গল্প :- সঙ্কোচ
পর্ব ৬
Writer :- Kabbo Ahammad
.
.
-:”কিন্তু এটাই কি ঘটতে চলেছে আশার ভাগ্যে?
আশার লাশটি পাওয়া গেলো ওদের বাসা থেকে দু’মাইল দূরে, হাইওয়ের ধারে, ও নিঁখোজ হওয়ার পাঁচদিন পর। প্রচন্ড পাশবিক নির্যাতনের পর খুন করা হয়েছে ওকে। ওর দু’ভাই একসাথে গিয়ে লাশটি শনাক্ত করলো। পুলিশ পোস্টমর্টেমের জন্য নিয়ে গেলো লাশটি। আর আশাদের বাড়িতে কান্নার রোল পড়লো।
আশার বাবা কিছুক্ষণ আফসোস করে কাঁদলেন মেয়ের জন্য। এরপর একদম চুপ করে গেলেন, কোনো কথাই বললেন না আর।
অনেকেই কাঁদলো আশার জন্য। কাব্যও কাঁদলো।
ও এসেছিলো আশাদের বাসায়। কিন্তু মিরাকে আনে নি। মিরা আশার মৃত্যুর খবর শুনে অসুস্থ হয়ে যেতে পারে, সেই ভয়ে। বাসায় থাকলে মা কিছু বলে দিতে পারে, এই চিন্তায় মিরাকে ওর বোনের বাড়িতে রেখে এসেছে, কোনো এক অজুহাতে।
আশার লাশ আসলো কাঠের বাক্সবন্দী হয়ে। তার বাবা শেষ দেখা দেখতে চাইলেন মেয়েকে। কিন্তু দেখতে দেওয়া হলো না। এমনিতেই খুনের জন্য বেশ বিভৎস হয়ে ছিলো ওর চেহারা, তার উপর পোস্টমর্টেমের কাটাকাটি, বাবা হয়তো সহ্য করতে পারতেন না ওকে দেখে। ওকে না দেখিয়েই শেষ বিদায় জানানো হয়ে গেলো।
রাতে যখন আত্মীয়-স্বজনে ভরে আছে বাড়ি, তখন আশার বড় ভাই গিয়াস দাঁড়িয়ে এক প্রস্তাব করলো।
–“আশার মৃত্যুতে আমার মনও আজ ব্যথিত, কিন্তু এই প্রস্তাব তোলার জন্য এমন উপযুক্ত সময় আর পাবো না আমি, কারণ আপনাদের সবাইকে একসাথে আবার কবে এভাবে পাবো, জানি না। (আত্মীয়দের উদ্দেশ্যে বললো সে)
প্রস্তাবটা হলো, গিয়াস জানতে পেরেছে, তার বাবা গ্রামের জমি নাকি স্কুলকে দান করে দেবেন। কেন এমন অবিচার তাদের ওপর। তারা কি তার বাবার সন্তান নন? কিছুই কি তারা করেননি বাবার জন্য? বাবা যে এতোদিন ধরে রয়েছে তাদের সাথে, কোন অভাবটা অপূর্ণ রেখেছে তারা বাবার? তাদের বউরা সারাদিন জান-প্রাণ দিয়ে খাটে বাবার জন্য (এ কথাটি বলার সময় দু বউই মুখে আঁচল চাপা দিয়ে কেঁদে উঠলো) বাবার সব আরাম আয়েশের জন্য কতো কষ্ট করেছে তারা। তবুও তাদের ওপর কেনো এই অবিচার? আচ্ছা, তাদের ওপর না হয় কোনো কারণে নাখোশ তাদের বাবা, কিন্তু তার নাতি-নাতনিরাতো রয়েছে। তাদের ভবিষ্যত এভাবে নষ্ট করে দেবেন তিনি, তাদের ওপরই কি একটুও মায়া নেই? এতোজন রয়েছে আজ একসাথে, সবাই যেন একটু বাবাকে বোঝান এই কথাগুলো।
শুনে সবাই সায় দিলে গিয়াসের প্রস্তাবে, ভুল কিছু বলেনি তো ও। বাবা প্রথমটায় গোঁ ধরে বসেছিলেন, শেষে সকলের চাপে পড়ে হোক, বা ছেলে-নাতি- নাতনিদের মুখের দিকে তাকিয়েই হোক- মেনে নিলেন প্রস্তাবটা। ঐ দশ বিঘে জমি তিনি ছেলেদের মাঝে ভাগ করে দেবেন। ছেলেরা খুব খুশি হলো। সে রাতে নিশ্চিন্ত মনে ঘুমাতে গেল তারা।
কিন্তু আমরাতো জানি, আশা ‘দিপা’ নাম নিয়ে একজনের বাসাতে আশ্রয়ে ছিলো। এখানে কি ঘটলো তবে?
এ ব্যাপারটি বুঝতে আমাদের আরেকটু পেছনে যেতে হবে। আশা নিঁখোজ হওয়ার পরের দিন। আশার বড় ভাই, আজমল নামের একজনকে আশার বাবার পেছনে লাগিয়েছিলেন। সে বিভিন্ন জায়গা তত্ত্ব-তালাশ করে খবর আনলো, বাবা তাদের গ্রামের জমি আশার নামে লিখে দিচ্ছে, আর আশা না থাকলে স্কুল এই জমি পাবে। গিয়াসের মাথায় হাত পড়লো শুনে। কি করবে বুঝতে পারছে না।
এর মধ্যেই, আশার বাসাতে পুলিশ আসলো একদিন। বাবা সেদিন বাড়ি ছিলেন না। পুলিশ জানালো, তারা এক মেয়ের খোঁজ পেয়েছে, রাস্তায় অ্যাকসিডেন্ট করেছিলো, এখন এক বাসায় আছে। মেয়েটি ওর নাম বলেছে দিপা, কিন্তু পুলিশের কাছে মেয়েটিকে দেখতে আশার মতোই মনে হয়েছে। তাই খবর এনেছে তারা। মেয়েটার একটা ছবিও এনেছে সঙ্গে।
গিয়াস আর ওর বউ দেখেই বুঝতে পারলো, এটা তাদের আশা। কিন্তু পুলিশের কাছে তারা ব্যাপারটি চেপে গেলো। বলে দিলো, এ মেয়েটা আশা হতেই পারে না। আর আশাই বা শুধুশুধু নাম চেঞ্জ করে থাকবে কেন? এটা অন্য কেউ।
তারপর পুলিশ চলে গেলে গিয়াস প্ল্যান বানাতে বসলো। এই প্ল্যানে তার ভাইকেও লাগবে, তাই ছোট ভাই জামিরকে খুলে বললো সবটা। দুভাই মিলেই ঠিক করে ফেললো কি করবে।
আশা যেহেতু নাম পরিবর্তন করে অন্য জায়গায় থাকছে, তার মানে তার বাসায় ফেরার ইচ্ছে নেই। এতে ভাইদের সুবিধেই হলো।
আজমলের সাথে পুলিশের কিছু কর্মকর্তার ভালো সম্পর্ক ছিলো। সে একদিন খবর আনলো, হাইওয়ের ধারে এক মেয়ের লাশ পাওয়া গেছে। মেয়ের মুখটা এমনভাবে থেতলে দেওয়া হয়েছে যে চেনা যাচ্ছে না।দু’ভাই-ই লুফে নিলো এই সুযোগ। লাশের কাছে গিয়ে বললো- এটাই তাদের আশা।
তখন বিভিন্ন প্রশ্ন যে ওঠেনি, তা নয়। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন- এতোদিন কোথায় ছিলো আশা? সন্দেহের তীর তো দুভাইয়ের দিকেই যায়। কিন্তু এসময়েই বড় বউ সবচেয়ে বড় খেলাটি খেললেন।
আশা বাড়ি ছাড়ার আগে তার বাবাকে একটা চিঠি লিখে বাবার টেবিলে রেখে গিয়েছিলো। সেই চিঠি কোনোভাবে টেবিল থেকে খাটের তলে চলে যায়, বাবা দেখেননি চিঠিটা। ঘর ঝাড়ু দেয়ার সময় বড় বউ পেয়ে যায় চিঠিটা, কিন্তু চিঠিটা তখন সে লুকিয়ে রাখে। এই গোলমালের মধ্যে সে চিঠিটা বের করে এনে সবাইকে দেখায়, সেখানে আশা তার বাবার কাছে ক্ষমা চেয়ে লিখেছে, সে নিজের ইচ্ছাতে বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে, বাবা যেন দুশ্চিন্তা না করেন। এই চিঠি দিয়েই বোঝা যায় দুভাই নির্দোষ, তখন এ নিয়ে খুব বেশি ঘাটাঘাটি হয় না আর।
এদিকে আসলো আশা তখন এসবের কিছুই জানে না। সে তখন অন্য এক বাড়িতে আশ্রয়ে। বাড়ির গৃহকর্ত্রী জাহানার বেগম, আশা সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত ওকে এ বাসাতেই থাকতে বলেছেন। কিন্তু ইদানীং একটা জিনিস ভালো লাগছে না তার। তার ছেলে আলিফ আশার দিকে যেন একটু বেশি নজর দিচ্ছে। কারণে অকারণে ওর রুমে চলে যায়, ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করে। তিনি বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করেন, কিন্তু লাভ হয় না। খুব ভয় লাগে তার। জোয়ান ছেলে, এমন যুবতী মেয়ে ঘরে থাকলে যেকোনো সময় অঘটন ঘটতে পারে। তিনি রাতে না ঘুমিয়ে বারবার ছেলের ঘরে উঁকি মারেন, ছেলে নিজের ঘরে আছে কিনা দেখার জন্য।
আশাও বুঝতে পারে, আলিফ যেন একটু বেশি ঝুঁকে পড়ছে আশার দিকে। আশা ওকে প্রশ্রয় দিতে চায় না, কিন্তু ওরও কেন যে ভালো লাগে আলিফের সঙ্গ। আলিফের কথা, হাসি, সবই এতো সুন্দর, ভালো লাগে আশার, আলিফ না আসলে ওর প্রতীক্ষায় বসে থাকতো সে। আর আলিফ আসলে বুকের ভেতর এক অদ্ভুত সুন্দর কেমন করা ভাব জেগে ওঠে।
আশা বোঝালো নিজেকে, ‘ছি আশা… তুই সামলা নিজেকে। তোর কি মনে হয়, তোর অতীত জানতে পারলে এরা কেউ মেনে নেবে তোকে? তবুও এমন করছিস কেন?’
কিন্তু সামলাতে আর পারলো কই?
সেদিন বিকেলবেলা, আশা ছাদে বসে চা খাচ্ছে, এসময় আলিফ এলো। ওর পাশে দাঁড়িয়ে বললো।
–“জানেন, বিকেল বেলার এই আলোকে কনে দেখা আলো বলে। কারণ এ সময়ের আলোতে মেয়েদের সবচেয়ে সুন্দর দেখায়।
–“তাই নাকি? আমাকে নিশ্চয়ই সুন্দর দেখাচ্ছে না?
–“আপনাকে অপ্সরীর মতো দেখাচ্ছে।
আশার সুন্দর মুখটা লজ্জায় লাল হয়ে গেলো। তখন আস্তে করে আশা বললো,
–“ধুর। আপনি বাড়িয়ে বলছেন।
–“একদমই বাড়িয়ে বলছি না। উল্টো আরো কম করে বলেছি। আচ্ছা, আপনি কখনো কারো প্রেমে পড়েছেন?
–“হ্যাঁ পড়েছি।
–“ওহ। সে এখন কোথায়?
–“মারা গেছেন।
–“ওহো, সো স্যরি।
–“স্যরির কিছু নেই, আমার জীবনটুকুই তো দুঃখে ভরা।(বলতেই আশার চোখে পানি জমে গেল)
তখন সে কিছু বুঝে ওঠার আগেই হঠাৎ করে আলিফ আশাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো।
–“প্লিজ দিপা, তোমার কষ্টের কিছু ভাগ চাই আমি। দিবে আমায় তোমার কষ্টের কিছু অংশ?
দিপা প্রথমে হকচকিয়ে গেলো, কি করবে সে বুঝতে পারছিলো না। এরপর ভালো লাগার এক আবেশ ছড়িয়ে পড়লো ওর সারা শরীর জুড়ে। খুব ইচ্ছে করছিলো এভাবেই যদি থাকতো সারাজীবন। হঠাৎ করেই ও বুঝতে পারলো কি হচ্ছে, এরপর এক ঝটকায় সরিয়ে দিলো আলিফকে। কাঁদতে কাঁদতে বললো।
–“না, এ হতে পারে না।
(বলে এরপর একদৌড়ে চলে গেল ছাদ থেকে)
ওদিকে ওরা জানতেও পারলো না, পুরো ব্যাপারটাই আলিফের মা আড়াল থেকে দেখেছেন। তার পুরো শরীর কাঁপতে লাগলো- রাগে, দুঃখে, ঘেন্নায়। তিনি ঠিক করলেন আজই তিনি এই মেয়েটাকে বাড়ি থেকে তাড়াবেন, আর এক মুহূর্তও দেরি করবেন না।
আর এদিকে কাব্য আশার বাড়ি থেকে ফেরার সময় মিরার বোন শিলা কাব্যকে ফোন দিলো।
–“দুলাভাই, তাড়াতাড়ি আসেন। আপু খুব কান্নাকাটি করছে।
এ কথা শুনে কাব্য তাড়াতাড়ি ছুটে গেলো। দেখতে পেল, মিরা যেন পাগল হয়ে গেছে। কাব্যকে দেখে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বললো।
–“সত্যি বলো, আশা মারা গেছে, তাই না? তোমার বাচ্চার দোহাই, আমায় সত্যি কথা বলো।
কাব্য তখন চুপ করে রইলো, কিছু বলতে পারলো না।
মিরা তখন আবার বলতে লাগলো।
–“সব দোষ এই বাচ্চাটার। তুই এই অসময়ে এলি কেন? তুই না আসলে তো এতো কিছু ঘটতো না। সবকিছু তো ঠিকভাবেই চলছিলো, তুই কেন এলি?
কাব্য তখন মিরার দিকে তাকালো। মিরা খাবার টেবিলে বসে আছে, ওর হাতে একটা ধারালো চকচকে ছুরি। সামিন খুব ভয় পেলো। মিরার মনের অবস্থা ভালো নেই। এখন যেকোনো সময়ে ও যেকোনো এক ভয়ঙকর কাজ করে ফেলতে পারে।
.
.
.
ওদিকে তখন কাব্যর আম্মু।
–“মিরার পেটে কোনো বাচ্চাই ছিলো না। ও এতোদিন মিথ্যা বলেছে আমাদের কাছে। ওর বোনের ব্যবহার করা টেস্টিং কিটটাই ও কাব্যকে দেখিয়েছে, ওর বোন ও তো প্রেগন্যান্ট। আর আমার ছেলেটাও গাধার মতো কিছু বুঝতে পারেনি, বউয়ের কথা মেনে নিয়েছে।
কথাগুলো বলে থামলো কাব্যর মা,
কাব্যর বাবাকে বলছিলো কথাগুলো এতোক্ষণ। কাব্যর বাবা তখন শুধু অবাক হয়ে তাকিয়ে বললো।
–“কি বলছো এগুলা কাব্যর মা, মাথা ঠিক আছে তোমার?
–“মাথা আমার ঠিকই আছে, তোমাদের মাথাই ঠিক নাই। রিয়ার সাথে কথা বলেই পুরা ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেছে আমার কাছে।
(রিয়া হচ্ছে কাব্যর মায়ের দুঃসম্পর্কের এক আত্মীয়ের মেয়ে। পেশায় ডাক্তার। কাব্যর মা তার কাছে মিরার আগের করা টেস্ট রিপোর্টগুলো নিয়ে গিয়েছিলো, যেগুলোর মাধ্যমে জানা গিয়েছিলো মিরা কখনো মা হতে পারবে না। মা মনে করেছিলেন এগুলো ভুয়া রিপোর্ট, মিরা যেকোনো সময়ই বাচ্চা নিতে পারতো, ইচ্ছা করেই নেয়নি। কিন্তু রিয়া রিপোর্ট দেখে বললো।
-“না আন্টি, এই কন্ডিশনে তো কিছুতেই বেবি নেয়া সম্ভব না।
কাব্যর মা তখন হতাশ হয়ে বাসায় ফিরছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করেই এই চিন্তাটা তার মাথায় আসে, রিয়া বলেছে কিছুতেই বেবি নেয়া সম্ভব না, তাহলে বাচ্চাটা হচ্ছে কিভাবে? সবচেয়ে সহজ ব্যাখ্যা, কোনো বাচ্চাই হচ্ছে না, সবটাই মিরা মিথ্যা বলেছে। তখন আরো কিছুক্ষণ ভাবলেন কাব্যর মা বিষয়টি নিয়ে। এরপরই দুয়ে দুয়ে চার মিলিয়ে ফেলেন তিনি।
–“কিন্তু ডাক্তারের রিপোর্ট আছে যে মিরা প্রেগনেন্ট। উনি তো না জেনে কিছু বলেননি।
(কাব্যর বাবা কথাটুকু শেষ করার আগেই মা থামিয়ে দিলেন)
–“তুমি কিছু জানো না। আমি খোঁজ নিয়েছি, ঐ ডাক্তার মিরার পুরনো বন্ধু। ও আর মিরা মিলেই সব রিপোর্ট বানিয়েছে। (মা)
–“কিন্তু মিরা এমন কাজ করবে কেন?(বাবা)
–“আমার উপর প্রতিশোধ নিতে। আমি যে ওকে বকাঝকা করতাম বাচ্চার জন্য, এজন্য। নাইলে এতো মেয়ে থাকতে আমার ভাইয়ের মেয়েটাকেই ও পছন্দ করলো কাব্যর জন্য? মেয়েটাকে অপমান করে ও আমার উপরই শোধ তুলেছে। ও এই কাজটা না করলে তো আজ আশাকে মরতে হতো না। দাঁড়াও, ওকে আমি কঠিন শাস্তি দেবো, এতো সহজে এই বেয়াদবকে ছাড়বো না আমি।
.
.
.
ওদিকে আশা চুপচাপ এক পার্কের বেঞ্চে বসে আছে, কোথায় যাবে কিছুই বুঝতে পারছে না। ওকে আলিফদের বাসা থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। আজ যখন ছাদ থেকে নেমে ও ঘরে ঢুকেছে, তার কিছুক্ষণ পরেই আলিফের মা ঘরে আসেন। আশার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করতে থাকেন।
–“বেহায়া বেশরম মেয়ে। বল তুমি ছাদে কি করছিলে?
আশা বুঝতে পারলো আলিফ যে তাকে জড়িয়ে ধরেছিলো ছাদে এটা উনি দেখছেন। তখন ও বললো।
–“আন্টি বিশ্বাস করেন…
–“চুপ, একদম চুপ। তোমার মতো মেয়েদের খুব চেনা আছে আমার। ছিঃ ছিঃ, একটা ছেলের সাথে এসব করতে তোমার লজ্জা করলো না? তুমি এখনই বেরিয়ে যাবে আমার বাড়ি থেকে।
(বলেই আশার ব্যাগ ওর মুখের উপর ছুড়ে মারলেন তিনি।)
এরপরই পার্কে চলে এসেছে আশা। চলে আসার আগে মনে হচ্ছিলো, যদি একটিবার আলিফ সামনে আসতো। যদি ওর মাকে বলতো যে আশার কোনো দোষ নেই। কিন্তু না, আলিফ আসেনি।
আশাতো জানে না, আলিফ সে সময় বাড়িতে ছিলো না। তার মা তাকে কোনো এক কাজে বাইরে পাঠিয়েছিলেন। যখন সে ফিরলো আর আশার বেরিয়ে যাওয়ার খবর শুনলো, সেও বেরিয়ে পড়তে চেয়েছিলো আশার খোঁজে। কিন্তু তার মা তাকে বেরোতে দেননি, ওকে রুমের মধ্যে আটকে রাখেন। তখন বন্ধ রুমে চিৎকার করা ছাড়া ও কিছুই করতে পারলো না আলিফ।
আশা কি করবে বুঝতে পারছিলো না। একবার ভাবছিলো বাড়িতেই ফিরে যাবেন, তো আরেকবার মনে হচ্ছিলো যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাবে, তার জন্য তো কেউ অপেক্ষায় নেই, তার কোনো ক্ষতি হলে বা মরে গেলেই বা ক্ষতি কি। এসব যখন ভাবছে আশা, তখনই তার পাশে এক বৃদ্ধ লোক এসে বসলেন। তার চুল আর মুখ ভরা দাঁড়ি সব পেকে সাদা হয়ে গেছে, চেহারাতে জ্ঞানী জ্ঞানী ভাব, দেখলেই মনে শ্রদ্ধাভাব চলে আসে।
লোকটি আশার পাশে বসে বললেন।
–“এখানে একলা বসে আছো কেন মা? তোমার বাসা কোথায়?
–“আমার কোনো বাসা নেই। যাবারও কোনো জায়গা নেই।
–“পালিয়ে এসেছো বাসা থেকে?
আশা কোনো জবাব দিলো না। লোকটি কিছুক্ষণ চুপ করে তারপর আবার বললেন।
–“মা, এই শহরে তুমি একা না, আরো অনেক নির্যাতিত মেয়ে এভাবে পালিয়ে আসে। এরপর ওদের যাওয়ার আর কোনো জায়গা থাকে না। আমি খুবই সাধারণ মানুষ, কিছু সহায় সম্পত্তি আছে আমার, তা এসব নির্যাতিত মেয়েদের জন্য আমি ব্যবহার করতে চাই। আমার এক আশ্রয়কেন্দ্র আছে। সেখানে অনেক মেয়েই নানারকম কাজ শেখে, সাবলম্বি হয়। তুমি যাবে সেখানে?
আশা যেন পায়ের তলাতে মাটি পেল। এমন আশ্রয়কেন্দ্রের কথা শুনেছে ও। সাথে সাথেই বলে দিলো।
–“যাবো আমি।
–“খুব ভালো হলো মা। আজই তোমায় নিয়ে যাবো আমি। তুমি একটু বসো, আমি গাড়ি আনতে বলে দিচ্ছি। এখনই আমি তোমায় নিয়ে যাবো সেখানে।
তখন আশার থেকে একটু দূরে গিয়ে লোকটা কাউকে ফোন দিলো। এরপর ফিসফিস করে বললো,
-“টাকা রেডি রাখো। নতুন জিনিস নিয়ে আসছি।
.
.
.
এদিকে মিরা ঘুমিয়ে আছে, ওর হাত পা বিছানার সাথে বাঁধা। এ ছাড়া কোনো উপায় ছিলো না কাব্যর। খুব পাগলামি করছিলো ও। একটা ছুরি নিয়ে নিজের পেটে ঢুকিয়ে দিতে চাচ্ছিলো। তখনই যদি শিলা আর কাব্য ওকে না থামাতো, তবে ওকে হয়তো আর বাঁচানো যেতো না।
এরপরই মিরার হাত পা বিছানার সাথে বেঁধে ফেলা হয়। এরপরেও পাগলামি কমে না মিরার। চিৎকার চেঁচামেচি করতে থাকে। কিছুই খেতে চায় না। এদিকে ওর শরীরও খারাপ হচ্ছে ধীরে ধীরে। গা প্রচন্ড গরম। যা খায় তাই বমি করে ফেলে দেয়। অবস্থা খারাপ দেখে কাব্য ডাক্তার নিয়ে আসে। ডাক্তার দেখে বলেন।
–“ওর অবস্থা একদমই ভালো না। আজই হাসপাতালে এডমিট করুন ওকে। আপনাকে কতো করে বললাম, ও শক পায় এমন কাজ করবেন না, তাহলে মা আর বাচ্চা দুজনেরই ক্ষতি হবে। তবুও সে কাজটি করেই বসে আছেন।
তখন ঘুমন্ত মিরার পাশে বসে আছে কাব্য। অ্যাম্বুলেন্সে ফোন দেয়া হয়েছে, কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে। এরমধ্যেই মিরা চোখ মেলে তাকালো। কাব্যকে এভাবে বসে থাকতে দেখে খুব খারাপ লাগলো ওর। তখন আস্তে আস্তে বললো।
–“তোমাকে খুব কষ্ট দিচ্ছি, না?
–“না তো। কষ্টের কি আছে? তুমি চিন্তা করো না একদম। সব ঠিক হয়ে যাবে।
–“তোমাকে অনেক ভালোবাসি কাব্য। আমি খুব ভাগ্যবতী, যে তোমার মতো স্বামী পেয়েছি।
মিরার চোখে পানি। কাব্য কিছু বলবে ওকে, এরমধ্যেই ওর মা ফোন করলো। ফোন ধরতেই মা জিজ্ঞেস করলেন।
–“কাব্য কই তুই?
–“মা মিরার বোনের বাসায়। মিরা খুব অসুস্থ।
–“অসুস্থ না, সব মিথ্যা। তুই ঐ ডাইনিকে আজকেই, এক্ষুণি তালাক দিবি। আর যদি না দিস, তবে তোর মাকে আর কোনোদিন দেখতে পারবি না।
.
.
চলবে………………