কলমে: নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
(১০ এর ক)
দরজায় নিরন্তর করাঘাতের শব্দে বিরক্ত হোলো মিথিলা। চ সূচক শব্দ করল, শোয়া থেকে উঠে এসে ছিটকিনি টানল।
মেয়ের অক্ষত মুখখানা দেখতেই প্রাণ পেলেন খোরশেদুল।
প্রকাশ না করলেও, গোপনে বুক ভরে দম টেনেছেন তিনি। তারপর
গম্ভীর গলায় বললেন,
“ সকাল থেকে দরজা খুলছিলে না কেন?”
মিথিলা যত যাই হোক বাবাকে মানে,ভয় পায়। উত্তরে, মাথা নুইয়ে বলল,
“ ভালো লাগছিল না কিছু। ”
“ ভোরবেলা অত চেঁচামেচি শোনোনি? তোমার মা যে পরে ব্যথা পেয়েছেন,হাসপাতালে নিয়ে গেলাম টের পাওনি?”
মিথিলা ভীষণ আশ্চর্য বনে চাইল। অবাক কণ্ঠে বলল,
“ মা হাসপাতালে? কেন, কী হয়েছে? ”
পালটা অবাক হলেন খোরশেদুল। এই ঘর আর বসার ঘর কতটা দূরে? সাউন্ডপ্রুফ তো নয়। সালমার মাথা ফাঁটা নিয়ে সকালে হূলস্থুল বাঁধালেন ওনারা। এমনকি আলেয়া অবধি নাকে কাঁদলেন। অথচ মেয়েটা কিছুই জানেনা?
খোরশেদুল ব্যথিত হলেন! ঠিক বুঝেছেন তাহলে। মেয়েটা অধিক শোকে স্তব্ধ হয়ে পড়েছে। স্বামীর ফেলে যাওয়া,আর অত মানুষের খোঁচাখোঁচি! তার মেয়ে বড় আদরে,আহ্লাদে মানুষ। এরকম পরিস্থিতিতে কী কখনও গিয়েছে?
খোরশেদুলের মায়া হলো। পিতৃসুলভ মমতার চাউনী উপচে এলো দু চোখে। এখন মায়ের কথা শুনলে মেয়েটা এরওপর আবার আরেক চিন্তায় পড়বে। থাক বরং!
মিথ্যে বললেন,
“ তেমন কিছুনা। দূর্বল,স্যালাইন দিচ্ছে।”
মিথিলার ছোট জবাব, “ ওহ।”
খোরশেদুল প্রসঙ্গ পাল্টাতে বললেন,
“ পলাশের সঙ্গে কথা হয়েছে?’’
অচিরে মুখে মেঘ জমল মিথিলার। আগের থেকেও ভার ভার স্বরে জানাল,
“ না। ”
“ ফোন করোনি?”
মিথিলার বলতে খুব লজ্জা লাগছে। তাও জানাল,
“ করেছিলাম। আমাকে ব্লক করে দিয়েছে।”
খোরশেদুল এবার সোজাসুজি শুধালেন ,
“ ওই বখাটে গুলো যা যা বলে গেছিল,সেসব সত্যি?”
মিথিলার চিবুক গলার কাছে ছিল এতক্ষণ। প্রশ্নটায় এবার গলা ফুড়ে বেরিয়ে যাওয়ার প্রয়াস জানাল। যথাযথ উত্তর দিতে ব্যর্থ সে। মিথ্যা বলতে গেলেও সুনিশ্চিত ধরা পড়বেই। চুপ করে থাকলেও বিপদ! কোন দিকে যাবে? কী বেছে নেবে? বিয়ের দুদিনের দিন মানুষ ঘুরেফিরে শহর ছাপিয়ে ফেলে,আর সে কী না এসব প্রেম-ট্রেম নিয়ে পুরোনো কাসুন্দি ঘাঁটছে?
মিথিলার রাগের সবটুকু চড়াও হলো নাহিদের ওপর। কোন কুক্ষণে বলদটার সাথে সম্পর্কে গিয়েছিল কে জানে! নিজেও ভালো থাকবে না,ওকেও ভালো থাকতে দেবে না। সামনে পেলে চড়িয়ে লাল করে দেবে একদম।
খোরশেদুল মেয়ের হাবভাবেই যা বোঝার বুঝে নিলেন। হতাশ হলেন ভীষণ! আক্ষেপ জানিয়ে বললেন,
“ তোমার থেকে আমি এসব আশা করিনি মিথিলা! ওরকম একটা মাস্তানের বন্ধু তো মাস্তানই হবে। কী রুচিহীনের মতো কাজ করেছ,ছি!ছি! আজ সব মান ইজ্জত এইভাবে জলে ডুবল আমার। ”
মিথিলা আর্ত চোখে তাকায়, ভেজা স্বরে বলে,
“ আব্বু প্লিজ! এনিয়ে কাল থেকে সবার উল্টোপাল্টা কথা শুনছি। অন্তত তুমিও এসব বোলো না।”
খোরশেদুল লম্বা শ্বাস ঝাড়লেন। বললেন,
“ ঠিক আছে। ব্লান্ডার যা করার তো করেই ফেলেছো। এখন কীভাবে কী ঠিক করবে কিছু ভাবলে?”
মিথিলা কালো চেহারায়,দুপাশে মাথা নাড়ল। সে কাল থেকে ভেবেছে,কিন্তু কোনও সুরাহা করতে পারেনি। পলাশ এত শক্ত মানুষ! ঠিক কী বলে ওকে বাগে আনা যাবে,মস্তিষ্কে ধাঁরাল বুদ্ধিটা কোনও মতেই আসেনি!
খোরশেদুল বললেন,
“ তাহলে আমি যা বলছি শোনো,পলাশের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করো। হাল ছেডো না। চেষ্টা করতেই থাকো। তোমার নম্বর ব্লক করলে অন্য নম্বর থেকে কল দাও। এভাবে বিয়ের পরদিন বউ ফেলে রাখা তো ভালো কথা নয়। তাও একটা নরমাল ইস্যু নিয়ে এত রিয়াক্ট করবে কেন? ”
মিথিলা দুঃখভারাক্রান্ত কণ্ঠে বলল,
“ ও মনে হয় আর আমাকে ফিরিয়ে নেবেনা আব্বু। ”
খোরশেদুল শক্ত কণ্ঠে বললেন,
“ ফিরিয়ে নেবেনা বললেই হলো? এটা কি মগের-মুল্লুক পেয়েছে? দেশে আঈণ-কানুন বলেও একটা কথা আছে। ভালোয় ভালোয় আসতে বলো,নাহলে আমিও অন্য ব্যবস্থা নেব। ”
গজগজে ক্রোধ ঝেড়ে চলে গেলেন তিনি। কিন্তু মিথিলার নিভু নেত্র জ্বলজ্বল করে উঠল । দপদপ করে সাড়া দিলো মস্তিষ্কের প্রতিটি কোষ।
এইত,এইত উপায় পেয়েছে। এতটা সময় ভেবে ভেবেও যা উদ্ধার করতে পারেনি,বাবার এক কথায় তা নিজে থেকে হানা দিলো এক্ষুণি।
মিথিলা ত্রস্ত দোর চাপাল। বিছানা থেকে ফোন হাতে তুলল । ঝটপট কল লাগাল পলাশ লেখা নম্বরে।
তবে,ব্লাকলিস্ট থেকে নম্বরটা তখনও সরায়নি পলাশ।
মিথিলা নাক ফুলিয়ে স্ক্রিনে চোখ বোলায়। ঠিক আছে, কোনও ব্যাপার না।
কীভাবে ব্লক ছোটাতে হয় ভালো করে জানা আছে ওর।
মিথিলা তৎপর হস্তে গোটা গোটা মেসেজ টাইপ করে পাঠাল,
“ তুমি কি ফোন ধরবে? নাকী আমি কোনও স্টেপ নিতে বাধ্য হব পলাশ? আর যেরকম ভাবছি তেমনটা করলে,সেটা অবশ্যই তোমার জন্য সুখের হবেনা।”
তারপর অপেক্ষা করল উত্তরের ৷ ডোজে কাজ হবে কী না চিন্তিত সে।
পুরো চার মিনিট ফোন হাতে নিয়ে পায়চারী করার মধ্যেই স্ক্রিন জ্বলে ওঠে। পলাশ কল ব্যাক করেছে। ক্রুর হাসল মিথিলা। রিসিভ করে কানে গুঁজতেই, ওপাশ থেকে শশব্যস্ত প্রশ্ন এলো,
“ স্টেপ নেবে মানে? কী বলতে চাইছো তুমি?”
“ তুমি যা বুঝেছ তাই।”
“ আমি কী বুঝব? তোমার থেকে শুনতে চাই। ”
“ সেসব পরে শোনাচ্ছি। আগে তুমি বলো,এভাবে আমাকে এখানে রেখে যাওয়ার মানে কী?”
“ মানে কী আবার? বলেইত এলাম। তোমার মত লোভী,গোল্ড ডিগার মেয়ের আমার ঘরে কোনও জায়গা নেই। সবই তো শুনছি। কী বাঁধাই করা রেকর্ড তোমার! অত মানুষের মধ্যে আমার মান -সম্মান যাস্ট ধূলোয় মিশিয়ে দিয়েছ।”
মিথিলা তেঁতে ওঠে,
“ একদম ফালতু কথা বলবে না! বিয়ের আগে সবারই কম-বেশি এসব থাকে। তোমার নেই মনে হয়? খোঁজ নিলে দেখা যাবে তোমার রেকর্ড আমার থেকেও সুন্দর! ”
পলাশ কাঠখোট্টা জবাব দিলো,
“ আমার এরকম ফালতু ক্যরেক্টর না। ”
মিথিলা ফুঁসে বলল,
“ চুপ করো। দুচারটে প্রেম এ যুগের খুব কমন ব্যাপার। এসব দিয়ে তুমি আমার চরিত্র মাপতে পারো না। ”
তারপর চোখ বুজে শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করে বলল,
“ আচ্ছা বেশ,এত কথার দরকার নেই। আমি যা বলছি এখন তাই শোনো,চুপচাপ ভদ্র ছেলের মতোন এসে আমাকে নিয়ে যাও ।”
পলাশের জবাব আসে,
“ মাথা খারাপ নাকী? শোনোনি কী বললাম? তোমাকে আমি ফিরিয়ে নিচ্ছি না।”
মিথিলা ভ্রু উঁচাল,
‘ আচ্ছা? বেশ,নিতে হবেনা। আমি বরং থানায় গিয়ে একটা মামলা ঠুকে আসি? বলি যে,আমার স্বামী বিয়ের পরদিন বিনা কারণে আমাকে বাপের বাড়ি ফেলে গিয়েছে। কারণ সে অন্য নারীর সঙ্গে পরকীয়ার সম্পর্কে লিপ্ত। বা বলব যে,আমার বাবা যৌতুক দিতে চাননি দেখে নারাজ হয়েছে।”
পলাশ বিস্ময়ে হা হয়ে বলল,
“ হোয়্যাট রাবিশ! আমি এরকম কিছু করিনি। তাছাড়া প্রমাণ কী এসবের?”
“ তাহলে আমি বিয়ের আগে যা যা করলাম,তোমার কাছে সেসবের প্রমাণ কোথায়? তুমিও তবে অযথা ব্লেইম করছো আমাকে। তাও কে এসে কী না কী বলে গেছে সে নিয়ে। শোনো পলাশ,একশটা বয়ফ্রেন্ডের সাথে ব্রেক আপ করলেও আঈনে কিন্তু শাস্তি নেই। কিন্তু বিয়ের পর অহেতুক কারণে বউ রেখে গেলে,ফেরত না নিতে চাইলে আঈণে কিন্তু এর শাস্তি অনেক ভয়াবহ। অন্তত মামলার চক্করে ইঞ্জিনিয়ারিং করা ছুটে যাবে তোমার। আর বিদেশ যাওয়ার কথা তো বাদই দাও। এখন তোমার একার সম্মান যাচ্ছে,তখন তোমার পুরো পরিবারের সম্মান কোথায় যাবে ভাবতে পারছো?”
“ তুমি কি আমাকে ভয় দেখাচ্ছো?”
মিথিলা ভণিতাহীন বলল,
“ দেখাচ্ছি। আর তুমি নিতে না এলে,কাজটা আমি করবও। তুমি আমাকে চেনো না। এখন বলো, তুমি কী করতে চাও? ভালোয় ভালোয় আমাকে নিয়ে সংসার করবে,নাকী নিছক এসব ঝামেলায় জড়াবে?”
ওপাশে তৎক্ষনাৎ নীরবতা নামল । কপালে ভাঁজ পড়ল মিথিলার। দুদিনের আলাপে পলাশকে অত ভালো সে আয়ত্ব করতে পারেনি। তাই এখনও ওর মতিগতি নিয়ে শঙ্কিত।
কিন্তু পলাশ একটু চুপ থেকে বলল,
“ ঠিক আছে। বিকেলে আসব। ’’
মিথিলার মিইয়ে থাকা অনুচিন্তিত মুখখানা চকচক করে উঠল। স্ফুর্ত চিত্তে বলল,
“ ঠিক আছে, রাখছি। ”
পলাশ লাইন কাটল। মিথিলা বিজয়ী হাসল বুক ফুলিয়ে।
ঠোঁট ভর্তি গাঢ় পৈশাচিক আনন্দ! সে স্ক্রিনের দিক চেয়ে বলল,
“ তোমাকে চালাক ভেবেছিলাম৷ অথচ তুমি সেই নাহিদের মতোই আরেকটা গাঁধা বের হলে। ”
*****
সালমা বেগমকে হাসপাতাল থেকে সন্ধ্যে নাগাদ ছাড়া হলো। ওনার দূর্বলতায় কাবু দেহটা সবাই ধরা-ধরি করে নিয়ে এলো বাড়িতে।
খোরশেদুল অফিস থেকে আবার হাসপাতালে গিয়েছিলেন। অতটুকু সময়, আলেয়া বানু আর সালমার ভাইয়ের বউ ছিলেন কাছে।
রাহাত দরজা খুলল। ওকে আর হাসপাতালে নেওয়া হয়নি। ছোট মানুষ, রোগীদের ভেতর গিয়ে কাজ নেই।
রাহাত মাকে দেখতেই গতিতে জড়িয়ে ধরল । এক প্রকার হামলে পড়ল ওনার বুকের ওপর। প্রকোপে সালমা পরে যেতে নিলেন।
খোরশেদুল দাঁড়িয়ে ছিলেন পেছনে। চট করে ধরে ফেললেন স্ত্রীকে। সালমা বেগম চাইলেন একপল। গম্ভীর মুখে আবার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতেই আহত হলেন ভদ্রলোক ।
সেদিনের পর থেকে সালমা এখন অবধি একটি কথাও ওনার সঙ্গে বলেননি। রাহাত মাকে জড়িয়ে রেখেই বলল,
“ আম্মু তোমার খুব লেগেছিল? ব্যথা কী একটুও কমেছে?”
আলেয়া বানু বললেন,
“ দাদুবাই,এগুলান সব পরে হুইনো, অহন মায়রে বইতে দাও। ”
সালমা মাথায় হাত বুলিয়ে একটু হাসলেন। রাহাত সরে এলো। তিনি ভেতরে ঢুকে, আস্তে-ধীরে সোফায় বসলেন। পাশে বসলেন আলেয়া। এদিক-ওদিক চেয়ে বললেন,
“ কী রে,তোর মাইয়া কই খোরশেদ?”
খোরশেদুল বিষয়টা এতক্ষণে খেয়াল করেছেন। সেই যে মেয়েটাকে দুপুরে পলাশের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলে গেলেন, তারপর আর কথা হয়নি। ত্বরিত মেয়েকে হাঁক ছুড়লেন তিনি।
দুবার ডাকেই দরজা খুলল মিথিলা। অথচ এত সময়ে বসার ঘরের একটা কথাতেও তার সাড়া ছিল না। মিথিলার বেশ-ভূষা দেখতেই আলেয়া বানু ভ্রু তুললেন কপালে ।
গাঢ় রঙের দামী জামদানি,গয়না, পরিপাটি করে বাঁধা চুল, চেহারায় অল্প-বিস্তর মেক- আপ। আলেয়া বানু পাতা ঝাপটালেন চোখের। স্বামী ওইভাবে রেখে গেল,মা এলো হাসপাতাল থেকে তিনি ধরেই বসেছিলেন, মেয়েটা হয়ত কেঁদে চোখ-মুখ ফোলাবে। কিন্তু এ তো….
মিথিলা হাসি- হাসি মুখে বাবার পাশে এসে দাঁড়াল।
“ ডাকছিলে আব্বু?”
খোরশেদুল মেয়ের আপাদমস্তক দেখে বললেন,
“ কোথাও যাচ্ছো?”
সে হৃষ্ট চিত্তে জানাল,
“ হ্যাঁ। পলাশ আসছে নিতে। তাই তৈরী হলাম ।”
খোরশেদুলের বক্ষ হতে দুশ্চিন্তার ভারি পাথরটা তত্র নেমে গেল। এ নিয়ে গতকাল থেকে কী যে ভাবনায় পড়েছিলেন!
সালমা বেগম অবাক হয়ে বললেন,
“ নিতে আসবে মানে? কোথায় গিয়েছে ও? আর কাল এলি আজ যাবি কেন?”
গতকালকের ঘটনার এক ফোঁটাও জানেন না তিনি। পরপর ঘটে যাওয়া দূর্ঘটনায় কিছু টেরও পাননি। আলেয়া বানু হা করলেন বলতে, ওমনি খোরশেদুল চোখ ইশারা করলেন।
বৃদ্ধা ইঙ্গিত বুঝে থেমে গেলেন। ছেলের ওপর দিয়ে তো আর চলা যায় না।
মিথিলা আমতা-আমতা করে বলল,
“ না আসলে,ওর একটা কাজ পড়েছিল, তাই চলে গিয়েছে। তুমি অসুস্থ তাই আর থেকে বাড়তি ঝামেলা করবে না বলল।”
সালমা বললেন,
“ এতে ঝামেলার কী আছে? জামাই মানুষ। প্রথম বার শ্বশুর বাড়ি আসবে। বেড়াবেনা? আমি যতটুকু পারি করার চেষ্টা করব।”
খোরশেদুল বললেন,
“ থাক না। এই সময় এত প্রেশার ঠিক হবেনা তোমার। ওরা আবার পরে সময় করে আসবে না হয়। ”
মিথিলা তাল মিলিয়ে বলল, “ হ্যাঁ হ্যাঁ আবার পরে আসব আম্মু।”
আলেয়া ফোস করে শ্বাস ফেললেন। টেনে টেনে বললেন ,
“ তোর কইন্ন্যা আবার মার পেশারও বুজে? এই যে কত সমায় হইল মায়ডা আইল হাসপাতাল দিয়া। একবার ত জিগাইলও না ভালা মন্দ। মায়ের মাথাত যে এত্ত বড় একখান পট্টি, ফিইরাও তো দেখল না।”
মিথিলা কটমট করে উঠল।
খোরশেদুল মেয়ের পক্ষ নিয়ে বললেন,
“ থাক আম্মা, ছেলেমানুষ! অত শত বোঝে না।”
“ হ পোলামানুষ। আকাম তো ঠিকই করবার পারে।’
সালমা বুঝতে না পেরে বললেন,
“ ও কী করেছে আম্মা?”
মিথিলা জ্বলে উঠল, “ আব্বু তোমার মাকে থামতে বলো। বুড়ি মানুষ এত কথা বলে কেন?”
খোরশেদুল চুপ থাকলেও সালমা ধমক দিলেন মেয়েকে। কড়া কণ্ঠে বললেন,
“ মিথিলা! উনি তোমার দাদু। গুরুজনের সাথে কেউ এভাবে কথা বলে?”
মিথিলা চুপ করলেও চেহারায় বিরক্তি। আলেয়া বানু পূত্রবধুর দিকে আপ্লুত চোখে চাইলেন। ছেলে তার সম্মান না রাখলেও,পরের মেয়ে ঠিক রাখছে।
রাহাত কাচের গ্লাসে পানি হাতে ছুটে এলো তখন। মায়ের দিক বাড়িয়ে বলল,
“ নাও।”
জলের কথা সালমা বলেননি । ছেলেটা নিজে থেকে আনায় সবাই বিস্মিত হলো। সালমা মৃদু হেসে গ্লাস হাতে নিলেন। চুমুক দিতে গিয়ে খেয়াল করলেন পানিতে চুল ভাসছে । হেসে ফেললেন আরো। বললেন,
“ এটাতে ময়লা আব্বু। খাওয়া যাবেনা।”
রাহাত ভেজা হাত পেটের কাছে জামায় মুছছিল। কথাটায় চোখ প্রকট করে বলল,
“ ময়লা? কিন্তু আমিতো ভালো করে দেখে আনলাম। আচ্ছা দাও, পালটে আবার ভালো পানি আনছি।”
গ্লাস নিয়ে রাহাত আবার চলে গেল। ফিরে এলো মিনিটে। আলেয়া বানু গদগদ হয়ে বললেন,
“ কী সুন্দার আমার নাতিডা! মার দিক কত খেইল। মাইয়ারে মানুষ করতে না পারলেও পোলা খুব সুন্দার মানুষ করছো বউ।’
সালমা ছোট্ট করে শ্বাস নিলেন। আলেয়া বানু আগের দিনের মানুষ। মেয়ে নাতীর প্রতি প্রথম থেকেই বিমুখ ছিলেন। যতটা নারাজ হয়েছিলেন মিথিলা হওয়ার সময়, ততটাই প্রসন্ন ছিলেন রাহাত আসার খুশিতে। এমনকি ওনার দৃষ্টিতে পুষ্পিতাকে বাড়িতে ঠাঁই দেওয়ার মত ভয়াবহ অপরাধটাও মাফ পেয়েছিল এই একটা কারণে।
ঢাকায় বেড়াতে এলে,বা শ্বশুর আলয়ে গেলেই মিথিলার সঙ্গে বৃদ্ধার সর্বদা ঠান্ডা যুদ্ধ বাঁধত। তাই আজকেও ধরে নিলেন হয়ত এজন্যে এসব বলছে।
অন্যদিকে মিথিলা দাদীর প্রতিটা কথায় খটমট করছে নীরবে। মায়ের জন্য কিছু বলতেও পারছে না। তবে, এত এত ঘটনার মধ্যেও, একমাত্র মহিদুল আলম নিশ্চুপ বসে। পৌঢ় লোকটি হ্যাঁ তেও নেই,না তেও নেই।
সালমা স্বামীর দিক চাইলেন। কণ্ঠে নম্রতা,
“ তোমার ওপর আজ অনেক ধকল গেল তাইনা? ”
খোরশেদুল একটু নড়েচড়ে দাঁড়ালেন,
“ হু? না কীসের ধকল? ”
“ সকাল থেকেই তো কত ছোটাছুটি করতে দেখলাম,তাই আর কী!”
খোরশেদুল মনে মনে খুশি হয়েছেন। ভাবলেন, সালমা তাহলে পুষ্পিতাকে তাড়িয়ে দেওয়া নিয়ে আর রাগ করে নেই। সহজ ভাবে কিছু বলতে নিলেন, সহসা আটকে গেলেন ওনার পরের কথায়,
“ আজ যদি পুষ্পিতাটা থাকত,কারোর কিছু করতে হতোনা। সব একা হাতে সামলাতো মেয়েটা। আমার যত্ন নিতো৷ কতবার অসুস্থ হয়েছি, ঘরের কেউ টেরই পায়নি। পাবে কেমন করে,এর আগেই হূলস্থুল বাঁধিয়ে সেবা করে একদম সুস্থ বানিয়ে ফেলেছে।”
চোখের অশ্রুজলটুকু বেঁয়ে ওনার গাল অবধি এলো। খোরশেদুলের শান্ত মেজাজ মুহুর্তে চটে যায়। কঠিন কিছু বলবেন ভেবেও গিলে নিলেন সালমা অসুস্থ বলে।
আশ্চর্যজনক ভাবে আলেয়া বানুও স্বায় মেলালেন আজ। মন খারাপ করে বললেন,
“ হ কথা-খানা সোটিক। আগে যেতবার আইছি,মায়টা যত্ন-আত্তির তুরটি রাহেনাই। আন্তরিক আছিল। যেন আমি ওর নিজেরই দাদী।”
মিথিলা আরেক দিক ফিরে,দুই গাল ফুলিয়ে শ্বাস ফেলল। তিঁতিবিরক্ত সে। অতীষ্ঠ পুষ্পিতার প্রসংশা শুনতে শুনতে।
অধৈর্য্য চোখে দেয়ালঘড়ি দেখল ও। পলাশ আসবে কখন? ও বাড়ি গিয়ে কত কাজ ওর! কত গোছ-গাছ বাকী। এই বৃহস্পতিবারই তো কানাডার ফ্লাইট। ভাগ্যিস আগে-ভাগে তার ভিসা -পাসপোর্ট করা ছিল। নাহলে এত দ্রুত তো আর যাওয়া হোতো না। মিথিলার লোঁচনদ্বয় ধীরে-ধীরে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বৈদেশের বিলাসবহুল জীবনের চিত্রটাও এঁকে এঁকে লোভে টলমল করল ভেতরটা।
খোরশেদুল ও সমান ভাবে পুষ্পিতার প্রসংশা শুনতে অনীহ। প্রসঙ্গ কাটাতে বললেন,
“ আম্মা,আমি বাজার আনছি। ফ্রিজে মাছ আছে। ওর তো শরীর ভালো না, আপনি একটু কষ্ট করে এ বেলার রান্নাটা করে দিয়েন।”
আলেয়া ভ্রু কুঁচকে বললেন,
“ ক্যান? আমি রান্দুম ক্যান? তোর এত্ত বড় কইন্যা কী কইরব? হেয় থাকতে রান্দোন-বারোন আমি পারতাম না।”
মিথিলা তাজ্জব বনে বলল
“ আমি রান্না করব? আমি? আমার হাতের মেহেদী এখনও ওঠেনি আর আমি কী-না মাছ কাটব?মশলা ঘুঁটব? ইয়াক!”
আলেয়া মুখ বেঁকিয়ে বললেন,
“ এহ, আইছে আমার রাইজরানী! শউর বাড়িত গেলে, দুইডা দিন পর এমনেই চূলার আগুন ঠেলোন লাগব। তহন এইসোমোস্ত মেহেন্দী ছুইট্টা যাইব বুইঝছো? ”
মিথিলা রেগেমেগে কিছু বলতে চাইল।
সালমা থামিয়ে দিয়ে বললেন,
“ কাউকে কিছু করতে হবেনা আম্মা। আমি করব যা করার। ”
আলেয়া প্রতিবাদ করে উঠলেন,
“ ক্যান? তুমি এই রোগা শইলে কাম করবা ক্যান? এইসব কইরাই মাইয়াডারে মাথায় তুইলা ফ্যালছো। রানলে হেতির জাত যাইব? পরের ঘরে যাইয়া রানব না?”
মিথিলা সাথে সাথে বলল,
“ নো ওয়ে! পলাশদের বাড়িতে রান্নার আলাদা লোক আছে। আমি কী যেন তেন ঘরের বউ হয়েছি নাকী!’
“ তা হইবা কেন,তুমি তো.. ”
খোরশেদুল মাঝপথে, ‘চ’ সূচক শব্দ করে বললেন,
“ উফ! থামো তো তোমরা। রান্না আমি করব, হয়েছে? যত্তসব।”
“ হেইয়া তো করবাই বাপ! যা মাইয়া বানাইছো! এহন রানবা,দুইদিন পর দেকবা এই মাইয়ার লইগা আরো কত কী করোন লাগতাছে।”
আলেয়া বিরতি নিতেই কলিংবেল বাজল। খোরশেদুল আর দ্বিতীয় জবাবে গেলেন না। মিথিলা উৎফুল্ল চিত্তে বলল,
“ পলাশ এসছে মনে হয়। ”
খোরশেদুল সদর দরজার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। ছিটকিনি টানলেন রাতা-রাতি। সত্যি সত্যি ওপাশে পলাশ দাঁড়িয়ে। ওনাকে দেখে ছেলেটা সালাম দিলো। খোরশেদুল উত্তর করলেন, ভেতর ভেতর হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন। যাক! ঘটনা বেশি দূর গড়ানোর আগেই মিটে গিয়েছে।
চলবে,
আজকের এই পর্বে তীব্র-পুষ্পিতা নেই। কারণ ওদের অংশটা অনেক বড় হবে। আর সেটা এখানে দিলে আগের মত হিজিবিজি হোতো। তাই পরবর্তী অংশ আসবে আজকে সন্ধ্যার পর। আপাতত অর্ধেক টা পোস্ট করলাম।
#সে_আমার_সন্ধ্যাপ্রদীপ!
কলমে : নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
❝১০ এর খ ❞
চলতি মাসের ঊনত্রিশ তারিখ আজ। নতুন মাস শুরু হতে হাতে গোনা দুদিন মাত্র। তারপরেই বৈশাখ সরিয়ে জায়গা নেবে জৈষ্ঠ্য। প্রচন্ড গরমে হাঁসফাঁস করবে গা-গতর। ফাঁকা রাস্তায় নামবে তৃষ্ণার্ত শালিকের জোড়া । তবে আজকের প্রকৃতি, ভবিতব্যের এই নিষ্ঠুরতা বুঝতে দিতে নারাজ।
সক্কাল সক্কাল ঝমঝমিয়ে বর্ষা নেমেছে। মধ্যাহ্নের দাপাদাপিতেও পিচের রাস্তা এখনও ভেজা। ড্রেন চুইয়ে চুইয়ে যাচ্ছে ময়লা পানির স্রোত। বাতাস ভারী! শীতার্ত এক দুপুর। কিছু কিছু জায়গায় রোদ পরেছে। তবে নিরুত্তাপ তার প্রখরতা। ঠিক বিকেলের কোমল সূর্য ঘেঁষে ছুটে আসা রোদ্দুরটার ন্যায়।
তীব্রর ছাদবিহীন,লাল টুকটুকে জিপটা রাস্তার এক কোণায় দাঁড়িয়ে। মাথার ওপর ফুট ওভার ব্রিজ। অন্তহীন মানুষের পদধ্বনি স্পষ্ট শোনা যায়৷ শুধু সে একা নয়। আজ জিপের ওপর জায়গা নিয়ে বসেছে আরো পাঁচজন। শাফিন তীব্রর পাশের সিটে, পেছনে মিরাজ, মুশফিক, আরমান। কেউই সাথে আজ বাইক আনেনি ।
হুট করে তীব্র তলব পাঠানোয় হাজির হয়েছে বিলম্বহীন। সবচেয়ে বড় কথা আজ আমাবস্যার চাঁদের ন্যায় তাদের সঙ্গ দিচ্ছে নাহিদ।
প্রায় সপ্তাহখানেক পর বাইরে বের হয়েছে ছেলেটা।
চোখ-মুখ এখনও কাহিল,শুষ্ক। এ কদিন আরমান ওকে রেখে এক পা-ও অবধি নড়তে পারেনি। তীব্রর কড়া নির্দেশ, নাহিদের মাথা ঠিক নেই৷ একা ছাড়লে যা খুশি করে বসতে পারে। সেই আশঙ্কায় আরমান নিজেও সিটিয়ে ছিল। ভয়ে নাহিদকে ওয়াশরুমের দরজাটা অবধি লাগাতে দেয়নি।
গরুটা একটা মেয়ের শোকে যেই পরিমান কাঁদছে,না জানি উউল্টোপাল্টা কী ঘটায়!
তবে আজকের ঘটনা একটু ব্যতিক্রমী। তীব্রর খবর পাঠানোয় আরমান যখন বের হওয়ার প্রস্তুতি নিতে ব্যস্ত,হুট করে নাহিদ নিজেই প্রস্তাব রাখল,
“ বাসায় আর ভালো লাগছে না রে। আমিও যাই? সবার সাথে আড্ডা দিলে হয়ত ভালো লাগতো একটু। ”
আরমান সঙ্গে সঙ্গে তীব্রকে জানাল। সে রাজী এক কথায়।
মোটামুটি ওদের দিয়েই, তার জিপ পরিপূর্ণ এখন। তিনজনের আসনে ওদের চারজনের একটা গাদা-গাদি বাঁধলেও কেউ টা-টু শব্দ করছে না।
আপাতত তারা চিন্তিত,কৌতূহলী। এই যে গত আধঘন্টা যাবত এইভাবে সবাই রাস্তায় বসে আছে, এর সঠিক কারণ কী?
তীব্র হুইলের ওপর দু পা উঠিয়েছে। একটার ওপর আরেকটা মেলে ক্রস বানানো। ডান হাতে ফোন,বা হাতে সিগারেট।
না কিছু বলছে,না কিছু করছে। তার এমন উদ্বেগহীন ভাবমূর্তি বন্ধুদের মাথার ওপর দিয়ে যায়।
একে অপরকে একটু পরপর ভ্রু উঁচায় সবাই। কিন্তু কেউই কিছু জানেনা। নাহিদের অবশ্য এসবে আগ্রহ নেই।
তবে বাকী চারজন অধৈর্য্য হয়ে পড়ল। মিরাজ জিজ্ঞেস করেই বসল,
“ কী রে বিট্টু! আজ হঠাৎ উত্তরায় কেন এলাম? কাজ আছে এখানে?”
“ হ্যাঁ। ”
শাফিন বলল,
“ কী কাজ? তাহলে বসে আছি কেন এরকম? চল যা করতে হবে সেড়ে আসি।”
তীব্র ছোট শব্দে জানাল,
“ কাজ এখানেই।’’
“ এখানে?’’
মুশফিক চূড়ান্ত অনীহা প্রকাশ করল,
‘ ধুর ভাল্লাগে না! উত্তরায় একদম মন টেকেনা আমার। গুলশানই জোশ!”
তীব্রর ফোনের দিক চেয়েই বলল,
“ তোকে এখানে বেড়াতে আনিনি।”
আরমান শুধায়,
“ তাহলে কী করব বল না! এরকম মূর্তির মত বসে থেকে কোমড় ব্যথা করছে। ”
“ বসে ব্যথা করলে শুয়ে থাক।”
আরমান ঠোঁট ওল্টাল। নাহিদ আশে-পাশে দেখছে। একমাত্র ঘটনা বোঝা নিয়ে তার ভাবান্তর নেই।
তীব্র আরো অনেকক্ষণ পর ফোন নামিয়ে রাখল। রাস্তার ঠিক ওইপাড়ে তাক হলো তার ঘোলাটে চোখ। সটান দাঁড়ানো একেকটা বিল্ডিং-এর ওপর বুলিয়ে আনল নিপুণ দৃষ্টি। তন্মধ্যে একটার দিকে আঙুল ইশারা করে বলল,
“ ওই বাড়িতে কে থাকে, জানিস?”
পাঁচজন এক যোগে ফিরল ওর ইশারা অনুসরণ করে। প্রাঙ্গনে বাগান-বিলাশ গাছের আড়ালে পরা সবুজ বসতটা মনোযোগ দিয়ে দেখল। সবাই একসাথে জানাল,
“ না। ”
শাফিন একধাপ এগিয়ে শুধাল, “ কে থাকে? তোর কোনও আত্মীয়? নাকী আঙ্কেলের কোনও শত্রু?”
তীব্র একপেশে হাসল শত্রু কথাটায়। খসখসে কণ্ঠটা জবাব দিলো ধীর-স্থির,
“ পুষ্পিতা!”
ওমনি চমকে ওঠে সকলে। শাফিন আর্তনাদ করে বলে,
“ কী?”
মিরাজ হৈচৈ বাঁধিয়ে বলল,
“ পুষ্পিতা? মানে ওই মেয়েটা না,রাহাতের বোন? তুই,তুই কীভাবে জানলি? আর ও কীভাবে এলো এখানে?”
তীব্রর উত্তরের আগেই, শাফিন খেই হারিয়ে বলল,
“ তুইত বলেছিলি মেয়েটাকে খুঁজবিনা। সময় নেই। তাহলে? আর এই পাঁচদিনের মধ্যে কীভাবে পেয়েছিস? ”
তীব্র খুব আরমসে বসে। লেশমাত্র উদ্বেগ নেই চেহারায়। বলল,
“ প্রথমে তাই চাইছিলাম । কিন্তু তুই এত কান্নাকাটি করলি , না খুঁজে পারিনি। ”
শাফিন সন্দিহান কণ্ঠে বলল ,
“ তাই? তুই সত্যিই আমার জন্যে করেছিস?”
তীব্র ভ্রু নাঁচাল,
“ এছাড়া? আর কোনও কারণ আছে তোর কাছে? আবার আহাম্মকের মত বলে বসিস না,আমি মেয়েটার প্রেমে পড়ে এসব করলাম। ”
মুশফিক এটাই বলতে চাইছিল। জ্বিভ থেকে খসার আগেই তালা ঝুলিয়ে দিলো তীব্র। সে চুপটি করে চোরের মত গিলে ফেলল কথাটা।
আরমান অবাক হয়ে বলল,
“ কিন্তু এত বড় শহরে,এত দ্রুত পেলি কী করে?”
“ আমি তীব্র রেজা তালুকদার আরমান! গাছের শিকড় সমেত তুলে আনতেও এক সেকেন্ড লাগেনা।”
দর্পযুক্ত বাক্যটায় আরমান মাথা ঝাঁকাল। প্রকাশ পেলো তার নীরব সম্মতি। শাফিন বারবার ঘাড় ঘুরিয়ে বাড়িটাকে দেখছে। ওর চোখের ভাষা ভিন্ন।
তীব্র ফোস করে শ্বাস ফেলে বলল,
“ মেয়েটির কলেজে লোক লাগিয়েছিলাম। সে অনুযায়ী এ অবধি পৌঁছেছি। মেয়েটা এখন ওর বান্ধুবি আর তার মায়ের সাথে থাকে। তিন তলার প্রথম বাসাটাই ওদের। ”
ওরা কথাগুলো শুধু শুনলোই না,সাথে ফ্যালফ্যালে নেত্র ঝাপটে তীব্রকে দেখছে। বন্ধুর লম্বা হাতের ব্যাপারে তারা জ্ঞাত। অথচ আজ যেন বিন্দুমাত্র সন্দেহেরও জায়গা রাখেনি তীব্র। পাঁচদিনে পুরো জ্ঞাতিকূল জেনে নিলো যে,তাকে নিয়ে সন্দেহ করবে কার সাধ্যি?
শাফিন বাড়ির দিক চোখ রেখে,ঠোঁট নেড়ে বলল,
“ এখন তাহলে আমরা কী করব? যাব ভেতরে?”
“ না।”
শাফিন ফিরে চায়, “ তবে?”
তীব্র নিশ্চুপ। এই কথার জবাব দেয়নি। তবে অপ্রস্তুত বন্ধুদের পেছনে হেলে দিয়ে, টান বসাল জিপে। দালান ছেড়ে, কিছুটা সামনে গিয়ে থামাল এবার। পিছু চেয়ে একবার রংচটা নিবাশে চোখ বোলাল। দুই অক্ষিতে তার কিছু আছে। ভীষণ গাঢ় আর অন্যরকম কিছু।
****
নূহা আজ ব্যস্ত। রান্নাঘর-বসার ঘরে নিরন্তর ছোটাছুটি চলছে। আর এই ছোটাছুটি খুব মন দিয়ে দেখছে পুষ্পিতা। নুহা তাকে বসিয়ে রেখেছে খাবার টেবিলের এখানে। কড়া করে বলেছে,
“ তোর রান্নাঘরে উঁকি দেওয়াও বারণ। ”
কাল থেকে ইউটিউবে একটা রান্নার রেসিপি দেখে দেখে মুখস্থ করেছে নুহা। ইটালির বিখ্যাত একটি পদ।
সকালে নাস্তা খেতে বসেই,মা আর পুষ্পিতার সামনে সগৌরবে ঘোষণা দিয়েছে,এই রান্না সে নিজের হাতে করে খাওয়াবে আজ।
পুষ্পিতাও পুতুলের মত বসে রয়েছে তাই। কিন্তু নুহা পড়েছে বিপদে। এমন ভাব নিয়ে ঘোষণা দেওয়াটা একদম উচিত হয়নি ওর। এখন যদি সব কিছু পার্ফেক্ট না হয়,তখন ইজ্জ্বত থাকবে?
সমস্যাটা যদিও সেখানে নয়,সমস্যা হলো রান্না করতে গিয়েই সে আবিষ্কার করেছে, যা যা লাগবে তার অনেক কিছুই বাড়িতে নেই। থাকার কথাও না। এ রকম হিজিবিজি রান্নাতো পূর্বে বাড়িতে হয়নি।
মা ছুটির দিন বাঙালী রান্না করেন। মাঝেমধ্যে ক্লান্ত লাগলে শুয়ে-বসে বিশ্রাম নেন। বুয়ার রান্নাই খেতে হয় তখন।
সে নিজেও চা-কফি বানানো ব্যাতীত ওখানে যায়না। তাহলে কী নেই,কী আছে কীভাবে জানবে?
এই নিয়ে দারোয়ান কে নুহা দুবার সুপার শপে পাঠিয়েছে।
কিন্তু শেষবার খেয়াল করল,টমেটো, আর সয়া-সস আর লেটুস পাতা নেই। নুহা আহত হলো ফ্রিজ ঘেঁটে। শেষে, শ্রান্ত ভঙিতে এসে পুষ্পিতার পাশের চেয়ারে ধপ করে বসে পড়ল।
গালে হাত দিয়ে, হতাশ কণ্ঠে বলল,
“ আমার আর রান্না করা হোলো না রে!”
পুষ্পিতা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল,
“ আমি রান্না করে দেই?”
“ তুই পারবি না। আর এটাতে অনেক কিছু লাগবে। সবই আনালাম,কিন্তু আসল যেটা লাগবে সেটাই নেই। এখন দারোয়ান চাচাকে দোকানে পাঠাব কীভাবে? দুবার গিয়েছেন,এবার গিয়ে কিছু বললে চেঁতে যাবে। আম্মুকে নালিশও করতে পারে।”
পুষ্পিতা বলল,
“ তাহলে এখন কী করবি? আচ্ছা আমরা এখন অন্য কিছু রান্না করি, পরে না হয়….”
নুহা উঠে দাঁড়িয়ে গেল। দৃঢ় গলায় বলল ,
“ না। নিশিতা নুহা যখন একবার ঠিক করেছে সে রাঁধবে তখন সে রাঁধবেই। তাতে যাই হয়ে যাক।”
পুষ্পিতাও দাঁড়াল ওর দেখা-দেখি। বলল,
“ কিন্তু বললিতো অনেক কিছু নেই…”
“ নেইতো কী? তাই বলে থেমে যাব? আমি যাব নীচে। নিয়ে আসব যা যা লাগবে। চল…”
পুষ্পিতা ভীত কণ্ঠে বলল,
“ আমি? আমিও যাব?”
“ তো কী আমি একা যাব? তোকে এভাবে বাড়িতে রেখে?”
“ কিন্তু আন্টি যে মানা করলেন আমাকে বাইরে যেতে।”
নুহা মাছি তাড়ানোর মতন হাত নেড়ে বলল ,
“ আরে ধুর! তোর আন্টি কি অফিস বসে দেখবে যে আমরা বের হয়েছি? নাকী বাসায় সিসি ক্যামেরা লাগানো? আমরা যাস্ট যাব,উপকরণ গুলো কিনব,আর চলে আসব। কোথাও দাঁড়াবও না।”
পুষ্পিতার চিন্তাটুকু তাও কমে না। যেখানে নূহার মা নিজে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে গেলেন,সেসব অমান্য করবে ভাবতেও পারছে না ও। কিন্তু এত কিছু নুহার কানে -মাথায় ঢুকল না। সে নিজের মত পার্সে টাকা ভরে ওকে টেনে-টুনে নিয়ে বের হলো। সদর দরজা পেরোতেই পুষ্পিতার বুক ধুপধাপ শুরু হয়। আচমকা বিষয়টায় ও নিজেই চমকে ওঠে। যেন সম্মুখে কিছু ঘটবে। জানার মাঝেও অকল্পনীয় অজানা কিছু একটা!
****
নাহিদ গাড়ি থেকে নেমেছে। তার খিদে পেয়েছে ভীষণ। যাওয়ার আগে বন্ধুদের জিজ্ঞেস করল, “ কে কী খাবি?”
প্রস্তাব শুনতেই একেকজন উৎফুল্ল হয়ে পড়ল। চারজন মিলে একটা ছোট-খাটো খাবারের ফর্দ্য মুখে মুখে বলে ঝুলিয়ে দিলো ওর সামনে। কোক থেকে শুরু করে একটা চিপস ও বাদ গেলনা। নাহিদের চেহারা শুকিয়ে এলো ওমনি। কিছু না বলে,তীব্রকে জিজ্ঞেস করল যখন, সে সরাসরি শুধাল,
“ পকেটে টাকা আছে?”
নাহিদের পকেট আসলেই ফাঁকা। গড়ের মাঠ নাহলেও যা আছে তাতে যুতসই বাজেট হয়না। মিরাজ ওরা যেই হাড়ে খাবারের কথা বলল ওসব তো আরোই না।
তীব্র তার মুখায়ব পরোখ করেই বুঝে ফেলল বিষয়টা। নাহিদ এমনিতেই বেকার! বাবার হোটেলে খায়-দ্বায়। আজ সপ্তাহ-খানেক সেখানেও যায়নি। টাকা আসবে কোত্থেকে?
নাহিদ ভেজালহীন ছেলে! তীব্রদের সাথে আজ অবধি কোনো মা*রামারি-কা*টাকা*টিতে সে থাকেনি। র*ক্ত দেখলেই উলটে পড়ে যেখানে,সেখানে তাকে নিয়েও বা কী লাভ!
তীব্র জানে,নাহিদ জীবনেও ওদের নাম ভাঙিয়ে দোকান থেকে বিনামূল্যে কিছু নেবেনা। ও অন্য রকম! ভদ্র, শুধু ওদের সঙ্গে মেশে বলেই নাম উঠেছে বখাটের খাতায়।
তীব্র চুপচাপ মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করল। দুটো নোট হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
‘’ আমার জন্য একটা স্প্রাইটের ক্যান, ঠান্ডা!”
নাহিদ আপ্লুত চোখে তাকাল। পরপর মুচকি হাসল কৃতজ্ঞতায়।
তীব্র বাইরে থেকে যাই হোক,যেমনই হোক, ওর ভেতরটা কেবল ওর সাথে মিশলে বোঝা যায়। আর এই সুপ্ত তথ্যটুকু ওদের বন্ধু গোষ্ঠী ব্যাতীত কেউ জানেনা। হয়ত তীব্রর বাবাও না।
আর ছেলেটার অমন চরিত্রের জন্যেই নাহিদ ওর পিছু ছাড়তে পারল না। নিজে সভ্য হয়েও বখাটে তীব্রর সাথ দেওয়ার মধ্যে অন্যরকম আনন্দ পায় সে। সেবার,কলেজে থাকাকালীন একবার বাবা খুব মে*রেছিলেন, তাও তীব্রর সাথে আড্ডায় দিতে দেখে। নাহিদ মুখে বলেছিল ‘আর মিশব না ওর সাথে,’ কিন্তু সেই কথা আজও রাখেনি।
কেন রাখবে? যে তীব্র বন্ধুদের সব বিপদে নির্দ্বিধায় পাশে দাঁড়ায়,তাকে ছেড়ে যাওয়া পাপ। এইযে ও চাইল বলে, মিথিলাকেও আনতে গেছিল। এমন বন্ধুর সঙ্গ ভদ্রতার দোহাই দিয়ে ত্যাগ করা যায়? তীব্রর জন্যে ও যে জান দিতেও তৈরী।
নাহিদকে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে দেখে তীব্র চোখ ছোট করল,
“ হা করে কী দেখছিস? যা।”
ছেলেটা প্রণিধান হতে নড়েচড়ে ওঠে,
“ হু? হ্যাঁ যাই।”
নাহিদ প্রস্থান নিতে না নিতেই তীব্র বন্ধুদের দিক ঘাড় ঘোরাল। রে*গে-মেগে বলল,
“ তোদের মাথায় কি ঘিলু বলে কিছু নেই? নাহিদের অবস্থা জানিস না? তাহলে হাভাতের মতন লিস্ট দিলি কেন? আমি তোদের না খাইয়ে রাখি?”
তিনজন চুপ। মিরাজ মিনমিন করে বলল,
“ আমি তো একটু মজা করছিলাম। তবে ওরা কেন এমন করল আমি বাবা জানিনা।”
মুশফিক ওরা ক্ষে*পে তাকাল। মিরাজ চোরের মত মুখ করে চেয়ে থাকল আরেকদিক।
তীব্র কটমট করে ফের কিছু বলতে যায়। আবিল অক্ষি আচমকা বিক্ষিপ্ত ভাবে নিক্ষেপ হয় জিপের ভিউ মিররের ওপর।
সহসা কণ্ঠনালী রুদ্ধ হয়ে থেমে গেল তীব্র। থামল তার অসম্পূর্ণ কথাটুকুন৷
পুষ্পিতা আসছে। সাথে ছায়াসঙ্গী নূহা। জিপের কাচে ফুটে আছে তার পরিষ্কার বিম্ব। পড়নে কুচকুচে কালো চুরিদার। সুতির ওড়নাটা পিঠ থেকে পেঁচিয়ে এনে, মাথার চুলটাও আবৃত। সেই কৃষ্ণবর্ণ রঙ হতে বেরিয়ে আছে অতীব শুভ্র-আদুরে বৃত্তাকার মুখখানি৷
চঞ্চলতাহীন দুই চোখ রাস্তার যানবাহন দেখতে ব্যস্ত।
মাঝে-মধ্যে নুহার দিকেও ঘুরছে। ঠোঁট নেড়ে নেড়ে এটা-সেটা বলছে।
তীব্র চেয়ে থাকে। আরশির ওপরে তার ঘোলাটে আঁখির সবটুকু নিবেশন। একটা সময় বক্ষ ফুলেফেঁপে, চোখ বুজে শ্বাস ফেলল।
খুব আস্তে বাকীদের উদ্দেশ্যে বলল,
“ মেয়েটা আসছে।”
তীব্রর মেয়েটা বলে উদ্দেশ্য করা মানবীটির পরিচয় আলাদা করে দিতে হোলো না। বিগত দিনগুলোয় এতবার শুনেছে সবাই,মুখস্থ এখন।
শাফিন তত্র লাফিয়ে শুধাল,
“ কই, কই?”
“ পেছনে।”
এক যোগে তাকাল ওরা। পুষ্পিতাকে দেখতেই চিনে ফেলল। আরমান বলল,
‘“ এখন কী করব? আমরা কি আবার ওকে কিডন্যাপ করে নিয়ে যাব? নাকী ভালো ভালো ব্যবহার করে বাড়ি ফেরার কথা বলব?”
এদিকে নুহা বকবক করছে। সে আসলেই ভরাডু*বি দুশ্চিন্তায়। প্রেসটিজ যে করে হোক বাঁচানো চাই।
বলল,
“ আমার তো কাচা টমেটো লাগবে রে পুষ্পিতা! সব ভ্যান দেখি পাঁকাটা দিয়ে ভর্তি!”
পুষ্পিতাও আশেপাশে খুঁজছে। কোনও সব্জির ভ্যানেই কাচা টমেটো নেই। নুহার একটা সময় চোখ পড়ল রাস্তার ওই পাড়ের ভ্যানে গুলোতে। খুব সামান্য পাঁক ধরেছে টমেটো ভর্তি একটা ভ্যান দেখেই বলল,
“ ওইত! চল…”
পুষ্পিতা একটু শঙ্কিত। ছোট থেকে শহরে বড় হলেও,একা একা চলেনি। এরকম ব্যস্ত রাস্তা পার হতে ভেতর ভেতর ভ*য় পাচ্ছে ও।
নুহা বিষয়টা বুঝল। নিজেই বলল,
“ আচ্ছা এক কাজ কর,তুই এখানেই দাঁড়া। আমি যা যা লাগে নিয়ে আসি। ”
“ ইয়ে, আমি একা দাঁড়িয়ে থাকব?”
“ রাস্তায় এত লোক,আর বলছিস তুই একা? আমি যাব আর আসব। তাও তোর দাঁড়িয়ে থাকতে মন না চাইলে,আশেপাশ থেকে যে সব্জি ভালো লাগে নিতে থাক। আমি এসে টাকা দিচ্ছি। কেমন?”
পুষ্পিতা বাধ্যের মত ঘাড় হেলাল। নুহা ওকে রেখে চলে এলো এ পাড়ে।
তীব্রর পো*ড়া ঠোঁটদ্বয় ওমনি উঁচুতে উঠে যায়। সূক্ষ্ণ সূক্ষ্ণ হাসল সে। একটু আগে করা আরমানের প্রশ্নের জবাব দিলো না। তৎপর জিপের দরজা খুলে নেমে গেল।
শাফিন বলল, “ কোথায় যাস?”
‘“ আসছি।”
তীব্র সম্মুখে এক পা বাড়িয়েও থামল। থুত্নীতে হাত ঘষে ঘষে কিছু একটা ভাবল। তারপর আবার ফিরে এলো জিপের নিকট। ওরা চেয়েছিল ওর দিকেই। সবচেয়ে বেশি মনোযোগী ছিল মুশফিক। তীব্র এসেই ওর মাথার ক্যাপে টান বসায়। ছেলেটা কিছু ভড়কাল।
বিস্ময়ে চোখ পিটপিট করল। তীব্র ক্যাপটা মাথায় গুঁজল নিজের। সিটের ফ্রন্ট প্লেস থেকে একটা ওয়ানটাইম মাস্ক নিয়ে নাক-মুখ ঢাকল।
দুটো জিনিসের ব্যাবহারে, মুহুর্তে বেশ পালটে গেল ওর। ফেরত গেল সেই রাতের নারী অপহরণকারী বিট্টু মাস্তান রূপে।
শাফিন ওরা বিহ্বল চোখে চেয়ে থাকে। সাথে প্রচন্ড বিভ্রমে হাবু*ডুবু খায়।
বিট্টু আবার এই বেশ নিয়েছে কেন?
তবে তীব্র এসব আমোলে নিলো না। বন্ধুরা প্রশ্ন করবে,সে সময় অবধি দিলো না। লম্বা পায়ে তড়বড়িয়ে হেঁটেই চলে গেল রাস্তার ও-পাশটায়।
আরমান সেদিক চেয়ে বলল,
“ কী ব্যাপার বলতো, বিট্টুর হাবভাব কিছু বুঝছিস তোরা?”
মুশফিক-মিরাজ সম-সঙ্গে মাথা নাড়ল। বলল,
“ না রে ভাই! ও কী করছে ওই জানে। কিছু তো বলছেও না। এত রহস্য রাখছে কেন? এত রহস্য দিয়েতো একটা ওয়েব সিরিজ বানানো যাবে।”
শাফিনের কপালে ভাঁজ পড়েছে। তীক্ষ্ণ তার চাউনী। তীব্রর চাল-চলন বেশ সন্দেহজনক! ওদের সামনে অনীহার ভাণ করে,অথচ ভেতর ভেতর যেন ওর আগ্রহই সবচেয়ে বেশি। এই যে নেমে গেল, পুষ্পিতার কাছে গিয়ে দাঁড়াল, এসব কেন? কেনই বা একা একা ওদের না জানিয়ে মেয়েটাকে খুঁজে বার করেছিল ও?
***
নাহিদ বন্ধুদের হুকুম মতো সব স্ন্যাকস একটা বড় পলিথিন ভরে নিয়ে এসেছে। ড্রাইভিং সিট খালি দেখে বলল,
“ বিট্টু কই?”
তার প্রশ্নের উত্তর এলো না। দেখা গেল, চারজন একেক ধ্যানে নিবেশিত। শাফিন তাকিয়ে তীব্রদের দিক। আর মিরাজ, মুশফিক, আর আরমানের নজর অন্য কোথাও। নাহিদ ওদের দৃষ্টি অনুসরণ করে নিজেও তাকাল।
একটি মেয়ে ব্যাতীত তেমন কিছু না পেয়ে বুঝে নিলো যা বোঝার। দুপাশে অতীষ্ঠ ভঙিতে মাথা নাড়ল সে।
ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভা*ঙে। বদমাশ গুলো এখানে এসেও এসব শুরু করে দিয়েছে?
তীব্রর জিপের কাছেই একটা বড় স্টেশনারী শপ। নুহা সেখানেই এসেছে মশলা আর সস নিতে।
ভোরের ভারী বর্ষণের পর নেমে আসা হাল্কা পাতলা শীতের তাপে, একটা পাতলা চাদর গায়ে জড়ানো ওর। যেটা এইসময় ওদের তিনজনের নিকট হাস্যকর মনে হলো।
মুশফিক ওকে শুনিয়ে, টেনে টেনে বলল,
“ আহারে! শীত শীত লাগে বুঝি? ”
মিরাজ বলল,’ হ্যাঁ ভাই
উহুউউউউ… ”
তারপর গান ধরল, “ বড় শীত শীত লাগে আমার,একা থাকা যায়না। আমার কাছে আগুন আছে পাশে আয় না।”
নুহা সব শুনছিল। গানের ইঙ্গিত বুঝেই,চোখ পাঁকিয়ে তাকাল। এতে ওদের বিশেষ কিছু যায় এলে তো? উলটে, আরমান বুকে হাত দিয়ে সুর করল,
“ ওরম তাকিওনা,আমি ক্যাবলা হয়ে যাই।”
নুহা আশ্চর্য বনে গেল। কী সাংঘাতিক লেভেলের অসভ্য এগুলো!
আরমানের গান শুনে, মুশফিক-মিরাজ সশব্দে হেসে ওঠে। কিন্তু নাহিদের এসব কোনওকালেই পছন্দ নয়। সে চাপা কণ্ঠে বলল,
‘“ এরকম করছিস কেন তোরা? মেয়ে দেখলেই তোদের ফাজলামো শুরু।”
আরমান ধমক দেয়,
“ তুই চুপ থাক গরু। বেশি হাম্বা হাম্বা করিস না। ”
নাহিদের আদল সংকীর্ণ হলো। ফাজিল গুলোকে কথা শোনানো বা মানানো ওর সাধ্যে নেই। সে স্ন্যাকস ভর্তি পলিটা সিটের ওপর রেখে উঠে বসল ভেতরে।
তবে চেহারায় বিরক্তির স্পষ্ট চিহ্ন। মাঝে- মধ্যে এই ব্যাপার নিয়ে তীব্রর ওপরে বেজায় রাগ হয়। সে নিজে মেয়েঘটিত বিষয়ে জড়ায় না ভালো কথা, কিন্তু সাঙ্গপাঙ্গদের ও তো নিষেধ করতে পারে। ওর চোখের সামনে মিরাজ-রা এইভাবে মেয়েদের উত্যক্ত করে। অনেক সময় যা নয় তাই বলে। কিন্তু তীব্র সেসব দেখেও দেখে না। অথচ ওর এক কথাতেই এসব বন্ধ হতে পারত। ওর ওপর দিয়ে চলার মত সাহস কারো নেই। তাহলে তীব্র কেন এমন নির্লিপ্ত থাকে এসবে?
***
পুষ্পিতা শাঁক ভর্তি একটি ভ্যানের সামনে দাঁড়িয়ে। মন দিয়ে লাউ শাঁকের আঁটি দেখছে। এর আগে তার বাজার করার অভিজ্ঞতা নেই। খোরশেদুলই বাজার করতেন,তাই আজই প্রথম সে নিজে কিছু কিনবে।
তবে রান্না-বান্নার জন্য টাটকা সব্জি চেনে।
তার নিবিষ্ট ধ্যান একটুও লক্ষ্য করেনি তীব্রর কেবলই পাশে এসে দাঁড়ানো।
সে যখন সতেজ সব্জি বাছা-বাছিতে ব্যস্ত,তীব্র সরু চোখে চেয়ে।
আজকের পুষ্পিতা আর সেদিনকার পুষ্পিতাতে যেন বিস্তর ফারাক। তীব্র অতি নৈকট্যে তার আপাদমস্তক দেখল। দুটো ক্ষুদ্র, গভীর দৃষ্টি খুঁটে খুঁটে ঘুরে এলো ওর সমস্ত চেহারায়। সেদিন রাতের ভয়া*র্ত নেত্রদ্বয়ের চাউনী আজ বড় সাবলীল। ওইসময়ে,আত*ঙ্কে জুবুথুবু মেয়েটার রাঙা ঠোঁট, একটার ওপর আরেকটা চেপে বসেছে। আঁকাবাকা ভ্রুতে গুটিকয়েক ভাঁজ। ক্ষণে ক্ষণে বৃষ্টির ফোঁটার ন্যায় টুপটুপ করে নেত্রপল্লব ফেলছে । নরম রোদের তীর্যক আলোটা সরাসরি মুখের ওপর পড়ায়,চিকচিক করছে গায়ের রং।
তীব্রর সুগভীর ধ্যানের মাঝেই,পুষ্পিতার রিনরিনে স্বর কানে বাজে।
“ শাঁক কত করে?”
“ ত্রিশ টাকা।”
“ ত্রিইইশশ টাকা? বিশ টাকা রাখা যায়না?”
“ না আপু।”
তীব্রর টানটান শৈলপ্রান্ত গুছিয়ে এলো ওমনি। অবাক হলো ভীষণ! ত্রিশ টাকা থেকে বিশ টাকা? দশ টাকা দিয়ে কী হবে? অথচ, এ মেয়ে এমন টান বসিয়েছে দাম শুনে,যেন তিন হাজার টাকা বলেছে।
“ আচ্ছা পঁচিশ টাকা দেই?”
ছেলেটি দুপাশে মাথা নাড়ল। বোঝাল, কম হবে না। হঠাৎ খেয়াল পড়ল তীব্রকে। জিজ্ঞেস করল,
“ ভাইয়া কিছু নেবেন?”
পুষ্পিতা সহজ চোখে ঘাড় ঘোরায়৷ পাশের মানুষটি কে,নিতান্ত সেই কৌতূহলে। অথচ মাস্ক/ক্যাপ পরূয়া পরিচিত লোকটিকে দেখতেই, আঁতকে উঠল । বক্ষপট ধ্বক করে কাঁপল গতিতে।
তীব্র ছেলেটিকে জবাব দিতে চেয়েও,ওর তাকানো দেখে থামল। সেই রাতের পর এই নিভু নিভু উষ্ণ দুপুরের মধ্যে আরো একবার চোখাচোখি হলো দুজনের। পুষ্পিতার ভীত,ভ্রান্ত দৃষ্টিতে, পুনরায় মিশে গেল,তীব্রর পূর্ন অস্বচ্ছ দৃষ্টি।
পুষ্পিতা একবার দেখেই ওকে চিনে ফেলেছে ।
সাথে সাথেই ওর মনে পড়ে গেল মিথিলার বিয়ের রাতটা। তারপর ওই জঘন্য সকাল! তার ঠোঁট ফুঁড়ে আপনা-আপনি বেরিয়ে এলো কিছু শব্দ। কণ্ঠে ভূমিকম্প…
“ বববিটট্টু মমায়ায়াস্তান!’’
তীব্র অবাক হলো না। সে জানত মেয়েটা এই রূপে ওকে দেখলেই চিনবে। তবে লক্ষ্য করল পুষ্পিতার চোখ-মুখ ফ্যাকাশে হয়ে আসছে। যেন রক্তশূন্যতায় ভোগা মুমূর্ষু রোগী!
আত*ঙ্কে থরথর করছে ওর হাত- পা। তীব্রর শক্তপোক্ত গড়ন ফেঁপে ওঠে সবেগে। শান্ত মেজাজ চটে আসে ভীষণ।
এত ভ*য় পাওয়ার,কাঁ*পা-কাঁ*পি করার কী হোলো? সেতো কিছু বলেইনি এখনও।
পুষ্পিতা ঢোক গিলছে ভ*য়ে। তার মাথায় ঘুরছে সেদিন গাড়িতে বসে তীব্রর ছুড়ে দেওয়া সেই হুমকিটা…
“ ভুল করে এনেছিলাম বলে নিজে পৌঁছে দিচ্ছি। যদি এ নিয়ে কোনও ঝামেলা হয়,বা পরিবারের লোকজন আঈনী কোনও ইস্যু ক্রিয়েট করে,পরেরবার কিন্তু আর ফেরত দিতে আসবনা। ”
এই গুন্ডাটা আবার এসেছে কেন? কী করে জানল ও এখানে? কোনও ভাবে কী মণি থানা -পুলিশ করেছে ওকে না পেয়ে? গুন্ডাটা কী সেজন্যে আবার ওকে তুলে নিতে এলো? পুষ্পিতার চোয়াল ঝুলে পড়ল ভেবেই। এবার যদি ওকে নিয়ে যায়, তাহলে তো আর ফেরত দেবেনা। যা খুশি তাই করবে ওকে নিয়ে।
পুষ্পিতার বুক ধড়ফড় করছে। এদিক-ওদিক এলোমেলো ঘুরছে শঙ্কিত নয়ন। এক পা, এক পা করে পিছনে যাচ্ছে সে। হাবভাবের অমন দশা দেখে তীব্রর ভ্রুদ্বয় আরো এঁকে বেঁকে এলো। রা*গটা তুঙ্গে উঠল অচিরে। বরাবরের কর্কশ কণ্ঠটা,আরো চড়া করে বলল,
“ এই মেয়ে,এত ভ*য় পাওয়ার কী আছে? আমি কি…. ”
পুষ্পিতা তাকে পুরো কথা শেষ করার সুযোগ দিলো না। তীব্রর ‘এই মেয়ে’ শুনেই রুহু উড়ে গিয়েছে। কলিজা ছলাৎ ছলাৎ করছে। ষষ্ঠইন্দ্রিয় বলছে এখানে থাকা বিপদ। পালাতে হবে,অতিসত্ত্বর গুন্ডাটার সামনে থেকে পালাতে হবে। তীব্রর কথার মধ্যখানেই দুরন্ত পায়ে ছুট লাগাল সে।
তীব্র ভ্যাবাচেকা খেল। হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইল। রাগে গজগজ করে উঠল সমস্ত দেহ।
পুষ্পিতার ছোটার প্রকোপে মাথার ঘোমটা খসে পড়েছে। পিঠের ওপর মোটা ঝুটিটা উন্মুক্ত। হাওয়া আর দৌড়ানোর কারণে দোলনার মত দুলছে দুদিক।
চেয়ে থেকে থেকে এই সামান্য বিষয়টাও মনযোগ খাঁটিয়ে দেখল তীব্র। হুট করেই সাধারণ ব্যাপার খানা মনের ভেতর ঢুকে গেল ওর । কমে গেল রাগ। গুঁটিয়ে থাকা ভ্রু টানটান করে আচমকা হেসে ফেলল সে। দন্তপাটি মুক্ত করা সুন্দর হাসি। সাথে কণ্ঠফুড়ে বেরিয়ে এলো কতক ঝরঝরে আওয়াজ।
বিড়বিড় করে বলল,
“ তীব্রর নজর যখন পড়েছে, মেয়ে পালিয়ে যাবে কোথায়!”
চলবে……………