#দ্বিতীয় পুরুষ
পর্ব ১৬
_নীলাভ্র জহির
একজন পুরুষ মানুষের জীবনে বাবা হতে পারাটা সবচেয়ে গৌরবের। সে যে অবস্থাতেই থাকুক না কেন বাবা হওয়ার খবরে সবচেয়ে বেশি আনন্দিত হয়। রূপকের হৃদয়টা আনন্দে টইটুম্বুর। সে বাড়ি ফিরল দুই কেজি মিষ্টি নিয়ে। চিত্রা সবেমাত্র চুলা থেকে গরম গরম তরকারি নামিয়েছে। রূপক বাড়িতে পা দিয়েই চিৎকার করে বলতে লাগল, মা তুমি কই? এই রুবিনা নাজমা তোরা কই? সাইদুল কইরে। সব এখানে আয় দেখ কি লইয়া আইছি। আজকে তোরা মিষ্টির শিরা দিয়া গোসল করবি।
রূপকের চিৎকার-চেঁচামেচিতে সবাই এসে হাজির হলো। ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন রূপকের বাবা। বাবাকে দেখে খানিকটা সংকোচ হলো রূপকের। সে আর আগের মত হইচই করতে পারলো না। মিষ্টির প্যাকেট গুলো রুবিনার হাতে তুলে দিয়ে বলল, সবাইরে মিষ্টি দে। যে যতটা খাইতে পারে তারে ততটাই খাওয়া।
জোসনা বেগম ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বললেন, রুবিনা তুই এই পাগলের কথা শুনিস না। এক প্যাকেট মিষ্টি ঘরে রাইখা আয়। আর এক প্যাকেট থাইকা সবাইরে দে।
রূপক বলল, আরে মা কিপটামু করতাছো কেন? সবাইরে মিষ্টি দিয়ে আজকে স্নান করামু।
তুই চুপ থাক। তোর মাথার তার ছিইড়া গেছে। দুইটা গরম ভাত খাইয়া তুই দোকানে যা।
আইজ এক্কেরে দুপুরের ভাত খাইয়া তারপর দোকানে যামু।
কথাটা শুনে মনটা আনন্দে নেচে উঠল চিত্রার। রূপক আশে পাশে থাকলেই তার পৃথিবীটাকে স্বর্গ মনে হয়। রূপক দুপুরবেলা দোকানে যাবে। তারমানে পুরোটা সময় তারা দুজন কাটাতে পারবে একসঙ্গে। সে তড়িঘড়ি করে রান্নাঘর থেকে উঠে পুকুর পাড়ে যায় হাত মুখ ধুতে। চুলার আঁচে তার গা ভিজে উঠেছে। ভিজে গেছে শাড়ির নিচে থাকা ব্লাউজ। চিত্রা ভালো করে পুকুরে নেমে হাত মুখ ধুয়ে ফেলল। পুকুর থেকে ওঠার সময় রূপক এসে দাঁড়াল তার সামনে। রূপকের চোখের দিকে তাকাতে লজ্জা করছিল চিত্রার।
রুপক বলল, বউ তোমার লাইগা একখান জিনিস আনছি।
কি জিনিস?
আনছি একখান জিনিস। ঘরের আসো তোমারে দেখামু।
আপনি এইখানে ক্যান আইছেন?
তোমারে দেখতে আইছি। আমার পোলারে পেটে ধইরাই তুমি দেখি সুন্দর হইয়া গেছো।
চিত্রা লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো। বলল, আপনার খালি ঢং এর কথা। এখন এখান থাইকা যান। সবাই দেখলে আমারে নিয়া হাসাহাসি করব। ঘরে যান আমি আসতাছি।
হাসাহাসি ক্যান করব। তুমি আমার বউ না?
সবার ঘরে বউ আছে। সবাই আপনের মত এত ঢং করে না।
এইডা কি কথা কইলা বউ? আমি ঢং করি? আমিতো তোমার লগে একটু পিরিতি করি।
পুকুরঘাটে পিরিতি করতে হইবো না তো। পিরিত যা দেখানোর ঘরে দেখাইয়েন। এখন এখান থাইকা যান।
ঘরে চলে এলো রূপক। তার পিছুপিছু চিত্রা ঘরে ঢুকতেই রূপক এসে দরজা ভেজিয়ে দিল। তারপর পকেট থেকে বের করল একটা লাল প্লাস্টিকের কৌটা। ভেতরে জ্বলজ্বল করছে একটা গলার চেইন। বাজারের মোড়ে জুয়েলের কসমেটিকের দোকান থেকে ইমিটেশনের একটা চেইন কিনে এনেছে রূপক। অন্য পকেট থেকে বের করল আরও একটা গোল কৌটা। সেখান থেকে বের করল দুইটা হাতের চুরি।
চিত্রার চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠল। আনন্দে ঝলমল করতে করতে লাগলো চিত্রা বললো, এগুলো ক্যান আনছেন?
আমার বউয়ের জন্য আনছি। বউটারে তো কিছুই দিতে পারিনা।
আমার কিছুই লাগবো না। সবই তো আছে। আগের চুড়িগুলান এখনো নতুন আছে। আইজ আবার ক্যান আনছেন?
তাতে কি হইছে? রাইখা দাও। সামনে তো আর একটা দাওয়াত আছে। তখন হাতে পইড়া যাইবা।
চিত্রা খাটের নিচ থেকে তার কাপড়-চোপড়ের সুটকেস বের করল। সেখানে পরম যত্নে রাখা আছে তার বিয়েতে পাওয়া সাজসজ্জা সামগ্রী। চুরি ও চেইনটা সেখানে ঢুকিয়ে রাখল চিত্রা।
রূপক বলল, আরে করতাছো কি? একটু গলায় পইরা আমারে দেখাও।
এখন না। সবাই কি ভাববে?
যা ইচ্ছা ভাবব।
চিত্রা এই প্রথম রূপকের চোখে চোখ রেখে খুব আবেগী গলায় একটা কথা বলল ,আপনি এত ভালো মানুষ ক্যান?
কথাটা হৃদয় স্পর্শ করল রূপকের। সে চিত্রার কোমল মুখটাকে দুই হাতে ধরে চোখে চোখ রেখে বলল, ভালা বউয়ের স্বামী কি খারাপ হইবো?
চিত্রার মুখটা হঠাৎ করে অন্ধকারে ছেয়ে গেল। ভালো বউ! সেকি ভালো বউ? তার শাশুড়ির কাছে সে এখনো পছন্দসই মেয়ে হয়ে উঠতে পারেনি। জানেনা কিভাবে ভালো বউ হয়ে ওঠা যায়। স্বামীর মুখ থেকে কথাটা শুনতে তার ভিষণ ভালই লাগলো। তবে একই সঙ্গে কষ্ট হতে লাগলো। স্বামী কি খারাপ হইবো কথাটা তার বুকে আঘাত করেছে। সে তো পূর্বেও ভালো বউই হতে চেয়েছিল। সোহরাব উদ্দিন তাঁকে কার হাতে তুলে দিয়েছিল সে সব কিছুই ভাবেনি চিত্রা। বাবা তাকে যার সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিল তার হাত ধরেই বাড়ি ছেড়েছিল সে। অথচ সেই মানুষটা তাকে বিক্রি করে দিয়েছিল এক শয়তানের কাছে। একজন মানুষ কতটা খারাপ হলে নিজের কুমারী স্ত্রীকে পর পুরুষের কাছে বিক্রি করে দিতে পারে। অবশ্য লোকটা বিক্রি করার জন্যই বিয়ে করেছি। চিত্রার মন গ্লানিতে ভরে গেল। ভালো বউয়ের স্বামী কখনো খারাপ হয় না। তবে সে কি ভাল ছিলনা? নাকি তার কপালটা খারাপ ছিল। চিত্রা আর কপালকে কোনো দোষারোপ করবে না। তার জীবনে রূপক এসেছে। এখন থেকে ওকে ঘিরেই তার সমস্ত কিছু আবর্তিত হবে। সে একেবারেই দুর্ভাগা নয়। রুপক তার সৌভাগ্য।
দেখতে দেখতে কেটে গেল দুটো মাস। রূপকের পরম আদরে ও যত্নে মাখামাখি হয়ে আছে চিত্রা। প্রতিদিন দোকান থেকে ফেরার সময় কোন না কোন খাবারের জিনিস নিয়ে ফেরে রূপক। কখনো বা মাথার তেল, চুল বাঁধার হেয়ার ব্যান্ড, কিংবা কখনো নিয়ে ফেরে দোকানের সবথেকে সুন্দর শাড়ি।
আজকাল জোসনা বেগম রীতিমত ঈর্ষান্বিত বোধ করেন ছেলের এই আদিখ্যেতা দেখে। কোন এক অজানা কারণে এসব সহ্য হচ্ছে না ওনার। তাই তিনি সবসময় খেমটা মেরে কথা বলেন চিত্রার সঙ্গে। সাইকেলের বিষয়টা পুরোপুরি ধামাচাপা পড়ে গেছে। রুপক সাইকেলটা কিনেছে সেটা নিয়ে সে দোকানে যাতায়াত করে। গত দুই মাসে একবারের জন্যও খোঁজ নেয়নি চিত্রার ফুপাতো ভাই কিংবা ভাইয়ের বউয়েরা। চিত্রা বেশ বুঝতে পারছে সাইকেলের আশায় বসে থাকলে এতদিনে তার সংসারে অশান্তির আগুন জ্বলত। ভাগ্যিস তার স্বামী নিজে থেকেই কিনে ফেলেছে সাইকেলটা। নয়তো কি যে হত তার কপালে? সকাল থেকে চিত্রা এই কথায় ভাবছিল।
হঠাৎ করে সে শুনতে পেল জোসনা বেগম একজনের সঙ্গে রীতিমতো জোর গলায় কথা বলছে, কি আর কমু রে বইন। জনমভরা দুঃখ। এত ভালো পোলা আমার। নায়কের মত চেহারা। বাপের দোকান নিজেই সামলায়। এখন আবার দর্জির কাম শিখছে। একবার দোকান দেখে একবার দর্জির কাম করে। এত কামাই রোজগার করে আমার পোলায়। এক ফকিরের বেটিরে বউ কইরা আনছি। আমার পোলারে একটা সুতা পর্যন্ত দিল না। অন্য কোথাও বিয়ে দিলে আমার পোলারে যেমন সাজাইয়া দিত পোলার ঘরদোর সব সাজাইয়া দিত। এত বড় টিনের ঘর তুলছে আমার পোলায় অথচ ঘরটা পুরা ফাকা। ফুটবল খেলার মাঠ হইয়া গেছে ঘর। কোন জিনিস পাতি নাই। পোলা আমার দুইটা টাকা কামাই কইরা নিজের আয় করব না ঘরের জিনিস করব? অন্য কোথাও বিয়া দিলে কতইনা জিনিস পাইতো আমার পোলাডা।
চিত্রার কানে কথাগুলো আসতেই তার বুকের ভিতর চিনচিন করে বেজে উঠলো। আজ এতদিন পর তার শাশুড়ি মা আবার যৌতুকের বিষয়ে কথা বলছেন। তবে এই কথাটা হয়তো সে শুনতে পারছে তার আড়ালেও নিশ্চয়ই সবাইকে তিনি এসব বলে বেড়ান। এসব ভেবেই ভয়ে তার বুক কেঁপে উঠতে লাগলো।
চিত্রা আড়াল থেকে দেখার চেষ্টা করল তিনি কথাগুলো কাকে বলছেন। দেখতে পেল পাশের বাড়ির দু জন মহিলা। ওনারা অবাক হয়ে রূপকের মায়ের কথা শুনছেন। ওনারা মৃদুস্বরে কি বলল চিত্রা তা শুনতে পেল না। সে দূর হতে দেখল তার শাশুড়ি মা বিড়বিড় করে তাদেরকে কি যেন বলতে লাগলো।
চিত্রার মন খারাপ হয়ে গেল। জোসনা বেগম তার ব্যাপারে দুর্নাম করছে না তো?
চিত্রা মন খারাপ করে শুয়ে রইলো। রাতে রূপক বাসায় ফিরলে জিজ্ঞেস করল, আপনারে একটা কথা জিগাই।
হ বউ কও।
আপনের কি মাঝে মাঝে মনে হয় অন্য কোথাও বিয়ে হইলে অনেক জিনিসপাতি পাইতেন?
এই কথা জিগাইতাছ ক্যান ?
আমারে বিয়া কইরা আপনি কিছুই পান নাই । জামাইয়ের খাতির সম্মানটুকুও পান নাই ।
আমি কি কখনো তোমারে সেসব কথা কইছি?
কন নাই । কিন্তু মনে মনে কি দুঃখ পান না?
না পাই না । আমি তোমারে নিয়ে খুশি আর তাছাড়া এই রূপক মানুষের জিনিস আশা করেনা।
চিত্রা ভীষণ আশ্বাস পায়। রূপকের এই ধরনের কথাগুলো তাকে শান্তি দেয়। তখন নিজেকে খুব সৌভাগ্যবান মনে হয়। ইচ্ছে করে হাজার বছর বেঁচে থাকতে রূপকের বুকে।
চিত্রা সব সময় ভয় পায় এত সুখ তার কপালে সইবে তো? তার এই শঙ্কা বাস্তবে রূপান্তরিত হতে আর খুব বেশি দেরি নেই। সে ধারণাও করতে পারছে না ভবিষ্যতে কি অপেক্ষা করছে তার জন্য!
চলবে..