#ফাবিয়াহ্_মমো
– ব্লাডিফুল! তোর মরার এতো ইচ্ছা! আয় তোকে মেরে ফেলি! আয়…তোকে আজ খুন করবো! কুটিকুটি করে তোর মাংস নদীতে ফেলবো আমি! তুই অপেক্ষা কর..
পূর্ব আমাকে এমন এক চড় মেরেছেন আমি দিন দুনিয়া উল্টে কোথায় যে আছি ভুলে গিয়েছি! এরই মধ্যে চটাং করে সে আমার দু’হাত চেপে কটমট করে বললেন,
-ট্রেনের দরজায় দাড়িয়ে তোর হের-ফের করার শখ দেখ কিভাবে মিটাই!
আমি হেলছি শুধু! কানের অবস্থা খুবই বাজে! বাজে মানে মারাত্মক রকমের বাজে! দাউদাউ করে জ্বলছে কঠিন থাপ্পড় খেয়ে! হঠাৎ পূর্ব ভাই এক ধাক্কা মারলো দরজার বাইরে! ষষ্ঠইন্দ্রীয় জানান দিচ্ছে পূর্ণতা তুই শেষ! তুই ফিনিশ! বিদায় পিতিবি! মনে হচ্ছে আমি এখনো মরিনি। কোথাও যেনো হাতটা আটকে আছে! খিচুনি দেওয়া এক চোখ খুলে দেখি পূর্ব আমার হাত ধরে অগ্নিদৃষ্টিতে দাঁত কটমট করছেন! মাগো, কি ভয়ংকর দৃষ্টি! আপু এই লোকটাকে হজম করতো কি করে? আমাকে তো দু’দিনের মধ্যেই লেবুর মতো চিপড়ে ফেলেছে! পূর্ব ভাই চোখ রাঙিয়ে বাঁ ভ্রুয়ের প্রান্তটা কপালে উঠিয়ে বললেন,
– কিরে বেয়াদ্দব মরবি? হাত ছাড়বো? যা কালিমা পড়!
আমি না বুঝেই ছাগলের তিন নাম্বার বাচ্চার মতো ধুপধাপ কালিমা জপা শুরু করেছি,
-…লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু…
– বাব্বাহ্ তোর মরার শখ তো ভালোই জন্মেছে দেখছি! দাড়া! ছাড়ছি হাত..
– ও ভাই! ভাই! ভাই!! আমার ভালো ভাই! আমার হবু বর কষ্টের ঠেলায় দোষ করবে ভাই! ওইযে ড্রিমদোষ করবে! হাত ছাড়বেন না প্লিজজ!
– কি দোষ? মানে?, পূর্ব ভাই অবাক!
– ছেলে হয়েও বুঝেন না ক্যা? এইসব ব্যাখ্যা দিতে লজ্জা করে তো! ড্রিমের বাংলা পড়ুন!
উনি অবুকের কিছুক্ষণ ভেবে চোখ কপালে তুলে বললেন,
– আসতাগফিরুল্লাহ্! ইয়াক! তুমি মেয়ে হয়ে এগুলো বলতে…
– শুনেন ভাই! আমার লজ্জা করেনা আবার প্রচুর করে! প্লিজ হাত ছাড়লে আমি টাটা বাই বাই হয়ে যাবো!! এখনো বিয়ে করিনি। চুটিয়ে প্রেম করা বাকি!! বান্ধুবী নামক কুত্তীগুলার বাসররাত নষ্ট করা বাকি! ভাই প্লিজ! দোহাই ভাই!
– ফালতু ! বেয়াদ্দব ! আমি তোর কোন জনমের ভাই হই? তোর কোন বোন আমায় বিয়ে করেছে! হ্যাঁ ! তোর মায়ের পেটের ভাই আমি? ফালতু কোথাকার! তোর মতো পাতানো বোনের দরকার নেই আমার! গো টু হ্যাল! গেট লস্ট!
– সরি তো!! ইয়া খোদা রে…আর বলবো না তো প্লিজ!! প্লিজ প্লিজ!! আমাকে ভেতরে আসতে দিন। প্রমিস!! আমি আপনার হাত ছুঁয়ে বলছি!! দেখুন!! আপনার সব কথা শুনবো! এই দেখেন পায়ে পা রেখে বলছি!!
– পায়ে পা রাখছিস মানে!
– এটা আপনি বুঝবেন না! আমাকে একটু উদ্ধার করুন! ভেতরে আসতে দিন!!
পূর্ব ভাই টান মেরে আমাকে ভেতরে এনে উনি চলে গেলেন কেবিনের দিকে। আমি কুমিরের থাবা থেকে বাচঁতে পেরে হাপাচ্ছি খালি! আল্লাহ্!! কি ভয়! ট্রেনের লোকজন গুলো কিভাবে যে তাকিয়ে আছে গা ঘিনঘিন করছে! সব ওই পূর্ব রাগীটার জন্য হয়েছে! কি দরকার ছিলো এখানে সিনক্রিয়েট করার? আস্তো একটা ঝামেলা!
পূর্ব মহোদয় সিটে আরাম করে বসে ফোনের ওপাশে জরুরী একটা ভিডিও কনফারেন্স এটেন্ড করছে। আড়চোখে দেখলাম ভিডিও কলে অনেকগুলো চশমা আঁটা প্রবীণ টাইপ লোক। খুবই গম্ভীর ভঙ্গিতে উনি একেকটা কথার জবাব দিচ্ছেন।
– পূর্ব তুমি আগে থেকেই জানো দেশের হাল কেমন দূর্দশায় লিপ্ত হয়েছে এমতাবস্থায় কাউকে বিশ্বাস করাও ঘোর পাপ! তোমার কি মত এতে? চ্যাটার্জী মশাই যা বলছেন তা নিয়ে তোমার পক্ষে যুক্তি আছে?
পূর্ব ভাই খানিকটা সময় চুপ থেকে কিছু একটা ভেবে অত্যন্ত শান্ত ভঙ্গিতে বললেন,
– চ্যাটার্জী জনাবের সাথে আমি দ্বিমত পোষন করি স্যার। উনি উনার দলের ছেলেগুলোকে কায়দা শিখাতে না পারলে ব্যর্থতা উনার। আমাদের না! আমি এখানে বলতে ইচ্ছুক অবশ্যই উনি এ কাজের জন্য মোটেই তৈরী নন এবং মতের বিরুদ্ধে যাওয়াই উনার অপরাধ! এতে আমাদের খসড়া বিধান অনুযায়ী উনাকে বহিস্কার করার বিষয়ে অনুমোদন দেওয়া হোক। দ্যাটস ইট!
– অন্ধকার যতোই ভয়ানক হোক না কেনো একসময় সেটা চোখ সইয়ে নেয় কিন্তু তোমাকে সয়ে নেওয়া দুষ্কর! আবার ভাবো! সময় নাও! তারপর সিদ্ধান্ত জানাও!
পূর্ব ভাই একটুও না থেমে মুখের উপর বললেন,
– আমি নিজের সিদ্ধান্তে ওপর দ্বিতীয় তৃতীয় ভাবি না স্যার! একবার যে বাক্য মুখ থেকে ছুড়ি তাতেই আমি শেষ পযর্ন্ত অটল থাকি। আই হোপ, আপনি সেটা খুব ক্লিয়ার ওয়ার্ডে জানেন।
– তুমি কিন্তু তাড়াহুড়ো করছো পূর্ব। আমাদের এসব কাজ বেশ বুঝেশুনে করা প্রয়োজন। হুট করে একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া খুবই হানিকর হতে পারে পূর্ব। চ্যাটার্জী মশাই খুবই পাওয়ারফুল লোক! মিডিয়া উনার মুঠোতে! বুঝতে পারছো তো কি বলছি?
– সুযোগে কোপ করা নৈতিক দায়িত্ব স্যার! মিডিয়ার ভয় আমার কোনোকালেই ছিলো না! না এখনো আছে! পূর্ব কখনো বেটার অপর্চুনিটিকে ‘গুড বায়’ জানায় না। আমি গ্রাম থেকে ফিরে এসে কাজে যোগ দিচ্ছি। তখন আমি ডিসকাস করে একটা নমুনা আপনাদের কাছে লিখে পাঠাবো। কারা কারা নতুন মুখ হিসেবে দলে প্রবেশ করবে আমি সেখানে উল্লেখ করে জানাবো। সহ্য, ধৈর্য্য, অপেক্ষা — তিনটা জিনিস আপাতত করুন স্যার। আল্লাহ্ হাফেজ।
কল কেটে দিয়ে উনি একেবারে সুইচ অফ করে ফেললেন। উনার কথাবার্তায় মনে হচ্ছে উনি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একজন লোক! উনাকে ছাড়া কোনো একটা জরুরী সিদ্ধান্ত নেওয়া যেনো আটকে আছে! আমাকে কৌতুহল চাহনিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে উনি পকেটে ফোন পুড়ে চিপসের প্যাকেটে হাত দিলেন। দাঁত দিয়ে ছিড়তেই আমার উদ্দেশ্যে বললেন,
-আমার কথাগুলো শুনেছো রাইট? খুবই জঘণ্য একটা কাজ করেছো! শাস্তিটা তোলা থাক!
– আপনি কে? কি করেন আপনি?
– প্রশ্ন করার অধিকার তোমার নেই।
– আমার গালেও থাপ্পর মারার অধিকার আপনাকে আমি দেইনি! তবুও আপনি হাত চালিয়েছেন!
– শোধবোধ করতে চাও নাকি! আরো দিবো চড়?
– প্লিজ..শুধু জানতে চেয়েছি আপনি কে! কি করেন! এতটুকু বলে ধণ্য করুন।
– আনিশা এ সম্পর্কে কিছু বলেনি?
-আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম আপু কখনো বলতে চায়নি। অদ্ভুত ভাবে ব্যাপারটা এড়িতে চলতো! কেন এমন করতো বলুন তো!!
– তোমার আপুর এ্যাজ কতো বলো তো!
– আপুর এ্যাজ? আমার থেকে দু/এক বছরের বড় হবে। মেবি টুয়েন্টি টু অর থ্রি।
– রিলেশন চলাকালীন আমার বয়স কতো ছিলো জানো?
– টুয়েন্টি ফাইভ?বাদ দিন! এখন তাহলে কতো?
– প্লাস ফোর!
– টুয়েন্টি ফোর?
– মাথাভরা গোবর! চিপস খাবে? ধরো প্যাকেট। সামনে জামালপুর স্টেশনে আমি নামবো। আর হ্যাঁ, আরেকটা বেহুদা কথা বললে গালের চামড়া সাথে থাকবেনা বলে দিলাম! মাইন্ড ইট স্ট্রিক্টলি!
বড় বড় অক্ষরে কালো কালির রঙে সাদা দুপায়া আয়তকার বোর্ডের উপর চলন্ত ট্রেন থেকে দৃশ্যমান হচ্ছে, ‘জামালপুর’ লিখাটা। বেশ উপচে পড়া ভীড় যে ট্রেনে ছিলো তা এই স্টেশনে থামতেই বোঝা গেলো। গাদাগাদি করে স্টেশনের দিকে ছুটছে যাত্রী। কি ব্যস্ততার ছাপ লেপ্টে আছে মুখে!! পূর্ব পাশে নেই সে গিয়েছে স্টেশনের ভেতরে। দুহাতে জানালাটা উপরে ঠেলে খুলে দিলাম। এসি অফ! বাইরে বেশ কড়া রোদ পড়েছে আজ। সূর্যের একফালি তেজবর্ণ জানালা দিয়ে আমার কোলের উপর বাঁকা হয়ে পড়লো। আলোটার দিকে তাকিয়ে আমি অনেক কিছুই ভাবছি। প্রথমত খটকা লেগেছে আপুর কথাবার্তায়।
আপু সর্বদা পূর্ব ভাইয়ের জন্য হাউমাউ করে কাদঁতো। ইভেন বিয়ের তিন আগেও আপু পূর্ব ভাইয়াকে নিয়ে অনেক ভালোবাসার এলান করে চিল্লাচিল্লি করেছে। মামা হাত উঠিয়ে দিয়েছিলো থাপ্পর! সবটা ঘটনা আমি ফোনে জানতে পারি। যাইহোক, আপু আমার সাথে এনাফ ফ্রি! কিন্তু একটা প্রশ্নের জবাব উনি কখনো দেননি! সেটা হলো, উনার পূর্ব পেশায় কি করেন, সে কি এখনো পড়াশোনা করে অথবা সে কি চাকরিজীবি? একটার উত্তরও আমি পরিস্কার পাইনি।
হঠাৎ হলুদ বর্ণটা ধীরেধীরে সরু হতে হতে একেবারে মিইয়ে যেতে গেলো…তখন বুঝলাম ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে! জানালা দিয়ে হনহন গতিতে তেজালো হাওয়া ঢুকছে। পাশে একপলক চোখ ঘুরিয়ে দেখলাম পূর্ব ভাইয়ার হাতে বই। কভারে লিখা, ‘Some Untold Story’. আজব তো! উনি বই কোথা থেকে পেলো? হাত তো একদম খালি ছিলো। আমি উশখুশ মনে কথা গুছিয়ে খানিকটা চুপ থেকে বলে উঠলাম,
– আপনি কি কাজ করেন একটু বলবেন? বই কোথায় পেলেন? আমার খুব অকয়ার্ড লাগছে এ ব্যাপারটা নিয়ে। একটু যদি বলতেন, উপকার হতো।
বই থেকে চোখ না ফিরিয়ে সে একপাতা উল্টে তাতে আরো মনোযোগ দিয়ে বলে উঠলো,
– আমি অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করি।
– কিহ্? কি বললেন! আমি বুঝিনি!!
উনি বইটায় এক আঙ্গুল ঢুকিয়ে সেটা বন্ধ করে তাকালেন আমার দিকে। আমার বুক অজান্তেই ধুকপুক করে দামাল অবস্থা সৃষ্টি করছে। উনার চোখদুটো যে কি! উফ..খেয়ে ফেলা যাবে?
– তোমার প্রথম প্রশ্নের জবাব! সাপোস কেউ তোমার কোমরটা জড়িয়ে কাছে এসে কিস করতে যাচ্ছে! তুমি তার কাছে টোটালি কবজা! তুমি না পারছো সহ্য করতে! না পারছো পালিয়ে যেতে! ওই অবস্থায় তুমি অবশ্যই অন্যের কাছে সাহায্যের এক্সপেক্ট করো..ঠিক? আর ধরো, মানুষটা তোমাকে তার থেকে বাঁচিয়ে ওই বদমাইশটার গালে দুটা ঘন্টা বাজিয়ে দিল, সেটা ঠিক না বেঠিক?
– ঠিক। একদম ঠিক!
– দ্যাটস দ্যা আন্সার। সেকেন্ড পার্সনটা আমি। আমি মূলত এটাই করি! এটা করে সুখ পাই! দ্যাটস অল! আর বই আমার পড়াশোনার একটা বৃহৎ অংশ! স্টেশনের ভেতরে একটা ছোটখাটো লাইব্রেরি দেখেছি ওখান থেকেই কিনে এনেছি। সব জবাব পেয়েছো? আমাকে শান্তি দাও! চুপ!
পুরোটা সফরে ভারী যন্ত্রণার মধ্যে কাটলো পূর্ণতার! মাথায় একবার যদি কোনো ঘাপলা ঢুকে যায় সেটা গোয়েন্দার মতো লাইন বাই লাইন না বুঝা পযর্ন্ত শান্তি পায়না। এখন এই পূর্বকে নিয়ে ওর খুব রহস্য লাগছে! পূর্বকে একটু একটু করে জানার মাধ্যমে অদ্ভুত একটা অনুভূতি কাজ করছে! আরো জানতে ইচ্ছে করছে পূর্বর ব্যাপারে। পূর্ব খুব চমৎকার করে কথা বলে! কন্ঠে যেনো মার্ধুয্য মেশানো! পূর্বর মধ্যে চার্মিং যেই জিনিসটা ছিলো সেটার জন্য প্রায় সকল মেয়েই পূর্বর সাথে সখ্যতা করতে চাইতো। কিন্তু পূর্ব ছিলো একগুঁয়ে। মেয়েদের সৌহার্দ্য তো দূর ! একটা মিষ্টি করে হাসি কেউ দিলেই ওর গায়ের ভেতর রক্ত টগবগ করতো! কেবল আনিশাই ছিলো এমন যার সাথে পূর্ব কথা ছেঁকে বহু প্রশ্নের ঘূণাক্ষরে একটু আধটু মুখ খুলতো। তখন ওদের আটমাস চলছিলো সম্পর্কের। আনিশা পুরো ক্যাপাস ভেজে পূর্বর খোজ করতে করতে ডিবেট ক্লাবে দেখা পেলো। কি যে রাগ হয়েছিলো পূর্বর ওপর!
– তুমি এখানে! লজ্জা করেনা তোমার! আমি কি একটা মানুষ না পূর্ব? আমাকে নূন্যতম কেয়ারটা তুমি করতে পারো না! আর কতো ছলচাতুরি করে ইগনোর করবে?
পূর্ব বইয়ের পাতা উল্টে মুখ স্বাভাবিক রেখে চুপ করে থাকলো। পূর্বর চুপটি বিষিয়ে তুলছে আনিশাকে! সে ছো মেরে বইটাকে দূরে ফেলে পূর্বর কলার টেনে ধরলো! পূর্ব ওর এহেন কান্ডে উপস্থিত সকলের সামনে ঠাস করে চড় বসিয়ে কটু কথা শুনিয়ে চলে যায়। কথাগুলো ছিলো এমন,
– তোর মতো নষ্টালজিক মেয়ে আমার ফ্রেন্ড হওয়ার যোগ্যতাই রাখেনা! ওই সেন্সে তোর তো এটা সৌভাগ্য! তুই আমার গার্লফ্রেন্ড হয়েছিস বাট তুই মেবি ভুলে গেছিস আমি বাবুই পাখি ডাকার মতো বয়ফ্রেন্ড না! রাস্তা মাপ অন্যদিকে! তোর সাথে আমার চলবেনা! কল দিবিনা আমাকে! আই সয়ার তোর গলায় পাচঁ পাক দড়ি পেচিয়ে মেরে ফেলবো!! বইটা সালাম করে শেল্ফে রাখবি! যদি নড়চড় দেখি ক্লাবের সবগুলা স্টুডেন্ট সাক্ষী থাকবে তোর মৃত্যুর জন্য আমি দায়ী! যা ভাগ!
এগুলো নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার ছিলো পূর্ব ও আনিশার মধ্যে। আনিশা জানতো পূর্বকে পাওয়ার জন্য ওর শতশত অহেতুক রাগ, কটুকথা , জেদ সামলে চলতে হবে এবং সেই সাথে খেয়াল রাখতে হবে পূর্বের ভেতরে লুকিয়ে থাকা পবিত্র মনটাকেও! পূর্বর একটা অদ্ভুত রূপ ছিলো সেটা আনিশার চোখে বেশ ক’বার ধরা পড়েছিলো কিন্তু আনিশা সেটা খুব একটা গায়ে মাখতো না। খোলসে আবরিত উৎফুল্ল মনটা কেনো আনিশার জন্য আকুপাকু করেনা? খুব কষ্ট হতো আনিশার তখন!
– পূর্ব ভাই? আপনি এতো রাগী কেনো? আপনার ফ্যামিলির সবাই কি রাগী?
পূর্ণতার শান্ত প্রশ্ন। পূর্ব বইয়ের ইন্ট্রেসটিং পয়েন্টে চোখ বুলিয়ে কিছুটা সময় বাদে বলে উঠলো,
– ডোন্ট জাজ এ্যা বুক বায় ইটস কভার!
পূর্ণতা এই নিয়ে এগার বার প্রশ্ন করলো। প্রতিবার উত্তর না পেলেও নবম এবং এগারোতম প্রশ্নে একটু উত্তর পেলো যেটা স্বস্তিসূচক ছিলো না। আরো কৌতুহল বাড়িয়ে দিলো মনে। চোখ আটকালো পূর্বর হাতের দিকে! রক্ত জমে নীল হয়ে আছে। দেয়ালে ঘুষি মেরেছিলো সেটার ফল?
– ও আল্লাহ্! আপনার হাত! দেখি দেখি!! আল্লাহ্ ! কি সাংঘাতিক নীল হয়েছে!!
পূর্বর হাত টেনে পূর্ণতা ফু দিয়ে নিজের কোলে উপর রেখে টিস্যু ভিজিয়ে চেপে ধরলো। রক্ত শুকিয়ে বাদামী রঙে জমাট বেধে আছে। পূর্ব পূর্ণতার হুটহাট কাজে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখছে। আনিশা ওর হাতটা পযর্ন্ত ধরার সাহস পেতো না!! অনুমতি ছাড়া তো ধরতোই না! বরং পূর্বর সামনে আঘাত-জখম-কাটাছেড়া নিয়ে কেয়ার দেখালে পূর্ব রেগে বারুদ হয়ে যেতো!দিতো থাপ্পর! এখন রাগ লাগছে না। ভালো লাগছে। মনেমনে বললো, আনিশার বোন কি সত্যি এমন? আনিশা কক্ষনো আমাকে টাচ করার অনুমতি পায়নি! নাহ্ সে কখনো টাচ করতে চেয়েছে, কেয়ার দেখাতে আসলে আরো কানের পিনায় হুল্কাবাজি খেয়েছে। পূর্ণ কেনো এমন? পুরোই মুদ্রার উল্টাপাশ! পূর্ব ওর দিকে তাকিয়ে আছে দেখে পূর্ণ একপলক সেটা দেখে হাতে ফু দিতে লাগলো। এবং বললো,
– আপনার অনুমতিপত্রের জন্য ওয়েট করিনি বলে সরি, আসলে হাতটা খুবই নীল তো। আমার তাই খারাপ লাগছিলো…
পূর্ব অপলক দৃষ্টিতে স্থির হয়ে তাকিয়ে আছে। পূর্ণতার গালে থাপ্পড়ের দাগগুলো না থাকলে কেমন লাগতো? যদিও আনিশা ওর চেয়ে বেশি সুন্দর। আনিশার পার্সোনালিটি খুবই ক্লাসি। কিন্তু পূর্ণ খানিকটা ওল্ড ফ্যাশনের। মাথার চুলগুলো সাইনিং স্ট্রেট না, কিছুটা ওয়েভি চুল। কোনো লিপলাইনার ছাড়াই সরু ঠোঁটগুলো আর্ট করা। লিপস্টিক ছাড়াই প্রাকৃতিকভাবে ঠোঁটজোড়া গাঢ় গোলাপী। ভ্রুঁদুটো চিকন এবং স্কান্চকাট শেপের। গালে টোল পড়ে কিনা খেয়াল নেই। কিন্তু হাসি ছাড়া এই মুখ কোনোভাবেই মানায় না। একটা হাসি মাস্ট জরুরী!
দেওয়ানগন্জ স্টেশন! ট্রেন এসে প্ল্যাটফর্মে থামতেই ট্রেনের ভেতর পুরোটা খালি হয়ে গেল! পূর্ব ভাই আমাকে ট্রেন থেকে নামিয়ে একহাতে আমার বাহু ধরে অপরহাতে আমার হাত চেপে অটোরিকশার কাছে নিয়ে যাচ্ছেন। আশপাশের লোকজন হা করে সেই দৃশ্য দেখছে! পূর্ব ভাই একটা অটোরিকশা রিজার্ভ করতেই উঠে পড়লাম। আমার বিপরীত সিটে মুখোমুখি হয়ে বসলেন পূর্ব ভাই। ফোনের স্ক্রিনে বুড়ো আঙ্গুল চালিয়ে অপরহাতে কোকের ক্যানে থেমে থেমে চুমুক দিচ্ছেন উনি। কি লোভনীয় দৃশ্য! তার উপর ফর্সা উজ্জ্বল কপালের কাছে চুলগুলো বাতাসের ঝাপটায় উড়ুক্কু করছে। উফ! অটোরিকশা টান দিলেই চুলগুলা আছড়ে কপালের তীরে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। একটা পর্বত সমান হাইটের ছেলে সরি ভুল বললাম। পর্বত সমান উচ্চতা উনার হয়নি তবে বেশ উঁচা লম্বা উনি। আমি পাশে দাড়ালে মাথাসহ হাইট উনার কাধ হয়তো ছুইছুই করবে। আমার বিপরীতে বসে ক্যানের মুখে মোহনীয় ঠোঁট বসিয়ে কোক পানীয় খাচ্ছেন এটা আমার দেখা উচিত না! কোনো মেয়েরই দেখা উচিৎ না!কিন্তু মস্তিষ্কের বিপরীতে আমি সেটা আড়চোখেই দেখছি। আনিশাপু পাক্কা একটা ভুল করেছে পূর্ব ভাইকে ছেড়ে! পূর্ব ভাইয়ের মতো ইয়াং নওয়াবকে ছেড়ে দেওয়াটা জীবনের মস্ত বড় ভুল! আমার মধ্যে আপুর মতো আর্কষিত কিছু থাকলে বাবাকে দিয়ে উনার বাড়িতে নিজের বিয়েরটাই পাঠাতাম বাট! ঘাপলা হলো এই! ওসব উটকো মার্কা চিন্তা করা বাদ দেওয়া উচিত! পূর্ব ভাই কখনোই আমার মতো মেয়েকে পছন্দ টছন্দ করবেনা। স্বপ্নেও না! কল্পেও না! বাস্তবে তো ভুলেও না!
বলে রাখি, আনিশা আপুর বাড়ি ‘খোলাবাড়ি’। পূর্ব ভাইয়ার দাদুবাড়ি ‘টাকিমারি’। পূর্ব ভাইয়াকে খুব ছোট থেকেই ফলো করতো আপু। ভাইয়া গ্রামের বাড়ি এলে আপু চুপিচুপি খালি উনাকে দেখতো। পূর্ব ভাইয়া সেটা মেবি দেখেও নি। যখন তারা বড় হলো তখন একই ভার্সিটিতে পড়ার সুযোগ পায়। কিন্তু আপু কি পূর্ব ভাইয়ার জন্যই মেডিক্যাল ছেড়ে ঢাবিতে ঢুকেছে কিনা সেটা আদৌ জানিনা। আপু প্রচুর মেধাবী ছাত্রী আবার মেডিক্যালের ১০২নম্বর পজিশনে সিলেক্ট হয়েছিলো।
অটোরিকশা চিকাজানি জামের মসজিদ অতিক্রম করতেই বুকটা আচানক চিনচিন করে উঠলো! আজ এতো তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌছে যাচ্ছি কেনো? সময় হুরহুর করে পালাচ্ছে? পূর্ব ভাই ফোনের মধ্যেই ডুবে আছে! ইশশ…একটা বার কথা বলার চান্স পেতাম! মেবি উনি পাত্তাই দিবেননা! হঠাৎ উনি চোখ ঘুরিয়ে বাইরের রাস্তা দেখতেই অটোওয়ালাকে গাড়ি থামাতে বলে আমার উদ্দেশ্যে বললেন,
– বের হও গাড়ি থেকে! বাড়ি সামনে! আউট!
উনি ধমক দিয়ে যেনো বললেন। আমি প্রথমদফায় কেঁপে উঠেছি। পা কাটা দেখে আমি কি আর সাহায্য পাবো না? উনার কাজিনই তো আমার এই দশা করেছে। ব্যান্ডেজের পা শেষে বের করে আমি কোনোরকমে দাড়ালাম ওমনেই অটোটা শো করে চলে গেল। পূর্ব ভাই নির্জীব একটা প্রাণী! সত্যিই একটা খারাপ মানুষ! আমি পা খুড়িয়ে বাড়িতে ঢুকতেই হৈচৈ করে মামী, মামা, খালামনি, খালুজান সবাই ঘিরে ধরলেন। নানা প্রশ্নের ভেতরেই মামী আমাকে বুকে জড়িয়ে হঠাৎ আমার হাত দেখতেই চক্ষু ভীষণ বড় করে বলে উঠলেন,
– পূর্ণতা মা! এ কি হাতের অবস্থা! কামড় কে দিয়েছে? মা তোর হাতে কামড়ের দাগ কিভাবে?
– চলবে
#FABIYAH_MOMO
সম্পূর্ণ গল্পের লিংক