কলমে: নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
(২৮)
প্রকৃতির মুখ গোমড়া। আকাশে ভীষণ মেঘ। বাতাবরণে হালকা-পাতলা হিমের ছোঁয়া নেমেছে। পুরোনো জানলার গ্রিল পেরিয়ে ছুটে আসছে ঠান্ডা ঠান্ডা বাতাস। পুষ্পিতা ক্লাসরুমে বসে আছে। ফরসা, পেলব হাতটা ঠাঁই পেয়েছে গালে। ক্লাসের এপাশটায় একটা বড়ো মাঠ। সবুজ ঘাস দেখা যায়। দুটো গোরু জাবর কাটছে বসে। পুষ্পিতার চোখের ধ্যান সেদিকে রইলেও,মনের যোগ অন্য কোথাও। অম্বরে পাখা মেলে উড়ে যাওয়া কাকের দল,কিংবা শ্যাওলা রঙা ডোবায় ফোটা শাপলা? এই নৈসর্গের রূপ মাড়িয়ে ছুটে যাচ্ছে ওরা।
আর তারপর! তারপর ঠিকড়ে পড়ছে বাড়ির সিঁড়িপথে। সেখানে কেবল তীব্রর অযাচিত দাপট। অনাকাঙ্ক্ষিত রাজত্ব চালানো এক বিলাতি চোখের মালিক। তীব্র একবার কাছে আসে,আবার সরে যায়। নিঃশ্বাস লুটিয়ে পড়ে কোনো লজ্জাবতীর কপোলে। কানের পাশে বেজে ওঠে যার ফিসফিসে ধ্বনি
“ তুমি সুন্দর! তুমি সুন্দর!”
পুষ্পিতা আই-ঢাই করে উঠল। শীর্ণ দেহ নড়ল ছলকে ওঠা হাওয়ার ন্যায়। কুণ্ঠায় পদ্ম কুড়ি চোখ দুটো বুজে ফেলল খিচে। কী জ্বালাতন এসব! স্যারের কথা এভাবে মাথায় আসছে কেন?
পুষ্পিতা নিজেকেই শাসাল
“ স্যার না শ্রদ্ধেয় মানুষ? তুই না বইতে পড়েছিলি শিক্ষক বাবা-মায়ের সমতূল্য? তাহলে তাকে নিয়ে এসব কী হাবিজাবি ভাবছিস পুষ্পিতা। ছি,লজ্জা থাকা উচিত তোর।”
পরপর মনে পড়ল নূহার বলা কথা,
“ এমন ইয়াং স্যার কখনও বাবা সমতূল্য হয় না। এই যুগে কত স্যার আর ছাত্রীর বিয়ে হয়েছে জানিস?”
পুষ্পিতা হাল ছেড়ে দিলো। সমস্ত যুক্তি-তর্কের অসহায়ত্ব টের পেলো মনে মনে। বুঝে নিলো, এই কল্পনার ঝোলাঝুলিতে ও নিজেই নিরুপায় হয়ে দুলছে। এখন চাক,বা না চাক,স্যারের কথা মাথায় ঘুরবেই। এখানে ওর কিচ্ছু করার নেই।
তক্ষুণি পাশে ধপ করে বসে পড়ল কেউ একজন। ধ্যানে থাকা পুষ্পিতা লাফিয়ে ওঠে। চকিতে ঘাড় বাঁকায়। তনুজা এসেছে। কাঁধব্যাগটা নামিয়ে রেখে হাসি মুখে তাকাল। ভ্রু উঁচিয়ে শুধাল,
“ কেমন আছো?”
পুষ্পিতা মুচকি হেসে বলল,
“ এইতো চলছে। তোমার কী খবর?”
উত্তরের বদলে মিটিমিটি হাসল তনুজা। ঠোঁট এগিয়ে চাপা কণ্ঠে বলল,
“ আমি না একটা জিনিস এঁকেছি জানো।”
“ কী আঁকলে?”
পুষ্পিতার কণ্ঠে আগ্রহ।
“ দাঁড়াও দেখাই।”
তনুজা ব্যাগ খুলে একটা মোটা ডায়েরি বের করল। পাতা মেলার আগে সচেতন করল,
“ আচ্ছা আগে বলে নেই,কাউকে কিন্তু বলা যাবে না।”
“ কাকে দেখাবো? আমি তো তুমি ছাড়া কারো সাথে মিশিই না।”
তনুজা খুশি হয়ে গেল। দু ঠোঁট মেলল গদগদ ভঙ্গিতে। পুষ্পিতা দেখতে ভীষণ সুন্দরী! বলতে গেলে তাদের ডিপার্টমেন্টের সবথেকে সুশ্রী মেয়ে। এত চুপচাপ,নরম। একভাবে কলেজে আসে,বসে ক্লাস করে চলে যায়। একমাত্র সখ্যতা ওর সঙ্গে বলে এ অবধি কতগুলো ছেলে যে তার হাতে চিঠিপত্র দিয়েছে। এমন একটা মেয়ে কেবল ওর সাথেই মেশে, এ যেন খুব গর্বের কথা।
ও আনন্দ সমেত ডায়েরির পাতা ওল্টাল। পুষ্পিতা চেয়ে রইল সেদিকে। তনুজা আকার হাত ভালো। আর্ট খাতাটা একবার এনেছিল কলেজে। এত চমৎকার করে গ্রামের দৃশ্যপট ফুটিয়েছে সবেতে!
আজ আবার কী একেঁছে!
সহসা সাদা পাতার ওপর একটা গোটা স্কেচের দেখা মেলে। কোনো পুরুষালি অবয়ব বের করে সবকটা দাঁত দেখিয়ে দিলো তনুজা।
“ কী, কেমন হয়েছে?”
পুষ্পিতা সরল ভ্রু কুঁচকে বলল,
“ হয়েছে তো ভালোই। কিন্তু কে এটা?”
মেয়েটা ভ্যাবাচেকা খেল। হাহাকার করে বলল,
“ মানে,কে মানে কী? বুঝতে পারছো না? ভালো করে দ্যাখো।”
ওর বলার ধরণে পুষ্পিতা মিইয়ে যায়। মহাভারত অশুদ্ধ হওয়ার মতন চেয়ে আছে তনুজা। এবার অধিক স্পষ্ট চোখে চাইল পুষ্পিতা। চশমা পরিহিত সেই যুবকের গোছানো বাদামী চুল দেখেই চেহারা টানটান হলো অমনি। স্কেচের সাথে বাস্তবের মুখের মিল নেই। কিন্তু পুষ্পিতার মস্তিষ্কে লাফিয়ে বেড়াল তীব্রর নাম। তনুজাটা স্যারের জন্যে যেই হা-পিত্তেস করে! ওনাকে ছাড়া আর কাকে আঁকবে?
অচিরাৎ ললিত আননে তমসা ভিড়ল তার। বিষাদের ন্যায় কালো দেখায় মুখায়ব। তনুজা স্ফুর্ত চিত্তে বলল,
“ একদম স্যারের মতো হয়েছে না? কাল সারারাত না ঘুমিয়ে ওকে এঁকেছি। ওই যে সেদিন একটা লুকিয়ে ছবি তুলে নিয়েছিলাম না? সেটা দেখে দেখেই আঁকা। হুবহু মিলেছে না বলো? আসলে ও তো সবসময় আমার মনের মাঝেই থাকে, না হয়ে যাবে কই!”
প্রথম প্রথম এসব নিয়ে বিস্ময়ে আহাজারি করলেও,এতদিনে সয়ে গেছিল পুষ্পিতার। ভাবত, তনুজা ছেলেমানুষ হয়ত। স্যারকে নিয়ে এসব বলে শান্তি পেলে পাক। আলগোছে হেসে উড়িয়ে দিত সব।
অথচ আজ,কেন যেন পুষ্পিতার কোনো অনুভূতিই এলো না। বরং মনে হলো,এসব শুনতে একটুও ইচ্ছে করছে না ওর। কথার পিঠে মাথা হেলিয়ে স্বায় দিলো কেবল।
তনুজা প্রাণোচ্ছল । তীব্রকে আঁকার যুদ্ধে জয়ী হওয়ার আনন্দে মাতোয়ার অধর। হাস্যজ্জ্বল বদন আরো ঝলকে জানাল,
“ জানো,আমার একটা স্কুল ফ্রেন্ড আছে,নাদিয়া। ওর আগামী মাসে বিয়ে। ছেলে কী করে শুনবে?”
পুষ্পিতা হাস্যহীন চেয়ে রইল।
ও বলল,
“ হোম টিউটর ছিল নাদিয়ার। দু বছর পড়িয়েছে। সাথে প্রেমও করেছে। কী দারুণ না? তুমি যে সারাক্ষণ আমাকে শিক্ষক নিয়ে জ্ঞান গুলো দিতে এবার দেখো,আজকাল এসব অহরহ ঘটছে।”
পুষ্পিতা নিষ্প্রভ তখনও। হু-হা করেনি। তনুজা ফের আওড়ায়,
“ সামনে ভালোবাসা দিবস। ঐদিনই স্যারকে একটা চিঠি দেব ভেবেছি। সেখানে আমার মনের সব কথা লেখা থাকবে। ভালোবাসার কথা বেশদিন চেপে রাখতে নেই।”
অকারণে, অজান্তে কেন যেন চমকে উঠল পুষ্পিতা। তনুজার ঠোঁট ভরতি হাসিতে যত জোর, ততোধিক জোরে ভাঙল মন। পরপর নিজের প্রতি বিশদ রাগে ফেঁপে উঠল নিজেই। তীব্রকে দেখে বুক কাঁপা,লজ্জায় মিটে যাওয়া মাটিতে, এইসব কিছুকে নিজের বেহায়াপনা মনে হচ্ছে এখন। ও তো শুরু থেকে জানে তনুজা স্যারকে পছন্দ করে। সেই প্রথম দিন ওনার কলেজে আসা থেকে। দেখতেও মেয়েটা বেশ! যেখানে ও মানুষের সামনে কথা বলতে পারে না,সেখানে ও কত চটপটে। পড়াশুনাতে ওর থেকে হাজার গুণ ভালো। এরকম মেয়েদেরই তো সবাই পছন্দ করে। পুষ্পিতা দুপাশে মাথা নেড়ে হাসল। নূহাটাও না। কত কী ভেবে ফেলেছিল ওকে আর স্যারকে নিয়ে।
তনুজা কত যোগ্য মেয়ে! স্যারকে একবার প্রস্তাব দিলেই উনি রাজি হবেন। ওকি পছন্দ করার মতো কোনো মেয়ে হলো?
নিজের ভাবনায় পুষ্পিতা নিজেই থমকে রইল এবার। আশ্চর্য! এসব কী ভাবছে? পছন্দ-অপছন্দ,যোগ্য-অযোগ্য এসব প্রশ্ন উঠছে কেন মনে? স্যারের প্রসঙ্গে তনুজার সাথে নিজের তুলনাই বা কেন টানছে? রমিজ স্যার ক্লাসে ঢুকলেন তখন। শিক্ষার্থীরা উঠে দাঁড়াতেই তনুজা ঝটপট ডায়েরি ঢোকাল ব্যাগে।
পুষ্পিতা ফোস করে শ্বাস ঝাড়ল। সাথে ঝেড়ে ফেলতে চাইল সকল উদ্ভট ভাবনা। কিন্তু নব্য অনুভুতিরা কি আর কথা শোনে? ওরা যে বেহায়াপনা করবেই।
******
নাহিদের ইন্টারভিউয়ের অফিস, নূহার ভার্সিটির আগে। গন্তব্য দেখতেই সে চটপট রিক্সা থামাতে বলল। এক লাফে নেমে পকেটে হাত দিতেই সাবধান করল নূহা,
“ খবরদার মিস্টার ঢেঁড়স। ভুলেও ভাড়া দিতে যাবেন না।”
নাহিদ অবাক হয়,
“ কেন? আমার ভাড়া আমি দেব না?”
“ না।”
“ তা কেন? এরকমটা আবার হয়?”
নূহা কপাল কোঁচকাল,
“ হবে না কেন? আপনি যান তো। আপনার না দেরি হচ্ছে? এই বারবার বার্গেইনিং করে করে কিন্তু ইচ্ছে করে দেরি করছেন।”
নাহিদ ঘাড় চুলকাল।
নূহা ওকে ভাড়া দিতে দেবে না বুঝতে পেরেছে। কিন্তু না,সে তো অমন ছেলে নয়। যে একটা ছোট্টো বাচ্চা মেয়ের ভাড়ায় যাতায়াত করবে।
একটু চুপ থেকে বলল,
“ আচ্ছা ঠিক আছে। আপনি দিতে চাইছেন যখন, দেবেন। সমস্যা নেই।”
নূহা প্রসন্ন হয়ে বলল,
“ এইত, অল্পতে মেনে নিয়েছেন দেখে খুশি হলাম।”
নাহিদ ঝরঝরে হাসল।
“ তাহলে আমি আসছি হ্যাঁ?”
নূহা ঘাড় কাত করল। হঠাৎ রাস্তার ওইপাড়ে চেয়ে ভ্রু গোছাল নাহিদ। আঙুল তুলে বলল,
“ আরে দেখুন ওখানে কীসের ধোঁয়া? আগুন লাগল না কি?”
নূহা ঘুরে চাইল সহসা। সে একা নয়,কৌতুহলে রিক্সাচালক লোকটিও চেয়েছেন। আচমকা নাহিদ মুঠোতে একশ টাকার নোট গুঁজে দিতেই ফিরলেন তিনি। নূহা কিছু খুঁজে না পেয়ে বলল,
“ কই ধোঁয়া?”
তাকাল যখন, ব্যাপারটা চোখে পড়ল। রেগে বলতে গেল,
“ এ কী আপনি… “
মেয়ের ধমক টুকু নাহিদ শুনল না আজ। ছোটো বাচ্চাদের মতো এক দৌড়ে ঢুকে গেল ভেতরে। গেট মাড়িয়ে, থামল আবার।
ঘুরে চেয়ে বড্ড ব্যস্ত ভাবে বলল,
“ মেজাজে আপনি বড়ো হলেও,বয়সে কিন্তু আমার থেকে ছোটো। ভাড়া সব সময় বড়োদের দিতে হয় মিস নূহা।
না বলে দিলাম বলে আবার বদদোয়া দেবেন না যেন। তাহলে কিন্তু এই অধমের সব শেষ। আসি হ্যাঁ?”
চলে গেল নাহিদ। গোটা ব্যাপারটায় তব্দা খেয়ে বসে রইল নূহা।
কিছুক্ষণ বোকা বোকা চেয়ে থেকে আচমকা হেসে ফেলল।
তারপর রিস্কা ছুটতে শুরু করে । প্যাডেল টানতে বহাল চালক হুট করে বললেন,
“ ভাইজান মানুষটা ভালোই আপা। অত বড়ো হইয়াও আফনের ঝাড়ি হুনলো।”
নূহা উত্তর দিলো না। শুধু হেসে গেল একা একা। নাহিদের বাচ্চামো গুলো ভীষণ মনে ধরেছে ওর। কিন্তু বাচ্চামো করা মানুষটা, তাকে মনে ধরেছে কি?
***
কলেজ ছুটি হয়েছে। লম্বা করিডোরে উপচে পড়া ভিড়। সব একইসাথে গেটের পথে হেটে যাচ্ছে কী না! এই সময়টা কিছু ফাজিল ছেলেপেলে সুযোগ লুফে নেয়।
ইচ্ছে করে মেয়েদের শরীর ঘেঁষে হাঁটে। স্পর্শ করে বাহানা দিয়ে। পুষ্পিতা একবার স্বীকার হয়েছিল। কী যে ভয় পেয়েছিল মেয়েটা! সেই থেকে হয় সবার পরে বের হয়,বা ভিড় কমলে।
তেমনই আজও দাঁড়িয়ে ছিল সে। মধ্যদুপুরে মাঠে কড়া রোদ বিধায় হাতে গোণা লোকজন সেখান থেকে যায়। কী মনে করে আজকে মাঠে নামল পুষ্পিতা। সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো মাথার তালু পুড়ে যাচ্ছে। ছুটে ছাউনীতে ফেরত এলো আবার। না,ভিড় কমলেই যাবে। বাসায় তো কাজ নেই। নূহাও নেই। ওরই বা এতো তাড়া কীসের? পুষ্পিতা একবার অফিস রুমের দিকে দেখল। কেন যেন খুঁজে বেড়াল তীব্রকে। স্যার আজ ক্লাস নেননি। কেন কে জানে! এত মেয়ে আফসোস করল তাতে! তনুজা তো পারলে দুঃখে মরে যায়।
কিন্তু ওর,ওর কি খারাপ লাগেনি? পুষ্পিতা কথাটা ভাবতে চেয়েও, মন-মস্তিষ্ককে প্রশ্রয় দিলো না। উলটে কঠিন ধমকে চুপসে রাখল তাদের।
চোখ তুলে মনমরা অম্বরে এক পল চাইল। এই আকাশের মতো ওর বুকেও মেঘ জমেছে আজ। অথচ এই মেঘের বৃষ্টি নেই। কখনও আসবেও না। যে মেঘের কারণ নেই,তা কখনও কাটে?
ততক্ষণে ভিড় কমেছে। চার ভাগের তিন ভাগ ছেলে-মেয়ে বেরিয়ে গেছে প্রাঙ্গন ছেড়ে। পুষ্পিতা পা বাড়াল এবার। ওপাশ হতে চারজন হেঁটে আসছিল। দুটো ছেলের সাথে আরো দুটো মেয়ে। সাইফুল,শরীফ,হেনা,রূপা। এই কলেজেই পড়ে। পুষ্পিতাকে দেখেই স্থানে দাঁড়িয়ে পড়ল শরীফ।
রূপাকে বলল,
“ ঐ দ্যাখ,যার কথা বলেছিলাম।”
বাকীরাও উৎসুক হয়ে সামনে তাকায়। পুষ্পিতা মাথা নিচু করে হাঁটছে। সুরূপা মেয়েটিকে দেখে হেনা আওড়ায়,
“ হুম মোটামুটি।”
সাইফুল আকাশ থেকে পড়ল যেন,
“ এত সুন্দর মেয়েকে মোটামুটি বলছিস? তোর কি চোখ না আর কিছু?”
“ আমার কাছে অতো ভালো লাগেনি। কী বলব তাহলে?”
“ কী রে শরিফ,ও কী বলছে?”
শরিফ বলল,
“ আহ ছাড় তো। মেয়ে মানুষ এমনই। একজন আরেকজনের প্রসংশা করতে পারে না।”
হেনা মুখ বাঁকাল। রূপা বলল,
“ না রে ভাই। আমিও তো মেয়ে। আমি বলছি মেয়েটা মারাত্মক দেখতে। মনে হচ্ছে পুতুল হেঁটে আসছে।”
শরীফ ছটফট করে বলল,
“ কাছে আসুক,আজকে কথা বলবই”
সাইফুল বলল,
“ আরে ভাই কথা বললে বলিস। কিন্তু মনে রাখিস তুই সিনিয়র,ও জুনিয়র। প্রথম দিনই ছ্যাবলামো করে মান ইজ্জত খোয়াস না।”
রূপা স্বায় মিলিয়ে বলল,
“ আমিও একমত। পছন্দ করিস বলে নিজের ওয়েট নষ্ট করবি না কিন্তু।”
“ ওকে ওকে।
চারজন খুঁটির মতো দাঁড়িয়ে রইল। কিছুটা শিকারের জন্যে,শিকারির ওৎ পাতার ন্যায়। অথচ ভাবনায় বুঁদ থাকা পুষ্পিতা খেয়ালই করল না ওদের। নিজের মতো পাশ কাটিয়ে চলে গেল মেয়েটা। অমনি ফুঁসে উঠল হেনা,
“ কী অভদ্র! আমরা এতগুলো সিনিয়র এখানে দাঁড়িয়ে আছি অথচ একটা সালাম অবধি দিলো না?”
কথাটা পুষ্পিতার কানে ঢুকেছে। তৎক্ষণাৎ দাঁড়িয়ে গেল সে। পিছু ঘুরল মিনসে আননে। হেনার চোখমুখে স্পষ্ট রাগ। সাথে অচেনা আরো তিনজনকে দেখে চুপসে এলো বেচারি।
নিভু কণ্ঠে শুধাল,
“ জি মানে,আমাকে কিছু বললেন?”
রূপা ডাকল মোটা গলায়,
“ হ্যাঁ, এদিকে এসো।”
পুষ্পিতার শঙ্কা হলো। চারপাশটা দেখল একবার। লোকজন কমে যাচ্ছে,এর মধ্যে এরা ডাকছে কেন এখন? একেকজনের মুখ দেখে তো মনে হচ্ছে বিষয়টা স্বাভাবিক নেই। কী করবে সে নিয়ে দ্বিধায় পড়ল মেয়েটা।
হেনা রেগে বলল,
“ কী হলো শুনতে পাওনি? এসো এদিকে।”
দোটানায় একশেষ পুষ্পিতা এক চুলও নড়ল না। দাঁড়িয়ে রইল ঠায়। অপ্রস্তুত বিষয়টাতে সে যথেষ্ট ঘাবড়ে গিয়েছে। এই কলেজে তো র্যাগ হয় না। হলেও ওর জানা নেই। গত মাস কয়েকে স্বীকার হয়নি কখনো। কিন্তু সিনিয়ররা এভাবে ডাকছে যখন,নিশ্চয়ই আদর-আপ্যায়ন করবে না।
“ আচ্ছা অভদ্র মেয়ে তো!”
বিরক্ত হয়ে ওরাই এগিয়ে এলো। দশ কদমের দুরুত্ব ঘুঁচে গেল এবার। পুষ্পিতার বিশীর্ণ বুক ধড়াস ধড়াস করছে। চারজন ওকে মাঝে রেখে কুণ্ডলী পাঁকিয়ে দাঁড়াল। যেন রোধ করেছে সব রকম পালানোর পথ। সাইফুল বলল,
“ বড় ভাইদের কোনো সম্মান দাও না। ডাকার পরেও জায়গায় খাম্বা হয়ে রইলে। কী? দেখতে সুন্দর বলে কি অহংকারে মাটিতে পা পড়ে না?”
পুষ্পিতা কী বলবে! কারো মুখের ওপর উত্তর দিয়েছে কখনও? জ্বিভে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,
“ না মানে..”
হেনা কথা কেড়ে নেয়,
“ কী না মানে? দেখে মনে হচ্ছে ভাজা মাছ উলটে খেতে পারো না। কিন্তু স্বভাবে তো আচ্ছা বেয়াদব তুমি।”
পুষ্পিতা নিরুত্তর মাথা নোয়াল। ব্যস,আরো পেয়ে বসল ওরা। রূপা বলল,
“ এই মেয়ে তো দেখি কথার উত্তরও দেয় না। সত্যি রে ভাই,দিন দুনিয়া থেকে সম্মান উঠে যাচ্ছে। আমরা সিনিয়রদের দেখলে খাওয়া রেখে, চার আঙুল ঠেকিয়ে সালাম দিতাম। আর এরা দ্যাখ,কেমন চুপ করে ভাব দেখায়।”
শরিফের এত সবে আগ্রহ নেই। সে পুষ্পিতার আপাদমস্তক বড়ো নিবেশন দিয়ে দেখছে। মেয়েটি ওর চোখে পড়েছে সপ্তাহ দুয়েক হবে। কলেজে ঠিকঠাক ক্লাস হয়না বলে একাডেমিক ভবনে খুব কম ঢোকে ওরা। আড্ডা দেয় বাইরে। তাই এতদিন দেখেনি। আর যখন দেখল,তখন নতুন স্যারের সাথে। আসে- যায়। সেজন্য চেয়েও কথা বলতে পারেনি। আজ তো মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি নেমে এলো। কী দারুণ ভাবে সুযোগ পেলো একটা! তবে শুনেছে মেয়েটির নাম পুষ্পিতা। নামের সাথে মুখের বড্ড মিল। একেবারে পুষ্পের মতোই সুন্দর! সত্যি,দূর থেকে যেমন দেখেছিল, কাছ থেকে এ যে আরো বেশি রূপসী। মোমের মত মেদুর মুখখানায় কুমুদিনী মায়া!
বাকীদের রাগ-ক্ষোভ উগলে দেয়া শেষে, মুখ খুলল শরিফ। তরল কণ্ঠে শুধাল,
“ তোমার নাম পুষ্পিতা?”
পুষ্পিতার নজর স্লিপার পরা পায়ে। জবাবে মাথা নাড়ল শুধু।
ও আবার বলল,
“ এখানকার কোথায় থাকো তুমি?”
পুষ্পিতার দ্বিধাদ্বন্দ্ব বাড়ছে। এরা হঠাৎ এভাবে কথা বলতে এলো কেন? হেনা খ্যাপে বলল,
“ কী হলো? যা জিজ্ঞেস করছি উত্তর দাও।”
শরিফ থামিয়ে দেয়,
“ আহ,চুপ কর। আমাকে কথা বলতে দে।”
হেনা বাধ সাধে,
“ কোনো কথা-টথা নয়। এই মেয়ে সিনিয়র হিসেবে আমাদের পাত্তাই দিচ্ছে না। ওকে একটা শাস্তি দেয়া উচিত।”
পুষ্পিতার মুখ শুকিয়ে গেল। ভয়-আতঙ্কে দুরুদুরু করে উঠল ভেতরটা।
শরিফের ভারি মেজাজ খারাপ লাগছে। এই হেনাটার সবেতে বাড়াবাড়ি। চটে কিছু বলতে চাইলে হেনা চোখের ইশারায় থামতে বলে। ঠোঁটের মিটিমিটি হাসি দেখে শরীফ চোখ সরু করল। কথানুযায়ী নিভে এলো এবার। বুঝে নিলো,শাস্তিটা নির্ঘাত তাকে নিয়েই।
হেনা ব্যাগ খুলে কাগজ-কলম বের করল। এগিয়ে দিয়ে বলল,
“ ধরো।”
পুষ্পিতা ভীত লোঁচনে চেয়ে। ঢোক গিলল একবার । রূপা ধমকে ওঠে,
“ কী হলো? কানা না কি? ধরতে বলেছে না?”
পুষ্পিতা বাধ্যের মতো কাগজ-কলম নিলো। হেনা বক্ষপটে হাত গুটিয়ে দাঁড়ায়। চোখেমুখে ফুটিয়ে তোলে সিনিয়র সিনিয়র গাম্ভীর্য।
ভাবসাব নিয়ে বলল,
“ এবার আমি যা যা বলছি লেখো ওখানে।”
পুষ্পিতা আবার চারপাশে দেখছে। সে যে কাকে খুঁজছে নিজেই জানে না। তনুজাটা তো বেরিয়ে গেছে অনেকক্ষণ। আচ্ছা,তীব্র স্যার,স্যার কি চলে গেছেন?
“ কী হলো,এত আশেপাশে কী? কেউ আসবে না এখানে। এই কলেজে আমাদের চারজনকে না সবাই এক নামে চেনে বুঝলে! ভালো চাইলে যা বলছি লেখো..”
পুষ্পিয়া উপায়হীন বনে খাতার সাদা পাতা মেলল। কলম ছুঁইয়ে চাইল ওর দিক। চাউনীতে নীরব প্রশ্ন,
“ কী লিখব?”
হেনা বলল,
“ লেখো,
শরিফ
আমি তোমাকে ভালোবাসি।”
পুষ্পিতা লিখতেই নিয়েছিল,পুরো লাইন শুনেই চমকে-থমকে একাকার। মুখ তুলল স্তব্ধ হয়ে। বাকীরা ফিক করে হেসে উঠল অমনি। রূপা নুইয়ে পড়ে হাসিতে। সাইফুল হাইফাইভ করে। শরিফ হাসে ঠোঁট চেপে।
পুষ্পিতা হতবাক, হতবিহ্বল। মুখ খুলল এতক্ষণে,
“ এসব কেন লিখব?”
হেনা চোখ পাঁকাল,
“কেন লিখব মানে? আমরা বলছি তাই।”
পুষ্পিতা মাথা নুইয়ে বলল,
“ আমি এটা লিখব না।”
রূপা চেতে বলল,
“ কী?এই তুমি জানো তুমি কী বলছো? লিখবে না মানে কী হ্যাঁ? না লিখলে এক্ষুনি প্রিন্সিপাল স্যারকে গিয়ে বলব তুমি আমাদের সাথে বেয়াদবি করেছ। স্যারকে তো চেনো না,সিনিয়রদের অসম্মান করা তিনি একদম পছন্দ করেন না। মনে নেই,নবীন বরণে বলেছিলেন সিনিয়দের সম্মান দিতে হবে?
পুষ্পিতার মনে আছে। নবীন বরণে প্রিন্সিপাল ভাষণের সময় সত্যিই এসব বলেছিলেন। একজন আদর্শ শিক্ষার্থীর কেমন হওয়া উচিত একটা লম্বা তালিকার সাথে যোগ করেছিলেন,
“ নিজের সিনিয়রদের সম্মান করা।”
হেনা বলল,
“ আমরা চারজন একসাথে গিয়ে যদি এটা বলি,স্যার তোমাকে কখনো বিশ্বাস করবেন? আবার আমরা হলাম চার বছরের পুরোনো ছাত্র-ছাত্রী। সেখানে তুমি এলে ছমাসও হলো না। এরপর এই কথা যাবে ফোরকান স্যারের কানে। ওনার চোখে চান্দু একবার খারাপ হলে জীবনে আর ভালো হতে পারবে না। নম্বরও কম পাবে। এখন ভাবো কী করবে! যা বলেছি সেটা লিখে চুপচাপ চলে যাবে,না স্যারের কাছে পাঠাবে আমাদের?”
পুষ্পিতার মাথায় বাঁজ পড়ল যেন। কী সাংঘাতিক এরা! অসহায়ত্বে সরু নাক ফেঁপে ওঠে মেয়েটার। নূহাকে মনে পড়ে। ও এখানে থাকলে ঠিক কিছু না কিছু করত। ওকে যে কেন এতো নরম বানানো হলো! দুনিয়াতে নরম হওয়া আর বোবা হওয়া সমান। এরা না পারে লড়তে,না পারে কিছু বলতে!
শরিফ বলল,
“ আমার নামে কিন্তু শ হ্যাঁ? আবার স দিও না।”
বাকীরা মজা পেয়ে গেল। হেসে উঠল খিলখিলিয়ে। অথচ এতো কান্না পেলো পুষ্পিতার! সাইফুল বলল,
“ ও হ্যাঁ, নিচে তোমার নামটাও লিখে দিও কিন্তু।”
পুষ্পিতার মন চাইল এটার গালেও একটা কষে থাপ্পড় মারতে। কিন্তু আজকে কি মেয়ের ওই সাহস আছে? আজকে তো পাশে তীব্র স্যার নেই।
“ পুরো নাম লিখবে? না অর্ধেকটা?” হঠাৎ পুরুষালি কণ্ঠটা তপ্ত বাতায়ণ ছিড়েখুঁড়ে এলো। চকিতে পিছু ফিরল সবাই। এই স্বর পুষ্পিতা চেনে। চেনে তার মালিককেও। মেয়েটার মৃগনেত্র সবেগে ঝলমলিয়ে ওঠে। ঠোঁট দুটোতে রাতারাতি ভিড় করল স্বস্তির সুরশাল হাসি।
তীব্র এগিয়ে আসে। বড় দম্ভ তার হাঁটার গতিতে। এসে ঠিক পুষ্পিতার পাশে দাঁড়াল। শরিফরা মিইয়ে এলো সহসা। শশব্যস্ত সালাম ঠুকল সবাই। তীব্র সূচাল চোখে একেকজনকে দেখে নেয়। ফটাফট প্রশ্ন করে,
“ কোন ইয়ার?”
সাইফুল মিনমিন করে জানাল,
“ ফা..ফাইনাল ইয়ার,বাংলা ডিপার্টমেন্ট।”
“ কী করছিলে এখানে?”
ওরা চোরা চোখে একে-অন্যের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে।
তীব্র নিজেই বলল,
“ র্যাগ দিচ্ছিলে,তাই তো?”
অচিরে মাথা নোয়াল সকলে।,
“ এই কলেজে আবার র্যাগ? পড়াশোনা রেখে তাহলে এসবই করো সারাদিন?”
শরিফ বলল,
“ সরি স্যার।”
তীব্রর আওয়াজ শাণের ন্যায়,
“ ডোন্ট সে সরি টু মি। সে সরি টু হার।”
একটা জুনিয়র মেয়েকে সরি বলতে বেশ গায়ে লাগল হেনার। মুখ খুলল কিছু বলতে,সহসা দরাজ কণ্ঠে চেঁচিয়ে ওঠে তীব্র,
“ সে সরি!”
হেনা একা নয়, পাশে দাঁড়ানো পুষ্পিতাও সমান কেঁপে উঠল।
সে বলে দিলো ঝটপট,
“ সরি!”
এরপর একে একে সবাই।
তীব্র আদেশ ছুড়ল,
“ আর কক্ষণও কাউকে র্যাগ দিতে যেন না দেখি।”
মাথা কাত করল সবাই।
তীব্রর কথা শেষ হয়নি। ফের শাসাল,
“ এই মেয়েটার চারপাশেও তোমাদের যেন না দেখি! আই সোয়্যার খুব খারাপ হবে তাহলে।”
তীব্র আঙুল উঁচাল। নিরব শাসানোর তপ্ততায় ওরা ছাই হলেও, বিস্ময়ে স্তম্ভিত হলো পুষ্পিতা। কোটর ছাড়াল তার সবটুকু জড়ীভূত ভাব।
তারপর মাথা নুইয়ে চলে গেল ওরা। শরিফ যেতে যেতে একবার পুষ্পিতার দিক চায়। ভাবল,
“ আজ স্যার এসছে,সব সময় তো আর থাকবে না। নজর যখন লেগেছে,কথা তো বলবেই ।”
এক কদম বাড়াল,তীব্র তক্ষুণি ডাকে,
“ দাঁড়াও।”
তীরস্থ বেগে দাঁড়িয়ে পড়ল শরিফ। কিছুটা ভয় জাগল মনে। তার জানামতে এই লোক নতুন এসেছেন। ফোরকান সাহেবের ভীষণ ক্লোজ! এমন সাদামাটা কলেজে এরকম বলিষ্ঠ দেহের একজন শিক্ষক,চার বছরে এই প্রথম দেখছে শরিফ। ঘুরে চাইল সে। নম্র স্বর,
“ জি স্যার?”
তীব্র নিজেও পেছন ফিরে মুখোমুখি হলো।
“ তোমার নাম?”
ছেলেটা বিক্ষিপ্ত,বিভ্রান্ত।
“ শরীফ হাসান।”
তীব্র মুচকি হেসে বলল,
“ সবে ফাইনাল ইয়ার। এখনও লাইফ অনেক দূর বাকী। তোমার চোখ দেখে আমার এই মুহুর্তে যা মনে হচ্ছে, মানে এই মুহুর্তে তুমি যেটা চাইছো সেটা এই কলেজ পার হতে হতেই ভুলে যেও। নাহলে বেশ দূর্ভোগ আছে তোমার কপালে।”
শরিফ কিছুই বোঝেনি। এই মুহুর্তে কী চাইছে ও? পুষ্পিতার সাথে সন্ধি করার কথা ছাড়া অন্য কিছু ভাবেনি তো। স্যার কি এই মেয়েকে নিয়েই ইঙ্গিত দিলেন?
শরিফ তীব্রর প্রস্তর সম মুখটায় চেয়ে থাকল কিয়ৎক্ষণ। চাউনীতে পরিচ্ছন্ন বিভ্রম। তীব্রর সাদাটে চিবুকের পোক্ত ভাব। অথচ পোড়া ঠোঁটে চমৎকার হাসি। বলল,
“ যাও। যেটা বলেছি মাথায় রেখ। আমার কথা শুনলে তোমারই ভালো। নাহলে আমি আবার কখন খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসি বলা যায় না।”
শরীফ এবারেও হতবুদ্ধি। পুরোটা মাথার ওপর দিয়ে গেছে। কীসের খোলস, কার খোলস? তবে মন বলল এখানে আর বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক হবে না।
ভদ্রের মতো এক পাশে মাথা হেলিয়ে চলে গেল ছেলেটা । তীব্র সেদিক চেয়ে থাকে। সুতনু আদল লালচে। চোখ দুটোতে জ্বলজ্বলে ক্রোধ।
বিড়বিড় করে বলে
“ মা***বাচ্চা আমার ভিতু মেয়েকে লাইন মারতে চায়। কত বড়ো কলিজা! আর একটু বাড়াবাড়ি দেখলে হাত ঢুকিয়ে তোর কলিজা বাইরে নিয়ে আসব। কুত্তার*বাচ্চা কোথাকার!”
এত স্বল্প আওয়াজ, বিমূর্ত হয়ে থাকা পুষ্পিতার কানে যায়নি। মেয়েটার বিস্ময় পালটে এসেছে ঘোরের জাদুতে। পরপরই সেই চাউনীদুটো আপ্লুত হলো। শক্ত মানবের শক্ত পিঠের দিক চেয়ে চেয়ে শত কৃতজ্ঞতায় লুটপাট করল নিজেকে। হেসে কিছু বলতে যাবে,তখনই ঘুরে চাইল তীব্র।
তেজি চোখদুটো তাক হতেই পুষ্পিতার ঠোঁট বন্ধ। গিলে নিলো কথার বাণ। তীব্র খ্যাক করে বলল,
“ তোমাকে বলেছিলাম না ছুটির পর আমার সাথে যেতে? তাহলে একা বেরিয়ে যাচ্ছিলে কেন?”
পুষ্পিতা তাজ্জব বনে গেল । এই কথা কখন বলেছেন স্যার? সে মনে করার চেষ্টা চালায়। না, বলেননি তো।
মিহি কণ্ঠে বলল,
“ এরকম কিছু তো বলেননি স্যার।”
তীব্র থতমত খেল। তাই তো,এমন কিছু ও বলেনি। চেহারায় গাম্ভীর্যের দাপট বজায় রাখল তাও। ভারি কণ্ঠে বলল,
“ ঠিক আছে, ঠিক আছে। বলিনি তো কী? এখন বলছি। এরপর আমাকে ছাড়া একা একা কোথাও যাবে না।”
পুষ্পিতার হ্যাঁ -না শোনার অপেক্ষায় সে রইল না। নির্দেশ দিয়ে সোজা হেঁটে গেল।
মেয়েটা নির্বোধ বনে চেয়ে রইল শুধু। কোথাও গেলে স্যারকে নিয়ে যাবে? এটা কেমন কথা! মানুষ ভাববে কী?
*****
কানাডায় তখন অনেক রাত! মনের সুখে টিভি দেখছে পলাশ৷ মিথিলা পাশেই শুয়ে। বিশালাকার ব্লাঙ্কেটটা পেঁচিয়েছে গায়ে। এসির ভলিউম কমাতে কমাতে,পলাশ রুমটাকে হিমালয় বানিয়ে ফেলেছে। শীতে তার কাঁপুনি ওঠার যোগাড় হয়েছিল প্রায়। একটু আগেই ভরপুর কেঁদেছে মেয়েটা। খিদেতে শুকনো চিপস চিবিয়েছে বসে বসে। বাঙালীর পেট! বিদেশে এলেও,ভাত নাহলে চলে?
কিন্তু আজকে আর টা-টু শব্দ মিথিলা করেনি। পলাশ যে সাংঘাতিক রকমের ঘাড়ত্যাড়া ছেলে বুঝতে বাকী নেই। এই কদিনে ঢেড় শিক্ষা হয়েছে। সে রা বিহীন গোঁ ধরে রইল। ভাতে পানি ঢেলেছে তো,ঠিক আছে। কী হবে এক বেলা না খেলে? মরে তো আর যাবে না।
পলাশ টিভি দেখতে দেখতে এক পল চাইল ওর দিক। একটু কাছে ঝুঁকে দেখল মিথিলার ভারি নিঃশ্বাস পড়ছে। আহারে,না খেয়েই ঘুমিয়ে গেল! এ যাত্রায় মায়া হলো ওর। ডাকতে চেয়েও গুটিয়ে আনল হাত। না থাক। এই মেয়েটা মাত্রাতিরিক্ত বেয়াদব। বাপ-মা যে বড়ো হওয়ার পর বিন্দুমাত্র ভালো শিক্ষার দেয়নি সে তো প্রতি কথায় বোঝা যায়। স্বামী হিসেবে মানে না। সম্মান দেয় না। লাট সাহেবের বেটি! উনি রাধবেন না। কাজ করবেন না। খালি গিলবেন, শপিং করবেন। বড়ো আরামের স্বপ্ন দেখে যে ওকে বিয়েটা করেছিল পলাশ জানে। নাও সোনা,এবার আরাম করো। থাকুক না খেয়ে। ডাকতে গেলেই ভাব নেবে, মাথায় চড়ে বসবে।
আচমকা পলাশের ফোন বেজে ওঠে। ভাইব্রেট হচ্ছে। ভিডিও কল দিয়েছে কেউ একজন। ও টেবিল থেকে হাতড়ে ফোন আনল হাতে। স্ক্রিনে শ্বশুরের নম্বর দেখে এতো বিরক্ত হলো! উফ,এই লোকটাও না! সারাদিন কল দিয়েই যাচ্ছে। আর যখনই ধরবে,মেয়েকে চায়। এর কী মেয়ের খোঁজ নেয়া ছাড়া কোনো কাজ নেই? অফিসের কাজ গুলোও কি করে না?
পলাশ সচকিতে একবার ঘুমন্ত মিথিলাকে দেখে নেয়। অজগরের মতন শুয়ে আছে দ্যাখো। কোনো নড়চড়ই নেই।
ও আলগোছে পাশ থেকে নেমে গেল। অন্য রুমে এসে দোর চাপালো। কল রিসিভ করতেই খোরশেদুল কে দেখা যায়। তিনি একা নন,পাশে সালমা বেগম। পলাশ ঠোঁটে হাসি টেনে বলল,
“ আসসালামু আলাইকুম! আঙ্কেল,আন্টি কেমন আছেন?”
খোরশেদুল ডগমগ ভঙ্গিতে বললেন,
“ ওয়ালাইকুমুস সালাম। ভালো আছি বাবা,তুমি কেমন আছো?”
“ জি ভালো। দুপুরে ফোন করেছিলেন,এত ব্যস্ত ছিলাম! ধরতেই পারিনি। পরে যে কল ব্যাক করব,মনেও ছিল না। কিছু মনে করবেন না।”
“ না না সমস্যা নেই। বিদেশে কত ব্যস্ততা তোমার, বুঝি আমরা।”
“ আন্টির শরীর এখন কেমন আছে?”
সালমা বললেন,
“ এই তো ভালো আছি। তা মিথিলা কোথায়?”
পলাশ ভেতর ভেতর বেজায় বিরক্ত হলো। এরা কল দিলেই শুধু মেয়ে মেয়ে করে! আর মেয়েটা সারাদিন করে আরাম আরাম। কিন্তু বিগত দিনে মিথিলার সাথে ও যা করছে,আর মেয়েরও যা স্বভাব। বাপ-মাকে পেলেই সব গড়গড় করে নালিশ করে দেবে।
তখন আবার যাচ্ছে তাই কাণ্ড হবে আরেকটা। এসব নিয়ে ঝামেলা পোহানোর মতো ফুরফুরে মেজাজ এখন ওর নেই। বিস্তর হেসে মিথ্যে বলল,
“ আসলে আপনার মেয়েকে তো চেনেন,এখানে এসে এক দণ্ড ঘরে থাকে না। আমাদের এপার্টমেন্টেই একটা বন্ধু জুটিয়ে ফেলেছে। দিনরাত তার সাথে ঘুরে বেড়ায়। আজকেও গিয়েছিল বাইরে। ফিরলো এই কিছুক্ষণ আগে। টায়ার্ড তো, ঘুমোচ্ছে।”
খোরশেদুলের মনটা খারাপ হয়ে গেল। স্বর নিভিয়ে বললেন,
“ ওহ।”
“ আপনি বললে ডেকে দিই? কাচা ঘুম তাতে কী! ডাকব?”
উনি বললেন,
“ না না থাক। ঘুমোচ্ছে যখন,বিরক্ত করার দরকার নেই। ঘুমাক। তা খেয়েছ তুমি?”
“ জি।”
সালমা বললেন,
“ আমার মেয়েটা সংসার করতে পারছে বাবা? ও আসলে কখনো কোনো কাজ করেনি তো। একটু শিখিয়ে পড়িয়ে দিও,ঠিক পারবে।”
কথাগুলো পলাশের মনঃপুত হলো। প্রসন্ন চিত্তে কিছু বলতে যাবে, তক্ষুনি
খোরশেদুল বিরোধাভাস করে উঠলেন।
“ কেন? মিথিলা কাজ করবে কেন? বিদেশে কি কাজের লোকের অভাব আছে? পলাশ কী মিথিলাকে খাটাবে না কি? ও তো এতদিনে একটা কাজের লোক রেখেই দিয়েছে, তাই না বাবা?”
সাথে দাঁত মেলে হাসলেন ভদ্রলোক। এপাশে নিজের দাঁত চেপে ধরল পলাশ।
এই ব্যাটাই মেয়েটাকে নষ্ট বানানোর আসল কারিগর। মেয়েকে দিয়ে কাজ করানো যাবে না, নিজের বউকে কি আয়েশে রেখেছে? তাঁর হাতের রান্না খায় না?
ফের হেসে বলল,
“ হ্যাঁ হ্যাঁ তাইতো।”
“ তা বাবা,মিথিলা কি ওখানকার সিম নিয়েছে?”
পলাশের উত্তর তৈরি,
“ না। আসলে ও খুব তাড়াতাড়ি নতুন ফোন নেবে। তাই ভেবেছে যে একইসাথে সিম কিনবে আর কী। আর আপনারা এত ভাববেন না আঙ্কেল। মিথিলা এখানে ভালোই আছে।”
“ সেতো অবশ্যই। আসলে আমার ওই একটা মাত্র মেয়ে তো। মন মানে না বাবা। তারওপর প্রায় মাস পার হতে চলল ওর গলাও শুনিনি৷ চিন্তা তো হবেই বলো।”
পলাশ মুখ ভার করে বলল,
“ আসলে আঙ্কেল কী যে বলব,আপনারা ওকে এত দেখতে চান। কথা বলতে চান। ও কিন্তু আপনাদের কথা তেমন মনেও করে না। আমি তো মাঝেমাঝেই বলি যে আমার ফোন থেকে কল দিয়ে কথা বলো। বলে যে, না ইচ্ছে করছে না থাক। পরে বলব। আসলে আপনাদের খারাপ লাগবে বিধায় বলতে চাইনি.. তাও বললাম আর কী!”
খোরশেদুলের হাসিটা মুছে গেল। আর্ত চোখে স্ত্রীর পানে চাইলেন। সালমা মৃদূ হেসে বললেন,
“ ও আসলে ছেলেমানুষ তো। সবে একটা নতুন দেশে গেল। একটু ঘোরাফেরা শেষ হলেই ঠিক বাবা-মায়ের খোঁজ নেবে দেখো। আচ্ছা বাবা,রাখি আজ। একটু খেয়াল রেখ ওর কেমন? ভালো থেকো।”
“ জি নিশ্চয়ই! আসসালামু আলাইকুম।”
লাইন কেটে ঠোঁট ফুলিয়ে শ্বাস ফেলল পলাশ। কত্তগুলো মিথ্যে বলল এই দশমিনিটে উফ! বিরক্তিকর।
এপাশে বসে খোরশেদুল নিলেন নিশ্চিন্তের শ্বাস। মেয়েটা একটু ছটফটে। রঙচঙে দেশ দেখেছে তাই বিভোর হয়ে আছে। সময় হলে ঠিকই খোঁজ করবে বাবার। ঠিকই বলেছে সালমা।
তিনি হাসি হাসি চেহারায় স্ত্রীর দিক দেখলেন। বললেন,
“ আর যাই বলো জামাইটা কিন্তু লাখে একটা পেয়েছি তাই না? কত বিনয়ী,সভ্য দেখলে? মেয়ের অনেক খেয়াল রাখে বোঝাই যায়।”
সালাম বেগম মাথা নাড়লেন শুধু। ভেতর ভেতর চিন্তায় ভুগছেন তিনি। কেন যেন মনে হচ্ছে মধ্যে কোনো গোলমাল আছে। এই এতদিনে যতবার কল দিয়েছেন,পলাশ কিছু না কিছু বলে মেয়েটার সাথে কথা বলতে দেয়নি৷ ঘুমাচ্ছে,গোসল করছে, বাইরে গিয়েছে এসবই থাকে শিরোনাম। আচ্ছা, এগুলো কি সত্যিই ঘটে,না কি সব বাহানা ?
মায়ের মনটা দুশ্চিন্তায় কামড়ে ধরল। মুখখানা তেমন ডুবে গেল তিমিরে। তাও তো মিথিলার খোঁজ জানেন। কেমন আছে,শুনতে পারেন। কিন্তু অন্য মেয়েটা! না জানি কোথায় আছে! কেমন আছে! কী দশায় আছে এখন!
ওর সাথে কি আর কোনও দিন দেখা হবে না?
চলবে…