কলমে: নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
(০৬)
মোমের কিরণ নিভে আসছে। অল্প সময়ের ব্যবধানে তার ফুরিয়ে যাওয়ার আ*শঙ্কা। কক্ষজুড়ে টিমটিমে আলোর কান্তি। বাইরে, শক্তিশালী বেগে ঠিকড়ে পড়া একেকটি প্রকান্ড বজ্রপাত। সানসেট ছোঁয়া বৃষ্টির ঝুপঝাপ কলতানের রিনঝিন শব্দ। সাথে নেত্র সম্মুখে চার-পাঁচজন অজ্ঞাত মুখোশধারী যুবকের লম্বা কদমের পায়চারি।
পুষ্পিতার শীর্ণ হৃদয় ভ*য়ে জড়োসড়ো। শুকনো দেহ সাদা দেয়ালে লেপ্টে। দেয়াল ফুঁড়ে নিজেকে আড়াল করার,একটু বাঁচিয়ে নেওয়ার ব্যর্থ প্রচেষ্টা। তার চোরা,অথচ সচেতন চাউনী বারংবার ঘুরে আসছে ওই অচেনা পুরুষগুলো হতে।
আগের থেকেও দ্বিগুন আঁতঙ্কে কুপোকাত পুষ্পিতা। শাফিনের কে*টে পিসপিস করার হুমকিটায় তার গতর এখনও কাঠ। এতক্ষণে এইটুকু বুঝতে পেরেছে,ছেলেগুলোর টার্গেট ছিল মিথিলা। যেখানে ভুলবশত তুলে আনা তাকে। কিন্তু এবার? এবার বুঝি ওকেই বলি হতে হবে? পুষ্পিতা চোখ বুজে আরো একবার প্রার্থনা করল,
‘ দরকার পড়লে আমায় মে*রে ফেলুক আল্লাহ,শুধু সম্মানে যেন হাত না দেয়!’
শাফিন, তীব্র, মিরাজ,মুশফিক ক্রমাগত তার নাকের ডগায় এলোমেলো হাঁটছে। একেজনের ভাবভঙ্গি চিন্তিত,উৎকণ্ঠিত। দ্বিতীয় তলার এই ফ্ল্যাটে ঘর মোট চারটি। বসার ঘরে কাজী সাহেব বন্দী। বাকী শোবার ঘরের একটিতে নাহিদ।
তার কা*ন্নাকাটি বহাল তখনও। মিথিলাকে পাওয়ার একটুখানি আশা,এমন নিদারুণ ভাবে চুরমার হয়ে যাওয়ার হাহা*কারে কণ্ঠনানী মত্ত।
পুষ্পিতার মায়া হয় সে কান্নায়। মুখবিবরের সংকীর্ণতা বাড়ে। আপুটা এমন না করলেই পারতো না? ওকে তো জোর করে বিয়ে দেওয়া হয়নি। খালুজান নিজে তার সামনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করেছিলেন, কাউকে পছন্দ কী না! আপু নির্দ্বিধায় জানিয়েছিল ‘না’। তবে এই ছেলে এলো কোত্থেকে? এমন করুণ কান্না, হা-হুতাশ তো মিথ্যে হতে পারেনা! কাউকে হারানোর শোকে,
এমন আহাজারি তো কোনও ভুল মানুষের নয়। উনি নিশ্চয়ই মন থেকে ভালোবাসতেন! পুষ্পিতা উদ্বীগ্ন বক্ষে দীর্ঘশ্বাস টানল। ফের চাইল বাকীদের দিকে।
মাত্রাধিক ভ*য়ে একটু আগে জ্ঞান হারিয়েছিল ও। চেতনা ফিরলে হাত-পায়ের বাঁধন খুঁজে পায়নি। তবে বাঁধা স্থান চিনচিন করছে যন্ত্র*নায়। দাগ পড়েছে হয়ত। কী নি*র্মম ভাবে বেঁধেছে আল্লাহ মালুম! সাথে ওরাও চুপচাপ। সেই থেকে শুধু পায়চারি করছে। কেউ কোনও প্রশ্নই তো করছেনা। এতেই শঙ্কা আকাশ ছুঁচ্ছে পুষ্পিতার। এই নির্বাক থাকাই যেন দানবীয় ঝড়ের পূর্বাভাস। দলবদ্ধ পরিকল্পনা সাজিয়েই কী হা*মলা করবে ওর ওপর? এতক্ষণে তো তার অ*ক্ষত থাকার কথা নয়! কী করতে চাইছে ওরা?
পুষ্পিতার মানস্পটে হঠাৎই নেকড়ে রূপে ধরা দিলো পাঁচজন। এক সে র*ক্তে মাংসের মানুষ, আর চারপাশে ঘুরছে এই হৃষ্টপুষ্ট,হিং*স্র নেকড়ের দল। আই- ঢাই বেঁধে একটা সময় ঝাঁপিয়ে আসবে গায়ে। নিষ্ঠুর ভাবে ছি*ড়েখুঁড়ে খাবে।
পুষ্পিতার গলা শুকিয়ে যায় ভেবেই। মাথা চক্কর কাটে দূর্বলতায়। একটু পানির জন্য গলবিলটা ছটফটায় খুব। বিধিবাম! চেয়ে নেওয়ার সাহস টুকুও হয় না।
এদিকে বিপাকে পড়েছে তীব্র। চিন্তায় তার মস্তিষ্কের শিরা লাফাচ্ছে। ভীষণ বাজে ভাবে ব্য*থা উঠেছে কপালে। নাহিদকে দেওয়া কথা না রাখতে পারার ব্যর্থতায় দ*গ্ধ অন্তপট।
মানুষটা সে পা*ষাণ বলে আখ্যায়িত হলেও,বন্ধু আর মায়ের জন্য শতভাগ খাঁটি।
তীব্র রা*গে ফোসফোস করল।
শাফিন আর মিরাজকে দুমদাম চিবিয়ে খাওয়ার ইচ্ছে চলছে ভেতরে। ওদের একটু অসতর্কতায় কী ঝামেলাই না বাঁধল! এমন বুঝলে সে নিজে যেত। কোনও দিন নির্বোধ দুটোকে পাঠাত না। এই ভেড়াগুলোকে নাকী এলাকার মানুষ ভ*য়ও পায় আবার!
নাহিদের কাছে আরমান বসে। ওকে সামলানোর চেষ্টারত ছেলেটা!
হাতে একটুখানি সময় মিললেও ফের মেয়েটাকে আনতে যেতে পারত! কিন্তু যতক্ষণে সত্যিটা জেনেছে ততক্ষণে সব শেষ। করার কিচ্ছু নেই।
ওদিকে বসার ঘরে বন্দি পৌঢ় কাজী। এদিকে এই মেয়ে…
কোনটাকে নিয়ে কী করবে ভাবলেই মাথা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে তার।
তীব্র আড়চোখে একবার পুষ্পিতার দিক চাইল। অগোছালো কালো চুলে তার পিঠ, গালের একাংশ আড়ালে। দুই হাঁটু বক্ষে চেপে কবুতর ছানার ন্যায় বসে। মেয়েটা যে কী সাংঘাতিক মাত্রার ভী*তু ওর বুঝতে বাকী নেই। তাই আপাতত জিজ্ঞাসাবাদ বন্ধ। আর করেও বা? যেখানে সকল পদক্ষেপ রুদ্ধ ,সেখানে মেয়েটিকে ঘাঁটিয়ে কী লাভ?
তীব্র দৃষ্টি ফেরায়। মেজাজ শান্ত করতে সিগারেট ধরাল। হুরহুরে ভঙিতে কামড়ায় ছড়িয়ে পড়ল কুণ্ডলী। খুব আস্তে, নীচুস্বরে কেশে উঠল পুষ্পিতা। একে তৃষার্ত সে,দুইয়ে ধোয়ার আক্রমণে গলা শুদ্ধ জ্ব*লে উঠল যেন।
তীব্র এই কাশির কারণ বোঝেনি। বুঝলেও কিছু করত কী না সন্দেহ! নিরুৎসাহিত সে সিগারেট ঠোঁটে চেপে কাঠের চেয়ারে বসল গিয়ে। বন্ধ জানলার এক পাশের কপাট খুলতেই বর্ষার ছাট এসে চোখমুখে লাগে। কতক এসে মেঝেতে লুটায়। তীব্র মনোযোগী চোখে প্রকৃতি দেখল। অন্ধকারে হাত খুঁজে পাওয়া মুশকিল। বৃষ্টির ধার কমেনি।
সম্পূর্ণ ঘর নিস্তব্ধ। হাঁটা ব্যাতীত, কারো টা-টু শব্দ নেই। শাফিন চেয়েও কিছু বলতে পারছেনা। দু দুটো অকাজ করে অপরাধীর ন্যায় চুপ সে। কখন আবার বিট্টুটা ফুঁসে ওঠে ওর ওপর! দলের মধ্যে তীব্রর চ*ড় সেই বেশি খায়। এইত, তখনকার চ*ড়ে এখনও গাল ঝিমঝিম করছে কেমন ।
ও ঘর থেকে আচমকা তারস্বরে ফোন বাজল। কাজী সাহেবের বাটন ফোনের উৎকট,মাথা ধরানো ক্রিং ক্রিং আওয়াজ। সেই শব্দে পুষ্পিতার শক্তিহীন শরীরটা ফের কাঁপে। নড়েচড়ে ওঠে। ভ*য়ার্ত,ভ্রান্ত নজর চারপাশে বোলায়।
সবকিছু আগের মত দেখে শ্রান্ত ভাবে চোখ বুজল। চক্ষুপটে হানা দিলো রাহাতের পাপহীন আর মমতাময়ী সালমা বেগমের আননখানি। আচ্ছা,সবাই কি জেনে গিয়েছে সে বাড়িতে নেই? মণি নিশ্চয়ই খুঁজছে খুব? রাহাত কাঁদছে বোধ হয়।
বাকীরাও কি খুঁজছে ওকে? আপুর বিয়েটা কী হয়েছে? ছেলেগুলো যদি এখন ওকে রেপ করে মে*রে ফেলে? তাহলে তো আর কোনও দিন ফেরা হবেনা ওদের কাছে। সারাজীবনের জন্য তার পথ চলা এখানেই স্তব্ধ!
পুষ্পিতা বেশি কিছু ভাবতে পারল না। বি*ভৎস কথাগুলো মনে করলেও বক্ষস্পন্দন থমকে যাচ্ছে। আজকের এই রাত এত ভ*য়ানক কেন? কেন এত জঘন্য! এই জঘন্যতম অনুভূতির কবলে পৃথিবীর কোনও মেয়েই না পড়ুক!
কাজী সাহেবের পিঠে বাঁধা হাত, নিশপিশ করছে। ডানে-বামে কাত হচ্ছেন,মোচড়াচ্ছেন ভীষণ! ফোনটা লাগাতার বাজছে তখনও। নিশ্চয়ই তাকে ফিরতে না দেখে বাড়ি থেকে কল করেছে। তিনি শরীরটা বেশ কিছুক্ষণ নাড়া-নাড়ি করলেন। কোনও ভাবেই পকেট অবধি পৌঁছাতে পারলেন না। শেষে উপায়হীন হয়ে নরম গলায় হাঁক ছুড়লেন,
‘ বলছি, বাবারা, কেউ একটু এদিকে আসবেন?’
ডাক শুনে ওরা হাঁটা থামাল। মুশফিক কটমট করে বলল,
‘ এই বুড়োটা তো আচ্ছা জ্বা*লাচ্ছে!’
‘ দ্যাখ তো ডাকছে কেন!’
মুশফিক গটগটিয়ে এ ঘরে এলো। খ্যাক
করে বলল,
‘ কী হয়েছে কী?’
ভদ্রলোক মিনমিন করে বললেন,
‘ আমার ফোনটা বাজছে। ‘
‘ তো কী নাঁচব?’
তিনি অনুরোধ করলেন,
‘ না মানে একটু রিসিভ করে দিন না! মনে হয় আমার বউ ফোন করেছে। আসলে এরকম রাত করে কোথাও থাকিনি তো। ‘
মুশফিক ফোস করে উঠল,
‘শালা!একে নিজের বউ নেই,দুইয়ে মাথা গরম। আর এই বুইড়া আছে তার রঙ্গ নিয়ে।’
‘ একটু রিসিভ করে দিন না বাবা! নাহলে ও চিন্তা করবে। ‘
মুশফিক নাক ফুলিয়ে ফোন বের করল পাঞ্জাবি হতে। কাজী সাহেব খুশিও হতে পারলেন না, চোখের সামনেই খট করে লাইন কাটল সে। রীতিমতো বাটন টিপে বন্ধ করে দিলো। কাজী হতভম্ব হয়ে বললেন,’ এ কী?’
মুশফিক যুদ্ধ জয়ী সৈনিকের ন্যায় বলল,
‘ এবার আর কেউ ডিস্টার্ব করবেনা। এদিকে আমরাও চিন্তা করছি ওদিকে তোর বউও করুক। দেশের প্রতিটি নাগরিকের সমান অধিকার বুঝলি?’
কাজী সাহেব থতমত খেয়ে বললেন, ‘ এ্যা?’
মুশফিক আর জবাব দিলো না। হেলেদুলে ও ঘরে গেল। ভদ্রলোক আ*হত ভঙিতে বসে রইলেন,সাথে চেয়ে থাকলেন কোলের ওপর থাকা ছোট্ট খাট্টো ফোনখানার পানে।
শাফিন ক্ষণে ক্ষণে পুষ্পিতাকে দেখছে। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে মেয়েটার সংকুচিত শরীর,ভাঁজ হচ্ছে আরো। শাফিন ভ্রু কুঁচকে কুঁচকে অনেক কিছু ভাবল। জ্বিভে ঠোঁট ভিজিয়ে আলগোছে
তীব্র কাছে গিয়ে দাঁড়াল তারপর।
আস্তে করে ডাকল,
‘ বিট্টু! ‘
তীব্র জবাব তো দূর,তাকালোওনা। সে মুখ কালো করে বলল,
‘ এখনও রাগ করে আছিস? ‘
‘ কী বলবি বল।’
থমথমে জবাব। শাফিন আরেকটু কাছে ঘেঁষে বলল,
‘ বলছিলাম যে, যে ভুল করেছি সেটা তো আর শোধরানো যাবে না। আর এমনও নয় যে আমরা ওসব ইচ্ছে করে করেছি। এখন যা হচ্ছে সেটার একটা অন্যরকম রুপ দিলে হোতোনা? না মানে,
কাজী যখন আনা হলো বিয়ে পড়াতে, তখন ওনাকে খালি হাতে পাঠানো ঠিক হবে?’
তীব্র ফিরে চাইল এইবার। সরু নেত্রে শুধাল,
‘ মানে!’
তাকানোর ধরণ দেখে উশখুশের মাত্রা বেড়ে এলো শাফিনের। আমতা-আমতা করে বলল,
‘ না, ভেবে দেখলাম যে, এ ঘরে মেয়ে আছে, ও ঘরে কাজী আছে, আমরা তো বিষয়টাকে কাজে লাগাতেই পারি।’
ইঙ্গিত বুঝলা তীব্র। নিষ্পৃহ কণ্ঠে বলল,
‘নাহিদ যেভাবে ওর গার্লফ্রেন্ডের নাম ধরে কাঁ*দছে, তোর মনে হয় এখন ও অন্য মেয়েকে বিয়ে করবে?’
শাফিন উদ্বেগ নিয়ে বলল,
‘ ওর কথা কে বলছে?’
‘ তাহলে? ‘
শাফিন মাথার পেছন দিক চুলকাতে চুলকাতে সলজ্জ্বে জানাল,
‘ মেয়েটাকে আমার অনেক পছন্দ হয়েছে! মা-ও তো কদিন ধরে পাত্রী দেখার কথা বলছিলেন।
ইয়ে মানে, এখন যখন সব হাতের নাগালে,বিয়েটা তো আমি করতেই পারি।’
তীব্র আশ্চর্য চোখে চাইল। পরপর দাঁত খি*চে বলল,
‘চ*ড় মনে হয় একটাতে হয়নি, আর একটা খাবি?’
শাফিনের মিটিমিটি, লাজুক হাসিটা মুহূর্তে মুছে যায়। তীব্রর রুষ্ট চাউনী দেখেই সতর্ক কদমে ছিটকে দাঁড়ায় দূরে। ওই খসখসে, পা*থুরে হাতের মা*র খাওয়ার ইচ্ছে ফের নেই।
ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,
‘ ভালো লাগেনা! তুই সব সময় আমার সাথে এমন করিস।’
তীব্র চোখ পাঁকাল,
‘ফোট এখান থেকে।’
শাফিন আর কথা বাড়াল না। দুঃখপ্রদ মন নিয়ে ফিরে গেল স্থানে।
****
পুষ্পিতা একটু পরপরই ওদের দেখছিল। বুকের মধ্যে ঢিপঢিপে কম্পন। সেই লুকোনো দৃষ্টি যখন বাঁক নিলো তীব্রর দিক,মেরুদণ্ড সটান হলো ওমনি। মানুষটার আবিল, অক্ষিপট এদিকেই,তার ওপর। নজরে নজর মিলতেই কিঞ্চিৎ থতমত খেল সে। সেকেন্ডে,তড়িৎ বেগে চিবুক নামিয়ে আনল গলায়।
তীব্র সম্পূর্ণ সিগারেট শেষ করে উঠে দাঁড়াল। শেষটুকু জানলা দিয়ে বাইরে ফেলল। তার দীর্ঘদেহী কালো অবয়ব প্রদীপের আলোতে বিম্ব তুলল দেয়ালে। পুষ্পিতা আশঙ্কায় সিঁটিয়ে আসে। লোকটা ওইভাবে তাকিয়েছিল। এখন আবার ওর দিকেই আসছে না তো?
তীব্রর জুতোর শব্দ শোনা যায়। তবে পুষ্পিতার নিকট নয়,বন্ধুদের কাছে গেল সে। চাউনী নামিয়ে শুধু লম্বা পদযূগল দেখল পুষ্পিতা। স্বস্তির শ্বাস বেরিয়ে এলো বক্ষ চি*ড়ে।
‘ ওদিকে চল,কথা আছে।’
নাহিদের কামড়ায় ঢুকল তীব্র। বাকীরা পেছনে গেল। ফটাফট মাথা তুলল পুষ্পিতা। উৎসুক চোখে নিরীক্ষণ করে,নিশ্চিত হলো ওদের প্রস্থান। ঘর ফাঁকা,কেউ নেই। পালানোর এটাই উপযুক্ত সময়।
ঝটপট উঠতে যাবে,হঠাৎই আরমান এলো সেখানে। কথাবার্তা না বলে সেই চেয়ারে গিয়ে বসল। পুষ্পিতা বুঝে গেল তাকে পাহারা দিতেই আসা। পালানো আর হলো না। নিহ*ত ভঙিতে বসে রইল আবার।
‘ মেয়েটাকে ফেরত দিয়ে আসতে হবে।’
মিরাজ সচেতন গলায় বলল,
‘ যাব? কোনও ঝামেলা হলে?’
‘ ঝামেলা যাতে না হয় সেভাবে যেতে হবে। আর হলেও বা,চিন্তা নেই। আমি আছি…’
মুশফিক মাথা হেলিয়ে বলল,
‘ আমিও তাই ভাবছিলাম। শুধু শুধু একটা মেয়েকে আটকে রেখে তো লাভ নেই।’
শাফিন ছোট কণ্ঠে বলল,
‘ আমার প্রস্তাবটা রাখলে পারতি!’
তীব্র চোখ গরম করতেই,ব্যস্ত ভাবে বলল,
‘ ঠিক আছে, ঠিক আছে। সকাল হলে আমি নিজে গিয়ে দিয়ে আসব।’
তীব্র হাসল। বিদ্রুপ করে বলল,
‘ তুই? বিড়ালের কাছে কেউ মাছ পাহারা দেয়,শুনেছিস?’
মিরাজ,মুশফিক ফিক করে হাসল। শাফিন ঠোঁট ওল্টায়,
‘ আমি অতটাও খারাপ নই।’
তীব্র ঘোষণা দিল,
‘ মেয়েটাকে আমি পৌঁছে দেব৷ আর সেটা সকালে নয়, এক্ষুণি। ‘
ওরা হতচেতন হয়ে চাইল। মুশফিক বলল,
‘ এক্ষুণি? এখন কীভাবে? বাইরে ঝড়-বৃষ্টি!’
‘ থাক। যেহেতু মস্ত বড় একটা ব্লান্ডার করেইছি, ওটাকে সারারাত আমাদের সাথে রাখা ঠিক হবেনা। ‘
দ্বিরুক্তি করল না কেউ। স্বায় মিলিয়ে বলল,
‘ আচ্ছা, যা ভালো বুঝিস।’
নাহিদ কা*ন্না থামাল সহসা। হুলস্থুল বাঁধিয়ে বলল,
‘ আমিও যাব। মিথিলা…’
এটুকুতেই মিরাজ ধ*মকে ওঠে,
‘ চুপ! তোর মিথিলার গুষ্টি কিলাই শালা! রাত বাজে ১টা। মিথিলা বসে আছে এখনও?’
মুশফিক বলল,
‘ হ্যাঁ আছে তো। এক বাটি পায়েস নিয়ে আছে। ও গেলেই বলবে, নাও বাবু খাও। আহাম্মক কোথাকারে! ভালোবাসলিই যখন একটা ভালো মেয়েকে বাসতি। কী পেয়েছিলি ওই মেয়ের ভেতর?কী লোভী! শুনলামতো সব। বিয়ের রাতেও বয়ফ্রেন্ডের থেকে আংটি নিতে নাঁচতে নাঁচতে আসতে চায়। যত্তসব!’
নাহিদ ভেজা গলায় বলল,
‘ তোরা এখন আমাকে নিয়ে মজা নিচ্ছিস তাইনা? নিবিইত। কখনও কী কাউকে ভালোবেসেছিস না কী? সবতো করিস ন*ষ্টামি!’
মুশফিক তেঁতে ওঠে, ‘ নাহিদ! মুখ সাম…
অর্ধপথে তীব্র আটকে দেয়,
‘ আহ,থামবি তোরা?’
মুশফিক থামল। তবে চেহারায় নাহিদের প্রতি পরিষ্কার বিরক্তি ।
তীব্র বেরিয়ে আসে। আরমানের বাবা প্রবাসী। দুদিন হলো মা, বড় বোনের শ্বশুর বাড়ি বেড়াতে গিয়েছেন। ওকে শুধাল,
‘ তোদের বাড়ি তো আপাতত ফাঁকা।’
‘ হ্যাঁ। ‘
‘ তাহলে ওকে( নাহিদকে ইশারা করে) দুদিন তোর কাছে রাখ। এই অবস্থায় ওকে একা ছাড়া ঠিক হবেনা।’
আরমান মাথা দোলাল। ‘ আচ্ছা।’
ততক্ষণে নাহিদ ব্যাতীত,বাকী তিনজন কামড়ায় এসে দাঁড়াল। পুষ্পিতা গুটিশুটি মেরে থাকলেও,কান সজাগ করে রেখেছে। তাকে নিয়ে কোনও পরিকল্পনা কী না,সেসবের নীরব গোয়েন্দাগিরি! অথচ বিফল সে মুশফিক আর নাহিদের উচ্চবাচ্যের কলহ ব্যাতীত কিছুই শোনেনি।
তীব্র তাকাল ওর দিকে। কিছু বলতে গিয়ে থামল। প্রহেলিকার ন্যায় অদ্ভূত দেখাল মুখশ্রী। তার বাক্য নিঃসরনের প্রবণতা দেখেই বন্ধুরা উৎসুক চেয়ে থাকে। বিশেষ করে শাফিন! তার দৃষ্টি সন্দিহান। চেহারায় হিসেব কষার প্রবল প্রতাপ।
তীব্রর প্রসস্থ বক্ষপট ক্ষুদ্র প্রশ্বাসে ওঠানামা করল। পরপর স্বভাবসুলভ রুক্ষ গলায় বলল,
‘ তোকে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হবে। নেমে আয়।’
পুষ্পিতা থমকে, চমকে মাথা তুলল। অত্যধিক বিস্ময়ে বিমুঢ় হয়ে চেয়ে রইল মুখের দিক। কৃষ্ণকায় নেত্রদ্বয়ের বিস্মিত দৃষ্টি ভেতরটা কেমন আঙ্গারের ন্যায় জ্বা*লিয়ে দেয় তীব্রর। খুব দ্রুত চোখ সরায় সে। শুধু পুষ্পিতা নয়, আরো চার জোড়া চোখ নিস্পন্দ হলো তৎক্ষনাৎ।
শাফিন,মিরাজ, মুশফিক,আরমান হতবাক, বিভ্রান্ত৷ ওমন নজরগুলি তীব্রর অস্বস্তি বাড়ায়। ঘাড় বাঁকায় সে। কপাল কুঁচকে বলে,
‘ এভাবে কী দেখছিস?’
নড়ে উঠল ওরা। চোখেমুখে বিহ্বল ছাপ ধরে রেখে, একইসাথে একবার ডানে,একবার বামে মাথা নাড়ল।
তীব্র দৃষ্টি সরাতেই ফোস করে শ্বাস ফেলল সবাই। একে অপরকে দেখল। সমস্বরে ব্যথিত আওড়াল,
‘ এখনও তুই?’
তীব্রর এতটুক আয়ুষ্কালীন ইতিহাসে, তুমি শব্দটি বিরল। আপনির তো কোনও জায়গাই নেই। তাও আবার মেয়েদের বেলায়!
একমাত্র বয়ষ্কা নারী ব্যাতিত এই সম্মানীয় সম্বোধন তার জ্বিভ থেকে খসেনা।
স্কুল-কলেজ-ভার্সিটি… সবজায়গাতেই তীব্র অত্যধিক ডানপিটে আর বাউন্ডুলে ছিল। ক্লাসে যেত কম। কামাই করত খুব! আহামরি ছাত্র তো ছিলই না কখনও। মা*রামারি তার দৈনিক রুটিন। নিয়মমাফিক পড়াশুনা না করলেও,নিয়ম করে ওইটুকু করত। সাথে চূড়ান্ত খচ্চুরে স্বভাব। মেয়েরা ভ*য়ে কথা তো দূর, পাশ ও মারাত না । তীব্র যেদিন ক্লাশে ঢুকবে সেদিন হেড অফিসে মুখ দেখানো বাধ্যতামূলক যেন। সপ্তাহের অন্তত একটা দিন হলেও জামশেদ তালুকদারকে প্রতিষ্ঠান প্রাঙ্গনে হাজিরা দিতে হোতো। ভদ্রলোক তখনও মন্ত্রীত্ব পাননি। তবে রাজনীতির বেশ দাপুটে নেতা ছিলেন। তার টাকার গরম,ক্ষমতার গরমে কর্তৃপক্ষ কথাবার্তায় বিষয়টা মিটমাট করত।
কিন্তু তীব্রকে দমানো দুঃসাধ্য। ঊনিশ থেকে বিশ ঘটলেই তার হাতাহাতি শুরু।
সে যেবার ফ্রেশার হয়ে ভার্সিটিতে পা রাখল, র্যাগ দিতে আসা এক সিনিয়র ছেলের সঙ্গে ঝামেলা বাঁধে। তর্কের এক পর্যায়ে তীব্র খেই হারিয়ে ঘু*ষি মা*রল নাকে। সকলকে ভড়কে দিয়ে,ছেলে মাঠেই জ্ঞান হা*রাল তাতে।
সেই থেকে তীব্রকে র্যাগ দেওয়ার নাম ভুলে গেল বাকীরা। সুতনু তাকে লাইন মা*রা তো দূর,হেঁটে গেলেও মেয়েরা তাকায়না অবধি। ভার্সিটি জুড়ে নাম ছড়াল, ‘ মা*রকুটে বিট্টু’।
ধীরে ধীরে তার স্বভাবের মিরাজ ওদের সঙ্গে আলাপ হলো। বন্ধুত্ব বাড়ল। যদিও শাফিনের সঙ্গে সখ্যতা কলেজ থেকে। তাদের প্রত্যেকের পছন্দসই বরাদ্দকৃত বেঞ্চ ছিল। যেখানে কারো বসা নিষেধ। ডিপার্টমেন্টের টপ ছেলেটাও জায়গা পেতোনা সেখানে। কেউ বসলেও, তীব্ররা ক্লাশে ঢোকা মাত্র বেঞ্চ হুলস্থূল বাধিয়ে ফাঁকা করত। তীব্র মনে মনে হাসত তখন। এই যে সবাই ওকে আ*তঙ্ক হিসেবে নেয়,এ যেন ভীষণ মজার! মেয়েদের মধ্যকার ভীতি সে, এটাও মজার। তীব্র পুরোদস্তুর,স্ফূর্ত চিত্তে উপভোগ করত সেসব।
মেয়েদের সঙ্গে তার আলাপের ঘটনা দুষ্প্রাপ্য। একেবারে কর গুণে সঠিক সংখ্যা বলে দেওয়া যাবে। যতটুকু কথা বলে,তাতে না ভদ্রতা থাকে,না সভ্যতা। তামাটে ঠোঁটের ডগায় সর্বদা তুই -তোকারির হাজিরা। বন্ধুরা এতদিন, অভ্যস্ত ছিল এসবে। কিন্তু পুষ্পিতার ব্যাপারটা নিয়ে ছোট মনে একটু আশা বেঁধেছিল আজ। তীব্র যেভাবে চেয়েছিল ওর দিক,তারা ধরেই নিয়েছিল মেয়েটিকে বন্ধুর মনে ধরেছে। অথচ সেই একইরকম খরখরে ব্যবহার দেখে হতাশ তারা।
ভাবি পাওয়ার অলীক প্রত্যাশায় বেঁধে থাকা বুকটা, ভে*ঙে খানখান হলো নিমিষে।
শাফিন পল্লব ঝাপটাল। তীব্রর চেয়ে থাকা,আবার বিয়ের কথা শুনে চোটপাট করায় সে মোটামুটি নিশ্চিত হয়েছিল ওর মনে প্রেমের ঘন্টা বেজেছে। কিন্তু এটা কী হলো?
আশ্চর্য! এ অতীব আশচর্য! এত সুন্দর মেয়ে দেখেও যার মন গললনা তাকে এখন প্রিন্সেস ডায়না এনে দিতে হবে?
মনঃক্ষুন্ন তারা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ওমন তালগাছের মতো দাঁড়িয়ে দেখেই তীব্র সজোরে ঝাড়ি মা*রল,
‘ তোরা চোখের সামনে থেকে সরবি?’
‘ যাচ্ছি যাচ্ছি….’
বলেই চটপটে কদমে ঘর ছাড়ল চারজন।নিরাশ বেশে এসে বসল কাজীর পাশে।
তীব্র গম্ভীর নয়,কঠোর। চুপচাপ নয় রুঢ়। হয়না,যারা ভালো কথা বললেও ধ*মকের ন্যায় শোনায়? বাচনভঙ্গি শ্রুতিকটু! নম্রতা ঠিক আয়ত্ত্বে নেই।
পুষ্পিতার অক্ষিপুটে অবিশ্বাস। ভরসা হচ্ছেনা কানদুটোকে। সত্যি শুনেছে তো? লোকটা ওকে বাড়ি দিয়ে আসার কথা বলল? এমনও হয়? ভুলবশত তুলে আনলেও,হাতে একটা জ্বলজ্যান্ত মেয়ে পেয়ে কে ছেড়ে দেয়?
তার ফ্যালফ্যালে চাউনী তীব্রর মনে ধরল না। রুষ্ট হয়ে বলল,
‘ অ্যাই মেয়ে,নামতে বললাম তো!’
কথাটা উঁচু কণ্ঠে বলায় পুষ্পিতা নড়েচড়ে ওঠে। প্রকান্ড বাঁজ বৃক্ষচূড়ায় ঠিকড়ে পরলে যেমন ঝাঁকুনি দেয় প্রকৃতি, অনুরূপ ক*ম্পিত হয় শরীর।
তীব্র বলেই হাঁটা ধরল। পুষ্পিতার নড়ন চড়ন টের না পেয়ে ফিরে চাইল আবার। সে ঠাঁয় বসে। চোখেমুখে পরিচ্ছন্ন অস্বস্তি। তীব্র চটে গেল নিমিষে। এই মেয়ে এত অবাধ্য?
‘ কানে খাটো? একটা কথা আর কতবার বলতে হবে? না কী ইচ্ছে নেই যাওয়ার? এতগুলো ছেলের মধ্যে রাত কাটাতে চাইলে আমার কিন্তু আপত্তি নেই।’
পুষ্পিতার নীচু মস্তক ঈষৎ উঁচু হয়। চেহারার অপ্রতিভের স্পষ্ট চিহ্ন। বেশ অনেকটা সময় নিয়ে মিহি কণ্ঠে বলল,
‘ আমার ওড়নাটা…’
বীতস্পৃহায় কুঁচকে থাকা ভ্রুদ্বয় মসৃন হলো তীব্রর। পুষ্পিতার এতক্ষণ ওমন ভাঁজ হয়ে বসার অর্থ বুঝল। তবে বিশেষ প্রভাব পড়েনি মাথায়। একইরকম শক্ত গলায় বলল,
‘ সেটা কী আমার জানার কথা? আর ওড়না দিয়ে কী হবে? যেভাবে আছিস সেভাবে আয়।’
পুষ্পিতা অসহায় চোখে চাইল। আজ অবধি ঘরের বাইরে ঘোমটা ব্যাতীত পা না রাখা মেয়ে, ওড়না ছাড়া কীভাবে যাবে? জ্ঞান হারানো দশায় গায়ে ওড়না ছিল না ভাবলেই তো মূর্ছা যাচ্ছে কুণ্ঠায়। সেখানে সজ্ঞানে… না না এ অসম্ভব।
সে রা না করে বসে রইল। একটা গুন্ডা কী আর এসব বুঝবে?
তীব্রর রা*গ তুঙ্গে উঠল । চেতে একাকার হয়ে কিছু বলতে গিয়ে, কী ভেবে থামল। আশেপাশে চাইল। টানাহেঁচড়ায় এই মেয়ের ওড়না কোথায় পড়েছে সে কীভাবে জানবে? ওদিকে হাতে সময় কম। কেউ বুঝে ওঠার আগেই মেয়েটাকে রেখে আসতে পারলে বাঁচে। উপায়ন্তর না পেয়ে ফোস করে নিঃশ্বাস ফেলল।
ক্ষিপ্ত ভঙিতে গায়ের শার্ট খুলে পুষ্পিতার দিকে ছু*ড়ে মা*রল তারপর।
পুষ্পিতা ভরকে ওঠে। তীব্র তর্জনী তুলে আদেশ ছুড়ল,
‘ এটা পড়ে, দু মিনিটে আসা চাই।’
পুষ্পিতা হকচকিয়ে চেয়ে রইল তার গমনপথে। শার্ট খানা ছো*ড়ার তোপে মেঝেতে পড়েছে। সেদিকে বিভ্রান্ত লোঁচনে দেখল একবার। এখন একটা অচেনা পুরুষের কাপড় গায়ে জড়াতে হবে?
সে নিজের দিক পুনর্বার চোখ বোলাল। সহায়হীনদের সকল পরিস্থিতি এমন প্রতিকূল কেন হয়? চুলগুলো আরেকটু লম্বা হলেই তো দুপাশে ছড়িয়ে রাখা যেত।
নিরুপায় হয়ে তীব্রর চেক শার্ট হাতে তুলল পুষ্পিতা। ভাগ্য যে আর কত কী দেখাবে!
কাছে আনতেই তা থেকে সিগারেট,ঘাম আর মদের গন্ধ ভকভক করে নাকে লাগে। পেটে ঢুকে, নাড়িভুঁড়ি অবধি পাঁক খায়। দুরন্ত সেটাকে ছিটকে ফেলে দিলো ও।
তীব্রর গায়ে শুভ্র স্যান্ডো গেঞ্জি। মাংসল, ফর্সা বাহু নগ্ন। বসার ঘরে এলে, উপস্থিত প্রত্যেকে কপাল গোছাল। এইত গায়ে জামা দেখে এলো,গেল কই?
তীব্র এসেই মেঝেতে রাখা নাহিদের ব্যাগ হাতাল। ভেবেছিল এক্সট্রা শার্ট থাকবে। কিন্তু কয়েকটা শাড়ি ছাড়া কিছু নেই। তিরিক্ষ মেজাজে বিড়বিড় করল,
‘ শালা নিজের জন্য কিছু আনেনি।’
চ সূচক শব্দ করল ক্ষোভে। আরমান জিজ্ঞেস করল,
‘ তোর শা…
প্রশ্নের মধ্যেই অতি ধীর পায়ে হাজির হলো পুষ্পিতা। পড়নের জামার ওপর, তীব্রর শার্ট। একেবারেই অন্য পন্থা না পেয়ে গায়ে জড়িয়েছে। বোতাম পেছনে,কলারের দিকটা সামনে দেয়া। রোগা-শোকা হওয়ায়, স্বাস্থ্যবাণ তীব্রর জামা ঢুলছে বাতাসে।
আরমান বাকীটুকু আর বলতে পারেনি। সহসা থেমে গেল। বাকীরা বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে পড়ল বসা থেকে। তীব্রর শার্ট কোনও মেয়ের শরীরে? এই পৃথিবী কাঁ*পানো আমূল,বোল পরিবর্তনের ঘটনাচক্রে তারা কিংকর্তব্যবিমুঢ়!
মিরাজ চক্ষু ঝাপটে তীব্রর দিক চায়, আবার পুষ্পিতাকে দেখে। হতচকিত সে টেনে টেনে বলল,
‘ বন্ধুগণ! আমি কি অন্ধ হইয়া গিয়াছি? যাহা দেখিতেছি আপনারাও কি তাহাই দেখিতে পাইতেছেন?’
একেকজন হতচেতন থেকেই মাথা ঝাঁকায়। অথচ তীব্র নির্বিকার। তার মধ্যে এসব ভাবনাচিন্তা দেখা গেল না। নিরুত্তর বের হতে নিলেই মুশফিক বলল,
‘ এই বুড়োটাকে কী করব, বললিনা তো…’
কাজী সাহেব চুপটি করে ছিলেন। কথাটা শুনেই গতর নাড়াচাড়া দিলো। ভ*য়ে ভ*য়ে চাইলেন তীব্রর দিক। এই যে পালের গোঁদা সে কী আর বোঝেননি? এখন এই ছেলে তাকে হ*ত্যার আদেশ দেবেনা তো? মিনমিনিয়ে অনুনয় করলেন,
‘ আমাকে ছেড়ে দিন। আমি তো কিছু করিনি।’
তীব্র একটু চুপ থেকে বলল,
‘ এটাকে সকালে সাথে করে, পৌঁছে দিয়ে আসবি। বাড়ির ঠিকানা, এলাকা, ভালো করে চিনে রাখবি। বাই এনি চান্স যদি মুখ খোলেই, একেবারে ঘরে গিয়ে জ*বাই করে আসব।’
বাড়ি দিয়ে আসার কথাশুনেই পৌঢ়ার চোখমুখ চকচকিয়ে ওঠে। ছাড়া যে পাবে এই ঢেড়। মুখ খুলবে কোন দুঃখে? কোনও রকম জানে বাঁচলেই হলো!
পেছনে সঙ্কীর্ণ শরীরে, লক্ষী মেয়ের মত দাঁড়িয়ে ছিল পুষ্পিতা। দুশ্চিন্তায় নিমীলিত। জ*বাই শব্দটা শুনতেই আৎকে উঠল অচিরাৎ। ঝুলে পড়ল চোয়াল। কোটর থেকে বাইরে আসতে চাওয়া চোখদুটো বিকট করে চাইল তীব্রর চওড়া পিঠের দিকে। ত্রাসের সূক্ষ্ণ, ধাঁ*রাল তীরটা গতিতে এসেই ফুসফুস ছিদ্র করে চলে গেল। এমন ভয়াব*হ লোকদের খপ্পরে পড়েছে ভাবতেই মাথা ঘুরছে। কোনওরকম রুদ্ধশ্বাসে দাঁড়িয়ে রইল সে।
তীব্র দৃষ্টি ফেলল তার ওপর। পুষ্পিতার ওমন গোল গোল চোখ দেখে কর্কশ স্বরে বলল,
‘ কী ব্যাপার? দাঁড়িয়ে থাকতে বলেছি? সামনে হাঁট।’
পুষ্পিতা হুশে ফেরে। ঝটপট আঁখি নামায়। হাঁটবে কী,পায়ে জোরই যে নেই। সব ঠকঠক করছে ডরে। কোনও রকম বিবশ কদমে সামনে চলল সে।
তীব্র পেছনে আসছে। স্পষ্ট তার পদধ্বনি। অথচ পুষ্পিতা এগোতে পারছে না। খুব গ্রাসে অপ্রসারিত মস্তক। মনে হচ্ছে, এক্ষুণি একটা ছু*রি এনেই তীব্র পোচ বসাবে গলায়। নলি কে*টে ওকে ঝুলিয়ে দেবে গাছে।
তীব্রর তার পিলপিল কদম মা*রাতে সময় লাগেনি। ওকে ফেলে এগিয়ে যায় সে। গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে আসে সামনে। নিরবে উঠতে বোঝায়। পুষ্পিতা দোয়া পড়তে পড়তে চুপচাপ পেছনের দরজা খুলে বসল।
গাড়ি ছুটতে দেখে, জানলা থেকে চোখ গুলো ফেরত এলো। আরমান আশা*হত কণ্ঠে আওড়াল,
‘ এ জন্মে কী বিট্টুটার প্রেম হবেনা গাইস?’
বাকীরা ভগ্নহৃদয়ে মাথা নাড়ল। যার মানে, ‘জানিনা,আমরা জানিনা। ‘
*****
শূনশান নিশি। রাস্তায় এক-দুটো যানবাহন। হেডলাইটের আলো ছাড়া বাকীসব অন্ধকার। বাতাসের ঝাপটা প্রবল। ঝড় কমলেও বৃষ্টি আছে। বাঁজ পড়ার মিহি আওয়াজ । জানলা-দরজা বন্ধ গাড়ির চালক, এক ভ*য়ানক গুন্ডা। পুষ্পিতার দেহ যতটা পারছে সেঁটে যাচ্ছে দরজায়।
যা কিছু ঘটল আজ, সব কেমন দুঃস্বপ্নের মতোন লাগছে। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মাঝে দোদুল্যমান যেন। সে কী সত্যিই বাড়ি ফিরছে? এই দূর্ভাগা মেয়েটির ওপর সৃষ্টিকর্তা এত প্রসন্ন কবে হলেন!
জীবন কোনও দিন সালমার আঙুল ছাড়া এক কদম হাঁটেনি। স্কুল-কলেজ সবখানে যাওয়ার সময় তিনিই রিক্সায় তুলে দিতেন। আবার ছুটির সময় দাঁড়িয়ে থাকতেন গেটে। তখন নুহারা পাশাপাশি থাকত। দুজন আনন্দ চিত্তে সঙ্গী হোতো যাত্রার।
সেই মেয়ে প্রথম বার, একটা অপরিচিত মাস্তানের সঙ্গে একা গড়িতে বসে। ভাবলেও শরীরের সব লোমকূপ সচকিতে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে শঙ্কায়। পরমুহূর্তে চোখমুখের আ*তঙ্ক একটু নিভল তার। লোকটা নিশ্চয়ই অতটাও খারাপ নয়! খারাপ হলে ওকে ফেরত দিতে যেত না।
গতকাল,মিথিলার গায়ে- হলুদের হুজুগে এক ফোঁটা ঘুমোয়নি পুষ্পিতা। সারাদিন ছুটেছে কাজে। গাড়ির হেলদোলে এখন চোখ বুজে আসছে তাই। তন্দ্রায় পুষ্পিতার মাথাটা হেলে পড়তে চাইল। অকষাৎ মেয়েলী মন ছল্কে উঠল সন্দেহে।
এত রাতে ঝড়ের মধ্যে ওকে বাড়িতেই পৌঁছে দেবে তো? এমন ভালো পুরুষ নিশ্চয়ই দুনিয়ায় আসেনি! কোনও ভাবে ওকে বেচে দিতে নিয়ে যাচ্ছে কি?
পুষ্পিতার সদ্য স্বস্তিটুকু শেষ। বরফ বাতাসে পালিয়ে গেল ঘুম। একেবারে তটস্থ বেশে,কাঠ হয়ে বসে রইল এবার।
এদিকে তীব্রর মেজাজ টনটন করছে ক্রো*ধে। এত রাতে একটা মেয়েকে নিয়ে রওনা তো করল,রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশ ধরলে? জামশেদ তালুকদারকে যে আগেভাগে কিছু জানাবে, ফোনটাও তো আনেনি সাথে। শেষে সব বানচাল না হলে হয়!
গাড়ি চলছে অনেকক্ষণ। গতি বেশ জোড়াল। হুশহুশ করে এগোচ্ছে চাকা। তন্মধ্যে আযানের মধুর সুর ভেসে এলো। পুষ্পিতা নড়েচড়ে বসে। চাইল বাইরে। এত দূর ওকে নিয়ে এসেছিল ছেলেগুলো? কোথায় আছে এখন? কতক্ষণ লাগবে আর? পুষ্পিতার অবিশ্রান্ত জ্বিভ নিশপিশ করছে খুব! জিজ্ঞেস করবে কী? না থাক! গুণ্ডাটা যা বদমেজাজি! শেষে রেগে গেলে! তক্ষুণি, নিরব গাড়িতে তীব্রর উষ্ণ কণ্ঠ শোনা যায়,
‘ ভুল করে এনেছিলাম বলে নিজে পৌঁছে দিচ্ছি। যদি এ নিয়ে কোনও ঝামেলা হয়,বা পরিবারের লোকজন আঈনী কোনও ইস্যু ক্রিয়েট করে, পরেরবার কিন্তু আর ফেরত দিতে আসব না। বোঝা গেল?’
উত্তর জানতে ভিউ মিররে চাইল সে। কী শীতল হুম* কি!পুষ্পিতার বুক ধুকপুক করে কাঁ*পছে। আয়নাতেই চোখাচোখি হলো। ত্রাসিত নজর নামিয়ে মাথা কাত করল সে।
কচ্ছপের বেগে সূর্য উঠছে পূর্বে। সদ্য সদ্য মলিন প্রভার লহরী, সুবিধে খোঁজার আশায়৷ রাস্তায় কাকপক্ষীও নেই। শুধু দোয়েলের কিচকিচ শব্দ।
বাড়ির গেট সম্পূর্ণ ফাঁকা, দারোয়ান নেই দেখেই গাড়ি এখানে এনে থামাল তীব্র।
পুষ্পিতার চোখ ঝলকে ওঠে চেনা নিবাস দেখে। এখনও প্যান্ডেল টাঙানো। লাইট বসানো। বাড়ি দেখেই, উত্তেজনায় টগবগায় তার সমস্ত কোষ। তীব্র কাচ নামাতেও পারেনি হন্তদন্ত ভঙিতে বেরিয়ে পড়ল ও। কিছু বুঝে ওঠার আগেই রকেট বেগে ছুট্টে ঢুকে গেল ভেতরে।
আচমকা ব্যাপারটায় তীব্র হতভম্ব হয়। চোখ-নাক কুঁচকে বলে ,’ আজব মেয়ে তো!’
এদিকে, টানা কয়েক ঘন্টা একভাবে মাস্ক আর ক্যাপ পরে সে। চুল আর নাকের ছিদ্র বেশ অনেকক্ষণ যাবত সুরসুর করছিল। থুতনীর আশপাশ ঘামে চটচটে। তীব্র এক টানে ক্যাপ খুলে, চুলে আঙুল চালাল। গাড়ির হুইল ঘোরাতে ঘোরাতে মাস্ক খুলে ফেলে দিলো বাইরে।
বাড়ির দারোয়ান স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইলেন। হাতের তালুতে দাঁত মাজার গুড়ো। বৃহৎ নেত্রে দেখে গেলেন তীব্রর যাওয়াটুকু।
গত রাতে সালমার চিৎকার,কান্না*কাটিতে শুধু বিল্ডিং নয়,পুরো এলাকায় ছড়িয়ে গিয়েছে পুষ্পিতা নিখোঁজ। এমনকি আজকেই থানায় জিডি করার কথা। সবার মতো তিনিও জানতেন পুষ্পিতাকে পাওয়া যাচ্ছেনা। কিন্তু গাড়ির শব্দ,সে মেয়ের ছুটে যাওয়া, পরপর তীব্রকে স্বশরীরে দেখে নড়াচড়া বেমালুম ভুলে বসলেন। ওমন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই ঘটনা একের পর এক সাজালেন লোকটি।
দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে মাথা ঝাঁকালেন। বিড়বিড় করে বললেন,
‘ মেয়ে তাহলে সারারাত বিট্টু মাস্তানের সঙ্গে ছিল?’
চলবে
দুঃখিত! এত দেরী করে দেওয়ায়। কী করব বলুন,আপনাদের লেখিকা যে বারো মাসিক রোগী। ভালোবেসে একটু সহ্য করুন না হয়!