#দ্বিতীয় পুরুষ
পর্ব ২৬
_নীলাভ্র জহির
শ্বশুর বাড়িতে এসেই রুবিনার শরীর খারাপ হয়ে গেল। সারাদিনের ধকল শেষে প্রচন্ড মাথা ঘোরাতে লাগল তার। ভাবীরা তাকে আয়োজন করে বাসর ঘরে বসিয়ে রেখেছে। তার শরীর খারাপ লাগার কথা কাউকে বলাও যাচ্ছে না। বাধ্য হয়ে দাঁত মুখ শক্ত করে সবকিছু সহ্য করতে হচ্ছে। অসুস্থতার কথা বললেই আবার ডাক্তার ডাকা হবে। ডাক্তার এলেই হবে বিপদ।
সবাই চলে গেলে শিমুলকে সবটা খুলে বলল রুবিনা। চাকরিতে জয়েন করতে হবে এই অজুহাত দিয়ে একদিন পরেই রুবিনা কে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিলো শিমুল। বিদায়বেলায় বাবার বাড়িতে আরো একবার এসেছিল সে। চিত্রার গলা জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না। রূপক ও জোসনা বেগম অবাক হয়ে দেখছিলেন। তাদেরকে জড়িয়ে ধরে ও এতটা মায়া কিংবা মহব্বতের সঙ্গে কান্না করে নি রুবিনা। অথচ ভাবির গলা জড়িয়ে ধরে এমনভাবে কাঁদতে লাগল যেন ভাবির সঙ্গে তার জন্ম জন্মান্তরের আত্মার সম্পর্ক।
রুবিনা ঢাকায় চলে গেলে চিত্রার মনটা খারাপ হয়ে গেল। কয়েকটা দিন বিষন্ন হয়ে রইল সে। গত কিছুদিনেই রুবিনার সঙ্গে তার বেশ ভাল সম্পর্ক হয়ে উঠেছিল। দিনের বেশিরভাগ সময় একসঙ্গে কাটাত তারা। রুবিনা চলে যাওয়ায় কোথায় একটা শূন্যতা তৈরি হয়েছে। তবে সেই শূন্যতাকে কল্যাণ ভেবে নেয়ার চেষ্টা করল। কারণ এই মুহূর্তে রুবিনার জন্য বিয়ে করাটাই সব থেকে বেশি জরুরি ছিল। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে সর্বশেষ তাদের বিয়েটা যে হয়েছে এতেই খুশি চিত্রা।
মেয়ে চলে যাওয়ায় জোসনা বেগম যেন ভীষণ একা হয়ে পড়লেন। এই মুহূর্তে চিত্রাকে নিজের মেয়ের মতো বুকে টেনে নেয়া ছাড়া আর কোন বিকল্প দেখতে পেলেন না। তিনি মাঝে মাঝে চিত্রাকে ডেকে পাশে বসান। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সাংসারিক গল্প করার চেষ্টা করেন। বিষয়টা চিত্রার খুব ভালো লাগে। শাশুড়ির শুন্য বুকটাকে সে নিজেও দখল করে নেয়ার চেষ্টা করতে লাগলো।
সকালবেলা জোসনা বেগম চিত্রাকে বললেন, আইজ একবার বাজারে যামু। দোকানে ঘুইরা আসি। কাম কাজ শ্যাষ কইরা রেডি হও।
খুশিতে চিত্রার চোখ দুটো চকচক করে উঠলো। এই প্রথম সে নিজেদের দোকানটা দেখতে যাবে। তার স্বামীর দোকান। তার শশুরের সম্পদ। এই দোকান দিয়েই তাদের সংসারটা চলছে।
বিকেলবেলা জোসনা বেগমের সঙ্গে বাজারে যেতে যেতে তার অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হল। তার ধারণা ছিল বাজারে শুধু পুরুষ মানুষরাই যায়। কিন্তু এখন দেখছে পুরো ব্যাপারটাই ভিন্ন। দলবেঁধে মেয়েরাও যায় বাজারে কেনাকাটা করতে। পথে যেতে যেতে পরিচিত অনেকের সঙ্গেই দেখা হল। ছোট ছোট মেয়েরা প্রাইভেট কিংবা কোচিং করতে যাচ্ছে। পরিচিত মহিলারা যাচ্ছে বাজার-সদাই করতে। কুন্দনপুর বাজার আগে তার কখনো ঘুরে দেখা হয়নি। বাজারে প্রবেশ করার পর বুঝতে পারলো বেশ আধুনিক বাজার। ইটপাথরের বড় বড় ঘরের ভেতর কাঁচ দিয়ে সুন্দরভাবে সুসজ্জিত দোকান গুলো দেখে মনে হতেই পারে কোনো শহরে চলে এসেছি। দোকানে দোকানে বসে কম্পিউটার চালাচ্ছে ছেলেরা। হিন্দি কিংবা রক মিউজিকের তালে তালে মূখরিত হয়ে উঠেছে রাস্তাঘাট। চিত্রা জানে এইসব দোকানে ছেলেরা মোবাইলের মেমোরিতে ভিডিও কিংবা ছবি ডাউনলোড দিতে আসে। বড় বড় বেশ কয়েকটা মার্কেট চোখে পড়ল। একদিকে কাপড়ের দোকান তো অন্যদিকে কসমেটিক্স। চিত্রা জোসনা বেগম কে বলল, বাজারে তো দেখি অনেক কাপড়ের দোকান।
জোসনা বেগম গর্বের সঙ্গে বললেন, হ। এগুলা দুই দিন আগেই হইল। এই বাজারে আমাগো দোকানটায় ছিল সবার পরথম। আমার বিয়ের পর কুন্দনপুর বাজারে কোন কাপড়ের দোকানে ছিল না। ম্যালা দূর থাইকা কাপড়-চোপড় মানুষ কিনা আনতো। তোমার শ্বশুর পরথম কাপড়ের দোকান দিছে এইখানে। ছোট দোকান দিছিল কিন্তু মেলা বেচাকেনা হইত। আস্তে আস্তে আমরাও দোকানটা বড় করছি। কিন্তু এখন আর আগের মতো বেচাকেনা নাই। বাজারে কতশত দোকান হইয়া গেছে। মানুষজন হরেক রকমের জিনিস কিনতে হরেক রকমের দোকানে যায়। এখন তো কেউ আবার উপজেলা থাইকা কিইনা আনে।
দোকানের সামনে এসে রূপকের সঙ্গে দেখা হতেই মুচকি হাসল চিত্রা। সব সময় রূপককে সে তার স্বামী রুপে দেখেছে। এই প্রথম একজন ব্যবসায়ী রূপে দেখে একটু ভিন্ন অনুভূতি হল। দোকানে বসে রূপক বেচাকেনা করছে। তারা আসার পর দুজন কাস্টমার এসেছে দোকানে। এরই ফাঁকে জোসনা বেগমের সঙ্গে কথা চালিয়ে যাচ্ছে রূপক। একটা ছোট্ট ছেলেকে সে কিছু খাবার ও চা নিয়ে আসার অর্ডার দিল। মুহূর্তেই দৌড়ে গিয়ে পাশের দোকান থেকে সিঙ্গারা, পিয়াজু ও চা নিয়ে এলো ছেলেটি। ততক্ষণে কাস্টমার বিদায় হলো।
রূপক চিত্রাকে বলল, প্রথমবার আইছো। কেমন লাগতাছে?
আপনার দোকানটা বড়ই সুন্দর।
সুন্দর কইরা গুছাইয়া রাখছি না? সিঙ্গারা খাও। মা, কও বাজারে কি কাম?
কাম আছে। নাক ফুলের পাথর পইরা গেছে অনেকদিন হইল। ঠিক করতে দিমু। আমি দুই গজ কাপড়ও নিমু।
দুই গজ কেন তোমার যত মন চায় নিয়ে যাও । তোমার কোন কালারটা পছন্দ বাইছা নেও।
জোসনা বেগম থরে থরে সাজানো কাপড় গুলোর দিকে তাকিয়ে নিজের পছন্দসই কাপড়টা খুঁজতে লাগলেন। রূপক উঠে এসে চিত্রাকে বলল আসো তোমারে আমার দর্জির মেশিন দেখাই।
মেশিনে বসে কিছুক্ষণ চালিয়ে চিত্রাকে দেখালো রূপক। পিছনে সাজিয়ে রাখা বেশ কিছু নতুন ডিজাইনের জামা। রূপক বলল এগুলো সব আমি সেলাই করছি। কেমন হইছে?
ভালো।
তোমার একটা সেলাই কইরা দিমু?
কি যে কন? আমার কি জামা পরার বয়স আছে? অহন তো শাড়ী আর মেক্সি পরার দিন।
হ, তোমারে দুইটা ম্যাক্সি বানাইয়া দিতে হইব। তুমি একটা কাম করো। কিছু প্রিন্টের কাপড় পছন্দ কইরা দেও। এইখান থেকে পছন্দ করো।
নিজের স্বামীর দোকান থেকে কাপড় পছন্দ করতে তার এক ধরনের গর্ব বোধ হচ্ছিল। সিঙ্গারা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। রূপক বারবার বলার কারণে চিত্রা সিঙ্গারা নিয়ে খেতে শুরু করল। এমন সময় রাস্তা দিয়ে যাওয়া একজন পথচারী দোকানের দিকে তাকায়। লোকটা চিত্রার পূর্বপরিচিত। তার বাপের বাড়ির পাশেই ওনার বাড়ি। লোকটা চিত্রাকে দেখে বলে উঠলেন আরে আমাগো চিত্রা যে। এইখানে কি করো?
সে ভেতরে এসে দাঁড়ালো। চিত্রা হাসিমুখে বলল, কেমন আছেন চাচা?
ভালো আছি। কাপড় কিনতে আইছো?
চাচা এটাতো আমার স্বামীর দোকান। ইনি আমার শাশুড়ি আম্মা।
তোমার স্বামী কাপড়ের দোকান করে? তার না বাজারে শুটকির দোকান?
মুহূর্তেই মুখটা শুকিয়ে গেল চিত্রার। বুকটা ধ্বক করে উঠলো। হঠাৎ মনে পড়ল তার প্রথম বিয়ের সময় এই লোকটা উপস্থিত ছিলেন। শঙ্কায় চিত্রার মুখ শুকিয়ে গেল। সে চেষ্টা করল সহজ ভাবে হেসে বিষয়টাকে সহজ করে দিতে। কিন্তু সবকিছু এতটা সহজ ছিল না।
জোসনা বেগম জিজ্ঞেস করলেন, তোমার বাপের এলাকার মানুষ?
চিত্রা মাথা ঝাকালো। তার গলা দিয়ে কোন শব্দ বের হলো না।
রূপক ওনাকে সালাম দিয়ে এসে দাঁড়াল চিত্রার পাশে। বলল, চাচা ভালো আছেন? আপনি আমার শ্বশুরবাড়ির এলাকার মানুষ। আর আমার দোকানে আইসা আপনি খাড়াইয়া আছেন। বসেন তো। চা খান।
রূপক ছোট ছেলেটাকে আবারো চা ও সিঙ্গারা আনতে পাঠালো। ক্রমশ পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে চিত্রার। কারণ এই লোকটা তার প্রথম স্বামীকে দেখেছে। কী যে হবে!
চিত্রা সহজ স্বাভাবিক ভাবে বলার চেষ্টা করল, চাচি কেমন আছে?
কিন্তু মুরুব্বী আর কথার উত্তর দিচ্ছেন না। তিনি হতভম্বের মত রূপকের দিকে তাকিয়ে আছেন। সম্ভবত তিনি পূর্বে দেখা মানুষটার সঙ্গে রূপককে মেলানোর চেষ্টা করছেন। সেটা করতে পারছেন না বলেই অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছেন তিনি। রূপক আবারও হাসিমুখে বলল, চাচা আপনি বসেন। চা আনতে পাঠাইছি।
লোকটা হতভম্ব অবস্থাতেই বসে পড়লেন। শুকনো হাসি দিয়ে চিত্রাকে বললেন, তো ভালোই আছ তাইলে? তোমার বাপের লগে দেখা হয়েছিল দুইদিন আগে। শুকায়ে গেছে।
আব্বারে কইয়েন আমার বাড়িতে আইতে। কিছুদিন আগে একবার খবর পাঠাইছিলাম। তাও আসে নাই। কইবেন চিত্রা আপনেরে দেখতে চাইছে।
আচ্ছা।
চা ও সিংগারা চলে এলো। রূপক বলল, চাচা চা খান। আমার শ্বশুর বাড়িতে যাওয়ার সৌভাগ্য নাই। তাই শ্বশুরের এলাকার কাউরে চিনি না। আপনি কি কোন কামে আইছেন এই বাজারে?
হ, একটা কামে আইছি।
মেলা দূর-দূরান্ত থাইকা লোকজন এই বাজারে আসে। যাইহোক মাঝেমধ্যে আসলে আইসেন আমার লগে দেখা করতে। পরিচয় যখন হইল।
হ, সেইটাই। পরিচয় যখন হইল, আসবো নে।
চিত্রার মুখটা অন্ধকারে ছেয়ে গেল। চাচা গ্রামে গিয়ে চিত্রা কিংবা তার স্বামীর ব্যাপারেও ভিন্ন কিছু বলবে কিনা সেই দুশ্চিন্তা কাবু করে ফেলল চিত্রাকে। তার গ্রামের লোকজন কিছুই জানেনা। এই লোকটা যদি গিয়ে সবকিছু নিয়ে গবেষণা শুরু করে দেয়, তাহলে তো বিপদে পড়তে হবে। পুরো গ্রামবাসীকে সে জানিয়ে দেবে চিত্রার আগের বিয়ের কথা, রূপকের কথা। চাচার সঙ্গে একাকী কথা বলতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু তখনই দোকানে চলে এল চিত্রার শ্বশুরমশাই। শশুরের সামনে লোকটার সঙ্গে একাকী কথা বলার সুযোগ পেলো না চিত্রা। তিনি এসে জোসনা বেগমকে বললেন, বউরে লই মোস্তফার দোকানে যাইও। যাইতে কইছে তোমারে।
জোসনা বেগম তাগাদা দিয়ে তাকে বললেন, চলো বৌমা। কাম সাইরা আসি। সন্ধ্যা হইয়া যাইতাছে।
চিত্রা তার গ্রামের লোকটিকে বলল, চাচা ভালো থাইকেন। চাচিরে আমার সালাম দিয়েন।
লোকটা হতভম্ব হয়ে সিঙ্গারা খাচ্ছেন। তার অদ্ভুত দৃষ্টি চিত্রার বুকে কাঁপন ধরিয়ে দিল।
লোকটা যদি রূপককে কিছু বলে দেয়? এই এক দুশ্চিন্তা মগ্ন করে ফেলল চিত্রাকে। লোকটা বিদায় না নেয়া পর্যন্ত চিত্রা কাপড় পছন্দ করার অজুহাতে দোকানে বসে রইল। তিনি চলে যাওয়ার পর মনটা কিছুটা শান্ত হল। কিন্তু তবুও এক ধরনের অজানা আশঙ্কায় চিত্রার আর কোন কিছুই ভালো লাগছে না। জোসনা বেগমের সঙ্গে জুয়েলারির দোকানে এসেও তার দুশ্চিন্তা কিছুতেই কমলো না। বাজারের কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে এলো। জোসনা বেগম চুলায় ভাত বসিয়েছেন। চিত্রার খুব অস্থির লাগছে। কেন যেন মনে হচ্ছে তার জীবনে কোনো বিপদ নেমে আসতে যাচ্ছে। এতদিন এই ভয়টা তার মনে ছিল না। আজ বিকেলের পর থেকেই ভয়টা দানা বেঁধেছে মনে। চিত্রা নিবিড়ভাবে প্রার্থনা করতে লাগল যেন তাঁর জীবনে বিপদাপদ গুলো কেটে যায়।
রূপক বাড়ি ফিরল রাত্রিবেলা। ভয়ে ভয়ে তার সঙ্গে কথা বলল চিত্রা। রূপকের কথাবার্তা বেশ স্বাভাবিক। তারমানে বিপদের আশংকা নেই। চিত্রা শংকায় ম্লান।
দেখতে দেখতে কেটে গেল কয়েকটা দিন। চিত্রার ভয়টা আস্তে আস্তে কেটে যাচ্ছে। প্রাণ ফিরে পেয়েছে সে। রূপক স্বাভাবিক আচরণ করছে তার সঙ্গে। সবকিছু যেন এভাবেই থাকে। তার জীবন থেকে রূপক হারিয়ে গেলে কি নিয়ে বাঁচবে সে?
চলবে..