#দ্বিতীয় পুরুষ পর্ব ১৯
_নীলাভ্র জহির
গতরাতে ঘটে যাওয়া অদ্ভুত ঘটনাটি সারাদিন চিত্রার মনকে প্রভাবিত করে রইল। সকালে রান্নাঘরে এলে জোসনা বেগম চিত্রাকে বসার সুযোগ দিলেন না। ছেলের ওপর হওয়া ক্ষোভ তিনি এখনো ভুলতে পারছেন না।
সারাদিনে বেশ কয়েকবার বললেন, অন্য জায়গায় বিয়া হইলে আমার পোলায় কত জিনিস পাইতো!
মনে অশান্তি চিত্রার। প্রতিদিন এই এক ঘটনার পুনরাবৃত্তি তার আর ভালো লাগছে না। রূপককে কথা দিয়েছিল বলেই সে শাশুড়ীর মুখের ওপর কোনো জবাব দিতে পারেনা।
সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। রান্না ঘরের চালার নিচে ভাত জ্বাল দিচ্ছেন জোসনা বেগম। চিত্রা উঠোনে হাঁটাহাঁটি করছে । সন্ধ্যা হলেও আশেপাশের ঝাউ জঙ্গলে জোনাকির আনাগোনা বেশ প্রকট । ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক জানান দিচ্ছে নেমেছে রাত্রি । এই রাতের অন্ধকারে দখিনা বাতাসে চিত্রার মনটা কেমন যেন ছটফট করে । সে মনে মনে বলছিল যদি এই মুহূর্তে রূপক বাড়ি ফিরত তবে অনেকক্ষণ সে রূপককে জড়িয়ে ধরে থাকতো । মাঝে মাঝে রূপকের কথা খুব মনে পড়ে । সারাদিন মানুষটা কেমন করে কাটায় খুব জানতে ইচ্ছে করে চিত্রার । হাঁটতে হাঁটতে আবছা অন্ধকারে একটা ছায়া দেখে চমকে উঠলো । অন্ধকার কাটিয়ে বের হয়ে আসছে মানুষটা । কাছাকাছি আসতেই চিত্রা বুঝতে পারল সেটা আর কেউ নয়, তার রূপক। মাঝে মাঝে তার মনের আশা গুলো এভাবে পুরণ হয়ে গেলে নিজেকে খুব সৌভাগ্যবান মনে হয় ।
রূপক চিত্রার সামনে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে বলল, কি গো বৌ এইখানে কি করতাছো ?
একটু হাটতে ছিলাম ।
তুমি কি জানবার পারছিলা আমি আসতাছি ?
না তো ।
চিত্রা মনে মনে রূপককে খুব করে কামনা করছিল সেটা অপ্রকাশ্য রাখল । নিজের অনুভূতি গুলো সব সময় প্রকাশ করতে চিত্রার ভালো লাগেনা ।
রূপকের হাতে দুটো ব্যাগ। একটা ব্যাগ রান্নাঘরে মায়ের কাছে রেখে আরেকটা ব্যাগ হাতে নিয়ে নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকলো। জোসনা বেগম তাকিয়ে রইলেন দরজার দিকে। চিত্রা ঘরে ঢুকে ভেজিয়ে দিল দরজা। বুকের ভেতরটা কেমন যেন জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছিল জোসনা বেগমের। তিনি এত আদিখ্যেতা সহ্য করতে পারেন না। এই ভরসন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে দরজা আটকে দেয়ার ঘটনা টা তাকে যতটা না কষ্ট দিয়েছে তার চেয়ে বেশি তিনি কৌতুহলী হয়ে উঠেছেন রূপকের ব্যাগে কি আছে সেটা জানার জন্য। বউ এর জন্য কি নিয়ে এসেছে সে?
রূপক চিত্রার জন্য নিয়ে এসেছে একটা নতুন শাড়ী, ব্লাউজ পিস, নারিকেল তেল ও এক কেজি আপেল।
খুশিতে ঝলমল করতে করতে চিত্রা জিনিস গুলো নাড়াচাড়া করছিল। হারিকেনের টিম টিমে আলোয় ওর মুখে লাল আভা পড়েছে। রূপক সেই গোলগাল লাল গাল দুটো টেনে দিয়ে বলল এত খুশি হইছো বউ? তোমারে এমন সব সময় হাসি খুশি দেখতে আমার খুব ভালো লাগে।
আপনার মত মানুষরে পাইলে হাসিখুশি না থাকলে উপায় নাই।
আম্মায় তোমারে কিছু কইছে?
না,
কাম করনের লাইগা কিছু কয় নাই?
চিত্রার মুখটা অন্ধকারে ছেয়ে গেল। একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, আপনি ক্যান কইছেন আমারে কাম না করতে দিতে। সে আমার উপর রাগ কইরা আছে। আমারে কোন কামে ধরতে দেয় না।
কাম কাজ না করতে দিলে তো আরো ভালো । শুইয়া বইসা কাটাও ।
আমার শুইয়া বইসা থাকতে ভালো লাগে না । আর তাছাড়া ওনারে দিয়া কাম করাইয়া আমি বইসা থাকমু সেটা কেমনে হয় ?
মন খারাপ কইরো না। দুইদিন পর ঠিক হইয়া যাইবো। তুমি এই এক কেজি আপেল আমার আম্মারে দিয়ে আসো। কইবা আপনার পোলায় এক কেজি আপেল আনছে। আপনারা খান। আমারে এইখান থাইকা দুইটা দিয়েন। তাইলে দেখবা তোমারে বেশি কইরা দিব। পোয়াতি হইলে একটু ফলমূল খাওয়াইতে হয় শুনছি। কিন্তু তুমি তো আর এক কেজি আপেল একা একা খাইতে পারবা না। আমার আম্মারে দিয়া দাও সে তোমারে খাইতে দিবো।
চিত্রা বললো, আচ্ছা ঠিক আছে। আমি যাইতাছি।
এখনই যাইতে হইবো না। একটু কাছে আসো। আজ আব্বা দোকানে বইছে। বেচাকেনা নাই। কইলাম তাইলে তাড়াতাড়ি বাড়ি যাই।
জামা কাপড়ের অর্ডার কেমন আসে?
প্রতিদিন দুই একটা অর্ডার থাকেই। দর্জিগিরি কাজ শিইখা ভালো করছি। রমজান মাসে আমার কাম বাইড়া যাইবো।
হ, আপনার লাইগা আমি সব সময় দোয়া করি।
বউ নতুন কাপড়টা একটু পড়ো। তোমারে মন ভইরা দেখি। তুমি পোয়াতি হওয়ার পর তোমারে আরো বেশি সুন্দর লাগে।
কি কন। আমারও তো এখনো পেটই বাইর হয় নাই।
পেটের জন্য না। তুমি এমনি খুব সুন্দরী হইয়া গেছ।
হইছে আর কইতে হইবো না।
দুইহাত বালিশের উপর দিয়ে চিত হয়ে শুয়ে পড়ল রূপক। টর্চ লাইট নিয়ে পুকুর ঘাটে হাতমুখ ধুতে গেল চিত্রা। সন্ধ্যার অন্ধকার কেটে এখন রাত নেমেছে। ঝিঁঝির ডাক আর পুকুর ঘাটে ভেসে আসা শীতল বাতাসে তার মনটা ফুরফুরে লাগে। তার স্বামীর কাপড়ের ব্যবসা। চিত্রা আগে শুনেছে যাদের স্বামীর কাপড়ের ব্যবসা থাকে তারা বউকে খুব একটা কাপড় এনে দেয় না। তার স্বামী সবার চাইতে আলাদা। কয়েকদিন পরপর দোকানের সবথেকে সুন্দর শাড়িটা বউয়ের জন্য নিয়ে আসে রূপক। শরীরে হাওয়া লাগছে শিরশির করে। ঠান্ডা পানি দিয়ে চিত্রা হাত মুখ ধুলো। বাসনা সাবান মুখে ডল ফেনা তুলে মুখ ধুয়ে ফেলল। তারপর গামছায় মুখ মুছতে মুছতে বাড়ির ভিতরে চলে এলো সে।
কয়েকদিন আগে কিনে দেয়া ক্রিম গালে মেখে তার ওপর পাউডার মাখল। মাথায় দিল সুগন্ধি তেল। চোখে মোটা করে কাজল টেনে দিয়ে কপালে দিল একটা ছোট্ট কালো টিপ। তারপর নতুন শাড়ির ভাঁজ ভেঙে পেটিকোটের ওপরে একটু একটু করে কুঁচি করতে লাগলো। চিত্রার শাড়ি পরা দেখতে দেখতে অন্য ঘোরে ডুবে যাচ্ছিল রূপক। তার বউয়ের পূর্ণযৌবনা শরীর। সুতীক্ষ্ণ নাভি। নাভির উপরের ব্লাউজের ভেতর থেকে ফেটে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে হৃষ্টপুষ্ট বক্ষ। শুধু পেটিকোট ও ব্লাউজে চিত্রাকে বড়ই রূপবতী লাগে। রূপকের খুব ইচ্ছা করল উঠে এসে চিত্রাকে একটু দলাই মলাই করে দিতে। কিন্তু সে উঠলো না। আজকাল বউয়ের জন্য তার খুব মায়া হয়। কামনার তীব্রতা বোধহয় ধীরে ধীরে ফুরিয়ে যাচ্ছে।
চিত্রা শাড়ি পড়া শেষ করে বুকের ওপর আঁচল তুলে দিল। তারপর লাজুক মুখে এসে বসল রূপকের সামনে। তার মাথায় হারিকেনের আলোয় জবজব করছে তেল। রূপক বলল তোমারে খুব সুন্দর লাগতাছে বউ।
লজ্জায় অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে চিত্রা মিটিমিটি হাসলো।
তাকে মন ভরে দেখল রূপক। প্রিয় মানুষকে দেখার মাঝে এক স্বর্গীয় আনন্দ বিরাজ করে। রূপক যতই তাকিয়ে আছে চিত্রার দিকে তার হৃদয়টা ভরে যাচ্ছে পুলকে। সদ্য মাড় ভাঙ্গা শাড়িতে চিত্রাকে নতুন বউয়ের মত লাগছে। তার সন্তানের মা হওয়ার পরও কি চিত্রাকে এমন নতুন নতুন লাগবে। নতুন বউ লাগার জন্য মাঝেমাঝে রূপক তাকে একটা করে নতুন শাড়ি এনে দেবে ভাবতে লাগলো।
এমন সময় দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করল রুবিনা। হাতে এনেছে বাটি ভর্তি পেঁয়াজ মরিচ ও সরিষার তেল দিয়ে মাখানো মুড়ি। রুপক বিছানার উপর উঠে বসলো। মুড়ির বাটি নিয়ে খেতে শুরু করল সে। একপলক চিত্রার দিকে তাকিয়ে রুবিনা বলল ভাবি তোমারে সুন্দর লাগতাছে। এই কাপরটা কে দিছে?
তোমার ভাইজান একটু আগে নিয়ে আসলো।
ভাবি আমি যাই।
রূপক বলল, রুবিনা দাঁড়া। আমি আপেল আনছিলাম। আপেলের ব্যাগটা নিয়ে যা।
থমকে দাঁড়াল রুবিনা। চিত্রা টেবিলের উপরে থাকা আপেলের পুরো ব্যাগটাই রুবিনার হাতে দিয়ে দিল।
রূপক বলল, ওইখান থেইকা দুইটা আপেল তোর ভাবিরে দিয়া যাস ।
কাইটা নিয়া আসি। তুমি খাইবা না ভাইজান?
তোর ভাবিরে দুইটা গোটা আপেল দিস। ওর এখন পুষ্টি খাবার খাওয়া দরকার আছে।
রুবিনা তাদের সামনেই পলিথিন এর প্যাকেট খুলে দুইটা আপেল বের করে টেবিলের উপর রাখল। হাসিমুখে বলল, ভাবী এই দুইটা তুমি খাইয়ো।
তারপর বাকি আপেল গুলো নিয়ে সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সেদিন রাতের ঘটনার পর থেকে রুবিনার আচরণে অদ্ভুত পরিবর্তন এসেছে। চিত্রার প্রতি যেমন তার সম্মানটা অনেক বেড়েছে তেমনি বেড়ে গেছে সহানুভূতি ও ভালোবাসাও। চিত্রা এখন অনেক আপন হয়ে গেছে তার। বিষয়টা খুব ভালো লাগছে চিত্রার কাছে।
কিন্তু ওই দিকে হিতে বিপরীত ঘটলো। জোসনা বেগম আপেলের খোলা প্যাকেট দেখে ভাবলেন ছেলে বউয়ের জন্য অনেক ফলমূল নিয়ে এসেছে। সেখান থেকে মাত্র কয়েকটা আপেল দিয়েছে তার জন্য। তার সামনে আপেল রাখতেই তিনি বললেন, তোর ভাই আনছে?
হ মা । ভাবিরে দুইটা দিয়া আইছি। এইগুলা আমাগো লাইগা দিলো। দুইটা ধুইয়া ভাইজান রে কাইটা দিয়ে আসি?
দিয়ে আয়।
জোসনা বেগম অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে রাখলেন। তার মেজাজ খারাপ হচ্ছে। ছেলে আগে কখনোই বাড়িতে আপেল কমলা নিয়ে আসেনি। ইদানিং বউয়ের জন্য লুকিয়ে লুকিয়ে অনেক কিছু নিয়ে আসে। সেগুলো মায়ের হাতে দেয় না। সরাসরি নিয়ে যায় বউয়ের কাছে। তারপর বউয়ের দয়া হলে সেখান থেকে দিয়ে যায় তার কাছে কিছু। বিয়ে করতে না করতেই তার ছেলেটা কেমন স্বার্থপর হয়ে উঠেছে। পেটের ছেলে ও কি কখনো আপন হয় না? ওনার বুক ফেটে কান্না আসতে চাইল। হিংসায় জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যেতে লাগলেন তিনি।
তিনটা আপেল কেটে পিরিচে করে কিছু ভাই ও ভাবীর জন্য নিয়ে গেল রুবিনা। সেগুলো দিয়ে এসে জোসনা বেগমকে বলল, তুমি খাইবা না?
না, তুই খা।
কেন খাইবানা?
অত কথার উত্তর তো দিতে পারুম না। খামু না আমি। এগুলা আমার চোখের সামনে থাইকা সরা।
রুবিনা কিছুই বুঝতে পারলো না। সে জানে মা ভাবির উপর রেগে আছে। সেই রাগ এখনো স্থায়ী হবে সেটা রুবিনার জানা ছিল না। সে দাওয়ায় বসে আপেল খেতে খেতে বলল, আম্মা ভাইজান ভাবির লাইগা একটা খুব সুন্দর কাপড় আনছে।
কোন দিন?
আইজই। একটু আগেই একটা কাপড় নিয়া বাড়িতে ফিরছে।
নতুন কাপড় নিয়ে আইছে?
হ মা ।
লগে আর কি আছে?
আমিতো টেবিলের উপরে শুধু আপেল দেখলাম। আর নারিকেল তেল। একটা ব্লাউজের পিস মনে হয়।
ঈর্ষায় আরো জ্বলে গেলেন জোসনা বেগম। তার ছেলে সত্যি সত্যি পর হয়ে গেছে। পরের বাড়ির একটা মেয়ে তার বাড়িতে ঢুকে দুদিনেই হাত করে ফেলেছে তার ছেলেটাকে। সে এখন শুধুমাত্র বউয়ের জন্য কাপড় আনে। ভুল করে কখনো মায়ের জন্য কাপড় আনে না। বউয়ের জন্য নারিকেল তেল নিয়ে এসেছে। ফলমূল নিয়ে এসেছে। আর মাকে দিয়ে গেল মাত্র কয়টা আপেল?
জোসনা বেগম অন্যদিকে মুখ করে আঁচলের আড়ালে নিজেকে ঢেকে ফেললেন। তার চোখ ভিজে আসছে। মনে মনে ভাবলেন আজকে স্বামী ফিরলে এর একটা ব্যবস্থা তিনি করেই ছাড়বেন।
জোসনা বেগম রাতে ভাত খেলেন না। দাওয়ায় ছেলে মেয়ে ও ছেলের বউকে তিনি নিজের হাতে ভাত বেড়ে দিলেন। পুরোটা সময় মুখ গম্ভীর হয়ে রইলো ওনার। রূপক বারবার বলল, আম্মা তুমি খাইবা না?
তিনি উত্তরে বললেন, তোর বাপ আসলে খামু।
জোসনা বেগম মাঝে মাঝেই এমন করেন। স্বামী ফিরলে একসঙ্গে বসে ভাত খান। তাই রূপক এটা নিয়ে কোন বাক-বিতণ্ডা করল না।
কিন্তু রাতে ভাত খেলেন না তিনি। স্বামী বাসায় ফিরতেই তিনি কান্না জুড়ে দিলেন। আহাজারি করা কান্না। তার ছেলে পর হয়ে গেছে। বিয়ে দিতে না দিতেই ছেলেটা আর বাবা মাকে চেনেনা। এখন তার সবকিছু নিজের স্ত্রী। স্ত্রীর জন্য কত কি নিয়ে আসে আর তার কপালে জোটে দুটো আপেল।
স্ত্রীকে তিনি সান্তনা দিতে পারলেন না । তিনি যাই বলতে চান না কেন জোসনা বেগম আরো বেশি হাহাকার করে কাঁদতে থাকেন। তবে সেই কান্নার শব্দ চিত্রার ঘরে পৌঁছালো না। কারণ বাইরে তখন ঝুম বৃষ্টি। রূপক আর চিত্রা অনেকদিন পর শব্দ করে হাসার সুযোগ পেয়েছে। রূপকের কথা শুনে হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে চিত্রা। নতুন শাড়ির আবরণ গা থেকে সরিয়ে সে স্বামীর বক্ষে নিজের জায়গা করে নিয়েছে।
চলবে..