সে আমার সন্ধ্যাপ্রদীপ ৩১
কলমে: নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
(৩১)
খুশির দিনগুলো বড্ড তাড়াতাড়ি পার হয় মানুষের। তেমনই দুঃখের দিন কাটে কচ্ছপের গতিতে। ঘড়ির কাঁটা ঘোরে। পালটায় পৃথিবীর রঙ।
ঠিক যেমন, এক কিশোরের স্ফূর্ত মন বদলে বেদনা বিধুর হলো! রাহাতের আজকাল কিছু ভালো লাগে না।
ভিডিও গেমসে মন নেই। পড়তে ইচ্ছে করে না একটুও। উঠতে-বসতে ছেলেটার শুধু ছোটাপুকে মনে পড়ে। আর ততবার কান্না উগলে আসে গলায়। বাবার প্রতি,দাদুর প্রতি ক্ষুদ্র মনটা ফুঁসে ওঠে রাগে।
রাহাত ছোটোখাটো একটা এ্যালবাম নিয়ে পা ভাঁজ করে বিছানায় বসল। একের পর এক পাতা উলটে দেখতে থাকল তারপর। প্রথম দিকে সব মিথিলার ছোটো বেলার ছবি। অমনি সে হাতের গতি বাড়ায়।
যখন ঠিক পুষ্পিতার ছবিগুলো সামনে এলো? বেগ থামায় রাহাত। কাগজের সারা গায়ে নিবিড় হাত বোলায়। চোখের জল এ্যালবামের চটচটে কাগজে চুইয়ে পড়ে ক-ফোঁটা।
পেছনের সব কথা মনে করে কপোল ভিজে যায়। পুষ্পিতার কোলে নেয়া,খাওয়ানো, গোসল করিয়ে দেয়া থেকে জুতো পরিয়ার দেয়ার দৃশ্যতে বুকটা হুহু করে কাঁদে।
চট করে এ্যালবাম নামিয়ে রাখল রাহাত। হাঁটুতে মুখ গুজে থম ধরে রইল কিছুক্ষণ। মা এখন আর আপুর জন্যে কাঁদে না। কেমন যেন শক্ত হয়ে থাকে। আপুর কথা তুললেও বলে,
“ চলে গিয়ে বেঁচে গেছে। নাহলে তোর বাবা তো জ্বালয়ে মারত। শুধু যেখানেই থাকুক ভালো থাকুক, তাই চাই। একটা খবর যদি পেতাম!”
কিন্তু রাহাত শুধু খবর নয়, আস্ত আপুটাকেই ফেরত চায়। আগের মতো ওকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাতে চায়। আপুর হাতে খেতে চায়। নাহলে ওর কিচ্ছু ভালো লাগে না।
রাহাত বিছানা ছেড়ে উঠে এলো বসার ঘরে। কাহিল ছোট্টো মনটা ঠিক করতে, অনীহায় টেলিভিশন ছাড়তে চাইল। সুইচ টিপতে যাবে,আচমকা বারান্দার ওপাশ হতে হর্নের শব্দ ছুটে আসে। এক – দুটো নয়,পটাপট কতগুলো। যেন কেউ ইচ্ছে করে এক নাগাড়ে হর্ন বাজিয়ে যাচ্ছে।
প্রথমে গায়ে মাখেনি ছেলেটা। ভেবেছিল, হয়ত অনেক গাড়ি যাচ্ছে।
সোফায় বসতে যাবে, সতর্ক হলো হঠাৎ। হর্ন তো এখনও বাজছে। রাহাতের ক্ষুদ্র মাথার বুদ্ধিটা সজাগ হয়ে ওঠে। তুরন্ত এক দৌড়ে বারান্দায় এসে উঁকি দিলো নিচে।
পিলে চমকে উঠল অমনি। রাস্তার ওই পাড়ে জিপের ভেতর বসে আছে তীব্র। ঠিক সেই আগেরবারের মতোন।
এই সময় অপ্রত্যাশিত অথচ কাঙ্খিত মানুষটিকে দেখে রাহাতের বিরস নয়ন চকচক করে উঠল। কাউকে কিছু না জানিয়ে, দমকা হাওয়ার ন্যায় এক ছুটে চলে গেল বাইরে। মা মেশিনে কাজ করছেন,বাবা অফিসে। ওকে আটকাবে কে!
মামুন শাহ অফিস থেকে ফিরেছেন মাত্র। গাড়িটা নিয়ে বাড়ির কাছাকাছি আসতেই, চোখ দুটো মারবেল হয়ে গেল। সামনের চিরচেনা লাল জিপ দেখেই, পিঠ বেয়ে জলের ধারা নামে।
চাপা কণ্ঠে আর্তনাদ করলেন অমনি,
“ থামো থামো।”
তড়িৎ ব্রেক কষলেন ড্রাইভার। পিছু ফিরে শুধোলেন,
“ কিছু হয়েছে স্যার?”
মামুন সেই উত্তর দিলেন না। প্রকট চক্ষু তখনও জিপের ওপর আটকে। ফটাফট কটা ঢোক গিলে বললেন,
“ গাড়ি আর সামনে এগিও না। পেছনে নিয়ে যাও।”
“ কিন্তু স্যার হঠাৎ কী হলো?”
“ আহ হা, যা বলছি করো তো।”
ভদ্রলোক আর কথা বাড়ালেন না। চুপচাপ মালিকের হুকুম তামিল করলেন। কিন্তু গাট হয়ে বসে রইলেন মামুন। টের পাচ্ছেন ভেতরটায় ফ্যাসফ্যাসে শ্বাস উঠেছে। ভয়ে ঘাম ছুটেছে গায়ে।
এই বিট্টু মাস্তান আবার এখানে কেন? আপদটা না কি ঢাকা ছেড়ে চলে গেছিল? এই আনন্দে তো, আলহামদুলিল্লাহ আলহামদুলিল্লাহ হিড়িক পড়েছিল পারাময়। আবার এখানে কী চায়?
ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ চোখ বড়ো করলেন মামুন। সচকিত চিত্তে মনে হলো,
“ মাস্তানটা নিশ্চয়ই সব যাচাই করতে এসেছে। গতবার যা যা হুকুম দিয়ে গেছিল সেসব ঠিকঠাক চলছে কী না দেখতে!”
এইরে, ওসব যে কিছুই করা হয়নি। কীভাবে করবে? পুষ্পিতা মেয়েটাই তো ফেরেনি বাড়িতে। মামুন দিশেহারা হয়ে পড়লেন। এখন লুকিয়ে কোনো লাভ নেই। বিট্টু মাস্তান যখন বাড়ির সামনে হানা দিয়েছে,তাকে না পাওয়া অবধি গেট ছেড়ে সরবে না।
ভদ্রলোক দাঁত পিষে বিড়বিড় করলেন,
“ হায়রে ডলি, তোমার কুচুটে স্বভাবের জন্য আমাকে বিপদে পড়তে হলো মহিলা!”
দ্বিগবিদিক খুইয়ে গাড়ি থেকে নেমে এলেন মামুন। পায়ের জোরে এগিয়ে চললেন সামনে। ব্যাপারটায় ড্রাইভার বোকা বনে গেলেন।
স্যার বাড়ির দিকে গেলে,গাড়ি পিছিয়ে নেয়া হলো কেন?
তীব্র সিগারেট টানছিল। মাঝেমধ্যে ডান হাতে চাপ দিয়ে হর্ন বাজাচ্ছিল জিপের। কখনও বিলাই নয়ন জোড়া তাক হচ্ছিল তিন তলার বারান্দায়। এর মাঝে নম্র পায়ে এসে দাঁড়ালেন মামুন। বিনয় সমেত বললেন,
“ আসসালামু আলাইকুম বিট্টু ভাই,কেমন আছেন? কতদিন পর আপনাকে দেখলাম এখানে।”
তীব্র চোখের দৃষ্টি সূচাল। স্যুটকোট পরা মামুনের দিকে গাঢ় চাউনী বোলায় একবার। সামনে ফিরে ধোঁয়া ছেড়ে বলল,
“ নাটক কম কর। মনে মনে বাপ তুলে গালি দিয়ে,সালামের ঢং করিস না।”
মামুনের চোখ বেরিয়ে এলো প্রায়। পুরোদস্তুর হকচকিয়ে গেলেন। সত্যিই তো, এই পর্যন্ত হেঁটে আসতে আসতে ছেলেটাকে খুব গালাগাল করেছেন তিনি। কিন্তু মাস্তানটা এসব বুঝল কী করে?
জ্বিভে ঠোঁট ভেজালেন ভদ্রলোক। অপ্রস্তুত ভাবটা ঢাকার চেষ্টা করে বললেন,
“ না না ভাই। কী যে বলেন! আমার ঘাড়ে কটা মাথা যে আমি আপনাকে গালি দেব। ছি! ছি!”
তীব্র বসেছিল সিটে। দরজাটা খুলে লাফিয়ে আসার মতো ঝট করে নেমে দাঁড়াল হঠাৎ। অমনি ভয়ে বুকটা ছ্যাৎ করে লাফিয়ে উঠল মামুনের। ত্রস্ত পিছিয়ে গেলেন দু কদম। ব্যাপারটায় মজা পেলো তীব্র। এক দিকে ঠোঁট নিয়ে হাসল। আড়মোড়া ভাঙার জন্য হাত তুলতে গেলেই, ভয়ে গুটিয়ে গেলেন তিনি। তীব্র মারবে ভেবে,আতঙ্কে হড়বড় করে উঠলেন,
“ ভাই, ভাই রাগ করবেন না। আসলে ব্যাপারটা আমি আপনাকে বুঝিয়ে বলছি। আপনি যা বলে গেছিলেন সবই করতাম। কিন্তু মেয়েটা তো এখনও ফেরেনি ভাই। কোনো খোঁজই পাওয়া যায়নি। আপনি বললে একটা ফ্ল্যাটে ফ্রিতে থাকা কেন,আমি ওকে এমনিই লিখে দেব।”
তীব্রর নিটোল ঠোঁটে কৌতুকের হাসি চাপা পড়ল। চেয়ে রইল চোখা নেত্রে। মামুন আরো ঘাবড়ে গিয়ে বললেন
“ তবে আপনি ভাববেন না,আমি আজই গিয়ে বলব যে এখন থেকে ওদের আর ভাড়া দিতে হবে না। তাহলে হবে তো ভাই?”
তীব্রর হঠাৎ খেয়াল পড়ল গেটের দিকে। মামুনের পেছন থেকে দৌড়ে আসছে রাহাত। প্রসঙ্গ কাটাতে বলল,
“ তোর সাথে আমি পরে বুঝে নিচ্ছি। এখন যা।”
মামুনের ত্রাস বাড়ল। পরে আবার কী বোঝাপড়া করবে শয়তানটা? বলতে গেলেন,
“ ভাই আমা..”
তীব্র হাত উঁচায়। চোখের ইশারায় সরতে বলে সামনে থেকে। মামুন নিরুপায় ভঙ্গিতে চুপচাপ প্রস্থান নিতে ঘুরলেন। রাহাতকে দেখে
চোখ-মুখ কুঁচকে নিলেন মুহুর্তে। এই মোটকা টাকে দেখলেই রাগ লাগে! এটার জন্যেই সেদিন অত বেইজ্জতি হলো ওনার। সারা পাড়ার লোক দেখল বিট্টু মাস্তান কীভাবে বুকের ওপর লাথি মেরে ফেলে দিয়েছিল তাকে! আর হাকিম, কত বছরের বিশ্বস্ত দারোয়ান তার! সেই যে মাথা ন্যাড়া হলো, লজ্জায় আর এলাকামুখো হয়নি।
এটাকে মাথায় তুলে একটা আছাড় মারতে পারলে, বেশ আরাম পেতেন মনে।
এক রাশ ক্ষোভ মনে চেপে চুপচাপ পাশ কাটালেন মামুন। অমনি ঝড়ের বেগে এসেই দুটো হাত তীব্রর কোমর জাপটে ধরল।
দুগালে হাসির তুফান নিয়ে বলল,
“ বিট্টু ভাইয়া,আপনি এসেছেন?”
তীব্র হাসল। এই যে রাহাত জড়িয়ে ধরল ওকে? বক্ষঃস্থলে অদ্ভুতুরে শান্তি লাগছে এবার। আলগোছের হাসিটা ঢেকে রাহাতের গোছানো চুল হাত বাড়িয়ে এলোমেলো করে দেয় তীব্র। জিজ্ঞেস করে নম্র স্বরে,
“ কেমন আছো?”
রাহাত সরে আসে। নিজের কথা ভুলে, অস্থির চিত্তে শুধায়,
“ আপনি এত দিন কোথায় ছিলেন? আমি আপনাকে কত খুঁজেছি জানেন? কিন্তু কেউ বলেনি আমাকে!”
তীব্র কিছু বলল না। চুপচাপ জিপের ভেতর থেকে দুটো বড়ো বড়ো চকলেটের বক্স তুলে আনল হাতে৷ সামনে বাড়িয়ে বলল,
“ এগুলো তোমার।”
রাহাতের নজর চকলেটে নেই। কিশোরের চোখেমুখে উৎকণ্ঠা। অমন করেই বলল,
“ আমার ছোটপুকে খুঁজে দেবেন বলেছিলেন। কিন্তু তারপর তো আর কিছু বললেন না। ওকে কি পান নি?”
পুষ্পিতার প্রতি রাহাতের ভালোবাসা মন ছোঁয় তীব্রর। ভিতু মেয়ে ওর ভালোবাসা! ভালোবাসাকে যারা ভালোবাসে,তাদের ভালো লাগবে না? মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“ পেয়েছি।”
রাহাত চমকে ওঠে। ধড়ফড়িয়ে বলে,
“ কোথায় আমার আপু? আমি আপুর কাছে যাব।”
“ যাবে। সময় হলে ঠিক দেখা করিয়ে দেব।”
রাহাতের সদ্য ফোটা উৎফুল্ল ভাব নিভে অমনি গেল। মন খারাপ করে বলল,
“ আর এখন? এখন করাবেন না?”
“ না। এখন সে পড়াশোনায় ব্যস্ত!
তোমাকে দেখলে পড়বে না। রেজাল্ট খারাপ হবে। তুমি তাই চাও?”
ও মাথা নাড়ল দুপাশে। তীব্র গাল টেনে বলে,
“ ভেরি গুড বয়! আমি এখন আসি। ঢাকা এলে আবার দেখা হবে।”
লম্বা পা বাড়িয়ে জিপে উঠে বসল সে। হুইল ঘোরাতে গিয়েও ফিরে চাইল আবার। একটু ভেবে বলল,
“ তুমি একদিন বলেছিলে না রাহাত? তোমার ছোটাপুর পাশে আমাকে মানাবে?”
সবেগে মাথা দোলায় ছেলেটা।
“ হ্যাঁ।”
“ তোমার বলা সেই কথা সত্যি করব,ভাবছি৷ মাস্তান হিসেবে আমি দারুণ ছিলাম। এ বার পাড়ার লোক দেখবে, বিট্টু রাহাতের দুলাভাই হিসেবেও দারুণ।”
বলতে বলতে একপেশে হাসল তীব্র৷ রাহাতের কাছে এই হাসিটা দুনিয়ার সবচেয়ে বড়ো রহস্য মনে হলো। বেচারা কিছুই না বুঝতে পেরে চেয়ে রইল বোকা বোকা চোখে। তীব্রর জিপ ছুটে হাওয়া হতেই, দেয়ালের এপাশ থেকে কান সরালেন মামুন।
দুশ্চিন্তায় কপালে গাঢ় ভাঁজ বসল। মাথা নেড়ে বললেন,
“ দুলাভাই হবে? ব্যাপারটা তো ভালো ঠেকছে না।”
*****
রাত নিশুতি হতেই পুষ্পিতার ছটফটানি বাড়ল। বোকা মেয়েটাও আজ হাড়েহাড়ে বুঝে ফেলল, তীব্রর প্রেমে পড়তে বাকী নেই।
এই নিয়ে অস্বস্তির সাথে সাথে ভীষণ রকম লজ্জায় পড়েছে পুষ্পিতা। সারাজীবন শিক্ষক কে মান্যিগণ্যি করে,বাবার মতো সম্মান দিয়ে শেষে কী না সেই স্যারের প্রেমেই ডুবল? ছি! ছি! ছি! কত জ্ঞান দিয়েছে তনুজাকে। আর এখন নিজেই?
পুষ্পিতা মাছ কেটে রুমে এসেছে অনেকক্ষণ। আর সেই থেকে পায়চারি করছে। ফ্লোরে তার অশান্ত পায়ের আওয়াজ ভেসে বেড়াচ্ছে বাতাসে। স্যার নেই বলে ঘর ফাঁকা লাগা, বারবার ওনার কথা ভেবে আনমনা হওয়া,যখন তখন কাঁপুনি ওঠা বুকে,ওনাকে দেখলেই লজ্জায় কাঁটা দেয়া শরীরে এসব তো প্রেমেরই লক্ষ্মণ। কত সিনেমাতেই না দেখেছিল!
নূহাই তবে ঠিক?
কিন্তু এতো বড়ো একটা ভুল কী করে করলাম আমি? তনুজা স্যারকে এতো পছন্দ করে জেনেও স্যারের প্রেমে পড়লাম? ইস,ও জানলে কত কষ্ট পাবে!
পুষ্পিতা আহত ভঙ্গিতে ধপ করে বিছানায় বসে পড়ে। মনের কাছে মানুষ এতো অসহায় কেন? এই যে চাইলেই নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। চাইলেই তাকে ধরে আটকানো যায় না,অন্যের প্রতি বুঁদ হওয়া থেকে! এতো অবাধ্য কেন ও?
উদাসীন পুষ্পিতার হঠাৎ চোখ পড়ল হাতের আঙুলের ওপর। মাছ কাটার সময় মধ্যমণির ডগাটা আড়াআড়ি ভাবে অনেকখানি কেটেছে। কাটবে নাই বা কেন? কোন বেখেয়ালে,কার খেয়ালে কাটতে বসেছিল দেখতে হবে তো!
পুষ্পিতা মন খারাপ করে কাটা জায়গায় হাত বোলাল। অথচ একটু ব্যথা,একটু জ্বালাপোড়া টের পাচ্ছে না। কীভাবে পাবে? ব্যথার আঁচ পেতেও তো অনুভূতি থাকা চাই। সেটাই যে নেই। সব অনুভূতি এক ভদ্রলোকের কাছে গিয়ে ঘাঁটি গেড়ে বসেছে। পুষ্পিতা হতাশ ভঙ্গিতে বিছানায় শুয়ে পড়ল। ঘনঘন মাথা নাড়ল ক-বার।
এই সত্যি সে কাউকে জানতে দেবে না। নূহাকেও না। স্যারের প্রেমে পড়েছে এসব শুনলে পুরো পৃথিবী ওকে নিয়ে হাসবে।
পুষ্পিতা স্বীয় সত্তার প্রতি বীতঃস্পৃহায় ভ্রু কুঁচকে থাকে। তক্ষুণি ঘরের বাইরে থেকে কারো গলার শব্দ পাওয়া গেল। তড়াক করে উঠে বসল মেয়েটা।
নূহা মায়ের ঘরে, পড়ছিল তখন। পরীক্ষা শুরু হতে হাতে গোণা কিছু দিন বাকী।
পুষ্পিতা ওই ছুটে আসা কণ্ঠস্বর মন দিয়ে শুনলো। এই আওয়াজ তার খুব চেনা৷ কেন, কী কারণে, না কি সদ্য প্রেমে পড়েছে বলে মেয়েটা জানে না,অথচ হাওয়ার গতিতে সে ছুটে এলো দরজায়। কাঠের মাঝে যে ছোট্ট গোল গ্লাসটা বসানো? যেখানে উঁকি দিলে বাইরে দেখা যায়? সেখানে চোখ পাতল পুষ্পিতা। নাহিদ দরজা খুলেছে। চোখেমুখে মুরুব্বিয়ানা নিয়ে বলছে,
“ এতো রাত অবধি কোথায় ছিলি বলতো? ফোনও ধরলি না। চিন্তা হয়ত না কি!’’
তীব্র পায়ের জুতো খুলতে খুলতে জানাল,
“ ফোন সাইলেন্ট ছিল। ঢাকা গিয়েছিলাম।”
“ হঠাৎ ঢাকা কেন? আমাকে তো একবার বললিও না। এতো পর ভাবিস তাই না?”
নাহিদের কথায় অভিমান।
তীব্র ভ্রু কুঁচকে বলল,
“ মেয়েদের মতো করিস না তো…”
আরো কিছু বলতে বলতে ঘরের ভেতরে ঢুকল সে। পুষ্পিতা সেসব কিচ্ছু শুনতে পায়নি। তবে টের পেলো ঝটকা ভরা সমীরণে মন-প্রাণ জুড়িয়ে এসেছে প্রায়।
এই যে সারাদিন পর মানুষটাকে দেখল? কী শান্তি লাগছে এখন! শুভ্রকায় গাল দুটো ফুলিয়ে মুচকি হাসল সে।
নূহা অনেকক্ষণ যাবত দাঁড়িয়ে আছে পেছনে। বক্ষপটে হাত গুঁজে রাখা তরুণীর ওষ্ঠপুটে মিটিমিটি হাসি। পুষ্পিতা যেই মাত্র পেছন ফিরল,চমকে উঠল অমনি।
চোখ দুটো প্রকট করে বলল,
“ তুই? এ এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?”
নূহার হাসি বাড়ল। ভ্রু নাঁচিয়ে বলল,
“ দেখা শেষ?”
মেয়েটা ভেতর ভেতর থতমত খায়। চোটপাট বজায় রাখতে
আমতা আমতা করল,
“ দেখা,কীসের দেখা? আমি তো কাউকে দেখছিলাম না।”
“ ঢং করিস না। তুই যে এতক্ষণ তীব্র স্যারকে দেখছিলি আমি জানি।”
পুষ্পিতা খুব বেশি মিথ্যে বলতে পারে না। তীব্র যেভাবে গুছিয়ে স্পষ্ট ভাবে বলে? অমন তো একেবারেই নয়। তারওপর নূহা ভীষণ চতুর। এক চুটকিতে ধরে ফ্যালে সব। তাই বাঁচার উপায় নেই দেখে,মাথা নুইয়ে নিলো। নূহা চপল পায়ে কাছে এগিয়ে আসে। কণ্ঠ মোটা করে বলে,
“ আমার দিকে তাকা তো।”
পুষ্পিতা চোর চোর মুখ করে চাইল।
ও বলল,
“ এবার সত্যি করে বল,তুই স্যারের প্রেমে পড়িসনি?”
পুষ্পিতা অসহায়ের ন্যায় মাথা নাড়ল। উপচে পড়া মনঃকষ্ট নিয়ে বলল,
“ বিশ্বাস কর, আমি একদম চাইনি এমন করতে। কিন্তু কীভাবে যে অঘটনটা ঘটে গেল। মনে হয় স্যারের এতো কাছাকাছি থাকা আমার উচিত হয়নি। দিনের পর দিন ওনার সাথে যাতায়াত করা,ওনার একেকটা কাজ,কথায় মুগ্ধ হয়েই হয়ত এসব হয়ে গেছে। আমার যে কী লজ্জা লাগছে এখন!”
বন্ধুর দুঃখ দেখেও নূহার মায়া হলো না। বরং পুষ্পিতা স্যারের প্রেমে পড়েছে শুনেই ভেতর ভেতর লাফিয়ে উঠল আনন্দে। মুখবিবরের রাগটুকু ধরে রাখল তাও। শক্ত কণ্ঠে বলল,
“ প্রেমে পড়েছিস,কেন কীজন্য এসব তো আমাকে বলে লাভ নেই পুষ্পিতা। তোর এই কাজে আমি ভীষণ কষ্ট পেয়েছি।”
পুষ্পিতা উদ্বীগ্ন চোখে চাইল।
“ কষ্ট পেয়েছিস? আমি আবার কী করলাম?”
নূহা চোখে-মুখে রাগ এনে বলল,
“ কী করলাম আবার জিজ্ঞেস করছিস? তুই তোর স্যারের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিস, অথচ আমাকে জানতে হলো এভাবে ফোর্স করে! এই আমি তোর বেস্টফ্রেন্ড? এই বন্ধুত্ব নিয়ে আমি আবার বড়াই করি? ছি! ছি!”
পুষ্পিতা হাঁসফাঁস করে বলল,
“ তুই বিশ্বাস কর, আমি লজ্জায় বলিনি।”
“ আমি কিছু শুনতে চাই না, বলতাম তো। কষ্ট পেয়েছি, রাগ করেছি ব্যস!”
পুষ্পিতা নূহার কাঁধে হাত রাখল। সাথে সাথে ঝটকা মেরে ফেলেও দিলো নূহা। মেয়েটার মুখ কালো হলো নিমিষে। কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলল,
“ আচ্ছা ঠিক আছে। আমি সরি! কী করলে তোর রাগ ভাঙবে বল। যা বলবি তাই করব!”
নূহা চোখ সরু করে বলল,
“ যা বলব, তাই করবি তো?”
পুষ্পিতা এক কথায় মাথা নাড়ল। তুরন্ত, রুমের দিকে ছুটে গেল মেয়েটা। ও ফোস করে শ্বাস ফেলতে না ফেলতেই হাজির হলো আবার। ডায়েরি -কলম বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
“ ধর এগুলো।”
ও কিছু বুঝল না। চেয়ে রইল প্রশ্ন নিয়ে। নূহা তাগিদ দেয়,
“ আহ হা, ধরবি তো।”
পুষ্পিতা হাতে নিতেই,তৎপর টেবিলের বুক থেকে চেয়ার টেনে দিলো নূহা। বলল,
“ বোস।”
পুষ্পিতার মাথা ভরতি প্রশ্ন। তালুর ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছে সব।
“ কী করতে চাইছিস বল তো?”
নূহা উত্তর দিলো না। তবে চট করে পাশের চেয়ারটা টেনে বসল। বড়ো আয়োজন নিয়ে বলল,
“ এবার আমি যা যা বলব লিখবি।”
পুষ্পিতা চোখ-নাক কোঁচকায়। সামান্য ব্যাপার। আর সে কী না কী ভেবেছিল!
সাদা দাগ টানা পাতায় কলম ছোঁয়াতেই
নূহা গড়গড় করে বলল,
“ আমি পুষ্পিতা,
দেখতে সুন্দরী হলেও কখনও কোনো প্রেমে জড়াইনি। স্কুলে-কলেজে প্রতিদিন কয়েক খানেক ছেলের প্রেমের প্রস্তাব নিয়ে বাড়ি ফিরতাম। কিন্তু কোনও দিন ফিরেও দেখিনি কারোর দিকে। কারণ সেসময় আমি বড্ড নিরামিষ ছিলাম। আর সেই নিরামিষ আমার মধ্যে আমিষ এনে দিয়েছেন আমাদের পাশের ফ্ল্যাটের তীব্র স্যার। বলতে কোনো লজ্জা নেই,আমি স্যারের প্রেমে পড়েছি। এখন দিন গুণছি ওনাকে কবে বিয়ে করব।
ইতি পুষ্পিতা”
নূহা থামল। দীর্ঘ বকবকের শেষে একটা লম্বা দম নিলেও,হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইল পুষ্পিতা। দুটো পীবর রাঙা ঠোঁট নদীর দুই প্রান্তে বসে।
অমন হাঁ করে বলল,
“ এসব কেন লিখব?”
নূহা ভ্রু কোঁচকায়,
“ কেন লিখব মানে? আমি বলেছি তাই।”
“ তুই কি চাইছিস বলতো? এমনিতেই আমি এই ব্যাপারটা নিয়ে লজ্জায় মুখ লোকাতে পারছি না। আর তুই মজা নিচ্ছিস তাই না?”
নূহা নিষ্প্রভ বলল,
“ আম্মুর খাটের তলায় একটা বড়ো ট্রাংক আছে। দাদুর আমোলের। ওটা খুলে ঢুকে পড়। মুখ কেন,আস্ত তুই সুদ্ধ এঁটে যাবে।”
পুষ্পিতা মুখ গোঁজ করে বলল,
“ ইয়ার্কি মারছিস তো? মার। যেদিন নিজেও এই বিপদে পড়বি তখন আমিও ঠিক এই ভাবেই মজা নেব।”
নূহা শব্দ করে হাসল। যেন হাওয়ায় উড়িয়ে দিলো তার প্রেমের পড়ার আশঙ্কা।
পরপরই মোটা কণ্ঠে বলল,
“ এতো কথা বলে লাভ নেই৷ আমার কষ্ট কমাতে চাইলে এসব তোকে লিখতেই হবে।”
পুষ্পিতা নিরুত্তর। সাথে গাট দেহে বসে। ও অভিমানের ভং ধরে বলল,
“ আচ্ছা বেশ। কিচ্ছু করতে হবে না। আমি কষ্ট পেলে কার কী!”
নূহা উঠতে নিলেই হার মানল মেয়েটা।
“ আচ্ছা বাবা লিখছি।”
নূহা হাসল না। হাসলেই তো পুষ্পিতা সব হালকা ভাবে নেবে। গম্ভীর মুখে বসল আবার।
বিফল শ্বাস ফেলল পুষ্পিতা। আজকাল সবাই ওকে কাগজে এটা-ওটা লিখতে বলছে। ওইদিন কলেজেও হেনা মেয়েটা বলেছিল, আজ নূহারও একই আবদার। কলেজের সেই গল্প নূহাটার সাথে বলাই উচিত হয়নি। নির্ঘাত ওখান থেকেই ধার নেয়া বুদ্ধি এসব!
পুষ্পিতা অনীহ চিত্তে পৃষ্ঠায় প্রথম দাগ টানল। তবে হুট করে চোখে ভাসল, তীব্রর মুখ। কেমন র্যাগিংয়ের যাতাকল থেকে দূতের ন্যায় এসে বাঁচিয়ে নিলো ওকে! চড়া কণ্ঠে হুশিয়ার করল,
“ এই মেয়ের ধারেকাছেও যেন না দেখি কাউকে! ”
সেই সুরম্য অতীত ভেবে ঠোঁটে হাসি ফোটে মেয়েটার। অস্তমিত নিভু নিভু সূর্যের ন্যায় ফেঁপে আসে কপোল। মাথা নামিয়ে মনের কথাই উগলে দিলো হাতে। লিখল গোটা গোটা অক্ষরে,
“ আমি তীব্র স্যারের প্রেমে পড়েছি!”
নূহা বলল,
“ এতটুকু লিখলি কেন? আচ্ছা ঠিক আছে থাক। এতেই হবে।
নিচে তোর নাম লিখে দে।”
পুষ্পিতা আর গাইগুই করল না৷ বাধ্যের মতো ব্রাকেটে নাম লিখল নিজের। সহসা যুদ্ধে জেতার ন্যায় শ্বাস টানল নূহা। ও তাকাতেই মুখখানা ফের গম্ভীর করে বলল,
“ এখন যা। পড়তে বোস।”
পুষ্পিতা খাতার পৃষ্ঠায় টান বসাতে গেলেই ধড়ফড় করে টেনে নিলো সে। মহাভারত অশুদ্ধ হওয়ার মতোন চোখ রাঙিয়ে বলল,
“ ছিড়ছিস কেন?”
পুষ্পিতা অবাক হয়ে বলল,
“ ওমা,লিখে তো দিলাম। এখন এটা দিয়ে আর কী কাজ?”
“ সেসব আমি বুঝব। এই লেখা আমার কাছে গচ্ছিত থাকবে। এরপর থেকে যখনই তুই আমার থেকে কিছু লুকাতে আসবি, এই লেখা গিয়ে সোজা আম্মুকে দেখিয়ে আসব আমি।”
হুমকিতে হোচট খেল পুষ্পিতা। তড়াক করে দাঁড়িয়ে বলল,
“ এসব কী বলছিস?”
নূহার মাঝে উদ্বেগ নেই। পৃষ্ঠাটা খাতা থেকে নিজেই ছিড়ল। ভাঁজ করে গায়ে বাতাস করতে করতে বলল,
“ যা শুনেছেন তাই। আপনি আমার থেকে কিছু লুকোবেন না,আমিও কাউকে বলব না। কাটাকুটি!”
পুষ্পিতা ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,
“ এভাবে ব্লাকমেইল করা কিন্তু অনেক বড়ো অন্যায়।”
নূহা পালটা যুক্তি দিলো,
“ বেস্টফ্রেন্ডের থেকে কিছু লুকোনোও অন্যায়। তুই যাবি এখন? নাকি আজকেই আম্মুকে দেখাব?”
পুষ্পিতা ভেঙচি কাটল। চলে গেল ধুপধাপ পায়ে। অমনি ঠোঁট চেপে হাসল নূহা।
বোকা মেয়েটা নিজেও জানে না,না বুঝে ওর হাতে সে কী দিয়ে গেছে!
***
পলাশের থাপ্পড়টা কোনো সাধারণ থাপ্পড় ছিল না। রীতিমতো শ্যামলা মেয়েটা থুবড়ে পড়ল মেঝের বুকে। দুচোখ ভরতি অবিশ্বাস নিয়ে মুখ তুলল তারপর। পলাশ ফিরেও চায় না। তড়িঘড়ি করে জেনিকে তোলে। গোলাপের কাঁটায় তার পেলব হাত কেটে কলের ধারায় রক্ত ঝরছে। ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদছেও। অভিযোগ করল নাক টেনে,
“ ফালাশ,তোমার মেইড আমাকে কীভাবে ধাক্কা দিলো দেখলে?”
“ ও বুঝতে পারেনি জেনি। মাথা ঠিক নেই বলেছিলাম তো তোমাকে? আমি ওর হয়ে ক্ষমা চাইছি তোমার কাছে।”
জেনি মেনে নিলো। তবে
গোটা বিষয়টায় থমকে থাকল মিথিলা। মারের রেশ তার এখনও কাটেনি। আজ অবধি বাবাও কোনওদিন ওর গায়ে ফুলের টোকা দেননি। সেখানে পলাশ!
মেয়েটার মাথায় রক্ত চড়ল রাগে। ঘটনা ঘটবে,আর সে মেনে নিয়ে চুপ করে থাকবে? এতটা নম্রতা তার নেই।
ঝট করে উঠে দাঁড়াল মিথিলা। ফের তেড়ে এসেই জেনির থেকে ছাড়িয়ে আনল পলাশকে। ক্রোধে আগুন হয়ে বলল,
“ তুমি আমাকে মারলে? তোমার এত বড়ো সাহস?”
পলাশ পালটা চ্যাঁচিয়ে বলল,
“ হ্যাঁ মারলাম। বাড়াবাড়ির একটা সীমা আছে মিথিলা। তুমি জেনিকে ধাক্কা দিয়েছিলে কোন সাহসে?”
“ একটা বাইরের মেয়ে তোমার গায়ে লেপটে থাকবে। আর আমি তোমার স্ত্রী হয়ে সেটা দেখব?”
জেনি চটে গেল এবার। মিথিলার বাংলা কথা না বুঝলেও ওর চোখমুখের অবস্থা দেখে ঘটনা আন্দাজ করা খুব একটা কঠিন নয়। এই মেয়ে তো সব বিষয়ে অতিরিক্ত করছে!
ও এসেই তাদের দুজনের মাঝে দাঁড়াল। পিঠের আড়াল হলো পলাশের ঠাম দেহ।
মিথিলার মুখের সামনে আঙুল তুলে বলল,
“ মেটিলা, নিজের সীমায় থাকো তুমি। আমি কিছু বলছি না মানে,বলব না তা কিন্তু নয়। সব সময় দেখছি,আমাদের দুজনকে একসাথে দেখলেই কীসব বলে ঝগড়া করতে আসো। ফালাশ কিছু না বলে লাই দিচ্ছে তোমাকে। মেইড হয়ে মালিকের সাথে এমন আচরণ করছো? এতো স্পর্ধা তোমার?”
মিথিলা উত্তর দেবে কী! বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেল। জেনির কথায় চোখ বুজে চ সূচক শব্দ করল পলাশ। আড়চোখে এক পল দেখল স্ত্রীকে।
মিথিলা হতবাক হয়ে বলল,
“ কী বললে তুমি? আমি মেইড? আমি মেইড তোমাকে কে বলেছে?”
প্রশ্নটা জেনির ভাষায় করায়,বুঝল সে। উত্তর দিলো নিজের মতোন,
“ মেইড নাহলে তুমি কী? ফালাশ যে আমাকে বলল, ওকে সাহায্য করতে ওর বাড়ির লোকেরা তোমাকে ওর সাথে পাঠিয়েছে। কী ফালাশ ঠিক বলিনি আমি?”
চার জোড়া চাউনী তাক হতেই, পলাশ চোখ নামিয়ে দিলো। মুখায়বে তার বিস্তর চিন্তা। কিছুটা ধরা পড়ার ভয়ও সাথে। মিথিলা কণ্ঠ ভিজে এলো কথা বলতে গিয়ে,
“ আমি তোমার মেইড পলাশ?”
পলাশের একটু আগের উঁচু স্বরটাই,রাতারাতি নেমে এলো এবার। সাফাই দিতে চাইল,
“ মিথিলা আমি আসলে..”
মিথিলা কোনোকালেই বোকাসোকা ছিল না। এতেই যেন উত্তর পেয়ে গেল বাবার রাজকন্যা মেয়েটাকে বিয়ের পরে স্বামী পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে কাজের লোক বলে? অপমানে মুখটা নীল হয়ে এলো ওর। সদ্য ঢেউ তোলা কান্না গিলে জেনির দিকে চাইল আবার। প্রশ্ন করল সোজাসুজি,
“ আমি মেইড হলে,তুমি পলাশের কে হও?”
জেনির মধ্যে রাখ-ঢাক নেই। কাঁধ উঁচিয়ে বলল,
“ আমি ওর গার্লফ্রেন্ড!”
মাথায় যেন বাঁজ পড়ল মেয়েটার। পলাশের প্রতি হয়ত এক ফোঁটাও ভালোবাসা নেই। টাকার জন্যেই তো বিয়ে করা! কিন্তু শত হোক,স্বামী তো। শক্ত পদযূগল টলে ওঠে মিথিলার। পিছিয়ে যায় এক পা। চোখ ফেটে জল ছুটে আসে। কোনো দিক না দেখে দৌড়ে চলে যায় ভেতরে।
***
সুগভীর রাত। ভ্যাপসা গরম ফুরিয়ে যাচ্ছে আচমকা ঠান্ডা বাতাস আসায়। শীতেল বাতায়ণে দাঁড়িয়ে, ফোনের ওয়ালপেপারে একবার চোখ বোলাল নাহিদ। এই ঘোর অন্ধকার রাতে ছাদের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে ও। একটা ছোট্ট টিউব লাইট চিলেকোঠার পায়া ছুঁয়ে ঝুলছে। সেই আলোর তীর্যক অন্ধকারটা গিয়ে লুটিয়ে পড়ছে
সিঁড়িতে। কেউ এলে-গেলে শুধু দেহের ছাঁয়া বোঝা যাবে। মুখ দেখার উপায় সংকীর্ণ। নাহিদের চোখ সেই অন্ধকারেই আটকে। আচমকা নজর পড়ল কেউ একটা এগিয়ে আসছে এদিকে। দেয়ালে যে ছাঁয়া বসেছে? জোরালো বাতাসে চুল উড়ছে তার। হুঙ্কারের ন্যায় হুম্ম হুম্ম শব্দ করছে মুখে। নাহিদের চোখ কপালে ঠেকল অমনি। এটা কী ভূত না কি? রাতের বেলায় ছাদে এসব থাকে শুনেছিল। সত্যিই সেসব না তো? কপাল কুঁচকে একবার চারপাশে তাকাল সে। হঠাৎ কী ভেবে ফিরে চাইল আবার। দেখল বড়ো স্পষ্ট চোখে। অবয়ব এগিয়ে আসছে। আর কয়েক কদমেই অমানিশা ফেলে আলোয় আসার পালা! এর আগেই শব্দ করে হেসে উঠল নাহিদ। হাসতে হাসতেই বলল,
“ মিস নূহা, ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। আমি ভূতে ভয় পাই না।”
মেয়েটা থতমত খায়। চুল গুলো ঠিকঠাক করে ত্রস্ত। শিশুসুলভ মুখটায় গাম্ভীর্য টেনে এসে দাঁড়ায় আলোতে।
নাহিদকে হাসতে দেখে লজ্জা পেলো নূহা। মিনমিন করে বলল,
“ মজা করছিলাম। আপনি বোকা হলেও সাহসী তা তো জানতাম না।”
ওর মিইয়ে যাওয়া দেখে, হাসিটা টেনেটুনে কমাল নাহিদ।
স্বাভাবিক হয়ে বলল,
“ আচ্ছা বেশ। ওসব ছাড়ুন। ডেকেছেন কেন?”
“ ও হ্যাঁ।”
বাম হাতটা চট করে সামনে আনল নূহা। ভাঁজ করা কাগজ মুখের সামনে তুলেতেই,আকাশ হতে ছিটকে পড়ল নাহিদ। বিকট চোখে আর্তনাদ করল,
“ আপনি আমাকে প্রেমপত্র দিচ্ছেন?”
মেয়েটা ভ্যাবাচেকা খায়। চোখের পাতা ঝাপটে বলে,
“ মানে?”
“ মানে আবার কী? এই রাতের বেলা ফোন করে ছাদে এনে চিঠি দেয়ার মানে তো আপনি আমাকে বলবেন।”
নাহিদের কণ্ঠ নরম।
অথচ নূহা কটমটিয়ে উঠল। আগের রূপে ফেরত গিয়ে খ্যাক করে বলল,
“ একদম বাজে কথা বলবেন না হ্যাঁ! তাহলে এই ছাদ থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেব। কোন দুঃখে আপনাকে প্রেম পত্র দেব শুনি? নূহা আর যাই হোক,এসব ঢেঁড়সদের প্রেমে পড়ে না।”
নাহিদের ইগোতে লাগল। মুখ শক্ত করে বলল,
“ যে কাজটা করছেন,সেটা বলায় এত ভাব নিচ্ছেন কেন? মুখের সামনে প্রেমপত্র ধরে বলছেন প্রেমপত্র দিচ্ছেন না?”
নূহা অতীষ্ঠ হয়ে বলল,
“ উফ! আপনি একটু মুখটা বন্ধ রাখবেন? পুরো ব্যাপারটা আগে বলতে দিন আমায়।”
নাহিদ কিছু বলল না। কপাল গুটিয়ে চেয়ে থাকল শুধু। ও নিজেই বলল,
“ এই কাগজটাতে পুষ্পিতার লেখা একটা জিনিস আছে। আপনি এটাকে চুপিচুপি গিয়ে তীব্র স্যারের পকেটে রেখে দেবেন।”
অমনি নাহিদ জ্বিভ কেটে বলল,
“ এই রে,এটা তীব্রর জন্যে? আর আমি না বুঝে কী উল্টোপাল্টা ভাবলাম বলুন তো!”
“ পুরুষ মানুষের কাজই এমন। বুঝবেও বেশি,চ্যাঁচাবেও বেশি। কিন্তু নাম হবে মেয়েদের। এখন যে কাজ দিচ্ছি সেটা করে দিন তাহলেই হবে।”
ও মাথা চুলকাল। পরপর খুব চিন্তিত কণ্ঠে বলল,
“ কিন্তু সমস্যা একটাই। তীব্র তো পকেট ছাড়া শার্ট পরে। তাহলে পকেট কোথায় পাব? আর চিঠিটা রাখবই বা কোথায়?”
নূহার এত মেজাজ খারাপ হোলো! টাস করে কপালে চড় মেরে বলল,
“ হায় আল্লাহ! কাকে দিচ্ছি রাজার পার্ট! আরে ঢেঁড়স, শার্টের পকেট না থাকলে কি প্যান্টেও নেই? সেখানে রাখবেন। ”
নাহিদ মাথা ঝাঁকাল এবার। ঠোঁট গোল করে বলল,
“ ও, আচ্ছা রেখে দেব। কিন্তু এতে কী হবে?”
নূহা রহস্য হেসে বলল,
“ আমরা যা চাইছি তাই।”
(এই পর্বটা আমি ইদের পরদিন থেকে লিখছি। অথচ শেষ করলাম আজ। মানে কী একটা অবস্থা হচ্ছে আমার! যাক গে,সব কষ্ট ভুলে যাই আপনারা যখন সুন্দর সুন্দর মন্তব্য করেন। আজকেও একটু কষ্ট কমিয়ে দিন তো!)
চলবে