কলমে: নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
(১৩)
এক ঝাঁক সোনালী রোদ্দুর আর ভোরের শান্ত আবহের মাঝে তীব্রর ছাদবিহীন লাল জিপ ছুটছে। এখনও সেই চিরাচরিত বন্ধুরা সাথে।
এয়ারপোর্ট থেকে ফিরছে তারা। শাফিনের ফ্লাইটের সময়-সূচী আজ। মায়ের উন্নত চিকিৎসা হেতু ভারতের পথে উড়াল দিয়েছে সে । সকাল সকাল তীব্ররা দলবেঁধে সেখানেই গিয়েছিল বন্ধুকে বিদায় জানানোর জন্যে।
শাফিন থাকলে সব সময় পেছনে বসত মিরাজ। আজ জায়গা পেয়েছে তীব্রর পাশের সিটে। তার মেজাজ চনমনে। সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে শীস বাজছে গলায়।
তীব্রর নজর রাস্তায়। এই সময় পথে যানবাহন স্বল্প হওয়ার কথা হলেও, পোর্ট এড়িয়ায় গতানুগতিক জ্যাম। তার ফর্সা মুখবিবর স্ফীত । ঘুম হচ্ছে না কিছুদিন। কোনও এক অমোঘ চিন্তায় মস্তকের সমগ্র কোষ ব্যস্ত হয়ে থাকে। কতক অব্যবস্থ ভাবনা, স্নায়ুতে দাঁপিয়ে বেড়ায় নিরন্তর।
তন্মধ্যে, নাহিদ মন খারাপ করে বলল,
“ শাফিন যাওয়ার সময় মুখটা কেমন করে রেখেছিল দেখেছিস? মনে হচ্ছিল কেঁ*দে দেবে। আমাদের ছেড়ে যেতে হয়ত খারাপ লাগছিল বেচারার!”
বিপরীতে ফোস করে শ্বাস ফেলল মুশফিক। শাফিনের মন খারাপের সঠিক হদিস,সে যে একটু হলেও জানে।
প্রসঙ্গ কা*টাতে আবদার ছুড়ল,
“ বিট্টু চা খাব। একটা টঙ দেখে থামাস তো। মাথাটা ধরেছে খুব!”
আরমান জানাল, “ আমারও।”
মিরাজ কেমন খ্যাক করে উঠল,
“ মাথা থাকলে ব্যথা করবেই। এর জন্য যেখানে সেখানে চা খেতে হবে? এরকম হলে বগলে ফ্লাস্ক নিয়ে ঘুরবি। আপাতত বাড্ডায় কাজ আছে আমার। তাড়াতাড়ি যেতে হবে।
পরপর ফোসফোস করে বলল,
“মঞ্জু নামের এক মা**** এলাকায় নতুন সেলুন বসিয়েছে। কোত্থেকে এসছে কে জানে! ব্যাটার কথা জানিনা,তবে সাগরেদের কলিজা বিশাল। নান্নু কে দিয়ে এ মাসে চাঁদা আনতে পাঠিয়েছিলাম, দিলো না। ওর সেলুনের কাঁচ না ভা*ঙা অবধি আমার শান্তি হচ্ছেনা বিট্টু!”
মুশফিক মস্তক ঝুলিয়ে বলল,
“ হু। ঢাকায় নতুন মনে হয়। আমাদের চেনেনা ওইজন্য! ভাবিস না, বায়োডেটা পেলেই আপনা আপনি টাকা দিয়ে যাবে।”
তীব্র শুধাল, “ কত নম্বর গলিতে?”
আরমান উদ্বেগ নিয়ে বলল,
“ একেবারেই ভেতরের দিকে। শপিং সেন্টার আছে না? ওটার উল্টোপাশের গলির শেষ মাথায়। ওইহজন্যেইত এতদিন দেখিনি। এসেছে নাকী সপ্তাহ খানেক। যাক গে,এসব ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে তুই ভাবিস না,আমরা আছিতো।”
তার জবাব এলো,
“ কাল থেকে আমি এমনিতেও বাড্ডায় থাকব না।”
চকিতে চাইল সবাই। মিরাজ হূলস্থুল বাঁধিয়ে বলল,
“ থাকবি না? থাকবিনা মানে?”
“ গাজীপুর যাব।”
“ সেতো জানি। কিন্তু শহরে থাকবিনা কেন? তুই কি ওখানে পার্মানেন্টলি যাচ্ছিস?”
চোখ বড় বড় করে বলল আরমান।
“ জানিনা। টেম্পোরারি গেলেও সময় লাগবে। তবে সপ্তাহে দু-তিনবার আসব এখানে। ততক্ষণ তোরা সামলাবি।”
মুশফিক মাথা চুল্কায়। বলতে গেলে বন্ধুদের মধ্যে তার বুদ্ধি প্রখর। কিন্তু শক্ত তীব্রর পোক্ত কথা আপাতত ঘটে ঢুকছে না।
নাহিদ বলল,
“ তুইত সেদিন কিছুই বললি না। কী করবি কিছু ভেবেছিস?”
“ হু।”
ওরা আগ্রহভরে চাইল।
“ কী ভাবলি?”
তীব্র খুব গুছিয়ে বলল,
“ নাহিদের কথা ঠিক,পুষ্পিতার কাছে আমি মাস্তান। মেয়ে যা ভীতু,আমাকে দেখলে ভেগে যায় যেখানে,পছন্দ করি জানলে, না হার্ট অ্যাটাক করে ম*রে।”
তারপর বিড়বিড় করল, “ভীতু মেয়ে একটা!”
আরমান বলল, “ তাহলে এখন?”
তার ছোট,নিরুদ্বেগ উত্তর,
“ ভদ্র হব।”
কথাটায় পুষ্পিতার নয়, মাইক্রোমিটার বেগে এট্যাক হলো ওদের। একেকজন মুখ থু*বড়ে হোচট খেল যেন। গোল গোল চোখে চেয়ে বলল,
“ ভদ্র হবি? তুই?”
তীব্রর অস্বস্তি দেখা যায় না। উল্টে বন্ধুদের প্রতিক্রিয়ায় মজা পেয়েছে। হাসল ঠোঁট কামড়ে।
কিন্তু খুশি হয়ে গেল নাহিদ। তীব্র ভালো হওয়া মানে, ওর আনন্দের সীমা নেই।
চকচকে নেত্রে চেয়ে বলল,
“ সত্যিই ভদ্র হয়ে যাবি বিট্টু? খুব ভালো হবে তাহলে। এই মাস্তানি- টাস্তানি তো এমনিতেও ভালো কথা নয় বল।”
তবে প্রভাব পড়ল বাকীদের ওপর। তারা তখনও হজম করতে পারেনি । কিয়ৎক্ষণ স্তব্ধ বসে থাকল তিনজন।
পরপরই, মিরাজ হাহা*কার করে বলল,
“ তুই একটা মেয়ের জন্য এতদিনের মাস্তানি ছেড়ে ভদ্র হয়ে যাবি? আমাদের এতদিনের নাম-ডাক, বিট্টু মাস্তানের গ্যাং সব শেষ করে দিবি? এ কী শোনালি বিট্টু…! না না, এ হতে পারে না। এ কথা শোনার আগে আমার ম*রণ কেন হোলো না…”
বলতে বলতে দুহাতে বুক চাপড়াল মিরাজ।
তীব্র সশব্দে ধমক দেয়,
“ থাম।”
ও থামল, কিন্তু মুশফিকও সমান দুঃখী গলায় বলল,
“ তুই সত্যিই সব ছেড়ে দিবি? আমাদেরও?”
তীব্র জিপের হুইল ঘোরাতে ঘোরাতে ঘাড় বাঁকায়। কপাল কুঁচকে বলে,
“ ছেড়ে দেব কখন বলেছি?”
মুশফিকের কথায় সতর্কতা,
“ এই যে বললি,ভদ্র হবি।”
“ ভদ্র হব বলেছি,সত্যিই হব না কী?”
আরমান বুঝতে না পেরে বলল,
“ মানে?”
চতুরের ন্যায় হাসল তীব্র। চোখের চাউনীতে স্বচ্ছ চালাকি লেপ্টে জানাল,
“ মিথ্যা মিথ্যে ভদ্র।”
চারজন মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। মুশফিক চোখ পিটপিট করে বলল,
“ মিথ্যে,মিথ্যে? সেটা কীভাবে?”
তীব্রর তপ্ত,স্পষ্ট স্বর,
“ বিট্টু মাস্তান থেকে তীব্র রেজা তালুকদার হব যেভাবে। ঠিক সেভাবেই।
তারপর ওদের দিক চেয়ে বলল,
“ তোরা জানবি আমি খারাপ,আমি জানব আমি খারাপ। গোটা ঢাকা শহর জানবে বিট্টু খারাপ। শুধুমাত্র পুষ্পিতা জানবে, তীব্র রেজা তালুকদার ইজ অন অফ দ্যা বেস্ট জেন্টেলম্যান ইন দ্য ওয়ার্ল্ড!”
সবাই শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। পুরো কথাটাই মাথার ওপর দিয়ে গেল। নাহিদ কৌতূহলে গলা ভিজিয়ে শুধাল,
“ তা কী করে সম্ভব?”
তীব্র চোখ ছোট করল,
“ কেন? কাল তুই বললি না, আমি মাস্তান জানলে ও উল্টোপথে পালাবে? সেজন্যেই এমন বুদ্ধি করেছি,মেয়ে পালাবে না,দিনে তিনবার সালাম ঠুকবে আমায়।”
আরমান বোকা বোকা কণ্ঠে বলল,
“ সেতো তোকে সবাই এমনিতেই সালাম দেয়। মেয়েটার সালামে এমন কী এসে যাবে…! ”
তীব্র বিদ্বিষ্ট হয়ে বলল,
“ গর্দভ! যা বুঝিসনা তা নিয়ে কথা বলিস কেন?”
সে ঠোঁট ওল্টায়,
“ আমার কী দোষ? তুই আজকাল এত পেঁচিয়ে কথা বলছিস, কীভাবে বুঝব? তুইত এমন ছিলি না রে ভাই। একটু সোজা করে বল না!”
তীব্র কটমটে কণ্ঠে বলল,
“ আমি যে কতগুলো আহাম্মক পুষছি তোরা তার প্রমাণ!”
( একটু থেমে)
“ এনি ওয়ে, খুব শীঘ্রই আমি পুষ্পিতার নতুন ভার্সিটিতে জয়েন করছি, লেকচারার হয়ে।”
এ কথা যেন কোনও কথা ছিল না, ছিল বিকট শব্দে বাঁজ আছডে পড়ার আওয়াজ। সবেগে মাথা ভোঁ ভোঁ করে চক্কর কা*টল ওদের। কোটর রেখে বেরিয়ে এলো চোখ। সমস্বরে চিৎকার করে বলল,
“ কীইইইইইই?”
মিরাজ আওড়াল, “ লেকচারার?”
মুশফিক বলল, “ভার্সিটির?”
আরমান বলল, “তাও বিট্টু!”
নাহিদ হতবাক হয়ে বলল,
“ এ কী শুনলাম? এমন শক তো মিথিলার বিয়ে হওয়াতেও পাইনি।”
মিনিট কয়েক কেউ নড়ল-চড়ল না। তবে সবার চোখের সামনে অতীতের কিছু কথা, ছবির মতোন ভেসে ভেসে উঠল।
একবার পরীক্ষার হলে তীব্রর পাশে টপারের সিট পড়ে। সচেতন ছেলেটা,কিছুতেই নিজের খাতা দেখে ওকে লিখতে দেবেনা। এ নিয়ে বেশ রং তামাশা করল হলে। ইনভিজিলেটরকে নালিশ অবধি ঠুকল।
আর তারপর, যখন পরীক্ষা শেষে বের হলো,তীব্রর হাতের কারিশমায় নাক-মুখ ফাঁ*টিয়ে ঘরে ফিরল বেচারা। পরের পরীক্ষা গুলোয় কাহিনী উলটে গেল পুরোপুরি। প্রতিটা পরীক্ষায় তীব্রকে শুধু খাতা মেলে দেখানোই নয়,পারছিলনা নিজে ওর খাতায় লিখে দিতে। সেই ছেলে কীভাবে….!”
ওদের মাথা ঘোরা কমল না। মিরাজের মনে হল তার সামনে অন্ধকার নেমেছে। কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। তৎপর বোতল নিয়ে ছিপি খুলেই চোখে মুখে ঝাপটা দিল জলের। ঘন ঘন শ্বাস ফেলে আকাশের দিক মুখ করে বলল,
“ হে পৃথিবী! আজ যদি আমি মরে যাই তাহলে মনে রেখ,বিট্টুর দেয়া চমকের জন্য মরেছি। দয়া করে এমন ভ*য়াবহ চমকের সম্মুখীন আর কোনও অবলাকে কোরো না।”
মুশফিক বলল,
“ আমাদের ও মাথায় একটু পানি দেওয়া উচিত। সব কেমন ঝাপসা দেখছি৷ কানেও আবছা শুনছি।”
তীব্র রেগে-মেগে বলল,
“ এইজন্যেই তোদের কিছু বলতে চাইনা।”
মিরাজ তত্র ওর দিক এগোলো। উরু চিপতে চিপতে বলল,
“ না না ভাই বল! বাকীটা না শুনলে আজ মরলেও শান্তি হবে না আমার।”
নাহিদের বিষয়টা মোটেই ভালো লাগেনি। মিথ্যে মিথ্যে ভদ্র হওয়া তো কাউকে ঠকানো।
বলল,
“ তুই হঠাৎ লেকচারার হওয়ার কথা কেন ভাবলি? চাইলে অন্য উপায়েও মেয়েটাকে পেতে পারতি। তোর যা লম্বা হাত,তুলেও আনা যেত। শুধু শুধু এত কষ্ট করবি!”
ধীরস্থির কথাগুলোর আড়ালে নাহিদের সুপ্ত অনুরাগ বুঝতে বাকী নেই তীব্রর।
সে সম্পূর্ণ মনোনিবেশ ব্যস্ত রাস্তায় রেখে বলল,
“ মেয়ে মানুষ ফুলের পাপড়ির মত। একটু চেপে ধরলেই ঝরে যাবে, নেতিয়ে পরবে। সেখানে জোরজবরদস্তি মানে তো আস্ত ফুলটাই ন*ষ্ট।
তাছাড়া, এমনিতে খারাপ হলেও, এই বিষয়ে যে আমার চরিত্র বাঁধাই করার মত সেটা তোরা অন্তত খুব ভালো করে জানিস। তাহলে অহেতুক তুলে আনা,জোর করা এসব করে অতদিনের রেকর্ড ভা*ঙতে যাব কেন? যদি আপোসে মেয়ে ধরা দেয়, তার মত আনন্দ,তুলে আনায় আছে?”
নাহিদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে দুপাশে মাথা নাড়ল। মুশফিক বলল,
“ কিন্তু শিক্ষক বাবার সমান,মেয়ে যদি এই নিয়ম মেনে তোকে আব্বার নজরে দেখে? তাহলে তো আমও যাবে, ছোকলাও যাবে। থাকবে শুধু আঁটি।”
তীব্র বলল,
“সেই সুযোগ ওকে দিলে তো! বখাটে হওয়া যেমন অসম্মানজনক, তেমন সবেচেয়ে সম্মানজনক প্রফেশন হচ্ছে শিক্ষকতা। মাস্তান হয়ে যার ভয়-ডরের লিস্টে থাকব,শিক্ষক হলে সে-ই শ্রদ্ধায় মাথায় তুলে রাখবে।”
মিরাজ চিন্তিত কণ্ঠে বলল,
“ কিন্তু ও তোকে চিনবে না?”
মুশফিক উত্তর দেয়,
“ চিনবে কীভাবে? আমরা তো ওর সামনে মুখ ঢেকে ছিলাম। আর সেবারও বিট্টু মুখ ঢেকেই গেছিল। তবে গলার স্বর চিনতে পারে।”
তীব্র সূক্ষ্ম হেসে বলল,
“ দেখাই যাক না কী হয়? আমি নিশ্চয়ই কোনও কাচা খেলোয়াড় হয়ে মাঠে নামতে যাচ্ছি না। পুষ্পিতার সামনে থাকব,কিন্তু ও বুঝবে না। ধরতে পারবে না, লেকচারার তীব্র রেজা তালুকদারই, ওকে তুলে নিয়ে যাওয়া সেই বিট্টু মাস্তানের অন্য রূপ।”
আরমানের গলার কাছটায় খুশখুশ করছে খুব। কিছু বলতে চায় ।
অনেকক্ষণ পর, রয়ে সয়ে বলল,
“ কিন্তু… তুই নিজে জীবনে একটা প্যারাগ্রাফ মুখস্থ করেছিস কী না সন্দেহ। ওখানে গিয়ে কী পড়াবি ভাই? বই খুলে যদি অজ্ঞান হয়ে যাস!’’
তীব্র তপ্ত চোখে চাইল। শশব্যস্ত ঠোঁট আঙুল চেপে ধরল ও।
মুশফিক বলল ভিন্ন কথা।
“ গাজীপুর তুই একা গিয়ে থাকবি? আমাদের নিবিনা?”
তীব্র মুখের ওপর বলল,
“ না। মাথা খারাপ? মেয়ে দেখলে ছুঁকছুঁক করা বিড়াল গুলোকে সাথে নেব?”
ও ঠোঁট উলটে বলল,
“ আমরাও নাহয় ভদ্র সাজতাম।”
তীব্রর কড়া কণ্ঠ,
“ একদম না। এই ব্যাপারে তোদের একটাকেও বিশ্বাস করিনা আমি। তাই তোরা ওখানে আমার সঙ্গে দেখা করা তো দূর,আমার বাসার আশেপাশেও যাবি না। দরকার পড়লে আমি আসব এখানে। এছাড়া যা কথা হবে ফোনে। মন থাকবে?”
ওর চেহারায় গম্ভীরতার চিহ্ন। চাউনীতে জ্বলজ্বলে উষ্ণতা। বাধ্যের ন্যায় মাথা দোলাল চারজন।
নাহিদকেও মাথা কাত করতে দেখে, তীব্র বলল,
“ তোর মাথা নাড়তে হবে না। তুই আমার সাথেই যাবি।”
বিস্মিত নাহিদ খুশিতে খলবলিয়ে বলল,
“ সত্যি?”
মুখ কালো হয়ে গেল বাকীদের। মিরাজ মিনমিন করে বলল,
“ গরুটাকে সাথে নিয়ে কী করবি?”
তীব্রর কাঠ জবাব,
“ ঘাস খাওয়াব। তোদের কোনও সমস্যা?”
ওরা আবার দুপাশে মাথা নাড়ে। এদিকে স্বস্তির শ্বাস ফেলল নাহিদ। গুলশানে মিথিলাকে নিয়ে প্রতিটি মোড় ঘুরেছে সে। প্রতিটা কোনায় ওর স্মৃতি। যা বড্ড পো*ড়ায় এখন। বুকের বেদনা বাড়ায় সহস্রগুণ। এই যে ও সবার সামনে হেসে বেড়ায়, প্রফুল্ল স্বরে কথা বলে,নিয়মিত আড্ডায় আসে বন্ধুদের, এসবের কারণ, একটু ব্যস্ত থাকার চেষ্টা। ব্যস্ত থাকলে তবেই না সব ভুলে থাকা যাবে!
মিথিলার প্রসঙ্গ আসলে তার বন্ধুমহল বিরক্ত হয়,ধমকায়। কিন্তু ওর ভেতরের ভালোবাসাটুকু কেউ বোঝে না। ভালোবেসে যে হারিয়েছে সে জানে এর জ্বা*লা ! মেয়েটা যেমনই হোক,ওর প্রতি ভালোবাসা তো মরেনি। হয়ত মর*বেও না!
যাক,শহর ছেড়ে গেলে, অন্তত একটু ভালো থাকা যাবে। দেখা গেল ওখানেই মিলল, নতুন করে বাঁচার কোনও শক্ত ভীত!
রাস্তায় জ্যাম পড়েছে। তীব্র জিপ থামাল। চোখ দুটো সিগন্যালের চকচকে আলোতে রইলেও, মস্তিষ্কে চলল অন্য কিছু। চিন্তায়,ভাবনায়,চাউনীতে টলমলে কোনও প্রতিচ্ছবি তার ।
সেখানে একটু পর পর হানা দেয় কারো ভী*তশশস্ত্র মুখ।
প্রথম রাতে ওকে দেখে কুঁকড়ে বসা পুষ্পিতা। পরের বার ত্রাসে, দৌড়ে যাওয়া পুষ্পিতা।
তীব্র স্বীয় মনে হাসল, বিড়বিড় করল,
“ দেখা হচ্ছে ভিতু মেয়ে! বিট্টুর থেকে পালালেও,তীব্রর থেকে রেহাই পাওয়ার কথা ভুলে যাও।”
মুশফিক ওর দিক চোখ রেখে, আস্তে আস্তে মিরাজের কানের কাছে এলো। ফিসফিস করে বলল,
“ বিট্টুর হাবভাব সুবিধার না। ওর চোখদুটো দ্যাখ,কিছু আছে। এ ব্যাটা ওই মেয়ের প্রেমে পড়েছে আমি শিওর। শুধু ভাব কমে যাবে বলে স্বীকার করছে না।”
মিরাজও পালটা ফিসফিস করল,
“ আমারও তাই মনে হয়। নাহলে শুধু পছন্দ বলে এত কিছু করবে কেন? জানিনা। কিছু বুঝতে পারছি না। বিট্টুকে বোঝার চাইতে হিরো আলমের ইংরেজি বোঝা সহজ।”
মুশফিক চোখ-মুখ কুঁচকে মাথায় চড় মারল ওর।
“ শালা তুই যেমন, তোর যুক্তিও তেমন!’’
******
“ এক মাস পর………..”
সকাল সাতটা বাজে। আজ দীর্ঘদিন পর তালুকদার নিবাসে পা রেখেছেন আবুল হাসান । কিন্তু এখানে আসতেই ইচ্ছে করে না তার। তীব্র বাসায় থাকলে তো একেবারেই না। বরং গা রিরি করে ওকে দেখলে। আছাড় মে*রে মা*রতে ইচ্ছে হয়।
চূড়ান্ত বেয়াদব একটা ছেলে! গুরুজন মানে না। যা নয় তাই শোনায়, তুই তোকাড়ি করে অপমান করে। একবার তো গায়ে হাতই তুলে দিলো! ইচ্ছে করে ওটাকে ঘন্টাখানেক চাপকে সোজা বানিয়ে ফেলতে।
কিন্তু অপারগ আবুল! তীব্রর গায়ে অসুরের মতন শক্তিটা সেদিনকার থাপ্পড়ে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন তিনি। সাথে মন্ত্রীর ছেলে! কিছু করার উপায় কই?
আবার চাকরি বাঁচাতে এসব রাগ-ঢাকের নিকটও সমান পরাজিত আবুল। শত আপত্তিতেও,জামশেদের তলবে হাজিরা দিতেই হবে। মোটা মাইনে বলে কথা! এই যে,আজকেও হোলো। তবে বাড়ির চৌকাঠ পেরোতে গিয়ে, দাঁত কিড়মি*ড়িয়ে আবেদন করলেন,
“অসভ্য ছেলেটা যেন বাড়িতে না থাকে।”
আধঘন্টার মত হলো আবুল বসার ঘরে আছেন। এর মধ্যে তীব্রকে দেখা যায়নি । এবার নিশ্চিন্ত হলেন ভদ্রলোক। যাক! তার অনুরোধ ফলেছে।
কিছু সময় পর,কাজের মেয়েটি চা নিয়ে আসে। টেবিলে রেখে ফিরে যায়।
জামশেদ কাজে ব্যস্ত ছিলেন। চা দেখে ওনাকে বললেন,
“ বোসো আবুল।”
“ না না স্যার, সমস্যা নেই।”
“ আহহা,খাবার দাঁড়িয়ে খেতে নেই। তাছাড়া আমিইত তোমায় বসতে বললাম। বোসো।”
আবুল দোনামনা করে বসলেন। চোখের ইশারায় চা নিতে ইশারা করলেন জামশেদ। কিন্তু মোড়ামুড়ি করছেন তিনি। এই চা তার গলা দিয়ে নামবে না। গতবার তীব্র যা খোঁচা দিয়েছে,এরপর তো পা জড়িয়ে ধরলেও চা মুখে দেয়া উচিত না। কিন্তু মন্ত্রীর কথার ওপর না বলবেন কী করে? তাহলে তো, এতদিন যা ভালো,বিনয়ী সেজেছিলেন, সব এক ঝটকায় শেষ।
পরপর ভাবলেন,বদমাশ ছেলে তো বাড়িতে নেই। খাওয়াই যায়।
দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে হাতে কাপ তুললেন আবুল। যেই মাত্র ঠোঁটের কাছে ধরলেন,তক্ষুণি সিড়িপথে গটগটে পায়ের শব্দ এলো।
সঙ্গে সঙ্গে,ভালো মেজাজটা দুর্দান্ত পর্যায়ে খি*চড়ে গেল তার । দাঁত পিষে তিরিক্ষ মনে চোখ তুলে চাইলেন।
মুহুর্তে স্তব্ধ লোঁচন আটকে গেল সেথায়। চোখের পাতার সাথে,আঙুল গুলোও কেঁ*পে উঠল গতিতে। প্রকোপে কাপের গরম চা নাড়া লেগে ছল্কে পড়ল গায়ে।
বিষয়টায়, জামশেদ কিছু বলতে গিয়েও ওনার দৃষ্টি দেখে থামলেন। কৌতূহলে নিজেও ফিরলেন সেপথে।
অচিরে চমকে,থমকে একাকার হয়ে গেলেন তিনিও।
তীব্র নামছে। বিট্টু মাস্তান হয়ে নয়,সম্পূর্ণ ভিন্ন, সাবলীল দৃষ্টিকেও আঁতকে দেয়া রূপে। সব সময়কার অবিন্যস্ত চুল, জেল দিয়ে ব্যাকব্রাশ করা আজ। পড়নের তিনটি বোতাম খোলা শার্ট,গলা অবধি কলার ভাঁজ করে লাগানো। পরেছেও ফরমাল প্যান্টের সঙ্গে ইন করে। চোখে চিকণ ফ্রেমের ঝকঝকে চশমা। বা হাতের রূপার চেইন গায়েব। সেথায় চকচক করছে মেটালের ঘড়ি। পায়ে কালো ব্যুট। অগোছাল খোঁচা দাড়ি গুলো পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন। ক্লিন শেভে মুখখানা লাগছে আরও ফর্সা,সাদাটে।
বেশ-ভূষায় সব মিলিয়ে ভদ্র-সভ্যতার আদর্শ এক প্যাকেজ।
জামশেদ রীতিমতো বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলেন। বিহ্বলতায় মাথার সবখানে দপদপ করে উঠল।
এদিকে মূর্তির মত বসে থাকা আবুল,ঠোঁট নেড়ে শুধোলেন,
“ স্যার,আপনার কি কোনও জমজ ছেলে আছে? যাকে দেখতে হুবহু ছোট স্যারের মতন।”
ঘোর কাটল জামশেদের। প্রশ্নের উত্তরে কেবল ছোট্ট শ্বাস ফেললেন। ওইদিন আরেকটু হলেই তার কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়ে যেত। কী ভয়ানক চমক দিয়েছিল ছেলেটা! কিন্তু আজকের চমক যে ওসবও ছাড়িয়ে গেছে।
জামশেদ আশ্চর্য হলেও ভেতর ভেতর মুগ্ধতায় দুচোখ ছাপিয়েছে তার। এমন গোছালো ভাবেই তো তীব্রটাকে দেখার ইচ্ছে। এইত, এখন একদম কাটায় কাটায় মন্ত্রীর ছেলেই লাগছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জামশেদ তালুকদারের আদর্শ পূত্র যেন। সর্বদা এমন ভালো হয়ে চললে তো,আকাশের চাঁদ এনে দিতেও দ্বিধা নেই তার।
ভদ্রলোকের ঠোঁটের কোণায় অল্প একটু হাসি ভেড়ে। কেউ বোঝার আগেই ধোঁয়ার মতন মিলিয়ে যায় আবার।
তীব্র নেমে এসে দাঁড়াল। আবুলের দিক চাইতেই শশব্যস্ত উঠে দাঁড়িয়ে গেল সে। জামশেদ গলা খাকাড়ি দিলেন। চেনা-জানা সেই ভারিক্কি গলায় বললেন,
“ তাহলে আজকে থেকেই জয়েন করছো?”
“ হ্যাঁ।”
তিনি ওপর নীচ মস্তক দুলিয়ে বললেন,
“ ভালো।
তা থাকবে কোথায় ওখানে?”
“ থাকব কোথাও একটা। ওসব নিয়ে ভাবার কিছু নেই। আপনাকে যা যা করতে বলেছিলাম, করেছেন তো?”
“ হ্যাঁ। না করে উপায় আছে?
যাক গে,ওখানকার যিনি হেড অর্থনীতি ডিপার্টমেন্টের? ফোরকান.. আমার পরিচিত। ওনাকে বলেছি তুমি আমার ছেলে। এরপরে সব রকম বাড়তি সুবিধা পাবে সেখানে। আশা করি আর কোনও অসুবিধে হবে না।”
তীব্র দ্বায়সাড়া,হাস্যহীন বলল,
“ থ্যাংক ইউ!”
আবুল দুই বাপ-ছেলের মুখ দেখাদেখি করছেন। সমস্ত কথা তালু ভেদ করে চলে যাচ্ছে ওনার। এই ছেলে ভাষাহীন গর্হিত আর ইতর। যাকে তার মাতৃভাষায় এক কথায় বলে শয়তানের খাড়া ঝিলকি! সে হঠাৎ এমন ভেলকী দেখাচ্ছে কেন? অমন গুন্ডা গুন্ডা চেহারার ঘোল এরকম আচমকা পালটে গেল কীভাবে?
তীব্রর আওয়াজ পেয়ে রান্নাঘর থেকে একপল উঁকি দিলেন লুৎফা। ওমনি চিৎকার করে বললেন,
“ একী! এ আমি কী দেখছি? এটা কী আমার ছেলে বিট্টু?”
বলতে বলতে দ্রুত পায়ে বেরিয়েও এলেন তিনি। জামশেদ বললেন,
“ আস্তে বাবা আস্তে! বাড়িতে ডাকাত পড়লেও মানুষ এমন ভাবে চেঁচায় না।”
লুৎফার ওসবে কান নেই। খুব নিকট থেকে, ছেলের পা থেকে মাথা অবধি দেখলেন তিনি। গদগদ গলায় বললেন,
“ মাশ-আল্লাহ! তোকে একদম রাজপূত্রের মতন লাগছে বাবা।”
তীব্র কপালের পাশ চুল্কে বলল,
“ রাজপূত্ররা শার্ট-প্যান্ট পরতো না মা। ভুল উদাহরণ দিচ্ছো তুমি।”
লুৎফা হাসলেন। ছেলের দুবাহু ধরে বারবার ওকে দেখছেন তিনি। ইশ! কী সুন্দর তার সন্তান! পুরো চোখ জুড়িয়ে দেওয়ার মতন দেখতে!
“ হ্যাঁ রে,সব সময় এভাবে থাকতে পারিস না? কী চমৎকার লাগছে তোকে জানিস? তা না কী অগোছালো বখাটের মত থাকিস!”
তীব্র নিসঙ্কোচে বলল,
“ আমিতো বখাটেই।”
আবুল ধাতস্থ হয়েছেন সময় নিয়ে৷ চমক-টমকের ধারও সামলে নিয়েছেন।
কথার মধ্যে আগ বাড়িয়ে বললেন,
“ হ্যাঁ, ম্যাডাম ঠিক কথা বলেছেন, ছোট স্যারকে মাশ আল্লাহই লাগছে। সারাদিন যে মাস্তানি করে বেড়ায়,এই চেহারা দেখলে কেউ বুঝবেইনা। ইয়ে, স্যারের হঠাৎ এই বেশের কী কারণ? স্যার কি কোথাও যাচ্ছেন?”
সূচালো চোখে চাইলে তীব্র। পূর্বের ন্যায় কর্কশ কন্ঠে বলল,
“ সেটা তোকে বলতে হবে? ”
ভদ্রলোক তব্দা খেয়ে গেলেন। তীব্রর এই মার্জিত বসন-ভূষণ দেখে বোকা মনে ভেবেই নিয়েছিলেন, ব্যবহারটাও এখন নরম-সরম হবে। কিন্তু এ তো যেই লাউ সেই কদু! আবুল মনে মনে আরেক বার গালা*গালি করে উড়িয়ে দিলেন ওকে।
তক্ষুণি তীব্র ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
“ কী ভেবেছিস? ফরমাল জামা-কাপড় পরেছি বলে ফরমাল হয়ে গেছি? আমি শুধু কাপড় পাল্টেছি, ক্যারেক্টার পাল্টাইনি। হাতটা আগের মতই টনটনে। ঊনিশ-বিশ দেখলেই যে কারো গালে পড়তে এক সেকেন্ড লাগবেনা।”
আবুলের মুখটা তত্র অপমানে থমথমে হয়ে এলো। জামশেদ ‘চ’ সূচক শব্দ করলেন। না,এই ছেলে বদলাবে না।
প্রসঙ্গ পাল্টানোর প্রয়োজন বোধ করলেন লুৎফা। নাহলে বাবা-ছেলের তর্কের কোনও ভরসা নেই। আবার শুরু না হলে হয়!
তীব্রর মনোযোগ ঘোরাতে বললেন,
“ গাজীপুর কেন যাচ্ছিস বললি না যে বাবা!”
ওর জবাব,
“ সময় হলে বলব। আসি এখন।”
“ সাবধানে যাস। পৌঁছে একটু জানাস আমায়।”
তীব্র এই কথার নিশ্চয়তা দিলো না। উত্তরবিহীন বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেল ।
এদিকে ঘটনার আদ্যপ্রান্ত না বুঝলেও, যতটুকু বুঝেছেন তাতেই প্রসন্ন আবুল। তীব্র কোথাও যাচ্ছে, ওখানেই থাকবে। মানে আপাতত রাস্তা মোটামুটি পরিষ্কার।
এই সুযোগে,মন্ত্রীর ব্রেনটা আরো ভালো করে ওয়াশ করা যাবে। সাথে নিজের আখের টাও গোছানো যায় যদি!
কিন্তু প্রশ্নটা রয়েই গেল,মাস্তানটা যাচ্ছে কই?
***
ইদানীংকাল, একটু বেশিই শুষ্ক মরুভূমির ন্যায় জীবনের স্বাদ পাচ্ছে পুষ্পিতা। অভাগীর মতোন যেদিকে চায়,টলটলে সাগরও শুকিয়ে আসে। যাই করতে যাচ্ছে,যাই ভাবছে কোনও কিছুতেই কোনও সুস্থ সুরাহা হয়না।
এই যে, প্রথমে ভেবেছিল ন্যাশনাল সরকারিতে ভর্তি হওয়ার কথা। অথচ হোলো না। সীমিত সিট সংখ্যা হলেও চান্স হয়নি। বাধ্য হয়ে আগের চেয়েও তুলনামূলক সস্তা দেখে,একটা কলেজে ভর্তি হতে হয়েছে। এখানে ইন্টারমিডিয়েটের পরপরেই অনার্সে ভর্তির সুযোগ। অর্থাৎ কলেজ- ভার্সিটি একই সঙ্গে । তাই হল্লাহল্লিও প্রচন্ড!
আজকেও ক্লাশরুমে উচ্চ শোরগোল। ছেলে-মেয়ে সকলের হৈচৈ,আড্ডায় মুখোরিত সব।
এদিকে মাথা ধরে যাচ্ছে পুষ্পিতার। খারাপ মন আরো তেঁতিয়ে আসছে। বই থেকে একবার মুখ তুলে চাইল ও। নিরন্তর হাসাহাসি চলছে অনেকের। একেকটি বন্ধমহলের সে কী গল্প!
পুষ্পিতার মুখে আঁধার নামল নূহাকে মনে করে। আজ প্রায় বিশ দিন হচ্ছে,দুজনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আলাদা। নূহা ভার্সিটিতে আর সে এই নরমাল কলেজে।
ক্লাসে,বেঞ্চে প্রতিটা জায়গায় ওকে মনে পড়ে। কত কষ্ট করে,ধরেবেঁধে যে মনটাকে এখানে টিকিয়ে রাখছে ও!
এই বিশদিনে একটা মাত্র ভালো ঘটনা ঘটেছে ওর জীবনে। আয়েশা খাতুন কথামতো একটা টিউশনি খুঁজে দিয়েছেন। মেয়েটা চতুর্থ শ্রেনীতে পড়ে। মাসে কেবল আড়াই হাজার টাকা বেতন। এ দিয়ে যাতায়াত,আর বাদ বাকী হাতখরচা টুকু আরামসে চলে যাবে।
কিন্তু পুষ্পিতা মরিয়া অন্য চিন্তায়! প্রতি ছ-মাসের মাথায় যে কতগুলো টাকা জমা করতে হবে,সেসব কোথায় পাবে ও? আরও তো কিছু টিউশনি দরকার এখন।
দীর্ঘশ্বাস ফেলল পুষ্পিতা। একবার শূন্য গলায় হাত বোলাল। জন্ম থেকে গলায় যে চেইনটা মায়ের বলে জেনে এসেছে, আজ পরিস্থিতির কারণে,সেটাও বেঁচে দিতে হলো!
যদিও সেই মহিলাকে অনেক ভাবে অনুরোধ করেছে ও। কিছুতেই যেন চেইনটাকে অন্য কোথাও বেঁচে না দেন। যখন হাতে টাকা আসবে,ঠিক ছাড়িয়ে আনবে গিয়ে। কিন্তু, কবে আসবে ওইদিন? আর উনিই বা,ওর অনুনয় রাখবেন তো!
তার অগাধ চিন্তার মধ্যেই হুটোপুটি করে এসে দাঁড়াল একজন। হড়বড় করে বলল,
“ এই পুষ্পিতা,জানো কী হয়েছে?”
পুষ্পিতার ধ্যান ভা*ঙল। চাইল চোখ তুলে। তনুজা শ্বাস ফেলছে ঘন-ঘন। মেয়েটা দেখতে কিউট! সাইজেও ছোটখাটো। একেবারে কোমড় অবধি লম্বা চুল গুলো সব সময় পাঞ্চ ক্লিপে কয়েদ করে রাখে।
এখানে আসার পর, এই একটা মেয়ের সঙ্গে আলাপ হয়েছে ওর। তাও তনুজা মিশুকে,চঞ্চল বলে। কিছুটা নূহার মতন স্বভাব।
পুষ্পিতা মেলে রাখা বই বন্ধ করল। জানতে চাইল,
“ কী হয়েছে?”
তনুজার চোখ আগের চেয়েও প্রকট হলো এবার। অবাক হয়ে বলল,
“ এমা, তুমি কিছু টের পাওনি?”
“ না তো। কিছু হয়েছে?”
“ কী বোলছো! এতক্ষণ ক্লাশের সবাই সব দেখে ফেলল আর তুমি কী না! আল্লাহ তুমিতো আমার চিন্তার চাইতেও নিরামিষ।”
পুষ্পিতা ঠোঁট ওল্টায়। অসহায় চোখে চায়। সে যে ধ্যান- জ্ঞান বিসর্জন দিয়ে ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবছিল,কোনও কিছুর খেয়াল থাকবে কীভাবে!
তনুজার মুখটা স্ফীত হয়ে এলো। চোখের চাউনীতে উদ্বেলিত ঝলক এনে বলল,
“ আমাদের কলেজে না নতুন লেকচারার এসছেন। সম্ভবত অনার্সের ক্লাসই নেবেন। কী দারুণ দেখতে জানো! আমরা সবাই উঁকি মেরে মেরে দেখে এসেছি। আমিত ওনাকে দেখার পর থেকে একটা জিনিসই মন-প্রাণ দিয়ে চাইছি, উনি যেন আমাদের ডিপার্টমেন্টের লেকচারারই হন।
অবশ্য হওয়ার চান্স টু হান্ড্রেস পার্সেন্ট। আমাদের
স্যারের অফিসেই বসে আছেন যখন, মনে তো হচ্ছে আমার চাওয়া ফলবেই।”
তনুজা যত উত্তেজিত হয়ে খবরটা জানাল,পুষ্পিতা ততটাই বিরস গলায় বলল,
“ ওহ।”
নিমিষে সব স্ফূর্তি মাটি হলো মেয়েটার।
ভ্যাবাচেকা খেয়ে,ভ্রু কুঁচকে বলল,
“ ওহ?
আর কিছু বলবেনা?”
“ আর কী বলব?”
“ স্যার কে দেখবেনা?”
পুষ্পিতার নিষ্প্রভ মৃদূ স্বর,
“ ক্লাশ নিলে তো দেখতেই পারব।”
তনুজা বিরক্ত গলায় বলল,
“ উফ! তুমি এমন কেন? সারাক্ষণ ক্লাশে, বইতে মুখ গুজে থাকো। এর বাইরে একটা রঙীন দুনিয়া আছে পুষ্পিতা, সেটাও তো দেখতে হবে নাকী!”
পুষ্পিতা আলগোছে হাসল। কণ্ঠ উদাস,
“ সবার দুনিয়া তোমার মত রঙীন হয়না তনুজা। কারো দুনিয়ার পুরোটা শুধু সাদা-কালো থাকে।”
“ এত শক্ত শক্ত কথা বলে লাভ নেই। আমি বুঝবই না। এর থেকে এসো, আমার সাথে এসো, আমি তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি।”
“ এখন গিয়ে কী করব?”
“ আহা, এত কথা না বলে এসো তো।”
তনুজা, হাত টেনেটুনে নিয়ে চলল ওর। পুষ্পিতা অনিচ্ছায় পা বাড়াল। কারো মুখের ওপর না বলা কোমল মনের সাধ্যে নেই!
সাদা দেয়ালে লাগানো নেমপ্লেটে বড় করে লেখা
“ ফোরকান আহমেদ!”
অর্থনীতি ডিপার্টমেন্টের হেড তিনি। শোধিত কক্ষের ভেতরে আরো কয়েকজন পুরুষ বসে। কলেজ প্রিন্সিপালও রয়েছেন।
তনুজা পুষ্পিতাকে নিয়ে, দেয়ালের এক কোণা ঘেঁষে দাঁড়াল। মাথাটা হাল্কা খরগোশের মতন নামিয়ে উঁকি দিলো ভেতরে। কলেজের মেয়ে গুলো বেশি ঘুরঘুর করছে এখানে। যাতায়াতের ছুঁতোয় বারবার আসা যাওয়া ওদের।
পুষ্পিতার চোখেমুখে অনীহা। তার মাথায় শুধু টাকার চিন্তা ঘুরছে। সেখানে দেখতে সুন্দর স্যার দিয়ে ওর কী লাভ?
তনুজা ফিসফিস করে বলল,
“ ওই দ্যাখো পুষ্পিতা! প্রিন্সিপাল স্যারের বাম দিকে যে ইয়াং লোকটা বসে উনিই নতুন টিচার।”
পুষ্পিতা অমন অনীহ চোখেই তাকাল। বয়ষ্ক, মাঝবয়সী,মোটা-সোটা, কাচা-পাকা দাড়ির লোকগুলো পেরিয়ে নজর পৌঁছাল দর্শনে সুতনু তীব্রর ওপর। ফোরকানের সঙ্গে কথায় মগ্ন সে। সব্য তার বসার ধরণ। শিষ্ট তার বাচনভঙ্গি।
তনুজা ওর দিক একধ্যানে চেয়ে রইল। প্রসংশার ঝুড়ি খুলে বলল,
“ আমি ইন্টারে এখানেই পড়েছি। এরকম হ্যান্ডসাম টিচার এই কলেজে জীবনে দেখিনি। সব একেকটা দাদার বয়সী। আর ওনাকে দেখো পুষ্পিতা! কী দেখতে! মাথার ছোট ছোট সোনালী চুলগুলো যেন মস্ত বড় ফ্রেম। একটা দারুণ বর্ডারের রং যেমন একটা ডিজাইনকে মোহময় করতে পারে,ঠিক তেমন। চশমার ফ্রেমটা চেহারার সাথে একেবারেই মানানসই। হাসিটা দ্যাখো হাসিটা,এই হাসি দেখলে তো আমার পরীক্ষায় পাশ করাই দূঃসহ হয়ে যাবে। আমি মনে হয় গেছি বুঝলে! পুরোদমে ক্রাশ খেয়ে ফেললাম!”
পুষ্পিতা সবটা মনোযোগ দিয়ে শুনে, জ্বিভ কাটল। মিনমিনে গলায় বিজ্ঞদের মতন বলল,
“ এভাবে বলতে হয়না তনুজা। উনি আমাদের শিক্ষক। আর শিক্ষক মা-বাবার সমান!’’
চলবে