#এক কাপ চা
পর্ব ৩১
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
(৯১)
মৃত মানুষের জন্য এক সময় সব কিছুই, সব অনুভূতিই মৃত হয়ে যায়। শুধু বেঁচে থাকে তা হলো অতীতের স্মৃতি।
সেই স্মৃতি পাতায় বর্তমানের স্পষ্ট স্পর্শ যন্ত্রণা দায়ক।
আজ স্নেহার বাবার ফোন থেকে কল এসেছিল।কল রিসিভ করে তার মা আশায় বুক বেধেছিলেন যে হয়তো তার ছেলে বেঁচে আছে এবং যা ঘটেছিল সব’টাই দুঃস্বপ্ন।
কিন্তু মৃত্যু এক অমোঘ সত্য।
মৃত ব্যক্তি ফিরে আসে না।কায়সার ফিরে আসেনি।তার ফোন থেকে কল দিয়েছে সে যেখানে চাকুরিরত অবস্থায় আছে সেখান থেকে।
কায়সার এর মৃত্যুর পর তাশদীদ, রাশেদ এবং সাগরিকার বাবা গিয়েছিলেন তার লাশ শনাক্ত করতে কিন্তু লাশের কোনো কিছু ছিল না।শুধু যা ছিল তাকে লাশ বলা যায় না তাকে সাধারণ ভাষায় হাড়গোড় বলা চলে।
সংসারকে দাঁড় করানোর জন্য, বাবার হাতের ব্যবসার খাতিরে নিজ সুখ শান্তি ত্যাগ করে পাড়ি জমিয়েছিল বিদেশে। কিন্তু তার লাশ দেশ অবধি আসেনি।এসিডের গাড়ি বিস্ফোরণের কারণে সে স্পট ডেড হয়েছিল।তাশদীদদের কে দেখানো হাড়গোড় তারা দেশে এনে আরো যন্ত্রণা বাড়াতে চায়নি।এরচেয়ে বরং তাকে পবিত্র মক্কাতেই দাফন করা শ্রেয় মনে করেছিল তারা।
ফিরে আসার পর আর যোগাযোগ হয়নি ওদেশের কোম্পানির সাথে।
যেহেতু সে অন ডিউটি মারা গেছেন তাই তার পরিবারকে আর্থিক সহায়তা করার জন্য তারা যোগাযোগ করেছে।
কল আসার পর থেকে আবার শুরু হলো সবার যন্ত্রণা। তাদের তো টাকার প্রয়োজন নেই কিন্তু এই যন্ত্রণার উপশম করবে কী দিয়ে?
সামিনা চুপচাপ বসে আছে স্নেহাকে কোলে নিয়ে। স্বামীর সাথে তার বয়সের পার্থক্য ছিল বারো বছরের।
কলেজ থেকে ফিরে একদিন সে দেখতে পেল বাইরের ঘরে কয়েকজন লোক বসে আছে।
তাদের মধ্যেই কেউ একজন তাকে বিয়ে করে নিয়ে যাবে। দেখতে এসেছে ছেলেপক্ষ কিন্তু ছেলেকে?
চশমা চোখে লোকটা অবশ্যই বয়সে তার অনেক বড় হবে।কিছু না ভেবেই না করে দেওয়াটা বিয়েটা যেন হুট করেই হয়ে গেল।এরপরের সময় ছিল স্বপ্নের মতোন।
বুড়ো বরটা না চাইতেই তার খেয়াল রাখা শুরু করলো।বাইরে থেকে ফিরলেই তার পকেটে থাকতো নানান ধরনের খাবার৷
বাড়ির সবার জন্য আনলেও তার ভাগে জুটতো একটু বেশি কিছু।
রাত বিরেতে মানুষটা তার অসুস্থতাকে আপন করে নিতে জানতো।
সামিনা খুব দ্রুতই ভালোবেসে ফেলল তাকে। কিন্তু মাঝেমধ্যে তার মনে হতো মানুষটা শুধুই ভালো থাকার অভিনয় করে পরিবারের জন্য কিন্তু পরেই মনে হতো
এই মানুষটাই তো নিজ কাধে সব দায়িত্ব তুলে নয়ে বাবার ব্যবসা ফেরালেন তাই বুঝি সে ক্লান্ত৷
আজ প্রথম দেখার কথাটা সামিনার মনে পড়ছে। খুব করে স্পর্শ করতে ইচ্ছে করছে সেই মানুষটাকে। কিন্তু মৃত্যু ব্যতীত হয়তো তা সম্ভব নয়।
সে মরতেও পারছে না কারণ স্নেহা যে স্বামীর আমানত। তাকে মানুষ করার দায়িত্ব সে একাই নিবে। কাউকেই নিতে দিবে না।
(৯২)
নাক ফুলিয়ে বসে আছে সাগরিকা। বাড়িতে এত কিছু হয়ে যাচ্ছে অথচ তাশদীদ আছে পড়া নিয়ে ব্যস্ত হয়ে। ভর্তি পরীক্ষার জন্য প্রিপারেশন নিতে হচ্ছে তাকে। এই লেখাপড়া কে গুল্লি মেরে উড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করে তার৷
শুধু তাই নয় যদি তার কাছে আধ্যাত্মিক ক্ষমতা থাকতো তবে সে সেই ক্ষমতা বলে পরীক্ষা নামক সব কিছুই তুলে দিতো।
“পিতা ও পুত্রের বয়সের সমষ্টি ৫৫ বছর। পিতার বয়স পুত্রের বয়সের ৪ গুণ হলে, পুত্রের বয়স কত?”
এই ক্লাস ফোর ফাইভের গনিত কেন তাশদীদ তাকে করতে দিলো সে খুঁজে পাচ্ছে না। সে জানে সাগরিকা গনিতে যাচ্ছে তাই, টেনেটুনে পাশ করতো। শুধু সুমন ভাইয়ের রহমতে সে ভালো রেজাল্ট করেছে তাই বলে এসব অত্যাচারের মানে হয়?
আধ ঘন্টা পার হয়ে যাওয়ার পরেও যখন সাগরিকা পারলো না তখন তাশদীদ সাথে করে এক পিচ্চি বাচ্চাকে নিয়ে এসেছে।সে তার সামনেই ফটাফট অংক করে দিয়ে তাশদীদের থেকে চকলেট নিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেল। সাগরিকা আরো ফুটো বেলুনের মতোন চুপসে গেল।
“হয়েছে হয়েছে, মুখ কে আর বাংলার ৫৫ বানাতে হবে না।”
“বাংলার পাঁচ হয়। ৫৫ না।”
“তোর মুখ দেখে পঞ্চান্নই মনে হচ্ছে।”
“লেখাপড়া না করলে হয় না?”
“হয় তো।মানুষের বাসায় কাজ করতে দিয়ে দিবো তবে।”
“মানুষ বলবে আপনার বউ মানুষের বাসায় কাজ করে।”
“কে আমার বউ?”
“আমি।!
” প্রমাণ কী?”
“প্রমাণ চাই?”
“হুম।”
“প্রমাণ নাই। মানলে মান না মানলেও মানতেই হবে।”
তাশদীদ কিছু না বলে অলস ভঙ্গিতে চেয়ারে বসে চায়ের কাপ হাতে নিলো।সাগরিকা পুনরায় ব্যস্ত হলো পড়ায় কিছুক্ষণ পর সে গুনগুনিয়ে গান গাইতে লাগলো,
ওরম তাকিও না, আমি কেবলা হয়ে যাই
আমার চোখের ভাষা যায় হারিয়ে
আমার হৃদয় কাঁপে, পরিস্থিতির চাপে
তখন থেকে বোকার মত দাঁড়িয়ে
তুমি চায়ের কাপ হাতে, ব্যালকনিতে
আমায় নিয়ে ছেলেখেলা করো আবার
আমার পায়ে ঝি ঝি, আমি জ্ঞান হারিয়েছি
কখন যে বৃষ্টি নেমেছে জানি না
তুমি বৃষ্টি ভিজো না ঠাণ্ডা লেগে যাবে
পাগল হলে নাকি আর আমার কি হবে?
তুমি বৃষ্টি ভিজো না ঠাণ্ডা লেগে যাবে
পাগল হলে নাকি আর আমার কি হবে?
আমার যে কি হবে? আমার কি হবে?
আমার যে কি হবে? আমার কি হবে?
তাশদীদ সাগরিকার এমন পাগলামোতে সায় না দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলো। কিন্তু সাগরিকা টুপ করে তার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
“ডিয়ার রাইটফুল হাজবেন্ড, আমার এখন চুমু চাই। বিশা______ল বড় একটা।”
সাগরিকার কথায় তাশদীদ তার মুখের কাছে নাক নিয়ে বলল,
“কিছু খেয়েছিস না কী?এমন বিহেভ করছিস কেন?লক্ষ্মণ ভালো না।দূরে গিয়ে মর।”
(৯৩)
সন্তান শোক বড় শোক।আজ মায়ের চোখের সামনে সকল কিছুই ভেসে উঠছে।কায়সারের জন্মের সময়,তার প্রথম মা ডাক,গাছ থেকে পড়ে যাওয়া, স্কুলে যাওয়া,তার এক কথায় সব ছেড়ে দেওয়া থেকে সব।ছেলেটাকে সে সব সময় অবহেলা করেছে, তখন সে ব্যস্ত সাগরিকার বাবাকে নিয়ে। পিঠাপিঠি ভাই ছিল। একজন কে দেখতে গিয়ে অন্য জন হারিয়ে গেল।কিন্তু সে মায়ের দায়িত্ব পালন করতে চায়। খুব করেই স্নেহার দায়িত্ব নিতে চায়৷
ইখুম কোনো একটা কারণে তার শাশুড়ির ঘরে এসে দেখতে পেল,
ভদ্রমহিলা ফ্লোরে পড়ে আছেন এবং তার নাক দিয়ে রক্ত আসছে।
চলবে ….