কলমে: নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
(০৭)
সূর্য তখন দিগন্তের ওপরে। আলো ফুটতে না ফুটতেই শহরের ফিলিং স্টেশনে মানুষের ভিড়। ঢাকায়, পঙ্গপালের মতো ছুটে চলা জনজীবন প্রতিটা দিনের মতো ব্যস্ত আজও। ঘড়িতে সাতটা ছুঁয়েছে। নিরত নগরে তখন গিজগিজে হুল্লোড়৷
এমন সাত সকালেই এক গাদা ফাইলপত্র বগলদাবা করে, তালুকদার বাড়িতে হাজির হয়েছেন আবুল হাসান। গতকাল রাতেই জামশেদ তালুকদার তলব পাঠিয়েছেন টেলিফোনে। দুটো জমি কেনার ব্যাপারে হিসেব- নিকেশের বিরাট বন্দোবস্ত সাড়বেন।
জামশেদ মানুষ হিসেবে বিন্দুগত! অতিরিক্ত রাত জাগা,বেলা করে ঘুমোনো,অসময়ে খাবার গ্রহণের নথি তার নেই।
মাত্রই নাস্তা সেড়ে বসেছেন। কাপের রং চা ফুরোতে না ফুরোতেই হাজিরা দিলো আবুল।
জামশেদ বসার ঘরের, সেন্টার টেবিলেই কাগজপত্র মেলে বসলেন। পাশে বিনয়ী ভঙিতে দাঁড়িয়ে আবুল। বসতে বললেও বসলেন না। ওনার গদগদ কণ্ঠের এক উত্তর,
‘ স্যার, আপনার সামনে আমি কী করে বসি?’
লোকটার এই অমায়িক দাসত্বে বরাবরই প্রসন্ন হন জামশেদ। আজকেও সমান হলেন। এই তুষ্টতায় কতবার যে আবুলের মাইনে বাড়িয়েছেন তিনি!
দুজনের আলাপ-আলোচনার মধ্যেই দোরগোড়ায় পা রাখল তীব্র। দু চোখ ছাপানো তন্দ্রা। মুখবিবরে জ্বলজ্বলে ক্লান্তি। সোনালী চুলের অবস্থা দফারফা। ফর্সা চেহারা অবসন্নতায় মুঁদেছে ভীষণ!
তার শুভ্র কেডসের শব্দে মুখ তুললেন দুজনে। যথারীতি তীব্র এগারটার আগে ঘুম থেকে ওঠেনা। পিতা যতটা সময় নিষ্ঠ,পূত্র ততোধিক উদাসীন,খামখেয়ালি। সে মানুষকে এই ভোর ভোর চৌকাঠে দেখে অবাক হলেন জামশেদ। প্রশ্ন ছুড়লেন সবেগে,
‘ রাতে বাইরে ছিলে?’
তীব্র হেঁটে এসে, সোজা বাবার মুখোমুখি সোফাটায় বসল। হাল্কা ফোমের, নরম গদি দুলে উঠল তোপে। অলস ভঙিতে, দুপাশে ছড়াল মাংসল হাত। জবাবের বদলে পালটা প্রশ্ন করল,
‘ ছেলে কোথায় থাকে না থাকে,বাড়ি ফেরে না ফেরে তার খোঁজ ও রাখেন না?’
ইঙ্গিতে শোধিত বিদ্রুপ। জামশেদ রাগতে চেয়েও রাগলেন না। শান্তভাবে শুধালেন,
‘ ফেরোনি কেন? কী করছিলে?’
তীব্র বাধ্যগত উত্তর দেয়না। আবুলের দিক চেয়ে ভ্রু গোছায়।
‘ এটা সকাল সকাল এখানে কী করছে?’
তার এইভাবে তাকানো,তারওপর হঠাৎ কথার বাণে থতমত খেলেন আবুল। অপ্রস্তুত হাতে নাকের চশমাখানা ওপরে ঠেললেন একটু। হাসার চেষ্টা চালিয়ে জানালেন,
‘ জি, স্যারের কিছু হিসেবের খাতা দেখাতে এসেছি।’
জামশেদের মনোযোগ ছেলের ওপর। সূক্ষ্ম নেত্রে দেখছেন ওকে। গায়ে জামা নেই,অগোছালো, বিশৃঙ্খল ভাবমূর্তি। কটাক্ষ করে বললেন,
‘ তা সারারত কোথায় ছিলে? নিশ্চয়ই কোনও ক্লাবে মদের আড্ডায়? নাহলে জুয়া,তাস এসবে তাইত?’
তীব্রর পরিশ্রান্ত জবাব,
‘ রোজ রোজ এই এক কথা জিজ্ঞেস করে কী মজা পান?’
অতীষ্ঠ শ্বাস ফেললেন তালুকদার। অসহ্য ভঙিতে আওড়ালেন,
‘ তোমার মধ্যে নূন্যতম লজ্জাও নেই।’
‘ আশ্চর্য! যেটা নারীর জিনিস, সেটা দিয়ে আমি কী করব?’
বিফল, পরাস্ত ভঙিতে মাথা নাড়লেন জামশেদ। তীব্র নিরুৎসাহিত, হাই তুলল। আবুল হাসান চোখ এপাশ- ওপাশ করে দুজনকে দেখছিলেন। জামশেদ ছেলের কাছে প্রতিবারের মতো আজও পরাজিত। ওনার মন জেতার আরেকটি অনবদ্য সুযোগ লুফে নিতে নিশপিশ করে ওঠে জ্বিভটা। বিস্তর হেসে, রয়ে- সয়ে বললেন
‘ বলছিলাম কী, আসলে স্যার, আপনি হলেন এই দেশের স্বরাষ্টমন্ত্রীর একমাত্র ছেলে। আপনি যদি রাত বিরেতে এইভাবে বাইরে থাকেন স্যারের তো একটু অসুবিধে হয় তাইনা!’
তীব্র সদ্য চোখ বুজেছিল। পঙ্কিল অক্ষি ঝট করে চাইল এইবার। স্থূল কণ্ঠে হুঙ্কার ছুড়ল
‘ এই মন্ত্রীর চামচা… কথা কম। ওইদিনের মার ভুলে গেছিস?
আবুলের হাসি মুছে যায়। অযাচিত অপমানে মুখশ্রী থমথমে হয়ে আসে। জামশেদ বিরক্ত গলায় বললেন,
‘ আহ তীব্র! আবুলের বয়স আমার কাছাকাছি। অন্তত একটু ভদ্রভাবে কথা বলতে পারো তো!’
তীব্র মুখের ওপর বলল,
‘ পারিনা। আপনাকে তো আপনি বলছি। সম্মান ওভারলোডেড! আপনি সেই আনন্দেই থাকুন। এসব নিয়ে মাথা ঘামিয়ে যে সময়টা নষ্ট হবে,সেইটুকু বাঁচিয়ে বরং আমার মাকে দিন। ‘
দ্বিতীয় বার উত্তর পেলেন না জামশেদ। উষ্ণ চোখে খি*টমিট করে চেয়ে রইলেন শুধু। প্রবল একখানা ইচ্ছে জাগল, ছেলের সাদা গালে ঠাস করে প্রকান্ড চ*ড় বসানোর। পারলেন না! ধৈর্যর যাতাকলে রাগ-ঢাক পি*ষে, বাধ্য হয়ে চোখ রাখলেন খাতায়।
তীব্র এত কিছু খেয়াল করলে তো! ভ্রুক্ষেপহীন সে, তার মত বসে। এদিক-ওদিক চাইল প্রথমে। পরপর উঁচু গলায় ডাক ছুড়ল,
‘ মা! মা!’
জামশেদ মনোযোগে ব্যঘাত পেলেন। ধীরস্থির জবাব দিলেন,
‘ তোমার মা রান্নাঘরে। এত জোরে না চিল্লিয়ে, কাছে গিয়ে কথা বলো।’
‘ এই সকাল বেলা মা রান্নাঘরে কেন?’
চোখ তুললেন তিনি,
‘ আবুলের জন্য নাস্তার ব্যবস্থা করছে।’
তীব্র কপাল কুঁচকে বলল,
‘ বাড়িতে এত গুলো কাজের লোক থাকতে আপনার চামচার জন্য আমার মা নাস্তা বানাবে কেন?’
আবুল অদৃশ্য দাঁত খিঁচ*লেন। বারবার ‘চামচা’ শব্দটা গায়ে আ*গুন ঢেলে দিচ্ছে। পরপর হঠাৎই এক অলীক কল্পনায় গুলিয়ে ফেললেন নিজেকে। টেবিলের ওপর রাখা, চায়ের খালি কাচের কাপটা উঠিয়েই তীব্রর মাথায় ভে*ঙেছেন তিনি। গলগল করে র*ক্ত বের হয়েছে। আ*র্তনাদ করে সোফাতেই লুটিয়ে পড়েছে তীব্র।
আবুল বিজয়ের উল্লাসে পৈ*শাচিক হাসলেন৷ আকষ্মিক মুখ থু*বড়ে পড়লেন বাস্তবে। একইরকম অক্ষ*ত তীব্রকে দেখেই মুখটা চুপসে গেল আবার। বিদ্বিষ্ট চেহারায় খেলে গেল চরম হতাশা।
জামশেদ বললেন,
‘ এটা আবার কেমন কথা? আবুল আমার কর্মচারী হলেও বাড়ির গেস্ট। তার আপ্যায়ন আছেনা?’
তীব্র কাঁধ উঁচায়,
‘ থাকবেনা কেন? কিন্তু গেস্ট আপনার, আপনি আপ্যায়ন করুন না। মাকে খাটাচ্ছেন কেন? বয়স হচ্ছে তার, এখন অন্তত তাকে রেহাই দেওয়া উচিত।’
জামশেদ আশ্চর্য হয়ে বললেন,
‘ অদ্ভূত তো! তুমি এমনভাবে বোলছো যেন আমি তোমার মাকে দিয়ে কী না কী করাই! শুধু তো এক কাপ ক…’
পথিমধ্যে লুৎফার ছটফটে স্বর ভেসে এলো। কথায় বিঘ্ন ঘটায় জামশেদ থেমে গেলেন। লুৎফা উদ্বীগ্ন কদমে এগিয়ে এলেন ছেলের নিকট। কণ্ঠ মোলায়েম,
‘ কখন এলি বাপ? রাতে ফিরবিনা,একবার জানাবি ত। কতক্ষণ বসে ছিলাম আমি!’
তীব্রর নিরেট,চোখ-মুখ শিথিল হলো। হাস্যহীন, নরম কণ্ঠে জানাল,
‘ কতবার তো বলেছি মা,রাত একটা বাজলে আর অপেক্ষা করবেনা। তাও বসে থাকো কেন?’
‘ মায়ের মন, তুই ওসব বুঝবি না।’
তীব্র ব্যর্থ শ্বাস টানে। লুৎফা হাত দিয়ে ওর অমসৃণ চুলগুলো যত্ন সমেত গুছিয়ে দিলেন। জামশেদের গায়ের রং শ্যামলা গোছের। তীব্র পেয়েছে মায়ের মতোন। তবে চোখদুটো ভিন্ন। জন্মের পর গায়ের রং আর এই নেত্রমণির দরুন আত্মীয়-স্বজন সবাই খ্রিষ্টান,বিদেশী বলত ওকে। কাড়া-কাড়ি পড়ত কোলে নেওয়ার। লুৎফার জীবনের সমস্ত অপূর্ণতা এই শুভ্র মুখটা দেখলে ঘুঁচে যায়। মাথায় নিরন্তর বোলানো হাতটা তীব্র মুঠোয় ধরল। চোখ তুলে মৃদূ হাসল একটু। এই বিরাটা ভূমিতে এই একটি নারী তার সবটা জুড়ে।
লুৎফার হঠাৎ খেয়াল পড়ল ছেলের গায়ের দিক। জিজ্ঞেস করলেন,
‘ তোর জামা কোথায় আব্বা?’
জামশেদ কাজে ব্যস্ত। সাদা পাতার,ছোপছোপ কালিতে পুরোপুরি ডুবে গিয়েছেন। মা-ছেলেতে আহামরি মনোনিবেশি নন।
তীব্র নিজের দিক চাইল এইবার। গতকাল রাতে ঘটা সমস্ত ঘটনা ছবির মতোন হানা দিল চোখে। সর্বপ্রথম ভাসল, পুষ্পিতার শোভিত,সুন্দর মুখটা৷ ঢিলেঢালা শার্টটা পড়ে,নত মাথায়, ধীরুজ পায়ে তার পেছনে এসে দাঁড়ানোর সেই চলমান চিত্র।
একটু থেমে, সময় নিয়ে বলল,
‘ পুরোনো হয়ে গিয়েছে। ফেলে দিয়েছি। ‘
উত্তরের সঙ্গে উঠেও দাঁড়াল সহসা। বেশিক্ষণ মায়ের সামনে থাকলে প্রশ্নবাণ ছুটবে নিশ্চিত৷ প্রসঙ্গ পাল্টাতে আবুলকে দেখিয়ে শুধাল,
‘ ওর জন্য কফি বানিয়েছ না?’
দ্বিতীয় বারের মতো থতমত খায় আবুল। নড়েচড়ে ওঠে। তীব্র বারবার তার দিকে আঙুল তাক করা,আর হুটহাট তাকানোয় অপ্রতিভ হয়ে পড়ছেন।
লুৎফা মাথা দোলালেন৷ তীব্র ফটাফট বলল,
‘ ওটা আমার রুমে পাঠাও। আর সাথে খাবারও দিও। মাথা ধরেছে, খেয়ে ঘুমাব।’
জামশেদ চোখ-নাক কোঁচকালেন ওমনি। কিছু বলার আগেই তীব্র সামনে দিয়ে নিরুদ্বেগ হেঁটে যায়৷ আবুলের চেহারায় অন্ধকার নামল৷ মনে মনে এই মানহানীর, যথাযথ প্রতিশোধ স্পর্হায় টগবগাল র*ক্তকণা।
লুৎফা দ্বিধাদ্বন্দে পড়লেন৷ ভীত দৃষ্টি স্বামীর দিকে। কী করবেন, কী না করবেন… কার কথা শুনবেন,আবার ঝামেলা হবে কী না এসব নিয়ে মহাচিন্তিত। তীব্র কয়েক সিড়ি উঠে থামল। ঘাড় বাঁকাল মায়ের দিক।
সুদৃঢ় কণ্ঠে বলল,’ ওনার দিকে তাকাচ্ছো কেন? হোম মিনিস্টারের কাছে নিশ্চয়ই ছেলের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি!’
জামশেদ চোখ বুজে, ঠোঁট ফুলিয়ে শ্বাস ফেললেন৷ তীব্র মজা পেয়ে গেল। মিটিমিটি হেসে রওনা করল কামড়ায়। লুৎফা ঠাঁয় দাঁড়িয়ে দেখে,তিনি বললেন,
‘ এখনও দাঁড়িয়ে আছো কেন? তোমার হীরের টুকরো ছেলের হুকুম শোনোনি? যাও, যা বলেছে পাঠাও। আর আবুলের নাস্তাটা রোকেয়াকে দিতে বলো।’
আবুল ভেতর ভেতর ফুঁ*সলেন। এত অসম্মানের পর এই নাস্তা তার গলা দিয়ে নামবে? কিন্তু জামশেদের মুখের ওপর না বলতে পারবেন না। তীব্রর প্রতি এক বুক দাউদাউ করা জ্ব*লন্ত ক্ষোভ গিলে চুপচাপ স্তম্ভ সেজে রইলেন। মনের সবটুকু রা*গ মেটালেন ভবিষ্যৎ-এ কোনও ফুরসত পাওয়ার আশায়।
****
পুষ্পিতার ধীর-স্থির কদম চঞ্চল আজ। স্নিগ্ধ আদোলে ফুরফুরে দ্যুতি। অস্থির,চপল ভঙিতে সিড়ি বেয়ে উঠছে সে। বক্ষে তোল*পাড়। মনে আনন্দ ধ্বনির রমরমে গীতালি। গতরাত পরেও, কাছের মানুষগুলোর নিকট আবার ফিরতে পারবে ভাবেনি। আরো একবার চোখ ভরে দেখবে সবাইকে তাও বোঝেনি। মণি,রাহাত,নুহা… সবাই চমকে যাবেনা ওকে দেখে? তাদের সবার সান্নিধ্য, পূনর্বার পাওয়ার উচ্ছাসে,লোভে, পুষ্পিতার শীর্ণ তনু উদ্বেজিত।
সে কয়েক ধাপ নীচ থেকেই ঘরের দিক চাইল। সদর দরজা হা করে খোলা। বসার ঘরে গিজগিজে মানুষ দেখা যায়। সকলের মুখ চিন্তিত,মলিন । কেউ সোফায় বসে, কেউ মেঝেতে।
পুষ্পিতার নজর শুরুতেই বর্তাল থমথমে চেহারার খোরশেদুলের ওপর৷ ভীষণ অনিচ্ছ্বায়,থম মেরে বসে তিনি। ওর নিখোঁজ হওয়া,রাহাত,সালমার কান্নাকা*টিতে একটি মানুষও রাতে চোখ বোজেননি। চক্ষুলজ্জার আয়ত্বে পরে ওনাকেও বসে থাকতে হয়েছে। ঘুমোতে গেলেই যদি সন্দেহ করে কেউ? খোরশেদুল ভেতর ভেতর দ্বিগুন ক্ষেপেছেন এতে। মেয়েটা বিদেয় হয়েও এক ফোঁটা শান্তি দিয়ে গেল না।
বাবার কাছে, ফ্লোরে পা গুটিয়ে বসে রাহাত৷ ক্ষুদ্র,রাঙা ঠোঁট তিরতির করছে৷ কা*ন্নায় ফোলা বাচ্চা মুখ৷ তার পাশে মামা -মামী, আরো অনেকে। ওপাশের সোফায় খোরশেদুলের বৃদ্ধ পিতা-মাতা বসে৷ প্রৌঢ়ার বয়স হলেও শক্ত-সামর্থ্য চেহারা।
পুষ্পিতা নীরবে সালমা বেগমকে খুঁজল। পেলোও এক সময়। দেয়ালে, মাথা-পিঠ মিশিয়ে বসে উনি৷ পড়নের শাড়িসহ, বি*ধ্বস্ত দশা৷ শুষ্ক চোখ নিষ্প্রাণ । কোটর সদ্য শুকালেও,গালে স্পষ্ট জলের দাগ। গলা বসেছে কা*ন্নায়। নুহা ওনাকে আগলে রাখা দুহাতে। ওদের ফেরার কথা গতকাল,বিয়ে শেষ হলেই। কিন্তু প্রিয় বান্ধুবির লাপাত্তা হওয়ার দরুন যেতে পারেনি৷ নুহার মা ফিরে গিয়েছেন। তার চাকরির ছুটি নেই।
সবার মধ্যে মিথিলাকে দেখা গেল না। পুষ্পিতা বুঝল,বিয়ে শেষ ওর। আজই হয়ত, শ্বশুর বাড়ির প্রথম ভোর।
সে পিলপিল কদমে চৌকাঠে এসে থামে।
তন্মধ্যে সালমার নাক টানার আওয়াজ এলো। ডুকরে কেঁদে উঠলেন ফের। একটু পরপরই হচ্ছে এমন। নুহা তাকে সামলাতে কিছু বলতে চাইল। বাক্য নিঃসরনের পূর্বেই চোখ পড়ল দরজায়। পুষ্পিতার সাথে চোখা-চোখি হতেই ছ্যাত করে ওঠে বক্ষপট। সেকেন্ডে,সজোরে চিৎকার করল,
‘ পুষ্পিতা?’
এক কথায় চমকে গেল সকলে। নেতানো চোখমুখ গুলি সজাগ হয়ে,তীরের বেগে নিক্ষেপ হয় ওদিক। পুষ্পিতা ছলছল চোখে, ঠোঁটে হাসি টানল। নরম পা টেনে, ভেতরে ঢুকল। নুহা উল্কার বেগে দৌড়ে গিয়েই জড়িয়ে ধরল ওকে। হাঁস-ফাঁস করে শুধাল,
‘ তুই,তুই কোথায় ছিলি? সবাই তোকে কত খুঁজেছি জানিস?’
বসা থেকে দাঁড়িয়ে গিয়েছে সবাই। উৎসুক তাদের চাউনী। ভোর -ভোর পুষ্পিতার হাজিরায় বিভ্রান্তও সমান। খোরশেদুল স্তম্ভিত। কপালে গাঢ় ভাঁজের পরিচ্ছন্ন রেখা। বিট্টু মাস্তান পুষ্পিতাকে নিয়ে আবার ফেরত দিয়ে গেল কেন? তিনি সুক্ষ্ণ চোখে ওর আপাদমস্তক দেখলেন। নজরে বিঁধল পুষ্পিতার পড়নের চেক শার্ট । এই শার্টের মতো অবিকল একটা কাল সেই গুন্ডাটার গায়ে দেখেছিলেন না?
বিট্টু ওকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল, এই ব্যাপারে সে নিশ্চিত। চাক্ষুষ সাক্ষী। তাহলে আবার শার্ট পরিয়ে সাদরে পাঠিয়েও দিলো? মেয়ে রূপ দেখিয়েই কী ঘায়েল করল ওদের? এমনও হয়? না কী কোনও রঙ্গ শুরু হয়েছে দুজনের? পুষ্পিতার দাগহীন,নিঁখুত মুখবিবর ভাবনায় ফেলল তাকে। একটা গুন্ডার দল, কোনও মেয়েকে তুলে নিয়ে গেলে এমন অনাহত কী করে পাঠায়?
খোরশেদুল নেতিবাচক মন্তব্য উগড়ে দিতে হা করতে নিলেন। কিছু একটা ভেবেই, থেমে গেলেন আবার। এখন মুখ খোলা মানে নিজেরই বিপদ ডাকা। একবার যদি সবাই টের পায় তিনি সব জানতেন,রক্ষে থাকবেনা তবে। এখন আর কিচ্ছু করার? আপদ দূর হয়েছে ভাবলেও লাভের কিছু হয়নি। ফিরে যখন এসছেই, সেই আগের মত দাঁত চে*পে হজম করতে হবে এটাকে।
সালমা বেগম কিছুক্ষণ হতবাক চেয়ে রইলেন। অবিশ্বাস্য লোঁচন তার। পুষ্পিতা সত্যিই ফিরেছে, মাথায় ঢুকতেই ত্রস্ত এলোমেলো শাড়িখানা গুছিয়ে দাঁড়ালেন। রাহাত চোখ মুছল সবেগে। স্বাস্থ্যবাণ গতরটা দৌড়ে গিয়েই আকড়ে ধরল বোনের কোমড়। পুষ্পিতার অশ্রুসজল চোখে চাইল। মুচকি হেসে মাথা নামিয়ে রাহাতের মাথায় চুমু খেল। এর মধ্যেই সালমা হন্তদন্ত ভঙিতে এসে জাপ্টে ধরলেন ওকে।
শক্ত হস্তে বুকের সঙ্গে মিশিয়ে রাখলেন কিয়ৎক্ষণ। কণ্ঠনালী
উত্তেজনায় কম্পিত। ছটফটিয়ে বললেন,
‘ ককোথায় ছিলি মা? কোথায় চলে গিয়েছিলি? বলে যাবিত মণি কে। তোকে দেখতে না পেয়ে আমার কী অবস্থা হয়ে ছিল জানিস?’
পুষ্পিতা চোখ বুজে শ্বাস টানে। প্রখর তৃপ্তিতে অনুভব করে মণির গা থেকে ছুটে আসা ওই মাতৃত্বের সুগন্ধ।
উপস্থিত অনেকের তীক্ষ্ণ চোখ তখন, তার ওপর। আবর্ত হয় গোটা দেহে। বাইরে রাত পার করা একটি জোয়ান মেয়ের শরীরের অস্বাভাবিক চিহ্ন টোকাতে ব্যস্ত যাদের শকুনে দৃষ্টি।
সালমা বেগম কাঁ*দছেন। সারারাত আত*ঙ্কে থরথর করা বুকটা প্রশান্তিতে নিভেছে। তবে এই কান্না খুশির। ওকে ফেরত পাওয়ার আনন্দের। চোখের জলে পুষ্পিতার কপাল ভেঁজে। সরে এসে স্বযত্নে অশ্রু মোছায় সে। নিশ্চিন্ত করতে বলে,
‘ আমি ঠিক আছি মণি। আর কেঁদো না।’
রাহাতের নিষ্পাপ বায়না, ‘ ছোটপু আমাকে ছেড়ে এভাবে আর যাবে না তো?’
পুষ্পিতা হেসে মাথা নাড়ল। বলল, ‘ কোথায় যাব? তোমরা ছাড়া আর কে আছে আমার?’
খোরশেদুলের সঙ্গে আরও একটি চেহারায় সমান বিতৃষ্ণা। ষাট ছুঁইছুঁই বৃদ্ধা আলেয়া বেগম। বোনের মেয়ের ওপর ছেলের বউয়ের এই আহামরি আহ্লাদ দেখলেই তার গা-পিত্তি জ্ব*লে । চোখ-নাক কুঁচকে দম ফেললেন উনি। টেনে টেনে শুধালেন,
‘ তা মাইয়া,আছিলা কই রাইতে? কার বাড়িত?’
এতক্ষণ নিশ্চিন্ত থাকা পুষ্পিতার বুক কাঁ*পল অচিরাৎ। সবাই উত্তরের আশায় চেয়ে ওর দিক। অতগুলো প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে,পুষ্পিতা সত্ত্বা গুলিয়ে ফেলল। ঢোক গিলল শ*ঙ্কায়। কী বলবে এখন? কী উত্তর দেবে? একে তো ছেলে গুলো মেহেরবানী করে ওকে দিয়ে গিয়েছে। একটা নখও স্পর্শ করেনি ওর। দুইয়ে গাড়িতে বসে, তীব্রর ছো*ড়া সেই সরাসরি হুমকি! তাছাড়া সত্যিটা বললে যদি কেউ বিশ্বাস না করে? হিতে বিপরীত হয়? পুষ্পিতার হৃদপিণ্ড ছলাৎ ছলাৎ করছে। প্রাতের শীতল বায়ুতেও ঘামাচ্ছে কপাল।
ওর চুপ থাকায় বৃদ্ধার সন্দেহ বাড়ল। শক্ত গলায় তাগাদা দিলেন,
‘ কী ব্যাপার? মুখে কথা নাই ক্যান? কই গেছিলা কাইল? নাগর টাগ…
সালমার আন্দাজ আছে শ্বাশুড়ির কথাবার্তার ধরণ। মহিকার মুখে লাগাম নেই। কথা সম্পূর্ণ করার আগেই, কে*ড়ে নিলেন তিনি,
‘আম্মা,মেয়েটা তো মাত্র ফিরল আর আপনি জেরা করতে শুরু করে দিলেন? এসব কী পরে শোনা যাবেনা?’
খোরশেদুলের পিতা, চোখ দিয়ে স্ত্রীকে চুপ থাকতে বোঝালেন। আলেয়া মুখ বাঁকালেন,তবে ফিরতি কথা বাড়ালেন না। খোরশেদুল,সন্তপর্ণে ‘চ’ সূচক শব্দ করল। এই সুযোগে যদি আসল কথা ফাঁস হোতো,তবেই তো জমত ব্যাপারটা।
জিজ্ঞাসাবাদ স্থগিত হওয়ায় স্বস্তি পেলো পুষ্পিতা। ভয়ে জমাট বক্ষপট ওঠানামা করল।
সালমা ওর মাথার এক পাশে হাত বোলালেন। মোলায়েম গলায় বললেন,
‘ মুখটা কী শুকিয়েছে! চল খাবার দেই। আয়…’
নুহা বলল, ‘ যা।’
পুষ্পিতা ঘাড় হেলায়। এই ওসিলায় প্রসঙ্গ চাপা পরে যদি! মণির পেছনে এক কদম ফেলতেই,দোরের বাইরে থেকে কেউ বললেন,
‘ দাঁড়ান ভাবি দাঁড়ান,খাওয়াবেন তো৷ এত তাড়া কীসের?’
কণ্ঠের উৎসের দিক দৃষ্টি গুলো ঘুরে যায়। ত্ত্র থামলেন দুজনে। এই গোটা বিল্ডিংয়ের মালিক, মামুন শাহ, তার স্ত্রী ডলি বেগম, আর দারোয়ান হাকিম এসেছেন।
ডলি বেগম নুহাকে বললেন,
‘ একটু জায়গা দেবে? ভেতরে যাব।’
সে ভদ্রমেয়ের মতো এক পাশ হয়ে দাঁড়াল। হাকিম বাইরে রইলেও,স্বামী সহ ভেতরে ঢুকলেন তিনি। প্রথমেই চোখ দিয়ে সম্পূর্ণ আগা-মাথা মাপলেন পুষ্পিতার। ওষ্ঠপুটে চতুরের ন্যায় চকচকে হাসি। কোটর ভর্তি প্রহসন। সালমার দিক চেয়ে বললেন,
‘ তা ভাবী,কাল তো খুব কা*ন্নাকাটি করলেন মেয়ের জন্য৷ অবশেষে সে ফিরলো তাহলে? ‘
‘ হ্যাঁ ভাবি, আল্লাহ রহম করেছেন। ‘
ডলি বেগম ওপর-নীচ মাথা ঝাঁকালেন। বললেন,
‘ বেশ,বেশ। সিড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে কানে এলো,কে যেন জিজ্ঞেস করছিল পুষ্পিতা কোথায় ছিল রাতে! কিন্তু ওর কোনও পালটা উত্তর শুনলাম না । অবশ্য যেখানে ছিল, সেটাতো আর বলার মত জায়গা নয়। লজ্জা-শরমের একটা বালাই আছেনা? কী, তাইত পুষ্পিতা?’
পুষ্পিতা বুঝতে না পেরে, প্রশ্ন নিয়ে চাইল। বুক ধুকপুক করছে গতিতে। অজানা আশ*ঙ্কার সুনামি উত্তাল তুলেছে যেন। উপস্থিত সকলের দৃষ্টি জিজ্ঞাসু। সালমা বললেন,
‘ ঠিক বুঝলাম না ভাবি।’
মামুন শাহ একটা কাঠের চেয়ার খালি দেখে বসলেন। বেশিক্ষণ দাঁড়ালে তার পায়ের ব্যথা বাড়ে। ডলি বেগম সাজানো গোছানো শব্দে বললেন,
‘ জি,বোঝাতেই তো দো-তলা থেকে চার তলায় আসা। আসলে, পুষ্পিতা কোথায় ছিল রাতে, তা ও জীবনেও বলবে কী না সন্দেহ। তাই ভাবলাম আমিই বরং আপনাদের জানিয়ে যাই। মানুষ হিসেবে উপকার করার দায়িত্ব তো আছে বলুন।’
কথাগুলো সবার দিক চেয়ে চেয়ে বললেন তিনি। পুষ্পিতার নিঃশ্বাস ঘন হয়ে আসছে। বুকের কম্পন জোড়াল৷ কী বলবেন তিনি? কী শোনাবেন?
ডলি বেগম ওর ব্যগ্র,উতলা চোখের দিক চেয়েই দৃঢ়তার সহিত ঘোষণা করলেন,
‘ পুষ্পিতা কাল সারা-রাত এলাকার মাস্তান বিট্টুর সাথে ছিল।’
রক্ত ছলকে ওঠে পুষ্পিতার৷ নিভু,স্পন্দিত নেত্রযূগল হকচকায়। হতবিহ্বল আওড়াল,
‘ বিট্টু মাস্তান!’
খোরশেদুলের চোখ দুটি জ্বলজ্বল করে ওঠে। এইত,এটাই তো বলার জন্য ভেতরটা উশখুশ করছিল খুব! এবার তোর কী হবে পুষ্পিতা?
পরপর ভ্রু বাঁকালেন, ‘ এসব কথা ওনারা কী করে জানলেন? ওখানে তো তখন কেউ ছিল না।’
আলেয়া বেগম কোঁচকানো ললাট আরো কুঁচকে বললেন, ‘ বিট্টুডা কেডা? খোরশেদ,এই ছ্যারা ক্যাডা?’
দারোয়ান বাইরে থেকে আগ বাড়িয়ে জবাব দেন,
‘ মাস্তান খালা। নামকরা গুন্ডা। এমন কোনও খারাপ কাজ নেই যা করেনা।’
প্রৌঢ়া ভ্রু কপালে তুললেন। হা-হুতাশ করে বললেন,
‘ ও আল্লাহ! গুন্ডা? একটা গুন্ডার লগে কী না এই মাইয়া রাত কাটাইয়া আইল!’
রাত কাটানো কথার যথার্থ ইঙ্গিত বুঝতে সময় লাগেনি পুষ্পিতার৷ বজ্রাহতের ন্যায় নিস্প্রভ হয়ে পড়ল তার আঁখিদ্বয়৷ বিট্টু মাস্তান নামটা তার পরিচিত,সঙ্গে অপছন্দের। অথচ ওদের সঙ্গেই ছিল কাল? ওই বিলাই চোখী কর্কশ ছেলেটা? সেই বুঝি বিট্টু? বাকীগুলো তার উগ্র সাঙ্গপাঙ্গ? কিন্তু এখন অবধি যা যা বিশেষণ শুনেছে ওদের, তাতে তো ওরা খারাপ,জঘন্য গোছের ছেলে-পেলে। ইভটিজিং-এ পটু ওমন লোকগুলো, ওকে একা পেয়েও ছাড়ল কেন তবে? আর সব জেনেশুনেও বিট্টু মাস্তানের বন্ধুর সঙ্গে মিথিলাই বা সম্পর্কে জড়াবে কেন?
মস্তিষ্কের প্রতিটি শিরা দপদপিয়ে উঠল ওর। প্রশ্ন অনেক,কিন্তু উত্তর নেই।
তার চুপ থাকাই যেন রাস্তা দেখালেন সকলকে। ডলি বেগম ফোড়ন কে*টে বললেন,
‘ তবে কী আর বানিয়ে বলছি খালাম্মা? এইত, পুষ্পিতা সামনেই দাঁড়িয়ে। আমি ভুল বলছি কী না ওকে জিজ্ঞেস করুন নাহয়।’
নূহা নামটা জানে। উত্তরাতেও বিট্টু মাস্তান চর্চিত। তবে দেখেনি কখনও। সে আর এই কী একই লোক? এদিকে স্তব্ধের ন্যায়, হা করে রইল রাহাত। ছোট্ট মাথার আশেপাশে মন্ত্রের ন্যায় বাজছে বিট্টু নাম।
পুষ্পিতা নীচু কণ্ঠে বলল, ‘ আন্টি, আমার মনে হয় আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে।’
ডলি বেগম খুব অবাক হলেন এমনভাবে বললেন,
‘ ভুল? আমার? আচ্ছা বেশ,মানলাম আমি ভুল বলছি। কিন্তু হাকিম তো সব দেখেছে.. ওই বলুক। কী হাকিম ভাই! কী দেখেছেন বলুন সবাইকে।’
হাকিম একটু কেশে, স্পষ্ট গলায় বললেন’ জি। আমি নিজের চোখে দেখেছি,একটু আগেই বিট্টু গুন্ডা গাড়ি করে আপনাদের মেয়েকে নামিয়ে দিয়ে গিয়েছে।’
আরেক দফা,বিস্ময়ের শব্দযুক্ত বাঁজ পড়ল ঘরটায়। পুষ্পিতার সবটা এলোমেলো লাগছে।
‘ শুনলেন তো? এরপর নিশ্চয়ই আমার ভুল ধরা হবেনা। পুষ্পিতা যদি বিট্টুর সাথে নাই থাকবে তবে ওকে পৌঁছে দিলো কেন? ওর কাছেই বা সে গেল কী করে?’
পুষ্পিতার শ্বাস আটকে আসছে। বিচলিত চেহারায় কণ্ঠনালি অবরুদ্ধ। নুহা ওকে টেনে নিজের দিক ফেরায়। উতলা হয়ে শুধায়,
‘ চুপ করে আছিস কেন? বল কিছু। সত্যিই কি বিট্টু মাস্তানের সঙ্গে ছিলি তুই? ‘
পুষ্পিতা দিশেহারা দশায় জ্বিভে ঠোঁট ভেজাল। চরিত্রে কালি লেপনের করুণ চিত্র, স্পষ্ট দেখছে সে। থেমে থেমে বলল,
‘ আমি জানিনা। আমি ওদের কারোর মুখ দেখিনি।’
ডলি কণ্ঠ শৃঙ্গে তুলে বললেন,
‘ ওদের? তার মানে আরো অনেকে ছিল পুষ্পিতা? ঠিক কজনের সাথে ছিলে তা নিশ্চয়ই বলতে পারবে।’
জড়বুদ্ধির মতো এতক্ষণ সবটা শুনছিলেন সালমা। কথা কোথা থেকে কোথায় গড়াচ্ছে ভেবে বাকরুদ্ধ তিনি। ডলির শেষ কথাটায় স্ফুলিঙ্গের ন্যায় জ্বলে উঠলেন এবার,
‘ ঠিক করে কথা বলুন ভাবি। আপনি কারো কথার ভিত্তিতে এভাবে আমার মেয়ের চরিত্র নিয়ে আজেবাজে বলবেন না।’
‘ আমি আজেবাজে কেন বলব? আমার কী ঠ্যাকা পড়েছে বলুন! হাকিম গিয়ে বলেছে বলেইত জানলাম।’
‘ উনি কী বলেছেন, কী বলেননি তা দিয়ে আমি কী করব? চোখের দেখা সবসময় ঠিক হয় তাও কিন্তু না।’
নিশ্চুপ মামুন শাহ মুখ খুললেন এবার। ভদ্রভাবে বললেন,
‘ দেখুন আপা,শুধু এই এলাকা না,আশেপাশের যে কোনও এলাকায় বিট্টু মাস্তান কে সবাই এক ডাকে চেনে। বাচ্চা-গাচ্চাও ওর চেহারার হুবুহু বর্ণনা দিতে পারবে। সেখানে হাকিম আমার বাড়িতে ডিউটি করছে আজকে বিশ বছর। ওর ভুল হবে এই যুক্তিটা হাস্যকর লাগছেনা?’
হাকিম স্ব-উদ্যোগে বলল,
‘ ভুল তো হয়নি স্যার। নিজের বাপের মুখ চিনতে ভুল করলেও বিট্টু মাস্তানেরটা ভুল হবেনা। আমি যা দেখেছি ঠিক দেখেছি। বিশ্বাস নাহলে,আপনারা মেয়েটাকেই জিজ্ঞেস করুন না!’
পুষ্পিতা মাথা নত করে দাঁড়িয়ে। তার চোখ ছাপানো সমুদ্র। যেন,যে কোনও সময় ভাসিয়ে নেবে পৃথিবী। সালমা তৎপর ওর দিক চাইলেন। নীরব দেখে কণ্ঠ উঁচু করে বললেন,
‘ কী রে! চুপ করে আছিস কেন? শুনতে পাচ্ছিস না সবাই কী বলছে? তোকে বিট্টু মাস্তান দিয়ে গেছে এখানে?’
পুষ্পিতা টলমলে আঁখি তুলল। অসহায় কণ্ঠে বলল,
‘ আমি সত্যিই জানিনা মণি। যে আমাকে দিয়ে গেল সে ওই গুন্ডাটা হলে….’
ডলি বেগম কথা হামলে নিলেন মাঝপথে ,
‘ দিয়ে গেল? কে দিয়ে গেল শুনি? এর মানে তুমি স্বীকার করলে পুষ্পিতা, বিট্টু নাহলেও,তুমি কোনও ছেলের সঙ্গে নিশ্চিত ছিলে?’
‘ ছিলাম। কিন্তু আপনারা যা বোঝাতে চাইছেন তেমন কিছুই হয়নি। ওরা কেউই আমাকে ছোঁয়নি অবধি।’
আলেয়া উপহাস করে বললেন,
‘ এহ, আইছে আমার সতি সাবেত্তি! রাইত কাটাইয়া আইল,আর এরে নাকী ছোয়নাই। আইজকাল গো পুরুষ মাইনষে ল্যাদা মাইয়া ছাড়েনা সেইহানে ওরে নাকী এমনে এমনে ছাড়ছে।’
নুহা চেঁতে বলল,
‘ আপনি একজন বয়ষ্ক মানুষ হয়েও আন্দাজে কথা বলছেন কেন? পুষ্পিতা আগে বলুক সবটা। না শুনেই লাফাচ্ছেন।’
খোরশেদুল পিঠে দুহাত বেঁধে সবটা দেখছেন,শুনছেন। ঠোঁটের কোণায় উপভোগ্য চাপা হাসি।
হাকিম বাইরে থেকে বললেন,
‘ কী আর বলবে ও মেয়ে? ওকে দেখেই তো সব সাফ সাফ বোঝা যাচ্ছে। আচ্ছা আপনারাই বলুন, একটা গোটা রাত,জোয়ান মেয়ে বাড়িতে নেই, ভোর বেলা ফিরল তাও পড়নে ছেলেদের পোশাক। এতেই কি সব কিছু প্রমাণ হয়না?’
ডলি তাল মিলিয়ে বললেন,
‘ হ্যাঁ তাইত। বাড়িতে ওঠার সময় ঘোমটার জন্য চেহারাও দেখা যায়নি ওর। সে কেন ওড়না ছাড়া পরপুরুষের জামা গায়ে দাঁড়িয়ে এখনও ? এই জামা কার? বলুন,আপনারাই বলুন।’
চেঁচামেচিতে চারপাশের ফ্ল্যাটের লোকজন জমা হয়েছে। উত্তরে ‘ ঠিক , ঠিক’ ধ্বনি তুললেন কতকে।
পুষ্পিতা ঠোঁট চেপে ধরল কা*ন্না আটকাতে। শ্বাসনালী ছি*ড়েখুঁড়ে যাচ্ছে। এমন ভাবে সম্মানের আহুতিও লেখা ছিল কপালে? এর চাইতে ওদের হাতে কিছু একটা হলেই তো ভালো হোতো।
সালমা এতক্ষণে পুষ্পিতার বেশভূষায় নজর দিলেন। মেয়ে ফেরার আনন্দে যা খেয়াল করেননি এতক্ষণ, মনোযোগী হলেন তাতে। পুষ্পিতার খোলা, অবিন্যস্ত চুল,পড়নে অচেনা এক পুরুষের কাপড়। নিজেই এলোমেলো হয়ে গেলেন নেতিবাচক ভাবনায়। ত্রস্ত ওর হাত চেপে এপাশে নিয়ে এলেন। পুষ্পিতা ভরকাল খানিক। সালমা কণ্ঠ চেপে বললেন,
‘ আমার কাছে বল, কাল কী হয়েছে? সত্যিই তুই ওই গুন্ডাদের সঙ্গে ছিলি? বিট্টু কি তোকে তুলে নিয়ে গেছিল? কী করেছে ওরা? কজন ছিল? জোর করেছে তোর সাথে?’
পুষ্পিতা বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়,সালমা বেগম জামা সরিয়ে হাত পা দেখতে নিলে। নিহত,ভেজা কণ্ঠে বলল
‘ মণি! তুমিও?’
আলেয়া বেগম গলা উঁচিয়ে বললেন,
‘ কোনায় গিয়া ফুসুরফাসুর কইরা লাভ হইব না বউমা। তোমার বইন ঝির কুকীর্তি ফাঁস হইছে৷ শাক দিয়া আর কত মাছ ঢাইকবা?’
পাশ থেকে এক ভদ্রমহিলা গলা মেলালেন,
‘ ঠিকই তো৷ ছি! ছি! এসে থেকে মেয়েটার কাজকর্ম দেখে কত ভালো ভেবেছিলাম। আর শেষে বের হলো কী না এমন দুশ্চরিত্রা? ‘
আরো একাধিক কণ্ঠ সামিল হয় সঙ্গে। ছি ছি, ধিক্কার ছুড়ে দেয় পুষ্পিতার ওপর।
পুষ্পিতা চোখ খিঁচে, বুজে নিলো। খা*মচে ধরল কামিজ। জন্ম থেকে সে চুপচাপ,চাপা,দূর্বল। তর্ক করতে পারেনা। অপটু, কাউকে মুখের ওপর জবাব দিতে। যদি পারত,আজ একটু হলেও কী প্রতিবাদ করতে পারতোনা এসবের? অনাথ,অবলা মেয়েটা নিজের অসহায়ত্বের স্বীকার প্রতি ক্ষণে ক্ষণে। আজ যেন পৃথিবী একটু বেশিই নির্ম*ম হলো তার ওপর। আচ্ছা, এই নির্ম*মতার শেষ কী নেই?
সালমা আ*ক্রোশে চেঁচিয়ে উঠলেন,
‘ চুপ করুন আপনারা! পুষ্পিতা আমার মেয়ে। সে যদি কিছু করেও আসে,আমি বুঝব। মা*রতে হয়, বকতে হয়, আমি করব। আপনাদের ওকে কিছু বলার কোনও অধিকার নেই।’
আলেয়া বেগম পালটা তেঁতে বললেন,
‘ থাইকব না ক্যান? এই মাইয়া আমার পোলার ঘাড়ে বইয়া খায়, দায়, থাহে। অহন আমার পোলার মান -ইজ্জত লইয়া তামশা করব আর আমি মা হইয়া কিছু কমুনা ক্যান?
তারপর ছেলের দিক চেয়ে বললেন,
‘ ও খোরশেদ, কী সব্বনাশ হইল বাপ! এই মাইয়া তো বিয়ার আগেই আকাম কইরা ঘরে আইল। সমাজে অহন মুখ দেখাইবি ক্যামতে?’
পুষ্পিতা বোজা গলায় সাফাই গাইল,
‘ দাদু, আপনি বিশ্বাস করুন আমার সাথে ওরা কিছু করেনি। ওরাতো আমায় ভুল করে তু…’
আলেয়া মাঝপথে ধমকে বললেন,
‘ তুই চুপ কর মাইয়া। তোর নাখান কলঙ্কিনীর মুখে কোনও কথা হুনাও পাপ। খোরশেদ,মায় কী কই হুন। এই মাইয়া কইলাম নাপাকি৷ অখন এরে সংসারে রাখোন মানে আল্লাহর গজব টাইনা আনা।’
নুহা রে*গেমেগে বলল, ‘ আশ্চর্য মহিলা তো আপনি! বয়স হয়েছে,এক পা কবরে গিয়েছে অথচ কূট-কাচালি কমেনি?’
খোরশেদ মোটা গলায় ধমক দিলেন,
‘ এই মেয়ে! তুমি কোন সাহসে আমার মায়ের সাথে এইভাবে কথা বলছো? তাও আবার আমার বাসায়,আমার সামনে দাঁড়িয়ে? ‘
‘ আর আপনার মা যে বলছে? তা এতক্ষণ শোনেননি? উনি একজন গুরুজন হয়ে কীভাবে এত নোংরা ভাষা বলছেন শুনি?’
‘ যা বলেছে বেশ করেছে! ভুলটা কী বলেছে এখানে? তোমার বান্ধুবি কু-কাজ করে আসতে পারবে আর কেউ বললেই দোষ? ‘
পুষ্পিতার মামী, নুরুন্নাহারের বয়স কম। তিনি একভাবে মায়া মায়া চোখে চেয়ে আছেন ওর দিক। পুষ্পিতার গাল,গলা ভিজিয়ে দেওয়া অশ্রুটুকুন দেখে বুকটা হুহু করছে। মেয়েটার দৃষ্টিতে যেন জন্ম-জন্মান্তরের দুঃখ! ভীষণ আক্ষেপে, আস্তে করে বললেন,
‘ আহারে! সবাই মিলে কেমন করছে ওর সাথে!’
জমির চাপা গলায় বললেন ,
‘ তুমি চুপ থাকো। এখন আমরা কিছু বললেই খোরশেদ ভাই ইনিয়ে-বিনিয়ে ওকে আমাদের ঘাড়ে গছাতে চাইবেন।’
নুরুন্নাহার তিঁতিবিরক্ত হয়ে চাইলেন। স্বামীর প্রতি মুখ বাঁকালেন আলগোছে। মানুষের মামী জল্লাদ হতে শুনেছে,দেখেছে। অথচ এই বেলায় যেন সব পাশা ওল্টানো। পুষ্পিতার বাবা খারাপ,মামা খারাপ, না আসলে মেয়েটার কপালই খারাপ। তার ভাবনার সুতো ছি*ড়ল সালমার কড়া কণ্ঠে। শ্বশুরবাড়ির লোকদের সামনেই স্বামীর ওপর ফুঁসে উঠলেন তিনি।
‘ মুখ সামলে কথা বলবে খোরশেদুল! পুষ্পিতা কেমন মেয়ে তুমি জানোনা?’
খোরশেদুল নাক ফাঁপিয়ে বললেন,
‘ না জানিনা। এত দিন ভদ্র মেয়ে সাজার নাটক করত তো। সেই নাটক আজ ধরা পড়েছে।আসল রূপ বেরিয়ে এসেছে এখন । সত্যি পুষ্পিতা,অবাক হচ্ছি তোকে দেখে, পরপরুষের সঙ্গে বিয়ে ছাড়া থেকে এসেও, কী বেহায়ার মত দাঁড়িয়ে আছিস।
অন্য কেউ হলে গলায় দড়ি দিত এতক্ষণে। ‘
পুষ্পিতার গায়ে কাঁটার ন্যায় বিঁধল কথাটা। ক্ষ*ত- বিক্ষ*ত করে দিলো অন্তঃপট। চিবুক তুলে,নরম গলায় বলল,
‘ আমি জানি খালুজান,আপনারা কেউই এখন আমার কোনও কথা বিশ্বাস করবেন না। যাই বলিনা কেন,আঙুল ঠিকই তুলবেন আমার চরিত্রে। কিন্তু আমার আল্লাহ দেখেছেন,তিনিই সব কিছুর একমাত্র সাক্ষী। উনি জানেন,আমি পবিত্র।’
আলেয়া বিদ্রুপ করে বললেন, ‘ ওরে আমার পবিত্তির কইন্যা রে। এক পোলার লগে থাকলি,শুইলি তার কাপড় পইরা ফিইরা আইলি আবার কস আমি পবিত্তির? আল্লাহ,কালে কালে কত কী দেখাইবা আর?’
পুষ্পিতা দাঁতে নিম্নাষ্ঠ চে*পে ধরে। দন্ত পাটির ধাঁরাল স্পর্শে নরম ত্বক ছি*ড়ে যায়৷ র*ক্তের নোনতা স্বাদ জ্বিভে লাগলেও হুশ-জ্ঞান এলো না। পুরো গলবিলটাই যে তি*ক্ততায় ভরে। সেখানে র*ক্তের লবনাক্ততা আর এমন কী?
সালমা বেগম ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন,
‘ আম্মা, আর একটাও বাজে কথা বলবেন না বলে দিলাম।’
‘ কী কইরবা কইলে? আমারে হুমকি দিতাছো তুমি? খোরশেদ দেইখা ল,তোর বউ আমারে চ্যাত দেহায়৷ আমার পোলার উপার বইনের মাইয়া খাওয়ায়, পড়ায়,আবার তার নোং*রামি ধামাচাপাও দিতে চায়? কী সুন্দার মগের মুল্লুক পাইছে একেকজন!’
মহিদুল আলম কপালে আঙুল চেপে বসে। তার স্ত্রী আগে থেকেই ঝগ*ড়ুটে স্বভাবের। যেখানে যাবেন স্বইচ্ছায় ঢুকবেন ঝামেলায়। এই বয়সেও তার বদল হয়নি। লাগামহীন, সীমাশূন্য নারীটিকে থামাতে বরাবর ব্যর্থ তিনি। আজ বয়স হয়েছে। হাতে লাঠি উঠেছে। এখন তো সফল হওয়ার চিন্তাও বিলাসিতা। তিনি হতাশ ভঙিতে চুপ রইলেন আগের ন্যায়।
সালমা বললেন, ‘ আপনারা বাইরের লোকের কথায় আমার মেয়েকে যা তা বলতে পারেন না।’
খোরশেদুল বললেন,
‘ এখন আমরা বলছি তাই গায়ে লাগছে সালমা? একটুপর তো পুরো এলাকা বলবে। আঙুল তুলবে তোমার বোনের মেয়ের ওপর। থুথু ছুড়বে ওর মুখে। এত যে গলা বাড়াচ্ছো, তা পুষ্পিতা চুপ কেন? আমি পবিত্র,আমার কিছু হয়নি এই দুটো কথা ছাড়া তো কিছু শুনছিনা। এর মানে নিশ্চয়ই এমন কিছু করে এসেছে, যা বলার মুখ ওর নেই।’
ডলি বেগম পুষ্পিতার কনুই টেনে নিজের দিক ফেরালেন। কা*ন্নায় মেয়েটার বুক অবধি ভেজা। অথচ সেই অশ্রুর রেশ বিন্দুমাত্র প্রভাব ফেলল না ওনাতে। নিজের মতো সন্দিহান গলায় বললেন,
‘ আচ্ছা পুষ্পিতা, একটা কথা বলবে? তুমি আবার নিজের ইচ্ছেতে বিট্টুর সঙ্গে যাওনিতো? না মানে তুমি সুন্দরী, আবার সেই মাস্তানেরও মেয়েদের প্রতি ছুঁকছুঁকে স্বভাব। তারওপর যেমন ফিটফাট অবস্থায় ফিরলে, এখানে নিশ্চয়ই জোরজবরদস্তির কোনও ব্যাপার নেই। যা হয়েছে তোমার সম্মতিতে তাইনা? তা কতদিন ধরে চলছে এসব নোং*রামি? ‘
পুষ্পিতা স্তব্ধ নেত্রে চাইল। টুপ করে গালের জল গড়িয়ে পড়ল মেঝেতে। বিহ্বলতায়,অবশ জ্বিভে প্রত্যুত্তর পেলোনা। অপমানে -লজ্জায় মরে যাওয়ার প্রয়াস জাগল শুধু।
অথচ তেলে-বেগুনে জ্ব*লে ওঠে নুহা। পুষ্পিতাকে খপাৎ করে ধরার ন্যায় সরিয়ে,নিজে মুখোমুখি দাঁড়ায় ডলির।
রুষ্ট, ক্রুদ্ধ হয়ে বলল,
‘ খবরদার আরেকটা বাজে কথা বলেছেন তো। এত লোকের সামনে এসব বলতে আপনার লজ্জা লাগছেনা? কেমন মানুষ আপনি? ‘
‘ আমার লজ্জা লাগবে কেন? আমি কী ন*ষ্টামি করে এসেছি নাকী ওর মত?’
পুষ্পিতার মাথা ঘুরছে। কেন ফিরে এলো ও? কেন ম*রে গেলনা কাল?
সালমা বেগম দিশাহীন,বাকহারা। এত এত আত্মীয়, স্বজন, অচেনা মানুষের মধ্যে ঘরের মেয়ের ইজ্জতে প্রশ্ন ওঠায় হৃদপিণ্ড জ্বলে যায় তার।
শক্ত গলায় বললেন,
‘ হ্যাঁ তাই৷ আমাদের মেয়ে খারাপ। তাতে আপনাদের কী? আমরা বুঝে নেব এসব। আপনি তো পরপকার করতে খবরটা দিতে এসেছিলেন ভাবি। দেওয়া হয়ে গিয়েছে? এবার আসুন।’
ডলি অবাক হয়ে বললেন,
‘ আসুন মানে? আপনার কি মনে হয়,এরকম একটা কথা জেনেও আমরা চুপচাপ চলে যাব? এমনি এমনিত আসিনি ভাই। আসল কথাটাইত এখনও বলা বাকী।’
খোরশেদুল আগ্রহভরে শুধালেন,’ কী কথা? ‘
মামুন শাহ চুপচাপ ছিলেন এতক্ষণ। মানুষ হিসেবেও বেশ নরম তিনি৷ ভাড়াটিয়াদের ওপর চোটপাট যা করার ডলিই করেন সর্বদা৷ হাল্কা গলা খাকাড়ি দিয়ে বললেন,
‘ দেখুন ভাইজান! বাড়িটা আমার বাবার ঋন নিয়ে তোলা। আমিও তেমন কাজ-বাজ করিনা। বাসা ভাড়া তুলেই খাই। এখন আমার যা মনে হয় আপনাদের মেয়ের সাথে বিট্টু মাস্তানের একটা গভীর সম্পর্ক আছে। ও যেখানে থাকবে বিট্টুর ও আনাগোনা বাড়বে সেখানে৷ হোক সেটা আমার বাড়ি বা অন্য কোথাও। কিন্তু কথা হোলো, আজ বিট্টু আসবে,একটা সময় হাজির হবে তার দলবল। বাড়ির নীচ তলায় ব্যাচেলর মেয়েরা থাকে। তাছাড়া আমারও দুটো শেয়ানা মেয়ে আছে। ওরকম ছেলে আসা মানে,বুঝতে পারছেন নিশ্চয়ই কী বলতে চাইছি? আমি কোন আক্কেলে এত বড় রিস্ক নিই বলুন তো!’
পুষ্পিতা ব্যকুল গলায় বলল,
‘ আপনারা কেন এসব বলছেন? আমার ওই ছেলের সাথে কোনও সম্পর্ক নেই।’
খোরশেদুলের মেজাজ চটে। হাতের মুঠোয় আপনা-আপনি আসা মোক্ষম সুবিধা হাতছাড়া না করার আন্দোলন চলে মাথায়। তিরষ্কার করে বললেন,
‘ সম্পর্ক ছাড়াই পরপুরুষ নিয়ে ফষ্টি-নষ্টি করে এলি তাইনা? খুব সম্মান বাঁচিয়েছিস আমার। লজ্জাও করেনা কথা বলতে? ন*ষ্টা মেয়ে কোথাকারে!’
সালমা উচু স্বরে উচ্চারণ করলেন,’ খোরশেদ!’
বি*ষবাক্যে পুষ্পিতার বক্ষ ভেদ করে চলে যায়। একেকজনের কথার সাথে প্রতিটি নিঃশ্বাস হয়ে উঠেছে বিষাক্ত। চোখের উষ্ণ জলে ভেতরের তা*ন্ডব টগবগায় আরো। সহ্য সীমা পার হয় এবার। খোরশেদুলের চোখের দিক চেয়ে পরিষ্কার প্রতিবাদ করল,কণ্ঠে নম্রতা,
‘ খালুজান! না জেনেশুনে আমার চরিত্র নিয়ে একটাও কথা বলবেন না আপনি।’
কোমল মেয়ের আকষ্মিক এই ব্যবহার মাথায় বহ্নি ধরাল খোরশেদুলের। হতবাক হয়ে বললেন,
‘তুই আমাকে চোখ রাঙাচ্ছিস পুষ্পিতা? আমাকে? দ্যাখো সালমা দ্যাখো, দুধ -কলা দিয়ে কী মারাত্মক সাপ পুষেছি! সে আজ তোমার স্বামীর ওপর ফণা তুলছে,আর কাল তোমাকে ছো*বল দেবে। বুঝেছ এখন?’
নুহা বলল,’ তো আপনি নোং*রা কথা বলবেন আর ও চুপ করে থাকবে? আপনার যদি নিজের মেয়ের বয়সী একটা মেয়েকে এসব শোনাতে রুচিতে না বাঁধে তবে ওর বাঁধবে কেন? পুষ্পিতার জায়গায় আমি হলে তো এটাই ভুলে যেতাম,যে আপনারা আমার গুরুজন।’
খোরশেদুল উষ্মায় একাকার হয়ে বললেন,
‘ কী অভদ্র মেয়ে দেখেছেন আপনারা? একজন কুকীর্তি করে আসবে, আরেক বান্ধুবি সাফাই গাইবে তার৷ আজকালকার ছেলে-মেয়েদের বাবা-মা কোনও শিক্ষাই দেয়নি ‘
সালমা বললেন, ‘ তুমিও যে খুব ভালো শিক্ষা পেয়েছ কী করে বুঝব? বাবার বয়সী হয়েও, যে কুৎসিত ভাষা তুমি উচ্চারণ করছো খোরশেদ, তাতো কোনও ভদ্র ঘরের সন্তানের হতে পারেনা।’
আলেয়া বেগম কটমট করে কিছু বলতে চাইলেন। পূর্বেই ডলি বেগমের কথায় বাধা পড়ল সেথায়৷ তিনি অধৈর্য হয়ে বলছেন,
‘ দেখুন ভাবি, আপনাদের পরিবারের এসব কাহিনী দেখতে আসিনি। আমার জামাই যেটা বলল শুনলেন তো? এখন কথা হচ্ছে আপনাদের এই মেয়ে নিয়ে এই বাড়িতে থাকা চলবেনা। এটা তো ভদ্র লোকের বাড়ি, এখানে এসব এলাউ না। এই মেয়ে আজ গিয়েছে যখন,কাল আবার যাবে। নাহলে গুন্ডাটাকে রাত-বিরেতে বাড়িতে ঢোকাবে। শেষে মহল্লায় কূৎসা রটাবে আমাদের নামে। অন্য ভাড়াটিয়াও নিরাপত্তার ভয়ে বাড়ি ছাড়বে। আপনাদের জন্য তো আর পেটে লা*থি মা*রতে পারব না ভাই। তাই পরশুর মধ্যে ঘরটা খালি করে দেবেন।’
সালমা বললেন, ‘ কেন? তিনমাসের এডভান্স দিয়ে উঠেছি আমরা। তাহলে খালি করব কেন?”
‘ আপনাদের ওই এডভান্সের টাকা ফেরত দেওয়া হবে। তাও দয়া করে রেহাই দিন আমাদের। আপনার এই মেয়ের জন্যে এত দিনের পুরোনো বাড়ির বদনাম করতে পারব না।’
হাকিম মাথা দুলিয়ে বললেন,
‘ সেইত। এলাকায় আসতে না আসতেই যে মেয়ে ছেলে জোটাতে পারে,সে মেয়ের যে আরো কোথায় কোথায় আসর পাতা কে জানে! এমনিতেও চেহারা ভালো হলে সেসব মেয়ে ছেলেদের নাড়াচাড়ায় নষ্ট হবে স্বাভাবিক। ‘
নুহা, সালমা একসাথে কঠিন চোখে চাইল্ ওনার দিক। দু জোড়া ভয়া*নক চাউনীতে ভরকে,হতভম্ব হলেন হাকিম। সালমা কাঠ কণ্ঠে বললেন,
‘ দারোয়ান,দারোয়ানের মত থাকবেন। বাড়ি ছাড়তে হবেত? ঠিক আছে,ছেড়ে দেব। ঢাকা শহরে তো আর বাসার অভাব নেই। কিন্তু আমার মেয়েকে নিয়ে আরেকটা কথা বললে খুব খারাপ হয়ে যাবে। ‘
খোরশেদুল চোখ ছোট করে বললেন,
‘ বাসা ছাড়ব মানে? তুমি বললেই হবে নাকী? তোমার আমাকে ঠেলাগাড়ি মনে হয় সালমা? যে মাসে মাসে বাসা পাল্টাব? ফের বাসা বদলানো মানে কতগুলো টাকা খসানো তুমি জানো? পুষ্পিতার জন্য আমি কেন টাকা নষ্ট করব? আমি কোনও বাসা টাসা পাল্টানোর মধ্যে নেই। দরকার পড়লে,ও চলে যাবে এখান থেকে।’
পুষ্পিতার মুখের রং পালটে গেল। ফ্যাকাশে হলো তত্র।
সালমা আর্ত*নাদ করে বললেন,
‘ এসব কী বোলছো? ও কেন যাবে?’
‘ কেন যাবে মানে? শুনলেনা মা কী বলল! এরকম অশুদ্ধ মেয়ে সংসারে থাকা মানে,গৃহস্থের অকল্যান। আমি কেন পরের মেয়ের জন্যে আমার গৃহের অমঙ্গল চাইব? কান খুলে শুনে নাও,বাসা আমি ছাড়ব না। আর না এই মেয়েকে আমার বাড়িতে রাখব।’
পুষ্পিতার দূর্বল দেহ দেয়ালে লেগে যায়। ক্ষুদ্র বুক দলিত-মথিত। একেকটি কটুবাক্য যেন একেকটি কুঠারের ম*র্মর আ*ঘাত৷
‘ তুমি কি পাগল হলে? সব জেনেও এসব কী বোলছো? ও আমাদের রেখে যাবে কোথায়?’
‘ কেন? ওর বাবা আছেনা? তোমার ভাইও তো রয়েছে। সে কেন দায়িত্ব নেয়না ওর? সব ঠ্যাকা তোমার একার?’
জমির মুখখানা চোরের ন্যায় গড়লেন। নুরুন্নাহারকে বললেন, ‘ দেখেছ,বলতে না বলতেই আমাদের দিক ঠেলছে।’
নুরুন্নাহার ওসবে কান দিলেন না। তার চোখ ফেটে জল আসছে। নিজেও এতিম কী না!
আলেয়া বললেন, ‘ কাউরে না পাইলে যে নাগরের সাতে রাইতে আছিল,তার কাছে যাইবার কও না।’
পুষ্পিতা চোখ ব্যথা করছে। এইটুকু সময়েই অধিক কান্নায় পল্লব ভারী। কথার ঘায়ে দগ্ধ শরীর জ্ব*লছে। খুব আস্তে,ভাঙা গলায় বলল,
‘ আমি চলে যাব। তাও দোহাই লাগে, আমার চরিত্রকে আর কাঠগোড়ায় তুলবেন না। ‘
রাহাত আৎকে উঠল। ঝট করে চেপে ধরল বোনের হাত। মাথা নেড়ে বলল, ‘ না না তুমি কোথাও যাবেনা।’
সালমা দুই বাহু ঝাঁকিয়ে বললেন,
‘ মাথা খারাপ হয়েছে তোর পুষ্পিতা? ও বললেই হবে? কোথাও যাবিনা তুই ।’
খোরশেদুল চেঁচিয়ে উঠলেন, কণ্ঠে আক্রো*শ।
‘ ব্যাস! অনেক হয়েছে সালমা। পরের মেয়ে নিয়ে অনেক বাড়াবাড়ি সহ্য করেছি তোমার। আজ আর নয়। এই মুহুর্তে সবার সামনে দাঁড়িয়ে সিদ্ধান্ত নেবে তুমি,ঠিক কাকে চাও? স্বামী,সন্তান,সংসার নাকী এই চরিত্রহীনা পুষ্পিতাকে? ‘
পুষ্পিতা মাথা তুলল না। তাকানো তো দূর,নড়ল ও না সামান্য। যেন অধিক শোকে গড়া অভঙ্গুর পাথর। শুধু ঠোঁটের পাশে বিষাদের হাসি ছড়াল স্বল্প। ক্লান্ত চোখ চাইল সিলিং ফ্যানের দিকে। এই দিন দেখার থেকে ওখানে ঝুলতে পারলে ভালো হোতো না?
সালমা স্বামীর শর্ত শুনে মূর্তি বনে গিয়েছেন। কিছুক্ষণ নিষ্প্রভ চোখে চেয়ে বললেন,
‘ কী বললে খোরশেদ?’
খোরশেদের কাট-কাট জবাব,
‘ যা বলেছি তুমি শুনেছ। পুষ্পিতাকে আর এক মুহুর্ত এই বাড়িতে রাখব না আমি৷ যদি এর বিরোধিতা করো,তাহলে তুমিও ওর সঙ্গে চলে যেতে পারো। তবে যাওয়ার আগে এই ফালতু সম্পর্ক চুকিয়ে যাবে। সাথে জেনে রাখবে,ভবিষ্যতে আমার ছেলে-মেয়ে বা আমার ওপর তোমার কোনও অধিকার থাকবেনা সালমা।’
পুষ্পিতা চোখ মুছল। উথাল-পাতাল বক্ষে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আস্তে করে রাহাতের হাতটা ছাড়িয়ে দিলো কব্জি হতে৷ ছেলেটা উদগ্রীব, বিভ্রান্ত চোখে চেয়ে রয়।
পুষ্পিতা এক পা, এক পা করে পিছিয়ে যায়৷ মুখ চেপে কেঁদে,আচমকা নিঃশ্বাসের বেগে ছুটে বেরিয়ে যায় ঘর হতে। রাহাত গতিতে ‘আপু, আপু’ বলে ছুটতে নিলেই, টেনে ধরলেন খোরশেদ৷ জোর করে চেপে রাখলেন ওকে। সালমা আহ*তের ন্যায় ধপ করে বসে পড়লেন মেঝেতে। বাকী সকলে,প্রত্যুষের এই সময়টায় বিনা টিকিটে মজা দেখে গেল। নিরব সাক্ষী রইল, একটি নিঃসহায়, নিষ্পাপ মেয়ের অযাচিত সম্মানের বলি হওয়ার। করুণাময়ের সৃষ্টি, বিশাল এই ধরিত্রী বরাবর নি*ষ্ঠুর। এখানে শক্তিহীন মানুষগুলোই সবচাইতে বড় ভুক্তভোগী! অনুগ্রদের কাঁদামাটির মত পি*ষে ফেলা কলুষিত সমাজের দয়াহীন রীতি। সেই রীতি যেন কাঁটায় কাঁটায় প্রমাণ দিলো আজ, বেঁচে থাকতে এতটাও নরম হতে নেই।
ভ্লবে