#ইসরাত_মিতু
#সত্য_ঘটনা_অবলম্বনে
আজ নতুন করে নতুনভাবে শূণ্যবাসর ঘরে সিমার জীবনের অধ্যায় শুরু হতে যাচ্ছে.. সেই সাথে পুরোনো স্মৃতির হাতছানি বার বার সিমার সবকিছু এলোমেলো করে দিচ্ছে, এক একটি মুহুর্ত মরনছোবলের মত মনে হচ্ছে তার, আজকের এই রাত কিভাবে সে পার করবে, নিশ্বাস বন্ধ হয়ে মরে যাবে নাতো! এসব ভাবতে ভাবতে সিমার সবকিছু চোখের সামনে ভেসে উঠলো, জীবনের প্রথম থেকে এখন পর্যন্ত সব কিছু মনে পড়তে লাগলো….
আজ থেকে এগারো বছর আগের কথা,
সিমা ও তাদের পরিবারের সবাই মিলে এক আত্বীয়দের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলো, যেখানে যেতো সেখানেই বিয়ের প্রস্তাব পেত। এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না, সিফাতের ছোটো চাচী ছিলেন সিমার আম্মার দূরসম্পর্কের ফুফাতো বোন, তিনিই সিফাতের পরিবারকে সিমার ব্যাপারে জানিয়েছিলেন।
সিফাতকে অনেক মেয়ে দেখানো হয়েছে কিন্তু পছন্দ হয়নি , সে চায় সুন্দর, লম্বা , ফর্সা একটি বউ! সিফাতের বাবার ভালো অবস্থা, নিজেদের ব্যবসা, ছয় তলা একটি বাড়ি আর এলাকাতেও তিনি সন্মানিত একজন। সিফাত দেশে থাকতে চায়নি বলে ইউরোপে পাড়ি জমিয়েছিলো, সেখানকার নাগরিকত্ব পাবার পর দেশে এসেছে বিয়ে করবে। সিফাত দেখতে লম্বা, সুদর্শন, পাত্র হিসেবে সবাই পছন্দ করার মত।
সিফাতের বাবা আব্দুর রউফ এক কথার মানুষ, রাগী স্বভাবের, পরিবারের সবাই তার কথা মেনে চলে, তিনি যেটা বলেন সেটাই হতে হবে, ছেলে-মেয়েরা তার অনুমতি ছাড়া কিছু করার সাহস রাখে না।
সিফাতের চাচী বাসায় এসে সিমার কথা বললেন আব্দুর রউফ ও সায়রা বানুকে, সিফাতও তখন সেখানেই ছিলো।
— ভাইজান, আমার এক বোনের একটা মেয়ে আছে, খুবই ভালো আর সুন্দরী, ব্যবহার ও খুব ভালো , কিন্তু একটা সমস্যা আছে, সেটা হলো এত তাড়াতাড়ি তারা মেয়ে বিয়ে দিবেনা মনে হচ্ছে! মেয়েটা এখনো এইচ.এস.সি পাশ করেনি, বয়স কম।
— আচ্ছা, তাই নাকি, মেয়েটাকে কি দেখার ব্যবস্থা করা যায়? বিয়ে দিবে কি দিবে না সেটা না হয় তাদের মুখেই শুনে নিবো, আর পরিবারের ও একটু খোঁজ খবর নেয়া হলো, দরকার হয় বিয়ের পরেও মেয়ে তার পড়ালেখা চালিয়ে যাবে, একথা বলেই সিফাতের বাবা সায়রা বানুর দিকে তাকালেন।
সায়রা বানুও একই কথা বললেন।
সিফাতের চাচী কথাবার্তা শেষ করে চলে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তখন সিফাত একটু আড়ালে ডেকে নিয়ে চাচীকে খুব আকুতি করে সিমার সাথে দেখা করানোর ব্যবস্থা করতে বললো, সে একাই আগে দেখতে চায়, দূর থেকে হলেও দেখবে। চাচী তাতে রাজী হলো।
দুদিন পর সিফাত সিমাকে দেখতে পেলো, বিকেল বেলা সিমা ও তার বোন রাস্তায় হাঁটতে বের হয়, সেভাবেই দেখা। কি সুন্দর একটা মেয়ে, মনে হচ্ছে যেনো কোনো ডানা কাটা পরী স্বর্গ থেকে নেমে এসেছে ধরনীতে! সিফাত অনেকক্ষন দাড়িয়ে ছিলো আর ভাবছিলো, এই মেয়েকেই সে বিয়ে করবে, যেভাবেই হোক।
সিফাত তার চাচীকে গিয়ে নিজের আবেগের কথা খুলে বললো, আর ওর বাবা-মাকে যেনো দেখানোর ব্যবস্থা করে খুব শীঘ্রই তাই বললো!
সিমাদের বাড়িতে খবর পাঠানো হলো, তাদের বাড়িতে ছেলেপক্ষ আসবে সিমাকে দেখতে, ফোনে কথা হলো এসব নিয়ে। সিমার আব্বা-আম্মা কিছুতেই রাজী না, তারা এখন মেয়ে বিয়ে দিবেনা। সিফাতের চাচী খুব আকুতি করে বললো..
— বুবু কথাটা শোনো, ছেলেপক্ষকে আমি কথা দিয়েছি, এখন যদি মানা করি খুব খারাপ দেখাবে, আর এটা তো আমার ভাসুরের পরিবার, মেহমান হিসেবেই না হয় আসুক তোমার বাড়িতে! ছেলেটা শিক্ষিত, দেখতে শুনতেও দারুন আর ব্যবহার খুবই ভালো, ওদের পরিবারের সবাই খুব মিশুক, একটু দেখলে ক্ষতি কী, বিয়ে তো হয়ে যাচ্ছে না!
— আচ্ছা, এত করে যেহেতু বলছিস তাহলে নিয়ে আয় ওদের কিন্তু সিমাকে এখন বিয়ে দিবোনা আগেই বলে রাখলাম, এই কথা বলে ফোনটা রেখে দিলো সিমার আম্মা।
সিফাতের পরিবারের সবাই এলো সিমাদের বাড়িতে, সবার সাথে সবার কথা হলো, আপ্যায়নে কোনো ত্রুটি ছিলো না বিন্দুমাত্র , সিমাকে দেখে তাদের খুব পছন্দ হলো, কিন্তু বিয়ের কথাটা বলার সুযোগ পাচ্ছিলো না কেউ। আব্দুর রউফ সাহেব হঠাৎ করে সিমার বাবার হাত ধরে বলে উঠলো..
— আপনার মেয়েকে আমি আমার মেয়ে বানাতে চাই, শুধু ঘরের পরিবর্তন হবে আর সব একই থাকবে, আপনি আমাকে নিরাশ করবেন না, অনুরোধ রইলো।
সিমার আব্বা আজাদ সাহেব কি বলবে ভেবে পাচ্ছিলেন না, আল্লাহ্ যদি তৌফিকে রাখে তবে হবে.. একথা বলে হাত ছাড়িয়ে নিলেন।
সন্ধ্যা বেলা সবাই চলে গেলো মেহমানরা, সিমার আব্বা-আম্মারও ছেলেপক্ষকে খুব পছন্দ হয়েছে, কী করবে দুজনে বসে ভাবতে লাগলো!
দুদিন পর পর কেউ না কেউ ফোন দিয়ে প্রস্তাবে রাজী হতে বলে, ছেলেপক্ষও ফোন করে, আসতে চায়। অবশেষে সবার মতামতে সিফাতের সাথে সিমার বিয়ের তারিখ ঠিক হলো।
সিমাদের বাসায় বিয়ের আয়োজন হলো, বিয়ের পরেও সিমা ওদের বাসাতেই থাকবে এইচ.এস.সি দেয়া পর্যন্ত, এমনটাই কথা হলো!
সিমাকে বউ সাজানো হলো, সিফাতদের বাড়ি থেকে লোকজন আসলো বরপক্ষ হিসেবে, সিফাত বর সেজে বসে আছে, তার চোখে-মুখে আনন্দের ছাপ, সে তার পছন্দের মানুষটাকে আপন করে পেতে যাচ্ছে। বিয়ে পড়ানো হলো, আর যা যা রীতি – রেওয়াজ আছে সব শেষ হলো!
সিমা বসে আছে বাসর ঘরে, সিফাত কে নিয়ে দিয়ে আসলো কয়েকজন।সিমার শরীরে কেমন যেনো একটা অনুভূতি কাজ করছে, সে আগে এমনটা কখনো অনুভব করেনি, শক্ত হয়ে বসে আছে, যেনো এখনি বুক চিড়ে হৃদয়টা বের হয়ে যাবে।
সিফাত গিয়ে সিমার পাশে বসলো, সিমা মাথা নিচু করে বসে আছে, সিফাত দু হাত দিয়ে মুখখানি উপরে তুলে বললো_
—আজ থেকে তুমি আমার হৃদয়ের রাণী, আমার ভালোবাসা, আমার কাছে তুমি পৃথিবীর সবচেয়ে দামী! আমি তোমার মনে একটু আশ্রয় চাই, তুমি কি দিবে?
—সিমার মুখে কোনো কথা নেই, চুপ করে শুনছে, জীবনে এই প্রথম কোনো ছেলের সাথে সে একা একটি রুমে, এমন স্পর্শ তাকে বিমোহিত করে তুলছে!
সিফাত একটা সোনার নেকলেস বের করে সিমাকে পড়িয়ে দিয়ে বললো, আজকে রাত আমরা গল্প করে কাটাবো, সিমা আচ্ছা বললো, সিফাত সিমাকে বুকে টেনে নিয়ে বললো— তুমি আমার বুকে থেকে গল্প শুনবে? সিমা লজ্জায় সিফাতের বুকে মাথা লুকালো! সারারাত ওরা গল্প করে কাটালো, সিমা কখন যে সিফাতকে গভীরভাবে ভালোবেসে ফেললো তা তার নিজেরই অজানা!
এভাবেই চলতে লাগলো বেশকিছু দিন, সব কিছুতেই ভালোলাগা আর ভালোবাসা। শশুড়বাড়ির সবাই খুব খুশি, মাঝে মাঝেই এসে দেখ যায় সিমাকে, সিমাও তাদের যত্নে ভরে রাখে! প্রতিদিন যেনো ওদের মধ্যে ভালোবাসা বেড়েই চলছে, সিফাত যখন চলে যায় ওদের বাড়িতে তখন সিমার কান্না আর থামে না ঠিক তেমনি সিফাতও ওদের বাড়িতে সকালে গিয়ে রাতেই চলে আসে!
এইচ.এস.সি পরীক্ষা শেষ হলো, সিমাকে আয়োজন করে শশুড় বাড়িতে পাঠানো হলো, কিছুদিন পর সিফাতের ইউরোপ যাওয়ার সময় হলো, কিছু কাগজপত্র ঠিক করে সিমাকে এসে নিয়ে যাবে ওখানে। সিফাত চলে গেলো, অনেক কষ্টে সিমা নিজেকে সামলালো, প্রতিদিন কয়েকবার করে সিফাতের সাথে ফোনে কথা হয় সিমার তবুও যেনো কথা শেষ হয় না! সিমার ভালো ব্যবহারে সিফাতের পরিবারের সবাই খুব খুশি, মাঝে মাঝে সিমা ওর আব্বা-আম্মার কাছে এসে থেকে যায়। এভাবেই চলতে থাকলো সময়! পরীক্ষার রেজাল্ট বের হলো, যেহেতু সিমা দেশের বাহিরে চলে যাবে তাই সে আর কোনো ভার্সিটিতে ভর্তি হলোনা।
সিফাত সব ঠিক করে সাত-আট মাস পরে চলে আসলো দেশে, কিছুদিন থেকে সিমাকে নিয়ে যাবার সব প্রস্তুতি শেষ করলো, বাড়ির বড় ছেলে সিফাতকে সবাই অনেক ভালোবাসে, আর সিমাকেও, তাই সবার মন খারাপ হলো ওদেরকে বিদায় দিতে।
সিমারও খারাপ লাগছে সবাইকে ছেড়ে যেতে আর মনে মনে ভালোও লাগছে, এখন থেকে সে তার ভালোবাসার মানুষের সাথে থাকবে। সিমার আব্বা- আম্মার সাথে দেখা করে বিদায় নিয়ে আসলো ওরা, পরের দিন পাড়ি জমালো ইটালীতে।
নানা রকম স্বপ্ন আর ভালোবাসার মিশ্রণে ওদের জীবন শুরু হলো ওখানে, প্রতিদিন যেনো এক একটি স্বপ্নের দিন, বাড়িতে ফোনে কথা হয় নিয়মিত, মাঝে মাঝে সুযোগ পেলে কিছু না কিছু উপহার পাঠিয়ে দেয় বাড়ির সবার জন্য, এমন ভাবেই চলতে থাকলো। আরো বছর খানেক পর দুজনে মিলে সিদ্ধান্ত নিলো সন্তান নিবে, সিফাতের বাবা- মা ও চাচ্ছে ওদের ঘরে সন্তান আসুক।
চলবে….