#কাঞ্চাসোনা পর্ব ১৩
#জাকিয়া_সুলতানা_ঝুমুর
সকালের জ্বর ভালো হলো।তার শাশুড়ী গতকাল আসবে।ধ্রুব এখন আগের চেয়েও বেশি জ্বালায়।সারাদিন পিছে পিছে ঘুরে।একদন্ড সকালকে একা ছাড়ে না।এই যে রান্না করার সময়ও কাছে দাঁড়িয়ে থাকবে,ফু দিয়ে সকালের চুল উড়াবে,যখন তখন বেনী ধরে কাছে টানবে।আর সাথে তো উল্টাপাল্টা আবদার আছেই।ধ্রুবর এই পাগলামি,আগোছালো কাছে টানা সকালের খুব ভালো লাগে,সব মেয়েইতো এমনি হাজবেন্ড আশা করে।যে কিনা ভালোবাসে,ভালো রাখে।সকালের মনে হয় সব ছেলেদেরই এমন পাগল পাগল ভাব থাকা উচিত,সবার সামনে না হোক বদ্ধ ঘরেই এমন পাগলামি করুক।মেয়েদের সুপ্ত মনে নিজেরা নরম পাখির বাসা বানিয়ে নেক।
বিয়ের প্রায় দুই মাস হতে যাচ্ছে ধ্রুব নিয়মিত অফিসে যায়।হাজারো ব্যস্ততার মাঝেও সকালকে সময় দেয়ার চেষ্টা করে।আগে অফিস থেকে এসে মোবাইল হাতে নিতো।এখন এই সময়টা সকালের জন্য বরাদ্দ রাখে।তার মনে হয় সম্পর্ক ভালো রাখার জন্য দুজন দুজনকে সময় দেয়া খুব প্রয়োজন।ফিজিক্যাল হলেই যে সম্পর্ক মজবুত হয় এমনটা না। সম্পর্ক মজবুত করতে হলে দরকার মনের সম্পর্ক আত্মার সম্পর্ক।আর এই সম্পর্ক গুলো তৈরি করার জন্য দরকার একে অপরকে সময় দেয়া।একে অপরের আস্তা ভরসা হওয়া।এই যে সকালের ছোট ছোট আহ্লাদগুলো তাকে হাসায়।অভিমানী চোখে যখন ধ্রুবকে দেখে তখন ধ্রুব অভিমান ভাঙ্গায় আর মনে মনে হেসে খুন হয় এটা ভেবে যে একটু আদর আদর কথা বললেই যে পাখির অভিমান কমে যায়!একটু জড়িয়ে ধরলেই যে কান্না থেমে যায়।এই অল্পদামি শাড়ি চুড়িতেই গাল ভরে হাসে।এটুকু পাওয়াতেই কেন এতো খুশী মেয়েটা!
সকালের রেজাল্ট দেয় সে ফোর পয়েন্ট সেভেন ফাইভ পেয়েছে।সবাই খুব খুশী হয়।
সকালের বাবা আসে সকাল আর ধ্রুবকে নিতে বিয়ের পরে একবারো যাওয়া হয়নি।ধ্রুব যেতে পারবে না তার এখন ছুটি নেই।ঠিক করা হলো সকাল তার বাবার সাথে গিয়ে কয়েকদিন থাকার পরে ধ্রুব গিয়ে নিয় আসবে।ধ্রুব কথাটা শুনে মন খারাপ হয়,আড়চোখে সকালকে দেখে সকালও তার দিকেই তাকিয়ে আছে।ধ্রুব চোখের ইশারা করে রুমে যায়,
সকাল রুমে গেলে টেনে কোলে বসিয়ে গলায় মুখ গুজে চুপচাপ বসে থাকে।এতো দিন হয়ে যাচ্ছে বিয়ের কিন্তু ধ্রুব এখনো স্পর্শ করলে শরীরে শিহরণ বয়ে যায়।লজ্জারা কতো তাজা!ছোঁয়াটা কতো পবিত্র!সকাল ধ্রুবর মাথায় হাত ভুলিয়ে,মাথা উচু করে ধ্রুবর নাকের সাথে নিজের নাক দিয়ে হালকা ধাক্কা দিয়ে খিলখিল করে হাসে।ধ্রুব হাসে না চুপ করে তাকিয়ে আছে।সকাল আদর আদর গলায় বললো,
“কি হলো? “
ধ্রুব নাক ফুলিয়ে বললো,
“বুঝতে পারছো না?”
সকাল বুঝতে পারছে,তারপরেও ধ্রুবকে রাগাতে বললো,”না।”
ধ্রুব মন খারাপ করে বললো,
“না করে দাও।বলো যে এখন না পরে যাবে।”
সকালের মনও খারাপ হয়।কি করে থাকবে এই মানুষটাকে ছেড়ে?আবার গ্রামে যেতেও মন চাইছে।
ধ্রুব বুঝতে পারছেনা তার এতো খারাপ লাগছে কেন।মনে হচ্ছে মেয়েটা কাছে না থাকলে সে মরেই যাবে।সকাল গলায় জড়িয়ে ধরে।
“আমি তো মাত্র দুইদিন থাকবো।”
“যা ইচ্ছা করো।”
“কি করবো?”
ধ্রুব কিছু বলে না।চুপচাপ অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে যায়।রেডি হয়ে সবাইকে বলে যায় শুধু সকালকে ছাড়া।সকাল মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে দেখে।মনোয়ারা সকালকে ডেকে কাছে নেয়।
“কোন সমস্যা হয়েছে সকাল?”
ধ্রুবর রাগ খুব ঠান্ডা মাথায় চলে,এটা সকাল বুঝতে পেরেছে।সে আমতা আমতা করে বললো,
“মা,আসলে উনি চাইছিলেন আমি উনার সাথেই যাই।প্রথমবার তো একা একা গেলে…..”
মনোয়ারা ব্যাপারটা বুঝতে পারে।সকালের বাবাকে বুঝিয়ে বললে তিনিও বুঝেন।সকাল গেলো না।সারাদিন ধ্রুব একবারো ফোন দেয়নি।সকালের খুব অভিমান হয়।
গেলো কি না এটাও তো জিজ্ঞেস করতে পারতো।অভিমানে,রাগে সন্ধ্যায় রুম অন্ধকার করে বিছানার এককোনে বসে থাকে।
ধ্রুবর সারাদিন মন বিষিয়ে থাকে।বউ চলে গেছে আর সে কিনা বসে বসে অংক করছে!আজকে বাসায় যেতেও মন চাইছে না,বউ নেই শান্তিও নেই।আজকে বাসায় গিয়ে হাসির রিনিঝিন,লজ্জার বহর আর দেখা হবেনা।তারপরেও ধ্রুব বাসায় যায়।নিজের রুমে গিয়ে তার মনে হয় একরাশ শূন্যতা আঁকড়ে ধরে আছে।প্রতিদিন অফিস থেকে আসলে বউটা এটা সেটার বাহানায় আশেপাশে ঘুরঘুর করতো।আজকে নেই!অন্ধকার রুমে দাঁড়িয়ে তার মনে হয় পিচ্ছিকে ছাড়া থাকা অসম্ভব।বিয়ে করে এই কোন জ্বালা হলো?ব্যাগটা বিছানায় ছুড়ে ফেলে ধ্রুব খুব কষ্ট কষ্ট গলায় গেয়ে উঠে, ❝আমি ফাইসা গেছি,আমি ফাইসা গেছি মাইনকার চিপায়❞
ধ্রুবর এমন গান শুনে সকাল নিজের অভিমান ভুলে খিলখিল করে হেসে উঠে।
প্রিয় হাসি,প্রিয় মানুষের উপস্থিতি টের পেয়ে ধ্রুব লাইট জ্বালায়,সকালকে দেখে এগিয়ে এসে বললো,
“তুমি যাওনি?!
সকাল হেসে বললো,
“না আমার বরকে মাইনকার চিপায় দেখার জন্য থেকে গেছি।”
ধ্রুবও হেসে দেয়।সকালকে জড়িয়ে ধরে বললো,
“বউ থাকলে কি আর এই গান গাই?”
তারপর চকাস করে কয়েকটা চুমু দিয়ে বললো,
“কেন যাওনি?”
সকাল আবার অভিমানী হয়।ঠোঁট ফুলিয়ে বল,
“আপনি রাগ করে চলে গেলেন।গেলে শান্তি পেতাম নাতো।”
ধ্রুব হাসে।তার বউটা তাকে বুঝে।একটু রাগ করেছে তাই যায়নি।কানের কাছে মুখ গুজে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো,
“তাইতো এতো ভালোবাসি।”
ধ্রুবর হাবভাব ভালো না দেখে সকাল বললো,
“ঘামযুক্ত শার্ট নিয়ে বউকে ধরা যায় না।”
ধ্রুব কোমড়ের বাধন শক্ত করে বললো,
“বর চাইলে সব করা যায়।”
সকাল ছুটে চলে যেতে নিয়েও পারে না,কাকে বুঝাবে?এই পাগলকে?যে কিনা সকালের সানিধ্যে এলে ছোট ছেলে হয়ে যায়।সকাল আবেশে চোখ বন্ধ করে।
ধ্রুব সে তো অগোছালো কাজের জন্যই এক্সপার্ট,মূহুর্তের মাঝেই সকালকে অগোছালো করে দেয়।নিজেও অগোছালো রাজ্যে শিকারের খুঁজে বেরিয়ে পড়ে।
আজকাল সকালের কেমন জানি লাগে,হঠাৎ করেই শরীর ঝিমিয়ে উঠে,চোখ চেপে বন্ধ হয়ে আসে।দুই দিন ধরে খাবারও খেতে পারছেনা।মনোয়ারা বিকেলে সকালের ঘরে আসে সকাল তখন বাথরুমে বমি করছে,বাথরুম থেকে আসার পথেই পিছলে পড়ে যায়।মনোয়ারা ধরে রুমে আনে,সকালের শরীরের অবস্থা উনার চোখ এড়ায়নি।এখন বমি করাতে সন্দেহ প্রবল হয়।সকালের হাত ধরে বললেন,
“সকাল আম্মু,কবে থেকে বমি হচ্ছে?”
সকালের চোখ ডুলডুল করছে।মাথা নেড়ে বললো,
“দুই দিন ধরে।”
মনোয়ারা জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বললো,
“ধ্রুব কি দেখেনি?শরীর যে খারাপ?”
“মা,সকালে আর দুপুরেই বেশী খারাপ লাগে,রাতে ভালই লাগে।আমিই বলি নি উনাকে।তাই জানে না।”
মনোয়ারার মন কু ডাকে,এখন যে পিছলে পড়লো?
মনোয়ারা তখনি সকালকে বগলদাবা করে ছুটলেন হসপিটালে।ঘন্টাখানেক পরে মনোয়ারা হসপিটালের কড়িডোরে বসে আছেন।ইউরিন আর আল্ট্রাসাউন্ড করে রিপোর্ট হাতে পেয়ে মাত্রই ডাক্তারের চেম্বার থেকে আসলেন।কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম ঝড়ছে।ধ্রুবকে ফোন করা হয়েছে।সকালকে পিছলে পড়ার জন্য কেবিনে ওষুধ দেয়া হচ্ছে।ধ্রুব তখনি এলো।
মাকে দেখে বললো,
“আম্মা কি হয়েছে?সবাই ঠিক আছো তো?”
মনোয়ারা যেন তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে।চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,
“তোকে এতো বড়ো বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়িয়ে কি লাভ হলো?গাধার বাচ্চা গাধা”
মায়ের হঠাৎ বকাঝকার কারন ধ্রুবর বোধগম্য হয় না।আশেপাশের সবাই মাথা ঘুরিয়ে তাকে দেখছে।মুখ কালো করে বললো
“আমি কি করেছি আম্মা।এতো লোকের মাঝে বাপ নিয়ে গালি দিচ্ছো কেন?”
“খুব না লাফিয়েছিলি আমি বাচ্চা মেয়ে বিয়ে করিয়ে দিয়েছি।”
ধ্রুব কি বলবে বুঝে না।আজকে আবার কি হলো?
“কি হয়েছে আম্মা?”
ধ্রুবর দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,”গাধা।”
ধ্রুব কিছু বলবে তার আগেই মনোয়ারা বলেন,
“বউয়ের শরীরের দিকে খেয়াল রাখা যায় না?আমি আজকে যদি না যেতাম তখন কি হতো বল তো?এই অবস্থায় পিছলা খেয়ে বসে আছে।”
ধ্রুব ভ্রু কুচকে বললো,
“এই অবস্থায় মানে?”
মনোয়ারা হাতের রিপোর্ট ধ্রুবর কাছে দিয়ে বলেন,
“লেখাপড়া কাজে লাগা।নে।”
এটা বলে উনি বিল দিতে যায়।ধ্রুব ইউরিন টেস্টে স্পষ্ট দেখে পজিটিভ লেখাটা।আল্ট্রার রিপোর্টে লেখা ❝ফাইভ উইক প্রেগ্ন্যাসি,এন্ড টু ফিটাস।❞
ধ্রুব ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ে।কিভাবে সম্ভব?আয় হায় এই মুখ সবাইকে কিভাবে দেখাবে?খুব লাফা লাফি করেছিলো বাচ্চা বউ বাচ্চা বউ করে এখন এই বাচ্চার পেটেই কিনা দুই বাচ্চা!ভাবা যায়!ধ্রুবর বুক ধরফর করে কাপেঁ।গলা শুকিয়ে কাঠ কাঠ।ধীরপায়ে উঠে কেবিনে যায়।সকাল বিছানায় শুয়ে আছে। ধ্রুব মাথা চুলকে পাশে গিয়ে বসে।ছোট্টখাটো শরীরে কিনা দুইটা বেবী!!টুইন!ধ্রুবর মনে হচ্ছে সে অজ্ঞান টজ্ঞান হয়ে পড়ে যাবে।বাচ্চার পেটে দুই বাচ্চা!
চলবে…..
❝প্রিয় পাঠক গল্প আমার মাথায় যেভাবে এসেছে আমি ঠিক সেভাবেই লিখবো।❞
❝আর হ্যাঁ ধ্রুবর মাইনকা চিপার গানটা কেমন ছিলো?❞
❝আজকের ভালো কথাগুলো কি কি?”
ভালোবাসা