#এক কাপ চা
পর্ব ২০
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
(৫৮)
এই শীতের মাঝেও সাগরিকার পায়ে বরফ ধরে রেখেছে তার মা।গরম পায়েস তার পায়ে পড়ে অনেকটা পুড়ে গেছে।তাশদীদের মা পায়েস রান্না করে বাটিতে বেড়ে ঘরে নিয়ে যাচ্ছিলেন। নিজের পরনের শাড়িতে পা লেগে তাল সামলাতে পারেনি। পায়েসের বাটিতে থাকা পায়েস সাগরিকার পায়ে পড়েছে। সাথে সাথে ঠান্ডা পানি দিয়ে পরিষ্কার করেও লাভ হয়নি হাটুর নিচের অনেকটা লাল হয়ে আছে। কেউ কেউ বলছে পেস্ট দিতে। কেউ বলছে ডিম ভেঙ্গে দিতে।সাগরিকার মা কারোর কথায় কান না দিয়ে ঠান্ডা পানি ঢালছে পায়ে।
কিছু কিছু সময় নিজের ক্ষতি হলেও যার কারণে ক্ষতি হয় তাকে কিছু বলা যায় না।
সাগরিকা একটা মাত্র মেয়ে তার। জন্মের পর থেকে মেয়েটার উপর শুধু বিপদ আপদ আসে। কোথাও একা খুব একটা ছাড়ে না।এত বড় মেয়ে হলেও মাঝেমধ্যে তাকে খাইয়ে দেয় সে। আজ অবধি মেয়ের কোনো কাপড় তাকে পরিষ্কার করতে দেয়নি।এমন কি চা বানানোর জন্যও যখন সাগরিকা রান্না ঘরে থাকে তখন তার মা পাশে দাঁড়িয়ে থাকে।ছোটো বেলায় একবার গাছ থেকে পড়ে গিয়েছিল সাগরিকা।
এরপর থেকে হুটহাট কোনো খুশীর খবর কিংবা উত্তেজনা সহ্য করতে পারে না।ভয় পেলেই তার মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দেয়। জ্ঞান হারিয়ে না ফেললেও ঘোরের মধ্যে চলে যায় সে।
পোড়া অংশে এখনো ফোস্কা পড়েনি। সাগরিকার মা মেয়ে নিয়ে ঘরে যেতে চাইলেন।ভয় পেয়েছে সাগরিকা। থরথর করে কাঁপছে সে।
বিছানায় বসতেই শুভ্র এলো ঘরে। আজ বিকেলেই সে ফিরেছে ফ্রান্স থেকে।সম্পর্কে সাগরিকার ছোটো ফুপুর ছেলে অর্থাৎ তুলির ভাই। সে এসেই বায়না ধরেছিল পায়েস খাওয়ার জন্য।
বিছানার এক পাশে বসে সে সাগরিকার মায়ের দিকে সরিষার বীজের একটা পেস্ট এগিয়ে দিয়ে বলল,
“মামীমা এটা লাগিয়ে দিন। অনেকটা কমে যাবে।”
“তুমি দাঁড়িয়ে আছো কেন? বোসো।”
“ওর তো হাটুর নিচটার কাছাকাছি পুড়েছে। আপনি লাগিয়ে নিন।আমি বাহিরে দাঁড়িয়ে আছি।লাগানো হলে আসবো।”
পুড়ে যাওয়ার সময় ওখানে তাশদীদ ছিল।সে দেখেও দেখেনি এমন একটা ভাব নিয়ে চলে গিয়েছিল বাড়িতে থাকা বাকী মানুষের মতোন।সাগরিকার সাথে শুধু তার মা, আর ইখুম বসে ছিল সবটা সময়। হাটুর অবধি কাপড় উঠানো ছিল বলে কেউ ওদিকে যায়নি।তুলির হাতে একটা মলম পাঠিয়েছে তাশদীদ। তুলি দৌড়ে এসে মলম বিছানায় রেখেই চলে গেল।তারা আজ পুরো গ্রাম দেখতে যাচ্ছে। যাওয়ার কথা শুভ্রেরও ছিল কিন্তু সে রয়ে গেল। সাগরিকার মা ডাক দিতে ঘরে প্রবেশ করে শুভ্র বলল,
“তুই যে পোল্ট্রি মুরগি আগে তো জানতাম না।”
“এটা সবাই জানে। তুমি যেহেতু জানো না এটা তোমার ব্যর্থতা।”
“যা তোর জন্য ব্যর্থতা হতে পারে অন্যের জন্য সফলতা।”
“বিদেশ গিয়ে একদম বদলে গেলে ভাইয়া।”
“শুভ্র উঠে দাঁড়িয়ে একবার আয়নায় নিজেকে দেখে বলল
এই দেশ থেকে যখন গিয়েছিলাম তখন
উচ্চতা ছিল ১.৮৩ মিটার ওজন ছিল ৬৫ কেজি। এখনো কেবল ওজন বেড়ে হয়েছে ৭০ কেজি।ওজন বদলাতে মানুষ বদলে যায়?”
“আমি তা বলিনি।”
“মন খারাপ?সবাই রেখে চলে গেলো যে? “
“না তো।আমার অভ্যেস আছে।”
“অভ্যেস থাকলে ভালো।চল ছাদে যাই? “
“এই পা নিয়ে?”
“একটু গরম আঁচ লেগেছে। পা কেটে ফেলে দিতে হয়নি। চল দেখি।”
(৫৯)
সামিনার পর পর তিন দিন এই রক্ত বমি হলো।এবার সে ব্যাকুল হয়ে আয়নায় নিজেকে দেখতে লাগলো।তার নিজের চেহারার প্রতি যত্ন সেদিন হারিয়েছে যেদিন তার স্বামী মারা গেলো।ফোনে খবর পেয়েছিল তার স্বামী আর নেই। এসিডের গাড়ি বিস্ফোরণে মাধ্যমে মারা গেছেন। তার লাশের কোনো অংশ নেই।শুধু না কী হাড়গোড় ছিল।তবুও ছিন্নভিন্ন। কোম্পানি থেকে তার লাশ পাঠানো হয়নি।বলেছিল লাশের কিছুই অবশিষ্ট নেই। কী পাঠাবে তারা?
নিজের মেয়েকে বুকে নিয়ে সারা রাত পড়ে থাকতো সামিনা।বার বার করে সবার কাছে মিনতি করেছিল
হোক হাড়গোড় তবুও যেন তার স্বামীকে এই দেশে এনে দাফন করা হয়। কিন্তু সেদিন কেউ তার কথায় কান দেয়নি তার স্বামী হয়তো পড়ে আছে ভীন দেশের কোনো এক কবরস্থানে। না কী তার কোনো দাফন হয়নি। কে জানে কী করেছিল তার সাথে!
আয়নায় তাকিয়ে সামিনা দেখতে পেল তার মুখে বয়সের ছাপ। মনে হচ্ছে তার বয়স কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে বেড়েছে অনেকটা।শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুখ মুছে বিছানায় এসে বসলো সে। তার শরীর ভালো না এটা স্নেহাকে বুঝতে দেওয়া যাবে না।তার মেয়ের জন্য হলেও টিকে থাকতে হবে তাকে। প্রথম বমি হয়েছিল মাস ছয়েক আগে। সেদিন প্রথম তার শাশুড়ি কল দিয়ে বলেছিলেন রাশেদকে তার ওয়াদার কথা মনে করাতে এবং স্নেহার দায়িত্ব নিতে। দ্বিতীয় বার হয়েছিল এই দিন কয়েক পূর্বে যখন মুনিরের বিয়ে হয় আর তার শাশুড়ি তাকে বলেছিল রাশেদ কে বিয়ের কথা বলতে। সে রাজী হয়নি কিন্তু রক্তবমি হওয়ার পর জুলি তাকে বলেছিল কঠিন রোগের লক্ষণ হলো এই রক্ত বমি। যদি সে না বিয়ের কথা বলে আর যদি তার কিছু হয়ে যায় তখন স্নেহার কী হবে?
দশ পাঁচ ভাবার সময় নেয়নি সামিনা।মেয়ের কথা চিন্তা করে আত্মসম্মান ত্যাগ করে রাশেদকে বিয়ে করতে বলেছিল। কিন্তু সে ইখুমের দিকটা ভুলে বসেছিল।সেরাতে যখন সে স্বপ্নে তার মৃত স্বামীকে দেখতে পায় যে তার মৃত স্বামী মন খারাপ করে বসে আছে তখন তার টনক নড়ে সে কী করতে যাচ্ছিলো।সে তার স্বামী কে ভালোবাসে, ভালোবাসে তার নিজের মেয়েকে।কিন্তু একমাত্র মেয়ের ভবিষ্যৎের জন্য মরিয়া হয়ে অন্যের ক্ষতি করা উচিৎ নয়।
আপাতত সে নিজের চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে। তাকে দ্রুত তার ভাইয়ের কাছে যেতে হবে। ডক্টর দেখানো প্রয়োজন। অন্তত সেই মেয়ের জন্য হলেও তাকে টিকে থাকতে হবে যে মেয়ের জন্য সে এতটা নীচে নেমেছিল।
জুলি ঘরে প্রবেশ করে ওয়াশরুমে যাচ্ছিলো গরম পানি রাখতে। রক্তের দাগ দেখে চিৎকার করে বলল,
“আবারো বমি হইছে?কইলাম না?এহন কী করবা?তোমার মেয়েরে কে দেখবো?রাশেদরে বিয়াডা করলে রাশেদ বাধ্য হইতো দেখতে। মরলে কী করবো জনো?এতিম খানায় নিয়া দিয়া আইবো।এহনো সময় আছে রাজী হও।”
“আমার যা বলার বলেছি।এসব বলে আমাকে আর বিরক্ত কইরেন না।”
“তোমার মাইয়্যারে কেডায় দেখবো?”
“আল্লাহ্ দেখবে।”
সামিনার কথায় জুলির মুখ ভার হয়ে এলো। সামিনা সেদিকে খেয়াল না করেই গা এলিয়ে দিলো বিছানায়।তার মনে হতে লাগলো সে তলিয়ে যাচ্ছে গভীর ঘুমের দেশে।
(৬০)
শুভ্র ফিরে আসার পর থেকেই বাড়িতে উৎসব মুখর পরিবেশ শুরু হয়েছে। তাশদীদ ফিরে সাগরিকার ঘরে ঢুকে দেখলো তার দেওয়া মলম টা কেউ পুরোটা টিপে টিপে বের করে ফেলে দিয়েছে। তা দিয়ে লেখা হয়েছে
“গো টু জাহান্নাম মি.তাশদীদ।”
তাশদীদ বুঝলো এটা সাগরিকা করেছে তবুও কিছু না বলেই তাকে খুঁজতে লাগলো। দেখতে পেল সাগরিকা বসে আছে তাদের বসার ঘরে। বাড়ির সব বাচ্চারা বসেছে তাকে ঘিরে। আসরের মধ্যমনি হচ্ছে সে।গল্প বলছিল, রুপকথার গল্প।যে গল্পে থাকে এক রাজা আর সাত রানী।বাচ্চারা উৎসুক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। টানটান উত্তেজনা,
রাজার সাত রানীর এক ছেলে বনাম রাক্ষুসির যুদ্ধ।
ঠিক সে সময় তাশদীদের খেয়াল হলো সাগরিকার পা রাখা শুভ্রের কোলের উপরে রাখা বালিশে। সে আস্তে-ধীরে মালিশ করে দিচ্ছে সাগরিকার পুড়ে যাওয়া বাম পা।
চলবে…