#এক কাপ চা
পর্ব ৫
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
১৩
সামিনার ঘরের দরজা খুলে তাকে তাশদীদ এবং রাশেদ নামিয়েছে।খুব একটা ক্ষতি হয়নি তার। শুধু গলায় দাগ পড়েছে খানিকটা। অনবরত ফুপিয়ে কেঁদেই চলেছে সে।রাশেদ ব্যতীত কেউ তাকে কোনো প্রকার সহমর্মিতা দেখাচ্ছে না।
সাগরিকার মা কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলল,
“তবে ইখুমকে বিয়ে কেন করলা তুমি?আর সামিনা, কায়সার ভাই মারা যাওয়ার দুই বছর পর ইখুম বাড়ির বউ হইলো।ইখুম তো একাই আসে নাই। আমরাই দেখে শুনে খোঁজ খবর নিয়ে এনেছি।যদি তোদের মধ্যে সম্পর্ক থাকেই তাহলে আগে বললেই হতো।এখন তো মনে হচ্ছে আমরা খুব ভুল করেছি। আর ছোটোর কথাই ঠিক।”
সামিনা দৌড়ে এসে সাগরিকার মায়ের হাত ধরে বলল,
“বুবুরে! যাই অপবাদ দিস না কেন চরিত্রহীনার অপবাদ দিস না।আমি সইতে পারবো না।”
“তোদের কাজ তোদের এই তকমা লাগাতে বাধ্য করতেছে।ইখুমের সন্তানের কথা তো চিন্তা কর।”
“আর আমার মেয়ে?ও তোমাদের কেউ না?”
“স্নেহাকে কেউ ঠকিয়েছে?কখনো ভেবেছিস? এই যে মরতে যাচ্ছিলি তখন কী হতো?”
তাশদীদের বাবা এতক্ষণ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সব শুনছিল।এমন লজ্জা জনক কথা কারোর কাছে বলাও যায় না।
লোকে জানলে কী বলবে?মেঝ ভাই মরেছে আর তার বিধবা বৌয়ের সাথে ছোটো ভাইয়ের সম্পর্ক? যখন ভাইটা বিবাহিত? পরক্ষণেই তার মনে হলো
নিজেদের শোক ভুলতে গিয়ে সামিনাকে চোখের সামনে রেখে সত্যি ভুল করেছে। সামিনার এবার একটা জীবন সঙ্গীর প্রয়োজন। যে তার জীবন পুনরায় সাজিয়ে তুলবে।
রাশেদের এমন বেহায়াপনাকে উস্কে দেওয়ার মানে পরিবারের মান-সম্মান, সাথে ইখুম এবং তার অনাগত সন্তানের ভবিষ্যৎ নষ্ট করে ফেলা।যা তিনি কখনো হতে দিবেন না।
দরাজ গলায় তাশদীদের বাবা রাশেদকে বলল ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে এবং সামিনাকে মানসিক ভাবে প্রস্তুতি নিতে পাত্রপক্ষের সামনে যাওয়ার জন্য।
১৪
বেসমেন্টে কিছু কাজ চলছিল।সামনে তাশদীদের দাদুর জন্মদিন। উনি গ্রামে আছেন।তাই ভদ্রমহিলার সন্তানেরা ঠিক করেছেন এবার তার শতবর্ষ জন্মবার্ষিকী পালন করবে।
তাশদীদ নিজে দাঁড়িয়ে থেকে কাজগুলো দেখছিল। হঠাৎ সিগারেটের তৃষ্ণা পেয়েছে তার। পকেটে হাত দিতেই সিগারেট পেল কিন্তু লাইটার পেল না।তার লাইটারটা বেশ প্রিয় কারণ তার সাতচল্লিশ তম প্রেম নিবেদনে পেয়েছিল এটি।তাশদীদ ভেবেছিলো হ্যাঁ এবার নিজেকে গুছিয়ে নেওয়ায় যাই। কিন্তু প্রেম নিবেদনের আগের রাতেই সে দেখতে পেয়েছিল এক জোড়া ঘন আঁখি পল্লব। ছলছল চাহনী, কমলার কোয়ার মতোন মসৃণ ঠোঁট,এক জোড়া নগ্ন পা।মুদিত কন্ঠে ক্লান্তি এসে জেকে বসেছিল।
তিরতির করা ঠোঁট দুটো যেন প্রথম বর্ষার বিন্দু বিন্দু জলকণা।
সেই যে তার বুকে আজন্ম তৃষ্ণার জন্ম দিলো!বিগত পাঁচ বছরেও এই তৃষ্ণা কমেনি।বরঙ শতবর্ষী ওয়াইনের মতোন তার কাছে হয়ে উঠছে তার আজন্মকালের তৃষ্ণা।
“একটা দেশলাই কাঠি জ্বালাও আহা আহা আহা
একটা দেশলাই কাঠি জ্বালাও তাতে আগুন পাবে
শীতের কাছ থেকে দুরে পালাও তাতে ফাগুন পাবে
তবু আমাকে আর পাবে না
কারণ আমায় অবহেলা করেছো
আরে আমায় নিয়ে খেলা করেছো
করেছো তুমি আমায় নিয়ে খেলা করেছো
আহা আহা”
তাশদীদকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে গান গাইছিল মৌসুমি। কন্ঠ এবং স্পর্শে তাশদীদ বুঝতে পেরেছে এটা মৌসুমি।তার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
“বেহায়াপনার লিমিট দিন দিন ক্রশ করছিস।”
“প্রিয়তম তোমাকে পেতে আমি হতে বেহায়া হতেও রাজি।”
“তোকে কে পেতে চায়?স্বভাব ঠিক কর। নইলে বাইরের মানুষ অপমান করতে কিন্তু দুই বার চিন্তা করবে না।”
মৌসুমি মেয়েটাকে কিছুই বলা যায় না।কিছু মেয়ে আছে যারা ছেলে দেখলেই গলে মোম হয়ে যায়৷ কিছুই বুঝতে পারে না।তাদের পোশাক তখন ঠিক থাকে না।তারা আহ্লাদিত বোধ করে ছেলেদের উপস্থিতিতে। শুধু তাই নয় এদের সব জায়গায় পাওয়া যাবে। সব অকাজের জায়গায়।এরা পারে শুধু মানুষের গসিপিং করতে। বলতে গেলে তাশদীদ এদের আলু বলে। যার তেমন গুণ নেই কিন্তু সে সব জায়গায় আছে।
শব্দটা শুনতে খারাপ লাগলেও আলুকে তাশদীদ বারোভাতারি সবজি বলে আর মৌসুমিকে আলু।
ইকুয়েশনটা মিলিয়ে তাশদীদ আপন মনেই হাসতে হাসতে দ্রুত সরে আসে মৌসুমির থেকে।বেরিয়ে আসতেই দেখতে পেল সাগরিকাদের গাড়ি ঢুকছে। এত দ্রুত ফিরে আসার কারণ ভাবাচ্ছে তাকে। কারণ এখনো মৌসুমীর বাবা-ভাই বসে আছে তাদের ড্রয়িং রুমে।যাদের মুখে ধূর্ততা এবং দৃষ্টিতে অশ্লীলতা। তাদের সামনে সে ইখুম, সাগরিকা কিংবা তুলিকে আনতে চায় না।ওরা তো তাশদীদদের বাড়ির সম্পদ। আর সম্পদের দিকে কুনজর কুকুরদের থাকেই।
তাজবীদ নেমে এসে বলল সাগরিকা পায়ে ব্যথা পেয়েছে। পা মচকে নীল হয়ে আছে। কিন্তু সে গাড়ি থেকে নামতে নারাজ।
তাশদীদ এগিয়ে যেতেই ইখুম বলল,
“বকো না ওকে। ভয় পেয়ে আছে এমনিতেই।”
সাগরিকা তখন ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। তাশদীদ কিছুটা শক্ত হাতেই টেনে নামিয়ে এনে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে ফেলল।
মৌসুমি ভ্রু-কুঁচকে তাকিয়ে আছে সেদিকে।হাবভাব ভালো লাগছে না তার কাছে।তাশদীদ সাগরিকাকে ধরেছে আর সাগরিকা তাজবীদকে।
এ যেন ত্রিমুখী সংঘর্ষ। তাজবীদ ম্লান হেসে সাগরিকার মাথায় হাত রেখে বলল,
“আমি ধরে আছি।ভয় কেন পাচ্ছিস?”
১৫
মৌসুমী হচ্ছে তাশদীদের বড় ফুপুর মেয়ে যার বাবা এলাকার একজন মাননীয় ব্যক্তি।রাজনৈতিক প্রভাব অনেক।এই সেই লোক যে তার স্ত্রীকে উঠিয়ে নিয়ে বিয়ে করেছিল।এর স্বভাব চরিত্র এবং কার্যকলাপ বেশ নিন্দাসূচক। তবুও বোনের খাতিরে তার সাথে নাম মাত্র সম্পর্ক রেখেছে সবাই।
তিনি এসেছেন তার ছেলের বিয়ের দাওয়াত দিতে।তাশদীদ কিছুটা জানতো। তাই আজ সামিনাকে দেখতে আসার ছোট্ট নাটক সাজায় সে। এজন্যই ইখুম, সাগরিকাকে বাড়ি থেকে দূরে পাঠিয়েছিল।এক কাজে দুই কাজ।সামিনার প্রতিক্রিয়া এবং মৌসুমির বাবা-ভাইদের, দুই পক্ষ থেকেই তাদের দূরে রাখতে চেয়েছে সে।
আজ সামিনা যা করেছে এটা ইখুম উপস্থিতিতে হলে পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারতো।
বিয়ের দাওয়াত দিয়ে যখন তারা বেরিয়ে গেল তখন পুনরায় সামিনার বিয়ের কথা উঠলো।সাগরিকার পায়ে তার বড় চাচা তখন গরম তেল মালিশ করে দিচ্ছে।পাশে বসে ছিল ইখুম।এ নিয়ে সে চুপচাপ। যেন সে জমে আছে বরফের মতোন।
তাশদীদ এবং রাশেদের কথা কাটাকাটির এক সময় তাশদীদ বলল,
“স্ত্রী স্বামীর জীবনে রহমত আর পরনারী বিষ সমতুল্য। তুমি বিষের জন্য রহমতকে কষ্ট দিচ্ছো।আমরা মেনে নিতে পারবো না।”
“সব সম্পর্ক পরকীয়ার হয় না।তাশদীদ তুই বুঝতে পারতিস আমাকে।”
“রাঙ্গাবৌয়ের খবর দিনে কয়বার নিয়েছো?এখন তার খেয়াল রাখা কার দায়িত্ব।”
“এক দায়িত্ব নিতে অন্য দায়িত্ব অবহেলা করতে পারবো না।”
“তবে সরি টু সে, আমরা এটা মেনে নিবো না।মেঝ কাকীর ভবিষ্যৎ আছে।কারো রক্ষিতা সে নয়।”
“এ বাড়িতে থেকে যদি তাকে রক্ষিতা উপাধি পেতে হয় তবে এই বাড়িতে সে থাকবো না।আগামীকাল ভোরেই চলে যাবো তাকে নিয়ে। আর স্নেহাকে নিয়ে।যে বাড়িতে তোমরা বাড়ির বৌকে রক্ষীতা বানাতে পারো সে বাড়িতে থাকার প্রয়োজন নেই।
প্রয়োজনে আমি ইখুমকে মুক্ত করে দিবো।”
ইখুম কিছু বলল না, সে শান্ত,নিষ্প্রভ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল রাশেদের দিকে৷ সামিনা এসে দাঁড়িয়েছে রাশেদের পাশে। সেম্লান হেসে বলল,
“তবে সন্তান?”
রাশেদের স্পষ্ট জবাব,
“এবোরশন করিয়ে ফেলো।”
চলবে
.