কলমে: নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
(০২)
স্যুট-কোট পড়ুয়া, সুদর্শন পাত্রকে দেখে মাথা ঘুরে গেল মিথিলার। মুগ্ধতায় চক্ষু ললাট ছুঁলো। এমন চমৎকার ছেলেইতো ওর চাই! আবার বিয়ের পর কানাডায় শিফট হবে শুনেছে। একবার ওখানে যেতে পারলেই এই পানসে জীবন ঝলমলে হবে।
মিথিলা দোরগোড়াতেই প্রার্থনা শুরু করল, ‘ ওকে যেন পছন্দ হয়!’
বসার ঘরে উঁকি মেরে, সে তৎপর রুমে ঢুকল আবার। গালে ব্লাশন ছড়াল আরেকটু। লিপস্টিক গাঢ় করে দিলো। খুঁটে খুঁটে দেখল অবঢৌকনে ঢাকা নিজের জৌলুশ। না,সুন্দর লাগছে! মেক-আপ নিয়ে নিজের সমস্ত প্রতিভা আজ চেহারায় ঢেলেছে ও। ছেলের মনে ধরতে বাধ্য। ওতো আর সাধারণ নয়। অসাধারণ বলেইত নাহিদটা পেছন ছাড়েনা। শত খ্যাচখ্যাচানির পরেও কুকুরের মত লেজ নাড়তে থাকে। মিথিলা দর্পণে চেয়ে আপ্লুত হাসল,নিজের প্রতি মোহিতায়।
সেই ক্ষণে, পুষ্পিতা এসে বিনম্র গতিতে পাশে দাঁড়াল।
আয়নার ভেতর থেকেই ওর ওপর চোখ পড়ল মিথিলার। হাসিটা কমে এলো ওমনি। একবার নিজেকে দেখে,তারপর ওকে দেখল।
গাঢ় প্রসাধনী, আর এত সাজসজ্জার ভিড়েও স্বীয় মুখবিবর খুব নগন্য লাগল মিথিলার। মনে হলো পুষ্পিতার ওই মলিন, ক্রিম রঙের মুখখানা অতী সুন্দর, নির্মল!
রাগ হলো ওর। দাউদাউ করে হিং*সের খড়*কুটোতে ব*হ্নি জ্ব*লল সবেগে।
হিসেব মতো পুষ্পিতা ওদের আশ্রিতা। ওদের দয়ায় বেঁচে আছে। এত রুপ কেন থাকবে এই মেয়ের? মিথিলা খিটমিটে চোখে চাইল ওর দিক। কণ্ঠে তেজ,
‘ কী চাই এখানে?’
‘ মণি বলল,তোমার কিছু লাগবে কী না দেখতে।’
‘ মণি মাই ফুট! আমি ডেকেছি তোকে? ডেকেছি?’
পুষ্পিতা মাথা নোয়াল। ডানে-বামে নাড়ল। বোঝাল ‘ না।’
‘ তাহলে বেহায়ার মত এলি কেন? সরে দাঁড়া আমার কাছ থেকে।’
নিশ্চুপ ভাবে সরে গেল ও। রাহাত বিছানায় শুয়েছিল। গেমস খেলছিল ফোনে। বোনের ব্যবহারে বিরক্ত হয়ে বলল,
‘ তুমি ছোটপুর সাথে এমন করছো কেন? হেল্পইতো করতে এসেছে।’
মিথিলা চোখ গর*ম করে তাকায়। ধমক দেয়,
‘ তুই চুপ থাক।’
ভেঙচি কা*টল রাহাত৷
মিথিলার এই খচ্চরে স্বভাবটা দূর্দান্ত অপছন্দ ওর৷ ঠিক যতটা পছন্দ পুষ্পিতাকে।
মাঝেমধ্যে রাহাত ভেবে পায়না, দুজনে এতটা অমিল কেন? ওরাতো একই চালের ভাত খায়। একইরকম তরকারি খায়,এক ঘরে ঘুমোয়। তাহলে দুজন দুই মেরুর কী করে?
পুষ্পিতা কত শান্ত,ভদ্র,কী সুন্দর করে কথা বলে ওর সাথে! কণ্ঠ শুনলেই বুক ঠান্ডা হয়ে যায়। আর মিথিলা,ধমক ছাড়া কিচ্ছু জানেনা। শুধু সাজে,ঘুরে বেড়ায়,ফোন টেপে। ওকে একটু আদরও করেনা।
রাহাত পুষ্পিতার শুষ্ক মুখের দিক চাইল। কণ্ঠে অজস্র স্নেহ ঢেলে বলল,
‘ ছোটপু,তুমি আমার কাছে এসো। আমি কতগুলো এনিমি মে*রেছি তোমাকে দেখাই।’
পুষ্পিতা ঠোঁটে হাসি টানল। এগোল ওর দিকে। বিছানায় বসতে যাবে, মিথিলা হুশিয়ারী দিলো,
‘ এই ওখানে বসবিনা। নীচে বোস।’
পুষ্পিতা থামে। মাথা হেলিয়ে মেঝেতে বসে। বিষয়টায় ছোট্ট রাহাতের মাথা গ*রম হয়। অসন্তোষ নিয়ে চেয়ে রয় বোনের দিক।
ওদের এই নতুন ফ্ল্যাটে শোবার ঘর মোটে দুটো। একটায় বাবা-মা থাকেন,অন্যটায় ওরা তিনজন। খাট-টা বেশ বড়সড়। তিনজন আরামসে ঘুমোনোর জন্য যথেষ্ট। কিন্তু তাও এখানে পুষ্পিতার জায়গা হয়না।
মিথিলা দেয় না। সালমা বেগমের শত চোটপাট অগ্রাহ্য করে,ওকে নামিয়ে দেয় ফ্লোরে। আগের বাসাতেও তাই হয়েছে। শুতে না দিক,বসতে দিলে কী হয়?
রাহাত মায়া-মায়া আঁখিতে পুষ্পিতাকে দেখল। ইশ! ওর যদি ক্ষমতা থাকতো,একটা বিরাট খাট বানিয়ে দিতো। ঠিক রূপকথার রাজকন্যারা যেমন পালঙ্কে শোয়? ওমন। ওর ছোটপু তো রাজকন্যার মতই সুন্দর!
সালমা বেগম ব্যস্ত পায়ে কক্ষে ঢুকলেন তখন। মেয়েকে শুধালেন,
‘ হলো তোর? চল এবার।’
মিথিলা ঘুরে চাইল। শাড়ি ঠিকঠাক করে জানাল,
‘ হ্যাঁ এইত,চলো।’
নিজেকে আরেকবার দেখে নিলো সে। সাজগোজের নিপুণ নিরীক্ষণ শেষে মায়ের সঙ্গে ঘর ছাড়ল।
রাহাতের সূক্ষ্ণ মনোযোগ স্ক্রিনে। যু*দ্ধ চলছে অহর্নিশ। গোলা-গুলির যান্ত্রিক শব্দে কামড়া আলোড়িত।
শ*ত্রুপক্ষকে হারানোর অদম্য প্রয়াস তার। চোখে-মুখে জিততে চাওয়ার ঝলক। পুষ্পিতা সেদিক চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। বাড়িতে ওর ভালো থাকার অন্যতম কারণ এই বাচ্চা ছেলেটা।
বসার ঘর থেকে হৈহৈ আওয়াজ আসছে। শোনা যাচ্ছে কতগুলো আমুদে কণ্ঠ! ওই পক্ষ থেকে কে কে এসেছে পুষ্পিতা জানেনা। কলিংবেল বাজতেই ও চলে এসেছিল এখানে।
আচ্ছা, আপুকে কী পছন্দ হলো ওনাদের? পুষ্পিতার জানতে ইচ্ছে হয়। ইচ্ছে হয় একটুখানি দেখতে মিথিলার হবু বরকে। অথচ চুপ করে বসে রইল। যাওয়া,বা দেখার ওই অধিকারটুকু তার নেই।
খোরশেদুলের তখনকার বলা প্রতিটি কথা শুনেছে পুষ্পিতা। তিক্ত বাক্যগুলো চা*বুকের মত বিঁ*ধেছে গায়ে। এফোড়-ওফোড় করেছে একটুখানি শরীর। পুষ্পিতা ঢোক গিলল। সাথে গিলে নিলো কণ্ঠনালীতে এসে আটকে থাকা কা*ন্নাদের। সে অনাথ,বাবা নেই। খোঁজ নেয়না,কোথায় আছে জানেওনা। এটা কী ওর দোষ? শুনেছিল মা মা*রা যাওয়ার পর, বাবা ওকে এতিম-খানায় দিয়ে দেন। মণিই খুঁজে খুঁজে সেখানে গিয়ে দত্তক আনেন ওকে। মায়ের মত সবটুকু আদর সে দিয়েছেন। এখনও দিচ্ছেন। কিন্তু খোরশেদুল কেন যেন ওকে সহ্যই করতে পারেন না। সেই ছোট্ট থেকে লোকটার বি*ষবাক্যের স্বীকার সে। প্রতিটা মুহুর্ত কাটে ওনার রুষ্টতার কবলে। পুষ্পিতা এসব চায়না। ইচ্ছে হয় একটু ভালো থাকতে। চায়না ওকে নিয়ে ছেলেবেলা হতে দেখা মণির সংসারের এসব অশান্তি । চলে যেতে চায় দূরে, অনেক দূরে! কিন্তু কোথায় যাবে? যাওয়ার তো জায়গা নেই! এই ভূমন্ডলের একটি পতিত বিন্দুর মত ও একা। ডানে-বামে,সামনে -পেছনে যেদিকে তাকায়, নিঃস্ব নিজেকে খুঁজে পায়।
পুষ্পিতা নিরলস মস্তক পেছনের দেয়ালে ঠেসে দেয়। চোখ বোজে ক্লান্ত ভঙিতে৷ কার্নিশ বেয়ে তরতর করে জল নামে দু ফোঁটা। আচমকা একটি কোমল হাত গাল ছুঁয়ে দিলো। তাকাল পুষ্পিতা। রাহাত জল মুছিয়ে বলল,
‘ কেঁদো না। আপুর কথায় ক*ষ্ট পেয়েছ? ওতো ওরকমই। তুমি কাঁ*দলে আমার খুব কষ্ট হয় ছোটপু।’
আদুরে হাতটা মুঠোয় নিয়ে মৃদূ হাসল পুষ্পিতা৷ রাহাতের মাংসল ডান গালে চুমু খেয়ে বলল,
‘ আর কাঁ*দব না। খুশি?’
রাহাত সানন্দে মাথা ঝাঁকাল। কোকড়া চুল নড়েচড়ে উঠল সজোরে।
পরপর বলল,
‘ একটু ওদিকে যাই। দেখে আসি কী হচ্ছে?’
‘ আচ্ছা।’
ফোন রেখে বিছানা ছাড়ল রাহাত। দুরন্ত পায়ে দৌড়ে গেল বসার ঘরে।
পুষ্পিতা বসে রইল ওমন। আস্তে-ধীরে হাঁটুতে থুত্নী নেমে আসে। আঠের বছরের জীবনের হিসেব-নিকেশে মস্তিষ্ক ব্যস্ত হয়। মৃত মায়ের জন্য ভেতরটা হুহু করে কাঁ*দে। ক্ষোভ জন্মে নিষ্ঠুর সেই বাবার প্রতি।
আচমকা পায়ের শব্দে মাথা তুলল পুষ্পিতা। মিথিলা ঢুকেছে, সঙ্গে তার হবু বর পলাশ।
দুজনকে আলাদা কথা বলতে পাঠানো হয়েছে এ ঘরে। পুষ্পিতা এক পল ওনাকে দেখেই তৎপর দৃষ্টি নামাল। মিথিলা কর্তৃর ন্যায় হুকুম ছু*ড়ল,
‘ যা এখান থেকে। ‘
বিলম্বব্যাতীত উঠে দাঁড়াল পুষ্পিতা। ভুল করেও তাকালো না উঁচুতে। গলদেশে চিবুকে রেখেই বেরিয়ে গেল।
পলাশ হা করে চেয়ে রইল সেদিক। অক্ষিকোটরের পরতে পরতে মূঢ়তা। বিড়বিড় করল,
‘ হোয়্যাট আ বিউটি!’
তার ধ্যান ভা*ঙল মিথিলার গদগদ কণ্ঠে,
‘ বসুন না! দাঁড়িয়ে কেন?’
‘ হু? ‘
গলা খাকাড়ি দিলো পলাশ। জ্বিভে ঠোঁট ভিজিয়ে ফের পুষ্পিতার প্রস্থানপথে চাইল। তার মস্তিষ্ক দিশাহীন ঘুরে গেছে। এমন সদ্য ফোটা পুষ্প দেখে আষ্ঠেপৃষ্ঠে ধরেছে অন্যরকম চাওয়া।
ওমন তাকিয়েই প্রশ্ন করল ‘ মেয়েটি কে?’
পলাশের চোখ-মুখ,আর চাউনী দেখে সবটা পরিষ্কার বুঝে ফেলল মিথিলা। দাঁতকপাটি পি*ষল। পরপর শান্ত হয়ে ভাবল, না,মাথা গরম করলে চলবে না।
বুদ্ধি খাটিয়ে জানাল,
‘ ও আমাদের মেইড সার্ভেন্ট। এতিম তো,যাওয়ার জায়গা নেই। এখানেই থাকে। সব কাজ করে দেয়।’
পুষ্পিতার কদম স্থিত হলো ওমনি। কথাগুলো শুনে থমকাল এক পল। পরপর দীর্ঘশ্বাস,আর তমিস্রার ঢাকনায়, ঢেকে ফেলল সমস্ত অপমান।
কাজের মেয়ে শুনেই,পলাশের মুখটা ছোট হয়ে আসে। তার মত হাইলি এডুকেটেড একজন ইঞ্জিনিয়ারের সাথে নিশ্চয়ই গৃহকর্মীকে মানাবেনা! তা সে যত সুন্দরীই হোক না কেন! স্টাটাস বলেও তো একটা ব্যাপার আছে। পলাশ আহত হলো। চুপচাপ গিলে নিলো ক্ষণিকের চাওয়া -পাওয়া। বসল বিছানায়। মিথিলা ঠোঁট চেপে বিজয়ী হাসে। পাশে বসল, স্ব-উদ্যোগে কথাবার্তা শুরু করল। পলাশ হু- হা করে উত্তর করল শুধু।
******
স্ফূর্ত কণ্ঠে, শীষের শব্দ শুনে প্লেট থেকে মুখ তুললেন জামশেদ। ফিরে চাইলেন সিড়ির দিক। অধীর পায়ে নামছে তীব্র। চেহারায় নিশ্চিন্তের প্রলেপ। পড়নে ডোরাকাটা প্যান্ট,এলোমেলো শার্টের বোতাম খোলা, মাথার চুল অপরিপাটি। বা হাতের কব্জিতে রূপার চকচকে পুরু ব্রেসলেট ঝুলছে।
সকাল সকাল ছেলের রূপ দেখেই মেজাজ চটে গেল ওনার। গতকাল রাতের কান্ডের পর তীব্রর এমন নিরুদ্বিগ্নতা নতুন নয়, হয়ে আসছে।
কিন্তু রা*গ হলো ওর বাউন্ডুলে বেশভূষায়। যেখানে তিনি সব সময় নিজেকে গুছিয়ে রাখেন,সেখানে একমাত্র ছেলের কী ছিড়ি! তার শরীরে থাকে দামী আতরের ঘ্রাণ,সেখানে ও কাছে আসলে সিগারেটের গন্ধে শ্বাস নেওয়া দূর্লভ।
তীব্র ফুরফুরে মেজাজে,গুনগুন করতে করতে এসে চেয়ার টানল। প্রমোদ গলায় আওড়াল,
‘ গুড মর্ণিং।’
লুৎফার মুখটা এইটুকুন। উত্তরে খুব ক*ষ্টে এক টুকরো হাসলেন। পরপর শঙ্কিত লোঁচনে দেখলেন স্বামীর শক্ত মুখ। ছেলের মাতলামি স্বয়ং ও ভুললেও উনি ভোলেননি জানেন। এ নিয়ে এখন আবার কী অশান্তি হবে কে জানে! ছেলেটা বড় হওয়ার পর একটু শান্তির মুখ দেখতে পেলেন না!
তীব্র বসল। নিজের মত খাবার তুলল প্লেটে। টেবিলের ওপর ফোন রেখে ভিডিও ছাড়ল। ভাবভঙ্গি এমন,এখানে কেউ নেই।
জামশেদের ক্রোধ প্রগাঢ় হয় এতে।
কণ্ঠ ভারী করে বললেন,
‘ কাল রাতে তুমি আবার মদ খেয়ে এসেছিলে!’
তীব্র ফোনের দিক চেয়েই জবাব দিল,
‘ হ্যাঁ, পার্টি ছিল।’
‘ পার্টিতে মদ খেতে হবে এমন কোনও কথা নেই।’
তীব্রর জবাবের বদলে এলো তার খাবার চিবানোর আওয়াজ। জামশেদ কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পেলেন না। অসন্তোষ জানিয়ে বললেন,
‘ তোমার নামে কাল ফের অভিযোগ এসেছিল।’
খাওয়া থামল তীব্রর। চাইল বাবার দিক। ঘোলা চোখ,তপ্ত রূপে শুধাল,
‘ কে দিয়েছে?’
‘ কেন? শুনে কী করবে? মা*রবে ওদের?’
তীব্র একপেশে হাসে।
‘ তীব্র রেজা তালুকদারের নামে বিচার দেয়। এত বড় বুকের পাটা যার, তাকে দেখব না?’
জামশেদ স্ফূলিঙ্গের ন্যায় জ্ব*লে উঠলেন,
‘ তোমার লজ্জা করেনা, একজন মন্ত্রীর ছেলে হয়ে রাস্তায় গুন্ডামি করে বেড়াতে? আমার কি টাকার অভাব যে তুমি দোকানে গিয়ে চাঁদা তুলে বেড়াবে! তোমার জন্য লজ্জায় মুখ দেখাতে পারিনা আমি। এ নিয়ে কতবার পেপারে তোমার নিউজ ছাপানো হয়েছিল জানো? কত টাকা খসিয়ে সেসব টেলিকাস্ট হওয়ার আগে আমাকে বাতিল করতে হয়েছে হিসেব আছে? কী পাও এসব করে? কী পাও আমার নাম খারাপ করে?’
তীব্র ভণিতাহীন জানাল, ‘ আনন্দ!’
জামশেদ থমকালেন।
নিশ্চিত হতে শুধালেন, ‘ কী?’
তীব্র চাইল। সদর্পে জানাল,
‘ আপনার অনেক টাকা! কিন্তু সেসব উড়িয়ে আমি আনন্দ পাইনা। আপনাদের চোখে যেটা মাস্তানি,আমার কাছে সেটা উল্লাস। মানুষ আমাকে ভ*য় পায়,দেখলে কাঁ*পে আই এঞ্জয় ইট ড্যাড। আপনি মন্ত্রী বলে আপনাকে যে সম্মানটা দেয়,এর চাইতেও অধিক সম্মান কিন্তু আমি পাই। বিষয়টা দারুণ না?’
জামশেদ আশ্চর্য বনে চেয়ে রইলেন। তীব্রর চোখ-মুখ দীপ্ত। উজ্জ্বল মুখবিবর। চেহারায় প্রকাশ পাচ্ছে তার কথার সত্যতা।
তিনি অবাক হয়ে বললেন,
‘ তোমার মুখে বাঁধেনা এসব বলতে? বিন্দুমাত্র
লজ্জাও করেনা?’
তীব্র উদ্বেগহীন,
‘ না। আর আপনার এই এক কথা এবার থামান। নতুন কিছু বলুন। আ’ম ফেডআপ!’
জামশেদ ক্রুদ্ধ হয়ে ঘু*ষি বসালেন টেবিলে। নড়ে উঠল থালা-বাসন। গ্লাসে ঢালা জল ছল্কাল দুদিক।
‘ বাড়াবাড়ির একটা সীমা আছে তীব্র! তুমি ভুলে যাচ্ছো আমি একজন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এই অবধি আসতে কত খেসারত দিয়েছি তুমি জানো?
জানোনা। জানলে এমন করতে না। গ্রাজুয়েশন শেষ করেও বেকার ঘুরছ। ঘোরো,কিছু তো বলিনি। তাই বলে মাস্তানি করবে? এলাকার প্রত্যেকটা মানুষ অতীষ্ঠ তোমার য*ন্ত্রনায়। প্রতিদিন গেটে কেউ না কেউ আসে। আর কত? মান ইজ্জত অনেক শেষ করেছ,থামো এখন। ছেলে বলে কিছু বলছিনা, মানে এই নয় যে বলব না। সাফ সাফ শুনে রাখো, বারবার মানা করা সত্ত্বেও একই কাজ করলে, আমি কিন্তু আর এক দন্ড সহ্য করব না।’
তীব্রর কিচ্ছু যায় এলো না। এমন ভঙিতে হাসল যেন উড়িয়ে দিলো বাবার তর্জন। বরফ গলায় বলল,
‘ একটু ভুল বললেন। আপনি আমাকে সহ্য করছেন,আপনার ছেলে বলে নয়, কাজে লাগি তাই।’
জামশেদ হু*ঙ্কার দিলেন,
‘ তীব্র! ব্লাকমেইল করছো তুমি?’
তীব্র তাকাল। কণ্ঠ অপরিবর্তিত,
‘ না, বোঝাচ্ছি। আমি যেমন আপনার কাজে হস্তক্ষেপ করিনা,কোথায় কী করছেন দেখতে যাইনা। আপনারও তেমন আমার কাজ নিয়ে মাথা ঘামানো উচিত নয়। এভ্রিওয়ান স্যুড হ্যাভ দেয়্যার প্রাইভেসি ড্যাড।’
লুৎফা দিশেহারা ভঙিতে দাঁড়িয়ে। স্বামী-সন্তানের দ্বন্দ্বে হাঁসফাঁস করছেন নীরবে। কাকে থামাবেন,কী বলবেন জানেন না। দুজনের কেউই যে কথার মান রাখেনি কোনওদিন।
তীব্রর কাটাকাটা জবাবে, জামশেদ বাক্যহীন। উত্তর খুঁজে পেলেন না। শুধু পৌঢ় গতর ক্রো*ধে থরথর করতে দেখা গেল। ছেলেকে যুতসই জবাব দিতে না পারার ব্যর্থতায় রুঢ়তা ছুটল রন্ধ্রে। আ*ক্রোশে
খাবার শুদ্ধ থালাটা ছু*ড়ে ফেললেন মেঝেতে। চমকে,আঁতকে চাইলেন লুৎফা। তীব্র একবার সেদিক দেখে, ফের ফোনে মনোযোগ দেয়।
জামশেদ কিড়মিড় করলেন। উঠে, হনহনে পায়ে হাঁটা ধরলেন সদর গেটের দিকে। পেছনে লুৎফা ছুটতে ছুটতে অনুনয় করলেন,
‘ শোনো,খাবার ফেলে যেতে নেই।’
টেবিলে বসা তীব্র তখনও ভ্রুক্ষেপহীন। বাবাকে তো দূর, মেঝেতে ছড়ানো থালার দিকে আর একটিবারও ফিরে দেখল না। সে তার মত ব্যস্ত খাওয়ায়।
লুৎফা সংকীর্ণ আদলে, পাশে এসে দাঁড়ালেন।
‘ কেন এরকম করিস বলতো! বাবা তো রা*গ করে না খেয়ে গেলেন। ‘
তীব্র খাওয়া শেষে উঠল,মায়ের আঁচলে মুখ মুছতে মুছতে বলল,
‘ আমি কি ওনাকে খেতে মানা করেছিলাম?’
‘ তুই…’
বলতে চেয়েও, শ্রান্তের ন্যায় থামলেন লুৎফা। কিছু বলে লাভ নেই যেখানে,সেখানে চুপ থাকা ভালো। তীব্র ফোন,চাবি পকেটে ভরে জানাল,
‘ আসছি।’
ভদ্রমহিলা ছেলের যাওয়ার দিক হতাশ চোখে চেয়ে রইলেন। বক্ষ হাতিয়ে, প্রতিবারের ন্যায় হা-হুতাশ ব্যাতীত কিচ্ছুটি মিলল না।
****
করিম শাহের ছোটখাটো চায়ের দোকান। কাল যেখানে বসেছিলেন খোরশেদুল।
দোকানের সামনে দুখানা চিকণ কাঠের বেঞ্চ পাতা। তীব্র তার দলবল সমেত সকালে চা এখানেই খায়। দু বেঞ্চে আটজন বসেছে আজ। বাকীরা লেপ্টে ওদের বাইক সমেত। পাশেই দাঁড়ানো তীব্রর লাল জিপ।
গান গাইছে সবাই। ওদের উঁচু কণ্ঠ হাওয়ায় হাওয়ায় দুলছে।
কাঠের ওপর, বাইকের ওপর হাত দিয়ে ঢোল বাজিয়ে তুলছে সুর। গলায় ফূর্ত আওয়াজ,
‘ আরে আরে ম্যায়তো গায়ারে,দিল ভি গায়ারে…’
তীব্রর মস্তক হাল্কা নড়ছে। তালে তালে নড়ছে পায়ের ওপর রাখা অন্য পা। দু আঙুলের ফাঁকে জ্বল*ছে অর্ধপো*ড়া সিগারেট।
করিম দোকানদার বয়ষ্ক লোক। অথচ বিনয়ের সাথে শুধালেন,
‘ বিট্টু ভাই, চা দেব?’
তীব্র বিড়িতে টান বসিয়ে জানাল, ‘ হু।’
সেই সময় প্রচন্ড গতিতে একটা বাইক পাশ কাটাল ওদের। আরোহি ঝড়ের গতিতে হাওয়া হলো সামনে দিয়ে। চৈত্র মাসে রাস্তার ধূলো সব উড়ে উঠল বায়ুতে। ওদের গান শেষ, তটস্থ ভঙিতে চাইল। তীব্র ভ্রু গোছাল। টং থেকে স্বল্প মাথা বের করল আগন্তুককে দেখতে।
শাফিনের দিক চেয়ে বলল,
‘ কে ছিল?’
সে মাথা নাড়ল।
‘ চিনিনা। দাঁড়া দেখছি। ‘
শাফিন মুহুর্তে তার বাইক ছোটাল। সাথে চলল, আরও ক’জন।
তীব্রর হাতে তকতকে চায়ের কাপ। এই কাপে করিম শাহ কাউকে চা দেননা। শুধুমাত্র তীব্রর জন্য বরাদ্দ তা।
উষ্ণ চায়ে পোড়-খাওয়া ঠোঁট ভেজানোর মধ্যেই লোকটিকে বগলদাবা করে হাজির হলো ওরা। ভদ্রলোকের চেহারায় আ*তঙ্ক। বিচলিত চোখ-মুখ। কী করেছেন,বুঝতে পারছেন না। এতগুলো তাগড়া যুবকের কবলে পড়ে ঘামছেন খুব। শাফিনের মুঠোয় তার বিন্যস্ত শার্টের কলার।
ওকে ছিটকে রাখার মত তীব্রের সামনে দাঁড় করাল সে। বলল,
‘ এই দ্যাখ,এই ব্যাটা। ‘
তীব্র ঘাড় ফেরাল,দেখল একবার। কিছু বলল না। মিরাজ গিয়ে দাঁড়াল সামনে।
‘ কী মামা! কই যাচ্ছিলে এত সেজেগুজে?’
লোকটি ভীত! মনে হচ্ছে ছেলেগুলো সুবিধের না। আর দশ বারোজনের সঙ্গে লড়াইয়ের সাহস তো তার একেবারেই নেই।
নরম গলায় জানাল, ‘ অ..অফিসে..’
‘ খুব তাড়া ছিল বুঝি?’
‘ জি মানে,দেরি হয়ে গেছিল।’
মুশফিক ভ্রু উঁচায়,
‘ এই এলাকায় থাকিস? আগে তো দেখিনি। ‘
‘ জি। আসলে আমার শ্বশুর বাড়ি এখানে। নতুন বিয়ে হয়েছে।’
সবাই সমস্বরে টেনে টেনে বলল , ‘ ওউউ… নতুন জামাই!’
মিরাজ ভদ্রলোকের চিবুক ডান-বামে ঘুরিয়ে বলল,
‘ ওলে ওলে! আমাদের পাড়ার নতুন জামাই। তা জামাই,বিট্টু মাস্তান কে চেনো?’
লোকটি বিভ্রান্ত হয়ে মাথা নাড়লেন।
ও শুধাল, ‘ নাম শুনেছ?’
‘ জজি।’
‘ দেখোনি তাইত। আচ্ছা দেখাচ্ছি, ওই দ্যাখো…’
তীব্রর দিক আঙুল তাক করল মুশফিক। লোকটি অনুসরন করলেন ইশারা। চায়ের কাপে নিপূণ মনোযোগী তীব্রকে দেখলেন গ্রাসিত লোঁচনে।
শাফিন বলল,
‘ দেখেছিস?’
‘ জি।’
‘ সালাম দেবে কে? তোর বাপ?’
লোকটি তৎপর ভ*য়ে ভ*য়ে আওড়াল,
‘আসসালামু আলাইকুম! ‘
মিরাজ তুষ্ট গলায় বলল,
‘গুড। ‘
উনি ছোট কণ্ঠে শুধালেন,
‘ আমি যাব এখন?’
মুশফিক চোখ পাঁকায়, ‘ যেতে বলেছি তোকে?’
‘ জি না…’
শাফিন বলল,
‘ শোন,যেখানে বিট্টু থাকে, লোকজন সেখানে চোখ তুলে হাঁটে না। উঠতে -বসতে সালাম ঠোকে। আর তুই সেখানে জোরে বাইক চালিয়ে যাওয়ার সাহস করেছিস। এটা অন্যায় হয়ে গেল না?’
লোকটিকে চুপ দেখে ধম*কে উঠল, ‘ হলোনা অন্যায়?’
তিনি শশব্যস্ত আওড়ালেন,
‘ জজি, হলো।’
মিরাজ বলল,
‘ হুম্ম,অন্যায় যখন করেছ ভায়া,একটা শা*স্তি পাবেনা তাহলে?’
আশঙ্কায় মুখ চুপসে গেল ওনার। ধরে নিলেন,
‘ এত গুলো ছেলের উদুম কে*লানি খাবেন এবার। মনে মনে সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেললেন,
আজ বেচে গেলে আর জীবনে ফুল স্পিডে বাইক চালাবেন না।
মুশফিক শুধরে দিয়ে বলল,
‘ আহ শাস্তি কেন বলছিস? ও হলো এই এলাকার নতুন জামাই। ওকে তো আমরা আপ্যায়ন করব,কী করব?’
সবাই একসাথে চেঁচাল, ‘ আপ্যায়ন।’
তারপর তীব্রর দিক চেয়ে বলল,
‘ বিট্টু,এই নতুন জামাইকে কী আপ্যায়ন করা যায় বলতো। বাইকটা ভে*ঙে দেই?’
লোকটার ত্রাসিত নয়ন আৎকে উঠল। বাইকখানা তার ভারি শখের! শ্বশুরের থেকে হাতিয়ে নেওয়া উপহার। ভে*ঙে দিলে কষ্টে নিজেই ভে*ঙে যাবেন।
তীব্র এতক্ষণ চুপ ছিল। কাপের আদা মেশানো চা সবটা খালি করে উঠে দাঁড়াল। ঘাড় ডলতে ডলতে এসে দাঁড়াল মুখোমুখি। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে একবার পা থেকে মাথা অবধি দেখল লোকটির। বিলাতি নয়নজোড়ার অতুষ্ণ চাউনী দেখেই ঘাবড়ে গেলেন তিনি। বিট্টু মাস্তান নামটা তার পরিচিত। তিনি এই এলাকার নন,তবু শুনেছেন। কিন্তু চোখে দেখলেন এই প্রথম। এমন চমৎকার চেহারার একটা ছেলে যে এত ভয়া*নক মাস্তান হতে পারে, প্রথম দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে?
আচ্ছা, কার মুখ দেখে বেরিয়ে ছিলেন আজ? কী কুক্ষণে বাইকের স্পিড বাড়িয়েছিলেন? এখন এদের খপ্পর থেকে মুক্ত হবেন কীভাবে?
নীচু গলায় অনুনয় করলেন,
‘ ভাই আর হবেনা। এবারের মত মাফ করে দিন।’
তীব্র পা ফাঁকা করে পেছনে দুই হাত বেঁধে দাঁড়াল। তুষার কণ্ঠে হুকুম ছু*ড়ল,,
‘ প্যান্ট খোল।’
লোকটি ভরকে বলল ‘ জি?’
শাফিন তেঁতে বলল, ‘ জি -এইচ -আই সব পরে। বিট্টু প্যান্ট খুলতে বলেছে, প্যান্ট খোল শালা।’
লোকটি পাথর বনে রইল। অসহায় চোখে দেখল চারপাশ। কত লোক ভিড়েছে! এখন এই ভরা রাস্তায় প্যান্ট খুলতে হবে? তাও শ্বশুর বাড়ির এলাকায়?
মিরাজ অধৈর্য হয়ে উঠল,
‘ বয়ড়ার বাচ্চা কানে শুনিস না? খোল প্যান্ট।’
লোকটি নি*হতের ন্যায় চাইল। আজকে আর নিস্তার নেই। সম্মানের হনন এখানেই লেখা। মন্থর বেগে বেল্ট ছাড়িয়ে প্যান্ট খুলতেই
তীব্রর পরের হুকুম,
‘ শার্ট খোল এবার।’
নিঃসহায়ের ন্যায় শার্ট আর টাই খুলে প্যান্টের পাশে রাখলেন লোকটি। পড়নে স্যান্ডো গেঞ্জি আর হাঁটুর এক ইঞ্চি ওপরে একটা ছোট্ট প্যান্ট ব্যাতীত কিচ্ছু নেই এখন। সবাই হু-হা করে হেসে উঠতেই লজ্জায় মস্তক ঝোঁকালেন তিনি।
তীব্র টাই হাতে তোলে। স্যান্ডো গেঞ্জির ওপর দিয়ে ঝুলিয়ে দেয় ওনার গলাতে। সরে এসে ডাকে,
‘ শাফিন!’
তার ব্যস্ত জবাব, ‘ বল দোস্ত…’
‘ ওকে নিজ দায়িত্বে এলাকাটা ঘুরিয়ে দেখা।’
লোকটি চোখ তুলল না। লজ্জায় মাটিতে মিশে যাচ্ছেন উপহাসের স্বীকার হয়ে। শাফিন কাঁধ পেঁচিয়ে বলল,
‘ চলেন দুলাভাই।’
তীব্রর চোখ হাসছে,অথচ চিবুক সুদৃঢ়। এসে আগের জায়গায় বসল। করিম শাহ সবটা নিশ্চুপ দেখলেন। আলগোছে, হতাশ, দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। মিরাজ আনন্দ চিত্তে বলল,
‘ একদম ঠিক হয়েছে। শালার সাহস কী,আমাদের সামনে থেকে জোরে বাইক চালায়।’
তীব্র হা করতে নেয় কিছু বলতে। পূর্বেই কানে আসে একটি ছোট,প্রফুল্ল কণ্ঠ,
‘ আপনিই বিট্টু মাস্তান?’
ঘাড় বাঁকিয়ে চাইল সে। উত্তর দেওয়া ঠোঁট দুটো থামল। সবাই তাকাল এক যোগে। খুঁজে পেল একটি বাচ্চা মুখ। কোকড়া চুলের,স্বাস্থ্যবাণ রাহাত দাঁড়িয়ে। পড়নে স্কুলের ইউনিফর্ম। পিঠে ব্যাগ,গলায় ঝুলছে পানির বোতল। হাঁপাচ্ছে সে। ছুটে এসেছে স্পষ্ট। এতক্ষণের কান্ডকারখানা সবটা দেখেছে ও।
গোলগাল মুখে রাজ্যের বিস্ময়! পুরোটা ঠিকড়ে দিচ্ছে তীব্রর দিক।
তীব্রর কপালে ভাঁজ পড়ল। একবার চাইল বন্ধুদের দিক। ফিরে শুধাল,
‘ তুমি?’
রাহাতের চটপটে উত্তর,
‘ আমি রাহাত।
আঙুল উঠিয়ে দেখাল, ‘ ওই গলিতে থাকি।
আচ্ছা,আপনিই বুঝি এই এলাকার সেই নামকরা মাস্তান বিট্টু? কাল বাবার মুখে আপনার কত কথা শুনলাম! তারপর থেকেই খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল আপনাকে। আমার না, ভিলেন ভীষণ পছন্দ জানেন!
কিন্তু আপনার বর্ণনা শুনে ভেবেছিলাম,আপনাকে দেখতে সিনেমার ভিলেনদের মত হবে। পেট মোটা,কালো,বড় বড় দাড়ি -মোচ। কিন্তু আপনি তো একদম রিত্তিক রওশনের মত।’
গড়গড়ে, ছটফটে ভঙিতে বলে থামল রাহাত। দম ছাড়ল। মিরাজ ওরা ঠোঁট ফাঁকা করে চেয়ে ওর দিক। বাঘা বাঘা লোক যেখানে তীব্রকে দেখলে ভ*য় পায়, সেখানে দু-ফুটের বাচ্চার কথায় মাথা ঘুরছে ওদের।
তীব্র হতভম্ব হয়েছিল। রাহাতের শেষ কথাটায় হেসে ফেলল এবার। তামাটে ঠোঁট উঠে গেল উঁচুতে। তার লাইফে এমন ঘটনা বিরল। কোনও বাচ্চা আজ অবধি ধারেকাছেই ঘেঁষেনি বলে হঠাৎই ভীষণ মনে ধরল রাহাতকে।
নিজের পাশের খালি জায়গা দেখিয়ে বলল,
‘ বোসো।’
রাহাত উচ্ছ্বাস সমেত বসল এসে।
‘ কোন ক্লাশে পড়ো?’
‘ সেভেনে উঠেছি।
আচ্ছা,আপনি ফাইটিং জানেন? এখন অবধি ক’জনকে মে*রেছেন? ‘
তীব্রর ছোট জবাব, ‘ গুনিনি।’
রাহাত কণ্ঠ শৃঙ্গে তুলল,
‘ তার মানে অনেক? এরপর কাউকে মা*রলে আমাকে দেখাবেন?’
তীব্র আশ্চর্য চোখে চাইল। তার জানামতে বাচ্চাগাচ্চা মারা*মারি দেখলে ভ*য় পায়,পালায়। আর এই ছেলে…’
ভ্রু নাঁচাল সে, ‘ তোমার মা*রপিট পছন্দ?’
‘ ভীষণ! আমিত সারাক্ষণ ফ্রি ফায়ার খেলি। কিন্তু সরাসরি কাউকে মা*রতে পারিনা। উলটে আমার ক্লাশের ওরা আমাকে মা*রে। আমার পেটটা একটু বড় তো,তাই ‘ভুড়ি ফাঁটিয়ে দেব ‘বলে ভ*য় দেখায়।’
মিরাজ ফিক করে হেসে ফেলল শুনে।
মুখ কালো করল রাহাত। সবেগে, নির্ভীক আবদার ছু*ড়ল,
‘ আপনি আমাকে ফাইটিং শেখাবেন ভাইয়া?’
তীব্র হেসে উঠল। বলল,
‘ শিখে কী করবে?’
‘ আপনার মত হব। সবাই ভ*য় পাবে!’
এবার সবগুলো স্বশব্দে হাসল। আরমান বলল ,
‘ ভাই এটা কে রে?আমাদের মত হতে চাইছে।’
সাথে দাঁত কেলিয়ে হাসল সে।
তীব্রর ঠোঁট দুটো ছড়িয়ে গেল দুদিক। রাহাতের কোকড়া চুল এলোমেলো করে দিয়ে বলল,
‘ বড় হও,শেখাব।’
রাহাত খুশি হলো,পরের দফায় চিন্তিত গলায় বলল,
‘ কিন্তু ততদিনে যদি আব্বুর ট্রান্সফার হয়ে যায়? আমরা তো এলাকা ছেড়ে চলে যাব। আপনাকে কোথায় পাব তখন!’
মিরাজ দুষ্টুমি করে বলল,
‘ তাহলে এক কাজ করো ছোট ভাই,তোমার বোন থাকলে আমাদের কাউকে দুলাভাই বানিয়ে নাও। যে কোনও একজনকে বানালেই বিট্টুকে পাবে।’
রাহাত মনোযোগী দৃষ্টিতে দেখল ওকে। মিথিলার বিয়ে ঠিক হওয়ায়,তার মানস্পটে এই মুহুর্তে ভাসল,শুধু পুষ্পিতার আনন। ওমন শুভ্র,প্রতিমার মত বোনের পাশে এদের ভেবেই কেমন কুঁচকে এলো চেহারা। সোজাসাপটা বলল,
‘ আমার আপু অনেক সুন্দর! তার সাথে আপনাদের মানাবেনা। ‘
ওরা হেহে করে হাসছিল। কথাটায় দপ করে মুছে গেল তা। হতচেতনায়, চাইল গোল গোল চোখে। রাহাত ঘাড় বাঁকায় তীব্রর দিক৷ চোখে-মুখে মুগ্ধতা নিয়ে বলে,
‘ কিন্তু আপনার সাথে মানাবে।’
বখাটে তীব্রর হাসিটা এবার ঠোঁট ফুড়ে বেরিয়ে এলো বাইরে। গা দোলানো হাস্যবাণ, মেলাল শনশন বাতাসে। প্রশ্ন করল,
‘ কী খাবে?’
করিম কে বলল,’ চিপ্স দাও ওকে।’
‘ না না, আমি চিপ্স খাইনা। চিপ্স তো বাচ্চারা খায়।’
মুশফিক আগ বাড়িয়ে বলল,
‘ তাহলে একটা বিড়ি খাও,এটা বড়দের খাবার।’
তীব্র তপ্ত চোখে চাইতেই মুখ ছোট করে বলল,
‘ সরি!’
রাহাত উঠে দাঁড়াল। বলল,
‘ আমি কিছুই খাব না। যাই,ফিরতে দেরী হলে মা বকবে। আচ্ছা,আপনাকে কি এখানে এলেই পাব?’
‘ হু। ‘
‘ ঠিক আছে। আমি বিকেলে আসব। ‘
রাহাত সানন্দে হাঁটা ধরল। তীব্রকে তার পছন্দ হয়েছে। কত ভালো লোক! বাবা যে কেন বাড়ি গিয়ে ওসব বলেছিলেন!
ওর যাওয়া থেকে চোখ এনে,মিরাজ হতবাক আওড়াল,
‘ আজকালকার বাচ্চারা কী পাঁকারে ভাই! মুখের ওপর বলে দিলো আমাদের ওর বোনের সাথে মানাবেনা?’
সেই ক্ষণে,আড্ডায় এসে হাজির হলো নাহিদ। তার মুখবিবরে আমাবস্যা। চোখ দুটো ফোলা। হঠাৎ ওকে দেখেই আলোচনা থামল ওদের। নাহিদ এসে ধীর গতিতে পাশে বসল তীব্রর।
আরমান বলল,
‘ কী রে নাহিদ! তুই কি পর্দা নিয়েছিলি? ইদানীং ঠিক-ঠাক তোকে পাইনা কেন? ‘
নাহিদ উত্তর দিলো না। মাথা নুইয়ে বসে রইল। তীব্র ভ্রু কুঁচকে শুধাল,
‘ কী হয়েছে?’
সে ভীষণ দুঃখ নিয়ে জানাল,
‘ মিথিলার বিয়ে ঠিক হয়েছে। ‘
‘ তোর ওই গার্লফ্রেন্ড? ‘
‘ হ্যাঁ। ‘
‘ ও।’
তীব্রর নিরুৎসাহিতা দেখে হতাশ হয় নাহিদ। ত্রস্ত ওর হাঁটু আকড়ে বলে,
‘ বিট্টু,আমি ওকে খুব ভালোবাসি! ওর অন্য জায়গায় বিয়ে হলে ম*রে যাব রে।’
তীব্রর বিশেষ প্রতিক্রিয়া হলো না। না পরিবর্তন এলো চেহারায়।
কাটখোট্টা জবাব দিলো,
‘তাহলে বেচে আছিস কেন? আজকেই মর। ‘
নাহিদ আ*হত হয়ে বলল,
‘ ভালোবাসি ভাই! নিজের আংটি বেচে ওকে আইফোন কিনে দিয়েছিলাম আমি। আর সেই মেয়ে এখন ইঞ্জিনিয়ার পাত্র পেয়ে আমাকে ছেড়ে দিচ্ছে। ‘
মিরাজ খোঁচা মে*রে বলল, ‘ ঠিক করেছে। তোর মত বলদার সাথে থেকে কী করবে?’
নাহিদ ফুঁসে উঠল, ‘ বাজে কথা বলবিনা মিরাজ।’
পরপর কণ্ঠ নামিয়ে, তীব্রকে অনুরোধ করল, ‘ কিছু একটা কর দোস্ত! ‘
‘ ফোন কর ওকে।’
নাহিদ মুখশ্রী অন্ধকার করে জানাল,
‘ কীভাবে করব? সব জায়গা থেকেই তো ব্লক করে দিয়েছে।’
‘ নির্বোধ! অন্য ফোন নেই?’
মুশফিক স্বীয় ফোন এগিয়ে দিলো,
‘ আমারটা থেকে দে।’
হাতে নিলো নাহিদ। মিথিলার নম্বর তুলে ডায়াল করল। রিং হলো দুবার। রিসিভ হতেই ভেসে এলো আওয়াজ,
‘ হ্যালো! কে বলছেন?’
নাহিদ ধৈর্যহীন বলতে গেল,
‘ আমি নাহি…’
পথিমধ্যেই চেঁতে উঠল মিথিলা,
‘ তুমি আবার ফোন করেছ? এতটুকু লজ্জাও নেই তোমার?
নাহিদের আবেদন,
‘ আমার কথাটা শোনো। প্লিজ…’
‘ চুপ। আর কক্ষনও ফোন করবেনা বলে দিলাম,ছ্যাচড়া কোথাকারে!’
মুখের ওপর লাইন কা*টল মিথিলা। দ্বিতীয় বারের মত মন ভে*ঙে আসে নাহিদের। মান ভুলে,আবার ডায়াল করতেই, ব্যস্ত শোনাল। বুঝল,এই নম্বরটাও পৌঁছে গিয়েছে মিথিলার ব্লকলিস্টের আঙিনায়।
নাহিদের আবেগপ্রবণ চোখ ভিজে উঠল। কোটরে চিকচিক করল অশ্রু। তীব্র বিরক্ত গলায় বলল,
‘ মেয়ে মানুষের মত কাঁ*দবিনা তো।’
‘ কী করব তাহলে? শুনলি তো ওর কথা। আজ আমি বেকার,তাই বলে ভবিষ্যতে কি কিছু করব না? ও আমায় ছেড়ে যেতে পারল? এতদিনের সম্পর্ক, একবার ভাবলোও না?’
মিরাজ মন খারাপ করে বলল,
‘ মেয়েরা এমনই ভাই! এদের অন্তর লোহায় গড়া। তুই কাঁদিস না,তোকে একটা ভালো মেয়ে এনে দেব আমরা।’
নাহিদ হাতের তালু দিয়ে চোখ মুছল।
‘ মেয়ের অভাব হবেনা জানি। কিন্তু মিথিলাকে ভালোবেসেছিলাম আমি। কী না করেছি ওর জন্য! রাত দুইটা বাজে, ওদের এলাকায় গিয়ে,ওকে ফুচকা দিয়ে এসেছি। যখন যা বলেছে,গোলামের মত শুনেছি। আর, আর সে-ই আমাকে এখন চায়না!’
তীব্র প্রতাপী গলায় বলল,
‘ ও কী চায় সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়,গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে তুই কী চাস!’
নাহিদের ব্যগ্র আঁখি। ভেজা কণ্ঠে বলল,
‘ আমি ওকে চাই বিট্টু। ‘
তীব্র তাকাল। দর্পযুক্ত কণ্ঠ,
‘ তাহলে ও তোর।’
চমকে চাইল নাহিদ। একইরকম চমক সবার চোখে। ও বিভ্রান্ত কণ্ঠে শুধাল,
‘ কী..কীভাবে?’
তীব্র হাসল। খুব সামান্য, ক্রুর হাসিটা মেতে উঠল অধরপুটের কোণাকুণিতে। পঙ্কিল দুই অক্ষিতে অন্য রকম ভাষা। চেহারার পরতে পরতে খেলে গেল রহস্যের ফাঁকফোকর-হীন দূর্দমনীয় জাল।
চলবে।
গল্পে তীব্র মাস্তান,বখাটে। তাই তার সব কাজ আপনাদের পছন্দ হবেনা। ওইজন্যে যাদের জেন্টেলম্যান, আদর্শবান নায়ক পছন্দ তারা গল্পটা স্কিপ করে যাবেন।