#এক কাপ চা
#পর্ব ৪৫
# সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
(২১৩)
শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ কক্ষের শীতল পরিবেশেও ঘেমে অস্থির হলো সাগরিকা।হুট করেই এত বড় খবর পেয়ে নিজেকে সামাল দিতে পারছে না সে।
স্নেহাকে দেখেই ডক্টর জানিয়েছেন তার হার্টে ছিদ্র রয়েছে এবং এই কথাটা অনেক দিন পূর্বেই তার অভিভাবক কে জানানো হয়েছে।
অথচ এমন কথায় জান পরাণ অবাক হলো সাগরিকা। তারা এ বিষয়ে কিছু জানে বলে মনে পড়লো না তার।
তৎক্ষনাৎ রাশেদকে কল দিলো সে।
“কাকা তুমি কোথায়?”
“বাড়ি ফিরছি।ভাবীর ময়নাতদন্তের রিপোর্ট আগামীকাল দিবে। আচ্ছা সাগরিকা তুই কি জানিস? ভাবীর হৃদ রোগ ছিল কী না?”
“কেন?”
“অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ এর জন্য দায়ী করা হচ্ছে হৃদ রোগে ব্যবহৃত কোনো মেডিসিন কে।যে মেডিসিন হৃদরোগীদের দেওয়া হয় তাদের রক্ত তরল করে সঠিক ভাবে প্রবাহিত করার জন্য।”
“কিন্তু কাকীর কোনো হৃদরোগ ছিল না।”
“অথচ ডাক্তার যা বলল এমন হতে পারে।দীর্ঘ সময় যাবত নিয়ে আসছিল এটা।”
“কাকা আমি যে জন্য কল দিয়েছিলাম।স্নেহার যে হার্টে ছিদ্র রয়েছে এটা তুমি জানতে?”
” মানে?কবে হলো?”
“ডাক্তার বলছে এটা জন্মগত। আর স্নেহার অভিভাবক না কি এই বিষয়ে জানে।”
“না,আমরা তো জানি না। আর তুমি এখন কোথায়?”
“জ্বরে স্নেহার গা পুড়ে যাচ্ছিল। হুট করেই বমি করছে। তাই পাশের ক্লিনিকে এসেছি আমরা।”
“তাশদীদ কে ফোনটা দেও তো!”
“আমি আর শুভ্র ভাই এসেছি। উনি পায়ে ব্যথা পেয়েছেন।”
“আচ্ছা,আমি আসবো?”
“না, কিছু সময়ের মাঝে আমরা ফিরছি।”
“সাবধানে এসো।কলটা কাটো। মিয়া ভাই কল দিচ্ছে।”
সাগরিকার কল কেটে দিয়ে রাশেদ তাশদীদের বাবার কল রিসিভ করলো।তাশদীদের বাবা তাকে শুধু এটুক বললেন,
“ছোটো, সাগরিকার কাছে দ্রুত পৌঁছে যা। আর তাশদীদকে বল বাড়ির সবার খেয়াল রাখতে। আমার শরীর ভালো লাগছে না।আমি ড্রাইভ করার শক্তি পাচ্ছি না।”
“আপনি এত রাতে বের কেন হয়েছেন?”
“ছোটো আমি বিপদে পড়েছি।কিন্তু আমার থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো সাগরিকা, স্নেহা।সাগরিকার কিছু হলে তাশদীদ বাঁচবে না। আর স্নেহা আমাদের ভাইয়ের শেষ আমানত।”
কথা বলতে বলতে রাশেদ গাড়ি ঘুরিয়ে হাসপাতালের দিকে রওনা দিয়েছে। তাশদীদকে ম্যাসেজ করলো বাড়িতে থাকতে আর তাজবিদ এবং শুভ্রকে জানালো সাগরিকাদের খেয়াল রাখতে।
(২১৪)
আরো একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ভোর। যে ভোর কেউ আশা করেনি।ভোরের আলোর সাথে বাড়িতে আরো একবার শোক এলো।এই শোক কাটিয়ে উঠবে পরিবারের এমন মানসিক শক্তি আদৌও ছিল কী না কেউ জানে না।
তাশদীদের বাবা হুট করেই গাড়ি চালানোর সময় ব্রেইন স্ট্রোক করেছিলেন।তার সাথে কথা বলতে বলতেই রাশেদ পৌঁছে যায় তার কাছে।ভদ্রলোক গাড়ির ভিতর স্টিয়ারিং হুইলে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে ছিলেন।তার হাত পা ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছিল।
রাশেদ পৌছানোর পর তাকে বললেন,
“একা কেন এসেছো?আমাদের একা থাকা উচিৎ না।শত্রু ঘরেই রয়েছে। তারা আমাকে ছাড়েনি।আমার ঘাড়ে দেখো কিছু একটা দিয়ে ইনজেকশন দিয়েছে। হয়তো খুব দ্রুত আমি মরে যাবো।তবে সত্যিটা শুনে রাখো।এসবের পিছনে কে আছে।শুনো হয়তো পুলিশ প্রমাণ চাইবে।তুমি বরঙ তোমার ফোনের ভিডিও টা চালু করো তো।আমি নিজ মুখে বলে যাচ্ছি।”
রাশেদ দ্রুত তাকে হাসপাতালে ভর্তি করে। তাদের পারিবারিক ডাক্তার বিভিন্ন পরীক্ষার পর জানায় তাকে উত্তেজিত করার জন্য কোনো ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে যা তার হৃদ স্পন্দন বাড়িয়েছে কয়েক গুণ। গড়ে একজন মানুষের ২৪ ঘন্টায় লাখ খানেক বার হৃদ স্পন্দন হয়। এটা বাড়িয়ে করা হয়েছে প্রায় দেড় লাখের বেশি।সে যে জীবিত আছে এটাই অনেক রহমত। তবে বয়স হয়েছে তার।এজন্য তার শরীর সবটা নিতে পারেনি।
সাময়িক প্যারালাইজড হয়ে আছে সে। হয়তো কয়েক দিন তার শরীর ঠিক কাজ করবে না, কথা বলবে না।তবে চিকিৎসা নিয়ে ঠিক হবে এমনটাই তারা আশা করছেন।
বাবাকে ধরে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে তার পাশে বসল তাশদীদ। ভিডিওটা দেখার পর থেকে রাগে গা পুড়ে যাচ্ছে তার।কিন্তু এই মুহুর্তে কোনো প্রকার সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না তারা। কারণ তাদের পুরো পরিবার বিপদের মুখে রয়েছে।বিষয়টা আজ সকালেই মালুম করতে পেরেছে সে।তাদের প্রতিটা কক্ষে লাগানো রয়েছে বিভিন্ন ক্যামেরা এবং স্পীকার। এটা নিঃসন্দেহে বলা যায় এই বাড়ির অনেক তথ্য জানে তারা। এমনকি তাদের বাড়ির দারোয়ানটাও তাদের দলে।
ঠান্ডা মাথায় সবকিছু ভাবতে হচ্ছে তাদের। এই সময়টা তাদের পরিবারের জন্য সব থেকে দুর্বল সময়। এই সময় একটু বোকামী মানে আরো একজন প্রিয় মানুষকে হারানো।
জুলি দাঁড়িয়ে ছিল দরজার পাশে। তাশদীদের মা তাকে দেখে কাঁদতে বলল,
“তোর ভাইজানের জন্য কিছু খাবার বানিয়ে দে রে জুলেখা। তোর হাতের চা মানুষটা খুব পছন্দ করতো।সেদিন ও বলছে মায়েরে নিয়ে হাসপাতাল থেকে ফিরলে কচুর মুখির ডাল রান্না করতে বলবে
তোকে। আর আজ!”
জুলি দৌঁড়ে এসে তাশদীদের মায়ের হাত ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো।তার কান্না দেখে যে কেউ বুঝতে পারবে সে খুব শোক পেয়েছে। তার কান্নার দিকে তাকিয়ে তাজবিদের ইচ্ছে হলো হলো লাথি দিয়ে ঘর থেকে বের করে দিতে। কিন্তু বড় ভাইয়ের আদেশে সে চুপ করে রইল।
তাশদীদ জুলিকে ধমক দিয়ে বলল,
“চুপ করুন।আর বাবা কিছু খাবেন না এখন।যা খাবে সব সেঝ মা বানিয়ে দিবে। এবং বানানোর পর সে নিজে খাইয়ে দিবে।ডাক্তার আংকেল যেভাবে বলবে বাবাকে সে ভাবেই চলতে হবে।”
তাশদীদের কথায় তার মা রেগে গিয়ে বলল,
“সাগরিকার মা কেন আমার স্বামীর সেবা করবে? আমি কী মরে গেছি?”
তাশদীদ কিছু না বলে উঠে দাঁড়ালো।শক্ত হাতে মায়ের মাথাটা নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলো।তার মা প্রথমে ছোটাছুটি করার চেষ্টা করছিল কিন্তু পরবর্তীতে শান্ত, বাধ্য হয়ে কাঁদতে লাগলো তাশদীদকে আকড়ে ধরে।
তাশদীদ নিজেও জানে এই মানুষটা তাকে প্রচন্ড ভালোবাসে কিন্তু মাঝে মধ্যে কেন যে পাগলামো করে এটা সে বুঝে না।বুঝতে চায় না।থাকুক না কিছু বিষয় না জানা।
(২১৫)
গতকাল রাতে সাগরিকার সাথে বাজে কিছু হতে পারতো।নারীর সম্মানে হাত দিলে সে নারী কখনো বাঁচতে চায় না।সমাজটা তাকে বাঁচতে দেয় না।তাশদীদের ভয় সেখানে নয়, তার ভয় হচ্ছে মেয়েটাকে তার কাছ থেকে কেউ আলাদা করে নিলে সে কী করতো।চায়ের কাপ হাতে সাগরিকা সামনে এসে দাঁড়াতেই তাশদীদের ধ্যান ভঙ্গ হলো।তার চোখে মুখে ফুটে উঠেছে ক্লান্তি।সাগরিকা তার পাশে বসে তার দিকে দুই হাত বাড়িয়ে দিয়ে তাকে বলল,
“একটু আসবেন?পাশে বসবেন?মনে হচ্ছে আপনার ব্যাটারি ডাউন হয়েছে।চার্জ করে দিচ্ছি।”
মেয়েটার কথায় তাশদীদের মুখে হাসি ফুটে উঠেছে। অথচ দু ঠোঁট প্রসারিত হলো না।তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সাগরিকা তার হাত ধরে টান দিয়ে বলল,
“এই সময় আমাদের পরিবারে থাকবে না।খুব দ্রুত সময় কেটে যাবে।”
তাশদীদকে নিজের বাহু বন্ধনে আবদ্ধ করে সাগরিকা কথা গুলো বলছিল।তার পিঠে হাত রাখতেই তাশদীদের হুট করে মনে হলো তাদের বাড়িতে লাগানো স্পাই ক্যামেরার কথা।নিশ্চয়ই এসব ভেসে উঠবে মনিটরে।সাগরিকাকে ছাড়িয়ে দিয়ে বলল,
“তৈরী হয়ে নে।তুই,সীমা,দাদী, রাঙামা, তুলি এবং স্নেহা এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছিস।”
“কোথায়?”
“আমি যেখানে বলবো সেখানে। তোদের সাথে মুনির আর তাজবীদ যাবে।”
“বাকীরা?”
“বাবা -মা, সেঝ কাকা আর সেঝ মা চিকিৎসার জন্য দেশের বাহিরে যাবে।”
“আর আপনি?ছোটো কাকা?”
“আমাদের এখানে দরকার আছে।”
সাগরিকা কিছু বলল না।চুপচাপ সিদ্ধান্ত মেনে নিলো।বিকেলবেলা তাদের বেরিয়ে যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু পারলো না।দুপুরের খাবার খাওয়ার পর বাড়ির চারপাশে পুলিশ এসে ভরে গেল।পুলিশ প্রধান সমেত কয়েক জন এসে বসলো ড্রয়িং রুমে। দারোয়ান,সিকিউরিটি গার্ডকে আগেই আটক করা হয়েছে।জানালা দিয়ে তাকিয়ে তুলি দেখলো।গাড়িতে আরো কয়েকজন আসামীকে হাতকড়া পরিয়ে গাড়িতে রাখা হয়েছে।
কুশলাদি বিনিময় করে তাশদীদ বলল,
“মেঝ কাকীর মৃত্যু, দাদীর উপর হামলা এবং আমার বাবাকে হত্যার অভিযোগ রয়েছে জুলেখার উপর। আজ তাকেই গ্রেফতার করার জন্য এত আয়োজন।”
তার দাদী উচ্চস্বরে বললেন,
“তোর মাথা খারাপ দাদাভাই?জুলেখা আমার বাড়িতে পনেরো বছর যাবত কাজ করে আর ও এসব বুঝে না।”
“যদি বলি এই সেই জুলিয়া আহমেদ। যাকে ঠিক পনেরো বছর আগে তুমি না দেখেই ফিরিয়ে দিয়েছিলে বাড়ির সামনে থেকে। আর এই সেই জুলি যে মেয়েটা তোমার সম্মতির জন্য পুরো রাত দাঁড়িয়ে ছিল বাহিরে আর তুমি গেটের ভিতর থেকে তাকে যাচ্ছে তাই অপমান করে ফিরিয়ে দিয়েছিলে?”
চলবে …….