আমি পা টিপে টিপে বাবার ঘরের সামনে যেয়ে দাঁড়াই। মা বিছানা গোছাচ্ছে ঘুমানোর জন্য আর বাবা পাশের একটা বিশাল চেয়ারে বসে পা দোলাচ্ছে। আমি সাথে সাথে দরজার পাশে লুকিয়ে পড়লাম। আমি চাইনা আমাকে বাবা বা মা কেউ দেখে ফেলুক।
“আচ্ছা রেনু, মেয়েদের ব্যাপারে কি ভাবছো?”
মা ভ্রু কুঁচকে বাবার দিকে তাকিয়ে বললেন,”মেয়েদের ব্যাপারে আবার কি ভাববো?”
“কি আশ্চর্য! মেয়েরা বড় হয়েছে। তাদের বিয়েশাদি দিতে হবে না? জমিদার বাড়ির মেয়েদের এতো দেরি করে বিয়ে হয়না।”
মা বাবার সামনে এসে দাঁড়ালেন। বাবার মুখটা এখন দেখতে পাচ্ছি না আমি।
“জমিদার বাড়ি জমিদার বাড়ি করবেন না। আপনারা জমিদার না। বড় মেয়েটা পড়াশোনায় ভালো। তাকে পড়াশোনাটা করতে দিলেন না। কলেজ গন্ডি পার হতে না হতে ঘরে বসিয়ে রাখলেন। এখন আবার বিয়ের তোরজোর শুরু করছেন? এসব কার বুদ্ধিতে করেন আপনি আমি জানিনা?”
বাবা উঠে দাঁড়ালেন। একটু রাগী রাগী গলায় বললেন,”কার পরামর্শে?”
“আপনার মেজো ভাইয়ের পরামর্শে। তার তো দুইটা ছেলে। আমার তো একটাও ছেলে নেই। তারপরেও আমার মেয়েদের নিয়ে তার হিংসার শেষ নেই। আর আমি ঘর করি যার সাথে তার কথা আর কি বলবো। মেয়েদের বাপ হয়ে মেয়েদের সর্বনাশ কিসে হয় বোঝে না।”
বাবা কিছুটা চুপ করে যান। এটা সত্যি, কোনো এক অদ্ভুত কারণে মেজোচাচা চান না আমরা পড়াশোনা করে অনেক বড় হই। অথচ তিনি ইতোমধ্যেই টাকা জমানো শুরু করেছে তার ছেলেদের বাইরের দেশে পড়তে পাঠাবে বলে। কিন্তু বাবাকে সবসময় কুপরামর্শ দিতে থাকে। এই বিয়ের বুদ্ধি তারই দেওয়া বুঝতে পারছি।
মা একটু থেমে আবার বলে,”আমার দাদাশ্বশুর এই বাড়ির নাম সাঁঝবাতির সাজবাড়ি রেখেছিলেন। যেহেতু নিজের মেয়ে হয়নি, তাই আমার শ্বশুরকে বলে গিয়েছিলেন, এ বাড়ির বড় যে দুই মেয়ে হবে তাদের নাম রাখতে হবে সাঁঝ আর সাজ। আপনার মেজো ভাই তো কম চেষ্টা করেনি আমাদের আগে নিজেদের সন্তান নিতে। এমনকি আমার প্রথম কন্যা সন্তানকে আমার গর্ভে থাকতেই কে মেরে ফেলেছিলো? আপনি সব জেনেও আপনার মেজো ভাইয়ের অন্ধ ভক্ত হয়ে আছেন। তারপরেও তো আমার মেয়েদের নামেই এই বাড়ি হয়েছে, আর এটাই উনার যতো হিংসার কারণ।”
বাবা এখন একদম চুপ করে যান। এটা সত্যি। আপা হওয়ার আগেও মায়ের এক সন্তান মায়ের গর্ভেই মারা যায়। কিন্তু সেইটা ছিলো ইচ্ছাকৃতভাবে করা একটা কাজ। মায়ের বাথরুমে অনেক সাবানের ফেনা ছড়িয়ে রাখা হয়েছিলো। যদিও এখনো জানা যায়নি কে এই কাজ করেছে কিন্তু মায়ের ধারণা এটা মেজোচাচারই কাজ। দাদী অবশ্য এই বিষয়ে কিছু বলেন না, শুধু আপন মনে হাসেন। মায়ের গর্ভেই যখন মায়ের প্রথম বাচ্চা মারা যায় তখন ছিলো মায়ের আট মাস। মেয়েটা নাকি ভূবনভোলানো সুন্দরী হয়েছিলো, কিন্তু মৃত। মেজোচাচা জানতেন না যে, ছেলে হবে না মেয়ে। তারপরেও তিনি এই কাজ করেছিলেন বলে মা মনে করেন।
বাবা আর কথা বাড়ালেন না। মা খানিকক্ষণ রাগে গজগজ করতে করতে লাইট অফ করে শুয়ে পড়েন। আমার দাদীর বয়স হওয়ায়, আর কিছুটা অসুস্থ হওয়ায় তার ছেলেরা কখনো নিজেদের ঘরের দরজা আটকে ঘুমায় না। হঠাৎ করে দাদী যদি তাদের ডাক দেন রাতে, তারা যেনো শুনতে পারে। তবে এই জিনিসটায় আমার বেশ লাভ হলো। এখন আমি ঘরে ঢুকে যেতে পারবো। কিন্তু এখনই ঢোকা যাবে না। বাবা খুব তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে যান, কিন্তু মায়ের ঘুম এতো তাড়াতাড়ি আসে না। মায়ের ঘুমটাও ভীষণ পাতলা। আমি দরজার বাইরে মায়ের ঘুমের জন্য অপেক্ষা করছি।
চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। বিদ্যুৎ অপচয় রোধের জন্য মেজোচাচা রাতে ঘুমানোর সময় বাড়ির সব লাইট অফ করে দেন। বাবার ঘরের সামনে ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে আমি ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকি। এদিকে ভিতর ভিতর খুব উত্তেজনা। আমি কি কাজটা ঠিক করছি? আপাকে চাবিটা দিলে তো আপা তেতলায় চলে যাবে। যদি সেখানে কোনো বিপদ হয় আপার? আবার রূপার যে বাক্সটার কথা আপা বললো, সে চাবি-ই বা পাবো কোথায়? উত্তেজনায় আমি কাঁপতে থাকি।
কতক্ষণ এভাবে অপেক্ষা করছি জানিনা, হঠাৎ বারান্দায় কারো ছায়া দেখে চমকে উঠি আমি। কোনোমতে তোতলাতে তোতলাতে বললাম,”কে? কে ওখানে?”
আচমকাই ছায়াটা সরে গেলো দরজার সামনে থেকে। আমি ঠকঠক করে কাঁপছি। যতো দোয়াদরুদ পারি সব পড়ার চেষ্টা করছি,কিচ্ছু মনে পড়ছে না। আমি যে ছুটে নিজের ঘরে চলে যাবো সে সাহসটুকু পাচ্ছি না। নিকুচি করেছে চাবির, আপা যা বলে বলুক। আমি এখানে আর কিছুক্ষণ বসলে ভয়ে অজ্ঞান হয়ে যাবো। মিশমিশে কালো লম্বা একটা ছায়া। এমনিতেই এ বাড়ি নিয়ে মানুষের জল্পনা কল্পনার শেষ নেই। স্কুলে শুনেছি সবাই বলে এখনো নাকি মীর মতলেব খাঁ এর আত্মা এই বাড়িতে ঘোরাঘুরি করে। আমি যদিও সারাদিন অনেক দস্যিপনা করে বেড়াই, কিন্তু আমি খুব ভীতু কিসিমের। যদিও এখনো এসব কিছুই আমরা দেখিনি, তারপরেও কি দরকার?
আমি বুকে ফুঁ দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। অনেক কষ্টে আয়াতুল কুরসিটা মনে করলাম। আস্তে আস্তে পড়তে পড়তে এক পা দুই পা করে বাবা মায়ের ঘরের সামনে থেকে সরে দাঁড়ালাম। এরপর ভোঁ দৌড়। এক দৌড়ে ঘরে চলে আসলাম।
এসেই দরজাটা ধম করে বন্ধ করে দিলাম। পাশের টেবিলে রাখা জগ ধরে ঢকঢক করে পানি খেলাম এক জগ। এখনো হাঁপাচ্ছি আমি। বুকের মধ্যে মনে হচ্ছে কেউ হাতুড়ি পেটা করছে।
আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আপা। কিছু একটা আন্দাজ করার চেষ্টা করছে।
“এ কেমন অভ্যাস সাজ? জগের থেকে গ্লাসে পানি ঢালবি না? জগ ধরেই পানিটা খেয়ে নিলি? আর এরকম হাঁপাচ্ছিস কেনো তুই? চাবি আনতে পারিস নি?”
আমার ভীষণ রাগ হয় আপার উপর। দেখছে আমার এই অবস্থা, এখনো চাবি চাবি করে যাচ্ছে। এতোই দরকার তুই যা না আনতে।
আমি রাগ করে অন্যদিকে ফিরে বললাম,”আনতে পারিনি চাবি। এখন কি করবো? তেতলার তালা ভাঙবো?”
আপা ভ্রু কুঁচকে বললো,”এসবের মানে কি? তোকে তেতলার তালা ভাঙতে কে বলেছে?”
আমি রাগে গজগজ করে বললাম,”আরেকটু হলে মীর মতলেব খাঁ এর আত্মা আমাকে গলা টিপে মেরে ফেলতো, আর তুই আছিস তোর চাবি নিয়ে।”
আমার কথা শুনে আপা চোখ বড় বড় করে তাকায় আমার দিকে। তার চোখেমুখে কৌতুহল। বেশ কিছুক্ষণ আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে হঠাৎ আপা হেসে দেয়। সে কি হাসি, হাসতে হাসতে চোখ দিয়ে পানি পড়ার যোগাড়।
রাগে আমার শরীর জ্বলতে থাকে। কি মেয়েরে বাবা! ওর জন্য এতোটা ঝুঁকি নিলাম, আরেকটু হলে তো মৃ ত্যুটাই বুঝি হতো। আর ও এমন হাসছে?
“তুই হাসছিস আপা? যা তোর সাথে আর কথাই বলবো না আমি।” মুখ ফুলিয়ে বসে থাকি আমি।
আপা এসে আমার পাশে বসে, আমার কাঁধে হাত রাখে।
“মীর মতলেব খাঁ সম্পর্কে যে মীথ শুনেছিস তুই, সেগুলো তোর মাথায় ঢুকে গেছে। এজন্য ভয় পেয়েছিস তুই, আর কিছুই না।”
আমি অসহিষ্ণু হয়ে বলি,”কিন্তু আপা তুই শুনবি তো কি হয়েছে, তারপর বল।”
আপা আমার সামনে এসে বসে। তার চোখ মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে অবিশ্বাস নিয়েই শুনবে আমার কথা।
আমি শুরু থেকে কি কি হয়েছে সব বললাম। হঠাৎই দেখলাম আপার চোখমুখ কেমন শক্ত হয়ে উঠছে। চোখগুলো কেমন লাল হয়ে উঠলো হঠাৎ। আমি কিছুটা ভড়কে যাই। আপার হাত ধরে বলি,”এই আপা এই, চুপ করে গেলি কেনো তুই? আর তোকে এমন দেখাচ্ছে কেনো? কি হলো তোর?”
আপা কঠিন গলায় বললো,”তুই ঠিক দেখেছিস সাজ? লম্বা মিশমিশে কালো ছায়া?”
আমি জোরে জোরে মাথা নেড়ে বললাম,”একদম ঠিক দেখেছি আপা, নিজের চোখে।”
হঠাৎ আপা একটা অদ্ভুত কাজ করলো যা দেখে আমার বুকটা ধক করে উঠলো, মনে হয় হৃৎস্পন্দনও একটা হারিয়ে ফেললাম।
আপা চোখটা উলটে ফেললো, এখন আপাকে দেখতে খুবই ভয়ংকর লাগছে। আমি কেঁপে উঠি ভয়ে।
“দাদী, ওরা মনে হয় বুঝে ফেলেছে চাবিটা বাবার কাছে৷ ওরা এসে গেছে দাদী, ওরা এসে গেছে।”
আমি স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে আছি আপার দিকে। আপা ঘরে বসে দাদীর সাথে কথা বলছে কেনো? আর এসব হচ্ছেটা কি?
আপা মনে হলো মনোযোগ দিয়ে কিছু শুনছে। হঠাৎ আপা অসহিষ্ণু হয়ে মাথা নেড়ে বললো,”কিন্তু দাদী, আমাদের আগে ওরা যদি চাবি পেয়ে যায় তাহলে তো সব শেষ হয়ে যাবে দাদী। আজও ওরা এসেছিলো, কিন্তু সাজকে দেখে ওরা চলে গেছে। সাজ যদি আজ ওখানে না থাকতো আমি জানিনা কি হতো এতোক্ষণে।”
আপা দুইহাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠলো,”দাদী, রূপার বাক্সের চাবি কোথায় আছে? আমি তো কিছুই মনে করতে পারছি না। কিচ্ছু না।”
আমার পুরো শরীর কাঁপছে, মনে হচ্ছে ভীষণ জ্বর আসবে। আমার শরীর আর নিতে পারছে না এতোকিছু।
হঠাৎ আপা স্বাভাবিক হয়ে যায় যেনো এতোক্ষণ কিছুই হয়নি। দুই হাতে মুখটা মুছে বলে,”তোর আপা আছে তোর কাছে, ভয়ের কিছু নেই। আর এতোক্ষণ যা যা দেখেছিস সব ভুলে যা, কিছুই দেখিস নি তুই। সময় হলে সব জানবি।”
আমি তোতলাতে তোতলাতে বলি,”আপা আজ তোর পালঙ্কে ঘুমাই? একা থাকতে পারবো না আজ আপা।”
আপা লাইট অফ করে নিজের পালঙ্কে যেয়ে শুয়ে বলে,”আমার কাছে ঘুমানোটা ঠিক হবে না সাজ। ওরা আমার ক্ষতি করতে চায়, কারণ আমি অনেক কিছু জেনে গিয়েছি। কিন্তু একটা অজানা কারণে ওরা আমার কোনো ক্ষতি করতে পারে না। কিন্তু তোকে সেই শক্তি বাঁচাবে না। তাই আমার কাছে থাকলে আমাকে যে ক্ষতি করতে চায় তারা তোর ক্ষতি করে দিতে পারে। তুই তোর পালঙ্কেই ঘুমিয়ে যা। কোনো ভয় নেই, আমি আছি পাশেই।”
আপার আর কোনো সাড়াশব্দ পাইনা। সে রাতে আমার আর ঘুম হয়না। অনেক প্রশ্ন মাথায় চরকির মতো ঘুরতে থাকে। কারা আপার ক্ষতি করতে চায়? কি-ই বা জেনে গেছে আপা? প্রচন্ড মাথা যন্ত্রণায় আমি চুল চেপে ধরি। সে রাতে অনেক জ্বর আসে আমার। পুরো শরীর কাঁপিয়ে জ্বর। আমার আর কিছুই মনে নেই।
সকালে যখন আমার জ্ঞান ফেরে আমি দেখি বাড়ির সবাই আমার সামনে দাঁড়িয়ে। মা আমার হাতটা ধরে কাঁদছে। মেজো চাচী মাথায় পানি দিচ্ছে। বাবা, মেজো চাচা, ছোট চাচা সবাই গম্ভীর মুখে এক কোণায় দাঁড়িয়ে আছে।
আমি মাথা ঘুরিয়ে আপাকে খুঁজতে থাকি, কিন্তু কোথাও দেখতে পাইনা।
আমার জ্ঞান ফিরতে দেখে মেজোচাচা সাথে সাথে হুমড়ি খেয়ে ওঠে আমার সামনে।
“এইযে সাজ, তুমি কাল রাতে তোমার বাবা মায়ের ঘরে গিয়েছিলে?”
আমা বুকটা ধকধক করে ওঠে। মেজোচাচা কীভাবে এই কথা জানলো? তবে কি সবাই বুঝে যাবে আমি ওখানে রাতে কেনো গিয়েছিলাম?
আমার মা কখনোই বাড়ির কারো সাথে উঁচু গলায় কথা বলেনা। কিন্তু মেজো চাচার কথায় মা একটু রেগে যায়। উঠে দাঁড়িয়ে বলে,”কি হচ্ছে কি মেজো ভাই? আমার মেয়েটার মাত্র জ্ঞান ফিরলো। এখনো গায়ে আকাশ পাতাল জ্বর। এখনই এই প্রশ্ন ওকে না করলেই নয়? আর আপনি কীভাবে নিশ্চিত হচ্ছেন ও রাতে আমাদের ঘরে গিয়েছিলো?”
মেজো চাচা আমতা আমতা করে বললেন,”সকালে আমি নামাজ পড়তে যাওয়ার সময় ওর এক পাটি জুতা আপনাদের ঘরের সামনে দেখেছি।”
আমি চোখ বন্ধ করে মনে করতে থাকি, আমি কি একপাটি জুতা ফেলে রেখে এসেছি? কি জানি, মনে নেই। যে ভয়টা পেয়েছিলাম!
মা এবার আরেকটু চড়া গলায় বললো,”তো জুতাটা তো অন্যসময়ও ফেলতে পারে। রাতেই ফেলেছে তার কি নিশ্চয়তা? আর যদি আমার মেয়ে রাতে আমার কাছে যায়-ও তাতে আপনার কি সমস্যা? হয়তো রাতে ওর বাবা মা কে দেখতে মনে চেয়েছিলো।”
মেজোচাচা আরো কিছু বলতে চেয়েছিলো মায়ের প্রতিত্তোরে। কিন্তু মায়ের অগ্নিচোখের সামনে মেজোচাচা একটু মিইয়ে যান। আমার মা ও বেশ বড় সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে। এ পরিবারের সাত জনমের ভাগ্য আমার মায়ের মতো মেয়েকে পরিবারের বড় বউ হিসেবে পেয়ে। আমার নানাজান জজ ছিলেন, এখন অবসরপ্রাপ্ত। কিন্তু নানাবাড়ির খান্দানী রেওয়াজ এখনো আছে। আমার বাকি দুই চাচীর পরিবার মায়ের পরিবারের ধারেকাছেও নেই। আবার আমার মা উচ্চশিক্ষিত, বাকি দুই চাচী তেমন শিক্ষিত নয়। এজন্য মা কে বলতে গেলে সবাই একটু সমীহ করেই চলে। কেউ মুখে বলে না কিন্তু মা কে একটু একটু ভয় পায় সবাই।
দুপুরের পর থেকে আমি একদম সুস্থ, জ্বর নেই। মাথাটা বেশ হালকা লাগছে। ভীষণ খিদা পেয়েছে। কিন্তু শরীরটা খুব দূর্বল। আমি আমার পালঙ্কে শুয়ে আছি একা একা, আমার মা এতোক্ষণ আমার কাছেই ছিলো, এখন নেই। আমার শরীরে কোনো শক্তি নেই উঠে যেয়ে কিছু খাওয়ার। হঠাৎ দরজা ঠেলে আপা ঢুকলো ঘরে, তার হাতে একটা রূপালী রঙের থালা। মুখে মিষ্টি একটা হাসি আপার।
সকাল থেকে আপার খোঁজ পাইনি। একটাবার আমাকে দেখতেও আসেনি আপা। সে কি শোনে নি আমার জ্বর এসেছে? কি এমন জরুরি কাজ করছিলো সে যে আসতে পারেনি? আমি গাল ফুলিয়ে বসে থাকলাম, কিছু বললাম না।
“এই নে, খা।”
দেখলাম আপা গরম গরম পরোটা আর আলুর দম করে এনেছে, আমার খুব পছন্দের।
পেটে যদিও অনেক খিদা কিন্তু তবুও আমি মুখ খুললাম না।
আপা একটু হেসে বললো,”আপার হাতে খেয়ে নে সাজ, বেশিদিন তো আর আপাকে পাবি না।”
আপার কথা শুনে বুকটা ধক করে উঠলো আমার।
“কি বলছিস কি আপা? বেশিদিন পাবো না মানে? কোথায় যাবি তুই?”
“ওমা, আমার বিয়ে হবে না? বিয়ের পরও বুঝি আমি এখানে থাকবো?”
আমার মনটা খারাপ হয়ে যায়। আপা থাকবে না আমি ভাবতেই পারিনা। আপাকে জোরে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিই আমি।
“কালকের অনেক কিছু নিয়ে তোর অনেক প্রশ্ন আছে তাইনা?”
আপার কথায় আপাকে ছেড়ে দিয়ে চোখ বড় বড় করে তাকাই ওর দিকে। আপা আনমনে বসে আছে।
“আপা তুই কি আমাকে কিছু বলতে চাস?”
“আমি চাই না, দাদী চায়। সে চায় তুই সবটা জানিস।”
আমি উত্তেজনায় কাঁপছি থরথর করে। সত্যিই এতোদিন যা জানতাম না সব জানানো হবে আমাকে?
আপা আস্তে আস্তে উঠে যেয়ে দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ করে দিলো। এরপর আপা দক্ষিণের জানালার পাশে যেয়ে দাঁড়ায়। জানালার গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে উদাস গলায় বলতে থাকে,
“আমাদের দাদীর সম্পর্কে কতোটা জানিস সাজ?”
“এটা আবার কেমন প্রশ্ন আপা? আমাদের দাদী, তার সম্পর্কে তো সবই জানি আমরা।”
আপা হাসে, কিন্তু সেই হাসিতে কেমন বিষাদ মেশানো।
“কখনো কি দাদীর বাপের বাড়ি সম্পর্কে কিছু শুনেছিস তুই?”
“হ্যা জানি তো, দাদীর বাবা মা কেউ বেঁচে নেই। দাদীকে অনেক ছোট থাকতেই দাদাজানের বাবা দাদীকে এই বাড়ি নিয়ে আসেন, পরে তার বড় ছেলে মানে আমার দাদাজানের সাথে তার বিয়ে দেন।”
“কে তোকে এসব জানিয়েছে? দাদী নিজেই?”
“না দাদী না, দাদী কোনোদিন তার বাপের বাড়ি নিয়ে কিছু বলতে চায়না। এগুলো সবই শুনেছি বাবা মেজোচাচার কাছ থেকে।”
আপা জানালার পাশ থেকে হেঁটে এসে আমার সামনে দাঁড়ায়। এরপর ম্লান হেসে বলে,”অনেকটা ভুল জানিস তুই। হ্যা দাদীর বাবা মা বেঁচে নেই, কিন্তু তাদের মৃত্যু কোনো সাধারণ মৃ ত্যু ছিলো না। তাদেরকে খু ন করা হয়েছিলো।”
আমি আঁৎকে উঠলাম আপার কথা শুনে।
“কি বলছিস কি আপা?”
“হ্যা, আর তাদের খু ন হয়েছে এই বাড়িতেই। এই সাঁঝবাতির সাজবাড়িতেই জোড়া খু ন হয়েছিলো দাদীর বাবা এবং মায়ের।”
আমার ঘাম ছুটতে থাকে। উঠে দাঁড়াই আমি আপার সামনে। ওর দুই বাহু চেপে ধরে ঝাঁকাতে থাকি আমি।
“এসব কি উল্টাপাল্টা কথা বলছিস তুই আপা? তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেলো?”
আপা নিজেকে ছাড়িয়ে আবার জানালার ধারে যেয়ে দাঁড়ায়।
“হ্যা আমি যা বলছি সব সত্যি। কোনো উল্টাপাল্টা কথা আমি বলছি না৷ আর কে এই নোংরা কাজ করেছে তুই জানিস?”
আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বলি,”কে?” আপা একটু থেমে আস্তে আস্তে বলে,
“দাদাজানের বাবা মীর মতলেব খাঁ।”
স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছি আমি আপার দিকে তাকিয়ে। আমার সামনে পুরো পৃথিবী যেনো টলছে। দাদীর শ্বশুর কিনা দাদীর বাবা মা কে মেরে ফেলেছে? তাও আবার এই বাড়িতে? কিন্তু কি কারণে?
“দাদীর বয়স তখন অল্প। তেরো বছরের একটা কিশোরী তখন সে। দাদীর বাবার উত্তরের আইলের পাশে চৌদ্দ কাঠা বিস্তীর্ণ জমি। দাদীর আর কোনো ভাইবোন ছিলো না। দাদীর বাবা মাকে নিয়ে সুখের সংসার। ভালোই চলছিলো তাদের মধ্যবিত্ত পরিবার। হঠাৎই তাদের সেই সুখের সংসারে চোখ পড়ে মীর মতলেব খাঁ এর। সে প্রথমে দাদীর বাবাকে এই বাড়িতে ডেকে আনে। আর তাকে জানায় ওই জমিটুকু তার খুব মনে ধরেছে। দাদীর বাবাকে প্রস্তাব দেওয়া হয় ওই জমিটুকু যেনো তার কাছে বেচে দেওয়া হয়।”
আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো আপার কথা শুনছি। যেনো মনে হচ্ছে আপা কোনো গল্পের বই থেকে গল্প পড়ে শোনাচ্ছে আমাকে।
“কিন্তু দাদীর বাবা কোনোভাবেই রাজি হয়না। কারণ ওটা ছিলো তার পৈতৃক সম্পত্তি। মীর মতলেব খাঁ অনেক টাকার লোভ দেখায় তাকে। কিন্তু দাদীর বাবার এক কথা, সে ওই জমি কোনোভাবেই বেচবে না। মীর মতলেব খাঁ মনে মনে ভীষণ রেগে যান। জিদ চেপে যায় তার। কিন্তু উপরে তা প্রকাশ করেন না। তিনি হেসে দাদীর বাবাকে বিদায় জানান। দাদীর বাবাও নিশ্চিন্ত মনে বাড়ি ফিরে যান। কিন্তু সেদিন রাতেই সেই ছোট্ট সাজানো পরিবারের উপর নেমে আসে কালবৈশাখী ঝড়। যে ঝড় ওলটপালট করে দেয় ছোট্ট সুখের সংসারটার উপর এক নিমিষে।”
আমি নি:শ্বাস আটকে বসে আপার কথা শুনছিলাম।
“এরপর কি হলো আপা? কি হলো দাদীর বাবা মায়ের সাথে? কীভাবে খু ন হলো তারা?”
আপা কিছু বলতে যাবে তার আগেই দরজার বাইরে মায়ের গলা শুনতে পাই, “সাজ, দরজা দিয়েছো কেনো ভিতর থেকে?”
আপা উত্তর দেয়,”মা আমি সাঁঝ।”
“তোমরা দরজা দিয়েছো কেনো? কি এমন কথা বলছো দুইজন যে দরজা আটকে দিতে হবে?”
আমি অসহায় মুখে আপার দিকে তাকাই। এখনই যদি সবটা না শুনতে পারি আমার নি:শ্বাস আটকে যাবে। আপা আমার দৃষ্টিকে অগ্রাহ্য করে দরজা খুলে দেয়। মা আমার জন্য খাবার নিয়ে এসেছে।
“কি কথা হচ্ছিলো সাঁঝ?”
আপা মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,”কিছু না।” এই বলেই গটগট করে হেঁটে আপা চলে যায়। মা অবাক হয়ে আপার চলে যাওয়া দেখে।
(চলবে……)