#এক কাপ চা
.
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
#পর্ব ৩০
(৮৮)
“এই বাচ্চা মেয়ে গুলোকে বিয়ে করতে কে বলেছে? এদের বিয়ে করা মানেই আকাশ সমান ঝামেলা নিয়ে ঘুরে বেড়ানো।না এরা বুঝে কোনো কিছু না পারে সমস্যা মেটাতে। খালি পারে নাত্তাইলি করতে।”
তাজবীদের কথায় মুনির বলল,
“ছোত্ত বাঈ মাতা তান্ডা কয়ো। কি হয়েছে এবার বলো।”
“আন্টি বিয়ে করবো আমি বুঝছো?একদম আন্টির বয়সী।যে মেয়ে সব বুঝবে।”
“কী হয়েছে বলবি তো?”
“ভাইয়া কই?তাকে নিচে শালিসে যেতে বলো।তার বউ সেখানে নাত্তাইলি শুরু করেছে।”
“নাত্তাইলি মানে কী আগে এইটা তুই বল।”
“বেশি বুঝা যাকে বলে। নিচের শালিসে সে চেয়ারম্যান, মেম্বারকে তাদের বিচার শেখাচ্ছে। এত বেশি বুঝে মেয়েটা। মনে হয় মাথায় তুলে আছাড় মারি।”
তাশদীদ ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে তোয়ালে বিছানার পাশে রেখে বলল,
“কী হয়েছে?”
তাজবীদের মুখ থেকে অর্ধেক কথা শুনেই সে দৌড়ে নিচে নামলো।
গ্রামের চেয়ারম্যান তাশদীদের বাবার চাচাতো ভাই। গ্রামে মোটামুটি সুপরিচিত হওয়ায় তাদের বাড়িতেই সকল বিচার হয়। নিচে বিচার বসেছে একটি মেয়েকে উত্যক্ত করেছে গ্রামের কিছু ছেলে।তার প্রেমের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় এসিড ছুড়ে মারবে বলে হুমকি দিয়েছে।
মেয়েটার বাবা গ্রামের নিম্নবিত্ত পরিবারের একজন।পরের জমিতে চাষ করে যা পায় তাই দিয়েই কোনো মতে তার সংসার চলছে।
মেয়েটাও একটা কোচিং সেন্টারে ক্লাস নিয়ে লেখাপড়া চালাচ্ছে কোনো ভাবে।
কিন্তু গ্রামের উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলের প্রেমের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় সে ক্ষমতা বলে কোচিং এর লোক দের বলেছে মেয়ে যেন ওখানে ক্লাস না নিতে পারে।
বাধ্য হয়েই মেয়েটার লেখাপড়া চালানোর জন্য টিউশনি শুরু করেছিল কিন্তু সে বাড়িতে গিয়েও মেয়ের নামে মিথ্যা বলেছে ছেলেটি।বাধ্য হয়েই গরীব বাবা এবার মেয়ের বিয়ে দিতে চাইলেন। এতে ক্ষেপে উঠলো ছেলেটা।সন্ধ্যেবেলা যখন মেয়েটা বাড়ির পিছনের পুকুর পাড়ে হাস গুলোকে আনতে গিয়েছে তখন ছেলেটা তার সাথে শালীনতা হানীর চেষ্টা করে। মেয়েটা চিৎকার করতেই ছেলেটা সব দোষ মেয়ের দেয় এবং নিজের ছেলেকে বাঁচাতে তার বাবা গ্রামে বিচার ডেকেছে।
অথচ মেয়েটার হাতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সে এবং তার বাবা থানায় একটা সাধারণ জিডি করেছে তিন মাসেই আগেই।কিন্তু তাদের এই কথা কেউ পাত্তাই দিচ্ছে না।অথচ সবাই ছেলের দোষ না দেখে সবাইকে নিয়ে মেয়ে এবং তার পরিবারকে গ্রাম থেকে বের করে দিতে চাচ্ছে।
সাগরিকা তার দাদীর ঘরের একপাশে দাঁড়িয়ে সবটা শুনছিল কিন্তু এই বিচার সে মেনে নিতে না পেরে প্রতিবাদ করলো।যেহেতু বড়রা কথা বলবে তাই তাশদীদ ওরা কেউ ছিল না। সাগরিকার কন্ঠস্বর শুনে তার পাশে এসে দাঁড়িয়ে তাকে বলল,
“কি হয়েছে? বাড়ির ভিতরে যাও।”
“আপনি আমাকে বাড়ির ভিতরে কেন যেতে বলছেন?আজ আপনার সামনে যদি আমাকে কেউ ওমন প্রস্তাব দিতো মেনে নিতেন? গত পরশুর কথা ভুলে গেলেন?
তখন তো আপনি কাউকে পাত্তা দেননি?যা হয় হোক আপনারা বিচার করেছেন। কিন্তু আজ মেয়ের কোনো কিছুই আপনারা দেখতে পাচ্ছেন না?
কেন?এই মেয়ের বাবার টাকা পয়সা নেই বলে?এরা দরিদ্র বলে?
এরা থানায় মাল-পানি দিতে পারে না বলে এদের কোনো বিচার হবে না?কেন হবে না?আমাকে জবাব দিন।
আপনাদের কাছে গরু আর নারীর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই?
আপনারা চাইছেন দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখতে?
না কী চাইছেন আমাদের কোনো সম্মান বোধ না থাকুক?
পুরুষ কে হয় নারীকে আঘাত করার?নারীকে হুকুম দেওয়ার কোনো অধিকার পুরুষের নেই।পুরুষকে নারী কখনো হুকুম দেয় না।কিন্তু নারীর সব কাজেই পুরুষের সমস্যা।
দেশে হরতাল,নারীর দোষ। যাই হোক নারীর দোষ। নারীর পোশাক খারাপ। কেন? নারীই কেন?”
কথাগুলো বলে সাগরিকা অস্থির হয়ে উঠেছে। তার মাথায় এক হাত রাখলো তাশদীদ। সামনে বসে থাকা চেয়ারম্যান এর দিকে তাকিয়ে সাগরিকা বলল,
“আমি এই বাড়ির মেয়ে। এখন এই বাড়ির বৌ।আমার দিকেও যদি সে এমন দৃষ্টিতে তাকায় তবে কী মেনে নিবেন?না কী তার চোখ তুলে ফেলবেন?
কাউকে নয়, আমার ভাইয়েরাই তাই করবে এবং করে। এদের সব ধরনের ব্যাক সাপোর্ট রয়েছে কিন্তু এই মেয়ের নাই বলে কী এই মেয়েকে হেলার চোখে দেখবেন?এর মান সম্মান কোনো কিছুই নয় কী?
যদি নারীকে সম্মান করতেই হয় তবে সব নারীকে এক চোখে দেখুন।তার বাবা বা স্বামীর পরিচয়ে নয়, সমাজে তার স্থানের পরিচয়ে নয়, তাকে সম্মান করুন একজন নারী হিসেবে।তার সম্মানের জন্য তাকে যেন বিচারে না আসতে হয়।”
বিচারের পর মেয়েটা সাগরিকার দুই হাত ধরে বলল,
“আজ আপনার জন্য আমার বাপের সম্মান রক্ষা হইলো।আমি যদি পারি কোনো দিন আপনার এই ঋণ শোধ করতে তবে অবশ্যই করবো।আমার সব কিছু দিয়েই আপনার উপকার করবো।”
তাশদীদ মুখে হাসি ঝুলিয়ে রেখে তাকিয়ে রইল সাগরিকার দিকে।
হয়তো সে পেরেছে সাগরিকাকে কিছুটা সাহায্য করতে। স্বামী হিসেবে তার যা করা দায়িত্ব সে না হয় সেটুক পালন করবে।
(৮৯)
তাজবীদ এবং সাগরিকা পাশাপাশি বসে আছে। শুভ্র আগামীকাল চলে যাচ্ছে। তার ছুটি শেষের পথে। এ নিয়ে সবার মন খারাপ। চায়ের কাপ তুলে নিয়ে তাজবীদ সাগরিকা বলল,
“ভালোবাসা বুঝিস?”
“নারীর জন্য পুরুষের প্রেম নারীই আগে অনুভব করে। সামনে থাকা মানুষটা ভালোবাসে কী না তার চোখের চাহনী বুঝিয়ে দেয়।”
“ভাইয়ের টা বুঝিস নি কেন?”
“কে বলেছে বুঝিনি?”
“অনুভব করিস?”
“সব সময়।”
“তবে এমন ভাবে থাকতিস যেন ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানিস না।”
“আমি তার ভালোবাসা অনুভব করি, না বুঝার মতোন থাকি এটাই সে বেশি ভালোবাসে। যদি তার ভালোবাসা বুঝে ফেলার কথা তাকে জানাই আর যদি সে ভালোবাসার ধরন বদলে দেয়?
মানুষটা আমাকে বকবে, শাসন করবে আবার নিজেই সোহাগ করবে এটাই কী অনেক না?তবে হ্যাঁ, তার প্রতি আমার ভয়টা কিন্তু একদম সত্যি। এক বিন্দুও মিথ্যে না।তাকে রাগে দেখলেই আমার অন্তর আত্মা কেঁপে উঠে।”
“আর শুভ্র?”
“আমি তার অনুভূতিও বুঝি।কিন্তু কী বলো তো! সে তো আমায় পুরো দিন ব্যস্ত রাখে তাই অন্য কাউকে নিয়ে ভাবার সময় নেই। তার ভালোবাসা আমাকে জ্বালায়, পুড়ায় যা অন্য কারোরটা করে না।”
(৯০)
তাশদীদের দিকে চাল ভাজা এগিয়ে দিয়ে সাগরিকা ধপ করে তার কোলের কাছটায় বসে পড়েছে। সে হন্যি হয়ে তাশদীদ কে অনুনয় করে বলল,
“আমি কেমিস্ট্রি নিয়ে পড়বো না।দোহাই লাগি। আমি আর লেখাপড়া করবো না।”
তাশদীদ ভ্রু-কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
“কেন?”
“লেখাপড়া করে কী লাভ? সেই রো আপনার আর আমার বাচ্চাকাচ্চা কেই সামলাতে হবে, রান্নাবান্না করতে হবে।”
সাগরিকা এমন ভাবে কথাটা বলেছে যেন সে ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে জবাবের আশায় তাশদীদের দিকে তাকিয়ে রইল।
ফোন হাত থেকে বিছানার উপর রেখে তাশদীদ বলল,
“বাচ্চাকে পড়াতে হলেও লেখাপড়া করা দরকার।”
“টিউটর রেখে দিবো।”
“নতুন নতুন রান্না শিখতে হলেও পড়া দরকার।”
“ইংলিশ সাবটাইটেল পড়তে পারি।”
“তবুও পড়তে হবে। অন্তত গ্রাজুয়েশন করা লাগবে।”
“তাহলে এক হালি বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে এক্সাম হলে যেতে হবে।”
“এত যে বাচ্চা বাচ্চা করছিস তোর মতলব তো ভালো লাগছে না।একটু দূরে যা।”
সাগরিকা ফ্যাল ফ্যাল চোখে তাকিয়ে রইল এরপর ওড়না কোমরে গুজে তাশদীদের দিকে ঝুকে তার থুতনি ধরে বলল,
“ইউ আর মাই রাইটফুল ওয়াইফ থুক্কু হাজবেন্ড। ভুলে গেছেন?”
তাশদীদ জবাব দেওয়ার আগেই নিচ থেকে তার দাদীর চিৎকার শুনতে পেল,
সে চিৎকার করে বলছে
“স্নেহারে তোর বাপ বেঁচে আছে রে। এই দেখ তোর বাপ কল দিছে আমার মোবাইলে।”
চলবে….