#ফাবিয়াহ্_মমো
বাড়ি সুদ্ধো বিদঘুটে আধারে মিলিয়ে আছে, প্রতিটি ঘরে ঘরে হারিকেন জ্বলছে। বিকেলের ভয়াবহ তান্ডব শেষে কেউ ইলেক্ট্রিসিটির লাইন জ্বালাতে পারেনি। কি ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিলো বিকেলের শেষ দিকে! চারধার বিদঘুটে অন্ধকার করে কালো মেঘে আকাশ ঢেকে গিয়েছিলো! পূর্ণতা এমন বাদলা দিনে আল্লাহ্কে ডাকছিলো ওর মন পূর্বের জন্য অশুভ পূর্বাভাস তিলতিল করে টের পাচ্ছে। পূর্ণতা পাগলের মতো অস্থির হয়ে উঠেছিলো, রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে জঙ্গলের পেছন জানালায় তাকিয়ে তাকিয়ে অঝোরে নিঃশব্দে কাদঁছিলো। প্রবল হাওয়ায় গ্রামাঞ্চলে ইলেকট্রিসিটির বোর্ড লাইনে দারুন সমস্যা হয়, যার ফলাফল পুরো আটটা গ্রামে বিদ্যূৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। ভয়াবহ অন্ধকারে তলিয়ে আছে পুরো গ্রাম। শ্রেয়া জোর করে পূর্ণতার রোজা খুলে কিছু হালকা নাস্তা খাওয়ায়। মাথায় হাত বুলিয়ে ঠোঁটের কাছে দুধের গ্লাস এঁটে অভয় বানীতে শোনায়,
– ভাইয়া সুস্থ থাকবে পূর্ণতা, তুই যদি নিজের অবস্থা খারাপ করে ফেলিস ভাইয়া খুশি হবে বল? কষ্ট পাবে না?
পূর্ণতা দুধের গ্লাসে চুমুক দিতেই টুপ করে গাল ভিজিয়ে অশ্রুকণা পরে। শ্রেয়ার কষ্ট হয় অনেক! বেষ্টফ্রেন্ড নামক মানুষটাকে বেষ্টনীর মতো আগলে রেখেও কষ্ট পোহাতে হচ্ছে… শ্রেয়ার খুব দুঃখ লাগে, অদ্ভুত ভাবে কান্নাও পায়। আয়মান পূর্ণতার বিয়ের বাজার সদাইয়ে ব্যস্ত থাকলেও এক মূহুর্তের জন্য পূর্ণতার কাছে এসে সাহস জুগিয়ে বলে,
– ভাই তোরে কি শিখাইছিলো ভুইলা গেছোস? তুই হইলি পার্ফেকশন মানে বাংলায় পূর্ণতা! হুদাই কাইন্দা লাভ আছে বল? ভাইয়ে দেখ ক্যামনে এন্ট্রি মারে! তোরে দেখিস ক্যামনে চমকায়া দেয়! তুই ছেড়ি খাইয়া লইয়া ফিটফাট হ, ভাইয়ে যেই সারপ্রাইজ দিবো তুই কাইত হইয়া যাবি নে!!
পূর্ণতা দুঃসময়ের মধ্যেও আয়মানে কথায় হাসে। খুবই মৃদ্যূ ভঙ্গিতে হেসে চোখের পানি ছেড়ে দেয়। খোদেজা যেই থাপ্পরটা মেরেছিলো এখনো ছাপ বসে আছে গালে। আনিশা আপাতত নিজের মতোই দিহানের সাথে টাইম পাস করছে। দিহানের মতো সরল সহজ ছেলেকে নিজের রূপের মায়ায় মোহিত করে ভুলিয়ে ভালিয়ে রাখছে আনিশা। আনিশার মনে চাপা ক্ষোভ! পূর্ব কেন বিশ্বাসঘাতকতা করলো? পূর্ণতাকে কেনো বিয়ে করতে চাইছে? আনিশার এখনো স্পষ্ট মনে আছে পূর্ব কিভাবে আনিশার কানের নিচে চড় বসিয়ে রাগে হনহন করে বলেছে,
– তোমার বুঝা উচিত! তোমার প্রোপোজাল একসেপ্ট করার পর নিজেকে অনেক বুঝিয়েছি তোমাকে প্রতি ফিল করার জন্য, যেভাবে তুমি উল্টাপাল্টা কাজ করো আমার মনকে আমি বুঝিয়েছি সেভাবে করতে। বাট উইথ গ্রেট সর্যো! এই মন কোনোভাবেই তোমার প্রতি টান অনুভব করছেনা! আমার দোষ নেই সরি! তোমাকে আমি আগেই বলেছি, প্রেম-ভালোবাসা দুটো দুই ব্যাপার। প্রেমের বেলায় মন কাজ করবে, ভালোবাসার বেলায় মন ও শরীর দুটোই সচল থাকবে। আমি তোমার সাথে নরমাল প্রেমটাই করতে পারছিনা ভালো কিভাবে বাসবো? আই এম রিয়েলি ভেরি সরি, আমার দ্বারা তোমাকে বিয়ে তো দূর রিলেশন টিকানোর এবিলিটি নেই। প্লিজ, নিজেকে সস্তা বানানো বন্ধ করো আমি তোমার প্রতি ফিল করতে পারছিনা।
আনিশা এখনো পূর্বের কথাগুলো সতেজ ভঙ্গিতে ভাবে। যেনো কানের মধ্যে রিনরিন করে এখনো বাজছে। পূর্ব তাহলে পূর্ণতাকে ভালোবাসে ফেলেছে? কখন? কিভাবে? কবে? আনিশা তিন বছর ধরে রিলেশন ট্যাগ লাগিয়ে পূর্বের গার্লফ্রেন্ড হিসেবে যে সুনাম অর্জন করেছিলো পূর্ণতা বউ হিসেবে কেনো সেটা গোপন থাকছে? কেনো শহরে বিয়েটা হচ্ছেনা? পূর্ব কি চায় না ওর রাজনৈতিক কর্মকান্ডের জন্য পূর্ণতার কিছু হোক? তাহলে আনিশা যখন গার্লফ্রেন্ড ছিলো যদি পূর্বের শত্রুদলের কারনে কোনো ক্ষতি হতো এতে পূর্বের কোনো ভ্রুক্ষেপ বা কষ্ট হতো না? তার মানে পূর্ব পূর্ণতার ভালোর জন্যই নিজের বুদ্ধি খাটিয়ে প্রতিটা গুটি ফেলছে। পূর্ণতাকে বাচানোর জন্যই পূর্বের যতো ভয়ংকর কারসাজি। পূর্ব কি নিষ্ঠুর! তোমার সুখ আমার সহ্য হচ্ছেনা পূর্ব! তুমি আমার খালাতো বোনের স্বামী হতে চলেছো তবুও তোমার সাথে পুরোনো হিসাব চিন্তা করলে বুক ঠেলে অভিশাপ আসে! শুধুমাত্র তোমার জন্য আমার খালাতো বোনের জীবনে দূর্ভিক্ষ নামবে পূর্ব! কেবল তুমি দায়ী পূর্ণতার প্রতিটা কান্নার জন্য! আনিশার খারাপ লাগে পূর্ণতার কথা চিন্তা করলে। যার মনটা সবার জন্য কাতরায়, পরিবারের প্রতিটি মানুষের জন্য ভাবে, সবাইকে কতটা ভালোবাসে! অথচ নিয়তি দেখো, সেই মিষ্টি পরী পূর্ণতা পূর্ব নামক রাজনৈতিক পথিকের জন্য অস্থির হয়ে উঠে। হায়রে লীলাখেলা…
‘আকাশে মেঘের মতো আমার জীবনে অনুভূতি এসেছিলো সেই মেঘগুলো বৃষ্টি না দিয়েই উধাও হয়ে গেলো। এখন শ্বাস-প্রশ্বাস শুধু টানছি আমি, আমার জীবনে আর নেই তুমি…’
আনিশা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিড়বিড় করে আকাশের পানে তাকিয়ে রইলো। কি ব্যথা হচ্ছে বুকে! এই ব্যথা কমবে কবে? কবে রেহাই পাবে অতীতের একতরফা ভালোবাসা থেকে?
.
হারিকেনের পলতে নামানোর কারনে নিভু নিভু আলোতে ভূতুড়ে পরিবেশ ধারন করেছে রুমের মধ্যে। মাথার উপর টিনের চালে গাছের ডালপালার ধাক্কাধাক্কি চলছে।কি বিদঘুটে শব্দ! বাইরে এখনো হো হো প্রতিধ্বনির বাতাস। যেন বাতাস বলছে, ‘হে মানব সমাজ! আমাকে ভয় করো! একদিন এভাবেই আমি আল্লাহর পক্ষ হতে কিয়ামতের নিদর্শন পাবো! তোমাদের এই রঙিন দুনিয়া ধূলোয় ধূলিসাৎ করে গুড়িয়ে দেবো!’ পূর্ণতার চোখ দুটো ভীষন ফুলে উঠায় পাতাদুটো প্রচণ্ড ভারী হয়ে আছে। চোখ খুলতেও হিমশিম খাচ্ছে পূর্ণতা। পূর্ণতার অকারনে কান্নার রহস্যটি সবার কাছে মেয়েদের বিদায়কালীন কান্নাসুর মনে হচ্ছে। আগামীকাল পূর্ণতা সবাইকে ছেড়ে নতুন পরিবেশে নতুন পরিবার পাবে তাই হয়তো বুকের ভেতর কান্না ঠেলে চোখ উজাড় করে কাঁদছে। কিন্তু রহস্য সবসময় রহস্য হয়ে থাকতেই পছন্দ করে বেশি। পূর্ণতার কান্নার রহস্য এখনো সবার অজানা, শুধু দু’ একজন জানতো আসল কারনটা। পূর্ণতা লম্বা হয়ে বিছানায় শুয়ে কপালের উপর কবজি উঠিয়ে উল্টে রেখেছে। হঠাৎ ফোনের টুংটাং রিংটোনটা বেজে উঠলে কপাল থেকে কবজি সরিয়ে বামে তাকায় পূর্ণতা। ফোনের সাদা আলো জ্বলজ্বল করছে। হাত বারিয়ে থাবার মধ্যে ফোন মুঠো করে আনলে চোখের পাতা ঝাপটা মেরে পরিস্কার করে তাকায়। Comrade is calling… লাফ দিয়ে উঠে বসে শক্ত হয়ে যায় পূর্ণতা! চোখদুটো হাতের উল্টোপিঠে তাড়াতাড়ি মুছে রিসিভ করে কানে লাগায়, বুকটা কি ধুকপুক করছে! হৃদ যন্ত্রটা এই বুঝি ফেটে গিয়ে বীভৎস কারবার করে ফেলবে!
– হ্যালো, পেছনের দরজা খুলে একটু বাইরে আসো না, একটু আসো প্লিজ..
পূর্ণতা উত্তর দেওয়ার মতো সময় নষ্ট করতে চায় না! ধুপধাপ খাট থেকে পা ফেলে ফোন বিছানায় রেখে দরজার ডাসা খুলে দেয়। এই পেছনের দরজা দিয়েই পূর্ব গতবার দেখা করে গিয়েছিলো! আজ পূর্ণতা ন্যানো সেকেন্ড পযর্ন্ত দেরি করতে চাচ্ছেনা! বাইরে বাতাসের সাথে হালকা বৃষ্টি বইছে! যেকোনো মূহুর্তে আকাশ চিড়ে বৃষ্টির ফোয়ারা নামবে।পূর্ণতা কোনোমতে হারিকেনটা নেওয়ার মতো বিবেকে ছিলো নাহলে বাইরে যেই অন্ধকার! কেউ একহাত দূরে দাড়ালেও কিচ্ছু বোঝা যাবেনা। পূর্ণতা হারিকেনের পলতে বাড়াতে বাড়াতে ডানেবামে চোখ ঘুরাতেই হঠাৎ স্থির হয়ে গেলো! শরীরের সবকটি পশম কাটার মতো মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো! পূর্ণতার গলা শুকিয়ে যেন রৌদ্রতপ্তের কাঠ হয়ে গেল। কালো গাড়ির দরজা খুলে পূর্ব ঠেস দিয়ে দাড়িয়ে আছে। চোখের চাহনি ক্লান্তিকর, উদভ্রান্ত, দূর্বল! শরীর এমন হয়েছে যেকোনো মূহুর্তে ধুপ করে মাটিতে নেতিয়ে পরবে। গাড়ির জানালাসহ সব কাচঁ ভাঙা। বাতাসে পূর্বের চুল এলোমেলো হয়ে উড়ছে। পূর্ণতা হারিকেন হাতেই দৌড়ে গিয়ে পূর্বের সামনে দাড়ালো। পূর্বের গালে হাত রাখতেই ঠোঁটে ভেঙে কেদেঁ দিলো। কি হাল হয়েছে পূর্বের! এই কি সেই পূর্ব? যার খানখান করা পুড়ে যাওয়া বুকটায় একটু উষ্ণ ছোঁয়া বসিয়েছিলো? পূর্ব হাতের উপর ভর করে এতোক্ষন দাড়িয়ে ছিলো হঠাৎ পূর্ণতার কাধে থুতনি রেখে নিজের শরীর ছেড়ে দিলো। অসম্ভব ক্লান্তিজনক দূর্বল গলায় আস্তে আস্তে বলে উঠলো,
– আমার মাথা ঘুরাচ্ছে পূর্ণ…খারাপ লাগছে..
ফিসফিস কন্ঠে বলতেই বলতে পূর্ব গা ছেড়ে দিতে শুরু করলো। পূর্ণতা একহাতে হারিকেন আকড়ে পূর্বকে আগলে ধরে ভেতরে নিয়ে বিছানায় শোয়ায়। দরজা ভালো মতো আটকে দিয়ে হারিকেন জায়গা মতো রাখে। এই মূহুর্তে মা না আসলেই চলে ! পূর্বকে এই অবস্থায় দেখলে বাড়ি মাতিয়ে তুলবে! মেইন দরজা তথা সামনের দরজায় ছিটকিনি আটকে দিয়ে পূর্বের কাছে গিয়ে বসে পূর্ণতা। পূর্বের সাদা পান্জাবী আর সাদা নেই ময়লায় ধূসরবর্ণে লেপ্টে গেছে। কিছু কিছু জায়গায় ছোপ ছোপ শুকনো রক্তের দাগ। হাতের নানা জায়গায় কাটা ছেড়া, চুলগুলো উশখুশ, চোখ মেলে তাকানোর জো পাচ্ছেনা পূর্ব। পূর্ণতা দ্রুত শ্রেয়াকে ফোন করে। একা একা বাড়ি ভর্তি মানুষের সামনে পূর্বের দেখভাল কিভাবে করবে?
– হ্যালো হ্যালো শ্রেয়া!! শ্রেয়া শোন, গোসলের মগ দিয়ে এক মগ পানি নিয়ে আয়। প্লিজ কোনো কারন জিজ্ঞেস করিস না! জলদি আয় প্লিজ! সাথে একটা কাপড় আনিস!
শ্রেয়া পূর্ণতার আচমকা আদেশের সূত্র মেলাতে পারেনা। পানি কেন লাগবে? শ্রেয়া কথামতো মগভর্তি পানি ও নরম কাপড় নিয়ে দরজায় টোকা দিলে পূর্ণতা চটপট সব হাতে নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে উঠে,
– পূর্ব এসেছে। তুই বারান্দার চৌকিতে বসে পাহারা দে!
– আচ্ছা। শ্রেয়া মনেমনে খুশি হয়ে আজ্ঞা পালনে ব্যস্ত হয়।
পূর্ণতা দরজা লাগিয়ে বিছানার উপর মগ রেখে কাপড় ভিজিয়ে বাড়তি পানি চিপড়ে পূর্বের মুখ মুছে দেয়। পান্জাবী খুলে ভেজা কাপড় দিয়ে গা মুছে দিয়ে পূর্বের কাটা জায়গায় মলম লাগিয়ে দেয়। পূর্ব অবচেতন হয়ে শুয়ে আছে, কোনো হেলদোল নেই ওর। কোনাবাড়ি যাওয়ার পর সেই সুনশান এলাকায় কি হয়েছিলো এখনো ধূপের বেরাজালে রহস্য! পূর্ণতা ময়লা পান্জাবী ঘরের এককোণে থাকা আলনার উপর মেলে দিয়ে ফিরে এসে পূর্বের জুতা খুলে দেয়। টিনের উপর বৃষ্টির ঝনঝন শব্দ শুরু হয়েছে।বৃষ্টির দাপুটে খেলা কেবল শুরু! কখন এই বৃষ্টির মুষড়ে পরা থামে কে জানে? প্রকৃতি এখন ঠান্ডার চাদরে গা ঢেকে নিয়েছে। পূর্ব এখন ঘুমাচ্ছে। হারিকেনের আলোয় কেমন সুন্দর, মনোরম, অন্যরকম লাগছে পরিবেশটা! টিনের চালে ঝমঝম বৃষ্টির শব্দ, মাটির মিষ্টি সোঁদা গন্ধ, পাতার ফাকে ফাকে বেড়ে উঠা নব্য ফুলের সুভাস, হারিকেনের মৃদ্যূ আলো, বদ্ধ রুমে গ্রামের সতেজতায় নিজের মধ্যে অদ্ভুত শান্তি অনুভব হচ্ছে। এই শান্তি শহুরে জীবনে উপভোগ করা যায়না। পূর্ণতা পরম শ্রান্তিতে পূর্বের কপালে ঠোঁট বসায়। ঠোঁট বসাতেই কেদেঁ দেয় আবার। দুহাতে পূর্বের মাথা আকড়ে বালিশ থেকে মাথা উচু তুলে চোখদুটিতে চুমু খায়। চোখের কোণা থেকে জল গড়িয়ে পূর্বের কানের পাশ ঘেঁষে গড়ায়। পূর্ব হালকা করে চোখ খুলে তাকায় পূর্ণতার দিকে বিড়বিড় করে বলে,
– প্রচুর কষ্ট দিয়েছি, কেঁদো না…আমার খারাপ লাগছে,
পূর্ণতা ফোপাতে যেয়েও ঠোঁট কামড়ায়। কান্নার শব্দ হুট করে ঘরের বাইরে চলে গেলে কেলেঙ্কারি হতে পারে। পূর্ণতা হেচকি তুলতে তুলতে নিচের ঠোট কামড়ে চোখ কুচকায়। পূর্বের শরীর এখনো প্রচণ্ড ব্যথায় টনটন করছে। তার চেয়ে বেশি ব্যথা হচ্ছে বুকে। চোখের পানিগুলো বুকের ভেতর তীরের মতো ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে। পূর্ব ঠোট শক্ত করে ধীরগামীতে হাত উঠিয়ে পূর্ণতার কানের পাশে রাখে। পূর্ণতা কান্নারত কুচকানো চোখ খুলে তাকালে পূর্ব ছোট্ট নিশ্বাস ছেড়ে ঢোক গিলে বলে উঠে,
– কান্না করো না পূর্ণ, একটু থামো।
পূর্ণতা কান্না অবস্থায় ধীরাজ ভাবে মাথা ডানে বামে নাড়ায়। সারর্মম এই, আমি কান্না থামাতে পারছিনা পূর্ব। ফুস করে চোখ বন্ধ করে নিশ্বাস ছাড়ে পূর্ব। শরীরের প্রতিটি পার্ট বিষের মতো যন্ত্রণা করছে। কোনোভাবেই এই যন্ত্রনার আখ্যা পূর্ণতাকে বুঝতে দেয়া যাবেনা। পূর্ণতা বিছানায় উঠে মাথার কাছে খাটের সাথে হেলান দিয়ে পূর্বের মাথা কোলে তুলে নেয়। চুলের ভেতর আঙুল ডুবিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই পূর্ব বদ্ধ চোখে ধীর কন্ঠে বলে উঠে,
– এখনো কাদঁছো? চুপ কর পূর্ণ। আমি তো ঠিক আছি। প্লিজ কেদোঁ না…একটু শোনো আমার কথা।
পূর্ণতা নাক টেনে কামিজের হাতায় চোখ ডলে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে। পূর্বের মুখের উপর ঝুঁকে কপালে চুমু দিতেই পূর্ব ঠান্ডাহত গলায় বলে উঠে,
– কষ্ট পাচ্ছো খুব?
পূর্ণতা মাথা তুলে আরেক দফায় কামিজের হাতায় চোখ ঘষে। কান্নার হিরিকে এখনো হেচকির তালে তালে কাপছে পূর্ণতা। পূর্বের মাথায় নরম স্পর্শে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। টিনের ফুটোয় চোখ বসিয়ে ডানের লাকড়ি ঘর থেকে দেখছে আনিশা। পূর্ণতা যখন শ্রেয়ার হাত থেকে সন্দেহজনক ভঙ্গিতে মগ নিচ্ছিলো দূর থেকে আনিশা সেটা দেখতে পেয়েছিলো। যার দরুন এখন সে লাকড়ি ঘরের ফুটো দিয়ে পূর্ব-পূর্ণতার অবস্থা দেখছে। আনিশার হাত অজান্তেই আঁচলের সাথে মুচলেকা করছে। দাতেঁ দাতঁ চিবিয়ে চোখ দিয়ে পানি পরছে। ফুটো দিয়ে আরো দেখে,
– চোখ দুটোকে ফুলিয়ে কি করেছো পূর্ণ? শ্বাশুড়ি আম্মাজান তোমায় বকেনি?
পূর্ণতা এ প্রশ্নের জবাবে কিছুই বলেনি। পূর্বের সাথে এ যাবৎ একটা কথাও উচ্চারণ করছেনা। পূর্ব বুঝতে পারে, সহ্য ক্ষমতার বেশি কষ্ট পেলে মানুষ মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলে। বাকরুগ্ধ হয়ে চরমসীমায় দুঃখভোগ করতে থাকে। পূর্ণতার কথা না শুনলে শান্তি পাবে না পূর্ব। এই মেয়ে চুপ থাকলে আরো ভয়ানক কান্ড ঘটতে পারে। দেখা যাবে বিয়ের পরও কথা বলছেনা। পূর্ব কিছুটা নির্লিপ্ত গলায় বলে উঠে,
– আমি যদি জীবিত না এসে লাশ হয়ে ফিরতাম কেমন লাগতো? শুধু শুধু কাদছো কেন? আমি আগেই বলেছি আমার সাথে থাকা মানেই কষ্টভোগ করা। তুমি কথা শোনোনি। এখন কেনো কাঁদছো? বলো? জবাব দাও পূর্ণতা?
পূর্ণতা কয়েক মিনিট স্তব্ধ হয়ে পিটপিট করে তাকিয়ে থাকে পূর্বের দিকে। মাথার উপর ভিমরুল বুঝি ভো ভো করে উড়ছে। হঠাৎ পূর্বের উপর নিচু হয়ে ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দেয় পূর্ণতা। পূর্ব অবাক! ভেবেছিলো এমন অলুক্ষনে কথার জন্য থাপ্পর খাবে উল্টো পূর্ণতা আদর করছে! টিনের ফুটো থেকে চোখ সরিয়ে আচঁলে চোখ ঢাকে আনিশা। কোথায় পূর্ণতার জায়গায় নিজে থাকতো অথচ নিষ্ঠুর ভাগ্যের পরিহাসে আচঁলে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে হচ্ছে আজ। আনিশা পা চালিয়ে লাকড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে যায়, চলে যায় নিজের রুমে। দিহান খাটে শুয়ে চুপচাপ বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছে। আনিশা দরজায় পিঠ দিয়ে পেছনে থাকা হাত দিয়ে দরজা লাগিয়ে দেয়। দিহান বই থেকে মুখ তুলে সচকিত চোখে আনিশার দিকে তাকিয়ে বলে,
– কি ব্যাপার? কোথায় ছিলে? দরজায় দাড়িয়ে আছো কেন? আসো…বসো।
আনিশা গুটিগুটি পায়ে দিহানের পাশে খাটে উঠে বসে। দিহান খুব মনোযোগ দিয়ে বইয়ের প্রতিটি পৃষ্ঠা উল্টাচ্ছে। আনিশা দিহানের বুকে হাত রেখে বলে,
– এই শুনো না?
দিহান বইয়ে চোখ রেখে বলে,
– বলো শুনছি।
– একটু কোলে মাথা রেখে শুবে? আমি তোমার চুলে হাত বুলিয়ে দিবো?
দিহানের কানে যেতেই ধপ করে বই বন্ধ করে আনিশার কোলে মাথা রাখে। দিহান প্রচণ্ড খুশি হয়। আনিশা যেই দিহানের মাথায় হাত বুলাবে ওমনেই ধাক্কা দিয়ে দিহানকে কোল থেকে সরিয়ে খাট থেকে নেমে যায় আনিশা। আনিশার এহেন কান্ডি দিহান আশ্চর্য হয়ে গেছে! আনিশার উদ্ভট উদ্ভট আচরনগুলো খুব ঘায়েল করে দিহানকে। কেন এই অমানুষিক অত্যাচার? দিহান বুঝতে পারেনা।
– আনিশা? তুমি এমন করলে কেন? ঘাড়ে ব্যাথা পেয়েছি তো। কি হয়েছে তোমার?
আনিশা সেখান থেকে সরে এসে জানালা খুলে বৃষ্টির ছাটে গা হেলায়। দিহানের প্রশ্নে মাথা ঘাটাতে ইচ্ছে করছে না ওর! দিহান কখনো ওর পূর্ব হতে পারবেনা। চাইলেও না!
গত কয়েকদিনের সমস্ত রাগ, জিদ, ক্ষোভ একত্র করে ঢেলে দিচ্ছে পূর্বের ঠোঁটের উপর। বেশ খানিকটা সময় পেরুলে পূর্বকে ছেড়ে দেয় পূর্ণতা। জোরে জোরে নিশ্বাস ছাড়ছে দুজনেই। পূর্ব আহত গলায় তাচ্ছিল্য করে বললো,
– কি করলে তুমি পূর্ণ? ঠোঁট কেটে দিলে? আমার উপর এতো রাগ?
পূর্ণতা হারিকেনের আলোয় স্পষ্ট দেখতে পেলো পূর্বের ঠোঁটে রক্ত। পূর্ব হাত দিয়ে রক্ত মোছার চেষ্টা চালাচ্ছে। পূর্ণতা পূর্বকে কোল থেকে নামিয়ে হেটে হেটে লাগেজ খুলে তুলোর প্যাকেট থেকে তুলো ছিড়ে আনে। পূর্বের হাত সরিয়ে কাটা ঠোঁটে তুলো চেপে ধরতেই মৃদ্যু গলায় বলে উঠে,
– যেখানে তুমি আমার রোগ বানিয়ে দিয়েছো সেখানে রাগ থাকলে সমস্যা কি?
পূর্ব অবাক হতেই হঠাৎ ফিক করে হেসে দিয়ে বলে উঠে,
– কি বললে?
– ‘চলবে’
# FABIYAH_MOMO
সম্পূর্ণ গল্পের লিংক