#দ্বিতীয় পুরুষ
পর্ব ৩১
_নীলাভ্র জহির
রাতে যখন রুপক ও চিত্রা নিজের ঘরে শুয়ে পড়েছে জোসনা বেগম তখন ছেলের ঘরের দেয়ালে কান পেতে দাঁড়ালেন। অনেকক্ষণ থেকে মনের ভেতর একটা খচখচানি ধীরে ধীরে তার কৌতুহল বাড়িয়ে দিচ্ছে। ছেলে ও তার বউ এর মাঝে কি এমন বিষয় নিয়ে দ্বন্দ্ব হচ্ছে সেটা জানতে ইচ্ছে করছে তার। সরাসরি প্রশ্ন করে কোন লাভ নেই। কারণ তাঁদের এই অশান্তি বেশ কিছুদিন আগে শুরু হলেও এখন পর্যন্ত জোসনা বেগমের কানে কোন টুঁ-শব্দ পর্যন্ত আসেনি। ওরা দু’জন বিষয়টাকে খুব সুন্দর ভাবে আড়াল করে রেখেছে। তবে আজকে মনে হচ্ছে বিষয়টি তার জানা দরকার। কারণ ছেলের অশান্তি তিনি আর সহ্য করতে পারছেন না। তার আদরের টুকরা সন্তান অনেক কষ্ট করে আয় রোজগার করে। এমন সোনার টুকরা ছেলে সংসারে অশান্তিতে থাকবে সেটা তো মা হিসেবে তিনি মেনে নিতে পারেন না। তাই তিনি বাধ্য হয়ে ছেলের ঘরের দেয়ালে কান পাতলেন। টিনের ঘর তাই ঘরের ভেতর কি কথাবার্তা হচ্ছে একটু দাঁড়ালেই সব স্পষ্ট শোনা যায়। তার ওপর নিস্তব্ধ রাত্রি। কোথাও কোন শব্দ নেই যেন নিঃশ্বাস ফেললেও সেই শব্দ স্পষ্ট শোনা যাবে। অনেকক্ষণ কারো কোন গলা শোনা গেল না। জোসনা বেগম হতাশ হয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি ভাবলেন হয়তো তারা একে অপরের সঙ্গে কথা বলবে না। অবশেষে তার অপেক্ষার পালা ফুরালো।
রূপক চিত্রাকে বলল, একটু সংসারের দিকে খেয়াল দাও। আমি একা একটা সংসার টানতাছি। কখনো তো কাউরে কিছু কই না। তুমি আমার বউ। সংসারের দিকে একটু মন দিও।
চিত্রা মৃদু স্বরে বললো আমার মনটা খুব খারাপ ছিল। আমি তখন খেয়াল করি নাই যে বিলাই আইছে। আপনি রাগ কইরেন না।
– কার সঙ্গে রাগ করব? তোমার সঙ্গে রাগ কইরা আমার কোনো লাভ আছে? রাগ করলে তোমার অতীতের সব কিছু ধুইয়া চইলা যাইবো না।
– এই জিনিসটা নিয়ে আপনি আর কতদিন রাগ কইরা থাকবেন?
– আমার কথা বাদ দাও। তোমার কোন অসুবিধা হইতেছে কিনা সেইডা কও।
-তিন বেলা ভাত আর কাপড় দিলেই যদি মানুষ সুখী হইতো, তাইলে কমু আমি সবচাইয়া সুখী। মনের মধ্যে অশান্তি নিয়া কি ভালো থাকা যায়? আপনি আমারে ভুল বুইঝা কষ্ট পাইতাছেন। আমার লগে ভালো কইরা কথা কন না। আমার কাছে আসেন না। আমি কেমনে ভালো থাকি?
রূপক চুপ করে রইলো। খানিকটা সময় কেটে গেল নীরবে। চিত্রা বলল, আমার আগে বিয়ে হইছে সেটা আমি স্বীকার করে লইসি। কেমনে বিয়া হইলো আর কেমনে সবকিছু হইল তাও আপনারে জানাইছি? বিয়ার লগে লগেই তো আমি পলাইয়া আইছি। ওই লোকের সঙ্গে আমার তো কয়েকটা কথা হয় নাই। আপনি তাও আমারে কেন ভুল বুঝতাছেন?
– বুঝতাসিনা কোনটা সত্য কোনটা নাটক।
– আপনি আমাকে বিশ্বাস করেন না?
– এতদিন তো বিশ্বাস করছি। কিন্তু যখনি মনে হয় তুমি আমারে এতো ভালোবাসা দিলা অথচ আগের স্বামীর কথা তোমার মনে আসে নাই, তাতো হইবার পারে না।
– ওই লোকটারে আমি ভালো কইরা দেখিও নাই। তার লগে আমার দুইটা কথাও হয় নাই। তার কথা আমার মনে ক্যান আইবো।
– কেন জানি মন থাইকা মাইনা নিবার পারতাছিনা। বারবার খালি মনে হয় তোমরা সবাই মিলা আমারে এমনে ঠকাইলা। বিয়া হইছিল এই পুরা ঘটনা আমারে খুইলা কইলে হইত।
– খুইলা কইলে কি আপনি আমারে বিয়া করতেন?
– হ, করতাম। সত্যটা খুইলা কইলে ঠিকই বিয়া করতাম।
– এত সহজ না রূপক মিয়া। তখন আমারে আপনি ছ্যাপ দিয়া চইলা যাইতেন। আর আপনার মায়ে জীবনে আমার লগে আপনার বিয়া দিতো না।
– আমার মায়ের জায়গা থাইকা তুমি ভাইবা দেখো। তার এতো ভালো পোলা। নিজে ব্যবসাপাতি করে। পুরা সংসারের দায়িত্ব নিয়ে নিছে। আমিতো দেখতে শুনতেও খারাপ না। এমন পুলারে একটা বিয়াইত্তা তে মাইয়ার লগে সে কেন বিয়া দিব।
– হ, সেইটা তো আমি জানি। তার পোলা একাই ভালো। আর আমি মাইয়াডা খারাপ। যেই ঘটনার উপর আমার কোন হাত ছিল না তাও আমি খারাপ। যেই লোক আমারে বেইচা দিতে নিয়েছিল সেই ভালো। আমারে বেইচা দিলে আমি তার ঘরে গিয়া তার সেবা যত্ন করতে হইলে ভালো হইতো। পলাইয়া আইসা ভুল করছি। ফুফুর সংসারে ভাইদের ঘরে বোঝা হইছি। আর এখন আপনার ঘাড়ে বোঝা হইয়া আছি। কপালটা আমারই খারাপ।
এরপর আর কোন শব্দ নেই। দুজনেই অনেকটা সময় চুপচাপ। কেবল কিছুক্ষণ পর দরজার খিল খোলার শব্দ শোনা গেল। জোসনা বেগম আড়াল হয়ে দাঁড়ালেন। ঘর হতে বেরিয়ে গেল। উঠানে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরাল সে। জোসনা বেগম স্তব্ধ। দুই পা ফেলার শক্তিটুকুও তিনি হারিয়ে ফেলেছেন। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে কেবল দেখতে লাগলেন দূরে তার ছেলে কতটা হতাশ ভঙ্গিতে সিগারেট টানছে। তার কলিজার টুকরা ছেলের এই অশান্তি কিছুতেই সহ্য হলো না ওনার। বুকের ভেতর দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো আগুন। তিনি যা কিছু শুনলেন তা শোনার পর নিজেকে ধরে রাখা কঠিন। ছেলেটার কপালে তবে এই ছিল। মনে ভাবতে লাগলেন অন্য কোথাও বিয়ে হলে তার ছেলেটা সবদিক থেকে কতটা খুব সুখী হতে পারত। একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিঃশব্দে তিনি নিজের ঘরে চলে এলেন। তবে সারারাত ঘুমাতে পারলেন না। ছটফটানিতে এপাশ-ওপাশ করে কাটলো তার। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলেন সকালবেলায় তিনি একটা বিহিত করবেন।
সবেমাত্র ভোরের আলো ফুটেছে। রূপকের বাবা গরু গুলোকে গোয়াল ঘর থেকে বের করছেন। ক্লান্ত চোখে জোসনা বেগম দাওয়ায় এসে বসলেন। ওনার স্বামী জিজ্ঞেস করলেন , বাজার সদাই আছে?
জ্বাল দেয়া ইলিশ মাছ আছে।
দেখলাম একটা লাউ বড় হইছে। রান্না কইরো।
আপনি আইজ কোথাও যাইয়েন না।
কেন?
যাইতে না করছি। এত কথা কইতে পারুম না।
তিনি জোসনা বেগম এর দিকে তাকিয়ে রইলেন। এলোমেলো চুলে বসে রয়েছে জোসনা। আঁচলটা ঠিক জায়গায় নেই। তাকে খুব দুশ্চিন্তাগ্রস্ত দেখাচ্ছে। একই সঙ্গে তিনি খুবই বিরক্ত ও কষ্টে জর্জরিত। তিনি গরুগুলোকে বেঁধে রেখে জোসনা বেগমের কাছে এসে দাড়ালেন, কি হইছে রে?
কি আবার হইবো? সাতসকালে আমি বাড়িতে অশান্তি শুরু করতে চাইতাছি না। আপনি আজকে কোথাও যাইবেন না। সবকিছুর একটা বিহিত করা দরকার।
কিসের বিহিত করবা?
কইলাম তো সাতসকালে অশান্তি করতে চাইতেছি না। আপনি আপনার কাম করেন। সময় হইলে সব জানতে পারবেন।
জোসনা বেগম আজ ভাত চুলায় তুলে দিতে দেরি করে ফেললেন। তার মনে বড় অশান্তি। ছেলের অশান্তিতে মা কখনো শান্তিতে থাকতে পারে না। তিনি একবার ছুটে পুকুরঘাটে যাচ্ছেন আবার ছুটে আসছেন আঙিনার ভিতর। একবার হাস মুরগিগুলোকে খাবার দিচ্ছেন তো আরেকবার দৌড়ে যাচ্ছেন গোয়াল ঘরে। তার যেন কোথাও এক দন্ড শান্তি নেই। মনটা কেমন বিষে তিতা হয়ে আছে। ইচ্ছে করছে মনের বিষ খেয়ে মরে যেতে। তার ছেলের কপালটাই খারাপ। নয়তো এমন সোনার টুকরা ছেলে কি করে এমন মেয়ের পাল্লায় পড়ল।
রান্না করার সময় দরজা খুলে বের হল চিত্রা। হাতমুখ ধুয়ে এসে রান্নাঘরের পাশে দাঁড়ালো। জোসনা বেগম তাঁর দিকে তাকালেন না পর্যন্ত। চিত্রা বলল, কিছু করতে হইবো আম্মা?
না,
চিত্রা কিছুক্ষন দাড়িয়ে রইল। তারপর ঝাড়ু নিয়ে চলে গেল নিজের ঘরে। তার শাশুড়ি ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে সবার আগে নিজের ঘর ঝাড়ু দেয়। তারপর আঙিনা উঠান ঝাড়ু দিয়ে রান্না করতে বসেন।
উঠান দেখে মনে হচ্ছে তিনি ঝাড়ু দেননি। পুরো উঠান জুড়ে শুকনো পাতা পড়ে রয়েছে। চিত্রা নিজের ঘর ঝাড়ু দিয়ে উঠান ঝাড়ু দিতে চলে এলো। জোসনা বেগম কিছু বললেন না। তবে শক্ত মুখ করে তাকিয়ে রইলেন। কড়া ভাষায় নিষেধাজ্ঞা করতে গিয়েও করলেন না। ভেতরে ভেতরে কেবল উনার রাগটা ফুলে ফেঁপে উঠছে।
সকাল সকাল ভাত খেয়ে রূপক দোকানে চলে গেল। জোসনা স্বামীকে পানের খিলি তৈরি করে দিচ্ছেন। এমন সময় চিত্রাকে ঘরে ডাকলেন তিনি। চিত্রা দরজায় দাড়িয়ে বলল আমারে ডাকছেন?
হ।
চিত্রা ঘরে ঢুকে চেয়ারের ওপর বসলো। জোসনা বেগম উনার স্বামীকে বললেন, ওর আগেও বিয়া হইছিল।
বিস্ফোরিত হয়ে উঠল চিত্রার চোখ। এই কথাটা জোসনা বেগম কিভাবে জানলেন? মুহুর্তেই দৃষ্টি নামিয়ে ফেলল। মাথা নিচু করে ভাবতে লাগল এবার কোথায় যাবে সে। শাশুড়ির কাছেও নিশ্চয়ই তাকে অনেক ছোট হয়ে থাকতে হবে।
রূপকের বাবা খানিকটা অবাক হয়েছেন। কারন এমনটা তিনি আশা করেন নি।
জোসনা বললেন, বউ কথাটা আমি ঠিক কইছি?
চিত্রা উপর নিচে মাথা ঝাকালো।
কয়দিন সংসার করছো?
একদিনো না। যেদিন বিয়া হইছে ওই দিনই ভাইঙ্গা গেছে।
শুনছি। তুমি পলাইয়া আইছো। কেন পলাইছো?
যে আমারে বিয়া কইরা নিয়া গেছিল সে অন্য একটা লোকের কাছে আমারে বেইচা দিছিল। এটা জানতে পাইরা আমি সঙ্গে সঙ্গে পলাইয়া আছি।
কথা সইত্য?
চিত্রা মাথা ঝাকালো।
এটাতে সইত্য কইছো তার পরমাণ কি? কেমনে বুঝবো তুমি কথাটা হাছা কইছ?
নিশ্চুপ রইল চিত্রা। জোসনা বললেন, তোমার ভাইয়েরা কাজটা ঠিক করে নাই। তাগো উচিত ছিল সবকিছু আমাগো কাছে খোলাসা কইরা তারপর মাইয়া বিয়া দেয়া। এতে আমরা বিয়া দিলে দিতাম, না দিলে না দিতাম। একটা মাইয়া রে ঘাড় থাইকা সরানোর লাইগা সত্য গোপন কইরা বিয়া দেওয়ার কোন মানে হয় না। এখন আমরা সত্যটা জানবার পারছি। এখন তো আমাদের তাদেরকে আর বিশ্বাস হইতেছে না। মনে হইতাছে তারা আরো অনেকগুণ সত্য আমাগো কাছে গোপন করছে।
চিত্রা মৃদুস্বরে কেবল উত্তর দিল, আমারে আপনারা বিশ্বাস করেন। আমার লগে যা ঘটছে আমি তাই কইছি।
– শুধু তোমার মুখের দিকে তাকাইয়া আমার পোলা বিয়া কইরা আনছে। অন্য ঘরে মাইয়া বিয়া দিলে আমার পোলার আদর সম্মানের কোন সীমানা থাকত না। পোলারে মাথায় কইরা রাখত। খাওন-দাওন জিনিসপত্র দিয়া একাকার কইরা দিত। তোমার ঘরে বিয়া দিয়া সে কোন সম্মান পাইলো না। শশুর ঘরে একবার দাওয়াত পাইল না। তোমাগো বাড়ি থাইকা তারে কেউ একটা সুতো পর্যন্ত দেয় নাই। তাও মাফ করতাম যদি আমার পোলাডারে কেউ একটু আদর কইরা নিয়া গিয়া দুইবেলা খাওয়াইত। একদিন দাওয়াত করার মতো তোমার গুষ্টি তে কেউ নাই। পোলায় আমার এতই দুর্ভাগা। অন্য ঘরে মাইয়া বিয়া দিলে আমার বাড়ি ভর্তি আজকে জিনিস দিয়া ভর্তি হইয়া যাইত। তাও আমি তোমারে কিছু কই না। কিন্তু এত বড় সত্যটা জানার পরেও কিছু না কইয়া কেমনে থাকমু? আমার পোলা ডা বড় ভালো। তার দিলটা অনেক বড়। মানুষরে দুইহাতে বিলায়। অনেক কষ্টে সে বাপের ব্যবসা বড় করতাছে। এমন সোনার টুকরা পোলা আমি অনেক ভালো মাইয়ার লগে বিয়া দিবার পারতাম। খালি পোলায় আমার তোমারে দেইখা কইসিলো যে ঐ মাইয়ারে ভালো লাগছে। আমি আর কোন খোঁজ খবর নেই নাই। কোন হিসাব-নিকাশে যাই নাই। তোমার ভাইয়েরা কইছিল রুপকরে সাইকেল দিব। আমরা খুশি হইছিলাম। সেই সাইকেল ডাও তারা দেয় নাই। সাইকেল দেওয়ার ভয়ে তারা আমাগো লগে কোনো যোগাযোগ করে নাই। তোমারও কোনদিনও খোঁজ নিলোনা। আর যখন জানতে পারলাম তুমি নিজেও আমার লগে বাটপারি করছো, আমার আর কি কওয়ার আছে।
– আম্মা আমি কোন বাটপারি করি নাই। যা সত্য আমি তা কইসি। আপনারা যদি তাও আমারে অবিশ্বাস করেন আমার তো আর কিছু করার নাই।
– তুমি তো সেটা কইবাই। এখন কথা হইতাছে আমরা এই জিনিস গেরামের মানুষরে কমু না। মানুষে শুনলে হাসাহাসি করব। আমি কাউরে কিছু কইতাছি না। কিন্তু আমার পোলায় যেভাবে কষ্ট পাইতাছে সেটা তো আমি সহ্য করবার পারতাছিনা।
চিত্রা মাথা নিচু করে রইল। রূপকের কষ্ট সে নিজেও তো সহ্য করতে পারছে না।
জোসনা বললেন, তোমারে যেই কথা কইতে ডাকছি। তোমার পেটে আমার বংশের পোলা। আর তাছাড়া তুমি মা মরা মাইয়া। তোমার বাপে তো পাগলা। তোমারে আমরা খেদাইয়া দিতে পারিনা। নিজের বিবেক বইলা একটা কথা আছে। তবে একটা কথা কইতাছি, আমি আমার পোলারে আবার বিয়ে করামু । তুমি এইখানে কোন বাধ সাধবা না।
মুহূর্তেই বিস্ফারিত চোখে জোসনা বেগম এর দিকে তাকাল চিত্রা। এক ভয়ঙ্কর সমুদ্রের গর্জন তার বুকে আছড়ে পড়ল। নিজের কানকেও তার বিশ্বাস হচ্ছিল না। সমস্ত দেহমন থর থর করে কাঁপতে লাগলো। রুপক তার স্বামী। তার প্রেমিক পুরুষ তার ভালোবাসার মানুষ। জীবন যৌবন সব কিছু উৎসর্গ করে সে রূপক কে ভালবেসে ফেলেছে। এই মানুষের ভাগ আর একজনকে দেয়া কোনভাবেই সম্ভব না। কিন্তু জোসনা বেগমকে সে এখন কিভাবে সেটা বোঝাবে। কি বলা উচিত তার? চিত্রার চোখে থেকে টলটল করে জল গড়িয়ে পড়ল।
জোসনা বললেন, কান্নাকাটি কইরো না। আমার পোলায় যে তোমারে তাড়াইয়া দেয় নাই সেটা তোমার সৌভাগ্য। আমরাও তোমার লগে কোন খারাপ কিছু করতাছিনা। আমরা তো বিষয়টা গোপন কইরা রাখতাছি। এতদিন আমার পোলা গোপন কইরা রাখছে। কিন্তু আমি তো জানবার পারছি। আমি তো মা। নিজের পোলার কষ্ট তো আর দেখতে পারিনা। সে তোমারে রাখতেও পারতাছে না আবার ছাড়তেও পারতাছে না। এখন আমার উচিত অরে আরেকটা বিয়া দেওয়া। তাইলে পোলায় আমার এই ঝামেলা থেকে উদ্ধার হইবো। মনের মত কাউকে পাইলে তার মনে শান্তি ফিইরা আসব।
চিত্রার চোখের জল ততক্ষণে টপটপ করে মাটিতে গড়িয়ে পড়ছে। এ কেমন বাস্তবতা? মনের মত কাউকে পেলে তার মনে শান্তি ফিরে আসবে। তবে সে কি তার স্বামীর মনের মত নয় ? সেকি যোগ্য নয় রূপকের? অবশ্য সে কিভাবে যোগ্য হবে। রূপক দেখতে ভালো, ব্যবসা বাণিজ্য করে। তার নামে গ্রামে কেউ কোন খারাপ কথা বলতে পারবে না। অন্যদিকে চিত্রা বিবাহিত, বাবা মা নাই বললেই চলে। অনাথ অসহায় মেয়ে। সে কিভাবে রূপকের যোগ্য হতে পারে? চিত্রা কোন উত্তর দিল না। মাথা নিচু করে কেবল অঝোর ধারায় কাঁদতে লাগল। শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছতে লাগলো চোখ।
রূপকের বাবা বললেন, তুমি পোলার লগে কথা কইছো? সে কি আবার বিয়ে করতে চায়?
জোসনা বললেন, ওর মনের কথা আমি বুঝি। বিয়ের কথা তো আমারে কয় নাই। কিন্তু ছেলে আমার খুব অশান্তিতে আছে। রাইতে ঘুমাইতে পারে না খালি সিগারেট খায়। ছটফট করে। ওর মন শান্ত করার লাইগা আমি ওরে আবার বিয়া দিমু।
রূপকের বাবা আর কিছু বললেন না। তিনি শংকিত মুখে খোলা দরজা দিয়ে বাইরে চেয়ে রইলেন। এরপর আর কোন কথা থাকতে পারে না। নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে চিত্রা। বারান্দার খুঁটি ধরে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তার বুক ফেটে আসা জল চোখ থেকে বেরিয়ে পড়ে। আকাশ-পাতাল সমস্ত কিছু ভেসে যাক সেই জলে।
চলবে..