কলমে: নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
(৩৩)
বেশ রাতের কথা। থমকে থমকে বাতাস বইছে বাইরে। গাজীপুরের সবথেকে উঁচু দালানের চিলেকোঠায়,অন্ধকার বুক ফুলিয়ে ঘুরছে। এইতো কিছুক্ষণ হবে, ঝড় থেমেছে। অম্বরের বক্ষচিড়ে উড়ে বেড়ানো পুঞ্জ পুঞ্জ কালো মেঘ, মিলিয়ে যাচ্ছে কোথাও। বৃষ্টি আর বাতাসের তোড়টা সামলে উঠতেই, ঘরে ফিরেছেন আয়েশা। তবে আসার পর তীব্র আর নাহিদকে পাননি। ওরা দুজন সেখান থেকে আরো আগেই বেরিয়ে এসেছিল। সেই পুষ্পিতা ছুটে যাওয়ার পরপরই, কথাবার্তা ছাড়া ঘরে ফিরেছে তীব্র। নূহার মন খারাপ তখন শৃঙ্গ ছাপিয়ে যায়। তার একটা সাধারণ প্রশ্নে কী থেকে কী ঘটে গেল! প্রফুল্ল বাতাবরণ বদলে গেল চোখের পলকে !
এখনও বিদ্যুৎ আসেনি। ছাদের পাঁচিল চুইয়ে টুপটাপ বর্ষা পতনের আওয়াজ পরিষ্কার আসছে কানে । ঘরের এক কোণে চুপ করে বসে আছে নাহিদ। থম ধরে থাকা তীব্রর উপস্থিতি ঠিক তার পাশেই। ছেলেটার জ্বিভে একটা টু শব্দ অবধি নেই । কী যে চলছে ওর মনে!
পুষ্পিতার তখনকার কথাগুলো শুনে নাহিদের নিজের বুকটাই হুহু করছে এখনও। তাহলে বিট্টুর কী হচ্ছে? ও তো মেয়েটাকে ভালোবাসে। তবুও এতো শান্ত কেন?
নাহিদ জড়োতা ভরতি হাতটা বাড়াল,মূর্তি বনে থাকা তীব্রকে একটু নাড়ানোর আশায়। প্রবল শঙ্কায় ফের পিছিয়ে আনল সেটা। এখন প্রশ্ন করলেও মুশকিল। চেতে টেতে একাকার করে যদি? থাক বাবা! মন ভালো হলে বিট্টু নিজেই কথা বলবে। নাহিদ ফোস করে শ্বাস ফেলল। চুপচাপ পাশ হতে উঠে গেল তারপর।
তীব্র তখনও পাথর হয়ে রইল। বিলাই চোখের চাউনী মেঝের দিকে স্থির। বাকী সব কিছু তুচ্ছ হোক,তুঙ্গে যাক। তার কানের পাশে নিরন্তর বাজছে পুষ্পিতার আওড়ানো কিছু কথা,
“ আমার একটা বাড়ি চাই।”
অমন ভাবেই সময় পার হয়। শুভ্র ফোনের ফ্ল্যাশ মাড়িয়ে ঘরময় আলো জ্বলে ওঠে। কমে আসে বাতাসের তেজ। অথচ তীব্রর ভাবনা যায় না। যে ভাবনায় তার কান বন্ধ। রুদ্ধ মাথার দ্বার। নাহিদ খেতে ডেকে ডেকে ক্লান্ত হয়ে শেষে নিজেই খেয়ে নিলো,অথচ এক চুল নড়ল না তীব্র।
হঠাৎই কী ভেবে নিচ থেকে চোখ তুলে দেওয়ালে ফেলল সে। টানটান শ্বেত ললাট গুছিয়ে, ভাবল কিছু একটা। চট করে ফোন তুলল হাতে। কারো নম্বরে ডায়াল করতেই রিং বাজল গিয়ে,ঠিক গুলশানের বুকে দাঁড়িয়ে থাকা এক প্রাসাদের অন্দরে। ঝড়-বৃষ্টি মাথায় তুলে মিনিট কয়েক আগে বাসায় ঢুকেছেন জামশেদ। লুৎফাকে কড়া এক কাপ কফি দিতে বলে,কেবল বসেছেন বিছানায়। শরীর জুড়ে ক্লান্তি। এমন বন্যার মধ্যেও দুদণ্ড জিরোনোর জো নেই। ঠিক সংসদে গিয়ে হাজিরা দিতে হয়েছে। রিংটোনের শব্দ শুনে বিরক্ত হন ভদ্রলোক। এতো রাতে আবার কে?
জ্বিভের ডগায় চ সূচক শব্দ তুললেন তিনি। ফোন তুলতেই, ঘরে ঢুকলেন লুৎফা। স্ত্রীর বাড়িয়ে ধরা মগটা হাতে নিতে নিতে স্ক্রিনে চোখ বোলালেন জামশেদ। তীব্রর নামটা দেখে খুব আয়োজন করে ভ্রু গুছিয়ে গেল। একটু নয়, বিস্ময় ছাপাল অনেক দূর। এই ছেলে তাকে নিজে থেকে শেষ কবে কল করেছে,আঙুলের কর গুণলেও মনে পড়বে না। রিসিভ করার আগে এক পল স্ত্রীর দিকে চাইলেন তিনি।
বললেন,
“ তুমি গিয়ে টেবিলে খাবার বাড়ো। আমি কথা শেষ করেই আসছি।”
বরাবরের বাধ্য নারী লুৎফা। এবারেও ঘাড় কাত করে নিশ্চুপ চলে গেলেন।
জামশেদ ফোন কানে
গুঁজে বললেন,
“ কী ব্যাপার, সূর্য আজ কোনদিকে উঠেছে? তুমি নিজে থেকে কল করলে আমায়!”
তীব্রর আজকে বাঁকা উত্তর নেই। সোজাসুজি বলল,
“ একটা দরকারে ফোন করলাম।”
জামশেদ ভ্রু তুলে বললেন,
“ সে কী! দরকারে নাকি আমিই তোমাকে স্মরণ করি? এমন কথাই বলে গেলে না সেদিন? তা আজ হঠাৎ নিজেই এ কাজ করছো?”
তীব্র চোখ বুজে শ্বাস ফেলে বলল,
“ আপনার ছেলে না? রক্ত বলে কথা। গরম হলে টগবগ তো একই ভাবে করবে।”
“ ত্যাড়া কথা কোনওদিন ছাড়বে না তাই না?”
ও একটু চুপ থেকে বলল,
“ যেটা বলার জন্য ফোন করা, সেটা বলি?”
“ বলো,শুনে ধন্য হই।”
বাবার শ্লেষটুকু কানে নিলো না তীব্র। বলল নিজের মতোন,
“ আপনি সেদিন আমাকে একটা কাজের কথা বলছিলেন না? জমি নিয়ে কোনো একাব্বরের সাথে ঝামেলা হচ্ছে? সেই কাজটা আমি করে দেব।”
বিস্মিত জামশেদ চোখ গুটিয়ে বললেন,
“ করে দেবে? এই যে বলে গেলে তুমি আর এসবে নেই!”
“ তেমনই ভেবেছিলাম। কিন্তু ভাগ্য হয়ত অন্য কিছু চাইছে। তবে এটাই শেষ।”
ভদ্রলোক ছেলের রহস্যময় কথার কানাকড়িও বুঝলেন না। শুনে গেলেন চুপচাপ। তীব্র নিজেই বলল,
“ কিন্তু কাজটা আমি এমনি এমনি করব করবো না। একটা শর্ত আছে।”
জামশেদ মাথা ঝাঁকালেন।
“ আচ্ছা আচ্ছা, টাকা লাগবে নিশ্চয়ই? কী, নিজের বেতনের টাকায় ক্লাবে যেতে পারছো না? তা গাজীপুরে ক্লাব আছে তো?”
তীব্রর ভারি মেজাজ খারাপ হলো। কণ্ঠ পুরু করে বলল,
“ আপনি আগে আমাকে শেষ করতে দিন। এসব খোচাখুচি পরেও করা যাবে।”
এতক্ষণে সিরিয়াস ইস্যু মনে হলো জামশেদের। নিজেও কিছুটা নড়েচড়ে বসলেন। “ হ্যাঁ বলো,শুনছি। কী শর্ত? কী চাই?”
তীব্র সময় নিলো। বুক ফুলিয়ে ভারি দম ফেলে বলল,
“ গাজীপুরে একটা ফ্ল্যাট চাই আমার।”
হেসে ফেললেন তিনি। দুপাশে মাথা নেড়ে বললেন,
“ ঠিক সেই জায়গায় এসে দাঁড়ালে তাহলে? আমি তো আগেই জানতাম, তোমার দ্বারা এসব হবে না। সারাজীবন রাজপ্রাসাদে ঘুমিয়ে, ভাড়া বাসায় থাকা মুখের কথা নয়।”
তীব্র পরাস্ত কণ্ঠে বলল,
“ দেখুন মন্ত্রীমশাই, আমার হাতে সময় নেই। কাজটা করার জন্য, কবে কখন আসতে হবে বলুন।”
ছেলের কণ্ঠস্বরে কপাল টানটান করলেন জামশেদ। আগের চেয়েও মুখভঙ্গি গুরুতর হল। ব্যাপারটা কী! এই কাল বলে গেল সে এসব মাস্তানিতে নেই। এখন থেকে ভদ্র ছেলের মতো শিক্ষকতা করবে। আবার আজকেই বলছে এসব? বিনিময়ে ফ্ল্যাটও চাইছে? ঘটনার জল কতদূর গড়িয়েছে? হাঁটু সমান? না ডুবে যাওয়ার মতো?
বাবাকে চুপ দেখে তাগিদ দিলো তীব্র,
“ কী হলো? বলুন কিছু!”
জামশেদ গলা খাঁকারি দিলেন। পিতৃসুলভ গম্ভীরতা টেনে আনলেন কণ্ঠে। তবে নরম শোনাল কথাগুলো,
“ দেখো তীব্র, তুমি যে মন থেকে আমাকে খুব একটা সম্মান করো না সে আমি জানি। মন থেকে কি, সামনাসামনিও করো না। তবে তুমি যাই ভাবো, তুমি তো আমার সন্তান। আমার একমাত্র বংশধর। মানো বা না মানো,তোমার জন্যেই এই বয়সেও আমার এতটা দৌড়-ঝাঁপ করা। যাতে নিজের শেষ বয়সে অন্তত আরামে জীবন কাটাতে পারো। কখনও নিজের মধ্যেও যেন প্রশ্ন না ওঠে, তোমার বাবা তোমার জন্যে কিছুই করেননি। এখন আমার যা কিছু, এসব তো তোমারই। এতদিন তুমি মাস্তানি করতে সেটা বাবা হিসেবে আমার পছন্দ ছিল না। কিন্তু কিছু কাজের ক্ষেত্রে আমি বাইরের লোককে ভরসা করতে পারতাম না বলেই তোমাকে সেসব করতে দিতাম। কিন্তু যখন তুমি মাস্তানি ছাড়ার কথা একবার মুখ থেকে বের করেই ফেলেছো, একটা সুস্থ জীবনে নিজেকে এগিয়ে নিতে চাইছো, তখন আমি আর তোমাকে আগের পথে ফেরত নিতে চাই না। আমার কোনও কাজ তোমার করতে হবে না। ফ্ল্যাট লাগলে বলো, আমি এমনিই দেখে দিচ্ছি।”
বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ল তীব্র। প্রথম দফায় বাবার এত কোমল সুর কান দুটো মেনে নিতে পারেনি। চোখমুখ থমকে বসে রইল কিছুক্ষণ। জামশেদ নিজেই বললেন,
“ কোনদিকে ফ্ল্যাট দেখে দেবো জানিও। এখন যেখানে আছো সেখানকার আশেপাশে? নাকি তোমার কলেজের কাছাকাছি?”
বাবার প্রতি ভেতরটায় একরাশ ভালো লাগায় ছেঁয়ে গেলেও,তীব্রর শক্ত কণ্ঠ টলেনি। থমথমে ভঙ্গিতে জানাল,
“ আমি নিজে বেছে নিতে চাই।”
“ বেশ তো। আমি তোমার একাউন্টে টাকা পাঠিয়ে দিচ্ছি,তুমি কিনে নাও।”
তীব্র বলল,
“ টাকাগুলো আমি আপনার থেকে এমনি এমনি নিতে চাই না ড্যাড। এই টাকা আপনি আমাকে ধার দিচ্ছেন।”
জামশেদ হোচট খেয়ে বললেন,
“ মানে? তোমার আমার মধ্যে আবার এসব ধার-দেনা শব্দ আসছে কেন? আমি তো বললাম…”
ও কথা টেনে নেয়,
“ আসছে তার কারণ আছে ড্যাড। এই ফ্ল্যাটটা আমার বিশেষ দরকার। যেটা আমার জীবনের বিশেষ কারোর জন্যে নেব আমি। তাই এখানে আমার বাবার টাকা,ক্ষমতা কোনও কিছুকেই আমি কাজে লাগাতে চাই না।”
ভদ্রলোকের মেজাজ চটে গেল।
“ কার জন্যে নেবে শুনি? তুমি তো আবার খুব ত্রান কর্তা ভাবো নিজেকে। ওই উচ্ছ্বন্নে যাওয়া ছেলেগুলোর কাউকে দেবে?”
তীব্র মুখের ওপর বলল,
“ সেসব তো আপনার জানার দরকার নেই। আপনি আমাকে টাকা লোন দিচ্ছেন। আমি সেটা শোধও করে দেব। তাহলে টাকা আমি কোথায় খরচ করব,সেটা জেনে আপনার খুব একটা লাভ হবে না।”
জামশেদ বিদ্রুপ করে বললেন,
“ তা কীভাবে দেবে শুনি? তোমার ওই বেতন দিয়ে? মোটে ওই কটা টাকা পাও তা দিয়ে একটা ফ্ল্যাটের টাকা শোধ করবে ভাবছো? এতোটা বোকা তো তোমাকে ভাবিনি তীব্র। বয়স বাড়ার সাথে দেখছি বাচ্চামোটাও দিন দিন বাড়ছে তোমার।”
“ হ্যাঁ তাই। প্রতিমাসে আমার বেতনের বড়ো অংশটা আমি আপনাকে পাঠিয়ে দেব। তাতে যদি কয়েকশ বছর লাগে লাগুক। তীব্র রেজা তালুকদার মরার আগের দিন হলেও আপনার পুরো টাকা শোধ দিয়ে যাবে।
“ এ আবার কী কথা?”
“ আমি এখন রাখছি। পারলে এই সপ্তাহে আমার একাউন্টে টাকাটা দিয়ে দেবেন। আর সামনের মাস থেকে প্রতি দশ তারিখের মধ্যে, আপনার একাউন্টে দশ হাজার করে পাঠিয়ে দেব আমি। ভাববেন না,আমার কথার হেরফের হবে না এবার।”
তীব্র লাইন কেটে দিলো। কিন্তু জামশেদের মাথাটা দপদপ করে উঠল অজ্ঞাত কোনো ভাবনায়। বুকের মধ্যে তেড়ে এলো খচখচানির ধাত।
কয়েক দিন যাবত কাজের ভীষণ ব্যস্ততা ছিল ওনার। ছেলের খোঁজ নেবেন করে করেও নেয়া হয়নি। সব থেকে বড়ো কথা তীব্র ঢাকা থেকে গেলই তো কাল। এর আগে ইস্যুটাকে এতটা সিরিয়াস মনে না হলেও,এইবার ভদ্রলোকের ঘুম ছুটে যাওয়ার অবস্থা হয় । কোথাও গিয়ে মনে হলো আবুলের সেদিনকার কথাই ঠিক। বহু আগেই তীব্রর ব্যাপারটা খতিয়ে দেখা উচিত ছিল তাঁর। শুধু কলেজে যাচ্ছে এটুকু জেনে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকাটা চরম বোকামি হয়েছে।
আস্ত ফ্ল্যাট কিনে কাকে দেবে ছেলেটা? এই বিশেষ কেউটা কে? ওখানে গিয়ে আবার কোনও মেয়ের পাল্লায় পড়ল না তো?
****
হঠাৎ মাথায় হাতের স্পর্শ পেয়ে,বই থেকে মুখ তুলল পুষ্পিতা। কাজল বিহীন চোখদুটোয় বড়ো গাঢ় দৃষ্টি তার। কিন্তু নূহার ঠোঁটে হাসি নেই। খুব মন খারাপ করে বলল,
“ তোর মাঝে এত কষ্ট পুষ্পিতা? কই, কখনও তো বলিসনি আমাকে।”
মেয়েটা অবাক হয়।
“ কীসের কষ্ট?”
নূহা খেকিয়ে ওঠে,
“ ঢং করলে এক চড় খাবি। ওই যে তখন খেলার সময় বললি তোর বাড়ি লাগবে।”
পুষ্পিতা হেসে ফেলল। রক্তজবার ন্যায় ওষ্ঠ গলে,চিরল দন্তপাটি ঠিকড়ে এলো বাইরে। মাথায় রাখা নূহার হাতটা মুঠোয় নিয়ে বলল,
“ আরেহ বোকা, তুই এখনও ওসব নিয়ে পড়ে আছিস? তখন কী বলতে কী বলেছি৷ এমন কথা কি ধরতে আছে?”
“ তার মানে তোর মধ্যে কোনও কষ্ট নেই?”
পুষ্পিতা দুপাশে মাথা নাড়তেই,অভিমান হলো নূহার। পুষ্পিতা এখন লুকাতেও শিখে গেছে?
আর একটা কথাও বলল না সে। গাল ফুলিয়ে গিয়ে চুপচাপ পড়ার টেবিলে বসল।
পুষ্পিতা বিফল শ্বাস ঝাড়ে। এই মেয়ে আবার রাগ করেছে! উঠতে নিলেই অমন ভাবে বাক্য ছুড়ল নূহা,
“ একদম আমার কাছে আসবি না । চৌদ্দ তারিখ থেকে আমার পরীক্ষা। পড়ব আমি। তুই তোর মতো থাক।”
পুষ্পিতা জায়গাতেই দাঁড়িয়ে গেল। নূহা মানা করেছে সেজন্যে নয়,অন্য কারণে। এখন তো ফেব্রুয়ারী মাস। চৌদ্দ তারিখ কবে?
ও ত্রস্ত টেবিল থেকে ছোটো ক্যালেন্ডার তুলল হাতে। আজকে বারো তারিখ৷ মানে পরশু চৌদ্দ তারিখ। হুট করে তনুজার সেদিনকার কথাটা মনে পড়ল ওর। সে যে বলেছিল ১৪ই ফেব্রুয়ারী স্যারকে প্রপোজ করবে। তাহলে তো পরশুই সেই দিন।
***
মাঝরাতে দরজায় ঠকঠক শব্দ। যেই আওয়াজ আলোড়ন তুলল গোটা ঘরের ভেতর। চোখের ওপর থেকে আড়াআড়ি রাখা হাতটা নামাল তীব্র। কপালে ভাঁজ নিয়ে চাইল পাশে শোয়া নাহিদের দিকে। তার চোখের সাইজ মারবেল। কেমন সজাগ হয়ে চেয়ে আছে কোথাও। তীব্র কর্কশ ভাবে বলল,
“ শুয়ে আছিস কেন? দরজা খুলে দিয়ে আয় যা।”
নাহিদ অমনি নড়েচড়ে ওঠে। তীব্রর হাতটা জাপটে ধরে মেয়েদের মতো। ভীত কণ্ঠে বলল,
“ এত রাতে কে এলো? যদি চোর-টোর হয়?”
“ চোর এমন কলিংবেল বাজিয়ে আসবে? তোর মাথায় কি কোনওদিন বুদ্ধি হবে না? নূহার মা এসেছেন হয়ত। গিয়ে দ্যাখ আগে।”
নাহিদ মেনে নিলো। মাথাটাকে এক দিকে নেড়ে ভদ্রের ন্যায় বিছানা ছাড়ল তারপর। তক্ষুণি তীব্রর ফোনে টুং করে ম্যাসেজ টোন বাজে। স্ক্রিনে ভেসে উঠল একাউন্টে টাকা ঢোকার খবর। প্রথমবার বাবার প্রতি প্রসন্ন হাসল সে।
নাহিদ হাই তুলতে তুলতে দরজা খুলল ঠিকই,তবে ওপারের মানুষ দেখে পিলে সুদ্ধ চমকে উঠল ছেলেটার। তিন তিনটে বাঘা বাঘা মুখোশদারী লোক দাঁড়িয়ে আছে। এরা কী ডাকাত?
কিছু বুঝে ওঠার আগেই হুড়মুড় করে ঢুকে গেল ওরা। গায়ের ধাক্কায় নাহিদ ছিটকে যায় দূরে। চিৎকার করতে যাবে, পূর্বেই একজন ওর মুখ চেপে ধরল। অন্যজন পেছনে গিয়ে পিঠের সাথে মুচড়ে রাখল হাত। আতঙ্কে অন্তরাত্মা শুকিয়ে গেল ছেলেটার। ঘেমে-নেয়ে মুখখানা স্যাতস্যাতে দেখাল।
বাকীজন খুব মোটা গলায় বলল,
“ তোর এত বড়ো সাহস,আমাদের এলাকায় এসে মেয়েদের বিরক্ত করছিলি?
নাহিদের চক্ষু চড়কগাছ। উম উম শব্দ করে জোরে জোরে মাথা নাড়ল দুদিকে।
কিন্তু কথা কানে নেয় না সে। বরং পকেট থেকে ছুড়ি বের করতেই নাহিদের রক্ত ছলকে ওঠে। তৃতীয় জন ছুড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে বলল,
“ কাল বাড়ির সামনে একটা মেয়ের ওড়না ধরে টানছিলি না তুই? আজকে তোর গলা কাটব দাঁড়া।”
সাথে গলার রগে টান বসাতেই নাহিদের সব কিছু থেমে গেল। এইত,এক্ষুনি মরে যাবে ও। গলগল করে রক্ত বের হবে নিশ্চয়ই? ভীষণ ব্যথা করবে?
নাহিদ মরার প্রস্তুতি নেয়ার মাঝেই তার হাত-মুখ ছেড়ে দিলো ওরা। সরে এলো কাছ থেকে। তার চোখমুখের কাহিল দশা দেখে হুহা করে হেসে উঠল জোরে।
নাহিদ কিছু বুঝল না। ভরকে যাওয়া চোখ মেলে দেখছে সবাইকে। যুবক তিনজন টান দিয়ে মুখোশ খুলে ফেলল। অমনি মাথা চক্কর কাটল ওর। হকচকিয়ে বলল,
“ তোরা?”
মাথার ওপর চাটি মারল মিরাজ,
“ গরু সারাজীবন গরুই থেকে গেলি। গলা শুনেও তো মানুষ বোঝে তাই না?”
নাহিদ ভয়ডর ভুলে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকল। এরা তিনজন এখানে এলো কী করে? হঠাৎ চোখ পড়ল একটু দূরে এসেছে দাঁড়িয়েছে তীব্র।
নাহিদ তুরন্ত ছুটে কাছে যায় ওর। হড়বড়িয়ে বলে,
“ বিট্টু, বিট্টু দ্যাখ ওরা এসেছে। এতো রাতে ওরা কী করে এলো এখানে?”
“ আমরা অনেকদিন আগেই এসেছি রে ছাগল। বিট্টু বহু আগেই জানতো। শুধু তোকে দেখা দিলাম আজ।”
বলতে বলতে তার কাঁধটা পেঁচিয়ে নিলো আরমান। নাহিদ কণ্ঠ শৃঙ্গে তুলে বলল,
“ কী বলছিস?”
“ আজ্ঞে হ্যাঁ। তা কেমন আছিস বল?”
নাহিদ উত্তর দিতে পারল না। ওর বুকখানা এখনও কাঁপছে। যদি সত্যিকারের ডাকাত দল হোতো? ভাবতেই ধড়ফড় করে গলায় হাত দিলো সে। ব্যাপারটায় ওরা হেসে উঠল আবার।
মিরাজ ছুড়িটা উঁচু করে দেখাল,
“ আরে এটা প্লাস্টিকের ছুড়ি। ভয়ে তো খেয়ালও করিসনি।”
নাহিদ ঠোঁট উলটে বলল,
“ তোরা আমার সাথে এভাবে মজা নিতে পারলি? আমি যদি ভয় পেয়ে মরে যেতাম? দেখলি বিট্টু,কেমন করল? তুই কিছু বলবি না?”
তীব্র সত্যিই কিছু বলল না। শব্দহীন ফেরত এলো ঘরে। বিষয়টাতে অবাক হয় সবাই। মুশফিক জিজ্ঞেস করল,
“ কী হয়েছে রে ওর?”
নাহিদ কাঁধ উঁচায়। নীরবে বোঝায়,সে জানে না।
আরমান বলল,
“ চল ভেতরে যাই।”
সবাই মিলে তীব্রর ঘরে এলো। লম্বা দেহটা নিয়ে ফের সটান হয়ে শুয়েছে ও। চোখের ওপর আবার সেই আড়াআড়ি হাত।
মিরাজ হাঁ করতে গেলে মুশফিক মানা করল। ফিসফিস করল কানের কাছে,
“ মনে হয় ওর মেজাজ ভালো না।”
“ এ বাবা,তাহলে এখন? ওর জন্যেই তো এলাম। আড্ডা দেব,মজা করব আর ও কী না!”
আরমান তখন চারপাশটা দেখছিল। মেঝের এক কোণায় বিস্কিটের কৌটো দেখে ত্রস্ত নিয়ে এলো গিয়ে। ঢাকনা খুলে বসল ফ্লোরে। প্রস্তাব ছুড়ল সবার দিকে,
“ এই আয় তাস খেলি। বিট্টু ওঠ না। কতদিন তাস খেলিনি এক সাথে।”
তীব্র ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। ভীষণ শান্ত সেই চাউনী। অমনি হুটোপুটি করে গোল হয়ে বসল সবাই। ভাবল,এক্ষুনি তীব্র উঠে এসে সামিল হবে খেলায়। কিন্তু সময় গেলেও, এমন কিছু হলো না। মিরাজ অধৈর্য হয়ে ডাকল,
“ কী রে বিট্টু আয়।”
ছেলেটার নিষ্প্রভ জবাব,
“ তোরা খ্যাল। ভালো লাগছে না আমার।”
“ আরে তুই না খেললে..”
শেষ করার আগেই, অনীহা দেখিয়ে ঘর ছাড়ল তীব্র। অন্য রুমটায় গিয়ে ধড়াম করে দোর চাপাল। এবার চিন্তায় হলো ওদের। আরমান মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,
“ ব্যাপারটা তো ভালো লাগছে না। বিট্টুকে এরকম কোনওদিন দেখিনি। কিছু কি হয়েছে ওর?”
নাহিদ হাঁ করতে গেলেই, মুশফিক আঙুল তুলল,
“ খালি বল যে জানি না। শালা এক ঘরে থেকেও আর ওর খোঁজ রাখিস না,কেমন বন্ধু তুই?”
ও মুখ কালো করে বলল,
“ আমি কী করব? বিট্টু তো তার ভিতু মেয়ের কিছু কথা শোনার পর থেকেই এমন ঝিম মেরে আছে।”
মিরাজ লাফিয়ে উঠে বলল,
“ কী বলেছে ওই মেয়ে? রিজেক্ট করেছে আমাদের বিট্টুকে? তাহলে কিন্তু ওই মেয়েকে আমি..”
নাহিদ থামিয়ে দেয়,
“ আরে না রে ভাই। অন্য ব্যাপার। আমি বাবা বলব না। তোরা বিট্টুর থেকেই শুনে নিস। সে যা পসেসিভ পুষ্পিতাকে নিয়ে,কী বলতে কী বলবে পরে আমাকে মারবে।”
‘আমাকে মারবে’ কথাটা শিশুর মতো করে বলল নাহিদ। । মিরাজ চট করে গালটা টেনে বলল,
“ ওলে ওলে বাবুতা। তোমাকে মালবে?”
নাহিদ ভ্রু কুঁচকাল। পরপরই শব্দ করে হেসে ফেলল সবাই।
সেই হাসি শুনেও গাট হয়ে বসে রইল তীব্র। তার মন, যোগ কোনওটাই ওসবে নেই। মাথার মধ্যে কেবল পুষ্পিতা ঘুরছে। ওর সেই ভেজা কণ্ঠ,চোখ থেকে গড়িয়ে পরা জল,কষ্ট লুকাতে পালিয়ে যাওয়া। আর বুক ভাঙা নিঃশ্বাসের সাথে উগলে দেয়া একেকটি বাক্যবাণ। ওই অতটুকু মেয়েটা এত কষ্ট চেপে কীভাবে হাসে? কীভাবে কথা বলে? কী করেই বা স্বাভাবিক থাকে সব সময়? ছোটো বেলা থেকে সামান্য বাবাকে কাছে পেতো না ,আর দশটা বাচ্চার মতো বাবা ওকে কোলে চড়িয়ে স্কুলে নিতো না,সময় দিতো না বলে বাবার প্রতি আজও তীব্রর কত অভিমান! কত রাগ! মনে মনে কতটা দুরুত্ব। কিন্তু ভিতু মেয়ের যে বাবাই নেই। বাবা কী,পৃথিবীতে মেয়েটার কেউই তো নেই।
আচ্ছা, কে এইভাবে ভিতু মেয়েকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বার করার ভয় দেখাত? কে খোটা দিত প্রতি কথায়? তীব্রর মাথায় প্রথমেই উঠল খোরশেদের নাম। মুখবিবর শক্ত হলো সহসা।
ওই লোকটা তার কোমল ফুলকে এত কষ্ট দিয়েছিল এক সময়? আর ও কী না এইভাবে ছেড়ে এলো? তীব্র নিজের প্রতি রাগে ঘুষি বসায় খাটের কাঠে।
না,এইবার আর ছাড়াছাড়ি নয়। লোকটাকে একটা চরম শিক্ষা না দিলে শান্তি হবে না ওর। যে হাত দিয়ে ভিতু মেয়েকে ঘাড় ধাক্কা দিতে চাইত? এবার সেই হাত ভেঙে গলায় ঝুলিয়ে দেবে তীব্র।
******
ঘড়িতে আটটা বাজতে চলল। তীব্র প্রতিদিন ন-টা নাগাদ কলেজের জন্যে বের হলেও,আজ বেরিয়ে গেল তখনই।
সেসময় ঘুমে বিভোর ছিলো নাহিদ। সাথে রুমের চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ঘুমিয়ে আছে মিরাজ,আরমান আর মুশফিক।
সকালের সব কিছু যখন খুব শান্ত? ঠিক সেই সময় গেটের কাছে হাজির হলেন জামশেদ। গাড়ি,দেহরক্ষী কিচ্ছু নিয়ে নয়। বরং একজন সাধারণ মানুষের মত সিএনজি থেকে নামলেন তিনি।
ভাড়া না দিয়ে বললেন,
“ এখানেই থাকো। আমি আধঘন্টার মাথায় ফিরব।”
উত্তরে ঘাড় নাড়লেন চালক। এত বড়ো মন্ত্রী তার সি এনজি চড়ে সুদূর ঢাকা থেকে এখানে এসেছে,ভাবতেই উত্তেজনায় জানটা ঝুলে পড়ছে গলায়।
জামশেদের পরনে সাদামাটা পাঞ্জাবি। হাতাটা গুটিয়ে চারপাশে চাইলেন। বাড়ির পরিবেশ একেবারেই যাচ্ছে তাই। এমন জায়গায় তীব্র থাকে ভাবতেই নাক সিটকে মাথা নাড়লেন দুপাশে।
দুটো বিল্ডিং পরের বিল্ডিংয়ে কাজ চলছে। স্তূপ করে রাখা বালু,গুড়ো গুড়ো ইটের টুকরো উড়ে আসছে হাওয়ায়। নিস্তেজ সকালে জনমানব কম। জামশেদ রুমালে নাক চেপে দ্রুত পায়ে ঢুকলেন গেট দিয়ে। খবর পেয়েছেন তীব্র তিন তলায় থাকে। সেই মোতাবেক এসে থামলেন ভদ্রলোক। তীব্র ঘুনাক্ষরেও আন্দাজ করতে পারবে না, উনি নিজে আসবেন এখানে। আর সেটাই হবে জামশেদের মোক্ষম সুযোগ। কী ঘোট পাঁকাচ্ছে এখানে বসে স্বচক্ষে দেখবেন তিনি। কিন্তু বিপত্তি একটা থেকেই গেল। চোখের সামনে পাশাপাশি দুটো ফ্ল্যাটের দরজা দাঁড়িয়ে। এর মধ্যে কোনটাতে থাকে সে? জামশেদ বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেন। দ্বিধাদ্বন্দে ভুগলেন কোন দরজায় টোকা দেবেন তা নিয়ে। আচমকা ডান পাশের ঘর হতে মেয়েলি কণ্ঠ ভেসে এলো। কোনও এক মহিলার আওয়াজ। কিছু বলছেন কাউকে। ব্যস! উত্তর পেয়ে গেলেন জামশেদ।
তীব্রর সাথে একটা ছেলে থাকে শুনেছেন। মেয়ে নিশ্চয়ই থাকবে না? এখনও অতোটা অধপতন হয়নি বোধ হয়।
নিশ্চিন্ত মনে অন্য ফ্ল্যাটের ডোরবেল টিপলেন তিনি। কয়েকবারের এই উৎকট শব্দটায় ঘুম ছুটল নাহিদের। খুব বিরক্ত হয়ে নড়ে উঠল সে। পা দিয়ে বারি দিলো পাশে শোয়া আরমানে পায়ে। চোখ ভরতি ঘুম নিয়ে বলল,
“ যা না, দরজাটা খুলে দিয়ে আয় না।”
গভীর তন্দ্রায় বিঘ্ন পেয়ে রেগে যায় সে। খ্যাক করে বলে,
“ এ বাসায় কি আমি থাকি? তোর বাসা তুই যা।”
অবলা ছেলেটা নিরুপায়ের ন্যায় বিছানা ছাড়ল। হাই তুলতে তুলতে দরজা খুলল গিয়ে৷ প্রকাণ্ড ধাক্কায় মুখ থুবড়ে পড়ল অমনি। চক্ষু প্রকট করে বলল,
“ আঙ্কেল আপনি?”
জামশেদ কপাল কোঁচকালেন। কিছু না বলে পাশ কাটিয়ে ঢুকলেন ভেতরে। চারপাশে চোখ বোলাতেই লজ্জায় নুইয়ে গেল নাহিদ। ঘর খুব নোংরা! তারওপর বদমাশ গুলো চিপস,কোক খেয়ে-টেয়ে সব একাকার করে ফেলেছে। জামশেদ বলেই ফেললেন,
“ এটা রুম না গোয়াল ঘর?”
নাহিদ মাথা নোয়াল। ইতস্তত করে একটা চেয়ার এগিয়ে বলল,
“ বসুন না আঙ্কেল।”
বসলেন তিনি। চতুর দিকে সতর্ক নজর বুলিয়ে বললেন,
“ তীব্রর সাথে তাহলে তুমি থাকো?”
ছেলেটা ঘাবড়ে যাচ্ছে। ভীতসন্ত্রস্ত চেহারা নিয়ে ঘাড় নাড়ল কোনওরকম।
“ জি।”
জামশেদ তুষ্ট হলেন। তীব্রর দলবলের মধ্যে এই একটা ছেলে একটু ভদ্র,ভালো। বাবা-মা দুজনেই উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষক ছিলেন। যাক,সব কটাকে ফেলে যে তার গুণধর ছেলে রুমমেট হিসেবে একে বেছে নিয়েছে ভালো লাগল জেনে!
ভারি গলায় শুধোলেন,
“ তা সে কোথায়? ঘুমাচ্ছে নিশ্চয়ই? যাও,ডেকে বলো তার বাবা এসছেন।”
নাহিদ মিনমিন করে বলল,
“ ইয়ে মানে, ও তো নেই আঙ্কেল। অনেক আগেই বেরিয়ে গেছে।”
জামশেদের গোটানো কপাল মিলিয়ে গেল। বিস্মিত হলেন খুব!
বারোটার আগে ঘুম না ভাঙা ছেলে আটটায় বেরিয়েছে? তাহলে তো ঘুম থেকে উঠেছে আরো আগে।
নিম্নোষ্ঠ চেপে কিছু একটা ভাবলেন তিনি। নাহিদ এক পা বাড়াতে নিলেই বললেন,
“ কোথায় যাচ্ছো?”
ছেলেটা ত্রস্ত দাঁড়িয়ে যায়। মিনসে কণ্ঠে বলে,
“ জি, মানে একটু চা বানিয়ে দেই আপনাকে।”
“ লাগবে না। যে সময় নিয়ে চা বানাবে,ওই সময় নিয়ে ঘরটা গোছাও। দেখতেও তো রুচি হচ্ছে না।”
ও চুপসে বলল,
“ জি আঙ্কেল।”
জামশেদ একটু চুপ থেকে বললেন,
“ একটা কথা বলো তো আমায়।”
নাহিদ চোখ তুললে শুধোলেন,
“ তোমার বন্ধু এখানে কী কী কারসাজি করছে!”
ও বোঝেনি। বোকার মতো চেয়ে থাকতে দেখে তিনি নিজেই বললেন,
“ দ্যাখো,তোমাকে আমি বেশ ভালো জানি। তোমার বাবাকেও তো চিনি। বাড্ডার কত মান্যগন্য শিক্ষক তিনি। তা শিক্ষকের ছেলে হয়ে তুমি নিশ্চয়ই চাইবে না তীব্র ভুল পথে যাক? ও কি এখানে আসলেই চাকরি-বাকরি করছে? না কি বাড্ডার মতোই কোনও চাল চালছে? হঠাৎ করে এত জায়গা থাকতে গাজীপুরে কেন এলো? আর এখান থেকেই বা যেতে চাইছে না কেন? হুট করে মাস্তানি ছেড়ে ভালো হয়ে যাওয়ার কারণটাই বা কী? সত্যি করে বলো। ”
জামশেদ যেন জিজ্ঞেস করছেন না,ধমকাচ্ছেন ওকে।
নাহিদ ঢোক গিলল। তীব্র চাকরি করছে এটা তো সত্যি। কিন্তু তার আসল উদ্দেশ্য যে পুষ্পিতাকে পটানো। আর এটা ও মরে গেলেও বলবে না। মুখে কুঁলুপ আঁটতে দেখে সন্দেহ গাঢ় হয় জামশেদের। উঠে এসে কাছে দাঁড়ালেন নাহিদের। কাঁধে হাত রেখে বললেন,
“ শোনো, তুমি নিসংকোচে আমায় জানাতে পারো। তীব্র কি সত্যিই বদলেছে? নাকি এর মাঝে অন্য কোনো উদ্দেশ্যে রয়েছে ওর?”
নাহিদ বিলম্বহীন মাথা ঝাঁকাল। স্ফূর্ত চিত্তে বলল,
“ জি আঙ্কেল। বললে বিশ্বাস করবেন না, বিট্টুর মাঝে কী মারাত্মক চেঞ্জ এসেছে এখন! ও সারারাত পড়াশুনা করে জানেন? কত সকালে উঠে কলেজে যায় সেতো আজকে নিজেই দেখলেন। নিজের কাপড় নিজে ধোয়। মাঝেমধ্যে রান্নাও করে। এখন আর কারোর সাথে বাজে ব্যবহার করে না। আগে যেভাবে মেয়েদের সাথেও তুই তোকারি করত? এখন তো আপনি ছাড়া কথাই বলে না। আপনি সামনাসামনি না দেখলে ভাবতেই পারবেন না,সেই বিট্টু মাস্তান এখন ভদ্রসভ্য লেকচারার তীব্র হয়ে গেছে।
কথা শেষে হাসল সে। জামশেদ সবটা মন দিয়ে শুনলেন। হাস্যহীন বললেন,
“ আমি আসলেই ভাবতে পারছি না। দ্যাখো, আমি চাইলে তোমার বন্ধুর পেছনে লোক লাগিয়ে সব খবর দু মিনিটে আঙুলের ডগায় নিতে পারতাম। কিন্তু কাউকে ভরসা না করে নিজের চোখে দেখে যাচাই করতে এসেছি। তা হঠাৎ তার এই চেঞ্জের কারণটা কী?”
নাহিদ জ্বিভে ঠোঁট ভেজায়। থেমে থেমে মিথ্যে বলে,
“ আসলে আমিও জানি না আঙ্কেল। তীব্রকে তো চেনেনই। ওর মনে কী চলে আমাদের তো স্পষ্ট করে বলে না কিছু। তবে যতদূর জানি,ওর মাস্তানি করতে এক ঘেয়ে লাগছিল। আবার আমি, আন্টি দুজনেই তো অনেক দিন ধরে বোঝাচ্ছিলাম এসব ছেড়ে দিতে। সব মিলিয়েই হয়ত ওর মধ্যে বদল এসেছে।”
জামশেদের তীক্ষ্ণ চাউনী তাও পাল্টায় না। কেন যেন মনে হলো ছেলেটা সব সত্যি বলেনি। নির্ঘাত লুকাচ্ছে কিছু। চোখমুখের উশখুশে ভাব দেখে তো এমনই মনে হচ্ছে। না, এই ছেলের সাথে কথা বলে সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না। একে নিশ্চয়ই তীব্র বুলি শিখিয়ে রেখেছে। একই সাথে থাকে,গাঢ় বন্ধুত্ব যখন মুখ যে খুলবে না জানা কথা। জামশেদ হাতঘড়ি দেখলেন এক বার। বললেন,
“ ঠিক আছে। থাকো তুমি।” ”
“ সে কী, এভাবে খালি মুখে চলে যাবেন? এক কাপ চা অন্তত খাবেন না?”
“ না।”
নিরেট জবাব দিয়ে,যেতে পা বাড়ালেন জামশেদ। আবার ফিরে বললেন,
“ ও হ্যাঁ, আমি যে এখানে এসেছি তীব্রকে বলতে হবে না।”
নাহিদ মাথা নাড়ল। ঘরের বাইরে এলেন তিনি। জুতো পরা অবধি ছেলেটা দাঁড়িয়ে রইল দোর আগলে।
“ কী হলো? দরজা আটকাও।”
“ জি।”
তৎপর নাহিদ দরজা আটকালেও, ওই পাশের ফ্ল্যাটের দোর খুলে গেল। হন্তদন্ত পায়ে বাইরে এলো পুষ্পিতা। জামশেদ চোখ তুলে চাইলেন। মেয়েটা ব্যস্ত ভঙ্গিতে হাত ঘড়ি দেখছে। সাড়ে নটা ক্রস করেছে প্রায়। স্যার তো ন-টায় যান। ইশ! বড্ড দেরি হয়ে গেল। তনুজার ওই চৌদ্দই ফেব্রুয়ারীর চক্করে তার সারারাত ঘুম হয়নি। ভোর ভোর কখন ঘুমালো,আর টেরই পায়নি কিছু। সজাগ হয়েই দেখল নটা বাজে। এত তাড়াহুড়ো করে কি ক্লাসে যাওয়া যায়? পুষ্পিতা জামশেদ কে দেখেও তেমন দেখেনি। তীব্র বাসায় নেই সে জানে। স্যার কখনও দেরি করেন না। তাই জোরালো পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল মেয়েটা।
কিন্তু মনে খটকা লাগে জামশেদের। এক নাগাড়ে পুষ্পিতার চলে যাওয়া দেখলেন তিনি। এত সুন্দরী মেয়ে ব্যাচেলর ছেলেদের পাশাপাশি থাকে?
তার ছেলের রেকর্ড তো বাঁধাই করা৷ বাড্ডায় দলবল নিয়ে কী সাংঘাতিক ভাবে মেয়েদের বিরক্ত করে বেড়াত! বাকী কীর্তিকলাপ গুলো তো বাদই থাকল। প্রায়ই নতুন নতুন ক্ষতিপূরণ দিতে হোতো ওনাকে।
সেখানে এই মেয়ে…
জামশেদের কেন যেন সন্দেহ হয়। নূহাদের দরজাটা তখনও খোলা। কী মনে করে সেদিকটায় এগোলেন তিনি। মাথা নামিয়ে ভেতরে উঁকি দেয়ার চেষ্টা করতেই, সামনে পড়ল নূহা। মেয়েটা বের হচ্ছিল তখন। দুজনেই মুখোমুখি থমকাল। জামশেদ থতমত খেলেন। এভাবে মেয়েদের ঘরে উঁকি দেয়া একেবারেই নিন্দনীয় কাজ। ব্যাপারটা ওনার ইমেজের সাথেও যায় না। সাফাই দিতে বললেন,
“ সরি! আসলে আমি দেখছিলাম এ বাড়িতে কে কে থাকে! কিছু মনে করো না।”
নূহার সাড়া এলো না। কথাবার্তা ছাড়া একইরকম হাঁ করে রইল।
জামশেদ খুব মুশকিলে পড়লেন এবার। সঠিক উওর ভেবে পেলেন না। কেন যে দেখতে এলেন! কী দরকার ছিল এতো তদন্তের! কী না কী ভেবে বসে এখন! নিজেই বললেন,
“ আসলে আমার ছেলে এই পাশের ফ্ল্যাটে থাকে তো। তাই দেখছিলাম ওর পাশাপাশি কারা থাকে আর কী!”
নূহার কানে ওসব গেল কী না কে জানে! খুব আশ্চর্য হয়ে বলল,
“ আপনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জামশেদ তালুকদার না?”
ভদ্রলোক কিছুটা স্বস্তি পেলেন এবার৷ যাক, ওনাকে চেনে মেয়েটা। ভুল বোঝার কথা নয়। মৃদু হেসে বললেন,
“ হ্যাঁ।”
নূহা ফের কিছু বলতেই যাচ্ছিল,থেমে গেল হঠাৎ। সতর্ক চক্ষু তাক করে বলল,
“ আপনার ছেলে এই পাশের ফ্ল্যাটে থাকে মানে? এখানে তো তীব্র..”
এটুকুতেই ভদ্রলোক কথা টেনে বললেন,
“ হ্যাঁ, তীব্রই আমার ছেলে।”
প্রখর বিভ্রান্তিতে লুটিয়ে পড়ল মেয়েটা। সব কেমন মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে। ধড়ফড় করে বলল,
“ কী বলছেন? আমি তো শুনেছি আপনার ছেলের নাম বিট্টু।”
জামশেদ নির্দ্বিধায় বলে দিলেন,
“ তীব্রর ডাকনামই তো বিট্টু।”
চলবে।