কলমে: নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
(১৭)
তখন ভোর! আনুমানিক ছয়টা বাজে ঘড়িতে। অমন সক্কাল বেলা,ফোনের ক্রিং ক্রি শব্দে মাথা ধরে গেল তীব্রর। ছুটে পালাল আরামের ঘুম। তিঁতিবিরক্ত হয়ে শোয়া থেকে উঠে বসল ও।
মোবাইলের স্ক্রিনে জ্বলজ্বলে সেভ করা মন্ত্রীমশাই নম্বরটা দেখে সেই বিরক্তি বৃহৎ হয়। তীব্র চ সূচক শব্দ তুলল জ্বিভে। গত রাতের এক ফোঁটাও সে ঘুমোয়নি। সারারাত পড়াশোনা করেছে। না নিজে ঘুমিয়েছে, আর না নাহিদকে ঘুমোতে দিয়েছে। এইতো, পাশেই ভোস-ভোস করে নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে ছেলেটা।
এখন আবার কল! তীব্র খুব নিষ্পৃহ ভঙ্গিতে ফোন রিসিভ করে স্পিকারে দিল। অমন নিষ্প্রভ গলায় বলল,
“ হ্যাঁ বলুন।”
ওপাশ থেকে উত্তর এলো,
“ কী করছিলে? মনে হচ্ছে বিরক্ত করলাম।”
“ সকাল ছটায় ফোন দিয়ে ঘুম ভাঙালে,আমি কেন দুনিয়ার সব মানুষ বিরক্ত হবে।”
জামশেদ থতমত খেলেন সোজা জবাবটায়। গলা খাকাড়ি দিয়ে বললেন,
“ঠিক আছে, ঠিক আছে । এমনি এমনি তো আর ফোন দেইনি। একটা কাজ আছে বলেই দেওয়া।”
তীব্র মুখের ওপর উত্তর দেয়,
“হ্যাঁ সেটা আপনার কল দেখেই বুঝেছি। আপনি তো আর স্বার্থ ছাড়া ফোন দেবেন না।”
জামশেদ রেগে রেগে বললেন,
“ সব সময় উল্টোপাল্টা কথা না বললে তোমার ভালো লাগে না তাই না?”
“ কী কারণে কল দিয়েছেন, বলুন। ঘুমাব আমি।”
উনি একটু চুপ থেকে বললেন ,
“ একবার বাড্ডা আসতে পারবে?”
“কেন?”
“ দরকার ছিল।”
“ কিন্তু আমার তো এই মুহুর্তে ওখানে কোনও দরকার নেই। আপাতত আমার দরকার এখানে। যেতে পারব না।”
জামশেদ উদ্বেগ নিয়ে বললেন,
“ কিন্তু তুমি তো বলেছিলে যখনই আমার দরকার লাগবে চলে আসবে।”
“ বলেছিলাম নাকি?
মনে পড়ছে না। মনে পড়লে আসব।”
জামশেদ ক্ষেপে বললেন,
“ তুমি কি আমার সাথে ইয়ার্কি করছো?”
“ আপনার তাই মনে হয়?”
“ এর মানে তুমি আসবেনা।”
“ তেমনই তো বললাম।”
জামশেদ চটে বললেন,
“ বেয়াদব ছেলে!”
তীব্র সাবলীল…
“পুরোনো কথা।”
“ রাখো তো ফোন।”
“কল তো আপনি দিয়েছেন, আপনি রাখুন না।”
বিদ্বিষ্ট জামশেদ,
“অসভ্য কোথাকার!”
“ এটাও পুরোনো।”
জামশেদ অতীষ্ঠতায় “উফ!” বলে লাইন কেটে দিলেন।
তীব্র ফোস করে দম ফেলল। ফোনটাকে দুরুত্বে ছুড়ে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল বিছানায়। নাহিদের নাক ডাকার শব্দ বেশ চড়া তখন। সে ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে,একটা বালিশ ওর মুখের ওপর চাপা দিয়ে রাখে। বিধিবাম! এতেও নাহিদের ঘুম ভাঙে না।
****
নূহার পেট খারাপ! ওয়াশরুমে নিরন্তর যাতায়াত চলছে! কাল ভোর রাত থেকে এই যাত্রার শুরু। গ্লাস গ্লাস স্যালাইন খেয়েও লাভ হচ্ছে না। গতরাতে আয়েশা খাতুন অফিস থেকে ফেরার সময় ফুচকা পার্সেল করে নিয়ে এসেছিলেন। মেয়েটা ফুচকা খেয়েছে তো খেয়েছে, সাথে সমস্ত টক বাটি চেটেপুটে খেয়ে নিয়েছে। এখন পেটের মধ্যে ঘূর্ণিঝড় চলছে ব্যথায়।
আর ওর এই অবস্থায় বিপাকে পড়েছে পুষ্পিতা। আয়েশা খাতুন অফিস কামাই দিতে পারবেন না। বাধ্য হয়ে যেতে হলো। একই দশা ওরও। সেদিন ক্লাসে এসাইমেন্ট করতে দিয়েছিল। আজকে জমা করার শেষ দিন। এদিকে নুহাকে একা ফেলে যেতেও পারছে না। সব মিলিয়ে তার উভয় সংকট! শেষে অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়ে ঠিক করল,ওই একটা ক্লাস করেই চলে আসবে। আর যাই হোক,প্রিয় বন্ধুকে এমন ভাবে ফেলে ওর ক্লাসে মন টিকবে কখনও?
পুষ্পিতা দরজা পেরিয়ে সিঁড়িতে নামতেই ঝটপট ঘর থেকে বের হলো তীব্র। এতটা সময় চিলের ন্যায় ওৎ পেতে বসেছিল সে। মেয়ে বের হলে,সেও বের হবে।
পেছনে বুটের শব্দ পেয়ে ঘুরে তাকাল পুষ্পিতা। ওকে দেখেই, লম্বা সালাম দিয়ে পাশে সরে দাঁড়াল। তীব্র উত্তর দেয় সালামের। সাথে
ভ্রু কুঁচকে শুধায়,
“ দাঁড়িয়ে গেলে যে?”
ও খুব বিনয়ী গলায় বলল,
“ স্যার আপনি আগে যান।”
তীব্র স্বর ভারী,
“ সমস্যা নেই, যাও।”
পুষ্পিতা ইতস্ততায় ভুগছে। স্যার পেছনে হাঁটবে, ও সামনে সামনে যাবে এটা একটু অভদ্রতা হয়ে যাচ্ছে না?
তার চেহারার দ্বিধাদ্বন্দ্ব তীব্র স্পষ্ট বুঝে নেয়। ধীরুজ গলায় আশ্বস্ত করল,
“আমি বললাম না সমস্যা নেই? হাঁটো।”
পুষ্পিতা বাধ্যের ন্যায় ঘুরে নামতে থাকে। পেছনে তীব্র,ঠিক এক সিড়ি ওপরে। তার নজর সেই পুষ্পিতার হেলতে দুলতে থাকা চুলের বেনুনীতে। পোড় খাওয়া ঠোঁটদ্বয়ের প্রতিটি ভাঁজে হাসি।
ওমন চেয়ে থেকেই ভাবল,
“ সামনে- পিছনে নয়, একদিন তোমার পাশে নিয়ে হাঁটবে আমাকে। আর সেই দিন আসতে খুব বেশি দেরি নেই ভীতু মেয়ে।”
গেট পেরিয়ে পুষ্পিতা,রিক্সার জন্য দাঁড়িয়ে থাকে। কলেজের পথ মোটামুটি দূরে। ভাড়া কম হলেও,হেঁটে যাওয়ার উপায় থাকলে, তাই করত ও। অন্তত কিছু টাকা বাঁচত এতে!
আচমকা সম্মুখে একটা লাল জিপ থামল। ব্রেক কষার শব্দে তাকাল পুষ্পিতা। ভেতরে তীব্রকে দেখতেই, ঠোঁট দুটো ফাঁকা হয়ে চলে গেল ভিন্ন ভিন্ন মেরুতে।
ও একবার জিপ দেখে, পরেরবার তীব্রকে। নেত্রজুড়ে বিস্ময়ের ভেলকি!
এমন চকচকে গাড়ির মালিক যিনি, সে নিশ্চয়ই ধনাঢ্য ব্যক্তি? তবে ওদের মত অমন সস্তা ভাড়া বাসায় থাকে কেন?
এই বাড়িতে আলাদা পার্কিং লট নেই। তাই পাশের গ্যারেজে ভাড়া দিয়ে গাড়ি রাখত তীব্র।
পুষ্পিতার নড়চড় না দেখে, মনোযোগ পেতে হর্ণ বাজাল।
নড়ে উঠল মেয়েটা। তীব্র বলল,
“ ওঠো।”
পুষ্পিতা এবার আকাশ থেকে পড়ে।
ঠিক শুনেছে কী না নিশ্চিত হতে বলল,
“ জি?”
তীব্রর শিরায় শিরায় মেজাজ থাকে। অন্য কেউ হলে,এতবার একটা কথা বলাতে হয়ত চেতে-টেতে একাকার করে ফেলত। কিন্তু এই মেয়েকে সে মেজাজ দেখাতে পারবে না। তাই ভেতরের সকল উষ্ণতা খুব আলগোছে চাপা দিয়ে রাখল। উত্তর হিসেবে জিপের দরজা খুলে বলল,
“ সিট।”
পুষ্পিতা হতবাক! সে কী না স্যারের গাড়িতে চড়বে? স্যার লিফট দিতে চাইছেন? আহা কী দয়ার শরীর ওনার! এত ভালো, নিরহংকারী মানুষ কী দুটো হয় পৃথিবীতে?
তাও মিনসে গলায় বলল,
“ স্যার আমি চলে যেতে পারব। এই একটু সামনে গেলেই তো রি..”
তীব্র মাঝপথে স্বর পুরু করে বলল,
“ উঠতে বলেছি ওঠো।”
পরপর-ই পুরুষালি কণ্ঠ অন্যরকম হলো। হুইলে হাত রেখে রাস্তা দেখে বলল,
“ দুজনের গন্তব্য যখন এক, একসাথেই যাওয়া উচিত।”
পুষ্পিতা জ্বিভে ঠোঁট ভেজায়। দোনামনা করে উঠে বসলে, যুদ্ধে জয় ছি*নিয়ে নেওয়ার মতন বুক ফোলাল তীব্র।
সন্তর্পণে হাসিটা লুকিয়ে, জিপে টান বসাল গতিতে৷
পুষ্পিতা তখন গাড়ির সিট দেখছে,জানলা দেখছে,দেখছে কাচ গুলোকে । অক্ষিকূটে তার বিহ্বলতার বাণ। এমন দামী গাড়িতে সে পূর্বে চড়েনি। জীবনে প্রথম বার প্রাইভেট কারে চড়েছিল সেই মাস্তানটার সঙ্গে। তাও জানটা হাতের মুঠোয় নিয়ে। না বাবা,সেসব ভয়া*বহ কথা না ভাবাই ভালো।
কিন্তু, কী আশ্চর্যের বিষয়,প্রথম বার এক মাস্তান যাত্রা সঙ্গী ছিল,আর আজ এক শিক্ষক। পৃথিবীর দুই প্রান্তের,দুই পেশার মানুষ!
ও চারপাশ দেখতে দেখতেই বলল,
“ এটা আপনার গাড়ি স্যার?”
“ না।”
পুষ্পিতা বিভ্রম নিয়ে তাকায়,
“ তাহলে?”
তীব্রর জবাব,
“ চুরি করে এনেছি।”
হেসে ফেলল ও। পদ্ম কুড়ির ন্যায় দুটো রক্তিম ঠোঁট সরে গেল দুপাশে। মুখ তুলল শুভ্র দন্তপাটি।
তীব্র ঘাড় বাঁকিয়ে চায়। প্রথমবার পুষ্পিতার মুক্তঝড়া হাসিটায় আটকে আসে, বিলাতি মূক দৃষ্টিযূগল। অথচ সেকেন্ড সে চোখ ফেরাল। মনের সঙ্গে সঙ্গে জিপের নিয়ন্ত্রণ রাখল খুব সতর্কতায়।
হুইল ঘুরিয়ে সামনে চেয়ে ভাবল,
“ এই হাসি দেখে দেখে,এক পৃথিবীর হাজারো ক্লান্তি, হাজারো ক্লেশ নির্দ্বিধায় লুকিয়ে নেওয়া যাবে!”
তীব্র নিরেট অভিব্যক্তি বেঁকে যাচ্ছে। অনুভূতিরা বাইরে ঠিকড়ে আসা আড়াল করার প্রয়াসে, প্রসঙ্গ পাল্টানো প্রয়োজন। গলার শ্লেষা পরিষ্কার করে বলল,
“ নামের মানে জেনেছো?”
জ্বিভ কাটল পুষ্পিতা৷ কাচুমাচু ভঙিতে দুপাশে মাথা নেড়ে বলল,
“ না মানে,ভুলে গিয়েছিলাম।”
তীব্র তাকায় ওর দিক। চশমার আবডালে তার সূচাল নেত্র আরো ছোট করে বলে,
“ ভুলে গিয়েছিলে? টিচাররা কিছু বললে ভুলে যাও? কেমন ছাত্রী তুমি!’
গুরুতর কথায় হাসি মুছে গেল ওর। ছোট হলো আদল।
তেমন ছোট করেই জানাল ,
“ সরি স্যার!
কালকে ঠিক বলব।”
তীব্র আর কিছু বলেনি।
তার কেমন অস্থির লাগছে। শরীর ঘামছে। শার্ট চুইয়ে নোনতা স্রোত নামার অনুভূতিটাও স্পষ্ট।
নার্ভাস লাগছে হয়ত। খুশখুশ করছে গলার মধ্যে। পুষ্পিতা এর আগেও তার সাথে এক গাড়িতে বসেছিল। কিন্তু সেদিন এরকম লাগেনি। বুকের মধ্যে কেমন অদ্ভুতুরে উত্থান- পতনের আওয়াজ পরিষ্কার শুনছে ও।
তীব্র ঢোক গেলে। এটা কী তবে সেই ধুকপুকানির শব্দ? সে জ্বিভে শুকনো ঠোঁট চাটে। এই শব্দ কী বাইরে যাচ্ছে? ভিতু মেয়েটাও শুনে ফেলছে না তো?
তীব্রর দিশেহারা লাগে। অশান্ত চিত্তের পরিস্থিতিকে হাতে আনতে চট করে এফ এমের বাটন টিপে দেয়। স্বজোরে বেজে ওঠে,
“ Parvat jaise yu khade hain
Had se zayaada ye ada hain
56” ki seena yein hain
Dharti faad ke yee aya hain
jor se bolo yeto chir dega yay hain sultan….”
গানের মিউজিক জোড়াল। সাথে মারপিটের সংকেত। নিঃসন্দেহে হিরো কাউকে মেরে উল্টেপাল্টে দিচ্ছে।
পুষ্পিতা প্রথম দফায় লাফিয়ে ওঠে। পরে পল্লব ঝাপটায়। এ আবার কেমন গান? পৃথিবীতে এত সুন্দর সুন্দর গান থাকতে এসব কেউ শোনে? দুমদাম শব্দে তার মাথা ব্যথা উঠল। একেবারে নিরুপায় হয়ে মুখ খুলল,
“ স্যার,আপনি সব সময় এরকম গান শোনেন?”
“ হ্যাঁ। কেন?”
পুষ্পিতা হাসার চেষ্টা করল,
“ এমনি।”
তার চেহারা দেখে তীব্র বিভ্রান্ত হয়।
“ কোনও সমস্যা? পালটে দেব?”
সবেগে, নিসঙ্কোচে মাথা ঝাঁকাল পুষ্পিতা। মুখবিবরেও একটু-আধটু আলোর ঝলক দেখা গেল এবার।
তীব্র ফের বাটন টেপে। তবে এবার আরো জোরে বাজল,
“ চ্যালেঞ্জ দিবি না শালা…
পাঙ্গা নিবি না শালা।”
সমস্ত আগ্রহ ফুস করে উড়ে গেল মেয়েটার। আস্তে করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
বিড়বিড় করে বলল,
“ মনে হচ্ছে,ওনারও রাহাতের মতো মারপিট অনেক পছন্দ!”
তীব্রর কানে পৌঁছে যায় সে কথা। বলতে যায়,
“ খুউব!”
অথচ শশব্যস্ত বাক্যগুলো গিলে নিলো। উলটে ভীষণ গম্ভীর গলায় বলল,
“ না। তা কেন হবে? আমি একজন লেকচারার! আমি শান্তি পছন্দ করি, মা*রামারি নয়।”
পুষ্পিতার মুখ শুকিয়ে গেছে। তাকাল বড় বড় চোখে। সে এত আস্তে বলল,আর উনি শুনতে পেয়ে গেলেন? মুখ কালো করে বলল,
“ আমি মানে, আমি ওভাবে বলতে চাইনি স্যার। আসলে এরকম গান আগে শুনিনি তো।”
“ তাহলে কীরকম গান শোনো তুমি?”
চপলতাহীন মেয়েটা এ পর্যায়ে চঞ্চল হলো খানিক। জড়োতাহীন জানাল,
“ আমার পুরোনো গান অনেক পছন্দ! ওই যে উত্তম কুমার, তারপর শাহরুখ খানের গান গুলো? ওসব শুনতে ভীষণ ভালো লাগে। শুনলে মনে হয়,বারবার শুনতেই থাকি।”
তীব্রর চেহারা কুঁচকে এলো অনীহায়। শাহরুখের সিনেমায় শুধু প্রেম থাকে। সে কস্মিনকালেও তা দেখেনি। আর উত্তম কুমারটা কে! চেনেই তো না।
কিন্তু পুষ্পিতার চকচকে চাউনী,আর উচ্ছল স্বরে মনে হলো একবার শোনা উচিত।
সে আচমকা ফ্রন্ট থেকে ফোন তুলে এগিয়ে দিলো। পুষ্পিতা প্রশ্ন সমেত চাইলে বলল,
“ বের করো।”
“ জী?”
“ যাদের কথা বললে,তাদের একটা গান বের করো।”
পুষ্পিতা জড়সড় ভঙিতে ফোন নেয় হাতে। তীব্র বলে দিলো ইউটিউবে যেতে৷ শুনল সে। সার্চ বারে উত্তম কুমারের গান লিখলে, অনেক গুলো ভেসে উঠল স্ক্রিনে। সবার প্রথমে যেটা ছিল সেটাই বাজাল সে।
খুব স্নিগ্ধ,মোলায়েম কিছু বাদ্যের আওয়াজের সাথে পুরুষ কণ্ঠ গেয়ে ওঠে,
“ এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হোতো তুমি বলো তো!
যদি পৃথিবীটা স্বপ্নের দেশ হয়, তবে কেমন হোতো তুমি বলো তো!”
তীব্রর চোখ রাস্তায় রইলেও,কান ছিল এদিকে। ভীষণ নিবেশনে সবটা শুনলোও গানের। তার মতো মানুষের নিকট এসব হাস্যকর মনে হয়েছে আগে। কিন্তু এই মুহুর্তে কেন যেন ভালো লেগে যায়! এই যে ভীতু মেয়েটা পাশে বসে। মাত্র কয়েক ইঞ্চি দুরুত্ব দুজনের। সত্যিই তো, এই পথটা শেষ না হলে কেমন হয়?
**
সেই অনর্থক চাওয়া ফলেনি। বরং একটু তাড়াতাড়িই গন্তব্য এসে গেল যেন। কলেজ গেট থেকে খানিক আগে,জিপে ব্রেক কষল তীব্র।
এখান থেকে কয়েক পা হেঁটে যেতে হবে।
পুষ্পিতা নামল। হাস্যজ্বল ঠোঁটে ফিরে চেয়ে বলল,
“ ধন্যবাদ স্যার!”
তীব্রর গলবিল তখন বৃষ্টি বিরল মরুভূমি! যেন কয়েক শতাব্দী একটুখানিও জলের ছোঁয়া পায়নি । পুষ্পিতার ওষ্ঠভাগের ওই সামান্য হাসিতেও আত্মহারা লাগছে। এই মেয়ে এমন হাসছে কেন আজ? এত হাসলে সে ঠিক থাকতে পারবে?
বেগ পুহিয়ে সংক্ষিপ্ত জবাব দেয়,
“ওকে।”
পুষ্পিতা এগোয়। কিন্তু তীব্রর লম্বা পদযূগলের কাছে সুবিধে করতে পারে না। তার অনেক পরে এসেও,পেছনে ফেলে এগিয়ে যায় সে।
ফুটপাতের এ-পাশে ছোট খাটো ভাঙা পাঁচিল। কিছু ছেলে সব সময় বসে থাকে তার ওপর। আজকেও দুজন আছে।
ঠিক সেই বিট্টু গ্যাং এর মতোন মেয়ে দেখলেই, জ্বিভ ঝাঁপিয়ে পড়ে ওদের।
পুষ্পিতা হেঁটে যাচ্ছিল যখন,
একজন ইচ্ছে করে কেশে ওঠে,যাতে ও তাকায়। লাভ হলো না দেখে অপর জন ফট করে বলল,
“ কী ফিগার! সাইজ কত বেবি?”
পুষ্পিতা চোখ খিচে বুজে নিলো। গাত্রের সমস্ত শিরা রি রি করে ওঠে। কিন্তু পালটা জবাবের স্পর্ধা তার হলো না। ঢোক গেলার সঙ্গে, গিলে নিলো অসম্মান। চুপচাপ, মাথা নুইয়ে চলে যায় সামনে থেকে।
অন্যদিকে,থমকে দাঁড়াল তীব্র। ক্রোধের আ*গুন দাউদাউ করে জ্বা*লিয়ে দিলো শরীর । হাত মুঠো হলো,ভেসে উঠল শক্ত গড়নের পোক্ত চিবুকের ধার। ঘুরে তাকাল পেছনে। পুষ্পিতা কাছাকাছি আসতেই বলল,
“ কী বলেছে ওরা তোমাকে?”
তার ধীর-স্থির কণ্ঠে ভেতরের টর্নেডো বোঝার সাধ্য নেই। কোটরে জল সমেত চোখ তুলল পুষ্পিতা। তীব্রর বুকের মধ্যে সুনামি ওঠে রা*গের। অথচ ততোধিক নম্র গলায় বলে,
“ ওরা কী এখানে রোজ বসে? রোজ বিরক্ত করে তোমায়?”
পুষ্পিতা ওপর-নীচ মাথা দোলাল।
“ শুধু আমাকে না, সব মেয়েদের!’’
“ তো চলে এসেছ কেন? এত নোংরা একটা কথা শোনার পর তোমার তো প্রতিবাদ করা উচিত ।”
পুষ্পিতা বিস্মিত,
“ আমি? আমি কী বলব?”
তীব্র কপাল গোছাল,
“ কী বলবে মানে? চ*ড় বসাবে ওদের গালে।”
পুষ্পিতার চক্ষু কোটর ছাড়ায়। জীবনে মাছি মা*রেনি,সেখানে একটা বখাটে ছেলেকে মা*রবে? এইটুকু কলিজায়, তার অত সাহস নেই!
চিবুক নামিয়ে বলল,
“ আমি পারব না স্যার! ”
তীব্র ভীষণ ঠান্ডা স্বরে বলল,
“ কেন পারবেনা? যে ভাষা ওরা ব্যবহার করেছে, তার শাস্তি দিতে ইচ্ছে করছে না তোমার?”
পুষ্পিতা টলমলে চোখে চায়। নিষ্প্রাণ হেসে বলে,
“ ইচ্ছে করলেই কী একটা অনাথ মেয়ে সব পারে? পারে না! তারওপর যে অন্যের দ্বারস্থ! আমার জন্য কোনও সামান্য ঝামেলা বাঁধলে নূহা, আন্টি ওদেরও সমস্যা হতে পারে। আমি তা চাইতে পারিনা! আমার হয়ে লড়ার যে কেউ নেই।”
তীব্র কিছু সময় চেয়ে রইল। সাদাটে চোখ ,হিমের ন্যায়। পুষ্পিতার দৃষ্টি যখন নীচে,হুট করে ওর হাত ধরে বলল,
“ এসো।”
বিমুঢ় নেত্রে চাইল ও। তীব্রর ধরে রাখা বাঁধনের দিক দেখল একপল। প্রশ্ন করার আগেই হাতে টান বসে।
একেবারে দীর্ঘ কদমে সেই ছেলে দুজনের সামনে এসে থামল তীব্র। তত্র মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল পুষ্পিতার।
তীব্র হাত ছাড়ল। ওদের দিক চেয়ে বলল,
“ নাও, মারো।”
হতচেতন মেয়েটা, আঁতকে ওঠে এবার। মার*বে কী, তার পা কাঁপছে। বুক ধড়ফড় করছে।
ছেলে দুটো মুখ চাওয়া-চাওয়ি করেই দাঁড়িয়ে গেল। একজন ক্ষেপে বলল,
“ কী? মা*রবি আমাদের? এত সাহস!
পুষ্পিতার আত্মা উড়াল দেয় ডরে। ঢোক গেলে বারবার। তীব্র ওদের উত্তর দিলোনা। নির্ভীক মনোভাব! হাত দুটো পকেটে গুঁজে দাঁত পিষে বলল,
“ আই সেইড স্ল্যাপ হিম।”
ও ভয় পেয়ে ঘনঘন মাথা নাড়ে। বোঝায়, পারবে না। তীব্র পুরোপুরি ঘুরে চাইল ওর দিক। গাঢ় কণ্ঠে বলল,
“ যদি নিজের শরীরকে সম্মান করো,নিজেকে সম্মান করো তবে আমার কথা তোমাকে শুনতে হবে। রাইট নাও। বাকীটা দেখার জন্য আমি আছি।”
তীব্রর দৃষ্টিতে জ্বলন্ত শিখা। তার কথাতে কী ছিল জানা নেই। কিন্তু সত্যি কেমন ভরসা পেলো পুষ্পিতা। সহসা দানবের ন্যায় অলৌকিক সাহস,ভর করল বুকে। বিগত এক মাস ধরে, এদের ছুড়ে দেওয়া একেকটা নোংরা ইঙ্গিত শ্রবণেন্দ্রিয়ে উৎকট হাম*লা চালাল। মেয়েলী দেহে কাঁটার মত বিঁধে খোঁ*চাল সেসব।
অচিরেই একজনের গাল বরাবর ঠাস করে চড় বসাল সে। কথাগুলো কে বলত পুষ্পিতা জানে না। তাকিয়ে দেখেওনি কোনও-টাকে। সামনে যাকে পেয়েছে, মে*রেছে।
মেয়েলী প্রহারে ওরা হকচকায়। পাশের জন তেঁতে বলতে নেয়,
“ শালী আম…”
তৎক্ষনাৎ পুষ্পিতা,ওকেও আরেক থাপ্পড় মা*রে। ভড়কে গেল সে ছেলে। গালে হাত চেপে গোলাকার চোখে তাকাল। এদিকে তীব্র নিজেই চমকে গেছে। দুই ভ্রু উঁচিয়ে ভাবল,
“ বাবাহ! একটা মা*রতেই চাইছিল না সেখানে দুটো?”
ঊনিশ বছরের জীবনে প্রথম বার কাউকে আ*ঘাত করল পুষ্পিতা। তাও কোনও পুরুষের অন্যায়ের বিরুদ্ধে! বক্ষপটে থাকা এতদিন কার বিরাট পাথর সুরসুরে ভঙিতে নেমে গেল কেমন।
সে আপ্লুত চোখে চায় তীব্রর দিকে। বিজয়ী হেসে বলে,
‘’ মেরেছি স্যার!”
তীব্র তার চমকটুকু ঢেকে রাখে। চোখ-মুখে গাম্ভীর্য ফলিয়ে বলে,
“ যাও এখন।”
পুষ্পিতা ফ্যাসফ্যাসে শ্বাস নিতে নিতে মাথা দুলিয়ে চলে গেল। আনন্দ হচ্ছে ওর! ভীষণ আনন্দ! হাঁটতে হাঁটতে যে হাতে মে*রেছে সামনে ধরল সেটা। ভূমিকম্প ছুটছে সেথায়। তাতে কী!
আজ ও প্রতিবাদ করেছে। আর এই অসম্ভাব্য জিনিসটা কেবল সম্ভব হয়েছে তীব্রর জন্যে। মানুষটার কাছে সে সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবে।
ছেলে দুটো রোষে থরথর করছে । একজন তীব্রর সামনে আঙুল উঁচিয়ে বলল,
“ তুই আমাগো চিনোস না। গাজীপুর কাঁপাইন্নার ক্ষমতা রাখি আমরা। আমগো গায়ে হাত? তোরে তো মাটি চাপা দিমুই আর ঐ মাইয়া….”
তীব্র খপ করে এক হাতে ওর কলার চেপে ধরে। চাপা কণ্ঠে কটমট করে বলে,
“ কলেজ ছুটির পর দেখা হবে। বাপের বৈধ ব্যাটা হলে এখন কোনও সিনক্রিয়েট করবি না।”
চলবে।
১. এবার অনেকে বলবেন তীব্র নিজেই তো এমন! আবার প্রতিবাদ শেখায়। জি সত্য কথা,মাথায় আছে। আর উত্তর পরের পর্বে পাবেন। প্যারা নেই,চিল!
২. এত দেরীতে গল্প দেই কেন হাজার বার বলেছি। তারপরেও যাদের আগ্রহ কমে যাচ্ছে,তারা গল্প শেষ হলে পড়বেন। তারপরেও এ নিয়ে আপনার করা কমেন্টের কোনও রিপ্লাই দেওয়া হবে না। ধন্যবাদ।