কলমে: নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
(১৫)
হামাগুড়ি দিয়ে সন্ধ্যে নেমেছে। আয়েশা খাতুন অফিস থেকে ফিরলেন কেবল। অথচ তাকে হাত-মুখ ধোয়ার সময়টুকুও দিতে নারাজ নূহা। শশব্যস্ত,গুরুতর ভঙিতে নালিশ ঠুকল বাড়ির মালিকের নামে।
সে তখনও বিষয়খানা মেনে উঠতে পারেনি। তাই এখনও রে*গে বোম। একা যাওয়া ঠিক হবেনা বিধায়, মায়ের অপেক্ষায় ছিল। এবার মাকে সহ জবাব দিহি চাইতে যাবে। কেন অমন তাগড়া দুটো জোয়ান ছেলেকে তাদের পাশের ফ্ল্যাটে ভাড়া দেয়া হয়েছে? একটু আক্কেল জ্ঞানও কী নেই এদের? টাকার জন্য এমন কাজ কারবার!
কিন্তু ঘটনা হলো উলটো। নালিশের বিনিময়ে সামান্য একটা বালিশও মেয়েটার কপালে জোটেনা। আয়েশা খাতুন যেই মাত্র শুনলেন, পুষ্পিতার স্যার উঠেছে এখানে,আহ্লাদে আটখানা হয়ে পড়লেন মহিলা।
রীতিমতো হূলস্থুল বাঁধিয়ে চলে গেলেন দেখা করবেন বলে । না ফ্রেশ হলেন,না বাইরের কাপড় পাল্টালেন। তার অপ্রত্যাশিত গদগদ ভাবটা,থতমত খাইয়ে দিলো নূহাকে। কিছু যে বলবে সেই সময়টা অবধি দিলেন না আয়েশা। সে ফ্যালফ্যাল করে, বোকার মতন মায়ের যাওয়ার পথে চেয়ে থাকল শুধু।
তীব্র দেয়ালে পিঠ ঠেসে মেঝেতে বসেছে। ঠোঁটের ঝ*লসে যাওয়া চামড়ার মাঝে আনন্দ নিয়ে পু*ড়ছে সিগারেটের মাথাটা। কানে গোঁজা হেডফোনে গান বাজছে ঝুপঝুপ আওয়াজে।
এদিকে গোছগাছ করে ক্লান্ত নাহিদ। পুরো ফ্ল্যাটের আসবাব ঠিকঠাক করার পর সেও এসে ধপ করে ওর পাশে বসল। শ্রান্ত গলায় বলল,
“ খিদে পেয়েছে!”
তীব্র সিগারেট দেখিয়ে বলল,
“ খাবি?”
নাহিদ এমন ভাবে চাইল যেন আকাশ ভে*ঙে মাটিতে পড়েছে। দুপাশে সজোরে মাথা নেড়ে বলল,
“ না না। এসব আমি খাই না।”
তীব্র দুষ্টুমি করেছিল। নাহিদের এমন অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া যে আসবে তাও জানত। ছেলের সবেতে বাড়াবাড়ি! মজা পেয়ে শব্দ করে হেসে উঠল তাই।
ঠোঁট ফোলাল নাহিদ। মা বলতেন,ও সহজ-সরল! এই যুগে এত সোজা মানুষ চলে না। একটু চালাক হতে হয়।
সত্যিইত,সহজ সরল বলে সব বন্ধুরা ওকে নিয়ে মজা নেয়। এইযে বিট্টুও নিয়েছে। আর সেই দুপুরে ওই মেয়েটা? সোজাসুজি ঢেড়স বলে দিলো?
তক্ষুণি কলিংবেল বাজে। নাহিদ উঠতে নেয়,দরজা খোলার জন্য। ত্বরিত ওকে আটকে দিলো তীব্র। কিছু না বলে তড়িঘড়ি করে সিগারেট এস্ট্রেতে রেখে সেটা ঠেলে দিলো ডিভানের নীচে।
উঠে গিয়ে গায়ে, কড়া পারফিউম ছড়াল। সারা ঘরে ফ্রেশনার দিলো। চোখে চশমা পরে,গায়ে শার্ট চাপিয়ে চলল সদর দরজার দিকে। সবটা বসে বসে দেখে গেল নাহিদ। তার কিছু বলার নেই৷ সে এখনও বাকরুদ্ধ,স্তম্ভিত!
দরজা খুলে যেতেই, আয়েশা নড়েচড়ে দাঁড়ালেন। ওপাশের চাশমিশ,পুরুষটিকে নির্দ্বিধায় সালাম দিলেন,
“ আসসালামু আলাইকুম!”
তীব্র এনাকে চেনে। পুষ্পিতার ওপর নজরদারির যে ফাইল সে বানিয়েছিল, সেখানে নূহা,নূহার মা সবার ছোটখাটো ভূমিকা আছে। প্রথমে সালামের জবাব দিলো।
পরপরই পালটা সালাম দিয়ে বলল,
“ আপনি আমার বড় আন্টি। সম্মান আগে আমার দেওয়া উচিত।”
আয়েশা খাতুনের ওষ্ঠপুট লম্বা হাসিতে ছড়িয়ে যায়। ভেতর ভেতর নিরন্তর প্রসংশায় ফুলেফেঁপে উঠলেন। এখনকার যুগে এত সব্য ছেলে, এত মার্জিত? আহা আহা! সাধু সাধু!
তিনি আপ্লুত হেসে বললেন,
“ কী নাম তোমার বাবা? আন্টি ডাকলে বলে তুমি করে বললাম। কিছু মনে করোনি তো?”
“ জি না। ভেতরে আসুন।”
“ না না সমস্যা নেই। আসলে, আমার মেয়ের কাছে শুনলাম পুষ্পিতার কলেজের স্যার এখানে নতুন উঠেছেন। ওইজন্যে দেখা করতে এসেছি।”
তীব্র ভ্রু কুঁচকে বলল,
“ কে পুষ্পিতা?”
“ ইয়ে,তোমার ছাত্রী। ওই *** কলেজেই পড়ে। অর্থনীতি ডিপার্টমেন্ট।”
তীব্র একটু ভেবে বলল,
“ ও! হতে পারে। আমি আজকেই জয়েন করলাম তো,এখনও ভালো করে কাউকে চিনিনা।”
“ হ্যাঁ হ্যাঁ, সেটা আমি বুঝেছি৷ তা তোমরা কোথা থেকে এসেছ?”
তীব্রর এই খেজুরে আলাপ ভালো লাগছে না। এসব ওর ধাতে নেই। মহিলা মানুষের সঙ্গে একটার বেশি দুটো কথা বলতেই বিরক্ত লাগে! আর সেখানে এই ভদ্রমহিলা পুরো প্রশ্নের ঝুড়ি খুলে বসেছেন।
খুব গোপনে বীতঃস্পৃহ ভাবটুকু চাপা দিয়ে জানাল,
“ ঢাকা থেকে।”
আয়েশা বললেন,
“ আমরাও তো ঢাকা থেকে এসেছি।”
“ আপনি বাইরে কেন আন্টি?ভেতরে এসে বসুন।”
“ না বাবা এখন না। পরে একদিন যাব। তা তোমাদের গোছগাছ সব শেষ বুঝি?”
“ না, চলছে এখনও।”
“ আচ্ছা, তাহলে আর বিরক্ত করব না। আসি হ্যাঁ? আবার পরে কথা হবে। আর কোনও সুবিধে- অসুবিধে হলে নিশ্চয়ই জানাবে কেমন?”
তীব্র অল্প হাসল। স্বল্প মাথা নাড়ল। আয়েশা তার ফ্ল্যাটে চলে গেলেন। তীব্র দরজা আটকে দেয়। এপাশ ফিরে ঠোঁট কা*মড়ে হাসে। ভদ্রমহিলা সুবিধে-অসুবিধে জানানোর দাওয়াত দিয়ে গেলেন। ওকে তো চেনেনা! ঢাকা থেকে এখানে আসতে পেরেছে যখন,পাশের ফ্ল্যাটে যাওয়া এমন কী!
এ ঘরে আসতেই নাহিদ শুধাল,
“ কে এসেছিল?”
“ তোর শ্বাশুড়ি! “
ছেলেটা চোখ বিকট করে বলল,
“ মানে,মিথিলার আম্মু এসছেন?”
তীব্র এমনি বলেছে। নিতান্ত কথার কথা! কিন্তু নাহিদের যোগসূত্র মেলানোর ধরনে চোখ-নাক কুঁচকে এলো ওর। ধমক দিয়ে বলল,
“ চুপ কর হাদারাম! সারাক্ষণ খালি মিথিলা মিথিলা।
নাহিদ মন খারাপ করে বলল,
“ এমন করিস কেন তোরা? আমিতো ওকে ভালোবাসি।”
তীব্র মুখের ওপর বলল,
“ কিন্তু ও তোকে শুধু ইউজ করেছে,এটা মাথায় কবে ঢুকবে তোর? তুই এখানে নাকে কাঁদবি,আর ও কানাডায় গিয়ে স্বামী নিয়ে সংসার করবে। দু বছর পর যখন বাচ্চা সহ আসবে,আর তারা তোকে দেখে বলবে হ্যালো মামা… তখন কাঁদিস!”
নাহিদের মুখটা ছোট হয়ে গেল। মাথা নোয়াল চুপচাপ। তীব্র তার মনের হদিস জানে। মিথিলার প্রসঙ্গ উঠলেই হলো,এ ছেলে দুঃখে ভেসে যায়। সে দুই গাল ফুলিয়ে শ্বাস ফেলল।
সোনালী চুলে হাত বুলিয়ে মোটা গলায় বলল,
“ নীচে যাচ্ছি আমি। খেয়ে আসব আর তোর জন্য নিয়ে আসব। ”
নাহিদের হু-হা এলো না। ঠাঁয় বসে থাকে। তীব্রও ঘাঁটাতে চায়নি।
“ দরজা লাগা” বলে চুপচাপ বেরিয়ে গেল।
****
তীব্র আর মায়ের সব কথোপকথন দরজার এপাশ হতে পরিষ্কার শুনেছে নূহা।
আয়েশা ঘরে ঢুকে দরজা চাপাতেই, রেগেমেগে বলল,
“ তুমি ওনাদের সাথে এত মিষ্টি মিষ্টি করে কথা বলছিলে কেন আম্মু?”
আয়েশা ফিরে তাকালেন,
“ তো কী করব?”
নূহা অবাক হয়ে বলল,
“ কী করবে মানে? বাড়িওয়ালা আঙ্কেলকে জিজ্ঞেস করবে, কেন সে আমাদের পাশে ব্যাচেলর ভাড়া দিলেন। আমরা এখানে দুটো মেয়ে সারাদিন একা থাকি উনি জানেন না? এবার যদি বিপদ হয় কোনও?”
“ বিপদ হতে যাবে কেন? বরং ওনারা যে উঠলেন এখানে,এটাত আরো ভালো হয়েছে।”
“ ভালো? ব্যাচেলর ছেলেপেলে এভাবে পাশাপাশি থাকবে এটা ভালো?”
আয়েশা বিদ্বিষ্ট হয়ে বললেন,
“ তুমি আসলেই খুব বেশি বোঝো বুঝলে? উনি পুষ্পিতার টিচার৷ একটা ভার্সিটির প্রফেসর! কত সম্মানীয় লোক! তাকে আর পাঁচটা বখাটে ছেলের সাথে গুলিয়ে ফেলছো কেন? সে কী বাকীদের মত হবে?এইত কথা বলে এলাম। আমার মানুষ চিনতে ভুল হয় না। কত আদব-কায়দা জানা ছেলে! আমাকে কত সম্মান দিলো!
তারপর পুষ্পিতার দিক চেয়ে বলল,
“ তোমার কী মনে হয় পুষ্পিতা,আমি ঠিক বলেছি না?”
পুষ্পিতা অবলার মতন বসে ছিল সোফাতে৷ নড়েচড়ে উঠল। মৃদূ কণ্ঠে স্বায় মিলিয়ে বলল,
“ জি। আমার কাছে স্যারকে ভালো মানুষই মনে হয়েছে।”
নূহা বলল,
“ একদিন দেখেই বুঝে গেলি মানুষ ভালো না খারাপ? নাকী এখন তুইও বলবি,তোর মানুষ চিনতে ভুল হয় না।”
পুষ্পিতা মিনমিন করে বলল,
“ না তা না। ওই তখন সিড়ি দিয়ে উঠলেন না? অথচ একবারও আমার দিকে তাকাননি। এমনকি কথা বলার সময়ে, একটাবার চোখ তুলে দেখেনওনি। যে মানুষ মেয়েদের মুখের দিক চেয়েই কথা বলে না, সে নিশ্চয়ই খারাপ হবে না।”
আয়েশা বললেন,
“ আর একটা কথা ভাবো, উনি কত পড়াশুনা জানা! গ্রাজুয়েট করা। পুষ্পিতা আর তুমি পড়াশুনার যে কোনও কিছুতেই, নিসঙ্কোচে হেল্প নিতে পারবে না? শিক্ষক মানুষ ধারেকাছে থাকা মানে তো তোমরা আরো সেফ থাকছো।”
নূহা উদ্বেগ নিয়ে বলল,
“ কিন্তু সাথে তো আরও একটা ছেলে আছে। ওনার বন্ধু না কী যেন!”
“ তাতে কী? থাকুক না। ভালো মানুষ কী খারাপ মানুষের সঙ্গে মিশবে? না তো! স্যার মানুষ নিশ্চয়ই ওরকম বাজে কোনও বন্ধু সাথে আনেনি।”
নূহা চিন্তায় পড়ে গেল। মিনিট কয়েক ভাবাভাবির পর মেনেও নিলো। মা,পুষ্পিতা কারোরই আপত্তি নেই যখন, তার এত নাঁচানাঁচির মানে আছে? মাথা ঝুলিয়ে বলল,
“ আচ্ছা ঠিক আছে!”
হাসলেন আয়েশা। ওর থুত্নী ধরে বললেন,
“ এইত, কত লক্ষী একটা মেয়ে আমার!”
নূহাও হাসল।
তিনি হঠাৎই চিন্তিত কণ্ঠে বললেন,
“ ছেলে দুটো আজ উঠল বাসায়। সারাদিন গোছগাছ করেছে, এখনও না কি বাকী! বোধ হয় রান্নাবান্নাও করতে পারেনি। আমাদের উচিত প্রতিবেশি হিসেবে ওদের কিছু খাবার পাঠানো।”
নূহার হাসি শেষ। কেমন খ্যাকখ্যাকে গলায় বলল,
“ কেন কেন? এখন খাবার ও পাঠাতে হবে কেন? আমরা কী ওদের জন্যে রান্না করেছি?”
“ আরে,তুমি এমন করে কথা বলছো কেন? রান্না না করলেও বা,খাবার তো কম নেই। ওদের দিলেও তোমার ভাগে কম পড়ে যাবেনা। আমরা যখন মতিঝিলে প্রথম বাসা নিয়েছিলাম, মনে নেই? পুষ্পিতার মণি আমাদের রান্না করে দিয়ে গেছিলেন? সেই রান্না খেয়ে হাত চেটেপুটে তো খুব বলেছিলে, আম্মু ওনারা কত ভালো! তাহলে এখন অন্যকে দেবে না কেন?”
মণির কথা শুনেই বুক ভারী হয়ে এলো পুষ্পিতার। মনে পড়ে গেল সেই ছোটবেলার কথা। নূহারা প্রথম পাশাপাশি ওঠার সময় সালমা নিজ হাতে খাবার দিয়ে এসেছিলেন। সেই বাটি ভরে আবার খাবার নিয়ে এলো ফ্রক পরা ছোট্ট নূহা। এরপর দুজনের আলাপ,বন্ধুত্ব! কী আনন্দ মাখা দিনগুলি! নূহাটা এখনও ওর জীবনে একই ভাবে রইলেও,মণি? আচ্ছা কেমন আছে ওরা? রাহাতের কী খবর? মিথিলা আপু কী বিদেশ চলে গিয়েছে? কতদিন সবাইকে দেখেনি!
সেই সময় আয়েশা ডাকলেন। পুষ্পিতা ধ্যান ভে*,ঙে তাকালে বললেন,
“ যাও তো মা, বাটিতে করে একটু ভাত তরকারি দিয়ে এসো তোমার স্যারকে!”
পুষ্পিতা ঘাড় কাত করল। যেই উঠতে যাবে নূহা হৈচৈ ফেলে বলল,
“ না। ও কেন যাবে? ও এমনিই বোকাসোকা! আর ছেলে গুলো কেমন না কেমন,ওকে আমি কিছুতেই ওদের ঘরে পাঠাব না।”
আয়েশা খাতুন অতীষ্ঠ হয়ে পড়লেন এবার।
“ উফ এই মেয়েটাও না! আচ্ছা বেশ,ওকে যেতে হবেনা। তুমি নিয়ে যাও। ”
সে চোখ প্রকট করে বলল,
“ আমি?”
তিনি এবার নাক ফুলিয়ে বললেন,
“ এবার বোলো না, যে তুমিও যাবে না।”
মায়ের উষ্ণ চোখ-মুখ দেখে দমে গেল নূহা,
“ আচ্ছা যাচ্ছি! দিয়ে আসছি খাবার তোমার সাধের প্রতিবেশীকে।”
সে হনহনে পায়ে রান্নাঘরে যায়। পুষ্পিতাও গিয়ে পেছনে দাঁড়াল। আয়েশা ওকে বললেন,
“ এতদিন ধরে বান্ধবীকে কিছু শেখাতে পারোনি?তোমার মত একটু নরম হওয়া শেখাও। একটু ভদ্রতা শেখাও। মেয়ে মানুষ এত কর্কশ হলে হয়?”
নুহা ওখান থেকেই জবাব দিল,
“হ্যাঁ ওর মত নরম হই, আর সবাই পায়ে পিষে দিয়ে চলে যাক।”
পুষ্পিতার মিহি আওয়াজ,
“ তুই একটু মাথাটা ঠান্ডা কর। আমার কাছে দে, আমি বেড়ে দিচ্ছি।”
নুহা চোখ পাকিয়ে বলল,
“একদম কথা বলবি না। তাহলে তোকেও এই বাটির মধ্যে ভরে নিয়ে যাব। তারপর তোর স্যারকে দিয়ে বলব এই নিন, আপনার ছাত্রীকে এনেছি, এখন শিক্ষা দিন গুরু।”
পুষ্পিতা নিঃসহায়ের মত চুপ করে থাকে। নূহা গটগট করে বেরিয়ে গেল। আয়েশা কপাল চাপড়ে বললেন,
“হে আল্লাহ! এইটুকু মেয়ের এত জেদ? একে কোন ছেলে বউ বানিয়ে নেবে কে জানে!”
****
নাহিদের মন বিষণ্ণতায় মোড়া। জানলার দিক চেয়ে বসে ও। চোখে জল, হাতে মানিব্যাগ। যার ফ্রন্ট পকেট থেকে বেরিয়ে আছে মিথিলার সুন্দর একটি ছবি। নাহিদ বৃদ্ধাঙ্গুল ছবির ওপর আলতো করে বোলায়। ক’বছরের ভালোবাসাময় দিন গুলো চিত্রের ন্যায় হানা দেয় চোখের সামনে।
ব্যথাতুর ঢোক গিলল নাহিদ।
মিথিলার দিক চেয়ে বলল,
“ আমি এখনও আগের মতোই তোমাকে ভালোবাসি। এই ভালোবাসা একটুখানিও কমেনি জানো! অথচ ওরা বলে তোমায় ভুলে যেতে। সব ভুলে সুন্দর করে বাঁচতে। সব কি এতই সহজ মিথিলা? প্রথম প্রেম,জীবনের প্রথম নারীকে এত অনায়াসে ভুলে যাওয়া যায় না। আমি তো শুরু থেকেই জানতাম তুমি আমায় নিয়ে সিরিয়াস ছিলে না। এটুকু না বোঝার মত বোকা আমি নই। কিন্তু কোনও এক ব্যর্থ আশায় বুক বাঁধা ছিল। সে ভেবেছিল, আমি আমার মত করে ভালোবাসবো , একদিন তুমিও ঠিক এইভাবে আমাকেও কাছে টানবে। হয়নি। আমি শত চেষ্টা করেও পারিনি তোমার মন গলাতে। অতগুলো দিনে, আমার ভালোবাসা একটুও ছুঁতে পারেনি তোমায়। জীবনে বাঁচার জন্য আমাকে নয়, আমার টাকাটাকেই এত বড় করে দেখলে মিথিলা? একবার আমাকে বেছে নিয়েই দেখতে না হয়,জান দিয়ে দিতাম তোমাকে সুখে রাখার জন্যে।”
নূহা দেখল দরজা হা করে খোলা। সে বাইরে দাঁড়িয়েই থমথমে গলায় ডাকল,
“ কেউ আছে?”
সাড়া এলো না। ও আবার ডাকল। এবারেও না। ভেতরে কেউ নেই না কী? এতবার ডাকল কেউ উত্তরই দিচ্ছে না।
নূহা ফেরত আসতে নিয়েও থামে। মায়ের কথাটা মনে করে মায়াও হলো। সত্যিইত,হতে পারে ওনারা এখনও কিছুই খেতে পারেনি। বাসা অদলবদল করা তো আর চাট্টিখানি কথা নয়। যতবার ওরা বাসা পাল্টেছে জীবন বেরিয়ে গিয়েছে ওর।
ভাবল, খাবার যখন নিয়ে এসেছেই তখন রেখেই যাবে। দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়ে ভেতরে ঢুকল নূহা।
বসার ঘর খালি। নূহা টেবিলের ওপর রাখতে গিয়ে চোখ পড়ল সোজাসুজি শোবার ঘরে। ভ্রু গোছাল ও। নাহিদ জানলার সামনে থম মেরে বসে আছে। এবার মেজাজ চটে গেল মেয়েটার। কী অভদ্রের দলবল! বাসাতেই আছে। অথচ অতক্ষণ ধরে সে যে হেঁদিয়ে ডাকল,ইচ্ছে করে সাড়া দেয়নি?
ও ব্যগ্র পায়ে রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।
একেবারে খেঁকিয়ে বলে,
“ এই আপনারা কেমন মানুষ হ্যাঁ?”
নাহিদের আর্ত চোখ দুটো মিথিলার ছবিতে ছিল। মন-যোগ সবই সেখানে। খালি ঘরে আচমকা এমন জোড়াল শব্দে পিলে চমকে উঠল বেচারার। ধড়ফড়িয়ে দাঁড়িয়ে গেল। ওঠার প্রকোপে হাতের মানিব্যাগ ঠিকড়ে পড়ল ফ্লোরে। ও প্রচন্ড ভ*য় পেয়ে বলল,
“ আপনি? আপনি কীভাবে ঢুকলেন? এ ঘরে এলেন কী করে?”
নূহা আশেপাশে চেয়ে জায়গা খুঁজল খাবার রাখার। একটা টেবিল দেখে এগিয়ে যেতে যেতে বলল,
“ ঢুকেছি দরজা দিয়ে। আর এসেছি পায়ে হেঁটে। বুঝেছেন?”
নাহিদ মাথা কাত করল আগের মত। তবে এখনও বুক ধুকপুক করছে। নতুন জায়গা আবার বিট্টুটাও নেই। ওকে তো কিডন্যাপ করে যে কেউ সহজেই নিয়ে যেতে পারবে।
নুহা খাবার রেখে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
“ আমার মা অনেক ভালো মানুষ! ওনার ধারণা আপনারা কাজের চাপে এখনও না খেয়ে আছেন। তাই খাবার দিয়েছেন। আমি একদম নিয়ে আসতে চাইনি। একরকম জোর করে পাঠালেন আর কী! যাক গে, না খেলে খেয়ে নেবেন। আর খেলে রাতের জন্য রেখে দেবেন, তখন কাজে লাগবে।”
নাহিদ ছোট করে বলল,
“এসবের কী দরকার ছিল!’’
“ সেসব আম্মু জানে। আমি তো…”
ওর মুখের দিকে নজর পড়তেই কথা থামল নূহার। আরো ভালো করে চাইল। নাহিদের চোখের কোণায় সূক্ষ্ণ জলের রেশ। এক পশলা কা*ন্নার পর চোখ মুছলেও যেমন চিহ্ন রেখে যায়!
“ আপনি কী কাঁদছিলেন মিস্টার ঢেড়স?”
নাহিদ হতভম্ব হলো। ভ্যাবাচেকা খেল। একে নাম,দুইয়ে ধরে ফেলায়। তৎপর আরেকদিক মুখ ঘুরিয়ে বলল,
“ কই না তো!”
নূহার চাউনী প্রখর। বোঝার চেষ্টায় সে। একটা ছেলে কী কারণে কাঁদতে পারে? লাইফ নিয়ে ডিপ্রেসড? চাকরি পাচ্ছে না? না কী…”
সেসময়, ওর চোখ যায় মেঝেতে। ওয়ালেট পরে আছে নাহিদের। যেখানে মিথিলার পাসপোর্ট সাইজের ছবিটাও সদর্পে চেয়ে। ও এগিয়ে গেল। হাতে তুলে দেখতেই বুঝে ফেলল যা বোঝার।
নিশ্চিত হতে বলল,
“ আপনার বুঝি ব্রেক-আপ হয়ে গেছে মিস্টার ঢেড়স?”
চকিতে চাইল নাহিদ। ওয়ালেটটা এক রকম কেড়ে নিলো ওর হাত থেকে। শান্ত মানুষ মুহুর্তেই কেমন তেঁতে বলল,
“ আমার ওয়ালেট ধরেছেন কেন?”
নূহা ভড়কে যায়। চোখ কুঁচকে বলে,
“ বাপ্রে! ব্যাগে কয় লাখ টাকা আছে শুনি? এভাবে টেনে নেওয়ার কী ছিল?”
নাহিদ কাজটা ঠিক হয়নি ভেবে আস্তে করে বলল,
“ সরি! আসলে মন মেজাজ ভালো নেই,ওইজন্যে আর কী! কিছু মনে করবেন না।”
নূহা ঠোঁট টিপে হেসে বলে,
“ বুঝেছি। গার্লফ্রেন্ড ভেগে গেছে বলে কাঁদছিলেন। তাইত?”
নাহিদ রুষ্ট চোখে চায়। তেমন চড়া কণ্ঠে বলে,
“ ভেগে যায়নি। বিয়ে হয়ে গেছে। না জেনে কেন আজেবাজে বলছেন?”
নূহা মজা করেছিল। মানিব্যাগে তো আর কোনও মেয়ের ছবি, ছেলেরা এমনি এমনি রাখেনা! গার্লফ্রেন্ডই হবে বলে আন্দাজে বলা। কিন্তু সত্যিই নাহিদ এই কারণে কাঁদছে শুনে তাজ্জব হয়ে বলল,
“ কী আশ্চর্য! একটা গার্লফ্রেন্ড চলে যাওয়ায় আপনি সত্যিই এভাবে কাঁদছেন?’
“ কেন? এটা কি কাঁদার মত ব্যাপার নয়?”
নূহার দৃঢ় কণ্ঠ,
“ মোটেই না। এর থেকেও কত বাজে বাজে ঘটনা ঘটছে আপনি জানেন? এই যে আমাদের দেশের কথা ধরুন,সাদা চামড়া বিদেশীদের কাছে তাদের কত টাকার ঋন,কই দেশ তো কাঁদছেনা। প্রধানমন্ত্রী তো দিব্যি গাড়ি করে ঘুরছে। তাহলে?”
নাহিদ জড়বুদ্ধিতে,চোখ বড় করে বলল,
“ আপনার কাছে এই দুটো জিনিসের মানে এক?’’
“ না, অবশ্যই এক না। আপনার থেকেও দেশের ব্যাপারটা মারাত্মক। কারণ দেশের ক্ষতি মানে দশের ক্ষতি। কিন্তু আপনি তো অক্ষত! তাই আপনার বিষয়টা এক্ষেত্রে অতিকায় তুচ্ছ।”
সহসা একপেশে হাসল নাহিদ। ওয়ালেটের দিকে চেয়ে থেকে বলল,
“ আপনার কাছে হয়ত তুচ্ছ,আমার কাছে নয়। কারণ আমি ভালোবেসেছি। আপনি কখনও কাউকে ভালোবেসেছেন?”
সে চাইল। উত্তর জানার প্রবণতা চোখে। নূহা দুপাশে মাথা নেড়ে বলল,
“ না।”
“ তাহলে আপনি বুঝবেনও না। একজন ব্যর্থ প্রেমিকের কষ্ট বুঝতে প্রেমসুলভ হৃদয় লাগে।”
নূহার শিথিল চাউনী বদলে যায়। গুরুতর হয়। নাহিদ একটু চুপ থেকে বলল,
“ খাবারের জন্য ধন্যবাদ! আমাকে একটু একা ছাড়বেন প্লিজ? একা থাকতে চাইছি, আবার ভেবে বসবেন না তাড়িয়ে দিচ্ছি আপনাকে।”
কেন যেন মন খারাপ হলো নূহার। শব্দহীন মাথা ঝাঁকিয়ে, চুপচাপ হাঁটা ধরল। দরজায় গিয়ে ফিরে চাইল আবার। নাহিদ ওয়ালেট থেকে চোখ নিয়ে জানলার বাইরে ফেলেছে। পরপর,বক্ষস্থল ফুলিয়ে ফোস করে শ্বাস ঝাড়ল।
নূহার মনে হলো এই নিশ্বাসের নির্গমন সাধারণ কিছু নয়। হাওয়ায় মিলিয়ে দেওয়া কারো বিষাদের ভার! সেই ভার বোঝার ক্ষমতা কি, আসলেই ওর নেই?
ঝাঁ চকচকে রাস্তাঘাট! একেকটি উঁচু স্তম্ভের মতন পরিষ্কার দালান। তকতকে, ঝলঝলে কানাডা ভূমি দেখে মিথিলার চোখ বিমোহে মুঁদে আসার জোগাড়।
এইত, ঠিক এরকমই দেশের স্বপ্নই দেখেছে ও। আহা, অবশেষে পেলো! প্রাচুর্যে ঘেরা,ভীষণ ভীষণ শৌখিনতায় মুড়ে থাকা জীবনে এবার আর সুখের অন্ত হবে না।
ওরা এখন দাঁড়িয়ে আছে এয়ারপোর্টের বাইরে। ল্যান্ড করেছে প্রায় আধঘন্টা হবে। মিথিলা সব কিছু দেখে টেখে এবার অধৈর্য হয়ে পড়ল। পা,হাঁটু ঝিমিয়ে এসেছে ওর৷ ওদিকে পলাশ ফোনে ব্যস্ত।
মিথিলা অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে। পলাশ নিজেও নড়ছে না। কিছু বলছেও না। সারাদিন এখানেই থাকার প্ল্যান করেছে না কি? গাড়ি আসবে না ওর? মিথিলা খেই হারিয়ে এবার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়।
“ কী ব্যাপার? আর কতক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখবে? তোমার গাড়ি আসবে কখন?”
“ এইত! ক্যাব বুক করেছি। চলে আসবে।”
মিথিলা নাক কুঁচকে বলল,
“ ক্যাব? ক্যাব কেন? তোমার গাড়ি নেই?”
পলাশ ফোন থেকে মুখ তুলে চায়৷ দু সেকেন্ড ওর দিক দুর্জ্ঞেয় চাউনীতে চেয়ে থেকে, হঠাৎই দুপাশে মাথা নেড়ে হাসে।
এতেই সবটা গুলিয়ে গেল মিথিলার। মাথায় ঢুকল না কোনও কিছু। বিভ্রমে গলা ভিজিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল পাশে।
ক্যাব এলো পনের মিনিটের মাথায়। পলাশ ব্যাগ-প্যাক সহ উঠে বসে। মিথিলা ঠাঁয় দাঁড়িয়ে তখনও। সে গাড়ির জানলা থেকে, চেয়ে বলল,
“ এয়ারপোর্টে থাকবে বলে এসেছ? নাকী ওঠার জন্য পালকি আনব?”
মিথিলার রাগ লাগছে। পলাশের গাড়ি থাকতে সে ক্যাবে যাবে কেন?
উঠলেও চোখেমুখে তার তীব্র অনীহা। পাশে বসেই ফের একই কথা শুধাল,
“ ক্যাবে যাচ্ছি কেন আমরা? তোমার নিজের গাড়ি নেই পলাশ?”
“ না।”
জবাব শুনে আহত মিথিলা। ঘুটঘুটে অন্ধকার নামল মুখে। পলাশের গাড়ি নেই। এর মানে এখানেও তাকে ট্রামে, ট্যাক্সিতে যাতায়াত করতে হবে? সে বিধ্বস্ত মনে বসে থাকে। তিক্ত গলায় ছোট করে বলে,
“ ধ্যাত!”
গাড়ি থামল একটি আলিশান ভবনের সামনে। উচ্চতায় বিশাল। বাইরে থেকে দেখেই মিথিলার চক্ষু চড়কগাছ।
উৎফুল্ল হয়ে বলল,
“ এটা তোমার বাড়ি?”
উত্তর এলো,
“ নামো।”
মিথিলা দুরন্ত কদমে নেমে যায়। পলাশ ভাড়া মেটাল ক্যাবের।
মিথিলা ভবন দেখতে দেখতে হা করে বলল,
“ এত বড় বাড়ি তোমার পলাশ? ও মাই গুডনেস! এত আমার কল্পনার চেয়েও বড়।”
পলাশ পাশে এসে দাঁড়ালে, ওর দিক চেয়ে বলল,
“ এবার বুঝেছি, এই বাড়ি করতে করতে আর গাড়ি কেনোনি তাইনা? থাক সমস্যা নেই। আমি এসে গেছি না? এখন আমরা দুজন মিলে গিয়ে, একটা মার্সেডিজ কিনে আনব। ”
পলাশ কেমন করে হাসল। মিথিলা বলল,
“ কী আজব! আমি যাই বলছি তাতে এরকম হাসছো কেন তুমি?”
ও ঠোঁটে হাসি রেখেই বলল
“ তোমার কথা শুনে হাসছি।”
“ হাসার মত কী এমন বললাম?”
“ কিছু না, চলো।”
মিথিলার কোনও কিছুই মাথায় ঢুকছে না। এক ঝাঁক প্রশ্ন সমেত পিছনে চলল পলাশের। মেইন গেটের বেল বাজালে গার্ড লক খুলে দিলেন।
পলাশ গ্রাউন্ডফ্লোর ফেলে যখনই লিফটে উঠতে যাবে, পূর্বেই কোত্থেকে এক মেয়ে এসে হামলে পড়ল গায়ের ওপর। চমকে উঠল মিথিলা।
সাদা চামড়ার মেয়ে। একটা হাটু সমান টপ পরেছে শুধু। পলাশের গলা জড়িয়ে রেখে,ইংলিশে বলল,
“ আও ফালাস,আই মিস ইউ!”
পলাশকে অপ্রস্তুত দেখা গেল না। এই যে, বউয়ের সামনে বুকের ওপর অন্য এক মেয়ে, এতে একটুও ভ্রুক্ষেপ এলোনা যেন। এক হাতে লাগেজ বার, অন্য হাতে পালটা মেয়েটির পিঠ আকড়ে বলল,
“ আই মিস ইউ ঠু জেনি!”
*****
মুখের ওপর হঠাৎ এক দলা পানির ঝাপটায় ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠল নাহিদ। ভ*য়ার্ত নেত্র হকচকিয়ে চাইল।
“ কে কে!”
ঘুমুঘুম চোখ দুটো স্পষ্ট হতেই সম্মুখে তীব্রকে দেখা যায়। হাতে গ্লাস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওটার পানিই মে*রেছে মুখে। নাহিদ হতবুদ্ধি হয়ে বলল,
“ ককী হলো?”
তীব্রর অসন্তোষ চোখে চেয়ে,
“ তোকে এখানে ঘুমোতে এনেছি?”
“ তাহলে? খেয়ে দেয়ে তো মানুষ রাতে ঘুমোবেই তাইনা?”
“ আপাতত কিছু দিন তোর ঘুম বন্ধ।”
নাহিদ মাথা চুল্কায়,
“ কী করব তবে?”
তীব্র ঘুরে হাঁটা ধরল। ছোট করে বলে গেল,
“ ফলো মি।”
নাহিদ নিরুপায় হয়ে উঠে বসে। পিছু নেয় ওর। তীব্র সোজা তার রুমে গিয়েছে। বসেছে টেবিলের নিকট থেকে একটা চেয়ার টেনে। নাহিদ আসলে আরেকটা দেখিয়ে বসতে বোঝাল।
বসল নাহিদ। তখনও কিছু বোঝেনি। টেবিল ক্লকটায় একবার সময় দেখে নিলো। রাত বাজে ১টা।
বলল,
“ তুই কি এখন পড়বি নাকী!”
“ হ্যাঁ। আর তুই আমাকে পড়াবি।”
চোখ বেরিয়ে এলো ছেলেটার। তীব্রকে পড়ানো মানে সাংঘাতিক ব্যাপার-স্যাপার। জান হাতে নিয়ে বসতে হবে। এ ছেলের রেকর্ডের শেষ নেই। ক্লাস সিক্সে বসে, পড়াশুনা নিয়ে বেশি চাপা-চাপি করাতে হোম টিউটরের মাথা ফাঁটিয়ে দিয়েছিল। সে আর্তনাদ করে বলল,
“ কী? এই না না, আমি পারব না।”
তীব্র গরম চোখে চেয়ে বলল,
“ কেন? সমস্যা কী?”
শুষ্ক ঢোক গিলল নাহিদ। আসল কথাটা মুখ ফুঁটে বের হলো না। তীব্র কপালে ভাঁজ ফেলে ওর মুখের দিক চেয়ে থাকে। এরপর ঠান্ডা গলায় বলে,
“ ভয় পাচ্ছিস? ভয় পাস না। আমি আমার কাছের মানুষদের আঘাত করি না। তুই তোর মত করে পড়াতে থাক।”
“ পড়াতেই হবে?”
তীব্র চোখ রাঙালে চটপট বই মেলল ও। তীব্র নিজের মত বলল,
“ প্রতি রাতে আমাকে পড়াবি। তুই আমাকে যা বোঝাবি, পরের দিন আমি সেটা ক্লাসে কপি-পেস্ট করে আসব। ক্লাসে,স্পেশালি ভীতু মেয়ের সামনে আমার ভালো পার্ফমেন্স জরুরি৷ আর সেটা নির্ভর করছে তোর ওপর। যদি আমার পার্ফমেন্স খারাপ হয় মাথা না ফাঁ*টালেও তোর চেহারার ডিসপ্লে পালটে দেব আমি।”
নাহিদ ভীত কণ্ঠে বলল,
“ এটা কেমন কথা হলো? যদি আমি তোকে পড়াই,তাহলে আমি তোর টিচার৷ টিচারের সাথে এরকম করে কেউ?”
তীব্র ভ্রু উঁচিয়ে বলল
“ কথা কম,শুরু কর।”
নাহিদ ফোস করে শ্বাস ফেলল৷ অবলা-অসহায় শ্বাস৷
বইয়ের পৃষ্ঠা ওল্টাতে ওল্টাতে বলল,
“ আসলে অনার্স লেভেলের পড়া বই দিয়ে হয় না। পড়াতে হয় নোটস দিয়ে। লেকচারারদের আলাদা নোট থাকে। সেখানে তারা গুরুত্বপূর্ণ কোটেশন গুলো তুলে তুলে ক্লাস নেয়৷”
কথাটা বলে সে পড়ানো শুরু করল। অপরদিকে,খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছে তীব্র। কিন্তু যতটা মনোযোগী হওয়ার চেষ্টায় সে, মাথায় অতটা ঢুকছে না। এই বয়সে পড়াশোনা এত সহজে হয়?
নাহিদ পড়িয়েই যাচ্ছে। মূল্য, মুনাফা,উৎপাদন খাজনা এসব বিষয়ে গড়গড় করে আওড়াচ্ছে। কিন্তু মাথা ভোঁ ভোঁ করে ঘুরছে তীব্রর। ডান থেকে বামে,বাম থেকে ডানে চক্কর কা*টছে সবেগে।
বইয়ের লেখার দিক চাইলেই মনে হচ্ছে নেশালো কিছু মেশানো। ঘুমে একাকার হয়ে আসছে সব। চোখের সামনে পৃথিবী দোদুল্যমান!
সে আধঘন্টার মাথায় তড়াক করে দাঁড়িয়ে যায়। বিঘ্ন ঘটায় নাহিদ বলল,
“ কী হোলো?”
“ পানি খেয়ে আসি দাঁড়া!”
তীব্র টালমাটাল পায়ে যেতেই ঠোঁট চেপে হাসল নাহিদ। জীবনে নিজের জন্য পড়েছে কী না সন্দেহ,আর এখন এক মেয়ের জন্য কত কী!
তীব্র খেতে যায়নি। গিয়েছে চোখে-মুখে পানি দিতে। বেসিনের ট্যাপ ছেড়ে মাথার তালু ভেজাল। আয়নার দিক চেয়ে বিড়বিড় করল,
“ শালা লেখাপড়ার চাইতে, মাস্তানি করা সোজা। এসব মানুষ করে?”
সে ফিরে এসে আবার আগের জায়গায় বসল। বোঝাল কিছুই হয়নি। একইরকম গম্ভীর গলায় বলল,
“ শুরু কর।”
“ একটা কথা বলব?”
তীব্র তাকায়,
“ কী?”
“ তোর মনে হচ্ছেনা, তুই মেয়েটার প্রেমে পড়েছিস?”
সে নিষ্প্রভ আওড়াল,
“ এক কথা বারবার বলতে ভালো লাগে না!”
“ তুই হয়ত বুঝতে পারছিস না। অবশ্য বোঝার কথাও নয়। জীবনে প্রেম কী তাইত জানিস না। এই অনুভূতি একদম আলাদা জানিস! সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম একটা জগতে তোকে নিয়ে যাবে। যেখানে তুই হাওয়ায় উড়বি। শয়নে-স্বপনে নিজের প্রেমিকাকে দেখবি। দেখিস তুই আস্তেধীরে টের পাবি যে তোরও প্রেম হয়েছে। আমি এখনই হান্ড্রেড পার্সেন্ট শিওর তুই প্রেমে পড়েছিস। না পড়িসনি,রীতিমতো হাবুডুবু খাচ্ছিস!”
তীব্র চেয়ারে পিঠ এলিয়ে, আড়মোড়া ভা*ঙল। এত্ত গুলো কথার বদৌলতে, খুব সাবলীল জবাব দিলো,
“ পড়লে পড়েছি। পছন্দ করলে প্রেম করব,প্রেমে পড়লে বিয়ে করে নিয়ে যাব। এর মাঝে আর কোনও কথা নেই৷”
****
পরের দিন তীব্রর ক্লাস নিতে হয়নি। প্রিন্সিপাল কর্তৃক কী একটা মিটিং হেতু আজকে ক্লাস হবে না। সকল শিক্ষকদের থাকতে হবে সেখানে। তীব্রও আছে। তবে দশমিনিটের মাথায় মনে হলো
এখানে ওর কাজ নেই। এসব ফ্যাচর ফ্যাচর শোনার চেয়ে সিগারেটে দুটো টান বসানো ভালো। সে কোনও রকম অনুমতি ছাড়াই কক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে যায়।
মকবুল খেয়াল করতেই থেমে গেলেন। পাশে বসা ফোরকানকে বললেন,
“ এভাবে চলে গেলেন কেন উনি?”
“ থাক বাদ দিন। আপনি বলুন যা বলছিলেন!”
লোকটার মেজাজ খারাপ হলো। দাঁত চেপে বসে রইলেন তাও। এই ফোরকানের নতুন লেকচারার নিয়ে একটু বেশিই গদগদ ভাব। সারাদিন পারলে নিজের রুমে বসিয়ে রাখে। এমন আদিখ্যেতা যেন, প্রধানমন্ত্রীর ছেলে!
তীব্র ধুমপানের জন্য একটা আদর্শ জায়গা খুঁজছে। চারপাশে ছাত্র-ছাত্রীদের হাঁটাহাঁটি, চলাফেরা। এদের সামনে তো খাওয়া যাবে না। কিন্তু যাবে কোথায়?
হঠাৎ মনে পড়ল লাইব্রেরির কথা। ওটা এই কলেজের শো পিস! ফাঁকাই থাকে। ছাত্র-ছাত্রীরা পড়বে কী,পা-ই মারায় না।
সে তৎক্ষনাৎ দোতলা পেরিয়ে লাইব্রেরীতে গেল। তনুজা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফিল্টার থেকে পানি ভরছিল বোতলে। তীব্রকে ওদিক যেতে দেখেছে। ওমনি বোতল- টোতল ফেলে চলে গেল ক্লাসে।
ক্লাস না হওয়ায় শিক্ষার্থীরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গল্পে মেতে। পুষ্পিতা সব সময়ের মত একা এক কোণায় বসে বেঞ্চের। তনুজা গিয়েই ব্যস্ত কণ্ঠে বলল,
“ এই পুষ্পিতা চলো লাইব্রেরিতে যাব।”
“ এখন?”
“ হ্যাঁ হ্যাঁ এখনই এসো।”
পুষ্পিতা রা করেনি। ভাবল বই নেবে। বাধ্যের মত সাথে চলল।
তীব্র বসেছিল খুব আরামে। আচমকা সজাগ কানে চপল পায়ের শব্দ পেতেই সোজা হয়ে বসল। পদধ্বনি এদিকেই আসছে। সে তাড়াহুড়ো করে সিগারেটের টুকরো ফেলে দেয় জানলা দিয়ে। পরপর তাক থেকে যে বই সামনে পেলো টেনে নামাতে যায়। অনেকদিন ব্যবহার না হওয়ায় ধূলো জমেছে মলাটে। তীব্রর টানার তোপে বাতাসে ময়লা উড়ে নাকে-মুখে ঢুকে গেল। খুকখুকে কাশিটা খুব ক*ষ্টে জোরে বের হওয়া থেকে বাঁচাল ও। আস্তেধীরে কেশে,জায়গায় বসল এসে। বই মেলে রাখল সামনে।
এদিকে তনুজা দরজা অবধি এসে দাঁড়িয়ে যায়। তার পাশের জানলা থেকে উঁকি দেয় ভেতরে। তীব্র বসে পড়ছে। কী মনোনিবেশ!
তনুজার বুকটা ভরে গেল ওকে দেখে। পেছনে থাকা পুষ্পিতা ওকে দাঁড়াতে দেখে বলল,
“ কী হলো? ভেতরে যাবে না?”
তনুজা তৎপর পিছু চেয়ে, আঙুল ঠোঁটে চেপে চুপ করতে বোঝায়।
পুষ্পিতা বুঝতে না পেরে বলল,
“ কিছু হয়েছে?”
তনুজার ফিসফিসে কণ্ঠ,
“ স্যার ভেতরে৷ আস্তে বলো,শুনতে পাবে।”
সেও এবার ফিসফিস করে বলল,
“ কোন স্যার?”
বলতে গিয়ে তনুজার চেহারা লালচে হয়,
“ তীব্র রেজা তালুকদার!”
পুষ্পিতার নির্ভেজাল উত্তর,
“ শুনতে পেলে কী হবে? আমরা তো বই নিতে এসেছি। তুমি যাও, গিয়ে বইটা নিয়ে চলে এসো।”
তনুজা বলল,
“ বই নিতে আসিনি তো। আমি স্যারকে দেখতে এসেছি।”
পুষ্পিতা গড়বড়ে চোখে চাইল। তনুজার ঠোঁটে হাসি। সে ধ্যান মেরে চেয়ে আছে তীব্রর দিকে। পুষ্পিতা এবার চাপা কণ্ঠে ভয় এনে বলল,
“ তুমি কী পাগল হয়ে গিয়েছ? কোনও ভাবে কেউ যদি দেখে নেয় তুমি লুকিয়ে লুকিয়ে স্যারকে দেখছো,কী হবে ভাবতে পারছো? আর স্যার যদি দেখে ফেলেন! কী ভাববেন উনি। মান সম্মান সব যাবে। নিজে ডু*ববে আমাকেও ডো*বাবে।”
তনুজা চ সূচক শব্দ করে বলল,
“ উফ পুষ্পিতা! বিরক্ত কোরো না তো। দেখতে দাও।”
পুষ্পিতার নাকাল দশা। সে আতঙ্কিত! ভয় পাচ্ছে কেউ দেখে ফেলার। তারওপর কেমন করে চেয়ে আছে তনুজা। একজন টিচারকে ছাত্রীরা এইভাবে দৃষ্টি দিয়ে গিলে নেয়ার ব্যাপারটা জানাজানি হলে…আর ভাবতে পারল না ও।
এরমধ্যে তনুজার মোহগ্রস্ত কণ্ঠ এলো,
“ দেখেছো পুষ্পিতা! স্যার পড়াশুনা নিয়ে কত সচেতন! আর অন্য স্যার গুলোকে দেখো,ক্লাস না হলে এরা আনন্দে ভাসে। ম্যাডামদের সাথে হাহাহিহি জুড়ে দেয়। অথচ স্যার? এখানে নিরিবিলি বসে বসে পড়ছেন। ওনাকে দেখে বাংলাদেশের সব ফাঁকিবাজ শিক্ষকদের শিক্ষা নেওয়া উচিত না বলো।”
“ হ্যাঁ ভাই উচিত। এখন চলো…”
“ আহা এমন কোরো না তো! তনুজা তার রেজাকে দেখছে,এখানে তৃতীয় ব্যক্তি হতে এসো না তুমি।”
পুষ্পিতা ঠোঁট উলটে বলল,
“ স্যারকে তো ক্লাসে গেলেও দেখতে পারবে। এভাবে দেখার কী দরকার?”
“ এভাবে দেখার মধ্যে যে সুখ,সেটা কী আর সবার সামনে দেখায় আছে রে মেয়ে!”
গফুর ছাদ থেকে কোনও একটা কাজ সেড়ে নামছিলেন। ওদেরকে ওখানে দেখেই ডাক ছুড়লেন,
“ এই মেয়েরা ওখানে কী কোরছো?”
পুষ্পিতা চমকে তাকায়। তুঁতলে বলে,
“ জি বই…”
উনিও সরল মনে ভাবলেন বই নেবে। বললেন,
“ আচ্ছা,নিয়ে তাড়াতাড়ি চলে যেও।”
তনুজা পিওন গফুরকে পাত্তা দেয় না। কলেজে থাকাকালীন এর হম্বিতম্বি দেখতে দেখতে সে অভ্যস্ত। তাই পুষ্পিতার মত ভয় পাওয়া তো দূর,ফিরে দেখলও না। সে তখনও মত্তের ন্যায় তীব্রকে দেখছে।
আচমকা বই থেকে ঝট করে চোখ তুলল তীব্র। সরাসরি নজর মিলতেই কলিজা ছল্কে উঠল তনুজার। তীব্রকে দাঁড়াতে দেখে বাকীটুক সাহসও গায়েব।
গফুর নেমে যেতেই হাঁপ ছাড়ল পুষ্পিতা। ওষ্ঠ ফুলিয়ে স্বস্তির শ্বাস ফেলে বলল,
“ তোমার তীব্র রেজাকে আর দেখতে হবে না বোন। আল্লাহর দোহাই এবার চলো।”
সে না দেখেই হাত টানে ওর। সাড়া না পেয়ে তাকায়। বক্ষঃস্থল ছ্যাত করে ওঠে অচিরে। কোথায় তনুজা,কোথায় কী!
তীব্র দাঁড়িয়ে সামনে। একদম নাকের ডগার ওপর যেন। ভয়ে পুষ্পিতার রুহু উড়ে গেল এবার।
তীব্র কখন এসে দাঁড়িয়েছে,তনুজা কোথায় গিয়েছে কিছুই টের পায়নি?
তীব্র একবার ওর ধরে রাখা হাতের দিক দেখল। তারপর মুখের দিক। পুষ্পিতা দৃষ্টি অনুসরন করে চাইতেই, চট করে হাতটা সরিয়ে আনে। লজ্জায় বুঁদ হয়ে মিশে যায় মাটিতে। ইশ! শেষে কী না স্যারের হাত ধরে টেনেছে?
পুষ্পিতা কুণ্ঠায় হাঁসফাঁস করে চোখ নামিয়ে নেয়। কাঁপা কণ্ঠে বলে,
“ সসরি স্যার!”
তীব্রর কপালে ভাঁজ। ছোট করে শুধাল,
“ কী নাম?”
পুষ্পিতার চোরা নয়ন তখন আশেপাশে। এই তনুজা ওকে বিপদে ফেলে কোথায় পালিয়েছে!
তীব্র ধৈর্য্যহীন,পুরু কণ্ঠে বলল,
“ নাম জিজ্ঞেস করেছি!”
ও ঢোক গিলে তাকাল।
“ পুষ্পিতা!”
তীব্র এক ভ্রু বাঁকাল,
“ পুষ্পিতা? এটা আবার কেমন নাম? মানে কী নামের?”
পুষ্পিতা চোখ ঘুরিয়ে ভেবে বলল,
“ মনে হয় ফুল।”
“ মনে হয়, কেন? নিজের নামের মানে নিজে জানোনা? কে রেখেছে?”
পুষ্পিতা আদল সংকীর্ণ করে বলল,
“ নানু।”
“ বেঁচে আছেন?”
পুষ্পিতা নীচের দিক চোখ রেখে দুপাশে মাথা নাড়ল।
তীব্র আদেশের মতন বলল,
“ পরেরবার নামের মানে শুনে, আমাকে এসে জানাবে। মনে থাকবে?”
পুষ্পিতা বাধ্যের ন্যায় ঘাড় কাত করল একপাশে।
“ ক্লাসে যাও।”
নির্দেশ মেনে দুরুদুরু বুকে ঘুরে হাঁটা ধরল পুষ্পিতা। এপাশ ফিরে এতক্ষণে রুদ্ধ হওয়া দমটুকু ছাড়ল যেন। একেবারে উড়ে যাওয়ার মতন করে ত্রস্ত কদমে সিড়ি ভে*ঙে নেমে গেল নীচে।
তীব্র বুকে হাত গুঁজে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। নিঃশব্দে হাসে।
যে হাত পুষ্পিতা ধরেছিল সেদিকে একবার চোখ বুলিয়ে বলে,
“ আজকে তুমি হাত ধরে ছেড়ে দিলেও,যেদিন আমি ধরব? সেদিন কোনও ছাড়া-ছাড়ি নেই।”
চলবে