#ফাবিয়াহ্_মমো
হাতে কাঁচের গ্লাস নিয়ে এগুচ্ছে পূর্ব! মেয়েটিকে আজ মেরেই ফেলবে!! একেবারে মগজে মেরে ব্রেন ডিফেক্ট করে দিবে! রাগে সমস্ত গা ভয়ংকর হয়ে উঠেছে তার! কাঁচের গ্লাসটা দেয়ালে বারি মেরে সামান্য একটু ভেঙ্গে মেয়েটার গলায় বসানোর জন্য হাত যেই শূন্যে তুলবে হঠাৎ মেয়েটা ঠোঁট ভেদ করে বমি করে দিলো! পূর্বের শূন্যে উঠানো হাতটা হঠাৎ থমকে গিয়ে মেয়েটার জন্য অস্থির হয়ে উঠলো! হাত থেকে গ্লাসটা ছুঁড়ে ফেলে চট করে ওকে কোলে তুলে ওয়াশরুমে দৌড় দিলো। ট্যাপ ছেড়ে হাটুতে ভর দিয়ে ওকে কোলে রেখেই গায়ের উপর থেকে ভেজা টাওয়ালে বমি সাফ করলো। রুমে এনে বিছানার অন্যপাশে যেদিকে পরিস্কার আছে সেদিকটায় হেলে দিয়ে শুয়িয়ে দিলো। পানি খাওয়ালো। মেয়েটা দূর্বল রোগা হাত দিয়ে পূর্বের গ্লাস ধরা হাতটির উপর আলতো করে রাখলো। মেয়েটাকে নিয়ে বুকে ঝড় উঠে কেন? কারন কি? পূর্ব দেখলো মেয়েটির শরীর খুব ঠান্ডা! ও চট করে কপালে হাত রেখে দেখলো মেয়েটির কপালও ঠান্ডা। পূর্ব দ্রুত গ্লাস রেখে ওর গালে আলতো থাপ্পর মেরে অস্থির গলায় বললো,
— প্লিজ প্লিজ আমার দিকে তাকাও!! তোমার শরীর ঠান্ডা হচ্ছে কেনো!! এই মেয়ে তাকাতে বলছিনা!!
মেয়েটি কয়েকবার চোখ ঝাপটা মেরে তাকানোর চেষ্টা করতেই পূর্ব ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে উঠলো,
— প্লিজ চোখ খোলা রাখো! বন্ধ করো না! তোমার শরীর ঠান্ডা হচ্ছে কেন? তোমার শীত করছে?
মেয়েটি অচেনা ছেলেটিকে কোনোভাবেই চিনতে পারছেনা। তবুও পূর্বের কথায় তাল মিলিয়ে সায় দিয়ে মাথা উপর-নিচ মৃদ্যু নাড়লো। ওর শীত করছে!! পূর্ব নিজের গায়ের দিকে তাকালো, রুমের সবখানে চোখ মেললো, বিছানায় দেখলো মেয়েটার শীত নিবারনের জন্য আসলে কিচ্ছু নেই! পূর্ব রুমের কোণে কাঠের আলমারি দেখতে পেয়ে সেখান থেকে একটা কম্বল এনে ওকে পেঁচিয়ে দিলো। মাথায় একটা হাত বুলিয়ে বললো,
— এখনো শীত লাগছে? আরো কিছু লাগবে?
মেয়েটি মাথা ডানেবামে নাড়লো। পূর্ব স্বস্তিদায়ক নিশ্বাস ছাড়লো। নিশ্বাস ছেড়ে ফ্লোরের দিকে চোখ পড়তেই ভাঙা গুড়াগুড়া স্বচ্ছ কাঁচের গ্লাসটা দেখতে পেলো। ছি! একটু আগে আনিশার কথা শুনে ও এই মেয়েটাকে মারতে নিয়েছিলো? ছি!ছি!ছি! ওর মতো উৎকৃষ্ট অধম আর দ্বিতীয়টা নেই! ওর গার্লফ্রেন্ড স্বেচ্ছায় বিয়ে করলে এতে এই মেয়েটার দোষ কি! নিজের বোকামির উপর খুব গালিগালাজ করলো পূর্ব! ইচ্ছে করলো গালে গুণেগুণে দশটা থাপ্পর মারতে! পূর্ব মাথা তুলে মেয়েটির দিকে তাকালো। মেয়েটির সম্পূর্ণ দৃষ্টি এখন পূর্বকে ঘিরে। পূর্ব একটু শান্ত গলায় বললো,
— তোমার নাম কি জানা যাবে? তুমি কোথায় যাচ্ছিলে, রাস্তায় বেঁহুশ ছিলে, কি হয়েছিলো বলা যাবে?
মেয়েটি কিছুই না বলে শোপিসের মতো পূর্বের দিকে চেয়ে রইলো। পূর্বের মনে হচ্ছে এই মেয়েটি মেবি বোবা! কথা টথা বলতে পারেনা। নাহলে এর জায়গায় অন্য কোনো মেয়ে হলে চিল্লাহুল্লা করে একশোটা প্রশ্ন করতো!
দরজায় কান লাগিয়ে দাড়িয়ে আছে ফুয়াদ। ভেতর থেকে অনেক গুলো ভাঙচুরের শব্দ হলেও পূর্বের অস্থিরতার আওয়াজ ওরা ঠিকই পেয়েছে। জাওয়াদ ধাম করে হঠাৎ ফুয়াদের পিঠে চাপড় মেরে বললো,
–শালা কানে কি খৈল জমছে তোর? শুনোস না কিছু? ভিতরে কি হইতাছে কস না ক্যা!
ফুয়াদ বিরক্ত মুখে হাত উল্টো করে পিঠ বুলাতে বুলাতে বললো,
— ভেতরে শব্দ না হইলে কথা কোই থিকা আমদানি করমু বা*?
মিথুন ওদের মাঝখানে এসে বললো,
— প্লিজ তোরা তর্ক থামা তো! পূর্বকে এভাবে রাগী মাথায় ভেতরে থাকতে দেওয়াটা একদম ঠিক হয়নি! ওই মেয়ের যদি কিছু করে ফেলে!
হঠাৎ কথা কেড়ে পূর্বিকা বললো,
— পূর্ব মরলেও কোনো মেয়ের ইজ্জতের সাথে উটকো কাজ করতে যাবেনা! উল্টো আমি তোদের উপর ডাউট করি! কজ, গতবার তোরা যেই ভুলটা করেছিস সেটার জন্য আদৌ পূর্ব পস্তায়! ভুলিস না!
ফুয়াদ, মিথুন ও জাওয়াদের মাথা লজ্জায় হেঁট হয়ে যায়।বারবার একই কথা তুলে পূর্বিকা ওদের অপমান করে! এগুলা আর কতো সহ্য হয়? কি বা দোষ ছিলো ওদের? পূর্বের ঘাড়ে একটা মামলা চাপিয়ে জাস্ট পার পেতে চেয়েছিলো। তাতেই কিনা দোষ? পূর্বিকা সবগুলাকে বিদেয় করে দিলো। বাইরে একলা দাড়িয়ে দরজায় নক করলো,
— পূর্ব? ভাইটা আমার! প্লিজ দরজাটা খুলে দে না!! এভাবে পাগলামো করিস না ভাই!!
পূর্বিকা দরজায় আরেকদফা নক করবে হঠাৎ দরজাটায় খচ করে শব্দ হলো। পূর্বিকা বিষ্ময় নিয়ে দরজার নব্ ঘুরাতেই দরজা খুলে গেলো। ভেতরে ঢুকে একপা না দিতেই পূর্ব চেচিয়ে বলে উঠলো,
— আপি দরজায় লক দে! একটা শয়তানও যেনো ভেতরে না আসে!
পূর্বিকা কথামতো দরজা লক করে গুটিগুটি পায়ে পূর্বের পাশে বেতের মোড়া টেনে বসলো। মেয়েটিকে দেখে খুবই খারাপ লাগছে পূর্বিকার। কি মাসুম চেহারা! আল্লাহ্ যেনো জগতের সকল মাসুমসুলভ বৈশিষ্ট্য এই মেয়েটির মুখেই ঢেলে দিয়েছেন! কি সুন্দর দেখতে মেয়েটা! অথচ? গালভরা থাপ্পরের ছাপ! ইশশ..কি যন্ত্রণা দিয়েছে! কে এভাবে পৈশাচিক আচরন করেছে? আত্মা কাঁপলো না? হঠাৎ পূর্বিকা চোখ নামিয়ে পূর্বের দিকে তাকালো।
— পূর্ব? মেয়েটাকে কিছু করেছিস রে?
— তুই কি করার কথা বলছিস আপি? আমি কি করবো ওকে?
— মানে…বাইরে থেকে ভাঙচুরের শব্দ আসছিলো তো ..
পূর্ব ভাঙা গ্লাসের দিকে তাকিয়ে বললো,
— রাগ উঠেছিলো। সবসময়ের মতো হাতের কাছে থাকা জিনিস আছাড় মেরেছি।
পূর্বিকা ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে ঠোট খুলে নিশ্বাস ছাড়লো। পূর্বের রাগই এমন। মাথা ঠিক থাকেনা। রাগের মাথায় পূর্ব দুনিয়ার সবচাইতে ভয়াবহ কাজগুলোও করতে পারে! একবার কলেজগেটে পূর্বিকাকে তিনটা ছেলে সামান্য টিজ করে শিষ মেরেছিলো। ওইদিনই পূর্ব ওদের হাত পা ভেঙ্গে ছ’মাসের জন্য হাসপাতালের বাসিন্দা বানিয়ে দেয়! পরদিন সকাল না হতেই পূর্বের নামে পুলিশ কমপ্লেইন আসে! সবাই অবাক হয়ে এই ব্যাপারে ‘ না না ‘ করলেও পূর্ব নিজ দায়িত্বে পুলিশের কাছে স্বীকার করে, ‘ওরা আমার বোনকে শিষ মেরেছিলো তাই ওদের শিষ মারার ঠোঁটই আমি নষ্ট করে দিয়েছি! আপনারা আমাকে এরেস্ট করতে চাইলে করুন! আমি কারোর বাপকেও ভয় পাইনা! এইসব নেতার ছেলে কি জিনিস??’ বেচারা পুলিশ পযর্ন্ত ওর কান্ডজ্ঞান দেখে আশ্চর্য হয়েছিলো!
পুরো নাম আয়াফ ওয়াসিফ পূর্ব হলেও এলাকার ছোটবাচ্চা থেকে টোকাই পযর্ন্ত ‘পূর্ব’ বললেই একদম ওর বাসা সুদ্ধো চিনিয়ে দিবে!পূর্বের খ্যাতি দু’একদিনে বা কোনোপ্রকার গুন্ডামি করে হয়নি! এমনে এমনেই ‘পূর্ব ভাই’ বলে চিৎকার দিয়ে এলাকার সামান্য একটা রিকশাওয়ালাও দৌড়ে আসেনা! রাস্তার ভিক্ষুকরাও পূর্বের জন্য প্রাণ উজাড় দোয়া করেনা! পূর্বের মধ্যে ছিলো এমন কিছু অদৃশ্য আর্কষন, অসীম উদারমনা এবং অসাধারণ কিছু অতুলনীয় গুণ, যেটা ভার্সিটি মাতিয়ে তোলা সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে আনিশাকে পূর্বের প্রেমে পড়তে বাধ্য করেছিলো! পূর্ব নিজ থেকে কখনো আনিশার কাছে যায়নি, না সে প্রেমপূর্ণ চিঠি দিয়ে আনিশাকে পটিয়েছে। আনিশা নিজ থেকেই পূর্বের জন্য প্রেমময়ী হয়েছে। পূর্বের বাবা ডেভেলপমেন্ট সংস্থায় চাকরি করে। মা হাইস্কুলের হেডটিচার। বেশ কঠোর ডিসিপ্লিনের সাথে বড় হয়েছে পূর্ব। পড়াশোনার প্রতি ছিলো খুব ক্ষোভ তবুও কোনোরকমে সেটা করেছে আরকি! বড় বোন, পূর্বিকা ওয়াসিফ বর্তমানে বিবাহিত। কাবিন পড়ানো হয়েছে কিন্তু তুলে নিয়ে যাওয়া হয়নি। ওর বাবার দুইভাই এবং একবোন আছে। ভাইদুটো ছোটো কিন্তু বোন সবার বড়। তিনভাই মিলে যৌথ ফ্যামিলি হিসেবে গুলশানের চারতলা বিল্ডিংয়ে মিলেমিশে থাকে। জাওয়াদ ও সায়মা ছোট চাচার ছেলেমেয়ে, ফুয়াদ ও মিথুন বড় চাচার।
— পূর্ব? মেয়েটার কি সমস্যা বলতো? জানতে পেরেছিস কিছু?
পূর্ব মেয়েটার চোখে চোখ রাখতেই দ্রুত সরিয়ে ফেললো! ওই চোখে কি যেনো আছে! সহজে তাকানো যায়না! ঘাবড়ে যায় পূর্ব! পূর্ব বললো,
— তুই যেভাবে বললি ও যেনো আমার বাসর করা বউ! সব খুঁটিনাটি তথ্য যেনো জেনে বসে আছি!
পূর্বিকার খুব রাগ হলো ত্যাড়া উত্তর পেয়ে! নিজেকে দমিয়ে বললো,
— তাহলে তুই কোন সুখে ওকে গাড়িতে তুলতে গেলি? রাস্তায় ফেলে আসতি! মরে পড়ে থাকতো!
পূর্ব ভ্রুকুচকে পূর্বিকাকে বললো,
— এসাইলামের পেশেন্টের মতো কথা বলিস না আপি! তুই নিজে একটা মেয়ে হয়ে অন্য একটা মেয়েকে রাস্তায় ফেলে আসতে বলছিস? এ কেমন বিচার?
— ঠিক বলেছি! না তুই এই মেয়েকে গাড়িতে তুলতি! না আমরা লজে আসতাম! না আমরা আনিশার বিয়ে হওয়ার খবর পেতাম!
— তুই ইনডাইরেক্টলি এই মেয়েটাকেই দোষারোপ করছিস?
— না করে উপায় কি! যার জন্য এতো এতো কষ্ট পোহালাম! মান ইজ্জত মাটিতে মেশালাম! সেই কিনা শেষমেশ উদার মনে উদয় হয়ে অচেনা একটা মেয়েকে হেল্প করতে!
— একটা মানুষকে বাচাঁনো ফরজ কাজ না?
— আগে তুই নিজে তো বাঁচ! তারপর পরের নাম নে!
পূর্ব কথা বললো না। ওর বেশি কথা বলা একদম সহ্য না! প্রচুর বিরক্ত লাগে কথা বলতে!
পূর্ব হঠাৎ দেখলো মেয়েটা কাপঁছে! কম্বলের ভেতর গুটিয়ে থাকা শরীরটা কাপছে। পূর্ব পূর্বিকাকে চমকে দিয়ে ওর কপালে আবার হাত রেখে বললো,
— ড্যাম! কিছুতেই শরীর গরম হচ্ছেনা!! কি করি! আপু? হেল্প মি! ওর শরীর ঠান্ডা!
— তো? মরতে দে না! আমার আর ক্যাচাল ভাল্লাগেনা!
পূর্বিকা কথাটুকু বলে উঠে দাড়ালো ঠিকই কিন্তু কি যেনো ভেবে আবার মাথা পেছনে ঘুরালো! চোয়াল ঝুলিয়ে পূর্বিকা পুরোপুরি থ! পূর্ব এই রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া মেয়েকে কোলে নিয়ে মাথায় হাত বুলাচ্ছে!
— পূর্ব তুই ওকে…
পূর্বিকার কথা থামিয়ে শক্ত চাহনিতে তাকালো পূর্ব! তর্জনী তুলে দরজার দিকে ইঙ্গিত করলে পূর্বিকা ব্যাপক আশ্চর্য হয়ে দরজার বাইরে পা দিলো। দিতেই পূর্ব চেচিয়ে বলে উঠলো,
— দরজা লাগাতে হয় জানিস না! দরজা লাগা!
পূর্ব মেয়েটাকে কোলে বসিয়ে কম্বল দিয়ে ঘিরে চেপেছে। দুটো হাত নিজের হাতে ঘষে দিচ্ছে। মেয়েটা মায়া মায়া চোখে পূর্বের ঠোঁট কামড়ে হাত উষ্ণ করা দেখছে। পূর্ব আড়চোখে ওর চাহনি বুঝে হালকা কেশে বললো,
— আমাকে অন্তুত নামটা বলো? বারবার এই মেয়ে এই মেয়ে বলে ডাকতেও তো বিরক্ত লাগে!
মেয়েটা কিছু না বললেও থুতনি বুকে লাগালো। চোখদুটো নিচু করে গলায় ঝুলানো একটি ছোট্ট চিকচিক করা বস্তুর দিকে তাকিয়ে আছে। পূর্ব ওর দিকে লক্ষ করতেই হঠাৎ হাত ঘষা থামিয়ে দিলো। ভ্রুকুঁচকে গলায় চকচক করা জিনিসটা নিজের হাতে নিয়ে দেখতে লাগলো।। আরে এটাতো একটা লকেট চেইন! তাতে ইংলিশ ভাষায় ইটালিক ফন্টে সাতটি এ্যালফাবেটের শব্দ লিখা! পূর্ব ঠোঁট নাড়িয়ে নিঃশব্দে সেটা উচ্চারণ করতেই চমকিত কন্ঠে বলে উঠলো,
— হেই! তোমার নাম কি পূর্ণতা?
পূর্ণতা চোখ নামিয়ে মাথা ঝাঁকালো। হ্যাঁ ওর নাম পূর্ণতা। পূর্ব হালকা হেসে বললো,
— ওহ্ সরি! আমি তো তিন অক্ষরের নাম ডাকতে পারিনা! তোমার নামটা ছোট করতে হবে! শর্টকাট নাম ‘পূর্ণ’ বলি?
পূর্ণতা বড় বড় পাপড়িভরা চোখ দিয়ে পূর্বের দিকে আগের মতোই মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিলো। পূর্ব হঠাৎই যেনো আছড়ে পড়া ঘূর্ণিঝড়ের ব্যাপারে ভুলে গেলো। আনিশা নামক ভয়াবহ তুফানটা কোথায় যে তলিয়ে গেলো বোঝা গেলো না। পূর্ব আপনমনে সেবা করলো মেয়েটার।
.
ফুয়াদ পূর্ণতার দিকে একধ্যানে তাকিয়ে আছে দেখে জাওয়াদ কনুই দিয়ে গুতা মারলো! ফুয়াদ হালকা চমকে উঠে বিরসমুখে বলে উঠলো,
– মারলি কেন হারামজাদা! ব্যথা পাই না?
– তুই মেয়েটার দিকে ওমনে তাকিয়ে আছিস কেন! পূর্ব যে সামনে চোখে দেখিস না!
– পূর্ব ওকে খাওয়াচ্ছে! আমাদের দিকে ধ্যান দেয়নি জাওরা!
– আমার নাম বিকৃত করবিনা ফুয়েলের বাচ্চা! ফুয়েল শালা! ফুয়েল কোথাকার!মদন! চোরা! পূর্বের সামনে ওই মেয়ের দিকে ওভাবে তাকাবি না! পূর্ব জিহবা কেটে কুত্তাকে খাওয়াবে!
পূর্ণতা নামের মেয়েটা এখনো নিশ্চুপ! কারো কোনো প্রশ্নের জবাব তো দেয়ই না উল্টো মুখ ফুটে কথাও বলেনা। শুধু পূর্ব কিছু জিজ্ঞেস করলে সেটাও মাথা ঝাঁকিয়ে উত্তর দেয়। পূর্বিকা, সায়মা চিন্তিত মুখে সোফায় বসে আছে। জাওয়াদ, ফুয়াদ বেতের মোড়ায়, মিথুন পূর্বের পাশে বসে হেল্প করছে, পূর্ণতা একটু একটু করে মুখে খাবার নিচ্ছে। পূর্ব নিজ হাতে নরম খিচুড়ি তুলে খাওয়াচ্ছে পূর্ণতাকে। পূর্ব বাদে সবার চোখমুখে প্রায় কান্নাকাটি ভাব। একটু আগে পূর্বের বাবা তথা বাড়ির বড়কর্তা ফোন দিয়ে বলেছে ‘একটা গাধাও যেনো বাড়িতে না আসে! আসলেই একদম মাটিতে পুঁতে ফেলবে!’ ব্যস এরপর থেকে সবাই ভীত হয়ে আছে। খাওয়াপর্ব শেষ হলে পূর্ণতাকে ঘুমাতে বলে সবাই লজের বাইরে গোল টেবিলে একত্র হয়ে বসে। এখন রাত তিনটা। মিথুন সবার আগে বললো,
— পূর্ব ভাই বাড়িতে যেতে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে দিছে। আমরা এখন যাবো কোথায়? লজের বুকিংও শেষ। সকালে অন্য টুরিস্ট উঠবে!
পূর্ব কফির মগে শান্ত ভঙ্গিতে চুমুক দিয়ে চোখবন্ধ করে খাচ্ছে। সবসময়ের মতো, ‘নো আন্সার’ টাইপ মুড! সায়মা উদ্বিগ্ন গলায় বলে উঠলো,
— পূর্ব? প্লিজ কিছু বল! এজ অলয়েজ চুপ থাকলে চলে? উপায় তো বের করে দে!!
পূর্ব কফিতে বড় চুমুক দিলো। মাথাটা পেছনে হেলিয়ে পায়ের উপর পা তুলে আকাশে তাকালো। দু’হাতে কফির মগ শক্ত করে ধরা। পূর্বিকা জাস্ট রাগে ফুঁসছে! ওর জন্যই সবাই বাড়ি থেকে পালালো, ওর জন্যই আনিশার বিয়ে ঠেকানোর জন্য রওনা দিলো কিন্তু ওর কোনো ফিলিংই নেই! কেমন ডোন্ট কেয়ার মুড নিয়ে আছে! যেনো কিছুই হয়নি! জাস্ট চিল! পূর্বিকা ফুসতে ফুসতে বললো,
– এখন কিন্তু অতিরিক্ত হচ্ছে পূর্ব ! বাবা আমাদের বাড়ি যাওয়াই নিষেধ দিছে তোর জন্যে! এখন তুই যদি চুপ থাকিস আমি বাপেরবাড়ি না গিয়ে সোজা শ্বশুরবাড়িতে উঠবো!
পূর্ব আকাশে মুখ করে বলে উঠলো,
– তোর যদি কবরস্থানে যাওয়ার চিন্তা থাকে তাও কর! প্লিজ আমার কানে ঘ্যানঘ্যান করিস না! আমি কাউকে পা টিপে ধরে আনিনি! যে যার মতো আমার সাথে এসেছে! তোহ্! দোষ কি আমার? না তোদের?
হঠাৎ মিথুন পাশ থেকে বলে উঠলো,
– পূর্ব ভাই তুমি পারমিশন দিলে একটা সলিউশন আছে!!
পূর্ব খানিকক্ষন চুপ থেকে বললো, ‘বল!’
মিথুন সবার দিকে তাকিয়ে জোরে নিশ্বাস ছেড়ে বললো,
– পূর্ব ভাই চলো আমরা দাদুবাড়িতে যাই। এই উছিলায় রিফ্রেশ হয়ে আসবো।
– আমরা জানি কোথায় যাচ্ছিলাম?
– না মানে পূর্ব ভাই আনিশার বাসা থেকে দাদুবাড়ি তো দূর। সমস্যা হওয়ার কথাই নেই।
– দাদুমনি, দাদাভাই যদি বাড়িতে উঠতে না দেয়?
– পূর্ব ভাই তুমি যেখানে পদচিহ্ন ফেলবা সেদিকে কেউ আপ্যয়ন করবে না এটা ভাবাও ভুল! তোমাকে পেলে দাদুমনি তো
খুশিতে এলাকায় ঢোল পিটাবে!
পূর্বিকা নিজেকে শান্ত করে বললো,
– মিথুন ভুল বলেনি। চল এই চান্সে গ্রামটা দেখে আসি। অনেক দিন হয়েছে যাওয়া হয়নি।
পূর্ব কি ভাবলো বোঝা গেলো না কিন্তু কফি একচুমুকে খেয়ে টেবিলে মগ রাখতেই বললো,
– গাড়ি স্টার্ট দে! পূর্ণকে নিয়ে আসি!
সবাই পূর্বের দিকে এমন আশ্চর্যে তাকালো যেনো পূর্ব কাউকে জবাই করার কথা বলেছে। পূর্ব পকেটে হাত গুজে চুলে আঙ্গুল বুলিয়ে চলে যাচ্ছে। পূর্ব এই উদারধর্ম কবে ত্যাগ করবে? ওর জন্য সবাই বাঘের গুহা থেকে পালিয়ে এসেছে কিন্তু পূর্বের কোনো বিকার নেই! কেমন উটকো ছেলে! উফ!
.
গাড়ি ঢাকার খিলগাঁও সড়কে উঠেছে। লম্বা জার্নি! রাস্তায় জ্যাম থাকলে তো কথাই নেই পৌছতে পৌছতে গভীর রাতও হতে পারে। ট্রেনে গেলে সুবিধা হতো কিন্তু টিকিট কাটা হয়নি। ভোর এখন পাচঁটা। কমলাপুর স্টেশন থেকে দেওয়াণগন্জগামী ট্রেন ছাড়ে সাতটা বিশ মিনিটে, তিস্তা এক্সপ্রেস। পূর্ব পূর্ণতার পাশে বসে ইয়ারফোন কানে গুজে চোখ বন্ধ করে আছে। পূর্ণতা চুপচাপ গ্লাসের বাইরে চলন্ত যানবাহন দেখছে। গায়ে পূর্বের দেওয়া মোটা জ্যাকেট, পড়নে টকটকে লাল রঙের লং কুর্তি, চুলগুলো ঝুটি করে উচুতে বাঁধা, পায়ে জুতো নেই। হঠাৎ কি যেনো ভেবে ফুয়াদ গাড়ি থামালো, মাথা পেছনে ঘুরিয়ে বললো,
— পূর্ব ভাই? ঘুমাইছো?
পূর্ব কান থেকে ইয়ারফোন খুলে বললো, বল!
— পূর্ব ভাই তুমি না রেস্টুরেন্ট দেখলেঞ গাড়ি থামাতে বলছিলা? ওইযে বাইরে।
পূর্ব দরজা খুলে চলে গেলো। ফুয়াদ শয়তানি হাসি দিয়ে মিথুন ও জাওয়াদের দিকে তাকালো। ওরাও হাসছে। পূর্বিকা ঘুমে কিন্তু পাশ থেকে সায়মাও হাসছে। ওরা খুব বাজে একটা প্ল্যান করেছে যেটা এখন এক্সিকিউট করতে যাবে! সায়মা গাড়ি থেকে বেরিয়ে পূর্ণতার কাছে দরজা খুলে কর্কশ গলায় বললো, এই ফকিন্নি! বের হ গাড়ি থেকে! বের হ বলছি!
পূর্ণতা মাথা নিচু করে জ্যাকেটটা আরো চেপে ধরলো। বেরুলো না। সায়মা ওর হেলদোল না দেখে ওর চুলের ঝুটিটা শক্ত করে মুঠি করে বাইরে বের করে রাস্তায় ফেললো। পূর্ণতা হাঁটুতে ব্যথা পেয়ে ‘ঊহ্’ করে উঠলো। সায়মা ওর ব্যথা জায়গায় পেনসিল হিল দিয়ে জোরে একটা লাত্থি মেরে বললো,
— তোর জন্য আমরা গন্তব্যে যেতে পারিনি! বুঝছিস ফকিন্নি! এখন তাড়াতাড়ি টপকে পড়! নাহলে জুতা মেরে মেরে তোর ছাল উঠিয়ে ফেলবো!
পূর্ণতা বুঝতে পারলো ওর পায়ের কোথাও ছিলে গেছে। চামড়াটা আছে কিনা কে জানে? তবুও হাতে ভর দিয়ে জ্যাকেট গায়ে জড়িয়ে উঠে দাড়ালো। সায়মার দিকে একপলক তাকালে সায়মা ঠোঁট কুঁচকে কষে থাপ্পর মারলো পূর্ণতার গালে! পূর্ণতা কাঁদলো না, খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাটা ধরলো ওইদিকে। পূর্ব ব্যস্ত রাস্তার ওপাশে থাকা খানিকটা দূরে বেশ নামকড়া রেস্টুরেন্ট গিয়েছিলো। ওখানে প্রায় বিশ মিনিট অপেক্ষা করে গরম গরম চিকেন ফ্রাই, ভেজিটেবল রোল, বার্গার নিয়ে চলে এলো। গাড়িতে উঠেই সে অবাক! সবগুলাকে জেরা করে ধরলো! ‘পূর্ণ কই! পূর্ণ কোথায় গেছে! ওকে এখানে বসিয়ে গেছিলো ও নিজ থেকে কোত্থাও যাবেনা!’ পূর্ব গর্জে উঠলে পূর্বিকার ঘুম ভেঙ্গে যায়। সায়মা ওদের সবটা বলে। কিন্তু বানোয়াট মিথ্যা ছাড়া কিচ্ছু বলে না।
— একচুয়েলি পূর্ণের স্বামী এসেছিলো নিতে। আমরা আবার কাল ফেসবুকে ওর নামে নিখোঁজ সংবাদের স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম তো!!ওখান থেকেই পেয়েছে বটে। তুই চিন্তা করিস না, আমরা চারজন কনফার্ম করেই ওকে স্বামীর হাতে তুলে দিয়েছি।
কথাগুলো এতো সুন্দর করে বোঝালো যে পূর্ব আর ভাবতেই পারলোনা ওরা একটা জঘন্যতম কাজ করেছে। গাড়ি ছেড়ে দিলো। পূর্বের মনটা কেমন দুরুদুরু করছিলো ও বারবার জানালার বাইরে কাউকে খুজছিলো। গাড়িটা চলতছে, চোখের সামনে ‘আজমল সুপার শপ’ নামটা পিছনে চলে যাচ্ছে। পূর্ণ কি বিয়ে করেছে? দেখতে তো পুরাই কিশোরী লাগে! এই বয়সেই বিয়ে করবে? পূর্ব জানালায় হাত মেলে তাতে থুতনি বসিয়ে মনেমনে বললো, শিট.. পূর্ণ একটাবার ‘বায়’ বলে যেতো? কালরাত থেকে সেবা করছে তার বদৌলতে এটুকু কি আশা করা যায় না? পূর্ব জানালা থেকে হাত সরিয়ে কানে যেই ইয়ারফোন গুজবে হঠাৎ পূর্ণের মতো কাউকে যেনো দেখতে পেলো! ও লাফিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো! ওহ্ শিট গাড়ি এতো স্পিডে যাচ্ছে কেন! পূর্ব মিথুনকে বলে গাড়ি থামিয়ে এক ধাক্কায় দরজায় খুলে রাস্তার ওপাশে দোকানগুলোর দিকে মিলিয়ে গেলো! ভিড় বেড়েছে। এখন পূর্বকে দেখাও যাচ্ছেনা! পূর্ব হন্যে হয়ে পূর্ণের মতো দেখতে পাওয়া মেয়েটাকে খুজতে লাগলো! ওর মন এখন বলছে, ওই মেয়েটা পূর্ণই ছিলো! কিন্তু একা থাকবে কেনো? তাহলে কি ওরা মিথ্যা বললো? পূর্ব পকেট থেকে ফোন বের কল করলো! ফুয়াদের কল বেজে উঠলো। ফুয়াদ দুটো ঢোক গিলে রিসিভ করলে পূর্ব বলে উঠলো,
— তোরা দেওয়ানগন্জের দিকে রওনা দে! আমি আসছি! আপিকে বলবি আঁখির সাথে দেখা হয়েছে! ফোন রাখ!
পূর্ব ঘন্টাখানিক খুজতে খুজতে যখন সুপারশপে পানি কিনতে গেলো সে ওয়ালেট থেকে টাকা বের করার শক্তি যেনো পাচ্ছেনা! শপের চেয়ারে বসিয়ে পূর্ণের পা ধরে একটা মেয়ে তরল রক্ত মুছে দিচ্ছে! পূর্ণ চোখ কুচকে কান্না করছে। পূর্ব একদৌড়ে পূর্ণের সামনে দাড়ালে রক্ত মুছে দেওয়া মেয়েটি বললো, ‘জ্বি? কিছু বলবেন?’
পূর্ব কোনো শব্দই খুজে পাচ্ছিলনা পূর্ণের এই অবস্থা দেখে! পায়ের বুড়ো আঙ্গুলের মাথায় চামড়া ঝুলে আছে। সেখান থেকে স্রোতের মতো রক্ত ভেসে পড়ছে সাদা টাইলসে। পূর্বের ঢোক গিলতেও প্রচুর অসুবিধে হচ্ছে! সুস্থ পূর্ণ আহত কিভাবে হলো?
– এইযে মিস্টার? কিছু কি বলবেন? এইভাবে খাম্বার মতো দাড়িয়ে আছেন কেন? আপনি মেয়েটাকে চিনেন?
পূর্ণ চোখ মেলে সামনে তাকালো! হঠাৎ চোখের সামনে পূর্বকে দেখতে পেয়ে ঠোঁট ভেঙ্গে বিনা শব্দে ফুপিয়ে কেদেঁ দিলো। পূর্ব নির্বাক চাহনিতে ধপ করে হাটু ভেঙে ফ্লোরে বসে পড়লে পূর্ণ ওর হাত উঠিয়ে কাটা জায়গায় ইশারা করে হু হু করে কেদেঁ উঠলো…
-চলবে
#FABIYAH_MOMO
সম্পূর্ণ গল্পের লিংক
(আমি গল্পে যদি দু’এক পার্টেই সবকিছু বলে দেই তাহলে সেটা কোনো গল্পের কাতারেই পড়বেনা। অনুগল্প হবে সেটা! আগেও বলেছি এটা ভিন্ন ধাঁচের গল্প। আগের কোনো গল্পের সাথে এই থিম মিলবেনা। আর এখানে পূর্বে শেষ করা স্টোরির মতো জটিলতাও থাকবেনা। ভালোবাসা!)