সে আমার সন্ধ্যাপ্রদীপ পর্ব ৯কলমে: নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
(০৯)
সকাল নয়টা বেজে কুড়ি মিনিট। চড়ুই পাখির কিচিরমিচির শব্দে শহুরে আবহাওয়া তারুণ্যে মেতে। ঝরেঝরে গন্ধবহে, ব্যালকনির কাঠের দরজাটা এপাশ-ওপাশ করছে।
নুহা বিছানায় আধশোয়া। শক্ত পায়ায় পিঠ ঠেকিয়ে, মাথায় এক হাত চেপে বসেছে। রাতে ঘুম হয়নি,মাথা ধরেছে তাই। সে চোখ বুজেছিল। কামড়ায় হঠাৎ কারো পায়ের শব্দ শুনে পল্লব মেলে চাইল। আয়েশা রহমান পরিপাটি হয়ে, ড্রেসিং টেবিলের সম্মুখে এসে দাঁড়িয়েছেন।
নুহা মাকে দেখে নড়েচড়ে বসে। বাবা জয়নাল উদ্দীন মারা গিয়েছেন বছর পেরোবে। মা একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি-রত । সকাল দশটায় রোজকার অফিস ৷ এইত,সেজন্যেই তৈরী হচ্ছেন। নুহার পূর্ণ দৃষ্টি তখন আয়েশাতে। পড়নে সাদামাটা সুতির শাড়ি। কুঁচিগুলো একটার ওপর আরেকটা নিপুণ হাতে গাঁথা। সমাজে ওর মা বিধবা হলেও, চেহারার টগবগে জৌলুশ এখনও ঠিক চোখে লাগার মতন।
কিন্তু আয়েশা রাহমান একবারও মেয়ের দিক দেখলেন না। এই যে মাথাব্যথা জেনেও,ভালো-মন্দ জিজ্ঞেসও করলেন না । গত তিন দিন ধরে ভদ্রমহিলার চেহারায় অন্ধকার নেমেছে। এখনও কেমন গোমড়া মুখে হিজাবের পিন আটকাচ্ছেন । ওনার মুখাবয়বের এমন অবস্থা নুহা আগে দেখেনি। তার মা মানুষটা ভীষণ হাসি-খুশি। স্বামী হারিয়ে একা হাতে একটা মেয়ে,সংসার সামলেও কী সুন্দর করে হাসতেন!
নুহা বুক ভার করে শ্বাস ফেলল। মায়ের ভাবমূর্তি আঁচ করতে,আগ বাড়িয়ে শুধাল,
‘ লাঞ্চ নিয়েছ আম্মু?’
আয়নার মধ্যে থেকে মেয়ের বিম্বে একবার চোখ বোলালেন আয়েশা। কণ্ঠ গম্ভীর রেখে জানালেন,
‘ লাগবে না।’
নুহা বুঝল,মায়ের রা*গ এখনও পড়েনি। নেমে এসে পাশে দাঁড়াল ওনার। যেচে, হেসে বলল,
‘ বাহ,শাড়িটাতে তোমাকে দারুণ লাগছে তো। কবে যেন নিয়েছিলে?’
আয়েশ জবাব দিলেন না। সরে এলেন কাছ থেকে । কাঁধ ব্যাগে ছাতা ভরতে ভরতে একবার হাত- ঘড়ি দেখলেন।
নুহার মুখে মেঘ ছড়াল ওমনি। মন খারাপ করে বলল,
‘ আম্মু এরকম করছো কেন? তাও একটা সামান্য ব্যাপার নিয়ে? ‘
আয়েশা তাকালেন। অবাক হয়ে বললেন,
‘ সামান্য? এটা তোমার কাছে সামান্য ব্যাপার নুহা? আমাকে কোনও রকম জিজ্ঞেস না করেই, এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছো, আর বলছো সামান্য?’
নুহা মাথা নোয়াল। তিনি বললেন,
‘ কখনও তোমাকে বকিনি। একমাত্র সন্তান বলে এক রত্তি শাসনও করিনি। যখন যা চেয়েছ,কষ্ট হলেও হাজির করেছি সামনে। যথেষ্ট স্বাধীনতাও দিয়েছি। এর মানে তো এই নয় যে, তোমাকে লাইসেন্স দিয়েছি আমার বাসাটাকে আশ্রয়স্থল বানানোর। ‘
নুহা চোখ তোলে। মৃদুমন্দ অসহায় কণ্ঠে বলে,
‘ তাহলে কী করতাম আমি? কী করার ছিল বলতে পারো? তোমাকে তো সবই বলেছি। আমি ছাড়া পুষ্পিতার যাওয়ার আর জায়গা নেই আম্মু। তুমি…’
আয়েশা কথা আটকে দিয়ে বললেন,
‘ যাওয়ার জায়গা নেই বলে তার দায়িত্ব তুমি নিয়ে বসোনি। আর সত্যিইত,যে মেয়ে একটা গোটা রাত বাড়ির বাইরে কাটিয়ে আসে,সমাজ অবশ্যই তার চরিত্র নিয়ে কথা তুলবে। আমি,তুমি, আমরা যে কেউ হলেও উঠত। এখানে ভুল তো কিছু নেই। তাহলে কেন সব জেনেশুনে ওরকম মেয়েকে আমার বাসায় রাখব? তুমি কতক্ষণ থাকো বাইরে? কলেজ যাওয়া আসা ছাড়া কতটুকু সময়ই বা থেকেছ? বিট্টু মাস্তানের ব্যাপারে আমি শুনেছি যা শোনার। হয়ত দেখিনি। কিন্তু বায়োডেটাতেই বোঝা যায় কে কীরকম। ওরকম বখাটে ছেলে-পেলে এত রূপবতী মেয়ে নিয়ে এমনি এমনি ছেড়ে দেয়না নুহা। ‘
নুহা দু সেকেন্ড জড়ের ন্যায় চেয়ে রইল মায়ের দিক। পরপর শান্ত-দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
‘ আমি ওসব জানিনা। পুষ্পিতা বলেছে ওর সাথে কিছু হয়নি,এর মানে আমি বিশ্বাস করি ওর সাথে কিছুই হয়নি। তাতে যে যাই বলুক না কেন!’
বন্ধুর প্রতি এমন অতিরিক্ত বিশ্বাস দেখে, আয়েশা বিস্মিত না হয়ে পারলেন না। বললেন,
‘ বাহ! তাহলে তো আমার আর কিছু বলারই থাকল না। শুনে রাখো,এই জল কিন্তু খুব সহজে মুছবে না। তুমি আমার মেয়ে। আমি কী তোমার খারাপ চাইব? আমার মন বলছে, বিট্টু তার দলবল নিয়ে পুষ্পিতার জন্যে এ বাড়িতে হানা দেবেই। ওদের মধ্যে নিশ্চয়ই কিছু আছে। আমিও সারাদিন অফিসে থাকি। ওরা ভালো ছেলে নয়। মাঝ থেকে শুধু শুধু নিজে বি*পদে পড়বে কেন?’
নুহা নম্র কণ্ঠে প্রতিবাদ করল, ‘ এরকম কিছুই হবে না। তুমি বেশি বেশি ভাবছো।’
আয়েশা দুই ভ্রু উঁচালেন,
‘ ও তাই? আচ্ছা ঠিক আছে। মাস্তানটার কথা বাদ দিলাম। কিন্তু গত তিনদিন ধরে যা সব হচ্ছে তার খোঁজ তুমি রাখো? এইত গতকাল যখন ফিরছিলাম,নীচ তলার মহিলা ইনিয়ে-বিনিয়ে পুষ্পিতার জন্য তার ভাইয়ের সমন্ধের প্রস্তাব রেখেছিলেন৷ কত কিছু বলে কাটিয়েছি সেটা আমি জানি। এমন ঝামেলায় কেন পড়ব? এসব তো আমার সামলানোর কথা নয়। আর এরকম যে রোজ হবেনা,তার কী নিশ্চয়তা?’
‘ সুন্দরী মেয়ে দেখলে, প্রতিবেশীরা এরকম একটু আধটু করে আম্মু। আমার গায়ের রং তো পুষ্পিতার মত উজ্জল না। তাও কত বিয়ের প্রস্তাব পাওনি তুমি? তখন সামলাতে না?’
নুহা দুপা এগিয়ে এলো তারপর । মোলায়েম কণ্ঠে বলল,
‘ পুষ্পিতার তো মা নেই আম্মু। তোমারও আরেকটা সন্তান নেই। ওকে নিজের মেয়ে বানালে হয়না?’
আয়েশা কড়া কণ্ঠে বললেন,
‘ ফিল্মি ডায়লগ বাদ দাও নুহা। ভালো কথা বলছি শোনো,পুষ্পিতাকে কোনও গার্লস হোম,বা হোস্টেলে রেখে এসো। দরকার পড়লে আমি নিজে সব ব্যবস্থা করে দেব। প্রয়োজনে ওর খরচও চালাব। কিন্তু এইভাবে ওকে ফ্ল্যাটে রাখা আমি নিরাপদ মনে করছি না। আমার জায়গায় তুমি থাকলে তুমিও করতেনা।’
তারপর মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললেন,
‘ কাল ওকে একটা ভালো দেখে হোস্টেলে রেখে আসি? ‘
নুহা সঙ্গে সঙ্গে মায়ের হাতটা নামিয়ে দেয়। চড়া কণ্ঠে বিরোধিতা জানায়,
‘ না। পুষ্পিতা কোথাও যাবেনা। ও তো এখানে আসতেই চায়নি,আমি জোর করে এনেছিলাম। আমি আমার বাবার মেয়ে,কথার খেলাপ আমি করব না আম্মু। পুষ্পিতা নিজের পায়ে না দাঁড়ানো অবধি ওকে আমি কোথাও যেতে দেব না। তুমি বেশি আপত্তি করলে,আমিও ওর সাথে চলে যাব।’
আয়েশা হতবাক! রেগে-মেগে বললেন,
‘ যে মেয়েকে তার নিজেদের লোকেরা বাড়িতে রাখেনি, তাড়িয়ে দিয়েছে, তার প্রতি তোমার এত দরদের কোনও মানেই হয়না। আর আমি কেন ওকে আমার বাসায় রাখতে যাব বলতে পারো?
‘ পুষ্পিতা আমার বেস্টফ্রেন্ড। আর তুমি আমার মা। আমার বেস্টফ্রেন্ডের প্রতি আমার দায়িত্ব আছে যেমন, তোমারও আমার প্রতি দায়িত্ব আছে। আমার কথার খেলাপ মানে, তোমারই অসম্মান। তবে আমি জানি,তুমি বিট্টু মাস্তানের কথা শুনেই এত ভ*য় পাচ্ছো৷ নাহলে আমার মা তো এরকম নয়। তার মন আমার থেকেও বড়। পুষ্পিতাকে কত আদর করতে,একটা সামান্য ঘটনায় সেসব শেষ হতেই পারেনা!’
আয়েশা রাহমান ব্যর্থ চোখে চাইলেন। যুক্তি দেওয়ার জন্যে যুতসই জবাব এলো না জ্বিভে। নুহা যে গুছিয়ে তাকে দমিয়ে দিলো,পরিষ্কার বুঝলেন। অসহ ভঙিতে বললেন,
‘ যা খুশি করো৷ আমি এসবের মধ্যে নেই। কিছু বলবও না আর।’
বলতে বলতে কাঁধে ব্যাগ ঝোলালেন তিনি। নুহা ঠোঁট চেপে হেসে বলল,
‘ কিন্তু তুমি আমাকে কিছু বললেই আমি বাবার কাছে বলে দেব। তাকে নালিশ ঠুকব,যে আম্মু আমাকে এখন আর আগের মতো ভালোবাসে না। আমার কথাও শোনেও না। বাবা নেই বলে আমার সাথে রুড বিহেব করে।’
আয়েশা পেছন ফিরলেন। চোখ পাঁকিয়ে বললেন,
‘ সব সময় বাবাকে টেনে ইমোশোনাল ব্লাকমেইল করবেনা। বলেছিতো যা খুশি করো। যখন একটা বিপদে পড়বে, তখন সবার আগে মাকেই খুঁজবে।’
নুহা ওমনি দুহাতে জড়িয়ে ধরল ওনাকে। আদুরে কণ্ঠে বলল,
‘ তাতো খুঁজবই। মা ছাড়া আমার আর আছেটা কে?’
আয়েশা নিভে এলেন। নিভে গেল তার সমস্ত তেজ। মেয়ের হাসি-হাসি মুখবিবর দেখে এক লহমায় শান্ত হলো ভেতরটা। মাতৃতের নিকট বরাবরই পরাজিত তিনি। কণ্ঠ কোমল করে বললেন,
‘ আরেকবার ভেবে দেখো। অন্য সময় হলে আমি বলতাম না। কিন্তু যেখানে অমন গু*ন্ডা -মাস্তানের ব্যাপার জড়িত…’
নুহা ততোধিক নিশ্চিন্ত কণ্ঠে বলল,
‘ আম্মু এসব নিয়ে একদম ভেবো না। পুষ্পিতাকে আমি চিনি। কিছু হলে ও আমার কাছে আড়াল করত না। তুমি এখন যাও,দেরি হয়ে যাচ্ছে।’
তারপর দেয়ালঘড়ি দেখে,ভ্রু কপালে তুলে বলল,
‘ এই দেখেছ,নটা পঞ্চাশ বেজে গেছে৷ এখন দশ মিনিটে যেতে পারবে?’
আয়েশা বুঝলেন কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। নুহা আর শুনবে না। কেন যেন জোরও করতে পারেন না মেয়েটাকে। বাপের আদরের কন্যা ছিল,হঠাৎ সে নেই। কিছু বললেই ভাবে মায়ের আদর কমে গিয়েছে। চোখে জলের ঝর্ণা নামায়,অভিমান করে না খেয়ে থাকে।
ভদ্রমহিলার বক্ষপট বিফল শ্বাসে,ওঠানামা করল। কক্ষ ছাড়লেন নিরুত্তর।
বাইরে আসতেই,সামনে পড়ল পুষ্পিতা। কিছু থমকালেন তিনি।
তাকালেন ভালো করে। বৃত্তাকার, শুভ্রলতার মতো একটি মায়াবী মুখ, চোখ জুড়িয়ে দিলো কেমন। পুষ্পিতা ওড়না দিয়ে ঘাম মুছল গলার। হাতের লাঞ্চ ব্যাগটা এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘ আন্টি,আপনার খাবার।’
আয়েশা অবাক হলেন।
‘ তুমি বানিয়েছো?’
‘ না না,বুয়া বানিয়ে রেখে গিয়েছে। আপনি ব্যস্ততায় সময় পাচ্ছিলেন না,তাই আমিই গুছিয়ে আনলাম। চামচ,পানি সব এর মধ্যে দিয়ে দিয়েছি। শুধু পরিমানটা ঊনিশ-বিশ হতে পারে। ‘
পুষ্পিতার ঠোঁটজুড়ে স্ব-প্রতিভ সরল হাসি। টানা টানা চঞ্চল দৃষ্টি। অমন সাংঘাতিক দিনগুলো যে পেছনে ফেলে এলো,কোনওরূপ চিহ্নই নেই তার।
আয়েশার নরম হৃদয়খানা নির্নিমেষ গলে যায়। আর যাই হোক,মেয়েটা লক্ষীমন্ত! আজ তো প্রথম দেখছেন না। সেই স্কুল যাওয়ার বয়স থেকে চেনেন। তিনি ঘাড় ফিরিয়ে একবার নুহার দিক দেখলেন । তারপর ফোস করে শ্বাস ফেলে ব্যাগ হাতে নিলেন। ছোট করে বললেন,
‘ থ্যাংক ইউ! ‘
পুষ্পিতার জবাব সেই মৃদূ হাসিতে ৷ আয়েশা দরজা অবধি গেলেন৷ ফিরে চেয়ে নুহাকে বললেন,
‘ ছিটকিনি ভালো করে লাগাও। কেউ এলে,আগে লুকিং গ্লাসে দেখবে। না দেখে কারো জন্যে দরজা খুলবেনা। ‘
যাওয়ার সময়, এই এক সতর্ক বানী তিনি প্রতিদিন দেবেন। নুহার মুখস্থ। তাও ভদ্রের মত মাথা কাত করে বলল ‘ আচ্ছা।’
আয়েশা পুষ্পিতার দিক চাইলেন। ইতস্তত করে বললেন,
‘ পুষ্পিতা,তুমি বাইরে যেওনা। ছাদেও না৷ কেমন? ‘
সে অবিলম্বে জানাল, ‘ জি।’
‘ দুজন সাবধানে থেকো। খেয়ে নিও। ‘
উনি যেতেই দরজা লাগায় নুহা। ওপর-নীচ দুটো ছিটকিনিই তুলে দেয়। ওষ্ঠপুটে যুদ্ধে জেতার, মিটিমিটি হাসি। মা যে নরম হয়েছে টের পেতে বাকী নেই। এখন নিশ্চয়ই আর পুষ্পিতার থাকা নিয়ে আপত্তি করবে না। যাক! ওকে নিজের কাছে রাখতে আর কোনও বাঁধাই রইল না তবে।
নুহা বুক ফুলিয়ে প্রশান্ত শ্বাস টানল। হাসিমুখে ফিরলেও, পুষ্পিতার মলিন মুখশ্রী মুছে নিলো সেটুকু। তার উদাস,অন্যমনস্ক চাউনী মেঝের ওপর। এতক্ষণ যে হাসছিল,তার লেশমাত্র নেই। নুহা দুধারে মাথা নেড়ে এগিয়ে এলো কাছে। কাঁধে হাত রাখতেই, নড়ে উঠল পুষ্পিতা। ওকে দেখেই পূনর্বার অধর টেনে হাসল। কৃত্রিম এই হাস্য বদন, মন খারাপ লুকোনোর নিরর্থক প্রয়াস। নুহা ভণিতাহীন বলে বসল,
‘ এত হেসে কাকে বোকা বানাচ্ছিস,আমাকে?’
পুষ্পিতা ব্যস্ত হয়ে বলতে নেয়, ‘ কই আমি তো…’
নুহা বাঁধা দেয়। ফটাফট প্রশ্ন করে,
‘ আম্মুর সব কথা শুনেছিস, তাইত?’
পুষ্পিতা থামল। কাঁ*পল ঠোঁট দুটো। বড় বড় বিষণ্ণ নেত্রদ্বয়ের সাথে,চিবুক এসে গলায় ঠেকে।
সে বলল,
‘ তাহলে আর ক*ষ্ট পেয়েছিস কী না জিজ্ঞেস করে লাভ নেই। পেয়েছিস জানি।’
পুষ্পিতা মৃদু কণ্ঠে বলল,
‘ পাইনি। আমার অভ্যেস আছে এসবের। ছোট থেকে যা যা শুনে বড় হয়েছি তার কাছে আন্টির কথাগুলো কিছুই না। তবে একটা কথা সত্যি, উনি সারাদিন বাইরে এত খাটা-খাটনি করছেন,এর মধ্যে আবার আমি এসে জুটলাম। একটা বাড়তি ঝামেলা!
নুহা চোখ রাঙিয়ে ধম*ক দিলো,
‘ চুপ কর। একদম তোর ওই আলু মার্কা খালুর মত কথা বলবিনা। আম্মু কিন্তু একেবারেই ওভাবে বলতে চায়নি। আসলে হয়েছে কী, উনি ভ*য় পাচ্ছেন। তুই এত সুন্দর, এলাকার ছেলেরা যদি তোকে দেখে দরজা -জানলা ভে*ঙে ঘরে ঢুকে যায়,কী হবে?’
নাক-মুখ কুঁচকে চাইল পুষ্পিতা। নুহা দুষ্টু হেসে চোখ টিপতেই বিরক্ত গলায় বলল,
‘ ধুর! সব সময় খালি বাজে কথা। ‘
নুহা ভাবমূর্তি গুরুতর করে বলল, ,
‘ বাজে কথা? কোন দিক দিয়ে এটা বাজে কথা? যখন এরকম হবে না, তখন মিলিয়ে নিস।’
পুষ্পিতা অতীষ্ঠ হয়ে বলল,
‘ থাক ভাই, আর বুঝতে হবে না। এই, তোর না মাথাব্যথা ছিল? কমেছে?’
‘ একটু একটু আছে।’
‘ কড়া করে চা বানাব, খাবি? ‘
স্ব-প্রবৃত্ত প্রস্তাব খানা নুহা তত্র নাকচ করে বলল,
‘ না। আমি বানাব।’
পুষ্পিতা দ্বিধাদ্বন্দে ভোগে,
‘ কেন? আমারটা ভালো হয়না?’
‘ হয়। কিন্তু তাতে আমার লাভ কী? আমাকে শিখতে হবেনা? আরে,যদি ভালো চা না-ই বানাই, তাহলে তো বিয়ের পর বিপদে পড়ব। শ্বশুর-শাশুড়ির মন জয় করতে হবেনা? নাহলে তো পরেরদিনই বাড়িতে ফেরত পাঠিয়ে দেবে। তুইত আর সেখানে গিয়ে চা বানিয়ে দিবি না। ওইজন্যে আমাকেই আগে-ভাগে এসব রপ্ত করতে হবে। বুঝলি?’
পুষ্পিতা হেসে ফেলল। মস্তক নেড়ে-চেড়ে বলল,
‘ বাবাহ,কত চিন্তা মেয়ের! আচ্ছা ঠিক আছে, যা।’
নুহা মুচকি হাসে। ভেতর ভেতর ভীষণ তুষ্টিতে লুটোপুটি খায়। যাক,মেয়েটা এবার জোর করে হাসেনি। দ্বিগুন হৃষ্টতায়, চপল পায়ে রান্নাঘরের দিক এগোল সে।
পুষ্পিতা টেবিলের, একটা চেয়ার টেনে বসল। হঠাৎ কিছু মনে করে দাঁড়াল নুহা। ঘুরে চেয়ে জানাল,
‘ সকালে সালমা আন্টি আবার ফোন করেছিলেন।’
পুষ্পিতার একটু আগের সদ্য ফোটা হাসি মুহুর্তে শেষ। উদ্বীগ্ন হয়ে শুধাল,
‘ বলিসনি তো আমি এখানে?’
‘ না। যা ইমোশোনাল ব্লাকমেইল করে রেখেছিস,এরপর আর সাধ্য আছে আমার?’
পুষ্পিতা চোখ বুজে শ্বাস ফেলল। নুহা বলল,
‘ তবে শুকরিয়া কর, আন্টি আমাদের নতুন বাসা চেনেন না। আম্মুর নম্বরও ওনার কাছে নেই। নাহলে এতদিনে ঠিক জেনে যেতেন তুই এখানে।’
পুষ্পিতার মলিন স্বর,
‘ জানেনা বলেইত এখানে এলাম।’
‘ আন্টি খুব কাঁ*দছিলেন জানিস। বারবার অনুরোধ করছিলেন যেন তুই থাকলে জানাই। আমার এত খারাপ লাগছিল মিথ্যে বলতে…’
পুষ্পিতার বিষাদটুকু হুরহুরে বেগে ফেরত আসে। সমগ্র আদল জুড়ে অদৃশ্য ব্যথার, অসিত দাগ। হীড়কচূর্ণের জলরাশি, সেকেন্ডে ছাপিয়ে ফেলে কোটর। ভেজা কণ্ঠে বলল,
‘ আমি জানি! মণি, রাহাত আমার একটা খোঁজ পাওয়ার জন্য কতটা ছট*ফট করছে আমি বুঝি। আমি কী কম ক*ষ্ট পাচ্ছি বল? জন্মের পর মণিকে ছাড়া কখনও থাকিনি। রাহাতটা রাতে না খেয়ে ঘুমায়। জোর করে ওকে তুলে খাইয়ে দিতে হয়। মণির কোমড়ে ব্য*থা,নীচে বসে কাজ করতে পারেনা৷ একটু ঠান্ডা লাগলেই অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। শেক দিতে হয় বারবার। এখন এসব কে করবে! আমিতো কাছে নেই। কে দেখবে?’
শেষ দিকে স্বরনালী বুজে এলো ওর।
নুহা বলল,
‘ আচ্ছা, এক কাজ করলে হয়না? ধর আন্টিকে শুধু জানিয়ে রাখলাম তুই কোথায়। কিন্তু ও বাড়িতে না গিয়ে তুই আমার কাছেই থাকলি। তাহলে কেমন হয়?’
পুষ্পিতা সজোরে মাথা নেড়ে বলল,
‘ না না। মণি জানলে আমাকে জোর করে হলেও নিয়ে যাবে। সাথে রাহাত তো আছেই। তারপর আবার খালুজানের সঙ্গে সেই একই অশান্তি। ওনাদের তো ভালোবেসে বিয়ে। আর যাই হোক,খালুজান মণিকে প্রচন্ড ভালোবাসেন। আমি ব্যাতীত অন্য কিচ্ছু নিয়ে কোনও দিন ঝ*গড়া হয়নি দুজনের। সবকিছুর মূলে সব সময় এই আমিই ছিলাম।
আর সেদিনকার সবটুকু তো তুই নিজেই শুনেছিস,দেখেছিস। ওখানে যাওয়া মানে, পুরো বিল্ডিংয়ের মানুষ আমার ওপর ছি ছি করবে। খালুজানের সম্মান নষ্ট হবে। ফ্ল্যাটটাও ছাড়তে হবে আমার জন্যে। কিছু না করেও,চরিত্রে কাঁদা মাখানোর মত ব*র্বরতা সহ্যের শক্তি আমার নেই রে নুহা। তাছাড়া আমি চাইনা, মণি আর খালুজানের সম্পর্ক ন*ষ্ট হোক। তাদের সংসারে সামান্যতম চিড় ধরুক। বা নতুন কোনও ঝা*মেলা হোক আমায় নিয়ে। একবার যখন চলে এসেছি,ওখানে না ফেরাই ভালো। আমার একটু খারাপ থাকায় যদি বাকী মানুষ গুলোর ভালো হয়,হোক না। হ্যাঁ, প্রথম প্রথম,আমাকে ছাড়া মণির কষ্ট হলেও আস্তে-ধীরে ঠিকই সামলে উঠবে দেখিস। ঠিকই ভুলে যা…
এরচেয়ে বেশি কথা ফুটল না মেয়েটার। বলতে বলতে ঠোঁট ভে*ঙে, ফুঁপিয়ে কেঁ*দে উঠল। টেবিলের ওপর দুহাত জড়িয়ে ঠে*সে দিলো মাথা। গতরের মৃদূ টালমাটাল কম্পন বেড়ে এলো ক্রমে।
নুহা ব্যস্ত পায়ে কাছে এসে দাঁড়াল। গায়ে- পিঠে হাত বুলিয়ে বলল,
‘ সেইত। একদিন সব ঠিক হবে আমিও জানি। তুই বোকার মত কাঁ*দিস না, প্লিজ বাবু! ‘
পুষ্পিতা মাথা তুলল। এইটুকুতেই মুখবিবর লালচে। যেন চামড়া ফে*টে র*ক্ত আসবে ভাব! বৃহৎ অক্ষিপটে সমুদ্র জলের উত্তলন। নুহা যেন এক নিরাপদ শরণ। পুষ্পিতার পেল্লব দুই বাহু, কেমন ঝড়ের বেগে হাম*লে ধরল তার সরু কোমড়। কা*ন্নার শব্দ আর চেপে নেই। চিকণ কণ্ঠফুড়ে তারা বেরিয়ে এসেছে বাইরে। কেমন হাহাধ্বনিতে বলল,
‘ আমার বুকটা জ্ব*লে যাচ্ছে নুহা। দমবন্ধ লাগছে! আমি মণিকে ছাড়া কী করে থাকব? রাহাতকে ছাড়া বাকী দিন কীভাবে কাটবে আমার? কেন মণি আমার নিজের মা হলো না বলতো! তাহলে তো পৃথিবী ধ্বং*স হলেও ওদের থেকে আলাদা হতে হোতো না আমাকে। কেন অধিকারবোধের এমন সস্তা বেড়িতে আটকে গেলাম আমি? সব সময় আমার সঙ্গেই কেন এরকম হয়!’
নুহার চোখেও জল। বাম হাতে মুছে বলল,
‘ আল্লাহ পরীক্ষা নিচ্ছেন পুষ্পিতা। পরীক্ষা শেষ হলেই দেখবি, তোর সব দুঃখ শেষ। আমার মন বলছে, খুব শীঘ্রই,একটা সুখের প্রজাপ্রতি নিজে উড়ে এসে তোর দরজায় দাঁড়াবে। ‘
একটু থেমে বলল,
‘আর তাছাড়া, এই তো অল্প কটা দিন। সামনের মাসেই আম্মুর বদলী হচ্ছেনা? গাজীপুরে শিফট হচ্ছি তো। তারপর একটা নতুন জায়গায় যাব আমরা। নতুন করে কত মানুষকে চিনব। ভার্সিটিতে ভর্তি হব। পড়াশুনায় আবার ব্যস্ত হলে তুইও ঠিক নিজেকে সামলাতে পারবি। ‘
পুষ্পিতার জবাব এলো না। তার শরীর ভা*ঙছে। গলায় হুহু আওয়াজ। নুহা আজোলে ওর ভেজা মুখ তুলল। আদ্র গাল থেকে অশ্রু মুছিয়ে বলল,
‘ এমন চাঁদের মত মুখে কী জল মানায়? আমি কিন্তু তোর কা*ন্না দেখতে বসে নেই। আমার সাথে থাকতে হলে সবসময় হাসতে হবে। একটু আগে যেমন হাসছিলি,অমন। বুঝেছিস? মাথা নেড়ে হেসে, বল,হ্যাঁ বুঝেছি। কী হলো,বল। ‘
নুহা চোখ পাঁকিয়ে তাগাদা দেয়। তার মুরুব্বিয়ানায় পুষ্পিতা স্বল্প হাসল। আদেশ মেনে বলল,
‘ বুঝেছি।’
‘ এইত, ভালো মেয়ে। বোস,আমি চা নিয়ে এক্ষুণি আসছি।’
নুহার যাওয়ার দিক থেকে চোখ ফেরাল পুষ্পিতা। সালমা বেগম আর রাহাতের নিষ্পাপ মুখটা মানস্পটে ঘুরেফিরে ভাসছে। অচিরেই চক্ষুকোটর ভরে ওঠে। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টির ন্যায়, গাল বেঁয়ে নামে। বুকটা দু*ভাগ হয়। একবার ওদের কাছে যাওয়ার তৃষ্ণায় অন্তঃপট হাহা*কারে মাতে।
তারপর কানে বাজে সেদিন ভোরের প্রতিটা কথা। প্রতিটি দৃশ্য। একেকটি মানুষের ছু*ড়ে দেওয়া সেসব তিক্ত,বিষা*ক্ত বাক্যবাণ, তীক্ষ্ণ গতিতে এসে মস্তিষ্কে বিঁধে। দুশ্চ*রিত্রা,কল*ঙ্কিনী শব্দগুলো মনে করতেই, পুষ্পিতা চক্ষুপল্লব খিঁ*চে নিলো। মর্মাহ*তের ন্যায় ঢোক গিলল।
ওইদিন, সে বেরিয়ে এসেছিল বাড়ি থেকে। উন্মা*দের ন্যায় ছুটেছিল দ্বিকদিশা ভুলে। অথচ কোথায় যাবে,কী করবে কিচ্ছু জানতো না।
নুহা যে একইভাবে পেছন পেছন আসছিল তাও খেয়াল করেনি। মেয়েটা জোরা-জুরি করে ওকে নিয়ে এলো এখানে। কিন্তু আয়েশা রাহমান হয়ত খুশি হননি। অবশ্য না হওয়ারই কথা। সব শুনে,যেখানে তার নিজের লোকেরাই বিশ্বাস করল না,সেখানে আয়েশা রাহমান তো র*ক্তের ধারেকাছেও নয়। ওনার জায়গায় উনি একদম সঠিক।
পুষ্পিতা আহ*ত শ্বাস টানল। সামনে ভার্সিটিতে ভর্তি হতে হবে। সারাজীবন মণি এত দূর্ভো*গ পুহিয়েও ওকে পড়িয়েছেন ,জীবনে যত উচাটনই আসুক, এই লেখাপড়া যে কোনওভাবেই ছাড়া যাবেনা। যা-ই হয়ে যাক,মণির মান রাখতে হবে। কিন্তু অনার্স পড়া যে অনেক টাকার ব্যাপার! অথচ,এই মুহুর্তে এক জোড়া হাত-পা ব্যাতীত একটা কানাকড়িও নেই ওর কাছে। কোথায় পাবে জানেনা। শুধু জানে,
এখন একটা কাজ জোগাড় করা খুব জরুরি। কিন্তু কী কাজ করবে? এত অল্প লেখাপড়ায় কোনও চাকরি তো জুটবেনা। টিউশনিই একমাত্র উপায়। অন্তত সেমিস্টার ফি-টুকু জোটাতে পারলেই চলে যাবে।
পুষ্পিতা বিরস চোখে সাদা দেয়াল দেখল। অতীত যেমন তেমন হলেও,ভবিষ্যতটা যে ওর ভীষণ লড়া*ইয়ের। আচ্ছা, এই লড়া*ইয়ে সে পারবে তো টিকতে?
******
প্রতিদিনকার মতো এক ঝাঁক সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে বসে তীব্র৷ পুরোনো দোকানের ভেতর ক্যারামের বোর্ড বসেছে তাদের। দশাধিক যুবকের জটলা। গুটিতে টোকা দেওয়ার, একেকটি উৎকট আওয়াজ। হৈ-হট্টগোল সহ,সবটা স্বাভাবিক রইলেও,শাফিন স্বাভাবিক নেই। সে কিছুতেই ঠিকঠাক হতে পারছে না। ভয়া*বহ অনুশোচনায় ভেতর পু*ড়ছে। এমন উৎক মেজাজে বন্ধুদের সাথে খেলতেও বসেনি।
কিন্তু এরকম কখনও হয়নি। কত লোককে মার*ল,দোকান ভা*ঙল,অকারণে বিপ*দে ফেলে নাকানি-চুবানি খাওয়াল, তাও এরুপ খারাপ লাগেনি। মেয়েটা এতিম,অসহায় জেনেই হয়ত পরিতাপের মাত্রা এত প্রগাঢ়! শাফিন আড়চোখে একবার তীব্রকে দেখল। অগোছালো সোনালী চুলের ছেলেটা কী মাত্রাতিরিক্ত নিরুত্তাপ! বরাবরের মত অধর ঝ*লসে দিচ্ছে এক টুকরো আ*গুনে। চোখে-মুখে ধীর লহরি!
শাফিন আশ্চর্য না হয়ে পারছে না। তীব্র এত ঠান্ডা ভাবে বসে কী করে? গতকাল যেই কান্ড ঘটিয়ে এসেছে,বাবারে বাবা! আপাতত কয়েক মাস পাড়া সরব থাকবে এ নিয়ে। অথচ দ্যাখো, তার নিজের অবস্থা! যেন সব ভাবনা ওর একার। তীব্রর মত নিরুৎসাহিত, চেহারার এই টাইট গাম্ভীর্য এসব ওর কেন নেই?
শাফিনের ধৈর্য্য বাঁধ ভা*ঙে। চুপ থাকা দূরহ লাগে। আর এক দন্ডও এভাবে বসে থাকা অসম্ভব। জোড়াল উশখুশ সমেত, তীব্রর কাছে এসে থামল সে। রয়ে-সয়ে বলল,
‘ একটা কথা বলব? ‘
তীব্র স্ট্রাইকে টোকা দেয়। সাদা গুটিটা রকেট বেগে গড়িয়ে পকেটে ঢোকে। জানতে চায়,
‘ কী?’
তার চিন্তিত কণ্ঠের বাণ ছুটল,
‘ পুষ্পিতা মেয়েটা কোথায় গেল?’
‘ কোথায় গেল সেটা কী আমি জেনে বসে আছি? তুই যেখানে,আমিও সেখানে।’
কর্কশ কণ্ঠটায়, দমে যায় শাফিন। মিনমিন করে বলে,
‘ না, তা ঠিক আছে। আসলে আমার এত খারাপ লাগছে কাল থেকে! রাতে ঘুমও হয়নি।’
মুশফিক ফোড়ন কে*টে বলল,
‘ তা হবে কী করে? রুপসী মেয়ের চ্যাপ্টার বলে কথা!’
শাফিন চেঁতে বলল,
‘ চুপ শালা। মানছি আমি খারাপ। কিন্তু এতটাও নই।’
তীব্র বলল, ‘ তাহলে সর এখন। খেলছি, বিরক্ত করিস না।’
শাফিন সরল না। এক চুল নড়ল না অবধি। উলটে হূলস্থূল প্রস্তাব রাখল,
‘ আচ্ছা, আমরা মেয়েটাকে খুঁজতে পারি না?’
তীব্র চোখা নেত্রে চাইলে বলল,
‘ না মানে ভুলটা তো আমাদেরই ছিল।’
মিরাজ কথাটা শুধরে দিয়ে বলল,
‘ আমাদের না। বল ভুল আমার,মানে তোর। ভালো করে দেখে-শুনে কাজটা করলে আজ এমন হতো?’
শাফিন মুখ ছোট করে বলল,
‘ হয়েছে রে ভাই! এক কথা আর কতবার বলবি?’
‘ যতবার তুই ভুলভাল বলবি, ততবার।’
শাফিন ফুলকো লুঁচির ন্যায় ফুঁসে ওঠে। জবাব দিতে চেয়েও থামে। তীব্রর দিক চেয়ে বলে,
‘ দ্যাখ বিট্টু,মাস্তান, বখাটে যাই হই, একটা বিবেক তো আছে। সামনের শনিবার আমার ফ্লাইট। এর মধ্যে একবার মেয়েটাকে খুঁজলে ভালো হয়না? অতটুকু মেয়ে,সাথে এতিম। নিজের কেউ নেই শুনে আমার কেমন কেমন লাগছে ভাই।’
তীব্র নিরুত্তর। ময়দা ছড়ানো কাঠের বোর্ডে,মন্থর তার হস্ত-গতি। সবাই ওর উত্তরের আশায় চেয়ে। শাফিন বুঝল না, কথাটা তীব্র শুনেছে, না কী শোনেনি!
নিশ্চিত হতে শুধাল,
‘ খুঁজবি? আঙ্কেলের সোর্স লাগালে হয়ত খুব সহজে পাব। বা ওর পরিবার থেকে ওর একটা ছবি….
মাঝপথে অনীহ,থমথমে জবাব এলো, ‘ দরকার নেই!’
শাফিন উৎকণ্ঠিত হয়ে বলল,
‘ কিন্তু এটা কী উচিত হবে? আমাদের জন্যেইত…’
‘ উচিত-অনুচিত নিয়ে মাস্তানরা ভাবে না। কাল যা করেছি ওটাই অনেক বেশি। তাছাড়া তোর ইচ্ছে করলে তুই খোঁজ। আমার সময় নেই। ‘
পরপর গোলাকার স্ট্রাইক ঠেলে দিলো সে। দরজা অবধি যেতেই, মিরাজ বলল,
‘ কী রে,খেলবিনা? কই যাস?’
তীব্র জিপে উঠেছে। যেতে যেতে ক্ষুদ্র জবাব দিল,
‘ কাজ আছে।’
তার ছুটে যাওয়া লাল জিপের দিক চেয়ে রইল শাফিন। এই ভরদুপুরে ওর কী কাজ মাথায় ঢোকেনি। এমনিতে তো মন্ত্রীর কল না এলে,আড্ডা রেখে নড়েনা। সে চ সূচক শব্দ করল। তীব্র না চাইলে এত বড় শহরে একটা মেয়েকে ও একা খুঁজবে কীভাবে? না আছে দলবল,না আছে ক্ষম*তাধর বাপ! কিন্তু একটা বিষয় নিয়ে বিস্মিত শাফিন। গতকালকের পর তো ধরেই নিয়েছিল, তীব্র নিজ উদ্যোগে পুষ্পিতাকে খুঁজতে নামবে। নিজে না নামুক,অন্তত কিছু একটা করবে এ নিয়ে। এখন তো রীতিমতো ধারণার পাশাই উলটে গেল তার।
মুশফিক ওর কালো মুখ লক্ষ্য করে বলল,
‘ আমাদের মন খারাপ করে লাভ নেই বুঝলি। বিট্টু যখন চায়না এসবে জড়াতে, তখন বাদ দে। আর ঠিকই তো,কাল যে অতকিছু করল ও, ওসবই বা কজন করবে? ‘
মিরাজ ভাবুক কণ্ঠে বলল, ‘ কিন্তু ও কী ওসব রাহাতের জন্যেই করেছিল? নাকী অন্য কিছু? তোদের কী মনে হয়!’
বাকীরাও চিন্তায় পড়ল এবার। সত্যিইত , তীব্রর ওসব করার কারণ কি শুধুই রাহাত?
****
খোরশেদুল পরিশ্রান্ত ভঙিতে বসার ঘরের কেদারায় বসলেন। চোখ-মুখে অপার ক্লান্তি! সবে মাত্র হাসপাতাল থেকে ফিরলেন। বিকেলে আবার অফিসে হাজিরা দিতে যেতে হবে । ওদিকে ক্যাটারিং এর বাকী টাকাও দেওয়া দরকার। কখন না কখন লোক পাঠায় তারা! এই বয়সে এত ছোটাছুটি শরীরে আর সইছে না।
গতকাল থেকে একটা না একটা বিপর্যয় নেমে আসছে কাঁধে। সব তো ভালোই চলছিল। একমাত্র মেয়ের বিয়ে, অনুষ্ঠান,পুষ্পিতার বিদেয় হওয়া। মাঝখান থেকে ওই অভদ্র গুলো এসেই সব কেমন বানচাল করে দিয়েছে।
কাল সবার সামনে মিথিলাকে রেখে চলে গিয়েছে পলাশ। প্রথমে তিনি ভেবেছিলেন,রাগ করেছে,মাথা ঠান্ডা হলে নিজেই ফিরবে। কিন্তু সে ছেলে ফেরেনি। এমনকি ফোন অবধি ধরছে না। এদিকে সমস্ত বিল্ডিংয়ের লোকজন মিথিলাকে কটু কথা শোনাতে ব্যস্ত। দেখছেও বাঁকা,তুচ্ছ চোখে। তারওপর স্বামীর ওমন ভাবে রেখে যাওয়ায়,হাসি-ঠাট্টায় সুবিধে হয়েছে ওনাদের।
সালমা বেগমের প্রেশার হাই। ভোরের দিকে ওয়াশরুমে গিয়ে পা পিছলে পড়েছেন। অসাবধানতায়,স্টিলের ট্যাপে মাথা ঠুকেছে। রীতিমতো গলগল করে র*ক্ত বের হয়েছে ক্ষ*ত থেকে। বাড়িতে তখন অল্প কজন। সকলে দিশেহারা হয়ে ওনাকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটেছেন। দূর্বল সালমা বেগম,এখন ভর্তি সেখানে। স্যালাইন চলছে পটাপট। আলেয়া বানু,মহিদুল সাহেব সবাই ওখানেই আছে।
খোরশেদুলের সব কিছু কেমন বি*ষাক্ত লাগছে। মেয়ের বিয়ে হলোনা দুটো দিন, এর মধ্যে এরকম একটা জ*ঘন্য কান্ড। তাও জামাইয়ের সামনে অসভ্য গুলো যা তা শুনিয়ে গিয়েছে! মান-ইজ্জত কিচ্ছু অবশিষ্ট নেই। তিনি শোবার-ঘরের বন্ধ দরজার দিক চাইলেন একপল।
মিথিলা স্বেচ্ছায় বন্দী সেথায়। ভোরবেলার এত চেঁচামেচিতেও একবার উঁকি অবধি দিলো না! ভেতরে আবার কিছু উল্টো-পাল্টা ঘটায়নি তো? যা সব কিছুর সম্মুখীন হচ্ছে মেয়েটা। বিপন্ন হয়ে কিছু করে না বসে। খোরশেদুলের বুক কাঁপে। মস্তিষ্কের শিরা লাফাতেই ত্রস্ত এগোলেন ওই ঘরের দিক।
***
রাহাত হাত-মুখ ধুঁয়েছে কেবল। বাবার সাথেই এসেছে বাড়িতে। আচমকা মনে পড়ল,বারান্দার চারাগুলোতে দুটোদিন পানি দেওয়া হয়না। পুষ্পিতা নিয়ম করে যত্ন নিতো সেসবের।
সে দ্রুত প্লাস্টিকের মগে পানি ভরল। দুরন্ত ছুটল বসার ঘরের দিক। এসে দেখল, দুদিনেই কেমন নেতিয়ে পড়েছে পাতাগুলো। পুরোনো সতেজ ভাবটা কম। হবেনা? তার ছোটপু নেই যে!
সে স্বযত্নে সব গুলোতে পানি ঢালে। আকষ্মিক রাস্তা হতে উৎকট শব্দে হর্ণ বাজল গাড়ির। একবারের জায়গায়, বেশ কয়েকবার। না চাইতেও ছেলেটার মনোনিবেশ ঘুরে যায় সেদিকে। সহজ ভাবে চাইলেও, উন্মুক্ত জিপে বসা তীব্রকে দেখতেই দৃষ্টিযূগল প্রকট হয়ে আসে।
তীব্র হাত নাড়ল,ইশারায় নেমে আসতে বোঝাল ওকে। আর কে পায় ! মগ, গাছ, পানি ফেলে রেখেই দৌড় লাগাল রাহাত। ধুপধাপ আওয়াজে খোরশেদুল ফিরে চাইলেন। ছেলের চপলতা দেখে শুধোলেন,
‘ কোথায় যাচ্ছো?’
রাহাত বিলম্বহীন, গড়গড় করে বলল,
‘ গাছে পানি দিতে গিয়ে মগটা নীচে পরেছে আব্বু। নিয়ে আসি?’
‘ যাও।’
রাহাত বেরিয়ে গেল দোর খুলে। খোরশেদুল এই সামান্য ব্যাপার নিয়ে ভাবলেন না। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মেজাজে নিজের কাজে এগোলেন।
**
তীব্র জিপ দালানের একটু সামনে নিয়ে থামিয়েছে। যাতে হুট করেই রাহাতের পরিবারের কেউ না দেখে ফ্যালে। দেখলে অবশ্য ওর কিছু হবেনা। ছোট ছেলেটা ভুগবে। রাহাত যেন হাওয়ার বেগে এলো। গাড়ির কাছে এসে থামল। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
‘ আপনি? ‘
তীব্র সিটের নীচ থেকে জলের বোতল নিয়ে,এগিয়ে দেয়।
রাহাত মাথা নাড়ল দুদিক। বোঝাল,লাগবেনা। সে রেখে দিলো আগের স্থানে। রাহাত একই প্রশ্ন আবার করল, উত্তেজিত সে।
‘ ভাইয়া, আপনি এখন এখানে?’
তীব্র ভ্রু উঁচিয়ে শুধাল,
‘ ছোটপুকে ফেরত চাই?’
ক্ষুদ্র চেহারার সবটুকু ঝলকে উঠল সবেগে। প্রত্যাশার কিরণ প্রতি পরতে ছড়াল। বিদ্যুৎ গতিতে ঘাড় ঝাঁকাল রাহাত। চাই মানে! একশ বার চাই।
তীব্র দরজা খুলে দিল,
‘ বোসো।’
‘ আপনি কী আপুর খোঁজ পেয়েছেন ভাইয়া?’
ভারি কণ্ঠের শান্ত উত্তর,
‘ ওঠো। বলছি!’
বিভ্রান্ত রাহাত উঠে বসল। তীব্র হুইল ঘোরাতে ঘোরাতে বলল,
‘ তোমার আপুর কলেজ চেনো?’
‘ না।’
‘ নাম জানো?’
‘ হ্যাঁ। ‘
‘ চলবে।’
রাহাত সারাটা পথ ছটফট করল। ব্যগ্র চিত্তে বসে থাকা কঠিন। তীব্র কোথায় নিয়ে যাচ্ছে কিচ্ছু জানেনা। শুধু চাইছে,গেলেই যেন পুষ্পিতাকে পায়। অথচ তীব্র হতে সামান্য আওয়াজ নেই। একেবারে পুষ্পিতার কলেজের সামনে এসেই জিপ থামাল সে। নামল,ওকে বলল,
‘ তুমি বোসো,আমি আসছি। ‘
রাহাত অস্থির হয়ে বলল,
‘ আমি যাব না?’
‘ না। ‘
তীব্র আশেপাশের দোকান দেখিয়ে বলল,
‘ কিছু খেতে চাইলে খেও। যে কোনও দোকানে আমার নাম বললেই হবে। আমি যাব আর আসব।’
রাহাতের নিরস বদন উজ্জল হলো না। শুধু ঘাড় কাত করল একটু। তীব্র কলেজের ভেতর পা বাড়ায়। প্রথমে দারোয়ানের সঙ্গে কথা বলে,মূল ভবনের দিক এগোয়।
রাহাত কাতর চোখে চেয়ে থাকল। ছোট্ট বক্ষ ভেদ করে ব্যথাতুর শ্বাস এলো। খুব ভোর বেলা বেরিয়েছিল মাকে নিয়ে। তন্দ্রিত চেহারায় অশেষ শ্রান্তি। অথচ পুষ্পিতার খোঁজ পাবে শুনতেই সব কেমন এক ঝটকায় মুছে গিয়েছে! এখন ফিরে পাবে তো ছোটপুকে? ওকে সাথে নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারবে?
গতকাল ওর ওপর দিয়েও কম ঝড় যায়নি। খোরশেদুল ঠিক বুঝেছিলেন,এসবের পেছনে সে-ই। সেই যে গিয়ে কথাগুলো তীব্রদের কানে দিয়েছে। আর তাতেই ক্রো*ধে আ*গুন হয়ে গায়ে হাত তুলতে পর্যন্ত উদ্যত হয়েছিলেন তিনি। আলেয়া বানু আটকেছেন ছেলে কে।
নাতী তার বংশের প্রদীপ! তার চোখের মণি! কিন্তু মিথিলা রেহাই পেলো না। বাইরের লোকজনের সামনে আলেয়া কুঁলুপ এঁটে থাকলেও, ঘরে ঢুকেই জবান ছুটেছে তার।
ছোট কণ্ঠে, প্রতিটা কথায় ওকে খুঁচিয়েছেন। তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে যা নয় তাই শুনিয়েছেন। মিথিলা তো আর পুষ্পিতার ন্যায় নরম -শরম নয়। একে স্বামী ফোন ধরছেনা,ব্লক করেছে নম্বর, দুইয়ে এসব। সে নিজেও তেলেবেগুনে জ্ব*লে উঠল। পাল্লা দিয়ে দাদীর সঙ্গে তর্কে নামল। কথা কাটা*কাটির পর্যায় তখন তুঙ্গে। খোরশেদুল মেয়েকেও কিছু বলতে পারেননি,মাকেও না। তবে স্বস্তি পেয়েছিলেন,সালমা ওষুধের প্রকোপে,নিদ্রায় বিভোর থাকায়। নাহলে কী যে হোতো!
ভোরে নুহাকে ফোন করে যখন কোনও ভাবেই পুষ্পিতার খোঁজ পেলেন না সালমা, আরো চারগুন ভে*ঙে পড়লেন । ফলস্বরূপ, অমন ভাবে পড়ে গিয়ে মাথা ফাঁ*টল। রাহাতের বিশ্বাস,পুষ্পিতা ফিরলেই এইসব কিছু আবার ঠিক হয়ে যাবে । আগের মতো সব কিছু ভালো হবে। এক তুড়িতে মা-ও সুস্থ হয়ে উঠবেন।
রাহাতের চিন্তার মধ্যেই তীব্রকে দেখা যায়। আসছে সে। রাহাত ব্যকুল চোখে তাকাল। তীব্র ওকে ওভাবেই,ঠাঁয় বসা দেখে বলল,
‘ কিছু খেলেনা?’
রাহাতের ওতে কান নেই। বিক্ষি*প্ত,অধীর প্রশ্ন ছুড়*ল,
‘ আপুকে পেয়েছেন? আপু কি ভেতরে আছে?’
তীব্র বলল,
‘ না। ‘
রাহাতের উতলা চোখ দুটি নিরা*শায় নিভে গেল। নিষ্পৃহ আওড়াল,
‘ তাহলে? ‘
তীব্র জিপে উঠতে উঠতে বলল,
‘ ব্যবস্থা করেছি। যাতে তোমার আপু এখানে পা রাখলেও, খবর আমার কানে চলে যায়।’
‘ কিন্তু ছোটপু এখানে এসে কী করবে ভাইয়া? ওর তো এখানকার পড়াশুনা শেষ। ‘
‘ জানি। তাও আসবে।’
‘ যদি না আসে? ‘
তীব্রর ভ্রু গুছিয়ে চাইল। কথাটা ফেলে দেওয়ার মতো মনে হয়নি। সত্যিইত, যে মেয়ের মাথার ওপর ছাদ আছে কী না, জানা নেই,সে কী আদৌ পড়াশুনার জন্যে কাগজ-পত্র নিতে আসবে কলেজে? যদি না আসে,তবে যে সমস্ত পরিকল্পনাই মাটি!
তীব্রর মুখের গুরুতর ভঙি দেখেই রাহাত যা বোঝার বুঝে নেয়। চাপা ক্রন্দ*নে, ফিনফিনে ঠোঁট ভেঙেচূ*ড়ে আসে। তীব্র ওকে শান্ত করতে বলল,
‘ কেঁদো না। তুমি না বড় হয়ে আমার মতো হবে? আমার মত হতে গেলে কিন্তু কান্না ভুলে যেতে হয় রাহাত। ‘
‘ কিন্তু ছোটপু…’
‘ পাওয়া যাবে। নিশ্চিত থাকো। ‘
রাহাত অশ্রু মুছে বলল, ‘ সত্যিই যাবে?’
তীব্র মাথা দোলাল। একপেশে হাসল একটু। পোড়া ঠোঁট কাম*ড়ে, ভাবল,
‘ তীব্র আজ অবধি যে কাজে হাত দিয়েছে তা বিফলে যায়নি। মেয়ে যেখানেই থাকুক,জমিনে বা পাতালে,খুঁজে আমি নেবই।’
চলবে।