কলমে: মিথিলা জামান নিভা – Methela Jaman Neva
আমার বাবা চাচারা সবসময় নিজেরা যে জমিদারের বংশ এটা প্রমাণ করতে চায়। জমিদারি থাকুক বা না থাকুক। সন্ধ্যার পর থেকে পুরো বাড়ি আলোয় ঝলমল করতে হবে, যেনো অনেক দূর থেকে দেখা যায়। তেতলা বাদে বাকি সব জায়গাতেই আলো থাকবেই। কিন্তু আজ আমাদের গ্রামজুড়ে লোডশেডিং, কি একটা সমস্যা নাকি হয়েছে গঞ্জ থেকেই। কোথাও কোনো আলো নেই। অমাবস্যা তিথি চলার কারণে বাইরে টাও অন্ধকার। আবার বিকালের পর থেকে শুরু হয়েছে টিপটিপ বৃষ্টি। সেই বৃষ্টি আবার সন্ধ্যার পর থেকে বাড়লো। কিছুক্ষণ আগেই মুষলধারে বৃষ্টি নামলো বেশ অনেকক্ষণ ধরে। আমরা সবাই একসাথে রাতের খাবার খেলাম হারিকেন জ্বালিয়ে। মেজোচাচা বার বার কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাচ্ছে বারবার খাওয়ার সময়, সেই দৃষ্টিতে কিছু একটা সন্দেহ। আমি দেখেও না দেখার ভান করে বসে থাকলাম।
খাবার টেবিলে আপাকে না দেখে মা ভ্রু কুঁচকে তাকায়। আমার দিকে তাকিয়ে বলে,”সাঁঝ কোথায়? ও আসেনি কেনো?”
আমাদের বাড়িতে রাতের খাবার সবার একসাথে খাওয়ার নিয়ম, দাদী ছাড়া। দাদী দোতলা থেকে নিচতলায় নামতে পারেননা। তার খাবার মা চাচীরা তার ঘরে দিয়ে আসেন।
“মা আপা নাকি আজ দাদীর সাথে খাবে। অন্ধকারে দাদী একা একা বসে খাবে তাই আপা বললো আপার খাবারটাও যেনো দাদীর সাথে ও ঘরে পাঠানো হয়।”
মা বিরক্তিতে চোখমুখ শক্ত করে ফেলেন কিন্তু বাবা চাচাদের সামনে খুব একটা প্রকাশ করতে পারেন না। আমার বাবা চাচা তাদের মা কে ভীষণ ভালোবাসে আর শ্রদ্ধা করে।
আমার তো অস্থিরতায় খাওয়াই হচ্ছে না। দাদীর বাবা মায়ের সাথে কি হয়েছিলো, মীর মতলেব খাঁ কেনোই বা তাদের এই বাড়িতে মেরে ফেলেছিলো? এই অসম্পূর্ণ কাহিনী আমাকে একবিন্দুও স্বস্তি দিচ্ছে না।
অল্প খেয়েই আমি উঠে দাঁড়ালাম। মা আমার দিকে তাকিয়ে বললো,”কি ব্যাপার? কোথায় যাচ্ছো খাওয়া শেষ না করে?”
“মা আমার আর খেতে ইচ্ছা করছে না। শরীর খুব দূর্বল লাগছে, আমি ঘুমাবো।”
“ঠিক আছে আর খেতে হবে না। তবে তুমি আজ একা ঘুমাবে না। আমি তোমার সাথে ঘুমাবো। এখানে বসো, একা যেতে হবে না অন্ধকারে। আমার খাওয়া হোক একসাথে যাবো।”
আমি চমকে উঠলাম মায়ের কথা শুনে। মা আজ রাতে আমার সাথে ঘুমালে আমি আপার কাছ থেকে কিছু শুনতে পারবো না। আর সবটা না শোনা পর্যন্ত আমার ঘুমও হবে না। আমি হঠাৎই হালকা চিৎকার করে উঠলাম,”না না।”
মা কিছুটা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকায়।
“না মানে?”
“না মানে বলছিলাম মা, তুমি কেনো আমার সাথে ঘুমাবে? বাবা একা ঘুমাবে নাকি?”
বাবা খাচ্ছিলেন। খেতে খেতেই আমার দিকে না তাকিয়েই বললেন,”আমার সমস্যা নেই সাজ মা। আজ তোমার মা তোমার সাথে থাকুক। গতকাল নিশ্চয়ই কোনো খারাপ স্বপ্ন দেখেছো। নাহলে জ্বর এসে জ্ঞান হারালে কেনো? কিছুদিন তোমার মা তোমার সাথেই ঘুমাবে।”
আমি আঁৎকে উঠলাম।
“বাবা আমি ভয় পাইনি। আমি তো বড় হয়ে গিয়েছি। তাছাড়া আপা তো থাকেই আমার পাশের খাটে। আমার সমস্যা হয়না।”
মা কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি একটা তেলতেলে হাসি দিয়ে বললাম,”মা, বাবা তো প্রায়ই রাতে অসুস্থ হয়ে যায়, শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যায়। তুমি পাশে না থাকলে হয়? আর তাছাড়া আমি তো এখন সুস্থ অনেকটাই, জ্বরও নেই। তুমি আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করো না।”
মেজোচাচা খাবার খেতে খেতে মা কে বললো,”বড় ভাবীজান, মেয়ে কেনো আপনাকে পাশে রাখতে চায়না রাতে? যাতে রাতে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে পারে?”
আমি একরাশ বিরক্তি নিয়ে তার দিকে তাকালাম, সবসময়ই কি এই লোকটার কিছু না কিছু বলতেই হবে? হচ্ছে কথা আমার আর বাবা মায়ের মাঝে, উনার কথা বলার দরকার কি এর মধ্যে? মাঝে মাঝে যৌথ পরিবার অসহ্য লাগে।
মা কঠিন দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বললো,”আমার মেয়ের এতো চিন্তা আপনাকে করতে হবে না মেজো ভাই, তার জন্য ওর বাবা আর আমি আছি। আপনি আপনার মতো খেয়ে উঠুন।”
বাবা অস্বস্তিতে একবার মায়ের দিকে আরেকবার চাচার দিকে তাকান। মেজোচাচা রাগে গজগজ করতে করতে উঠে যান খাওয়া ছেড়ে।
নিজের পালঙ্কে আধশোয়া হয়ে একটা গল্পের বই পড়ছে আপা। তার চোখে ভারী ফ্রেমের চশমাটা, লম্বা চুলগুলো এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তার মুখের চারদিকে। বাইরে এখনো বৃষ্টি, তবে এখন কিছুটা কমের দিকে। মাঝে মাঝেই ব্যাঙ ডাকছে, আর এক নাগাড়ে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। বাতাসে খুব সুন্দর একটা সোঁদা মাটির গন্ধ। হারিকেনের টিমটিমে আলোয় আপা বই পড়ছে, সব মিলিয়ে কেমন একটা সম্মোহন করা পরিবেশ। আমি একদৃষ্টিতে আপার দিকে তাকিয়ে আছি। আজ রাতেই সবটা শুনতে হবে আমাকে, নাহয় আমার ঘুম হবে না। মা কে অনেক কষ্টে রাজি করিয়েছি আমার সাথে না থাকতে। যদিও মা কেমন সন্দেহের চোখে তাকিয়েছে, তবুও অগ্রাহ্য করেছি।
বইয়ের পাতা উল্টিয়ে আমার দিকে না তাকিয়েই আপা বললো,”ঘুমিয়ে পড় সাজ, তোর শরীরটা ভালো না।”
“আপা, তোর বইটা পড়তে আর কতোক্ষণ লাগবে?”
“কেনো বল তো?”
“সকালে যেই কথাটা বলা শুরু করেছিলি ওটা শেষ করিস নি তো। ওটা শুনবো আমি এখন, তাই।”
আপা এতোক্ষণ পর আমার দিকে তাকালো, তার দৃষ্টি শীতল।
“কোন কথা?”
ভারী অবাক লাগে আমার মাঝে মাঝে আপার কথায়। এটা তো কোনো সাধারণ কথা নয় যে আপার মনে থাকবে না।
“আহা আপা, মনে নাই তোর? দাদীর বাবা মায়ের কথা। মীর মতলেব খাঁ নাকি উনাদের……”
আমি কথা শেষ করতে পারিনা। আপা তার আগেই আমার থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে আবার বইতে মনোযোগ দেয়। আমি ভালো করে বুঝতে পারি আপা আজ আর কথাটা শেষ করবে না। আপা খুব জেদি ধরণের মেয়ে। সে যদি বলে এটা করবো না, কেউ তাকে করাতে পারে না সেইটা।
আমি মন খারাপ করে কাঁথামুড়ি দিলাম। সারাদিন অস্থির ছিলাম কাহিনীটা শোনার জন্য। আপা যে কি করে না মাঝে মাঝে। আমি ঠিক করলাম আগামীকাল সকালেই দাদীর কাছে সবটা শুনবো আমি যেভাবেই হোক। কিন্তু দাদী কি বলতে চাইবে?
“সে রাতে দাদীর মা আর দাদীকে তাদের বাড়ি থেকে লোক দিয়ে তুলে আনেন মীর মতলেব খাঁ, ঘুটঘুটে অন্ধকারে যখন গ্রামের সবাই গভীর ঘুমে।”
আমি লাফ দিয়ে উঠে বসলাম। আপা তাহলে ঘটনাটা বলবে আমাকে? চোখ বড় বড় করে আপার দিকে তাকালাম। আপার দৃষ্টি শান্ত, সে এখনো বইয়ের দিকে তাকানো।
“দুইজনকেই একসাথে তুলে আনা হলো?”
“হুম।”
“তারপর?”
“দাদীর বাবাকে তার নিজের বাড়িতেই বেঁধে রাখা হলো। সে একা একজন পুরুষ, মীর মতলেব খাঁ এর পোষা এতোগুলো গুণ্ডার সাথে পারবে কেনো? তার হাত,পা,মুখ বেঁধে ফেলা হলো। সে শুধু অশ্রুসজল চোখে চেয়ে চেয়ে দেখলো তার স্ত্রী এবং মেয়েকে টানতে টানতে পাষণ্ডগুলো নিয়ে যাচ্ছে জমিদারবাড়ি।”
এতোটুকু বলে আপা থামলো। বৃষ্টির বেগ বেড়েছে। ঝমঝম শব্দ হচ্ছে বৃষ্টির। আমাদের ঘরটা বাড়ির পুকুরের পাশেই। পুকুরের পানিতে বৃষ্টির ধারা পড়ার অন্যরকম একটা শব্দ। চারদিকে সুনসান নীরবতা তার মাঝে শুধু একনাগাড়ে বৃষ্টির আওয়াজ, এদিকে আপার বলা হাড় হিম করা সত্যি কাহিনী সব মিলিয়ে পরিবেশটাকে ভারী করে দিয়েছে।
হঠাৎ আপা বইটা পাশে ফেলে হারিকেনটা বন্ধ করে দেয়। ঘর অনেকটাই অন্ধকার হয়ে যায়। আপা খাট থেকে নেমে জানালার পাশে যেয়ে দাঁড়ায়। এতোক্ষণে অন্ধকারটা অনেকটাই চোখ সয়ে গেছে। আবছা আলোয় আপাকে দেখলাম সে জানালার গ্রিলে মাথা ঠেকিয়েছে।
“দাদীর মা ছিলেন ভূবনভোলানো সুন্দরী, আগুন সুন্দরী যাকে বলে। গ্রামের মানুষ যারা তাকে একবার দেখেছে তারাই অবাক হয়েছে সেই সৌন্দর্য দেখে। দাদীও পেয়েছিলেন তার মায়ের সৌন্দর্য। এমন দুই সুন্দরীকে দেখে মীর মতলেব খাঁ এর মাথা খারাপ হয়ে যায়। কিন্তু দাদীর বয়স অনেক কম থাকায় সে তার বড় ছেলে মানে আমাদের দাদাকে ডেকে পাঠান। দাদা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, ছুটিতে বাড়ি এসেছেন। দাদীকে মীর মতলেব খাঁ দাদার ঘরে পাঠান আর দাদীর মা কে নিজের ঘরে রাখেন। দাদীর মা চিৎকার করে বলেছিলেন,” আমার সাথে যা করবেন করুন। আমার মেয়েটা ছোট, ওকে ছেড়ে দিন। ও মরে যাবে।”
দাদীও তার মা কে ছেড়ে এক পা-ও নড়তে চাচ্ছিলো না। কিন্তু মীর মতলেব খাঁ কোনো কথা শোনে না। বরং পৈশাচিক একটা হাসি দিয়ে বলে,”তোর সাথে তো তোর স্বামীর হিসাব মেটাবোই।” মীর মতলেব খাঁ এর দরজায় তখন তার পোষা আরো অনেক গুণ্ডা এসে দাঁড়ায়, আগুন সুন্দরী দেখে তাদেরও লোভ জন্মায়।
দাদীকে দাদা তার ঘরে নিয়ে আসেন। দাদা এসব পছন্দ করতেন না তখন,পরে অবশ্য নিজেই খারাপ পথে চলে গেছে সে গল্প অন্য একদিন নাহয় বলবো। কিন্তু দাদার বাবার প্রতিপত্তি তখন আকাশচুম্বী। তাকে কিছু বলার মতো বা প্রতিবাদ করার মতো সাহস দাদার ছিলো না।
দাদী দাদার ঘরে এসে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে যে, সে বাবার কাছে যাবে, মায়ের কাছে যাবে। দাদা বুঝে উঠতে পারেন না কি করবেন এখন। কারণ তিনি খুব ভালো করে তার বাবার স্বভাব জানেন। ছোটবেলা থেকে দেখে আসছেন।
দাদা দাদীকে ঘরে রেখে বারান্দায় চলে যান। হঠাৎ একটা বিকট আর্তচিৎকারে বাড়িটা কেঁপে ওঠে। দাদা একছুটে ঘরে ঢোকেন। দেখেন দাদী ভয়ে কাঁপছে থরথর করে, তার শরীর নীল বর্ণ ধারণ করেছে ভয়ে। কারণ চিৎকারটা ছিলো তার মায়ের।
দাদা দাদীকে বলেন,”তুমি এখানেই বসো। এখান থেকে এক পা-ও নড়বে না। দরজা আটকে দাও, আমি বাদে কেউ ডাকলে দরজা খুলবে না। মনে থাকবে?”
দাদী তখন দাদাকে অনেকটা বিশ্বাস করা শুরু করেছে। অবশ্য বিশ্বাস না করেও উপায় নেই। এই বিশাল বাড়িতে কে বাঁচাবে তাকে? দাদী আস্তে আস্তে মাথা নাড়ে। দাদীকে ওই অবস্থায় রেখে দাদা বেরিয়ে পড়েন। যে ঘরে দাদীর মা কে আটকানো হয়েছিলো সে ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়ান। দুমদুম করে দরজায় শব্দ করতে থাকেন, ভিতর থেকে কারো কোনো আওয়াজ পাওয়া যায়না। দাদীর মায়ের চিৎকার এ বাড়ির সবাই শুনতে পারে, বাড়ির দারোয়ানগুলোও পারে। কিন্তু কারো সাহস নেই তেতলায় এসে সব দেখার।
বেশ কিছুক্ষণ পর ঘরের দরজা খোলা হয়। দাদা হুড়মুড় করে ঘরে ঢোকেন। ঘরের ভিতরটা অন্ধকার। হঠাৎ পায়ের কাছে পিচ্ছিল তরলের স্পর্শ পেয়ে থমকে যান দাদা। সাথে থাকা টর্চটা জ্বালিয়ে দেখেন কালচে লাল চাপ চাপ র ক্ত। হঠাৎ দাদার মাথায় আচমকা একটা লাঠির আঘাত পড়ে। দাদা পিছন ঘুরে দেখতে যান কে এই কাজ করলো। তিনি জ্ঞান হারাতে থাকেন তীব্র য’ন্ত্রণায়। কিন্তু পিছন ফিরে ঠিকই দেখতে পান কার কাজ এটা। যদিও ঘর অন্ধকার, তবুও নিজের বাবার ছায়া দেখেও চিনে ফেলেছিলেন তিনি। ততক্ষণে তিনি জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছেন।
অনেকক্ষণ যাবৎ কারো কোনো সাড়া না পেয়ে দাদী মন:স্থির করেন তিনি বাইরে আসবেন। মায়ের চিৎকার শোনার পর কোনো সন্তানই স্থির থাকতে পারে না। যদিও দাদা দাদীকে বলে গিয়েছিলেন এই ঘরের বাইরে না যেতে বা তিনি বাদে কেউ আসলে দরজা না খুলতে। কিন্তু দাদীর আর মন মানে না। ছটফট করতে থাকে দাদী মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য।
দাদী এ বাড়ির কিছুই চিনেন না তখন। দরজা খুলে আস্তে আস্তে পা টিপে টিপে হাঁটতে থাকে এদিকে সেদিকে। হালকা আলো আঁধারিতে ওই ছোট্ট একরত্তি মেয়েটার বুকে হাতুড়িপেটা হতে থাকে। অনেকক্ষণ ধরেও কাউকে কোথাও দেখতে না পেয়ে দাদী ঠিক করেন তিনি আবার দাদার ঘরে ফিরে যাবেন কারণ তখন ভোর হতে বেশি বাকি নেই। ভোরবেলা নিশ্চয়ই আলোয় আলোকিত হয়ে যাবে এই বাড়ি। তিনি ফিরেই আসছিলেন হঠাৎ কয়েকজনের চাপা গলা শুনে দাদী ভয়ে কাঠ হয়ে যায়। আওয়াজ আসছে পাশের একটা ঘর থেকে। দাদী আস্তে আস্তে হেঁটে দরজার পাশে যেয়ে দাঁড়ায়। ভিতরের কথা শোনার চেষ্টা করে সে। কেউ চাপা গলায় কাউকে খুব বকাঝকা করছে। গলা শুনেই দাদী বুঝতে পারেন এই সেই মীর মতলেব খাঁ।
“এখন আমি এই লা শ কি করবো? এই বাড়িতে র ক্তের দাগ হয়ে গেলো। তোদের বারবার আমি সাবধান হতে বলেছিলাম। আমাদের কাজ ছিলো শুধু ভয় দেখানো, আর তোরা কি করলি? এখন পুরো গ্রাম যদি আমার বিপক্ষে চলে যায়? বিদ্রোহ ঘোষণা করে যদি? যদি সবাই মিলিত হয়ে এই বাড়িতে আগুন দেয়? কেউ বাঁচতে পারবো আমরা?”
“মীর সাহেব, আমাদের ক্ষমা করে দিন। এতো সুন্দরী সহ্য করতে পারিনি। এতো অল্পেই যে মরে যাবে বুঝতে পারিনি। ক্ষমা করে দিনা আমাদের।”
“একদম চুপ কর তোরা। এখন আমি এই মৃ তদেহ কি করবো?”
“আপনি কোনো চিন্তা করবেন না মীর সাহেব। আমরা আছি তো, আমরা কোথাও মাটি চাপা দিয়ে দিই বা পানিতে ফেলে দিই?”
“বোকার মতো কথা বলবি না। এমনিতে অনেক বিপদে ফেলেছিস আমাকে। এখন যদি আমরা এটা গুম করে দিই, এর স্বামী বাড়িতে আছে না? সে তো সবাইকে বলে দিবে আমরা কি করেছি। এতোদিন তো শুধু মেয়েদের তুলে এনে, নিজেদের কাজ মিটিয়ে আবার সকালে বাড়িতে ফেলে এসেছি। গ্রামের লোক ভয়ে কিছু বলেনি। কিন্তু এখন তো আমরা ফেরত দিতে পারবো না। এখন তো গ্রামের লোক রেগে যাবে। আমাকে ভাবতে দে তোরা।”
দাদী নি:শ্বাস বন্ধ করে সব শুনছেন। তিনি বিশ্বাস করতে চাচ্ছেন না এখানে তার মা কে নিয়ে কথা বলা হচ্ছে। তার কান গরম হয়ে আসে। হাত পা কাঁপতে থাকে তার থরথর করে। হঠাৎ আবার সে মীর মতলেব খাঁ এর গলা শুনতে পায়।
“একটা বুদ্ধি পেয়েছি। কাজটা ঝুঁকিপূর্ণ। আবার সময়ও কম। যা করার ভোরের আলো ফোটার আগে করতে হবে।”
বাকিরা একসাথে বললো,”কি কাজ মীর সাহেব? একবার হুকুম করুন।”
“ওর স্বামীকেও তুলে নিয়ে আয় তোরা।”
দাদী এবার পরিষ্কার বুঝতে পারেন সবটা। মুখ চেপে বোবা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন মেঝেতে বসে। তার মা আর নেই? এই নরপিশাচ গুলো তার মা কে মেরে ফেলেছে? এখন তার বাবাকেও আনতে যাচ্ছে? কি করবে তার বাবার সাথে? দাদী শক্ত করে নিজের মুখটা চেপে ধরেন যাতে কোনো শব্দ বের না হয়। অতোটুকু বয়সে দাদী বুঝতে পেরেছিলেন এখন সে মুখ খুললে তারও প্রাণসংশয় আছে।
দাদীর সামনে দিয়েই আট/দশটা গুণ্ডা বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। দাদী কাঠের মতো বসে থাকেন নি:শ্বাস আটকে। অন্ধকার থাকায় কেউ তাকে দেখেনি। দাদী আকূল হয়ে দাদাকে খুঁজতে থাকেন কিন্তু দাদা তো অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে এটা তো দাদী জানতেন না।
প্রায় আধা ঘণ্টার মধ্যে দাদার বাবাকে এনে হাজির করা হয়। টানতে টানতে তাকে এদিকে আনা হয়। দাদী আর সহ্য করতে পারেন না। বাবাকে দেখে ঝাপিয়ে পড়েন তার উপর। উপস্থিত সবাই হতভম্ব। এই মেয়ে এতোক্ষণ কোথায় ছিলো?
দাদীর বাবা দাদীকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন,”আমি চলে এসেছি মা, আমি তোমাদের এখান থেকে নিয়ে যাবো। কিচ্ছু হয়নি মা, আমি এসেছি তো।”
দাদী অসম্ভব ফোঁপাচ্ছিলো তার বাবাকে জড়িয়ে। কোনো কথা বলতে পারছিলো না সে। মীর মতলেব খাঁ চোখের ইশারায় তার বাবার কাছ থেকে তাকে সরিয়ে নেওয়ার আদেশ দেয়। যখনই দাদীর গায়ে হাত দিতে যাবে তখনই দাদীর বাবা চিৎকার করে বলে,”আমার মেয়ের গায়ে কেউ হাত দিবে না, কেউ না। আমার স্ত্রী কোথায়? জবাব দিন মীর মতলেব খাঁ, আমার স্ত্রী কোথায়?”
“বাবা, ওরা মা কে মেরে ফেলেছে।”
দাদীর কথায় সারাঘরে পিনপতন নীরবতা নামে।
দাদী তখনও একনাগাড়ে ফুঁপিয়ে যাচ্ছেন। দাদীর বাবা বিস্ফারিত চোখে মেয়ের দিকে তাকান।
“কি বললি মা তুই?”
দাদী কোনো কথা বলতে পারে না। ফোঁপাতে ফোপাঁতে মাথা নেড়ে হ্যা জানায়। দাদীর বাবা চিৎকার করে ওঠেন,”মীর মতলেব খাঁ, তোকে আজ শেষ করে দিবো আমি।”
এই বলে দাদীকে ছেড়ে দিয়ে দাদীর বাবা ছুটে যান মীর মতলেব খাঁ এর দিকে। কিন্তু তিনি ছিলেন একা, আর এরা প্রায় দশ/পনেরো জন। তাকে মীর মতলেব খাঁ অব্দি পৌঁছানোর আগেই ধরে ফেলে। মীর মতলেব খাঁ তখন তার ব ন্ধুক বের করে দাদীর সামনেই তার বাবাকে……”
আপা দুই হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে ওঠে, আর বলতে পারেনা কিছু। আমি স্তম্ভিত হয়ে শুনছিলাম এতোক্ষণ। নড়াচড়া করতেও ভুলে গিয়েছি। দাদীর জন্য কষ্টে আমার কলিজাটা ছিঁড়ে যেতে থাকে। আমি ছুটে যেয়ে আপাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরি। দুইবোন শব্দ করে কাঁদতে থাকি।
“আপা, দাদীর এতো কষ্ট? কোনোদিন জানতে পারলাম না? সারাজীবন হাসিখুশি থাকা দাদীর এতো কষ্ট? কিন্তু যেই মানুষটা তার বাবা মা কে এভাবে হ ত্যা করলো, সেই বাড়িতে সে বউ হয়ে এলো?”
আপা চোখ মুছে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আবার বলতে থাকে,”দাদী মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে যান ওই ঘটনার পর। সবাই মীর মতলেব খাঁ কে বলে দাদীকেও মেরে ফেলতে। কারণ দাদী তখন এতোটাই মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে যে, সে বলতে থাকে মীর আমার বাপ মা কে মারছে, আমারে এতিম করছে। কেউ কেউ বলে দাদীকে বাড়ি থেকে বের করে দিতে কেউ বলে দাদীকে মেরে ফেলতে। কিন্তু সম্ভবত মীর মতলেব খাঁ এর মায়া হয় দাদীর জন্য নাকি আর কোনো কারণেই হোক সে এই দুইটার কোনোটাতেই রাজি হয়না। সে এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করে যে, পরদিন গ্রামবাসীকে জানান যে, দাদীর বাবা মা এই ছোট্ট মেয়েটাকে জমিদার বাড়ির সামনে ফেলে রেখে, জমিদার বাড়ির অনেক কিছু চুরি করে নিয়ে গ্রাম থেকে পালিয়েছে। আর সে কিনা তার বড় ছেলের সাথে সেই মেয়ের বিয়ে ঠিক করেন। কিন্তু ততক্ষণে দাদীর বাবা মায়ের লা শ এই বাড়িতেই পোঁতা হয়ে গেছে। কারণ তখন প্রায় ভোর, মুসল্লীরা ইতোমধ্যেই নামাজের জন্য বেরিয়ে গেছেন। ওই অবস্থায় বাইরে নেওয়া সম্ভব ছিলো না। তাই বাড়িতেই……”
আমি দু’চোখ বেয়ে অঝোরে পানি পড়তে থাকে। ইচ্ছা করছে ছুটে যেয়ে দাদীকে জড়িয়ে ধরতে এখন। দাদীর জন্য কি ভীষণ কষ্ট হচ্ছে আমার!
“দাদা বাবার উপর রেগে যেয়ে খারাপ পথে পা বাড়াতে থাকেন। প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া ছাড়েন, পরে আস্তে আস্তে সব। আর দাদীকে সবার সামনে বানানো হলো পাগল। মীর মতলেব খাঁ এতোটাই উদার যে, একটা পাগল মেয়েকে নিজের বড় ছেলের বউ করে এই বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছে। চারদিকে মীর মতলেব খাঁ এর জয়ধ্বনি ছড়িয়ে পড়ে। সেই দশ কাঠা জমিও সে দখল নেয়।”
এই বলে আপা থামে। জোরে জোরে নি:শ্বাস নেয়।
আমি অসার হয়ে গিয়েছি আপার কথায়। পালঙ্কের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি একদৃষ্টিতে শূণ্যের দিকে তাকিয়ে।
“এসব কিছুই কি তেতলায় হয়েছে আপা?”
“হু।” আপা ছোট্ট করে উত্তর দেয়।
“কিন্তু মীর বংশের কারো ওখানে যাওয়া নিষেধ কেনো আপা?”
“এগুলো আস্তে আস্তে পরে জানবি। শুধু একটা কথা শুনে রাখ দাদীর বাবা মা এখনো এই বাড়িতেই আছেন।”
আমি আপার কথা শুনে চমকে উঠি। আপার গলাটা একদম অচেনা লাগলো, মনে হচ্ছে অন্য কেউ বুঝি শেষের কথাটা বললো।
আমি ভয়ে ভয়ে আপাকে বলি,”আপা এই আপা। কি বলছিস তুই?”
আপা কোনো উত্তর দেয়না। আবছা আলোতেও আপাকে আমি দেখতে পাইনা। বুকটা ধক করে ওঠে আমার।
“আপা, কোথায় গেলি তুই? আমার ভীষণ ভয় করছে আপা।”
“আমি আছি, ভয় পাস না।”
আবার সেই অচেনা গলা। আমার গলা শুকিয়ে আসে ভয়ে।
“আপা তোর গলা এমন শোনাচ্ছে কেনো?”
“কেমন শোনাচ্ছে?”
“আমি জানিনা আপা, কেমন অচেনা। তুই সামনে আয়।”
“ঘুমিয়ে পড় সাজ। ভয় পাবিনা। দাদীকে যদি ভালোবেসে থাকিস, একদম ভয় পাবি না। তোর বাকি সব প্রশ্নের উত্তর রয়েছে তেতলায়। তেতলার চাবি যোগাড় কর যে কোনো মূল্যে। বাকি সব জানতে পারবি।”
“কিন্তু তুই যে বললি দাদীর বাবা মা নাকি এখনো এই বাড়িতেই আছে। কিন্তু তারা তো বহু বছর আগেই মারা গিয়েছেন, এই বাড়িতে কীভাবে থাকবেন?”
“সব প্রশ্নের উত্তর আছে শুধুমাত্র তেতলায়।”
আমার মনে হচ্ছে আমি আবার জ্ঞান হারাতে চলেছি।
(চলবে……)