#এক কাপ চা
পর্ব ২৫
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
(৭৩)
সামিনা তার বড় ভাইয়ের সাথে হাসপাতালে এসেছে। ডক্টর সব কিছু জানার পর কিছু টেস্ট করতে দিয়েছেন।ভাইয়ের সাথে সামিনা বসে আছে ওয়েটিং রুমে।স্নেহা তার কোলের মাঝে ঘুমিয়ে আছে। স্নেহাকে তার বড় মামাতো ভাই নিতে চাইলে ইখুমের হঠাৎ মনে পড়লো স্নেহা তাকে বলেছিল সে কারোর কাছেই যাবে না। তাই সে না করলো কিন্তু মিনিট দুই পর প্যাথলজি ল্যাব থেকে ডাক পড়তেই স্নেহাকে তার মামাতো ভাইয়ের কাছে রেখে যেতেই হলো।কারণ সামিনার বেশ কয়েকটি রক্ত পরীক্ষা দিয়েছে। রক্ত নেওয়াটা স্নেহা সহ্য করতে পারে না।
সামিনা চলে যেতেই স্নেহা কারোর শক্ত স্পর্শে জেগে উঠেছে।
অপুষ্পিত দেহে পুরুষালী স্পর্শে কেঁদে উঠলো স্নেহা।
নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চাইলে হাতের বাধন আরো শক্ত হলো।
স্নেহা শুধু বলল,
“মায়ের কাছে যাবো।মা কই?”
“আছে আছে। চলো একটু বর বৌ খেলি।”
“না আমি খেলবো না।”
“কেন?”
“আমার ভালো লাগে না।তুমি ভালো না।”
“তোমার ভাইয়ারা বুঝি তোমার সাথে বর বৌ খেলে না?”
“না, আমার ভাইয়ারা আমাকে খুব আদর করে। ওরা ব্যথা দেয় না।”
“আহারে দেখছো?ওরা তোমার সাথে খেলেও না আর তুমি আমাকে পছন্দ করো না।আমি তোমার সাথে বর বৌ খেলতে চাচ্ছি, সুন্দর সুন্দর পুতুল কিনে দিবো আর তুমি নিবে না?”
“লাগবে না। তুমি আমাকে ব্যথা দাও খালি আর আমার ভাইয়া, চাচ্চুরা আমাকে এমনিতেই পুতুল এনে দেয়। আমার লাগবে না তোমার পুতুল। আমি মায়ের কাছে যাবো।”
“আমিও ব্যথা দেবো না সোনা।একটু খেলবো।”
“আমি মায়ের কাছে যাবো। আমি মা কে সব বলে দিবো।”
“কান্না করে না।মানুষ জানলে কিন্তু তোমাকে পঁচা বলবে। তোমার মা কিন্তু আর তোমার সাথে কথা বলবে না।তোমাকে বের করে দিবে।”
“দিবে না।আমার বড় মা কে আমি সব বলে দিবো।তাশদীদ ভাইয়া তোমার নাক ফাটিয়ে দিবে। আর সাগরিকা আপু তোমাকে মার দেবে।”
“তুমি যদি এসব বলো তো তোমার তাশদীদ ভাইয়া, সাগরিকা আপু কেউ তোমাকে আর আদর করবে না।”
“আমার রাঙ্গা মা আছে।ছোটো চাচ্চু আমাকে আদর করবে। বড় বাবা আমাকে আদর করবে। আমি রাঙ্গামা কে সব বলে দিবো।”
“তাহলে তোমার মা কে আর তোমাদের বাড়িতে যেতে দিবো না।এইখানে আটকে রেখে দিবো।তোমার বাবাকে আর দেখেছো?ওই রকম হারিয়ে যাবে সে। ভালো হবে না?”
“আমি মায়ের কাছে যাবো।”
স্নেহার মামাতো ভাই তাকে নিয়ে ওয়েটিং সিটে বসে ছিল।এতক্ষণ এদিকটা ফাকা থাকলেও স্নেহার কান্নার শব্দে রিসিপশন ডেস্ক থেকে একজন এগিয়ে এলো।সে জিজ্ঞেস করতেই বলল,
“ফুপু একটু ব্লাড দিতে গেছেন তাই কান্না করছে।তেমন কিছু না।”
কিন্তু লোকটার যেন বিশ্বাস হলো না তাই সে স্নেহাকে জিজ্ঞেস করলো,
“তোমার কী লাগে? তুমি একে চিনো?”
স্নেহা কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“আমার ভাইয়া লাগে।”
লোকটা চলে গেলেও যেন তার দৃষ্টি নিবিষ্ট রইল ওদের উপর।
স্নেহার মামাতো ভাইয়ের বেশ রাগ হলো।এবার বাড়ি আসার পর সে স্নেহাকে একা পায়নি। সব সময় মায়ের আঁচল ধরেই থাকে। যা একটু সুযোগ পেয়েছে সব’টা এই রিসিপশনের লোকটার জন্য মাঠে মারা গেল।
রাগে কিড়মিড় করে ছেলেটা আরো জোড়ে চাপ দিয়ে ধরলো স্নেহার নিতম্বে।
(৭৪)
তাশদীদের জন্য খাবার নিয়ে ঘরে প্রবেশ করলো সাগরিকা।তাশদীদ নিজে নিজেই ব্যস্ত তার কপালের ব্যান্ডেজটা পাল্টাতে। কিন্তু ডান হাতে ব্যথা পাওয়ার কারণে সে করতে পারছে না।একটা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে সামনে থাকা আয়নার দিকে তাকালো তাশদীদ। আয়নার সাগরিকার অবয়ব স্পষ্ট। চোখের ইশারায় বলল এইড বক্সটা নিয়ে বারান্দায় আসতে। তাদের বাড়ির এই বারান্দাটা লম্বালম্বিভাবে এগিয়েছে। যেমনটা দেখা যায় পুরোনো কোনো রাজবাড়ী কিংবা একচালা প্রাইমারি স্কুলে।
সাগরিকা লম্বার তাশদীদের থেকে অনেকটা খাটো হলেও এখন সে লম্বা।তাশদীদ বসেছে একটা টুলে। কিন্তু এবার সাগরিকার জন্য ঝামেলা হলো।সে দাঁড়িয়ে যে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিবে, কাজটা খুব কষ্টের হচ্ছে। সাগরিকা উবু হয়েও কাজটা করতে পারছে না।
কিছুটা দূরে গিয়ে নিজের গায়ের চাদর রেখে সামনে এগিয়ে এলো সাগরিকা।একটু ঝুকে হাত দিলো তাশদীদের কপালে।
শুভ্র সকাল সকাল একটা আপেল হাতে এদিকটায় আসছে। আপেলে কামড় বসাতেই নজর গেলো তাশদীদ এবং সাগরিকার দিকে। তাশদীদ নিজেও এক নজর শুভ্রকে দেখেছে। তাদের মধ্যকার স্নায়ু যুদ্ধ এবং যুদ্ধের পর সাগরিকা নামক স্বাধীনতা সবটাই দুজনের সামনে।শুভ্র যত দ্রুত এগিয়ে আসছিল তার আগেই তাশদীদ একটা কাজ করে বসলো।
বাম হাতে সাগরিকার কোমড় জড়িয়ে তাকে নিজের উরুর উপর বসিয়ে দিয়েছে। ঘটনাটা এত দ্রুত ঘটলো যে সাগরিকা নিজেও কিছুটা বোকা বনে গেলো।
তাশদীদ স্বাভাবিক ভাবে বলল,
“এবার তোর হাইটের সাথে ঠিক আছে। দ্রুত কর,ক্ষুধা পেয়েছে।”
সাগরিকা চুপচাপ কাজ চালিয়ে গেলো।কোনো কথা বলার তার ইচ্ছে নেই।আজকের পর এমনকি কিছুক্ষণ পর থেকেই মৌসুমি সবটা করবে। শুধু একটু সময়ের জন্য তর্ক বির্তক করার মন টানলো না সাগরিকার। দ্রুত ব্যান্ডেজ পালটে উঠে দাঁড়ালো সে। মৌসুমি ততক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে। বারান্দায় রোদ আসায় মুনির, তাজবীদ ওরা সবাই জমেছে সকালের নাস্তা করার জন্য। তাশদীদের পাশে মৌসুমি বসার জন্য দাঁড়াতেই সাগরিকা উঠে দাঁড়ালো।সে নিচের দিকে চলে যাচ্ছিলো তখন তাজবীদ বলল,
“কই যাচ্ছিস? খাবি না?”
“বসার জায়গা নেই, তোমার কোলে বসবো?আসি?”
সাগরিকার এমন কথায় তাজবীদ ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো।নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
“রাগ করেছিস কেন?কী হয়েছে?”
সাগরিকা কোনো জবাব না দিয়ে নিচে নেমে গেলো।সোজাসুজি গিয়ে নেমেছে পুকুরে। ঠান্ডা পানিতে পর পর সাত টা ডুব দিয়ে বসে রইল শান বাধানো পুকুর ঘাটে।
সাগরিকা চলে যাওয়ার পর তাজবীদ বলল,
“কেউ ওকে কিছু বলেছে?ওর এত রাগ উঠেছে কেন?”
তাজবীদের কোথায় শুভ্র বলল,
“মেয়েরা সব সহ্য করতে পারে কিন্তু নারী দেহে অযাচিত কারোর স্পর্শ নয়। জোড় করে আর যাই হোক নারী মন স্পর্শ করা যায় না।মন স্পর্শ করতে হলে তাদের স্নেহের সমেত আগলে রাখতে হয়। নারী যখন স্নেহ বুঝে, প্রেমিক পুরুষের ভালোবাসার জন্য তখন সে নিজেই এগিয়ে আসে। অথচ যে পুরুষ কোনো দিন প্রেমিক ছিলোই না তার স্পর্শ নারী মনে শুধু ঘৃণার জন্ম দেয়।”
(৭৫)
সাগরিকা কোনো কালেই তার দাদীর কাছে প্রিয় ছিল না।কেন ছিল না সে জানে না।শুধু জানে তার দাদী তাকে পছন্দ করে না।পুকুর পাড় থেকে ফিরে এসেই দাদীর সামনাসামনি হলো সে। তার দাদী তাকে কিছুটা বিরক্তির সাথেই অনেক কথা শুনালো।সাগরিকাকে পছন্দ না করার একটি অন্যতম কারণ হলো সাগরিকা মেয়ে। সে খুব করে চেয়েছিল তার সেঝ ছেলের একটা ছেলে হবে কিন্তু সাগরিকা জন্মের পর ডক্টর জানিয়েছিল সাগরিকার মা আর কোনো দিন মা হতে পারবে না।এজন্য তার দাদী তাকে দেখতে পারে না।একটা মেয়েকে ঘিরে কী করে জীবন চলতে পারে। বিরক্তি এসে গেছে তার সাগরিকার উপর। যদিও তাকে মেনে নেওয়া যায় কিন্তু মেয়ে হয়েছে উড়নচণ্ডী। নিজের ইচ্ছে মতোন সব করে। এবাড়ির ছেলেদের নিয়ে তার যত চিন্তা।সে চেয়েছে সাগরিকাকে যত দ্রুত বিয়ে দেওয়া যায়। তাই পাত্র ও দেখেছে কিন্তু মেয়ে কোনো কাজ পারে না,ছেলের বাড়ি সব প্রকার ফসল ফলে।পুরো বছর বত্রিশ জন মানুষের ভাত তিন বেলা রাধতে হবে। তাছাড়া আরো কত কাজ।শহরে থেকে এই মেয়ে রুপচর্চা করতে জানে শুধু।
এমন বনেদি পরিবার সে হাত ছাড়া করবে না। সে ওতটা অবুঝ না। সাগরিকাকে যে তাশদীদ পছন্দ করে এটা সে বুঝে। কিন্তু সাগরিকার থেকে মৌসুমি তাশদীদের জন্য ভালো। ওদের ক্ষমতা আছে, তাশদীদকে সাহায্য করবে বিপদে পড়লে তাছাড়া মৌসুমিকে সে কথা দিয়েছে। আজ কালের মধ্যেই ওদের চিনি পানিটা করিয়ে দিবে। এরপর ঘরে বৌ এলে তাশদীদের আর অন্য দিকে মন যাবে না।তখন এই সাগরিকার এক ব্যবস্থা হবে।
“যা চুলোয় পানি দেওয়া আছে, সবাইরে চা দিবি।”
সাগরিকা কিছু না বলে চলে এলো।কাপড় বদলে চা ঢালতে গেলেই বাধলো বিপত্তি।পুরো এক পাতিল চা পড়ে তার হাতে ফোস্কা পড়ে গেল।মা কোথাও নেই, তার দাদী এসে সবটা দেখেও দেখলো না,
পুনরায় চা বসাতে বলল সে।আজ সাগরিকার ইচ্ছে নেই জেদ করার। তাই যা বলল তাই করলো। কিন্তু চা নিয়ে যখন উপরে গেল তখন হাত টা ঢেকে ফেলেছে সে।
মুচকি হাসি হেসে তাশদীদ এবং মৌসুমিকে চা দিয়ে বলল,
“চায়ে আজ চিনি কিছুটা বেশি দিয়েছি। কারণ তোমাদের বিবাহিত জীবন মিষ্টিময় হোক।”
“কাদের বিয়ে?”
“আপনার এবং মৌসুমি আপুর।”
“মানে?”
“আগামীকাল চিনি পানি আপনাদের।”
তাশদীদ এক মুহুর্ত অপেক্ষা না করে সাগরিকার হাত ধরে টানতে টানতে নিচে নিয়ে এলো।তাকে গাড়িতে বসিয়ে ড্রাইভার কে বলল,
“কাজী অফিসে চলেন।”
চলবে …..