কলমে: নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
(২১)
পুষ্পিতা ঘরে ঢোকা মাত্রই, পেলব হাত খানা লুফে নিলো নূহা। মেয়েটা ভড়কাল, ভ*য় পেলো। প্রকোপে চেয়ারের ওপর বসে পড়ল ধপ করে। গোল চোখে চেয়ে বলল,
“ কী হয়েছে?”
নূহার চোখমুখ থমথমে। চাউনীর ভাষা তীক্ষ্ণ। গম্ভীর কন্ঠে শুধালো
“ কি করছিলি ওখানে?”
পুষ্পিতা বুঝতে না পেরে বলল,
“কোথায়?”
“ তোর স্যারের ঘরে।”
ও মৃদু হেসে বলল,
“ ওহ! আরে আর বলিস না, স্যার রান্না করতে গিয়ে হাত কে*টে ফেলেছেন। সেই জন্য আমিই….
নূহা মাঝপথে কথা কে*ড়ে নেয়। টেনে টেনে বলে,
“ সেই জন্যে মায়া দেবী মায়া করে স্যারের রান্না করে দিয়ে এলেন। তাইতো?”
পরপরই নাক ফুলিয়ে বলল,
“ দুটো ব্যাচেলর ছেলের বাসায় এভাবে যেতে তোর ভ*য় করল না? এখনো এতো আবুল কেন তুই?”
পুষ্পিতা ঠোঁট উল্টায়।
“ এভাবে বলছিস কেন?উনি তো আমার স্যার। শ্রদ্ধেয় মানুষ! বি*পদে পড়লে আমি যাব না?”
নূহা শান্ত হলো খানিক। বুকে হাত গুঁজে মাথা নাড়ল,
“ ঠিক আছে। উনি মনে হয় ভালো! উনাকে সাহায্য করাই যায়। কিন্তু এইসব দয়ামায়ার সাগর বুকে নিয়ে আজকাল বেশিদিন টিকে থাকা যায় না। সবাই সব সময় তোমার স্যারের মত জেন্টলম্যান হবে না বুঝলে?”
পুষ্পিতা বাধ্য মেয়ের ন্যায় মাথা কাত করল। হুট করে অন্যমনস্ক চোখের পর্দায় ভেসে উঠল তখনকার ঘটনা।
মলম লাগানোর সময়ে তীব্রর চাউনী,একযোগে চেয়ে থাকা দুটো সাদাটে মণি। ঠিক সে মুহুর্তের অস্বস্তিটাতে, গলা অবধি ভিজে গেলো মেয়েটার। কথা গুলো কি নূহা কে বলবে? না থাক। এমনিতেই সারাক্ষণ নূহাটা ওকে নিয়ে ভাবে। কিছু ঊনিশ-বিশ শুনলেই ধরা কে সরা জ্ঞান করে বসবে। নিরন্তর ঝামেলার কথা চিন্তা করেই, কথার বাণে ছুটতে চাওয়া ঠোঁটদ্বয় টিপে নিলো পুষ্পিতা।
***
জৈষ্ঠের দাবদা-হের হাহা*কার কমাতে হাজির হয়েছে আষাঢ়। আজকাল সারাক্ষণ বৃষ্টি থাকে। আকাশ জুড়ে কেবল আচ্ছন্ন অম্বুবাহি ঘুরে বেড়ায়। সকাল থেকে রৌদ্রদগ্ধ প্রকৃতিতে আচমকা বৃষ্টি নামল আজ। জনজীবনের সাবলীল জোয়ারে,অস্বাভাবিকত্বের ভাটা নামল।
রাস্তার পাড়ে নিত্য সামগ্রী নিয়ে হাজির থাকা ভ্যান গুলো, তীরস্থ হলো পন্য ঢাকায়। নিরস সবকিছুতে সতকর্তা ভিড়তেই,কেমন ঘোল বদলে গেল প্রকৃতির।
কাকভোরে প্রচণ্ড বর্ষার পর আটটার দিকে একটু রোদের দেখা মিলেছে। ঘড়িতে নয়টা ছাড়িয়েছে এখন। বসার ঘরের ডিভানে পরিপাটি হয়ে বসে আছে তীব্র৷ সদর দরজার লক হালকা খুলে রাখা। ভীষণ রকম অপেক্ষায় সে। অথচ অনেকক্ষণ গেলেও কাঙ্ক্ষিত মুখের দেখা নেই। পুষ্পিতা বের হচ্ছে না। ভীতু মেয়েটা কি আজ যাবে না কলেজে?
তীব্র উঠে দাঁড়াল। পায়চারি করতে করতে সিগারেট টানলো। তার সামনে দিয়েই বিদায় নিয়ে চলে গেল নাহিদ। ছেলেটা কদিন ধরে চাকরির জন্যে দ্বিগবিদ্বিক ইন্টারভিউ দিয়ে বেড়াচ্ছে।
কিন্তু পুষ্পিতার অপেক্ষায় থাকতে থাকতে তীব্রর ক্লান্ত হওয়ার দশা। বদমে*জাজি ছেলেটার,উৎকৃষ্ট মেজাজ ধরে রাখা দুঃসহ হচ্ছে বড্ড। তক্ষুণি ওপাশ থেকে দোর খোলার শব্দ এলো। পুষ্পিতা বের হয়েছে বুঝতেই ত্রস্ত পুরোপুরি দরজা খুলে দিলো তীব্র। উঁকি দিতেই, উত্তেজিত চোখমুখ নিভে গেল সহসা। পুষ্পিতা নয়, নূহা বেরিয়েছে। ইউনিভার্সিটি যাচ্ছে সে। কী আশ্চর্য, ভীতু মেয়েটা কোথায়? নূহা কাঁধব্যাগে ছাতা ভরতে ভরতে সামনে তাকায়। চোখের সম্মুখে সটান তীব্রকে দেখেই ভড়কায় খানিক। স্যার মানুষ! পুষ্পিতার শিক্ষক তো তারও শিক্ষক। হেসে সালাম দিয়ে বলল,
“ ভালো আছেন স্যার?”
তীব্র জ্বিভে ঠোঁট ভেজাল। যার অর্থ
নিজের আনচানে অভিব্যক্তি আলগোছে ঢেকে ফেলা। শুভ্র আদলে ভারিক্কি এনে বলল,
“ হ্যাঁ, আপনি?”
“ জি, আলহামদুলিল্লাহ ভালো!
তীব্র উশখুশে ভঙ্গিতে ঘাড় ডলল দুবার। ইতস্তত করে বলল,
“ আচ্ছা পুষ্পিতা কি…”
নূহা বুঝে নেয়। মাঝপথেই স্ব-উদ্যোগে জানিয়ে দেয়,
“ পুষ্পিতা তো অনেক আগেই বেরিয়ে গেছে!”
হোচ*ট খেলো তীব্র। এমন ভাবে চাইল,যেন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গেছে।
“ মানে? নয়টার দিকে বের হওয়ার কথা। আগে বের হলো কেন?”
“ আসলে বৃষ্টির সময় তো! আমাদের দুটো ছাতা। একটা আম্মু নিয়ে গেছেন,আর একটা আমার কাছে। আমি এত করে বললাম নিয়ে যেতে,নিলোই না। একটু খরা পড়তেই বেরিয়ে গেল।”
পুষ্পিতার ভালো মানুষী,আজকে তীব্রর হৃদয় ছুঁতে পারল না। উলটে ভ*য়ানক রা*গে লালচে হলো সাদা মুখ । সে তৈরি হয়ে,গত আধ ঘন্টা যাবত যার জন্য বসে আছে, সে কী না তাকেই রেখে চলে গেল? মেজাজের ত*প্ততায় নূহার থেকে বিদায় পর্যন্ত নিলো না তীব্র। হনহনে পায়ে নেমে গেল সিঁড়ি ভে*ঙে । মেয়েটা আশ্চর্য হয় ওর আচরণে। টানটান কপালে ভাঁজ পড়েছে বিভ্রমের।
বিড়বিড় করল,
“ আজব লোক তো!”
***
তীব্রর সব কিছু অস্থির,কখনো অচপল। শান্ত তবিয়ত ভীষণ রকম অশান্তিতে নেমেছে। লালিত সরু নাকটা দেখেই ঠাওর হচ্ছে,তার মেজাজ খারাপের ধরণ। কিন্তু এই খারাপ হওয়া নিতান্তই অযাচিত,অকারণে। ওর একটাই কথা.. ভীতু মেয়ে কেন আগে আগে বের হবে? সে আসবে ওর সাথে। একই গাড়িতে পাশাপাশি বসবে। কথা হবে দুজনের। অতি নৈকট্যে তার মেদুর মুখবিবর দেখে দেখে বুক জুড়াবে তীব্র। তারওপর সে যে কাল উত্তম কুমারের শখানেক গান দিয়ে জিপের ক্যাসেট ভরেছে,সেসব শুনবে কে এখন? অভদ্র মেয়ে কোথাকার! স্যারের আগে কলেজে আসে! বের করছি আসা।
তীব্র রা*গে গজগজ করতে করতে ক্লাস রুমের সামনে এসে থামল। রমিজ হাসান ক্লাস নিচ্ছিলেন ভেতরে। ও পিঠের সাথে হাত বেধে দাঁড়িয়ে থাকে। উদ্দেশ্য, উনি বের হওয়া মাত্রই ঝড়ের বেগে এন্ট্রি নেয়া।
ফোরকান আহমেদ সবে মাত্র কলেজে ঢুকেছেন। নিজের কক্ষে যাওয়ার সময় হঠাৎ চোখ গেল ফার্স্ট ইয়ারের ক্লাসরুমের দিকে। তীব্র উলটো ঘুরে দাঁড়িয়ে আছে সেথায়। এই গোটা কলেজে এমন পেটানো দৈহিক গড়নের একজনই আছে। তাই ভদ্রলোকের চেনায় গলদ হয়নি। ওকে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই ভেতরে না ঢুকে, এগিয়ে গেলেন তিনি। ছেলেটার বাবা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী! অথচ তুচ্ছ শখের বশে এখানে শিক্ষকতা করতে এসেছে৷ কত বড় মন! এই কম বেতনের চাকরি,তাও এমন মফস্বলে। সত্যি,শখ জোরদার নাহলে অট্টালিকা ছেড়ে কেউ আসতে পারত কখনো?
তীব্রর পেছনে এসে দাঁড়ালেন ফোরকান।
“ মিস্টার তালুকদার কী ব্যাপার,আপনি এখানে?
তীব্রর রেখাযুক্ত কপাল সজাগ হলো ওমনি৷ উলটো থেকেই দন্তপাটি পি*ষল। কটমটিয়ে ভাবল,
“ এই বা**র বুইড়াটার এখনি আসতে হলো? মন চাইছে একটা লা*থি মে*রে ভোতা চেহারার নকশা পালটে দিই।”
অথচ ফিরল হাসিহাসি চেহারায়। খুব শিষ্টের ন্যায় বলল,
“ ক্লাস নেব স্যার। রমিজ স্যার বের হওয়ার অপেক্ষা করছিলাম।”
বিস্মিত ফোরকান, চটপট হাত উলটে সময় দেখলেন ঘড়িতে। তেমনই বিস্ময় তাঁর কণ্ঠে,
“ এখনো তো পাঁচ মিনিট বাকী! আপনি এখনই দাঁড়িয়ে আছেন?”
তীব্রর ভেতরটা চেঁচিয়ে উঠল তেজে,
“ আমার যেখানে ইচ্ছে দাঁড়াব। দরকার পড়লে শুয়ে থাকব এখানে। তোর বাপের কী শালা? তোর বাপের জায়গা এটা? বা**র ডিপার্টমেন্ট হেড। এক্ষুণি সামনে থেকে সর। হাতটা নিশপিশ করছে কিন্তু। যে কোনও সময় নাক থে*তলে দেব।”
মুখে বিস্তর হাসি এনে বলল,
“ আসলে..
এটুকু বলে ঘাড় চুলকাল। কথা খুঁজে খুঁজে জানাল,
“ অফিস রুমে ভালো লাগছিল না। ভাবলাম অল্প সময় আছে,থাকি এখানে। আর ওদেরও আজ একটা নতুন টপিক পড়াব। সেসবের জন্যেই একটু তাড়াহুড়ো। আপনি তো জানেন স্যার,আমি ক্লাস নিতে কত পছন্দ করি!”
ফোরকান মুগ্ধতায় আরেকবার আপ্লুত হয়ে পড়লেন৷ এই তীব্র তালুকদার পুরো কলেজের কাছে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আহা! কাজের প্রতি কত ডেডিকেটেড ছেলেটা। তাঁর পছন্দের মাত্রা প্রগাঢ় হলো আরো। হাতটা তুলে কাঁধে রাখলেন ওর। তীব্রর গা জ্ব*লে উঠল রা*গে। বক্র নজর ফেলে একবার দেখল সেথায়। মন চাইল হাত মুচ*ড়ে হাড্ডি বাঁকা করে দিতে। করল না। বরং আঙুলের নিশপিশে ভাব কমাতে, স্বীয় ডান হাতের ফাইলটা শক্ত করে চে*পে ধরল সাথে। বাম হাত মুঠো করে পকেটে ভরে রাখল। যু*দ্ধ চালাল ক্রো*ধের টং*কার সামলানোয়।
ওদিকে ফোরকান গদগদ হয়ে বললেন,
“ আপনার কাজের প্রতি এই আগ্রহটাই আমাকে ভীষণ মুগ্ধ করে মিস্টার তালুকদার! অল দ্য বেস্ট ফর এভ্রিথিং!”
তীব্র হাসল,মাথা নাড়ল।
ফোরকান চলে গেলেন।ঝকঝকে দাঁত খিচে সে পথে চেয়ে থাকল তীব্র। ভদ্রলোকের হাত রাখা কাঁধের জায়গাটা ঝাড়ল,ঠিক ধুলো ঝাড়ার মতন। বিড়বিড় করল,
“ শালা খরগোশের বাচ্চা! তোর মুগ্ধতা ধুয়ে তুই পানি খা। ”
ঘন্টা বাজল। রমিজ স্যার বেরিয়ে এলেন। প্রসংশার মতোন হাসি ছড়িয়ে বললেন,
“ তীব্র স্যার ক্লাস নেওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে আছেন? আমাকে একবার বললে তো আরেকটু আগে বের হতাম।”
এমন সুন্দর কথার বিনিময় তীব্র সৌজন্য দেখাল না। ছোট করে “ সমস্যা নেই” বলেই,ক্লাসে ঢুকে গেল। পাত্তা না পেয়ে আ*হত হলেন তিনি। কালো চেহারায় আমাবস্যা নিয়ে নিজের কাজে চললেন।
দাঁড়িয়ে যাওয়া সব শিক্ষার্থীদের বসার জন্য হাত উঁচাল তীব্র। টেবিলের কাছে এসে দাঁড়াতে দাঁড়াতে চশমার ফাঁক দিয়ে হন্য নজর দিশাহীন ছুটছে। খুঁজে বেড়াচ্ছে পরিচিত কোনো মুখ। অত অত স্টুডেন্ট ছাপিয়ে, সামান্য কয়েক সেকেন্ডে দৃষ্টিরা গন্তব্য ছুঁতে পারে না। নামিয়ে আনল ফের। এই এক মাসে তীব্র ক্লাস নিয়েছে ছেলেদের দিক চেয়ে চেয়ে। এখনো তাই। তবে ব্যাপৃত কণ্ঠে গম্ভীরতা,
“ আজকে কিছু প্রশ্ন ধরব তোমাদের। এতদিন কী পড়ালাম, তোমরা কী শিখলে আমিও একটু দেখি!”
সমস্বরে আওয়াজ এলো,
“ ওকে স্যার!”
তীব্র চারপাশে তাকায়। এলোমেলো দৃষ্টি ফেলতে ফেলতে ঘোষণা ছোঁ*ড়ে,
“ যাকে বলতে বলব শুধু মাত্র সে উত্তর দেবে। কেউ আগ বাড়িয়ে একটা কথাও বললে, ক্লাসের বাইরে কান ধরিয়ে দাঁড় করে রাখব। এই বয়সে সেটা নিশ্চয়ই ভালো লাগবে না?”
বিগত মাস খানেক যাবত স্বভাবে হাস্যজ্জ্বল শিক্ষকের কথায়, চেহারায় উষ্ণতা আজ। রা*গ-ক্ষো*ভের আঁচ পেতেই তটস্থ ক্লাস রুম আগের চেয়েও নিস্তব্ধ হয়ে পড়ল। তীব্র একটু চুপ থেকে প্রশ্ন করল,
“ মৌলিক ব্যাষ্টিক অর্থনীতি সম্পর্কে আমাকে কেউ একটা ছোটো খাটো বিশ্লেষণ দাও। কে পারবে?”
সিংহভাগ হাত তুলল সাথে সাথে। কিন্তু তীব্রর চিলের নজর ভিন্ন কোথাও আটকে। নীরব তল্লাসিতে ধরা পড়েছে পুষ্পিতা। প্রমোশন হয়েছে মেয়েটার। পেছনের বেঞ্চ ছেড়ে আজ মাঝের সাড়িতে বসেছে। পাশে বসা তনুজার দুই হাত তুলে রাখা। চোখেমুখে উত্তেজনা। তীব্র একবার পড়া ধরুক, খুব করে চাইছে। কিন্তু পুষ্পিতা হাত তোলেনি। তার একটি বিশেষ সমস্যা আছে। দশজনের সামনে দাঁড়িয়ে গুছিয়ে কথা বলতে পারে না। মুখস্থ জিনিসও আউলে যায়। জড়তা,সংকোচে কণ্ঠনালী সহ আস্ত শরীরটাই চুর হয়ে থাকে।
কিন্তু তীব্র নিশানা করল ওকেই। বলল,
“ এই যে আপনি, চার নম্বর বেঞ্চের কালো ওড়না। আপনি দাঁড়ান।”
পুষ্পিতা চমকে গেল। সে তো হাত তোলেনি। তবে স্যার ওকে ধরলেন কেন? আল্লাহ! ভীত, শঙ্কি*ত বদনে উঠে দাঁড়াল মেয়েটা।
তনুজার আগ্রহ মাটি। হাত নামিয়ে চ সূচক শব্দ করল।
“ ধুর,আজকেও আমাকে ধরল না। কেন যে সবুজ পরে এসেছি! কালো পরে এলে ভালো হোতো।”
পুষ্পিতা জ্বিভে ঠোঁট ভেজায়। তীব্রর মেঘের মতো স্বর,
“ যে প্রশ্ন করলাম, সেটা গুছিয়ে বলুন।”
ঢোক গিলল ও। উত্তরটা তার জানা। যাকে বলে কণ্ঠোস্থ! কিন্তু গুছিয়ে বলতে পারবে না। তারওপর ক্লাসের সবাই,সামনে-পেছনে আশেপাশের সব কেমন করে চেয়ে আছে। এতে তো জানা বিষয় এমনিই গুলিয়ে যাবে। পুষ্পিতা টের পাচ্ছে,ওর হাত-পা কাঁ*পছে। আচ্ছা,লিখে দিলে হবে? বলবে সে কথা?
তীব্র প্রশ্ন করেছে ঠিকই,কিন্তু উত্তর জানতে অনাগ্রহী! তার চোখ অন্য দিকে।
পুষ্পিতা সুন্দরী! কলেজে আগমনের পর থেকেই পেছনে কিছু ছেলেপেলেদের ছুঁকছুঁক বেড়েছে। তীব্র সেটা ধরতে পারল তখন,যখন ক্লাসের সবগুলো ছেলে ড্যাবড্যাব করে দেখছিল ওকে। ক্রো*ধের জ্বল*ন্ত দা*বানলে মস্তিষ্ক ফে*টে যাচ্ছে তার। এগুলোর এত সাহস! কার দিক চেয়ে আছে জানে?
ওদিকে মুখে কুঁলুপ এঁটেছে পুষ্পিতা। দু একবার থেমে থেমে আওড়াল,
“ মৌলিক অর্থনীতি হচ্ছে.. মৌলিক অর্থনীতি হচ্ছে….”
তীব্র আগে থেকেই ক্ষে*পে ছিল। এবার বেড়ে প্রকান্ড হলো তা। ডাস্টার তুলে ধড়াম করে বা*রি দিলো টেবিলে। ওমনি হকচকিয়ে ঘুরে চাইল সবাই। পুষ্পিতার কলিজা ছলাৎ করে ওঠে। আতঙ্কে ডানে-বামে লাফায়।
তীব্র চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
“ আমি এদিকে। তাই সবার চোখ এদিকে থাকা চাই।”
তনুজা নিজে নিজে বলল,
“ সবারটা থাকবে কি না জানি না। তবে আমার চোখ আজীবনের জন্য তোমার ওপরেই লক করে দিয়েছি।”
তীব্র পুষ্পিতার দিকে দেখল। নির্মল মুখ ফ্যাকাশে লাগছে কেমন। মন গলেছে তার? গলেনি। কেমন ধম*কের সুরে বলল,
“ বোসো..”
পুষ্পিতার আনন জুড়ে মেঘ ছড়াল। লজ্জায় নুইয়ে এলো দেহ। জানা জিনিস বলতে না পারার শোকে, মাথা নামিয়ে নিশ্চুপ বসে পড়ল।
তীব্র চাইছিল,তাকে ফেলে আসার জন্য পুষ্পিতাকে দাঁড় করিয়ে রাখার ছোটো-খাটো শাস্তি দিতে। কিন্তু মেয়ে দাঁড়াতেই সব গুলো ছেলে যেভাবে তাকিয়েছে,এতেই তালুর র*ক্ত অবধি টগবগ করছে ওর।
জীবনে প্রথম বার এমন ভ*য়ানহ রাগ, আত্মস্থ করতে বাধ্য হলো ছেলেটা। উলটে শান্ত থাকার প্রয়াস খাটিয়ে কোনোরকমে ক্লাস করাল। রাতে নাহিদ যেটা যেটা বুঝিয়ে দেয়,তার কাজ সেসব উগড়ে দেয়া এখানে। কোথাও আটকালে,নাহিদের করে দেয়া নোটস তো আছে। তীব্র পড়াশুনাতে তীব্রতর খারাপ হলেও,তার বাচনভঙ্গি দারুণ! ভরাট কণ্ঠে নম্রতা ঢেলে শুদ্ধ বাক্যলাপে, সেসব আরো শ্রুতিমধুর শোনায়। স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিতে পারে। তাই যতটুকু পড়ায়, শিক্ষার্থীরা সর্বোচ্চ মনযোগ দিয়ে শোনে।
অন্য সময় তীব্র ক্লাস ঘন্টাখানেকের চেয়ে বেশি নিলেও,আজ বেরিয়ে গেল ঘন্টা বাজার আগেই। পুষ্পিতা তখনও মাথা নিচু করে বসে। এই কলেজে ওকে প্রথম পড়া ধরা হলো,আর ও সেটাই পারেনি। ছি! কী লজ্জার ব্যাপার! স্যারও বা কী ভাবলেন ওকে?
***
কলেজ ছুটি হয়েছে। একে একে সবাই বেরিয়ে যাচ্ছে। পুষ্পিতা করিডোর দিয়ে হাঁটছিল। ওমনি পেছন থেকে দরাজ কণ্ঠ হাঁক ছোঁ*ড়ে,
“ এই মেয়ে!”
অচিরাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল সে। কণ্ঠস্বর আর ডাক এই কদিনে চেনার গন্ডি পেরিয়েছে। পিছু ফিরতেই লম্বা পায়ে এসে সামনে দাঁড়াল তীব্র। শ্বেত-সমান্তরাল ললাটে ভাঁজ পড়েছে। ভ্রু দুটো আরো বাঁকাল এবার। পুষ্পিতার মুখায়ব এমনিতেই কাঠ। এখন বাড়ল সেটা । তীব্র ক*র্কশ গলায় বলল,
“ সারাদিন কি হাতা খুন্তিই নাড়ো? পড়াশোনা করো না?’”
ফরসা মুখখানা কুণ্ঠায় চুপসে গেল মেয়েটার। চিবুক নামিয়ে নিলো গলায়।
তীব্রর মায়া হলো না। চেয়ে রইল সরু চোখে। কণ্ঠে এলো কথার বাণ,
“ কলেজে আসার জন্যে আমাকে ছাড়া এক পা-ও নড়বে না এরপর।”
অথচ বলেনি। গুরুভার স্বরে ডাকল,
“ শোনো..
পুষ্পিতা চোখ তোলে। ও অমন করেই বলল,
“ সব সময় আমি তোমাকে আমার গাড়িতে নিয়ে যেতে,নিয়ে আসতে পারব না। নিজেরটা নিজে বুঝে নেবে বুঝেছ?”
পুষ্পিতা তব্দা খেল। ভ্যাবাচেকায় কপাল গোছাল। ওতো এমন কিছু বলেইনি। সেদিন একবার উঠল গাড়িতে,তাও তো স্যার বললেন দেখেই। নিজে কি যেতে চেয়েছে কখনো? তার আশ্চর্যজনক চিন্তা ভাবনার মাঝেই দীর্ঘ পায়ে পাশ কাটাল তীব্র। কিছু বলার,শোনার সুযোগ অবধি দিলো না।
পুষ্পিতা ছোট ছোট কদমে কলেজ ছেড়ে বাইরে এসেছে। আকাশের অবস্থা ভালো নয়। থেমে থেমে মেঘ ডাকছে! যখন তখন জোরালো বর্ষার ছাট তেতে আসতে পারে। ফুটপাতের রাস্তা ধরল সে। সামনে থেকে রিক্সা নিলে, দশ টাকা কম ভাড়া নেয়।
ফুটপাতের রাস্তাতেই সেই ভা*ঙা পাঁচিল পড়ে। তীব্রর হাতে মা*র খাওয়া,আর পুষ্পিতার চ*ড় খাওয়া ছেলেগুলোর মধ্যে তিনজন আজকেও বসে সেখানে। মাঝের দুদিন তারা আসেনি। বেধরম মা*রধরের পর গায়ে-পায়ের ব্য*থা অল্পসল্প সেড়েছে।
পুষ্পিতা মাথা নিচু করে হাঁটছিল। তীব্রর শেষ কথার প্রহেলিকা এখনও কাটেনি তার। স্যার কেন অমন কথা বললেন? ও কি নিজে কখনো স্যারের গাড়িতে উঠতে চেয়েছিল? চায়নি তো। কখনো বলেওনি। আর বলবেই বা কেন? এমন কিছু তো আশাও করা যায় না। একজন শিক্ষকের গাড়িতে চড়ে, তার ছাত্রী কি রোজ রোজ কলেজ আসতে পারে? পুষ্পিতার মনটাই খারাপ হয়ে গেল। সবার মধ্যে পড়া না পারার সঙ্গে, তীব্রর ভাবনা আর ওর কথার দুঃখ মিলল গিয়ে।
নয়ন,হাবিব, ওলি চুরুট টানছিল বসে বসে।
পুষ্পিতাকে দেখেই কনুই দিয়ে হাবিবকে গুতো দিলো নয়ন। তাকাল সে। তিনজনই শশকের ন্যায় ব্যস্ত হলো ওমনি।
পাঁচিল থেকে লাফিয়ে দাঁড়াল। সাথে সমস্বরে চেঁচিয়ে ওঠে,
“ আসসালামু আলাইকুম ভাবি!”
ভাবনায় বুঁদ থাকা মেয়েটার, বক্ষঃস্থল ছ্যাৎ করে উঠল। ছিটকে সরে গেল সহসা। ছেলেগুলোকে দেখতেই, নিভন্ত আদল সাদাটে হয়ে আসে। তীব্র অফিস কক্ষে ডেকে নিয়ে বলেছিল না সেদিন? ওরা তোমার জন্য বাইরে অপেক্ষা করছে, মনে পড়ল সেসব। সেদিন তো স্যারের বন্ধু আগেভাগে ওকে নিয়ে চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু আজ কী হবে? আজ কি ওরা সেই চড়ের শোধ তুলতে এসেছে? পুষ্পিতার গলা শুকিয়ে গেল ডরে। পেছনে তাকাল একবার। না,রাস্তায় যথেষ্ট লোকজন আছে। ফাঁকা ঢোক গিলল সে। ভাবল, যা হবার হবে। আজকে গলা ফাটিয়ে চ্যাঁচাবে ও। বিধিবাম! হাঁ করতেই, নয়ন দাঁত মেলে বলল,
“ ভালো আছেন ভাবি?”
পুষ্পিতার হাঁ-টা বন্ধ। থমকে এলো কণ্ঠ। হতবুদ্ধি হয়ে ভাবল,
“ ভাবি?”
ওলির কপালের এক পাশে এখনো একটা ছোট্ট ব্যান্ডেজ আছে।
সে কথা বলল বড়ো নরম সুরে,
“ এখানে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো ভাবি? হলে কিন্তু আমাদের জানাবেন। আমরা সব সময় আপনাকে শেল্টার দেব।”
পুষ্পিতার মাথা চক্কর কাটল এবার। কী শুনছে এসব? যারা এখানকার মূল সমস্যা,তারা জিজ্ঞেস করছে সমস্যা হচ্ছে কী না! আজ কয়েক মাস যাবত এদের যন্ত্রণায় এখান থেকে হাঁটা অবধি যায়নি। আর ওরা দেবে শেল্টার? থা*প্পড় খেয়ে
মাথা টাথা খারাপ হয়নি তো!’’
তখনই হাবীব বলল,
“ এই নয়ন, যা ভাবিকে একটা রিক্সা ডেকে দে।”
পুষ্পিতার চোখ কপালে উঠে যায়। নিজের কানকেই ভরসার যোগ্য মনে হয় না। নয়ন এক পল বাম পাশে দেখল। ফিসফিস করে বলল,
“ লাগবে না। ওই দ্যাখ, ওখানে কে!”
ওলি, হাবীব ফিরল সেদিক৷ সুপ্ত ভাবে তুবড়ে এলো অচিরে। পুষ্পিতা ওদের চাউনী অনুসরন করে নিজেও তাকাল।
খুঁজে পেলো তীব্রকে। জিপ নিয়ে দাঁড়িয়ে সে। এদিকেই দেখছে। পুষ্পিতা যেন সাহারা খুঁজে পেয়েছে, অমন চপল পায়ে দৌড়ে গেল কাছে। মৃগনেত্র বড়ো বড়ো করে বলল,
“ স্যার, জানেন কী হয়েছে?”
তীব্রর ওসব জানা-শোনার সময় নেই। সাদা গ্লাসের ফাঁক থেকে তার বিলাতি অক্ষি পুষ্পিতার সুন্দর চোখে বন্দী। কালচে ঠোঁট নেড়ে শুধাল,
“কী?”
“ ওই বখাটে গুলো আমাকে ভাবি ভাবি ডাকছে।”
পুষ্পিতার ছটফটে কণ্ঠ। অথচ গোটা লাইনে বখাটে শব্দটায় মন পড়ে রইল তীব্রর। যেন কানের পাশে বেজে উঠেছে পরিচ্ছন্ন পিয়ানোর সুর। এতদিন বাড্ডার আট থেকে আশি, প্রতিটা মানুষ তাকে বখাটে বলেছে। যদিও সামনে সালাম দিয়েছে,কিন্তু নাম তো ছিল বখাটে। সবচেয়ে বড়ো কথা তার নিজের বাবা? জামশেদ তালুকদারও তো দিনরাত বখাটে বখাটে করতেন। কিন্তু শুনতে এমন ভালো লাগেনি তো। এই মেয়ের কণ্ঠে কী আছে তাহলে? ওর স্বর কী কোকিলের মত সুরেলা? কই, না তো! বাকী মেয়েদের মতোই স্বাভাবিক। তাহলে তার কাছে এমন রিনিঝিনি ঝর্ণার আওয়াজ মনে হয় কেন?
তীব্রর থেকে একটা চমৎকার জবাব আশা করেছিল পুষ্পিতা। সাথে ভেবেছিল ওর মতো সেও চমকে-থমকে একাকার হয়ে যাবে। কিন্তু সময় কাটলেও এমন কিছু হলো না। তাই ভ্রু গোটাল। বরাবরের মৃদূ স্বর অল্প উঁচু করে বলল,
“ স্যার, শুনেছেন কী বলেছি?”
তীব্র স্বাভাবিক।
“ শুনলাম।”
পুষ্পিতা নিজেই বিস্মিত।
“ শুনেছেন? কিছু বলবেন না?”
কাঁধ উঁচাল সে,
“ কী বলব? ওরা তোমাকে ভাবি ডেকেছে এটা আমাকে বলছো কেন? আমিতো ওদের ভাই নই।”
পুষ্পিতা থতমত খেলো তার খোলামেলা কথায়। মিনসে কণ্ঠে বলল,
“ না মানে আমি তা বলিনি। ওরা ওইদিন অমন বাজে কথা বলল! চড় খেলো,অথচ আজ এত তোষামোদ করছে। রিক্সাও ডেকে দিতে চাইল। তাই আর কী!”
তীব্র নিরুৎসাহিত জানাল,
“ সেটা ওদের ব্যাপার। আমাকে বলে লাভ নেই। তোমাকে ভাবি ডাকছে যখন, হয়ত ওদের ভাই তোমাকে চেনে।”
পুষ্পিতার নিষ্পাপ উক্তি
“ কিন্তু স্যার আমি তো চিনি না। তাছাড়া একটা বখাটের ভাইকে কে চিনতে চাইবে বলুন! এদের থেকে যত দূরে থাকা যায় ততই ভালো।”
কথার হুল গায়ে বিঁধল তীব্রর। চোখ ছোট করল। পুরু তার স্বর,
“ কেন? দূরে থাকতে হবে কেন? বখাটে নিয়ে কী সমস্যা তোমার?”
পুষ্পিতা উদ্বেগ নিয়ে বলল,
“ কী বলছেন স্যার,দূরে থাকব না? এরা কি ভালো ছেলে না কি! সারাক্ষণ এখানে বসে বসে মেয়েদের নোংরা নোংরা কথা বলে। বিরক্ত করে। লোকজনের সাথে গা জোরামি করে। চা খেয়ে বিলটা পর্যন্ত দিতে চায় না। আমার তো এদের দেখলেই মাথা গরম হয়।”
তীব্রর ফরসা মুখটা চিন্তিত দেখায়। নিম্নোষ্ঠ দাঁতে কা*মড়ে চশমা ঠেলল নাকের। খুব মনযোগ দিয়ে ভাবল,
“ নোংরা কথা তো দূর,আমি তো মেয়েদের দিক ফিরেও চাইনি কখনো। আমি নিশ্চয়ই ভালো! আর যেখানে যত চা খেয়েছি সেসবের বিল দিয়ে এলে ভীতু মেয়েটা আমাকে খারাপ বলার কোনো চান্সই পাবে না।”
পুষ্পিতার হাস্যহীন, গোমড়ামুখ। এমন সুরূপা আননে আমাবস্যা মানায়? নীরব অমানিশার রেশ নিরেট তীব্রর হৃদয় ছুঁয়ে দিলো। জিজ্ঞেস করল,
“ কী হয়েছে? ওরা ভাবি ডেকেছে তোমার ভালো লাগেনি?”
পুষ্পিতা অবাক চোখে চাইল। ও না বলতেই স্যার বুঝে গেলেন? নরম কণ্ঠে শশব্যস্ত বলল,
“ একটুও না। বখাটেদের ভাবি হতে কি ভালো লাগে? মন চাইছে সেদিনের মত গিয়ে একটা ঠাস করে মে*রে দিই।”
ভ্রু উঁচাল সে,
“ তাই?”
শিশুশুলভ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল মেয়েটা।
হাসি পেলো তীব্রর। ঠোঁট কা*মড়ে হাসলও স্বল্প।
“ বখাটে ভাবি ডাকায় এই অবস্থা! দুদিন পর যখন বখাটের বউ হবি তখন কী করবি রে মেয়ে?”
মুখে বলল,
“ এসো।”
সেদিনের মত হাত টেনে ঠিক ওদের সামনে নিয়ে দাঁড় করতেই ভড়কে গেল পুষ্পিতা৷ নয়নরা তীব্রকে দেখে পাঁচিল রেখে নেমে দাঁড়াল আবার। ভী*তসন্ত্রস্তের ছাপ পড়ল মুখে। হাবীবের চোখে সানগ্লাস ছিল। তীব্র আদেশ ছুঁড়ল,
“ চশমা খোল।”
তুরন্ত চশমা খুলে বুকপকেটে গুঁজে রাখল সে।
“ আগে ভাবি ডেকেছে কে?”
তীব্রর প্রশ্নে পুষ্পিতার চোখমুখে পরিবর্তন এসেছে। যেন আজকে সে ভীষণ সাহসী। সেদিনের মতো ভ*য়-ড*রের চিহ্ন মাত্র নেই।
বিভ্রান্ত ছেলেগুলোকে একবার একবার দেখে,আঙুল তুলল নয়নের ওপর।
“ ও।”
তীব্রর ঠান্ডা আদেশ,
“ মা*রো।”
হতভম্ব তারা। আজকের অপরাধ কী? আজ তো কিছু করেনি। জিজ্ঞেস করতে মুখ খুলবে,পূর্বেই নয়নের গালে কোমল হাতের শক্ত চ*ড় পড়ল। কোটর থেকে ঠিকড়ে পড়া চক্ষু নিয়ে পুষ্পিতার দিক চেয়ে রইল সে।
তীব্র বলল,
“ যাও। আমি আসছি।”
পুষ্পিতা বুক ফুলিয়ে হাসল। পৈশাচিক আনন্দ পেয়েছে আজ৷ আর জীবনে ভাবি ডাকবি?
সে যেতেই তীব্র ওদের দিকে তাকায়। হাবীব, ওলি চটজলদি নিজেদের গাল চেপে ধরে দুহাতে। ভেবেছে,তীব্রও ওদের মার*বে এখন। তবে সে এমন কিছু করেনি। নয়নের চেপে রাখা কপোল থেকে হাতটা নামিয়ে দিলো শুধু। সহানুভূতির ভাণ টানল কথায়,
“ বেশি জোরে লেগেছে?”
শিশুর মতো মাথা নাড়ল নয়ন। কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলল,
“ ভাই আপনিই তো সেদিন বললেন, যেখানে মেয়েটাকে দেখবি সেখানেই ভাবি ডাকবি। আমরা তো তাই করলাম। কত ভালো ভালো কথাও বললাম। তারপরেও মা*রল কেন?”
তীব্র চশমা খুলল। নয়নের শার্টের কোনা দিয়ে গ্লাস মুছে চোখে পড়ল আবার।
“ সেটা আমি বলেছিলাম। কিন্তু তোদের ভাবি ডাক ওর পছন্দ হয়নি। মারবে বলে আবদার করেছে। এখন তোদের ভাবির আবদার,না রেখে পারি?”
পরপরই কাঁধ চাপড়ে বলল,
“ এনি ওয়ে! যাই হয়ে যাক না কেন, গালে চড় একটা পড়ুক বা দশটা, তোদের ভাবি ডাক যেন বন্ধ না হয়। ওকে?”
শীতল তর্জন-গর্জন দিয়ে প্রস্থান নিলো সে। তিনজন বুদ্ধিভ্রষ্ট বনে চেয়ে থাকে। ওলি নাক-চোখ কুঁচকে আওড়ায়,
“ এই ব্যাটা তো আজব জিনিস! চোরকে বলছে চুরি করতে, গৃহস্থকে বলছে সজাগ থাকতে। এমন আধপাগল মাস্টার আমি আমার জীবনে দেখিনি।”
বাকীরা স্বায় মেলাল। জোর যার মুল্লুক তার! সেই অর্থ মেনে নিয়ে, আগের জায়গায় নিশ্চুপ বসে পড়ল আবার।
তীব্র কাছে আসতেই পুষ্পিতা চমৎকার করে হাসল। উজ্জল মুখশ্রীর, মুক্তোর মত চিরোল দাঁতের হাসিতে বা’পাশটা থমকে আসে তার। সে প্রফুল্ল স্বরে বলল,
“ আপনাকে অনেক ধন্যবাদ স্যার! আমি..”
তীব্র কথা টেনে নেয়৷ ধন্যবাদের বিপরীতে ছোটো শব্দে বলে,
“ গাড়িতে ওঠো।”
মেয়েটা থামে। কমে যায় হাসি। মাথা নেড়ে
হাঁটতে গিয়েও থামল আবার। নিশ্চিত হতে বলল,
“ গাড়িতে? কিন্তু স্যার, আপনি যে তখন বললেন আমি যেন গাড়িতে না উঠি?”
তীব্র জিপের দরজা খুলেছে কেবল। উঠতে নিয়ে দাঁড়াল। ভ্রু কুঁচকে শুধাল,
“ কখন বলেছি?”
পুষ্পিতা অধৈর্য ভঙ্গিতে মনে করিয়ে দেয়,
“ ঐ যে কলেজের মধ্যে ছুটির সময়।”
তীব্র ফটাফট বলল,
“ ভেতরে কী বলেছি ভুলে যাও। এখন কলেজের বাইরে আছো না? এখন যা বলছি সেটা করো।”
পুষ্পিতা জড়বুদ্ধি হলো কিছু। আস্তে আস্তে যত দিন যাচ্ছে,তীব্রকে কেমন রহস্য ঠেকছে তার৷ যার মতিগতি এক চুটকিতে বুঝে নেয়া যায় না। আচ্ছা, পৃথিবীতে এমন দূর্বোধ্য মানুষও হয়?
চলবে।