সন্ধ্যা ৬ টা ২০। সবাই ইফতার গোছাতে ব্যস্ত।বাসায় একদম উৎসবমুখর পরিবেশ।কোয়ারেন্টাইনের বিষন্নতা আমাদের ছুঁতে পারে নি একদম। ফুপ্পি,,মামু,,,মামানি সবাই এসে হাজির…আজ একসাথে ইফতার করবে সবাই।।বলতে গেলে ইফতার পার্টি।আপু আর আম্মু রান্নার দায়িত্বে আছে….আমি এটা ওটা করে সাহায্য করছি মাত্র….রোযায় খানিক কাহিল হয়ে গেছি বললেই চলে।আমার থেকেও কাহিল অবস্থা যার সে হলো জারিফ।বেচারার জীবনের প্রথম রোজা এটি… ফুপ্পি যে কতো কিছু বুঝিয়ে এখন পর্যন্ত ওকে সতেজ রেখেছে আল্লাহ মালুম।।
আদিবা আর জারিফ দুজনেই শুভ্র ভাইয়ের গলায় ঝুলে আছে….আর উনি অদ্ভুত অদ্ভুত সব গল্প শুনাচ্ছেন তাদের।। রোযা রাখলে আল্লাহ এতো গিফ্ট দিবে,, রাজপ্রাসাদ দিবে এসব বুঝিয়েও আদিবাকে রোযা রাখতে রাজি করতে পারেন নি উনি।।যে মেয়ে রাজপ্রাসাদের মানেই বুঝে না তাকে রাজপ্রাসাদের লোভ দেখিয়ে কি লাভ কে জানে??ভাইয়া হাতে কয়েকটা নিমের ডাল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে….এতোগুলো মেসহাকের মধ্যে কোনটা দিয়ে দাঁত মাজবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না সে।।আমি ড্রয়িং রুমে বিশাল এক পাটি বিছাচ্ছি….
সবাই মিলে নিচে বসে খাবে এটাই বাবা আর মামুর অর্ডার।তাদের মূলতত্ত্ব হলো….”আমাদের মূল যেহেতু গ্রামের মাটির সাথে মিশে আছে সেহেতু আমাদেরও উচিত গ্রামীণত্বের সাথে মিশে থাকা।আর সব ভুলা যাবে কিন্তু ঐতিহ্য ভুলা যাবে না।” শুভ্র ভাই একটু দূরে সোফায় বসে ছিলেন…আমাকে ওঠে যেতে দেখেই পেছন থেকে ডেকে উঠলেন।আমি অনিচ্ছা সত্ত্বেও উনার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই ভ্রু কুঁচকে বলে উঠলেন –
.
তোর সমস্যা কি বল তো?
.
আমার আবার কি সমস্যা? (অবাক হয়ে)
.
কোনো সমস্যা না থাকলে আমার সামনে এভাবে ঘুরঘুর করছিস কেন?কাহিনী কি বল তো?আমার রোযা নষ্ট করার প্ল্যান নাকি তোর?তুই তো দেখি আমার জীবনে হিটলারনীর রোল প্লে করছিস।
.
উনার কথায় রাগে মেজাজ চটে গেলো আমার।।এমনি ক্ষুধার জ্বালায় বাঁচি না আরেকজন আসছে বেহুদা আলাপ ঝাড়তে।আমি হালকা বিরক্তি নিয়ে বলে উঠলাম –
.
শুভ্র ভাই?আপনি নিজেকে এতো ইম্পোর্টেন্ট কেন ভাবছেন?আমার কি দুনিয়াতে আর কোনো কাজ নেই যে আপনার সামনে ঘুরঘুর করবো….দেখছেন না আমি পাটি বিছাচ্ছিলাম।।আর আমার সামনে আসা যাওয়াতে আপনার রোযা নষ্ট হতে যাবে কেন শুনি??
.
অবশ্যই নষ্ট হবে।। মেয়ে মানেই নষ্টের কারবার….এদের জন্য জীবন নষ্ট,,,সময় নষ্ট,,টাকা নষ্ট,, রোযা নষ্ট সব নষ্ট।।দেখ আর মাত্র ১১ মিনিট বাকি ইফতারের….এই ১১ মিনিটের মধ্যে আমার সামনে তুই আসবি না।।আর এই নুপুরের বিরক্তকর শব্দ তো একদমই তৈরি করবি না।।বুঝলি??
.
রাগে আমার মাথা ফেটে যাচ্ছে….মেয়ে মানেই নষ্টের কারবার?এতোবড় অপমান??রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে কিছু একটা বলতে যাবো ঠিক তখনই উনি আমাকে শুনিয়ে জারিফকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন –
.
জারিফ শোন!!অলওয়েজ মেয়েদের থেকে দশহাত দূরে থাকবি।মেয়ে মানেই ঝামেলা বুঝলি?এই ধর তোর সামনে দিয়ে যাবে….তাতে কিন্তু তাদের যথেষ্ট মোটিভ থাকে….শুধু শুধুু কোনো কাজ করে না এরা…
.
মোটিভ মানে কি দাদাভাই??
.
মোটিভ মানে হলো উদ্দেশ্য!! তারপর শোন…
.
উনাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে আদিবা ভ্রু কুঁচকে বলে উঠলো –
.
দাদাভাই?উদ্দেশ্য অর্থ কি?
.
এবার আমি হেসে উঠলাম।উনি বিরক্তি নিয়ে বলে উঠলেন-
.
তোদের দুই ভাইবোন কে কিছু বলতে গেলে আমাকে ডিকশনারি নিয়ে বসতে হবে বুঝলি??
.
আদিবা আবারও উৎসাহ নিয়ে বলে উঠলো –
.
দাদাভাই দিকশনারি মানে কি?
.
ডিকশনারি মানে হলো একটা বই।আর একটা প্রশ্ন করবি তো তোর ভাগের চকলেট কাট।।সব জারিফকে দিয়ে দিবো।।আর জারিফ তুই??এতো প্রশ্ন করে মেয়েদের সামনে মান ইজ্জত খোয়াচ্ছিস কেন?চুপচাপ সব প্রশ্ন মুখস্থ করে রাখ….ইফতার শেষে চুপিচুপি উত্তর দিবো ওকে?
.
আচ্ছা দাদাভাই।(মুখ কালো করে)
.
ততক্ষণে পাটির উপর সব খাবার সাজানো শেষ প্রায়…পায়ের পায়েলটা অনেকটা খুলে যাওয়ায় ওটা লাগাতেই টি-টেবিলের উপর পা টা রাখলাম।।সেদিকে নজর যেতেই কৌতূহলী হয়ে পায়ের আঙ্গোটের দিকে ইশারা করে বলে উঠলো আদিবা-
.
ওটা কি দাদাভাই?
.
শুভ্র ভাই ভ্রু কুঁচকে আমার পায়ের দিকে তাকালেন।।তারপর ঠান্ডা গলায় বলে উঠলেন –
.
কি জানি চিনি না।।
.
আমি ওটা নিবো।(মুখ ফুলিয়ে)
.
নিবিই তো নিবি না?দুনিয়ার সব জিনিস হাতে ধরিয়ে দিলেও তোর নজর শুধু ওইদিকে।।তোরা সব কটা বোন তো এক টাইপ…. ত্যাড়ামোর চূড়ান্ত।। খুঁজে খুঁজে পায়ের আংটিও বের করে ফেলেছিস….কি বুদ্ধি তোদের…
.
কথাটা বলে রাগি চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন –
.
এই তুই যাবি এখান থেকে?নাকি কানের নিচে মারবো?
.
আমি মুখ ভেঙিয়ে সেখান থেকে চলে আসতেই পেছন থেকে উনার গলা ভেসে এলো।।উনি আদিবাকে আঙ্গোটের অপকারিতা বুঝাচ্ছেন….ওটা নিলে যে তার কতোবড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে….তাই উনার আলোচনার প্রধান বস্তু।।কিন্তু ছোট্ট আদিবা এতো যুক্তি বুঝলে তো??তারও প্রশ্নের শেষ নেই…শুভ্র ভাইয়ের মুখের অবস্থা এখন ” ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি” টাইপ।অবশেষে ইফতারের টাইম হলো…হৈ -হল্লোড় করে ইফতার শেষে হাত ধুতে গিয়ে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে বলে উঠলেন উনি-
.
তোরা সবগুলো বোনই এতো ডেঞ্জারাস কেন?এর শোধ কিন্তু আমি নিবো বুঝলি??আমার বাচ্চাকে এর থেকেও ডেঞ্জারাস বানাবো…..তারপর হাতে প্রশ্নের লিস্ট ধরিয়ে দিয়ে বসিয়ে দিবো আদিবা আর জারিফের বাসরে।।সারারাত বসে বসে প্রশ্ন করবে….বেশ হবে না??
.
উনার এমন বাচ্চামো কথায় খিলখিল করে হেসে উঠলাম আমি।।উনি কিছুক্ষণ নিঃশব্দে তাকিয়ে থেকেই বলে উঠলেন –
.
তোকে না এমন দাঁত বের করে হাসতে বারন করেছি??হাসবি না একদম….মুখ বন্ধ।।
.
আমি মাথা নেড়ে মুখ চেপে হাসতেই আবারও বলে উঠলেন উনি-
.
আমার প্রিন্সেসকে তোর সব খারাপ গুণগুলো শিখাবি রোদ।।এই দায়িত্ব তোর…একদম তোর কার্বন কপি হওয়া চাই।।চাই ই চাই।।
.
কথাটা বলে আমার ওড়না টেনে হাত মুছেই নামাযের জন্য চলে গেলেন উনি।।আমি পেছন থেকে উনার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছি চুপচাপ।।এই নিঃশব্দ চাহনীতে আজও কতো প্রশ্নের ছড়াছড়ি….কতো উত্তরের অপেক্ষা!!
.
রোদ শুভ্রর প্রেমকথন সম্পূর্ণ গল্পের লিংক
https://kobitor.com/rodsuvro/
#রোদবালিকা