#ফাবিয়াহ্_মমো
পূর্বের বেপরোয়া ভাব ও চটান চটান জবাব দেখে প্রচণ্ড ক্ষেপে উঠলেন খোদেজা। কিন্তু পূর্ণতার কড়া চাহনি দেখে কিছুই বলতে পারলেন না। এদিকে কবির গোসল শেষে ডাইনিং স্পেসে এসেই দেখেন পূর্বকে ঘিরে এই চান্ঞ্চল্যকর অবস্থা। তিনি কপাল কুঁচকে খোদেজার দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকালে পুরো ঘটনার সংক্ষিপ্ত ব্যাপার আচঁ করতে পারেন। পূর্বের জন্য কিছুই বলতে পারছেনা পূর্ণতা। মনে উশখুশজনিত সমস্যা এবং প্রচণ্ড রাগে ওর গা জ্বলে উঠছে মায়ের চাহনি দেখে।পূর্ব কখনোই বড়দের অসম্মান করে কটু কথা সহ্য করতে পারেনা, তার উপর নিজের ব্যাপার নিয়ে কেউ খোদেজাকে কথা শোনাক সেটাও সে চায়না। পূর্ব ঠান্ডা মাথায় পরিস্থিতি সামলানোর জন্য পূর্ণতাকে বিদায় জানিয়ে চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলো। কবির সেটা মানতে একদম নারাজ হলেও শেষমেশ পূর্বের আশ্বস্ত সূচক হাসি দেখে ওকে যেতে দিলেন। স্ত্রীর উপর তিনিও দীর্ঘদিন যাবৎ ক্ষোভ পুষে রেখেছেন। খোদেজার কঠোর আচরণবিধি তারও কোনোভাবে সহ্য হয়না কিন্তু একবার ব্যবসায় যে লসটা হয় সেটার জন্য পরিবারটা ভালোই সঙ্কটের মুখে পরেছিলো। এরপর থেকে খোদেজা নিজের কর্মদক্ষতায় সবটুকু শক্তি খরচ করে লসের বিশাল টাকা এবং পরিবার দেখাশোনা করার দায়িত্ব পালনে উদ্বুদ্ধ হয়। কবির যেখানে ব্যাপক লসের শিকার হয়ে বেকারত্ব গ্রহণ করেছিলো, সেখানে খোদেজা কর্তার ভূমিকা পালন করে সংসার ও অন্যান্য চাহিদাও মিটিয়েছিলো। সেদিনের ওইসব ঘটনার পর থেকে কবির ও খোদেজার মধ্যে নামেমাত্র স্বামী-স্ত্রী ছাড়া আর কোনো ভালোবাসার স্বাচ্ছন্দ্য ছিলো না। পদে পদে অমিল ও অমত অবস্থা সৃষ্টি হতে হতেই তাদের মধ্যে বেশ দূরত্ব এসে যায়। কবির এতোদিন শুধু এই কারনেই মেয়ের সংসার নিয়ে জোর গলায় কিছু বলার সাহস ও ভূমিকা রাখতে পারেন নি। কিন্তু আজ পূর্ব যখন বিদায় জানিয়ে চলে গেলো তখন তিনি পূর্ণতাকে জোর গলায় বলে দিলেন আজকের মধ্যেই মায়ের আচঁল ছেড়ে শ্বশুরবাড়ির দরজায় চলে যেতে। যেখানে এতোদিন পূর্ব কোনো পাত্তা দেয়নি সেখানে আজ যেহেতু পূর্ব নিজেই পূর্ণতার কাছে এসেছে, কাজেই এখানে থাকার কোনো মানে হয়না পূর্ণতার। এ কথা শুনে খোদেজা সমস্ত রাগ উজাড় করে কবিরকে পূর্বের বাড়ির লোকজনের কথা তুলে সেই বিভীষিকা আচরণের ঘটনাগুলো স্মরণ করায়। পূর্বের চাচার পরিবার ও চাচাতো ভাইবোনগুলো যেখানে এতোই জঘন্য সেখানে পূর্ণতা কি করে শান্তি পাবে! কবির একটা কথাও শোনেনি খোদেজার। তিনি চোখ শক্ত করে খোদেজাকে পাল্টা জবাবে বলে দিয়েছেন দুনিয়ায় সব পরিবারেই ছোটখাট ঝামেলা হয়। কিন্তু ঝামেলা মানে এই নয় যে স্বামী-স্ত্রী আলাদা হয়ে থাকবে। পূর্ব রাগের মাথায় হোক কিংবা জেদের বশে এতোদিন পূর্ণতাকে ইচ্ছে করেই সে দূরে ঠেলেছে। কিন্তু আজ যেহেতু নিজেই সব শর্ত ভুলে চলে এসেছে কাজেই পূর্ব মানসিক ভাবে অবশ্যই সুস্থ নেই। খোদেজা যে নিজ হাতে মেয়ের সুখের সংসারে আগুন জ্বালিয়ে তামাশা সৃষ্টি করছেন সব পার্টে পার্টে বুঝিয়ে দিলেন কবির। মেয়ে আজ বড় হয়েছে, তার বিয়েও হয়েছে। এই মূহুর্তে স্বামীর দায়িত্বে নিয়োজিত থাকাই পূর্ণতার কর্তব্য। এখানে মায়ের দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ভাবনার জন্য সে স্বামীর সোহাগ ছেড়ে ওই নগন্য শর্তকে মূল্যবান করাটা বোকামি ছাড়া কিছুই নয়। কবির দুপুরের খাবারের পর ঘোষণা দিলেন বিকেলের দিকে পূর্ণতাকে ওয়াসিফ ভিলায় রেখে আসবেন।এতোদিন যাবৎ যত মনোমালিন্য ও বিচ্ছিন্ন অবস্থা হয়েছিলো সব মিটিয়ে নতুন করে দুই পরিবারের সম্পর্কটা মজবুত করে আসবেন। যদি খোদেজার এতেও দ্বিমত থাকে সে যেনো কোনো ব্যাপারে নাক না গলায় এটাও পরিস্কার গলায় জানিয়ে দিলেন। পূর্ণতা বাবার কঠিনীভূত আচরণ খুব কমই দেখেছে বটে। তার উপর মায়ের সাথে কখনো উঁচু গলায় কথাও কবির বলেনি। নিতান্ত চুপচাপ, ঝামেলামুক্ ত এবং সরল ভাবে চলতে ভালোবাসেন কবির। খোদেজার মতো বেহুদা চিন্তা ও ঝামেলা ডাকা একদম অসহ্য ভাবেই দেখেন তিনি। কিন্তু এ যাবৎ সব মুখ বুজে সহ্য করা গেলেও পূর্বের আচমকা আগমনে উনার চুপটি অবস্থা নাড়িয়ে দেয় যেনো। তাই তিনি ক্ষিপ্ত ভঙ্গিতে কথাও শুনিয়ে দেন খোদেজাকে।
.
মুখ টিস্যু চেপে গাড়িতে উঠতে হয়েছে পূর্বের। মাস্ক ও কালকের পোশাক এখনো কবিরের ফ্ল্যাটে পূর্ণতার কাছে। শরীরে ম্যাজম্যাজে ভাব থাকলেও কাল রাতের তুলনায় অনেকটাই সুস্থ বোধ করছে সে। স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে যেই গাড়ি টান দিবে ওমনেই ভ্রুকুটি করলো পূর্ব। গাড়ির সব জানালা আটকানো বিধায় ওকে কেউ দেখতে না পেলেও বাইরে দাড়ানো দারোয়ানের দিকে ওর তীক্ষ্ম দৃষ্টি আটকালো। দারোয়ান হতাশ মুখে এমন ভাবে কাঠের টুলে বসে আছে যেনো এখুনি হাউমাউ করে কেদেঁ দিবে। ব্যাপারটা খটকা লাগতেই সে বাধ্য হলো দারোয়ানের মুখোমুখি হতে। দারোয়ান প্রথমে খেয়াল না করলেও পরে যখন মুখ তুলে তাকায় চোয়াল বিশাল বড় হয়ে কথা জড়িয়ে যায়। পূর্ব আশেপাশে দৃষ্টি দিয়ে দারোয়ানকে একটু ভেতরে কোথাও প্রাইভেসি জায়গায় নিয়ে যেতে বললো। দারোয়ান তার ছোট্ট একরুমের অন্ধকার রুমে পূর্বকে নিয়ে গেলো। ময়লা বিছানা, শক্ত তোশক, ভ্যাপসা গন্ধে গা গুলিয়ে আসে রীতিমতো। এই দারোয়ান কিভাবে এমন অপরিচ্ছন্ন রুমে ঘুমান? পূর্বের সামনে একটা প্লাস্টিক টুলে দারোয়ান মাথা নিচু করে বসলো। পূর্ব লোকটাকে জোর দিতেই দারোয়ান নিজের নাম মোজাম্মেল উল্লেখ করে বললো তার বড় মেয়ে কলেজে পড়ে। শামসুল হক খান, (ডেমরা) কলেজে অধ্যয়নরত। মেয়ের জিদে কারনে ওই বড় কলেজেই ভর্তি করান তিনি। কিন্তু আর্থিক অবস্থা এতো শোচনীয় যে দুবেলা তিনি খেতেও ভয় পান। তার পরিবার ডেমরায় একটা ছোট্ট ভাড়া বাসায় থাকে, আর উনি এই আবাসিক এলাকায় দারোয়ানের চাকরী করে টাকা কামান। সবটা শুনে পূর্ব দারোয়ানের ফোনটা দিয়ে তার টিমের কাছে মিসকল দিলো। সাথেসাথেই ওই নাম্বারে ব্যাক করতেই পূর্ব নিজের পরিচয় দিয়ে দারোয়ানের সমস্যাটা গোপনে চুকিয়ে দিলো। দারোয়ান আপ্লুত হয়ে হাউমাউ করে কেদেঁ দিলেন পূর্বের হাতদুটো ধরে। অমায়িক ঠান্ডা কন্ঠে বললেন,
– তুমি আমারে উদ্ধার করলা বাজান। আমি চিন্তায় চিন্তায় কাহিল হইয়া গেছিলাম। বিষ খাইয়া মরবার পথও রাখেনাই আমার মাইয়া। ছোট থেইকাই স্বপ্ন দেখতো লেহাপড়া কইরা বড় কলেছে পরবো, আমি এক মূর্খ কামলা জীবনেও মাইয়ার বড়লোকি ইচ্ছা পূরণ করবার পারিনা। দুনিয়াডা বড় খারাপ গো বাজান। দুনিয়ার মানুষের কাছে হাত পাতলে থুথু দেয়, তারা টাকা দেয়না। এতো বড় ব্লিডিংয়ের মালিকও আমারে দু আনা দিয়া সাহায্য করলো না বাজান। তুমি ফেরেশ্তার মতো সাহায্য কইরা দিলা। এই ঋণ রক্ত দিয়াও শোধ করতে পারুম না বাপ। আমগোর মতো কামলার রক্তও বড়লোকের থুথুর চেয়ে দামী।
পূর্ব শেষ কথাটায় বিরোধ করতে চেয়েছিলো কিন্তু বাস্তব সত্যের জন্য কিছুই বলতে পারেনি। কিছু বড়লোক পরিবারের একজন সদস্যের মাসিক হাতখরচই থাকে দেড় লাখের মতো। তাদের যতোসব অদ্ভুত অভিলাষ ও শখের জন্য টাকা নষ্ট করতে বিবেকে বাধেনা। বাড়িতে শখের বশে মাছের খামার বানিয়ে খাবার কিনে দেখভাল করে, অথচ পথের ভিক্ষুককে এক টাকাও খুশিমনে দেয়না। পূর্ব মোজাম্মেল দারোয়ানকে ওয়াদা করালো ভুলেও কেউ যেনো না জানে সে এখানে আর্থিক সাহায্য করছে। কেউ যদি জিজ্ঞেস করে তাহলে বলবে একজন অজ্ঞাত লোক কিছু গরীব মানুষদের সাহায্য করছে। দারোয়ান নিজের ভাষা হারিয়ে ফেলার মতো অবাক হয়ে গেলেও পূর্ব স্থান ত্যাগ করে চুপচাপ চলে যায়। দারোয়ান ধূলো উড়ানো পথটার দিকে তাকিয়ে থেকে নিরবে ইউনিফর্মের শার্টে চোখ ডলে। আকাশের দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ নয়নে চোখ বুজে ফেলে দারোয়ান। দুনিয়াটা আজও বেঁচে আছে। আজও বেঁচে আছে কিছু সুপ্ত মানুষের দয়াময় গুণের জন্য।
.
বাড়িতে পৌঁছে পলাশ ওয়াসিফের সাথে দেখা করে রুমে ফিরলো পূর্ব। আয়েশা ছেলের সাথে রুমে এসেই দেখা করলেন। কালরাতে পূর্ব কোথায় ছিলো এমন প্রশ্ন করলেন না। যেখানে হামেশার মতো পূর্ব কোনো জবাবের পাট চুকাবে না। পূর্ব শান্ত ভঙ্গিতে ফ্রেশ হয়ে পান্ঞ্জাবী পরতে লাগলো।আয়েশা কাল সন্ধ্যায় ওর জ্বরতপ্ত যে অবস্থা দেখেছিলো সেটার রেশ কিভাবে গায়ে পুষে আবার বাইরে যাচ্ছে তিনি তা জানেন না। পূর্বকে কোনোকিছুর জন্য বাধা দিলেও যে লাভ হবেনা এ সম্বন্ধে আয়েশা ভালো করেই জানেন। তিনি চুপচাপ ছেলেকে একপলক দেখেই পা চালিয়ে রুম থেকে বিদায় হলেন। পূর্ব ড্রয়ার থেকে সিজার নিয়ে ঔষুধের পাতা থেকে দুটো ক্যাপসুল কেটে পকেটে নিলো। যদি মাথা ঘুরায় তাহলে একসাথে দুটো গিলে নিবে। চুলে ব্রাশ করে মোবাইলটা হাতে নিতেই শূন্য বেডের দিকে চোখ পরলো। খোদেজা আজ না ফিরলে পূর্ব সত্যি পূর্ণতার কাছে থাকতো, কিন্তু ওই পরিস্থিতিতে ঝামেলা বাড়ানোর মানে হয়না। পূর্ব দুকানে মাস্কের রাবার লাগাতেই গাড়িতে চড়ে বসলো। মোমিন ড্রাইভিং সিটে বসে আছে কিছুক্ষণ যাবৎ। পূর্ব উঠতেই গাড়ি ছেড়ে দিলো পার্টি অফিসের দিকে। আজ প্ররোচনার জন্য রাস্তায় থাকার কথা হলেও পূর্ব সিদ্ধান্ত পাল্টে বস্তি এলাকায় ঢুকার চিন্তা করলো। সেখানকার অবস্থা ও মানুষের সমস্যা সম্বন্ধে জানাটা জরুরী। গাড়িটা বস্তির মুখে দাড়ালে কৈলেশ, সবুজ ও সাব্বির এগিয়ে এসে পূর্বের সাথে যোগ দেয়। কৈলেশের হাতে খাতা ও কলম, সাব্বিরের হাতে বড় ব্যাগ, সবুজ হাত নাড়িয়ে বিশদ ব্যাপারটা পূর্বকে বোঝাচ্ছে। দূর থেকে একজোড়া চোখ পূর্বের কার্যকৌশল অনুসরণ করে ফোনে সেগুলো কাউকে বলছে। পূর্বরা কেউ লোকটাকে দেখতে পায়নি। তারা বস্তির মানুষদের প্রতিটি ঘরে ঘরে সমস্যা নিয়ে কথা শুনছে। ইতিমধ্যে বস্তির সবার সাথেই পূর্বের একটা ভালো সম্পর্ক তৈরী হয়েছে, তারা ওকে যথেষ্ট সম্মান ও সমীহ নজরে দেখে। কাটায় কাটায় ঠিক আধা ঘন্টা পর হুলস্থুল চিল্লাচিল্লি করে বিকট মাইকিং করে মিছিলের শোরগোল শুনতে পায় পূর্বের দল। বস্তির ছোট বাচ্চারা ততক্ষণে শব্দ উৎসের দিকে ছুটে গিয়ে উত্তেজনায় লাফাচ্ছে। পূর্ব একজন বৃদ্ধার ঘরে ঢুকে তার সমস্যার কথাগুলো শুনছিলো তখনই কৈলেশ পূর্বের কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললো,
– পূর্বদা, আপনার দেখাদেখি অপোনেন্ট দলের ক্যান্ডিডেট এখানে প্রচার চালাতে আসছে। এতোদিন ভুলেও এইদিকে চুপি মারেনি, আর যেই দেখছে আজ আপনি এখানে এসেছেন ওমনেই দলবল নিয়ে হাজির। কি করা উচিত পূর্বদা? ধমকে তাড়াবো?
কৈলেশের নির্বুদ্ধিতায় পূর্ব গম্ভীর মুখে কিছু বলতে গিয়েও বৃদ্ধার উপস্থিতিতে বলতে আর পারলো না। বৃদ্ধা নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে। ময়লা ফ্লোরের এককোণায় একটি বুড়ো লোক নোংরা লুঙ্গি পরে শুয়ে আছে। বুড়ো-বুড়ির সন্তানরা তাদের তাড়িয়ে দিলে দুজন এই বস্তিতে আশ্রয় নেয়। বুড়ো সারাদিন ভ্যান চালিয়ে যা কামাতো তাতেই কোনোমতে পেটের টান চুকাতো। কিন্তু এক্সিডেন্টে বুড়ো দুইপা একসঙ্গে কাটার ফলে আর কিছু করতে পারেন না তিনি। ভিক্ষাবৃত্তিতে নিরুপায় হয়ে যোগ দিয়েছেন বুড়ি। চোখে দেখেনা, তার উপর পেটেও ভাত জুটেনা। পূর্ব সাব্বিরকে ডেকে বস্তার ছোট্ট খুপরির ভেতরে ঢুকতে বললো। কৈলেশ বেরিয়ে সাব্বির ঢুকলে পূর্ব ওর ব্যাগ থেকে একটা আয়তাকার বাক্স নিয়ে সেটা সন্তপর্নে খুললো। বুড়ির দিকে মিষ্টি হেসে লম্বা ডাটগুলো টেনে বুড়ির দুইকানের কাছে ঢুকিয়ে দিতেই বুড়ি আশ্চর্য কন্ঠে হড়কে গিয়ে বললো,
– ও বাবাগো এই জীবনে এই দিনও দেখমু ভাবতে পারিনাই। চশমা দিয়া আবার সবকিচ্ছু ভালা কইরা দেখমু ভাবিনাই বাপ, এই ফকিরের দিকে তাকাইলা তুমি…
বুড়ি যতটা সরল গলায় কথাটা বলছিলো তার গলা যেনো জমাট হয়ে থরথর করে কান্নায় কাপছিলো। অনবরত তিনি পূর্বের মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। পূর্ব প্রতিবারের মতো এবারও বুড়ির হাতে কিছু নোট গুঁজে দিয়ে বেরিয়ে এলো। বেরুতেই দেখলো বিপরীত দলের প্রার্থী ইবরাহিম খান দুই হাত কোমরে পিছু করে বেধে হেঁটে হেঁটে সবাইকে ভোটের জন্য আহবান করছে। কৈলেশ দাঁতে দাঁত চেপে শক্ত করে মুখে বললো,
– শালার ন্যাকামি দেখছেন পূর্বদা? এই কয়দিন রাস্তাঘাট আর দোকানপাটে ভোটের জন্য চিল্লাচিল্লি করলো অথচ এইদিকে চোখ তুলেও তাকালো না। আর আজ যেই শুনছে আপনি আসছেন ওমনেই বাজনা বাজিয়ে চলে আসছে। শালা খবিশের বাচ্চা!
পূর্ব তৎক্ষণাৎ কৈলেশের দিকে এমন দৃষ্টিতে তাকালো কৈলেশ মিইয়ে যাওয়া ভঙ্গিতে ঢোক গিললো। পূর্ব ওর দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে সামনে তাকাতেই গম্ভীর মুখে মাস্কের আড়ালে চোখ স্বাভাবিক রেখে বললো,
– যারা অযোগ্য তারা নিশ্চয়ই গালি দিয়ে নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করতে চায়। আমি তোমার কাছ থেকে ইদানিং যে শব্দগুলো শুনছি সেগুলো মার্জিত করো। ইবরাহিম সাহেব কি করবেন, কি করছেন সেগুলো আমাদের দেখার দরকার নেই। জনগণ সবার এবং তাদের দেখার অধিকারও সকলের। কারোর সাথে আমার জন্য হিংসা করতে যেও না কৈলেশ। আমি অবশ্যই এসব সহ্য করতে রাজি না। চলো এখন। আর শোনো ইবরাহিম সাহেব সালাম দিতে ভুলবেনা।
পূর্ব একনাগাড়ে সবগুলো কথা উগলে ইবরাহিম সাহেবের দিকে এগুলো। পেছনে ওরা দুজনও এগিয়ে এসে পূর্বের সাথে সালাম দিলো। ইবরাহিম খান অবাক হতে গিয়েও শেষমেশ হেসে ফেললেন। পূর্ব হ্যান্ডেশেক করে সৌজন্য আচরণ দেখিয়ে নির্বাচনের জন্য শুভকামনা জানালো। বস্তির লোকেরা এ দৃশ্য দেখে ইবরাহিম খানের চোয়াল ঝুলানো মুখটা শুধু দেখলো। ইবরাহিম খান হয়তো ভেবেছেন নাম-ডাক-হাক পাওয়া ওয়াসিফ পূর্ব উনাকে দেখে মুখ ঘুরিয়ে চলে যাবে। কিন্তু পূর্ব যে সম্মানের ভঙ্গিতে আচরণ করতে এগিয়ে আসবে তা একদম অকল্পনীয় ছিলো। পূর্ব চলে যেতেই বস্তির সকলের মুখ কেমন যেনো ক্ষুদ্ধ ভঙিমার মতো কালো হয়ে গেলো। তাদের মধ্যে হাসি-হাসি ভাবটা আর নেই। ইবরাহিম খান জোরপূর্বক হাসি দিয়ে উনাদের কাছে যেতেই ভোটের কথা নিয়ে ইশতেহার দিলেন। কিন্তু মানুষ যেনো আপ্লুত হওয়ার বদলে উল্টো বিমর্ষ রূপ ধারন করলো।
.
রাতের দিকে ওয়াসিফ ভিলায় ফিরলো পূর্ব। ইচ্ছে করছিলো পূর্ণতার কাছে যেতে কিন্তু খোদেজার রূঢ় আচরণের জন্য আর মন মানলো না সেখানে। সিটের পেছনে মাথা হেলিয়ে চোখ বন্ধ করলো পূর্ব। সাদা পান্ঞ্জাবীর বুকের কাছে দুটো বোতাম খুললো। অস্থির লাগছে। জ্বরটা বোধহয় আসবে-আসবে করছে। পকেটে ট্যাবলেট থাকলেও খাওয়ার ইচ্ছা হচ্ছিলো না ওর। এসির মৃদ্যু পাওয়ারে গায়ে কাটা দিয়ে শীত করছিলো পূর্বের। মোমিনকে বলে এসিটা বন্ধ করে নিলো সে। চলন্ত গাড়ি থেকে আকাশে তাকিয়ে উদাস হয়ে গেলো পূর্ব। কালরাতের মতো পূর্ণতাকে যদি আজও পাওয়া যেতো?পূর্ণতার কথা চিন্তা করলেই মন আর সামলে থাকতে চায়না। কিন্তু ওই অহেতুক শর্তই যেনো বড় দেয়ালের মতো বিবেকে বাধা দিচ্ছে এখনো। গেট দিয়ে গাড়ি ঢুকে সেটা পার্কিং এরিয়ায় থামতেই পূর্ব বুকের বোতাম দুটো লাগিয়ে ভেতরে ঢুকলো। শূন্য বাড়ি, কেউ নেই। চাকররা খাবার খেয়ে শুয়ে পড়েছে দশটার দিকে। জ্বর না থাকলেও বুকের শুষ্ক উঠোনে চৌচির অবস্থা ঠেকছে।
কালও রাত ছিলো, আজও রাত হয়েছে। কাল পাশে পূর্ণতা ছিলো, আজ পূর্ব একা-একা রুমে আসছে। নব্ মোচড়ে দরজা খুলতেই ঘুটঘুটে সেই আগের মতো অন্ধকার। লাইট জ্বালাতেই সেই অগোছালো অবস্থা। রুমে কেউ নেই সবসময়ের মতো। দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে নব ছেড়ে পূর্ব মাথা নিচু করে বেডে এসে বসলো। বসতেই পিঠ ছেড়ে দিলো বেডে। কয়েক মূহুর্ত কাটলো নিস্তব্ধে। এরই মধ্যে কানে খট করে একটা শব্দ বাজলো ওর। চোখ খুলে যেই তাকাতে নিবে ওমনেই রিনরিন গলার সুর ভেসে এলো,
– কমরেড সাহেব? খারাপ লাগছে? আমি কি আসবো?
পূর্ব বিষ্ময়ের ঘোরে দরজার দিকে তাকিয়ে ধীরে-ধীরে বেড থেকে পিঠ উঠিয়ে বসলো। ভ্রুদ্বয়ের মাঝে ভাঁজ ফেলে চোখ দুটো অনেকবার ঝাপটালো। হ্যালুসিনেশন? কল্পনা? পূর্ণতার মতো সেমি পাগল হলো নাকি? টানা একগাদা প্রশ্ন তখন মাথার মধ্যে আঁকিবুকি করলেও পূর্ব দৌড়ে ছুটে গিয়ে পূর্ণতাকে জাপটে ধরলো। ওর মাথাটা শক্ত করে বুকে চেপে পিঠ আকড়ে ধরলো। সমান তালে বুকে চাবুক পেটাচ্ছে পূর্বের। এটা যেনো সত্যি হোক সেই মিনতি অগোচরেই চাচ্ছে। পূর্ব চোখ বন্ধ করেই পূর্ণতার মাথায় অজস্র ঠোঁট ছোঁয়াতে লাগলো। উন্মাদের মতো এমন আচরণ দেখে পূর্বকে ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই পূর্ণতা দরজাটা চাপিয়ে দিলো। পূর্ণতা অনেকক্ষন পর পূর্বের পিঠে হাত রাখলো। এতোক্ষন চুপ করে পূর্বের উন্মত্ত কারখানায় আটকা পরে হাতদুটো পিঠে রাখতে খেয়াল ছিলোনা। পূর্ব শান্ত হয়ে ওকে জাপটে রাখলে পূর্ণতা প্রসন্ন কন্ঠে হেসে বললো,
– আমাকে সঙ্গে নিয়ে আসলে কি খারাপ হতো? তখন ওভাবে চলে গেলে কেনো?
পূর্ব কিছু বললো না। হাতদুটো ঢিলে করে পূর্ণতাকে ছেড়ে দিলো। ওর দিকে আপাদমস্তক তাকিয়ে দেখলো শাড়ি পরেছে পূর্ণতা। কালো রঙের শাড়ি, খয়েরী রঙের পার, চুলে খোপা করা, চোখদুটোতে কাজল দেয়া, ঠোঁট আজ কৃত্রিম লিপস্টিকে ঢাকা। পূর্ণতা স্পষ্ট বুঝতে পারলো পূর্বের দৃষ্টি স্বচ্ছ না। চোখে অদ্ভুত নেশা-নেশা ভাব জড়িয়ে গেছে। বুকের বোতামে হাত উঠেছে পূর্বের। পূর্ণতা চোখের পলকে পূর্বের হাত ধরে তীর্যক চাহনিতে বললো,
– দুপুরে খেয়েছো? ঔষুধ নিয়েছিলে? কিচ্ছু করোনি, ঠিক না?
পূর্ব কোনো জবাব দিলো না। ড্যাবড্যাব করে পূর্ণতার দিকে তাকিয়ে রইলো। রাতে যেহেতু সব চাকরদের ঘুমাতে যেতে বলেছে তাই নিজেই পূর্বের খাবার এনে রুমে ফিরে এসেছে। পান্ঞ্জাবী পাল্টে, সাদা প্যান্ট বদলে টিশার্ট-ট্রাউজার পরলো পূর্ব। রাতের খাবারটা পূর্ণতার সাথে খেয়ে আবারও সেদিনের মতো বারান্দায় বিছানা করলো। তবে এবারের বিছানাটা পূর্বিকার রুমে। পূর্বের রুমে বারান্দা না থাকায় স্থান পরিবর্তন হয়েছে। আকাশে একটা গোলাকার চাদঁ উঠেছে আজ। দিগ্বিদিক চন্দ্রকিরণে এমন প্রকৃতি হয়েছে জোৎস্নার আলো যেনো সত্যি চুয়ে চুয়ে পরছে। রুমের লাইট নিভিয়ে দরজা লাগিয়ে কোলে তুলে বিছানায় শোয়ায় পূর্ণতাকে। পূর্ণতার কপালে গভীর চুমু খেয়ে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। পূর্ণতা জানেনা পূর্ব হঠাৎ হঠাৎ ঠিক কি নিয়ে চিন্তায় ভুগে। এটুকু অনুমান করতে পারে হয়তো নির্বাচনের দুশ্চিন্তায় পূর্ব ধুকে ধুকে কষ্ট পাচ্ছে। পূর্ণতা তার নরম হাতদুটি দিয়ে পূর্বের খোচা খোচা গালদুটো আবদ্ধ করলো। ধরে কাছে টানলো। কিন্তু পূর্বের চোখদুটো বিষণ্নতায় কাতর। পূর্ণতা ঠান্ডা কন্ঠে নরম হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– টেনশনে আছো অথচ খুলে বলছো না। আমার দিকে ঠিক করে তাকিয়ে বলো তোমার মনের ভেতর কি চলছে।
পূর্ব চোখ বন্ধ করে কয়েক মিনিট নিশ্চুপ থাকলো। টিক-টিক-টিক করে সময় অতিক্রম হচ্ছে পূর্ব চোখও খুললো না, কিছু বললোও না। এদিকে পূর্বের আচমকা চুপচাপ অবস্থা দেখে ভয়ে পূর্ণতার বুকে ধড়ফড় ধড়ফড় করে হৃদপিন্ড ছুটছে। নিশ্বাসে টান লাগতে শুরু করেছে। গলা শুকিয়ে কাঠ-কাঠ হচ্ছে টেনশনে। পূর্ব হঠাৎ ছোট্ট নিশ্বাস ছেড়ে চোখের পাতা ধীরে ধীরে খুললো। পূর্ণতার স্থিরদৃষ্টির দিকে চোখাচোখি হতেই অদ্ভুত শূন্য আভায় নিচু স্বরে বললো,
– হয়তো আমাদের আর দেখা হবেনা। আমার মন বলছে তুমি আর কোনোদিন আমায় পাশে পাবেনা। আমার বুকে মাথা রেখে হাতে হাত জড়িয়ে ঘুমটা হয়তো হারিয়ে যাবে পূর্ণ। আমি আবারও তোমাকে ফেলে ওয়াদা ভঙ্গ করে হয়তো অনিশ্চিত দিকেই ছুটে যাবো। হয়তো আর কখনো তুমি আমাকে এইভাবে কাছে টেনে রাখবেনা। সুযোগটা হারিয়ে…
পূর্ব তার কথা শেষ করলো না। কেনো জানি করতে পারলো না। বুকের কোথাও ক্ষরণ হচ্ছে ওর। চাপা ব্যথায় নিশ্বাস ভারী হচ্ছে।অবচেতন মন তোলপাড় করছে। অজানা ভয়ে মন কুকড়ে আসছে। পূর্ণতার দিকে চোখ ফেলতেই জোৎস্নার কিরণ যেনো জ্বলজ্বল করে অশ্রুর সাথে খেলছে ওর। পূর্ণতা নিচের ঠোঁট কামড়ে তাড়াতাড়ি চোখের উপর কবজি তুলে ঢাকলো। পূর্ব চমকে গিয়ে বিষ্ময় জড়ানো কন্ঠে কিছু বলবে তার আগেই পূর্ণতা ফুপানো কান্নায় জোর দেখিয়ে বললো,
– তুমি মরতে চাইলে মরো। আমিও তোমার মৃত্যুর পর ওই জায়গা তছনছ করে আসবো। সব শেষ করে দিবো আমি। কিচ্ছু বাদ রাখবো না ওয়াসিফ পূর্ব! আমি সব নষ্ট করে আসবো!
– ‘ চলবে ‘
#FABIYAH_MOMO
সম্পূর্ণ গল্পের লিংক