#এক কাপ চা
পর্ব ৪৩
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
(২০৮)
রাতে খাবার টেবিলে সাগরিকা বেশ চুপচাপ বসে আছে।তার মাথার রেলগাড়ি চলছে দ্রুত গতিতে।রেস্তোরাঁর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা তাদের গাড়ির কথা মনে হচ্ছে বার বার। পুরো ট্যাংক খালি হয়ে ফুয়েল গড়িয়ে পড়েছিল আশেপাশে। অথচ এমন হওয়ার কথা নয়। কয়েক দিন আগেই তাশদীদ তার গাড়ি চেক করিয়েছে। তাছাড়া তারটা এমন ভাবে কাটা মনে হচ্ছে কেউ ব্লেড দিয়ে খুব যত্ন সহকারে কেটেছে।
অথচ গাড়ি বাসার গ্যারেজে ছিল রাত থেকে।
ভ্রু-কুঁচকে সাগরিকা তাকিয়ে আছে সামনে থাকা মাছের বাটির দিকে।নিজের ঠোঁট কামড়ে সে মনে মনে ভাবলো,
“তাশদীদের ক্ষতি কে করতে চাইবে?”
ফ্রেশ হয়ে তাশদীদ সাগরিকার পাশে বসতেই দেখতে পেলো সাগরিকা বেমালুম ভুলে বসে আছে তাকে। তার বাম হাত নিচে নামিয়ে সাগরিকার ওড়নার কোনা ধরে টান দিলো।মেয়েটা তাকাতেই ভ্রু-বিলাস করলো সে।
প্রতি উত্তরে তার স্ত্রী দু চোখের ভাষায় আস্বস্ত করলো সে ঠিক আছে।লোকচক্ষুর আড়ালে হাত বাড়িয়ে শক্ত হাতে ধরব নিলো তার হাত।
সাগরিকার ডান পাশে তাশদীদ বসেছিল, হুট করেই বাম পাশে এসে বসে পড়লো শুভ্র।তাদের দিকে তাকিয়ে প্রানখোলা হাসি দিয়ে বলল,
“বৌ কি আর কারোর নেই?খাবার সময় অন্তত হাত ছাড়ো।”
প্রসঙ্গে তাশদীদ সাগরিকার হাত টেবিলের উপর রেখে বলল,
“বৌ আমার আমি যা ইচ্ছা করবো।”
“নাউজুবিল্লাহ্!”
সাগরিকা আলতো করে হাত ছাড়িয়ে নিলো তাশদীদের হাত থেকে। বোকা বোকা হাসি দিয়ে শুভ্রর উদ্দেশ্যে বলল,
“ভাত খেয়েছো?না কী সালাদ খাবে?”
“তোর যা ইচ্ছে হয় দে। আমার আপত্তি নেই।”
খাবার বেড়ে শুভ্রর সামনে দিয়ে নিজের চেয়ারে বসলো সে। তাশদীদের হাত ততক্ষণে প্লেটে থেমে গেছে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সাগরিকার দিকে। এক সাথে বসে খাবার সময় কখনো তো সাগরিকা তাকে এক টুকরো মাছ তুলে দেয়নি তার প্লেটে কিংবা এক টুকরো লেবু?অথচ শুভ্রর সাথে ওর কি মিল!
নিজের রাগ কে দমিয়ে রাখতে চেয়েও পারলো না সে। এই মেয়েটার ক্ষেত্রে এসেই তার পুরো মস্তিষ্ক বন্ধ হয়ে যায়। রোবট রোবট লাগে তার। অথচ সে অবশ্যই একজন গোছানো স্বত্বার অধিকারী।প্লেটে পানি ঢেলে দিতে দিতে তাশদীদ বলল,
“তুই হঠাৎ এখানে? তোর চলে যাওয়ার কথা ছিল।”
“বোনের বিয়েতে ভাই থাকা স্বাভাবিক নয় কী?”
“আমি আবার ভাবলাম তুই বুঝি কারোর মায়ার টানে রয়ে গেলি।”
“আমি তো পড়েছিই মায়ায়। কারোর মায়ায় পড়ে কাটিয়ে দিচ্ছি আমার এই নষ্ট, ব্যর্থ জনম।”
তাশদীদ এক মুহুর্ত অপেক্ষা না করে নিজ কক্ষে ফিরে এলো।পিছন থেকে সে শুনতে পারছিল শুভ্র এবং সাগরিকার মৃদুস্বরে ঠাট্টার স্বর। হাতের কাজ শেষ করে রুমে ফিরে সাগরিকা দেখলো তাশদীদ ঘুমিয়ে পড়েছে। পা টিপে টিপে হেটে এগিয়ে এলো বিছানার দিকে। তাশদীদের দু হাতের বন্ধনে নিজেকে বন্দী করে ফিসফিস করে বলল,
“এত হিংসুক কেন আপনি?আপনারো কি আমার মতো ভয় হয়? যখন অন্য কারোর সাথে থাকলে?ইচ্ছে করে লুকিয়ে রাখতে?”
তাশদীদ কিছু বলল না। একটা ক্লান্তিকর দিন শেষ হলো প্রশান্তির মাধ্যমে।তুলতুলে অনুভূতি হচ্ছে তার বুকের মধ্যে।বিনিময়ে শুধু তার হাতের বন্ধন শক্ত হলো।আর সাগরিকার মনে হচ্ছিলো, এই বুঝি তাকে নিজের বুকের ভিতর ঢুকিয়ে ফেলে তাশদীদ!
(২০৯)
স্নেহার মামাতো ভাই আজ জেল থেকে ছাড়া পেয়েছে। তার মামী কল দিয়ে যা তা শুনিয়ে দিলো সামিনাকে। দোষটা স্নেহাকে দিয়ে সে বলল স্নেহার পোশাক খারাপ। ছোটো ছোটো জামা পড়ে। খালি গায়ে থাকে তবে কোনো ছেলে হাত বাড়ালেই তার দোষ হবে কেন?আগে নিজের মেয়েকে সামলানোর উপায় জানতে হবে তার। একজন মা যেমন চাইলে সন্তানকে ভালো করতে পারে তেমনি খারাপ ও করতে পারে। বাকী জীবনে যেন সামিনা তাদের বাড়িতে না যায়।
তাদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা না করে।
পুরোটা সময় সামিনা চুপ ছিল।গত কয়েক দিন যাবত তার শরীর ভালো না।হয়তো কোনো বড় রোগ ব্যধিতে ধরেছে তাকে। নিজের ক্লান্ত শরীর বইতে বইতে আজ আর পারছে না।এদিকে আজ শাশুড়ি বাড়ি ফিরেছে। সে এসে এক বারের জন্যএ তাকে ডাকেনি।জানে না সে আগামীকাল কি হবে? তাকে আবার কেউ জোর করবে কি না? এবার আর কারোর কথায়, অন্যের যুক্তিতে নিজের ভবিষ্যৎ ভাববে না সে। কিন্তু পর মুহুর্তেই থমকে গিয়েছিল সে৷
এক সময় তার এবং রাশেদের বিয়ের কথাতে সম্মত জানাতো, আজ তারা সবাই চাইছে রাশেদ আইনী ভাবে স্নেহার বাবার দায়িত্ব নিক।
ভয়ে গলা শুকিয়ে এলো তার। পাশে শুয়ে থাকা মেয়ের দিকে তাকিয়ে চোখের পানি ঝরতে লাগলো তার।
এই মেয়ে ছাড়া তার আর কেউ নেই।তার করা পাপ গুলোর শাস্তি তার মেয়ে পাচ্ছে। অথচ তার কিছুই করার নেই। এমন সময় দরজায় নক করে প্রবেশ করলো জুলি।এই কয়দিন হাসপাতালে থেকে তার চেহারা,স্বাস্থ্যের বেশ অবনতি ঘটেছে। এক গ্লাস দুধ হাতে সামিনার পায়ের কাছে বসলো সে। দুধের গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বলল,
“মেলা শুকাই গেছ বৌ। এত শুকাইছো কেন?”
“কোনো দরকার আছে আপনার? না থাকলে আসতে পারেন।”
“আমি কি তোমার ক্ষতি চাই?”
সামিনা যথেষ্ট চেষ্টা করছে জুলিকে এড়িয়ে চলতে।এই মহিলাকে নিয়ে তার ইদানীং বেশ সন্দেহ হয়। অদ্ভুত ক্ষমতা আছে তার। সে খুব সহজেই তার যুক্তিতে অন্যদের সামিল করতে পারে। সামিনাকে মানতে বাধ্য করে তার সকল কথা৷
“কোনো প্রয়োজন?”
“দেখো, আগেই কইছি। এরা ভাইয়েরা মিলা তোমার হক মারতে চাইবো।তোমার স্বামীর প্রতি তোমার হক এরা নষ্ট করে নাই?যে বছর স্নেহার বাবা বিদেশ গেল তোমারে বাড়িতে রাইখা, সেইবার কি সে যাইতে চাইছিল?চায় নাই কিন্তু। রাশেদরে পাঠাইতে চাইছিল।অথচ সে গেল না।কেন গেল না? কারণ সে তখন প্রেমে মজছে। বাড়ির সবাই কইলো বেতন ভালো, আবার যাও। কয়েক বছর থাইকা আসো। বেচারা গেল আর ফিরলো না।কোম্পানি তার নামে কোটি টাকা পাঠাইলো। কয় টাকা দিছে তোমারে?”
“আমার নামে ব্যাংকেই রাখা আছে।”
“হু আছে। ঘোড়ার ব্যাংকে আছে।সেই টাকা দিয়া ওরা ব্যবসায় লাগাইয়াই আজ এত কিছু করলো।বাইচা থাকতে তো দিছেই বেচারা মরার পরেও ভাইগো দিয়া গেল।”
সামিনা কিছুই বলল না।হাতে থাকা শূন্য দুধের গ্লাসের দিকে তাকিয়ে আছে সে। জুলির বলা কথা গুলো তার কাছে কোনো সুরের মতোন লাগছে। অনুরনন তুলছে তার মস্তিষ্কে।তার দুই চোখ ভারী লাগছিল।মন্ত্রমুগ্ধের মতোন সে বসে রইল বিছানার উপর।
“শুনো, ওরা তোমারে কিছুই দিব না।কাল সকালে তুমি এই বাড়ির ভাগ চাইবা।বুঝছো?আমি আসি তুমি ঘুমাও।”
জুলি চলে যাওয়ার বেশ কিছু সময় পর সামিনা বসে রইল। স্নেহার জন্য নিয়ে আসা গ্লাসটা হাতে ধরে বসে আছে সে। ভুল বশত স্নেহার গ্লাসটার দুধ খেয়ে ফেলেছে সে। ধীরে ধীরে তার মাথাটা ভার হয়ে এলো।বমির ভাব হতে ওয়াশরুমের দিকে ছুটলো সে। অথচ পৌঁছাতে পারলো না।পড়ে গিয়ে নাক, মুখ দিয়ে রক্ত চলে এসেছে তার।মনে হচ্ছে তার বুক জ্বলে যাচ্ছে দুধটা খাওয়ার পর।
ধীরে ধীরে দুচোখ বন্ধ হয়ে এলো তার। সাহায্যের জন্য প্রাণপণে কাউকে ডাকতে চাইলেও পারলো না।
তার মনে হচ্ছিলো সে মরে যাচ্ছে। অথচ অবচেতন মনে শুনতে পেল কেউ তাকে বলছিল,
“ব্যর্থ জীবন থেকে মুক্তি পাচ্ছিস। ভেবে দেখেছিস? যদি তোর চোখের সামনে তোর ছোট্ট স্নেহা এভাবে ছটফট করতো?”
#চলবে ……