ভাইয়ের পক্ষে সব সম্ভব। সহজ-সরল কথাকে উত্তর-দক্ষিণ করে কাউকে হার্টের রোগী বানিয়ে দেওয়া উনার জন্য দু’মিনিটের ব্যাপার। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্পৃহার কাছে ছুটলাম। স্পৃহাকে হেনতেন বুঝিয়ে গেইট খুলতে বলেই নিচে নেমে গেলাম। আন্টি শুয়ে পড়েছিলেন। আমাকে ঢুকতে দেখে ওঠে বসলেন। আমি মৃদু গলায় বললাম,
‘ আন্টি আমি একটু নিচে যাচ্ছি। আসলে, আলমারির চাবিটা ভুলে আমার ব্যাগে থেকে গিয়েছিল। ওটা নিতেই কাজিনকে পাঠিয়েছে আম্মু। আমার কাজিন নিচে দাঁড়িয়ে আছে।’
আন্টি অবাক হয়ে বললেন,
‘ এতো রাতে?’
আমি ঢিপঢিপ বুক নিয়ে দ্বিতীয় মিথ্যেটা বলে ফেললাম,
‘ হয়ত কোনো প্রয়োজন। বাবার অফিসের ফাইলগুলো তো আলমারিতেই থাকে। আমি চাবিটা দিয়ে আসি?’
আন্টি ব্যস্ত হয়ে বললেন,
‘ চলো। আমিও যাই তোমার সাথে। নিচে অন্ধকার।’
‘ না না। বাইরে তো জ্যোৎস্না। তাছাড়া স্পৃহাও যাবে সাথে। আপনি ঘুমোন।’
‘ তুমি শিওর?’
‘ জি, আন্টি।’
স্পৃহার মাকে ছাইপাঁশ বুঝিয়ে বেরিয়ে এসেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম আমি। বুকে হাত দিয়ে বার কয়েক শ্বাস টেনে নিয়ে দ্রুত পায়ে সিঁড়ির ধাপ অতিক্রম করলাম। আকাশে মস্ত বড় চাঁদ। আকাশ থেকে ঠিকরে পড়া জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে দেবকাঞ্চন ফুল আর সিমেন্টে ঢাকা সরু পথ। ঘাসের কচি ডগাগুলো লাজুক ভঙ্গিতে নুইয়ে আছে। পাতায় জমে থাকা বিন্দু বিন্দু শিশির কণা জ্যোৎস্নার আলোয় হয়ে উঠেছে প্রাণোচ্ছল। আমি একহাতে শাড়ির কুঁচি সামলে নেমে গেলাম রাস্তায়। হাত ভরা কাঁচের চুড়ি আর নুপুরের রিনঝিন শব্দে চারপাশটাই আলৌকিক এক সুর বাজল। তার সাথে বাজল নিশাচর পাখির করুণ কন্ঠ। আমি গেইট পেরিয়ে মূল রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ালাম।
পায়ে জুতো নেই। রাস্তার ছোট ছোট নুড়ি পাথরগুলো পায়ের নিচে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। বামহাতে চুলগুলোকে হাত খোঁপা করে আশেপাশে তাকালাম আমি। নির্জন,জনমানবহীন রাস্তায় কাঁচের চুড়ির নিরন্তর কান্না ছাড়া অন্যকোনো শব্দ নেই। কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক করে শুভ্র ভাইকে চোখে পড়ল আমার। আমার থেকে কিছুটা দূরে একটা ল্যাম্পপোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে আছেন। নীল পাঞ্জাবীর ওপর কালো চাদর জড়িয়েছেন । পাঞ্জাবির হাতাদুটো কনুই পর্যন্ত গোটানো। চুলগুলোতে ঢেকে আছে প্রশস্ত, ফর্সা কপাল। গম্ভীর, ভাবুক চোখগুলো ফোনের স্ক্রিনে আবদ্ধ। আমি শাড়ির কুঁচি সামলে দৌঁড়ে গিয়ে দাঁড়ালাম উনার সামনে। উনি চোখ তুলে তাকালেন। পুরু ভ্রু’জোড়া কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন অনেকক্ষণ। আমি এদিক-ওদিক তাকিয়ে অনেকটা ফিসফিসিয়ে বললাম,
‘ ডেকেছেন কেন? কি দরকার?’
উনি জবাব দিলেন না। চোখের ঘন পাঁপড়িগুলো ঝাঁকিয়ে আগাগোড়া নিরক্ষণ করলেন। গা জ্বালানো হাসি দিয়ে বললেন,
‘ বাপরে! এতো সেজেছিস কেন? মানুষ তো বিয়ে বাড়িতে গেলেও এতো সাজে না। ধান্ধা কি বল তো? তোর বান্ধবীর ভাই টাই আছে নাকি? সেই ধান্ধা ধরেই এতো সাজ?’
আমি নাক ফুলিয়ে বললাম,
‘ আপনি কি আমাকে এসব লেইম কথা বলার জন্য ডেকেছেন? সাজগোজ মেয়েদের জন্যই। মেয়েরা শুধু ছেলেদের জন্য নয় নিজের জন্যও সাজে।’
‘ সাজে নাকি?’
আমি জবাব দিলাম না। উনি রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে মৃদু গাইলেন,
‘ How do I live? How do I breathe?
When you’re not here I’m suffocating
I want to feel love, run through my blood.
Tell me is this where I give it all up?
For you I have to risk at all
Cause the writing’s on the wall.’
আমি দৌঁড়ে তার পাশাপাশি হাঁটতে লাগলাম। ভ্রু বাঁকিয়ে বললাম,
‘ আপনি সবসময় ইংলিশ গান কেন গান? বাংলা গান গাইলেই পারেন।’
শুভ্র ভাই মৃদু হাসলেন। আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘ ফিলিংস এক্সপ্রেস করাটাই মূখ্য বিষয়। কি ভাষায় গাইলাম সেটা মূখ্য বিষয় না।’
‘ এটাকে ফিলিংস এক্সপ্রেস করা বলে? এত দ্রুত গাইলেন প্রথম লাইন বুঝতে বুঝতেই লাস্ট লাইন শেষ।’
আমার কথায় হেসে উঠলেন শুভ্র ভাই। নিস্তব্ধ রাস্তায় শুভ্র ভাইয়ের হঠাৎ হাসিতে ঘেউ ঘেউ করে উঠল দুটো কুকুর। আমি ভয়ে শুভ্র ভাইয়ের শরীর ঘেঁষে দাঁড়ালাম। শুভ্র ভাই হাসি থামিয়ে বললেন,
‘ এই জন্যই গাইলাম। জানতাম তোর মাথায় কিছু ঢুকবে না। বাপের মতো হান্ড্রেড পার্সেন্ট নিরেট মাথা তোর।’
আমি দাঁড়িয়ে পড়ে বললাম,
‘ আপনি আবার আব্বুকে টানছেন? আপনি একটা অসহ্য। আমি কখনও আপনার বাবাকে নিয়ে কিছু বলি?’
শুভ্র ভাই বিরস কন্ঠে বললেন,
‘ বলিস না বলবি। আমি তো তোর মুখ চেপে বসে নেই। তোর মামু তুই যা ইচ্ছে বলতে পারিস। কি বলতে চাস, বল।’
আমি মুখ ফুলিয়ে বললাম,
‘ আপনি অত্যন্ত খারাপ একজন মানুষ। আপনার মতো খারাপ ব্যক্তি এই পৃথিবীতে দুটো নেই।’
উনি স্বাভাবিক কন্ঠে বললেন,
‘ না থাকারই কথা। আমি তো এক পিসই।’
কথাটুকু বলে আবারও হাঁটতে লাগলেন শুভ্র ভাই। গলা ছেড়ে গাইতে লাগলেন,
‘ বালিকা তোমার প্রেমের পদ্ম দিও না এমন জনকে-
যে ফুলে ফুলে ঘুরে মধু পান করে
অবশেষে ভাঙে মনকে।
একটা হৃদয় বার বার নয় একবারই প্রেমে পড়ে
সেই হৃদয়-এর সুখ লুঠ হয় নিঠুর মৌন ঝড়ে।
বালিকা….. ‘
আমি আবারও দৌঁড় গিয়ে তার পাশাপাশি হাঁটতে লাগলাম। রাগী গলায় বললাম,
‘ গান বন্ধ করে চুপ করে দাঁড়ান। আপনার এসব ছাইপাঁশ গান অসহ্য লাগছে আমার।’
শুভ্র ভাই ভ্রু বাঁকিয়ে তাকালেন। ল্যাম্পপোস্ট আর জ্যোৎস্নার মিশ্র আলো এসে পড়ছে তার মুখে। চুলগুলো শীতের বাতাসে মৃদু মৃদু উড়ছে। আমি বিমোহিত চোখে তাকিয়ে রইলাম। শুভ্র ভাই ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললেন,
‘ এখন আরও জোরে গাইব। তোর ভালো না লাগলে কানে আঙ্গুল ঢুকা। আমি হলাম স্বাধীন দেশের নাগরিক। তোর মতো পুচকু আমার স্বাধীনতা খর্ব করবে আর আমি তা মেনে নেব, তা হতে পারে না।’
আমি বিরক্ত গলায় বললাম,
‘ আপনি একটা যাচ্ছে তাই মানুষ। আপনার সাথে তর্কে জড়ানো মানেই নিজের পায়ে কুড়াল মারা। আপনি আমাকে কেন ডেকেছেন বলুন। আমার ফ্রেন্ডরা আমার জন্য অপেক্ষা করছে।’
শুভ্র ভাই দায়সারা কন্ঠে বললেন,
‘ করুক।’
আমার রাগ তখন সপ্তমাকাশে। আমি ফুঁসে উঠে বললাম,
‘ করুক মানে? আপনি কারণটা বলবেন? নাকি আমি এমনি চলে যাব?’
শুভ্র ভাই এবার দাঁড়ালেন। আমার দিকে নরম দৃষ্টিতে তাকালেন। ভীষণ আদুরে গলায় বললেন,
‘ আমি কি তোকে শুধু কারণেই ডাকি? অকারণে ডাকি না?’
আমি নিভে গেলাম। সরু চোখে তাকালাম। আমাকে এভাবে তাকাতে দেখেই শব্দ করে হেসে উঠলেন শুভ্র ভাই।
‘ হাসছেন কেন?’
উনি ঝট করে হাসি থামালেন। চোখে-মুখে গম্ভীরতা এনে বললেন,
‘ আজ কি জ্যোৎস্না দেখেছিস? এটা কে বলে মুনলিট নাইট। তোকে আজ প্রেকটিক্যালি ‘মুনলিট নাইট’ কম্পোজিশন শেখাব বলে ডাকলাম। চল। লেট’স স্টার্ট।’
এই অসহ্য লোকটির কথায় রাগে কান্না পেয়ে গেল আমার। জন্মদিনের দিন। প্রাণের বন্ধুদের অপেক্ষা করিয়ে সে আমাকে মুনলিট নাইট কম্পোজিশন শেখাবে। ভাবা যায়? রাগে আর বিরক্তিতে নিজের চুল টানতে ইচ্ছে করছে আমার। কেন এলাম আমি? এই লোকটির কথায় নেচে নেচে রাস্তায় নেমে আসাটাই বিরাট ভুল হয়েছে আমার। শুভ্র ভাই ধমক দিয়ে বললেন,
‘ কি রে? পড়ার কথা শুনে আট্যাক ফ্যাট্যাক খেয়ে গেলি নাকি?’
আমি জবাব দিলাম না। শুভ্র ভাই নিজের চাদরটা আমার কাঁধে ছড়িয়ে দিয়ে চুলগুলো মুক্ত করে দিলেন। ডানহাতটা চেপে ধরে বললেন,
‘ চল।’
‘ আমি কোথাও যাব না।’
‘ না গেলে ফিরে যা। আসার সময় দুইটা মারমুখো কুকুর দেখে এলাম। যাওয়ার সময় তাদের সাথে সাক্ষাৎ করে যাস। যা যা…’
আমি আবারও ভয়ে সিটিয়ে গেলাম। শুভ্র ভাই সবসময়ই আমায় ট্রেপে ফেলেন। এইবার তিনি মারাত্মক এক খেলা খেলেছেন। এই খেলা থেকে বেরুনো আপাতত অসম্ভব। আমি মুখ কালো করে হাঁটতে লাগলাম। বিরক্তি আর ভালো লাগার মিশ্রণে ঢাকা ওই মানুষটির হাতে হাত রেখে কিছুটা পথ হাঁটতেই উপলব্ধি করলাম, আমার ভালো লাগছে। এমনই এক রাতের, নির্জন রাস্তার, বিশ্বস্ত হাতের স্বপ্নই তো বুনেছিল এই সুপ্ত, অবুঝ মন। এর থেকে সুন্দর ইচ্ছে-পূরণ কি হয়? হতে পারে? আধঘন্টা মতো হাঁটার পর প্রথম কথা বললেন শুভ্র ভাই। নরম গলায় বললেন,
‘ তোর পায়ে জুতো নেই কেন? পায়ে ব্যথা লাগছে না?’
আমি তখন দমবন্ধ ভালো লাগায় চারপাশটা দেখতে ব্যস্ত। শুভ্র ভাইয়ের ছোট্ট কথাতেও খুশিতে ঝুমঝুম করে ওঠে বললাম,
‘ অনেকদিন খালি পায়ে হাঁটা হয় না। ভালো লাগছে।’
শুভ্র ভাই মৃদু হাসলেন। রাস্তার ধারের টং দোকানটা ইশারা করে বললেন,
‘ চল, চা খাই।’
আমরা টং দোকানের দাওয়ায় দাঁড়ালাম। অন্ধকার দোকানটায় টিমটিম করে জ্বলছে হলুদ আলো। পানির কেতলি থেকে নিরবিচ্ছিন্ন ধোঁয়া উড়ছে। খদ্দেরবিহীন টং দোকানে বিরসমুখে চুলো সামলাছেন দোকানী। গায়ে তার লাল টকটকে শীত কাপড়। শুভ্র ভাই দু’কাপ স্পেশাল চা অর্ডার করে ব্রোঞ্চোাা বসলেন। আমার হাত টেনে পাশে বসালেন। দোকানী ছাঁকনিতে চা ঢালতে ঢালতে বার কয়েক আড়চোখে তাকালেন। কৌতূহল দমন করতে না পেরে বললেন,
‘ নতুন বিয়া করছেন নাকি মামা? মামি মাশাআল্লাহ খুব সুন্দর।’
শুভ্র ভাই হেসে বললেন,
‘ দেখে বউ মনে হচ্ছে নাকি মামা?’
‘ তাই তো মনে হইতাছে। এতোদিন ধইরা দেখতাছি। একবার দেখলেই বুইঝা যাই কোনটা পাটক্ষেত আর কোনটা গইঞ্চা ক্ষেত।’
আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম,
‘ গইঞ্চা ক্ষেত কি?’
শুভ্র ভাই জবাব না দিয়ে হাসলেন। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন,
‘ চা’টা কিন্তু অস্থির বানিয়েছ মামা। মামি বোধহয় চা খেয়েই ফিদা।’
দোকানী পান খাওয়া লাল দাঁত বের করে হাসলেন। শক্তপোক্ত তামাটে চমড়াই ঈষৎ লজ্জার ছায়া। আমি চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিলাম। ঠান্ডা শিরশিরে বাতাসে বুক ভরে এলো। শুভ্র ভাই চা শেষ করে অল্প কিছুক্ষণ ফোন ঘাটাঘাটি করলেন। উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন,
‘ চল। মামা আসি।’
দোকানী বিগলিত হেসে বললেন,
‘ আইচ্ছা।’
টং দোকান থেকে বেরিয়ে রাস্তায় দাঁড়াতেই সামনে এসে দাঁড়াল একটি রিক্সা। শুভ্র ভাই কোনো ভূমিকা না করেই রিক্সায় ওঠে বসলেন। উনার ভাবভঙ্গি থেকে মনে হচ্ছে রিক্সাটা যে এখানে পাবেন তা উনার আগে থেকেই জানা বা রিক্সাটা হয়তো আমাদের জন্যই বরাদ্দ।
‘ আর হাঁটতে ইচ্ছে করছে না। বলদের মতো দাঁড়িয়ে না থেকে ওঠে আয়। জলদি।’
আমি উঠে গেলাম। ফাঁকা রাস্তায় টুনটান শব্দ তুলে ছুটে চলল রিক্সা। কনকনে শীতের বাতাসে শুভ্রময় সুবাস। আকাশ ভরা তারা আর বিরাট এক চাঁদ। জ্যোৎস্নায় মাখামাখি দালান-কোঠা। পিচে ঢালা রাস্তা। মনের মাঝে অন্যরকম এক স্বস্তি। শম্ভুগঞ্জ বিজ্রের ওপর রিক্সা থামল। ঘড়িতে কয়টা বাজে জানা নেই। হয়ত শেষ প্রহর চলছে। শুভ্র ভাই আমাকে নিয়ে নেমে দাঁড়ালেন।
ব্রিজের রেলিং ঘেঁষে বেশ দূরত্ব রেখেই দাঁড়ালেন। আমি বিস্মিত চোখে নদী দেখছি। জ্যোৎস্নার আলোয় নদীর কি অলৌকিক রূপ! আমি চোখ ঘুরিয়ে শুভ্র ভাইয়ের দিকে তাকালাম। তিনি আমার দিকেই তাকিয়ে ছিলেন। চোখে চোখ পড়ল। শুভ্র ভাই চোখ সরালেন না। তার গম্ভীর, গভীর দৃষ্টি আমার চোখে-মুখে ঘুরতে লাগল। অস্বস্তিতে কাটা হয়ে উঠল শরীর। শুভ্র ভাই চোখের ইশারায় সামনের দিকে তাকাতে বললেন। উনার দৃষ্টি লক্ষ্য করে সামনের দিকে তাকালাম। নদীর ঠিক মাঝ বরাবর চোখ যেতেই থমকে গেলাম আমি। নদীতে মাটির প্রদীপ ভাসছে।
একটা দুটো নয়। অসংখ্য প্রদীপ। প্রদীপের হলদে আলো নদীর পানিতে প্রতিফলিত হয়ে জ্বলজ্বল করে উঠছে। প্রদীপগুলোর দু’পাশে দুটো নৌকা। দুই নৌকা থেকে দুটো হাত একে একে সাজাচ্ছে সেই প্রদীপ। প্রদীপগুলো ধীরে ধীরে নতুন রূপ নিলো। নদীর বুকে আলো ঝলমলে রোদপাখি লেখাটা ভেসে উঠল। ঠিক তার নিচেই ভাসলো আরো একটা শব্দ ‘ভালোবাসি’। আমি বিস্ময়ে মুখ চেপে ধরলাম। উথালপাতাল আনন্দ নিয়ে শুভ্র ভাইয়ের দিকে তাকালাম। শুভ্র ভাইয়ের মুখ-চোখ স্বাভাবিক। আমাকে তাকাতে দেখে কপাল কুঁচকে বললেন,
‘ বাপরে! শহরের আনাচে কানাচে প্রেমিক জুটিয়ে ফেলছিস দেখছি। নদীতেও রোদপাখি। আকাশেও রোদপাখি। কাহিনী কী?’
তার ইশারায় আকাশের দিকে তাকালাম আমি। নৌকা থেকে ফানুশ উড়ানো হচ্ছে। জ্যোৎস্নার আলো ছাপিয়ে হলদে আলোয় ছেঁয়ে গেছে ঝাপসা অন্ধকার। আমি কয়েক মুহূর্তের জন্য নিঃশ্বাস নিতে ভুলে গেলাম। বুকের খাঁচায় আটকে থাকা মনটা চেঁচিয়ে উঠে বলল,
‘ এমনটা কখনই হয় নি। এতোগুলো সুপ্ত ইচ্ছে কখনও তো একসাথে পূরণ হয় নি। হঠাৎ এতোটা ভালোলাগা তো কেউ উপহার দেয় নি। এটাই প্রথম।’
আমি বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিলাম। পৃথিবীটা হঠাৎ করেই খুব বেশি সুন্দর হয়ে উঠল। ফানুসগুলো অদূরে হারিয়ে যাওয়া পর্যন্ত আমি নির্ণিমেষ তাকিয়ে রইলাম। কিছুক্ষণ পর হাতে শুভ্র ভাইয়ের আলতো স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠলাম। শুভ্র ভাই ভ্রু বাঁকিয়ে বললেন,
‘ এই? এমন পাবদা মাছের মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? মরে টরে যাস নি তো?’
আমি হাসিমুখে তাকালাম। কোনো এক অদ্ভুত কারণে শুভ্র ভাইয়ের অদ্ভুত কথাগুলোও ভীষণ ভালো লাগছে। অযথায় খিলখিল করে হাসতে ইচ্ছে করছে। জন্মদিনের প্রথম প্রহরটাকে খোঁদাই করে রেখে দিতে ইচ্ছে করছে বুকের গুপ্ত কোনো পাটাতনে। শুভ্র ভাই ব্যস্ত ভঙ্গিতে ঘড়ি দেখলেন। চিন্তিত গলায় বললেন,
‘ এতো হাসি দেখিয়ে লাভ নেই। এসব কিছু আমি করি নি।’
আমি আবারও হাসলাম। শুভ্র ভাই কপাল কুঁচকে বললেন,
‘ পাগল নাকি? অযথা হাসছিস কেন? চল। অল মোস্ট দুটো বাজে।’
শুভ্র ভাই আমার হাত ধরে রিক্সায় ওঠে বসলেন। কেউ কোনো কথা বলছি না। ফাঁকা রাস্তায় কনকনে বাতাস ভেদ করে ছুটে চলছে রিক্সা। শুভ্র ভাই বারবার আমার দিকে তাকাচ্ছেন। উনার এই তাকানোতেও ভীষণ হাসি পাচ্ছে আমার। স্পৃহাদের বাসার কাছাকাছি আসতেই নড়েচড়ে বসলেন শুভ্র ভাই। গেইটের সামনে রিক্সা থামল। আমি রিক্সা থেকে নামতেই রিকশাওয়ালা মামা বেশ কয়েকটা গোলাপ এগিয়ে দিলেন। সাথে দিলেন ধবধবে সাদা এক লেফাফা। আমি ইতস্তত করে ফুল আর লেফাফাটা নিলাম। শুভ্র ভাই ডানপাশে চেপে বসলেন। রিক্সা থেকেই হাতটা চেপে ধরে কাছে দাঁড় করালেন। খানিকটা ঝুঁকে এসে ফিসফিসিয়ে বললেন,
‘ হ্যাপি জানুয়ারি রোদপাখি। তোমার জীবনটা জানুয়ারিময় হোক।’
আমি কপাল কুঁচকে তাকালাম। কোনো প্রশ্ন করার আগেই রিক্সা ছুটলো। মুহূর্তেই হারিয়ে গেল মোড়ের বাঁকে। আমি দ্রুত পায়ে বাড়িতে ঢুকলাম। গেইটটা এখনও খোলা। আমি তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলাম। বান্ধবীরা বিছানায় আকাঁ বাঁকা হয়ে শুয়ে আছে। আমাকে রুমে ঢুকতে দেখেই সব কটা সরু চোখে তাকাল। ছামি চেঁচিয়ে উঠে বলল,
‘ মহারাণীর আগমন শুভেচ্ছার স্বাগতম। কুত্তা। যাবি তো যাবি কেকটা কাইটা যেতে পারলি না? আমরা একা একাই কেটে ফেলছি।’
আমি অপরাধীর দৃষ্টিতে তাকালাম। স্পৃহা হাই তুলতে তুলতে বলল,
‘ ফ্রেশ টেশ হয়ে বাঁশ খাওয়ার জন্য রেডি হয়ে আয় যা। তোকে সাময়িক বিরতি দেওয়া হলো।’
আমি দ্রুত পায়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলাম। আঁচলের নিচ থেকে ফুল আর লেফাফাটা বের করলাম। ফুলগুলো ভেসিনের ওপর রেখে লেফাফা খুললাম। লেফাফার ভেতর লম্বা একটা চিঠি। তাতে লেখা,
‘ “তখন ২০১৭ সাল। জানুয়ারি মাসের শীতটা জমে এসেছে মাত্র। চট্টগ্রাম থেকে ফিরেছি দু’দিন হলো। হঠাৎই আম্মু এসে বললেন, ‘ শুভি? তোর কোনো পছন্দ আছে?’ আমি মনে মনে অবাক হলেও হেসে বললাম,’ কেন? বিয়ে টিয়ে করাবে নাকি? মাত্র থার্ড সেমিস্টার সো ওসব চিন্তা করো না।’ আম্মু বললেন, ‘আরে ধুর! বিয়ে করাব কেন? অন্য একটা কথা আছে। আগে বল, পছন্দ আছে নাকি নেই?’
আমি হাতের ফোনটা পাশে রেখে হাসিমুখেই বললাম, ‘নেই।’ সাথে সাথেই কিশোরী মেয়েদের মতো খুশি হয়ে উঠলেন আম্মু। তার আনন্দে ঢাকা মুখ দেখে মনে হচ্ছিল, ছেলের পছন্দ না থাকার মতো আনন্দময় ঘটনা এই দুনিয়ায় দ্বিতীয়টি ঘটতে পারে না। কিছুক্ষণ হাসি হাসি মুখ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে ইনিয়ে বিনিয়ে কথা পাড়লেন, ‘ শুভি? ফোনটা রেখে মায়ের কথাটা মনোযোগ দিয়ে শোন। মা তো তোর একটাই তাই না?’ আম্মুর কথায় দমফাটা হাসি হাসলাম আমি। হাসতে হাসতেই বললাম, ‘ কি বলবা বলে ফেলো। এতো পেচিয়ে পুচিয়ে বলার প্রয়োজন নেই।’
আম্মু আর পেঁচালেন না। খুব সহজ সরল ভাষায় জানালেন তিনি পুত্রবধূ হিসেবে অসাধারণ একটা মেয়ে পছন্দ করেছেন। যাকে বিয়ে না করলে আমার জীবনটা ব্যর্থ হলেও হতে পারে। আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, ‘হঠাৎ বিয়ে নিয়ে পড়লা কেন? বুঝলাম না। আমি এখন বিয়ে টিয়ে করতে পারব না।’ আম্মু ভীষণ উৎসাহ নিয়ে বললেন, ‘তোকে আমি একবারও বলেছি যে বিয়ে কর? আমি শুধু মেয়ের কথা বলছি। বিয়ের কথা নয়। তোর কাজ হলো প্রেম করা।
তারপর যখন ইচ্ছে হবে তখন বিয়ে করবি, ব্যস।’ আমি হতভম্ব চোখে আম্মুর দিকে তাকিয়ে রইলাম। কোনোরকম জিগ্যেস করেছিলাম, ‘মেয়েটা কে?’ আম্মু বেশ আগ্রহ নিয়ে মেয়ের অতীত,বর্তমান, ভবিষ্যৎ, হাঁটা-চলা, ঘুম সব বিশ্লেষণ করলেন। আমি চোখ কপালে তুলে বললাম, ‘ অসম্ভব। তুমি পাগল হয়ে গিয়েছ মা। ওই বাচ্চাটা? আল্লাহ! কি বলছ? প্লিজ আম্মু, এসব পাগলামো বন্ধ করো।’ আম্মু পাগলামো বন্ধ করলেন না। পৃথিবীতে হয়ত তিনিই প্রথম মা যিনি প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেকে প্রেমে পড়ার জন্য হাজার হাজার মাসলা দিলেন। কিন্তু কাজ হল না। আমি প্রেমে পড়লাম না। অবশেষে সেই ঠান্ডার রাতেই আমাকে বগল দাবা করে নিয়ে গেলেন মেয়ে দেখাতে।
মনে মনে আমি তখন প্রণোদ গুণছিলাম। ‘আমার প্রেমিকা আছে’ এই ছোট্ট মিথ্যাটা বলতে না পারার জন্য নিজেকেই গালি দিচ্ছিলাম। মেয়ের বাড়ি বেশি দূরে নয়। আমার একমাত্র ফুপুর বাড়িতেই তার বসবাস। কাকতালীয়ভাবে ফুপির বাড়ির এই মেয়েটির সাথেই আমার দেখা সাক্ষাৎ নেই প্রায় অনেক বছর। আমি যখন বাসার বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করছিলাম, আম্মুকে বিরাট এক ধমক দিয়ে এসব পাগলামো বন্ধ করতে বলব ঠিক তখনই ছোট্ট একটা মেয়ে দরজা খুললো। আমার মায়ের সাথে অল্প কিছুক্ষণ জড়াজড়িও করল।
আমি যে হুট করেই গায়ে কালো সুয়েটার আর মাথায় টুপি পরা মেয়েটির প্রেমে পড়ে গেলাম তেমনটা নয়। মেয়েটা ভীষণ ছোট। তাকে দেখে আমার প্রথম ভাবনাটা ছিল, এই পিচ্চির গালগুলো নিশ্চয় খুব নরম হবে? তারপর, সময় করে জানলাম এই সেই পিচ্চি যাকে পুত্রবধূ হিসেবে না পেলে আমার আম্মুর জীবনটা ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে। আমাকে এটা সেটা বুঝিয়ে মিনিটে মিনিটে মারা যাচ্ছেন। আমি মেয়েটাকে বেশ খেয়াল করে দেখলাম। সুন্দরী নয় মিষ্টি। চোখে-মুখে উপচে পড়া মায়া। তবে বয়স নিতান্তই অল্প। এই ১৪/১৫ হবে। আমি কোনো আকর্ষণ বোধ করলাম না।
প্রেমে পড়ার ব্যাপারটা আমার মাথাতেই এলো না। তবে প্রবল আগ্রহ হলো। যে মেয়ের জন্য মায়ের এতো পাগলামো তাকে জানার আগ্রহ হওয়াটা স্বাভাবিক। আর সেই আগ্রহটাই আমার কাল হলো। জানুয়ারি পেরিয়ে ফেব্রুয়ারিতে এসেই বুঝতে পারলাম ঘটনা ঘটে গিয়েছে। আম্মুর রোগ আমার মধ্যেও ছড়িয়ে গিয়েছে এবং তা সময়ের সাথে সাথে আরো ভয়ঙ্কর রূপ নিচ্ছে। আজ ২০২১। সেই জানুয়ারি মাস। রোগটা এখন রক্তে রক্তে মিশে গিয়েছে আমার।
চারটা বছর ধরে ছিন্নভিন্ন রোগে আহত হচ্ছি। মরছি। ভাঙছি। ভেঙে গুড়িয়ে গিয়েও তাকে চাইছি। শুধুই তাকে চাইছি। এই রোগটা খুব প্রিয় আমার। এই অপেক্ষা, এই দূরত্ব সব কিছুতেই প্রিয়তার স্বাদ। সেই সাথে প্রিয় এই জানুয়ারিটাও। এই রোগময় গোটা জানুয়ারিটা। রোদপাখি? তুমি কি আমার জানুয়ারি হবে? ব্যক্তিগত জানুয়ারি? যে জানুয়ারিটাকে কুয়াশার মতো আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রাখব। সকালের সোনালী রোদের মতো অসহ্য মিষ্টি কিছু আবদার রাখব। এই মেয়ে?হবে কি আমার জানুয়ারি? একান্তই ব্যক্তিগত জানুয়ারি?’
আমি চিঠিটা উল্টেপাল্টে দেখতেই চোখ পড়ল গোলাপের পাতায়। ভ্রু কুঁচকে ফুলগুলো তুলে নিয়ে সূক্ষ্ম চোখে পাতাগুলোর দিকে তাকালাম। প্রত্যেকটা পাতায় সাদা কালীতে লেখা ‘ আই ওয়ান্ট টু কিস ইউ!’ বাক্যটা পড়েই থতমত খেয়ে গেলাম আমি। চোখদুটো বড় বড় হয়ে গেল। তারপর লজ্জায় চোখমুখ লাল হয়ে এলো। ছিঃ কি বিশ্রী কথা! উনি এতো বিশ্রী কথা বলতে পারেন? এতোটা? ছিঃ কখনোই না।
#রোদবালিকা….
রোদ শুভ্রর প্রেমকথন সম্পূর্ণ গল্পের লিংক
https://kobitor.com/rodsuvro/
[ বিঃদ্রঃ উপরে ব্যক্তিগত জানুয়ারির বিষয়টা ওয়াসিকা নুযহাত আপুর ‘অক্টোবর রেইন’ উপন্যাসের সাথে মিলে যায়। যদিও আমি লাইনটা এডিট করে দিয়েছি। তবুও ব্যাপারটা বোধহয় ঠিক হয়নি। সেজন্য দুঃখিত।]