#ইসরাত_মিতু
#সত্য_ঘটনা_অবলম্বনে
“ তারপর ফেরে, তবু ফেরে, কেউ তো ফেরেই,
আর জীবনের পক্ষে দাঁড়ায়,
ভালোবাসা যাকে খায়, এইভাবে সবটুকু খায় ”
ভালোবাসা আসলেই যাকে খায়, এইভাবে সবটুকুই খায়, কবি হেলাল হাফিজ মিথ্যে কিছু বলেননি!
সিমার সিফাতের প্রতি অন্ধ ভালোবাসাই জীবনের শেষ সম্বলটুকুও কেড়ে নিয়েছে, সিমা মনে মনে মরতে চেয়েছে বহুবার।
যেখানে দুঃখের বৃক্ষরোপন করা সেখানে শুধু ডালপালা ছেঁটে কী হবে!
সিমার মন তবুও আশার আলো নিয়ে বাচঁতে চায়, সবকিছু হারানোর পরও নিজেকে আবিষ্কার করতে চায়, কিন্তু যে জীবন অবহেলায় পরিপূর্ণ সেখানে মাটির প্রদিপ জ্বালানোটাও বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়!
অতি কষ্ট নিয়ে পরের দিন বাসায় ফিরে সিমা সিফাতের সাথে, সালমা হয়তো মনে মনে খুশিই হয়েছিলো এখন তার আর কোনো চিন্তা নেই!
সিমার আম্মাকে সিমা সবকিছু জানালো ফোনে আর কাঁদলো , এ কান্না আর কারো কলিজা ভেদ করে ভিতরে ক্ষত তৈরী করে না! সিমাকে ওদের বাসায় যাবার জন্য বললেও ও যায়নি!
সিমার আব্বা-আম্মা তাদের কাছে যেতে বলে ঠিকই কিন্তু কখনো বলেনি-তুই একবারে সিফাতকে ছেড়ে চলে আয়! শান্তার এখন বিয়ের বয়স হয়েছে, মাঝে মধ্যে ছেলেপক্ষও আসে , হয়তো বড় বোনের এমন একটি ঘটনা জেনে ছোটো বোনের সৌভাগ্যে কিছুটা ভাঁটা পড়বে বলেই এমনটা বলেনা!
সিফাতদের সংসারে সিমা আগের মতই অবহেলিত, সিফাত আর সালমার ঘরে ছেলে সন্তান হয়েছে, সিমার কাছে সালমা ওর ছেলেকে আসতে দেয় না, এখন সালমার দাপটে সংসার চলে, সিফাতকে সিমার রুমে দেখলেই ঝগড়া শুরু করে দেয় সালমা, সালমার সাথে ভালো থাকতে গিয়ে সিফাতও সিমার সাথে ঠিকমত কথা বলে না।আস্তে আস্তে সিফাতের সাথে সিমার দূরত্ব আরো বেড়েই চলে!
সিমার শশুড়ের ক্যান্সার ধরা পড়লো, চিকিৎসার জন্য তাকে সিংগাপুর নিয়ে যাওয়া হচ্ছে , তিনি সিমাকে ডেকে বললেন- আমি তোমার জন্য দোয়া করে যাচ্ছি , তুমি যেখানেই থাকো না কেন আল্লাহ্ তোমাকে ঠিকই সুখে রাখবেন! যদিও তিনি ক’দিন পরেই মারা গিয়েছেন!
হয়তো সিমার প্রতি যে অন্যায় তারা করেছে সেই চিন্তা থেকেই হয়তো তিনি কথাগুলো বলেছিলেন!
এরপর একদিন,
সুন্দরী বউ ছাড়া তোমার চলে না, তাই না? আমি তো সুন্দর না তাই আমার কথাও তোমার ভালো লাগে না- এভাবেই কথা বলছিলো একদিন সালমা সিফাতের সাথে!
কী যে বলো! তুমি তো আমার কলিজা ঠান্ডা করেছো সন্তান উপহার দিয়ে, সিমা কী পেরেছে এত বছরে আমার কলিজা ঠান্ডা করতে? পারেনি, ওর রূপ ধুঁয়ে কী আমি পানি খাবো! ঐসব রূপ দিয়ে জীবন চলে না- সিফাত বিনা সংকোচে কথাগুলো বলতে লাগলো।
সবগুলো কথা সিমা খুব পরিষ্কার ভাবে শুনলো! নিজেকে শক্ত করলো, আর নাহ্, এবার আমাকে এই মোহজাল থেকে বেরিয়ে যেতেই হবে!
সিমার বোনেরও বিয়ে হয়ে গিয়েছে, এখন ওর নিজের বাড়িতে যেতে সমস্যা নেই, সিমার আব্বাও মেয়ের কষ্ট সহ্য করতে পারছে না, তাই তিনিও তাই চাচ্ছেন!
সিমা তার জিনিসপত্র সব গুছিয়ে নিলো, সায়রা বানুকে বললো—
— মা আমি চলে যাচ্ছি সারাজীবনের জন্য! আর হয়তো আপনাদের সাথে দেখা হবে না!
— কি বলো, কেনো যাবে? কি হলো আবার তোমাদের মধ্যে?
— না মা, নতুন করে কিছু আর হবার নেই , তাই তো চলে যাচ্ছি!
— আচ্ছা, যাবেই যদি যাও, তবে এই সিদ্ধান্তটা তোমার আরোও আগে নেয়া উচিত ছিলো!
—সিমার ঠোঁটে বিদ্রুপ বাঁকা হাসি, তাই বুঝি, আসলে আপনাদের মত আর হতে পারলাম কই! সিমা সায়রা বানুর রুম থেকে বের হয়ে গেলো।
সিফাত আমি তোমাকে আর তোমার সংসারকে ছেড়ে সারাজীবনের জন্য চলে যাচ্ছি, দোয়া করো যাতে এই মুখ তোমাদের আর না দেখাতে হয়।
—তুমি আর কোথায় যাবে, ঠিকই ফিরে আসবে আমার এখানে, তোমার তো আসতেই হবে, জিদ লাগছে চলে যাচ্ছো আবার জিদ শেষ হলে ফিরে আসবে, তোমার আর যাওয়ার জায়গা কোথায়! সিফাত ব্যঙ্গ করে কথাগুলো সিমাকে বললো!
—সিমার শরীরে জ্বালা করে উঠলো! আমার জায়গা নেই যাওয়ার? আর কে বললো তোমার এখানে ফিরে আসবো!? আমার বাবার বাড়ির দরজা আমার জন্য সারাজীবন খোলা আছে, ভাগ্যে থাকলে পৃথিবীতে ভালো রাখার মত মানুষও খুঁজে পাওয়া যাবে, কোনোদিন তোমার এখানে আসার প্রয়োজন হবে না, আমি কখনোই আসবো না!
— তোমাকে কে আর নিবে, কয়দিন মজা করে ছেড়ে দিবে!
কথাটি শুনে সিমার ঘৃনা হতে লাগলো সিফাতকে দেখে, ভেবেছিলাম তোমাকে ক্ষমা করে দিবো, কিন্তু তুমি তো ক্ষমারও অযোগ্য, সিমা নিজের ব্যাগ টা নিয়ে সোজা বের হয়ে গেলো, সিফাতের সব কিছুই ও বাড়িতেই রেখে আসলো!
সিফাত সিমাকে বিদায় পর্যন্ত দিতে নামলো না নিচে, সালমা আনন্দে মনে মনে হাসতে লাগলো, এতদিনে তার মনের আশা পূর্ণ হয়েছে!
সিমা চলে আসার পর একদিনও সিফাত ফোন দেয়নি, কোনে খোঁজ ও রাখেনি, ছয়মাস কেটে গেলো, সবাই সিমাকে বিয়ে করার কথা বলছে, তবুও সিমা কোনোভাবে হয়তো ভুল করে ভাবে সিফাত হয়তো আসবে, ক্ষমা চাইবে, ওকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে! এভাবে আরো কিছু মাস কেটে যায়, এবার সিফাতের কাছে সিমার মামা ফোন দিয়ে সিমাকে ডিভোর্স পেপার পাঠাতে বলে, সিফাত তাতে রাজী হয়না, যার দরকার তাকে ডিভোর্স পেপার পাঠাতে বলেন। আমি পারবোনা!
তাহলে কী তুমি সিমাকে ফিরিয়ে নিতে চাও? মামার কথায় সিফাত বলে, আমি কেন ওকে ফিরিয়ে নিবো, ও গিয়েছে ওর ইচ্ছে হলে নিজেই আসবে!
একথা শুনে সিমার মামা বললো আমরা সিমাকে বিয়ে দিবো, খুব শীঘ্রই ডিভোর্স পেপার পেয়ে যাবে!
সিমাও মনে মনে অটল আর নয়, এখন নিজেকে ভালো রাখার সময় এসেছে, খুব তাড়াতাড়ি ডিভোর্স পেপারে সাইন করে পাঠিয়ে দিলো সিফাতের ঠিকানায়, সিমার মনে হলো এককালের ঘটে যাওয়া কোনো যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে নিজেকে বিজয়ের মুকুটে ফিরে পেয়েছে! নিজের জীবনের এতগুলো বছর নষ্ট করার জন্য খুব অনুতপ্ত হলো!
মাঝে মাঝেই বিয়ের সম্মন্ধ আসে তবে কোনটাই সিমা ও তার পরিবারের মন মত হয় না! ওরা মানা করে দেয়!
বেশ কিছুদিন পর সিমার মামী এক পাত্রের খোঁজ দিলো, সিমাকে ফোন নাম্বার দিলো কথা বলতে, সিমার ফোন নাম্বারও সেই পাত্রের কাছে ছিলো!
শাহেদ সাহেব এক ছেলে ও এক মেয়ের বাবা, মধ্য বয়স্ক, তার স্ত্রী তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে! ছেলের বয়স যখন ছয় আর মেয়ের বয়স দুই তখন সে অন্য ছেলের সাথে পরক্রিয়ায় আসক্ত হয়ে সংসার ত্যাগ করে, আর কখনো আসেনি, কারন সে এখন অন্য পুরুষের ঘর করছে! শুধুমাত্র সন্তানদের কথা চিন্তা করে শাহেদ সাহেব আবার বিয়ে করতে যাচ্ছে, বাসায় কেউ নেই তার সন্তানদের দেখার মত!
পৃথিবীতে কত রকম অদ্ভুত মানুষ দেখা যায়, নিজের সন্তানদের ছেড়ে যখন কোনো মা অন্য জায়গায় সুখ খোঁজে তখন সিফাতদের মত মানুষদের খুব বেশি দোষ দেখিনা! কারণ পাপীরা পাপ করবে এটাই স্বাভাবিক , হোক সে মায়ের জাত আর পুরুষ জাত, ভুক্তভোগী কিন্তু সেই স্বার্থহীন মানুষগুলোই হয়!
সিমার সাথে শাহেদ সাহেবের অনেক কথা হয়, দু’জন দুজনার অতীত জীবন নিয়ে কথা বলে, সিমার বাচ্চা দুটোর প্রতি খুব মায়া হলো, এত কিছু জীবনে ঘটে গেলো শুধু সন্তান হয়নি বলে আর এই মা এত বড় নিয়ামতকে পা দিয়ে ঠেলে ফেলে গেলো! খুবই আফসোস সিমার, আর মনে মনে ভাবলো- আমিই ওদের মা হবো!
এক সময় দু’পরিবারের সম্মতিতে সিমা আর শাহেদের বিয়ে সম্পন্ন হলো!
সিমার আজ নতুন পথের যাত্রা শুরু হলো, সিমা আজ নিজের ঘর পেয়েছে , সাথে দু’জন সন্তান, শাহেদের কোনো চাওয়া নেই সিমার কাছে শুধু একটা চাওয়া ছাড়া..
— তুমি আমার সন্তানদের অনেক ভালো মা হবে, আমাদের ঘরে যদি কোনো সন্তান আসে তুমি তারও অনেক ভালো মা হবে! আর আমি কথা দিচ্ছি, তোমার কাছে আমি অনেক ভালো স্বামী হবো , শাহেদ চোখের পানি ছেড়ে দিলো!
ছেলে-মেয়ে দুটো সিমাকে “মা” বলে ডাকে! সিমা এখন অনেক ব্যস্ত, স্বামী , সংসার আর সন্তানদের নিয়ে! যতবার ওরা “মা” ডাকে সিমা ততবার ওদের বুকে আগলে রাখে! ওদের ভালোবাসায় কোনো মিথ্যে নেই , ছলনা নেই যা আছে সবটুকুই প্রাণ!
আর সিমা এখন খুব বেশি “মা” হয়ে উঠেছে, সিমার সীমানা এখন পুরো পৃথিবী জুড়ে, যার অস্তিত্ব এখন সীমাহীন বিস্তৃত!
#নিজের_কিছু_কথা:
(আসলে আমি কবিতা প্রেমী, কবিতা লিখতে ভালোবাসি, পড়তেও ভালোবাসি, একটা কবিতার বইও প্রকাশিত হয়েছে আমার ২০১৯ একুশে বইমেলায়, এরপর তো করোনা আতংঙ্ক, গল্পও পড়ি কিন্তু লিখার অভ্যাসটা খুবই কম! কিভাবে যেনো ভাবনার মধ্যে অনেক দিন আগে থেকেই এই গল্পটা ঘুরপাক খাচ্ছিলো আর লিখা শুর করে দিলাম, আপনাদের এত রেসপন্স দেখে বাকিটা লিখার সাহস পেলাম, আপনাদের সকলের দোয়ায় আমি গল্পটি শেষ করতে পেরে ধন্য, যদিও শেষ পর্বটা আরোও দীর্ঘ হতে পারতো কিন্তু আমার শারিরীক অবস্থার জন্য তা সম্ভব হয়নি! যে কয়েকদিন ধরে গল্পটি লিখেছি সেই কয়দিন আমি খুব মানষিক যন্ত্রনায় ছিলাম, মনে হচ্ছিলো সব কিছু আমার চোখের সামনে ঘটছে অথচ আমি কিছুই করতে পারছি না, খুবই পেইনফুল ছিলো, রাতে ঘুমাতেও পারিনি!
আজ আমাকে বিকেল বেলা হসপিটালে এডমিড হতে হবে, আগামীকাল আমার ডেলিভারী ডেট! আমি ইনশাআল্লাহ্ আমার সন্তানকে কোলে নিবো! আপনারা আমার জন্য দোয়া করবেন! শুধুমাত্র আপনাদের জন্য কষ্ট করে হলেও আমার গল্পটা শেষ করতে হলো! যদিও আমার হাজবেন্ড আমাকে এসময় রাত জেগে লিখতে দেখে অনেক সময় রাগ করেছে, কিন্তু ভালোবাসায় তো সব কিছুই পসিবল!
আপনাদের কিছু জানার থাকলে সেটা পরে বলতে হবে, এখন আপনাদের শুধু দোয়া চাই! ভালো থাকবেন সবাই,
আল্লাহ্ যেনো আমাকে ও আপনাদের সহিহ্ সালামতে রাখে! )
#সিমা_প্রসঙ্গ:
(সিমাকে ( ছদ্মনাম) কে যখনই ফোন দেই তখনি সে তার সন্তানদের নিয়ে ব্যস্ত থাকে, আর সিমার স্বামী ব্যবসা আর বাসা, বউ , বাচ্চা নিয়ে ব্যস্ত!
সিমা জানে সে অনেক ভুল করেছে, অনেক বোকামিও করেছে, কিন্তু ওর সততা ওকে এখন ভালো রেখেছে, সন্তান দিয়েছে দুইজন!
হ্যাঁ , ও ওর প্রাক্তন স্বামীকে এখনো সেভাবে মন থেকে ভুলতে পারেনি, আর তার একটাই কারন ওর ভালোবাসায় কোনো ছলনা ছিলো না, এতগুলো বছর একসাথে থেকেছে, কত স্মৃতি আছে মনে পড়ার মত, মানুষতো একটা কুকুরকেও মনে রাখে!
সিমাও এই গল্পটা পড়ছে, কারন সেও এখানে Kobitor.com গ্রুপ এর একজন সদস্য! জানি, সে এই গল্প পড়ে কষ্ট পেয়েছে, অতীতের কথা মনে করে কান্নাও করেছে, তবুও আমার মনে হয় তার মনটা এখন হাল্কা হয়েছে হয়তো অতীতকে চিরতরে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে নতুনকে আগলে রাখবে! অনেক বার সিমাকে আমি বিরক্ত করেছি তার জীবন কাহিনী শোনার জন্য, হয়তো আমার লিখার কোনো ভুল থাকতে পারে তার জন্য সিমার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি! ভালো থাকো আজীবন এই কামনা করি! আপনারাও সিমার জন্য দোয়া করবেন। আল্লাহ্ হাফেজ)
আস্সালামুআলাইকুম