#ইসরাত_মিতু
#সত্য_ঘটনা_অবলম্বনে
সিমার আনন্দে সব কিছু মুখরিত হয়ে উঠলো, সিফাতকে ফোন দেওয়ার জন্য পাগল হয়ে গেলো, আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জ্ঞাপন করলো হাজার বার। সিমার আম্মা বাসায় গিয়ে সামনা-সামনি সুখবরটা দিতে বললো, কিন্তু সিমার কিছুতেই না জানিয়ে থাকতে পারলো না।
সিফাতকে ফোন দিয়ে…
— হ্যালো, সিমা বলো, কি খবর শান্তা( সিমার ছোটো বোন) ভালো আছে?
— হ্যাঁ ভালো , তোমাকে আজকে আমি একটা খবর শুনাবো যা শুনে তুমি থমকে যাবে! ( খুশিতে কথা আটকে যাচ্ছে সিমার)
— কি হয়েছে?
— তুমি বাবা হতে যাচ্ছো, আর আমি মা! আমি প্রেগন্যান্ট, আল্লাহ্ আমাদের ঘরে সন্তান দিয়েছে, আমি মা হবো!
— কি বলছো, আমার সাথে মজা করছো?
— নাহ্, সত্যি বলছি তোমাকে, আল্লাহ্ সাক্ষী আমি একটুও মজা করছি না!
— আল্লাহর কাছে অনেক শুকরিয়া, আমার জীবনে এটা অনেক খুশির খবর, আমি এখনি বাবা-মা’কে জানাচ্ছি, আর আমি সকালেই আসছি তোমার এখানে!
সিফাত তার বাবা-মা’কে সুখবরটা দিলো, তারা শুনে খুশির ভান করলেও মনে মনে খুশি হলো না! খুব চিন্তায় পড়ে গেলো,এখন এই পরিবারে একটা ঝামেলার সৃষ্টি হবে, আর সেটা নিয়ে তাদের মাথাব্যথা।
সালমাকেও সুখবর টা দেয়া হলো, কিন্ত সে এটা শুনে খুবই উল্টাপাল্টা কথা বলা শুরু করে দিলো! কান্নাকাটি করে শাশুড়ির সাথে অনেক কিছু বললো—
—আমার এখন কী হবে? আপনাদের ছেলে আমাকে এখন আর তেমনভাবে দেখবে না, আমাকে তো সন্তানের আশায় বিয়ে করেছিলো, এখনতো বড়জনের ঘরেই সন্তান আসবে, আমাকে তো দুইদিন পর ঘর থেকে বের করে দিবে!
— আহা, চুপ করতো, এসব কী মানুষের হাতে? কিছুই হবে না, তোমার শরীর খারাপ , রুমে গিয়ে রেষ্ট নাও!
সায়রা বানুর কথা শুনে সালমা রুমে গেলো ঠিকই কিন্তু জোড়ে জোড়ে কান্না করে ওর মায়ের সাথে অনেক কিছু বললো!
সালমার মা আব্দুর রউফ সাহেব কে ফোন দিলেন সাথে সাথে—
— আপনারা কী কথা দিয়েছিলেন আপনাদের মনে আছে? এখন এমন হলো কেনো, বলেছিলেন আপনাদের বউ বন্ধ্যা, কখনো বাচ্চা হবে না, এখন কিভাবে বাচ্চা হবে, আমার মেয়েটার জীবন নষ্ট করে দিলেন, আমার মেয়ের এখন কী হবে, আমার মেয়ের তো এখন কোনো দামই থাকবে না আপনাদের কাছে! আমার মেয়ের যদি কিছু হয় তাহলে ভালো হবে না!
— আচ্ছা, একটু থামেন তো, আপনাদের এত চিন্তা করতে হবে না, সালমার কোনো অযত্ন হবে না, আমরা তো আছি! এই বলে সিফাতের বাবা ফোন রেখে দিলেন!
সকাল বেলা সিফাত হসপিটালে চলে গেলো, সিমা আবেগে আপ্লুত হয়ে সিফাতকে জড়িয়ে ধরে চোখের জলে বুক ভাসালো।
সেখানেই সিমাকে ডাক্তার দেখানো হলো, আলট্রাসনোগ্রাফি করা হলো, ১১ সপ্তাহ চলছে সিমার গর্ভকাল সময়! ডাক্তার সিমাকে ফুল বেড রেস্ট এ থাকতে বললো, যেহেতু অনেক বছর পরে সে মা হতে যাচ্ছে আর স্বাস্থ্যটাও একটু বেশি তাই খুব সাবধানে থাকতে বললো, সাথে কিছু মেডিসিনও দিয়ে দিলো!
বিকেল বেলা সিফাত সিমাকে নিয়ে বাসায় চলে এলো, আর সিমার আম্মা ও বোন রিলিজ নিয়ে তাদের বাসায় চলে গেলো।
সিমা বাসায় এসে শশুড়-শাশুড়ির সাথে দেখা করলো, নিজের খুশির কথা তাদের বললো, তারপর সালমার কাছে গেলো বলতে কিন্তু সালমা কোনো কিছুই বললো না, চুপ করে রইলো!
সিফাতের সাথে সালমার অনেক ঝগড়া হলো, নিজে একটু অসুন্দরী বলে সিমাকে নিয়ে এমনিতেই অনেক কথা শোনায় আর এখনতো সন্তান হবে শোনে অনেক বেশি কথা শোনালো, কেন হসপিটালে গেলো আর সন্তান হবে শোনে এত খুশি হওয়ার কি আছে? এখনতো বড় বউ ছাড়া কিছুই বুঝবেনা সে!
এমন করো নাতো, অনেক বছর পর সিমা মা হতে যাচ্ছে আর সন্তানটা তো আমারই, এখানে খুশি না হবার কী আছে, সিফাত সালমাকে আরো কিছু কথা শুনিয়ে ব্যবসার কাজে চলে গেলো!
সিমা নিজের রুমে রেস্ট নিতে গেলো, ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চলতে থাকলো আর এখানেই বাধলো বিপত্তি! সিমার এমনভাবে শুয়ে-বসে থাকা কারো চোখেই ভালো লাগলো না!
শাশুড়ি সারাদিন ঘ্যান ঘ্যান করতে থাকলো, সালমাও কিছু করতে চায় না, আর তারাও চায় না সালমা কিছু করুক।
তাদের একই কথা, সালমা তো ছোটো , ও বুঝে কম, ওর এখন অনেক বিশ্রামের দরকার, আর তুমি তো বড়, অনেক কিছুই বুঝো, তোমার তো বেশিদিন হয় ও নাই , পেট এখনো ছোটো, চলাফেরা করতে কী এত সমস্যা?
এসব কথা শুনেও সিমা চুপ থাকে আর নিজের সন্তানের কথা ভেবে সাবধানে থাকার চেষ্টা করে! এভাবে কিছুদিন কেটে যাবার পর একদিন সিফাতের বাবা সিমাকে ডেকে বললেন —
— এভাবে কী সংসার চলে নাকি? তুমি যা শুরু করেছো তাতে তো মনে হচ্ছে তুমি একাই মা হচ্ছো, আর কেউ কখনো হয় নাই! সারাদিন শুয়ে থাকো, সংসারের কাজ কী শুধু তোমার শাশুড়ি একা করবে? সেও তো মা হয়েছে, বাচ্চা পেটে নিয়ে সংসারের সব কাজ করেছে, কখনো আমার মা’য়ের উপর কিছু চাপিয়ে দেয়নি! এ সংসারে থাকতে হলে কাজ করেই থাকতে হবে, মনে রেখো তোমাদের সবার খাওয়া থেকে শুরু করে পরার জামাটাও আমার টাকায় কেনা! আমার ব্যবসা থেকেই এই সংসারে পয়সা আসে!
সিমা এসব শুনে গেলো একমনে, খুব জিদ কাজ করলো ওর মনে, ঠিক আছে কাজেরই যেহেতু দাম এখানে মানুষের খুশি , চাওয়া-পাওয়ার কোনো দাম নেই তাহলে কাজই করবো।
সিমা আবার আগের মত কাজ করা শুরু করে দিলো, ঘরের কাজ , রান্নার কাজ নিজের হাতে করা শুরু করলো, এমনকি ঘর মোছাও নিজ হাতে করা শুরু করলো, একটিবার সিমার শাশুড়ি সিমাকে কোনো কিছুতেই নিষেধ করলো না, আর সিফাতও বিষয় টা নিয়ে তেমন গুরুত্ব দিলো না।
নিজের শেষ ক্ষতিটা সিমা নিজেই করলো, একদিন হঠাৎ করে সিমার খুব পেট ব্যথা শুরু হলো সাথে হাল্কা ব্লিডিং ও শুরু হলো , সিফাত সিমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে ডাক্তার কিছু মেডিসিন দিয়ে একদম বেড রেস্টে থাকতে বললো।
কিন্তু রাতের বেলা সিমার প্রচন্ড পেট ব্যথা হতে থাকে সাথে ব্লিডিং ও বেড়ে যায়, সিমা খুব কষ্ট পায়, আর কষ্টের চেয়ে বেশি আতংঙ্ক কাজ করে মনে, আল্লাহকে ডাকতে থাকে, চোখের জল যেনো আর থামছেই না ওর!
সিফাত আবারো রাতেই সিমাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেলো, ডাক্তার সব কিছু পরীক্ষা করে জানালেন বাচ্চাটা আর নেই, কিছু অবশিষ্ট আছে তাই ডিএনসি করাতে হবে! সিমার দু’চোখে আধার নেমে এলো, কান্নারত অবস্থায় নিজেকে দায়ী করলো বার বার! পুরো শরীরটা অবশ হয়ে গেলো ওর, কাঁচের টুকরোর মত মনটা ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গেলো, এ যে কেমন ব্যথা তা শুধু সিমা-ই অনুভব করলো!
দুঃখ যার সাথী তার তো দুঃখের সাথেই বসবাস করতে হবে, এ জীবনে হয়তো সুখের দেখা তার আর কপালে নেই।
সিফাতেরও খুব মন খারাপ হলো, ও বাসায় ফোন করে জানালো সব কিছু। রাতের মধ্যেই ডিএনসি করা হলো , সিমার শাশুড়ি আর ননদ ইরা আসলো হসপিটালে সিমাকে দেখতে, সিমা তাদেরকে দেখে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো, দু’জনেই তাকে স্বান্তনা দিলো!
এখানে আমি থাকি, তুই বাসায় যা, সালমাও একা বাসায়, সিফাতের মা সিফাতকে বাসায় চলে যেতে বললো।
না মা , সিফাত থাকুক আমার সাথে , আপনি চলে যান বাসায়, সিমা সিফাতকে বাসায় যেতে নিষেধ করলো, সিফাতও তাই বললো!
সালমা বার বার ফোন দিতে থাকলো সিফাতকে বাসায় যাবার জন্য, তারপরও সিফাত রয়ে গেলো।
পরের দিন সিফাত বিল পরিশোধ করতে গিয়েছে আর রুমে সিমা একা, ডাক্তার সিমাকে দেখতে এসেছে, ডাক্তারকে দেখে সিমা কিছু প্রশ্ন করলো-
— ম্যাডাম, আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?
— হ্যাঁ, সিমা বলুন।
— আপনার একটি কথাতে আমার সংসার দু’ভাগ হয়ে গিয়েছে, আমার হাজবেন্ড দ্বিতীয় বিয়ে করেছে!
— কী বলছেন এসব, আমি কী এমন বলেছি?
— আপনার কাছে যখন লাস্ট বার আমার হাজবেন্ড আমার রিপোর্ট দেখাতে আসে তখন আপনি বলেছিলেন, “ আমি আর কখনোই মা হতে পারবোনা!” কিন্ত দেখেন আমি কিন্তু মা হয়েছি, হয়তো কোলে নিতে পারিনি, আমি কিন্তু বন্ধ্যা নই!
— আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে সিমা, আপনার হাজবেন্ড আমার কাছে রিপোর্ট নিয়ে এসেছে বলে আমার মনে পড়ছে না, আর আপনি আমার এখানে অনেক ট্রিটমেন্ট করিয়েছেন টেস্ট টিউব বেবীর জন্য তাই আপনাদের দু’জনকেই আমি খুব ভালোভাবে চিনতে পেরেছি। আর আমি তো চিন্তিত এই ভেবে আপনারা আর আসলেন না কেনো? আজকের এই যে দুর্ঘটনা সেটা থেকে হয়তো নিরাপদেও থাকতে পারতেন। সবই আল্লাহর ইচ্ছে কিন্তু তিনি তো আমাদের বিবেক-বুদ্ধি দিয়েছেন ভালোমত চলার জন্য!
সিমার আর বুঝতে বাকি রইলো না যে সিফাত ওকে মিথ্যে বলেছিলো তখন, শুধুমাত্র আরেকটা বিয়ে করার জন্য এত বড় মিথ্যা? বুকের মধ্যে চিনচিন ব্যথা শুরু হলো সিমার, এত কষ্ট সে কিভাবে সহ্য করবে, কিভাবে নিজেকে সামলাবে, বাচ্চা হারানোর কষ্টের সাথে সিফাতের প্রতারনার কষ্ট এক সাথে মিশ্রিত হয়ে মানষিক যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগলো সিমা!
চলবে…