#অন্যরকম তুমি
পর্ব ৪৪
#তানিশা সুলতানা
শশুড় বাড়ি এসেও কারো সাথে কথা বলছে না ছোঁয়া। একা একা রুমের মধ্যে ঘাপটি মেরে বসে আছে৷ আজকের দিনটা থাকলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেতো?
রাগটা হচ্ছে শাশুড়ী মায়ের ওপর। ছোঁয়ার ধারণা শাশুড়ীই আনতে বলেছে ছোঁয়াকে।
আসার সময় ভুল করে ফোন আনেনি। সিফাত নিয়ে এসেছে। একটু আগে ফোনটা দিয়েও গেছে রুমে। ছোঁয়া এখন পর্যন্ত ফোনটা ছুঁয়েও দেখে নি। সাদি যে ওকে কল করতে পারে বা করেছে এটা মাথাতেই নেই। আপাতত ওর মাথাতে সাদি নামটাই নেই। আছে শুধু বাড়ি ফেরার ধান্দা। ঢাকায় যখন ছিলো তখন তো এতোটা বাড়ি আসতে মন চাই নি৷ তাহলে এখন কেনো চাইছে?
সন্ধা হয়ে গেছে প্রায়৷ সাদি ফাইলপএ গুছিয়ে নিয়েছে। এখনই বাসায় যাবে। পচন্ড খিদে পেয়েছে।
বা হাতে চুল গুলো পরিপাটি করে উঠে দাঁড়ায় সাদি। আর তখনই বস দরজা ঢেলে ভেতরে প্রবেশ করে। সাথে মেঘা। মেঘার চোখে মুখে খুশির ঝলক।
“স্যার কিছু বলবেন?
সাদি জিজ্ঞেস করে।
” আগে বসি তারপর বলছি।
বলেই বস বসে পড়ে। সাদি সটান দাঁড়িয়ে আছে। মেঘা মুচকি মুচকি হাসছে।
“জানোই তো বিদেশি কোম্পানির সাথে আমাদের ডিল হয়েছে। ডিলটা তুমিই করেছে। আমাদের প্রডাক্টও তাদের খুব ভালো লেগেছে। তো এবার সিঙ্গাপুর মিটিং ডাকা হয়েছে। ওনারা চাইছে মিটিং টা তুমি এটেন্ট করো।
আর আমি তাদেরকে বলেছি তুমি আমার সাথে পার্টনারশিপে আছো। তো বুঝতেই পারছে কতটা ইমপটেন্ট তুমি।
সাদি বড়বড় চোখ করে বসের দিকে তাকায়। মনে মনে প্রশান্তি হাওয়া বয়ে যায়।
” মিটিং আমি এটেন্ট করবো। তবে আপনি তাদের যা বলেছেন সেটা সত্যি করতে হবে।
সাদি বুকে হাত গুঁজে বলে। বস মুচকি হাসে।
“তুমি না বললেও কথাটা সত্যি করে দিতাম।
“কবে যেতে হবে?
সাদি জিজ্ঞেস করে।
” তুমি যেদিন যেতে চাও।
“আমি একা যাবো না।
” তোমার সাথে মেঘাকে পাঠানো হবে।
“ওনাকে লাগবে না। আমি আমার ওয়াইফকে নিয়ে যেতে চাই।
বস বড়বড় চোখ করে তাকায় সাদির দিকে। মেঘা দাঁত কটমট করে।
” তুমি বিয়ে করেছো?
অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন উনি।
“জি স্যার।
” আচ্ছা তাই হবে।
বস মুচকি হেসে বেরিয়ে যায়। মেঘা দাঁত কটমট করে সাদির দিকে তাকায়৷ সাদি তাতে পাত্তা দেয় না।
সন্ধার দিকে চোখ লেগে গেছিলো ছোঁয়ার। আর তখনই ফোন বেজে ওঠে। বিরক্ত হয় ছোঁয়া। নাক মুখ কুঁচকে ফোন রিসিভ করে।
“হ্যালো
” এই সন্ধা বেলায় ঘুমচ্ছো কেনো? যাও নামাজ পড়ে নাও।
সাদির কর্কশ গলা শুনে এক লাফে উঠে বসে ছোঁয়া। চোখ ডলে হামি দেয়।
“আজকে নামাজ পড়তে ইচ্ছে করছে না।
ঘুম ঘুম কন্ঠে বলে।
” ইচ্ছে না হলেও পড়তে হবে। ইটস মাই অর্ডার। নামাজ শেষ করে কল দিবা।
বলেই সাদি খট করে ফোন কেটে দেয়। ছোঁয়া মুখ বাঁকিয়ে ওজু করতে যায়। শান্তি দেবে না আর এরা।
চট করে নামাজ সেরে নেয়।
সাদিও নামাজ শেষ করে রান্না করতে যায়।
ভাত চুলায় বসিয়ে ছোঁয়াকে কল দেয়।
ছোঁয়া তখন আবারও ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। সাদির ফোন পেয়ে আর সোয়ার সাহস পায় না। কুশন জড়িয়ে বসে ফোনটা কানে নেয়
“কি করছো?
সাদি জিজ্ঞেস করে।
” এই তো বসে আছি। আপনি?
“রান্না করছি। বসে কেনো আছো? মা একা একা রান্না করছে। তুমি যাও। মাকে হেল্প করো।
সাদি গম্ভীর গলায় বলে।
” আজকে ভালো লাগছে না
অলস ভঙিতে বলে ছোঁয়া
“ভালো লাগছে না বললে চলবে। ভালো লাগাতে হবে। যাও মায়ের কাছে। রান্না শেষ করে খাওয়া দাওয়া পড়ালেখা শেষ করে কল দিবা আমাকে। কেমন?
ছোঁয়া কিছু না বলে ফোন কেটে দেয়। ফোন চার্জে বসিয়ে সাদিকে বকতে বকতে চলে যায় রান্না ঘরে।
সাবিনা বেগম ভাত চড়িয়ে তরকারি কাটছে। ছোঁয়া ওনাকে উঠিয়ে তরকারি কাটতে লেগে পড়ে। একটা কথাও বলে না অপ্রয়োজনীয়। সাবিনা বেগম কিছুটা অবাক হয়। কথা কেনো বলছে না বুঝতে পারে না।
ছোঁয়া জেদ ধরে আজকে তরকারি ও রান্না করবে। সাবিনা বেগম হাজার বারণও সে শুনবে না। ইলিশ মাছের চরচরি রান্না করা হবে।
ছোঁয়ার জেদের কাছে হাত মেনে নেয় সাবিনা বেগম। ছোঁয়ার পাশে দাঁড়িয়ে বলে দিতে থাকে কিভাবে রান্না করতে হবে। ছোঁয়াও পাক্কা গৃহিনীর মতো রান্না করতে থাকে। চোখে মুখে ফুটে উঠেছে প্রশান্তির ছায়া।
ছোঁয়া খুব ভালো ভাবে রান্না শেষ করে। চোখে মুখে খুশির ঝিলিক। সাবিনা বেগম চেখে দেখে। দারুণ হয়েছে খেতে। ছোঁয়ার অভিমান শেষ।
“শাশুড়ী আমি ফোন নিয়ে আসি৷ ছবি না তোলা ওবদি কিন্তু চুলা থেকে নামাবেন না কেমন?
বলেই ছোঁয়া দৌড়ে চলে যায় রুমে। সাবিনা বেগম মুচকি হাসে। একদম পাগল মেয়েটা।
দুই মিনিটে ফোন নিয়ে আবারও হাজির হয়। ফটাফট কয়েকটা ছবি তুলে নেয়।
তারপর শাশুড়ীর সাথে হাতে হাতে খাবার গুলো টেবিলে রেখে ফ্রেশ হতে যায়।
রুমে এসেই ফটাফট ছবি গুলো সাদিকে পাঠায়৷ সাদি তখন রান্না শেষ করে একটু রেস্ট নিচ্ছিলো। টিং টিং শব্দ হতেই ফোনটা হাতে নেয়। তাতে ছোঁয়ার দেওয়া ছবি গুলো দেখে ভ্রু কুচকে ফেলে।
” রান্না করেছে? তাও আবার ছোঁয়া? বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে সাদির। দেখতে দারুণ হয়েছে।
সাদি কল দেয়। সাথে সাথে ছোঁয়া রিসিভ করে।
“জানেন আমি রান্না করেছি আজ।
খুশিতে লাফিয়ে উঠে বলে ছোঁয়া।
” বাহ ভালোই তো।
তবে খাওয়া গেলে কথা।
ছোঁয়াকে খেপানোর জন্য বলে সাদি।
ছোঁয়া গাল ফুলিয়ে ফেলে।
“খুব ভালো হয়েছে খেতে।
নাকের পাটা ফুলিয়ে বলে।
” তুমি খেয়ে বলছো?
সাদি বলে।
“হ্যাঁ
“দেখেই বোঝায় যাচ্ছে এটা খাওয়ার অযোগ্য। বাড়ির সবার পেট খারাপ হয়ে না যায়।
অফসোসের সুরে বলে সাদি।
” আপনি একটা হনুমান, করলার জুস আপনি। কথাই বলবো না আপনার সাথে।গোমড়া মুখো বাঁদর একটা।
সামনে পেলে তরকারির কড়াইতে মুখ ঠেসে ধরতাম।
রাগে গজগজ করতে করতে বলে ছোঁয়া।
“গালি গুলো কি তুমিই বললে? নাকি কারো থেকে শুনে বললে?
সাদি বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে বলে। ছোঁয়ার রাগ এখন আকাশ ছুঁই ছুঁই।
” আর কখনো কল দিবি না আমায়। শা*লা হনুমান।
খট করে ফোন কেটে দেয় ছোঁয়া। সাদি মুচকি হাসে। অল্পতেই কাউকে এতোটা খেপানো যায় ছোঁয়াকে না দেখলে বুঝতেই পারতো না।
“ইডিয়েট একটা
চোখ বন্ধ করে বলে সাদি।
ছোঁয়া সাদিকে ব্লক করে দিয়েছে। কত বড় সাহস ছোঁয়ার রান্নাকে খারাপ বললো।
রাগে গিজগিজ করতে করতে পুরো রুম পায়চারি করতে থাকে ছোঁয়া। রাগটা কমছেই না।
পরিকে দুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে সিফাত৷ শরীর হালকা গরম। রাত সবে নয়টা বাজে। পরির পাশে আধশোয়া হয়ে আছে সিফাত। মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কত ভালোবাসে বাবাকে। এখন যে ঘুমিয়ে আছে তবুও বাবার এক হাত জড়িয়ে ঘুমচ্ছে। বাবাকে ছাড়া অচল মেয়েটা।
সিফাত প্রশান্তির হাসি হাসে। ভালো হাসবেন্ড না হতে পারলেও ভালো বাবা হতে পেরেছে। এটাই অনেক।
মেয়ের কপালে পরপর কয়েকটা চুমু খায় সিফাত। তারপর ফোনটা হাতে নেয়। জানা আছে সিমি এখন ছটফট করছে। এই দিনগুলোতে মেয়েকে একদম আপন করে নিয়েছে। মেয়েকে ছাড়া থাকাটা অসম্ভব হয়ে পড়েছে সিমির। কিন্তু পরি বাবাকে পেয়ে মা ভুলেই গেছে। ওই বাড়ি থেকে চলে আসার পরে আর একবারও মায়ের কথা বলে নি।
সিফাত কল করে সিমিকে। সিমি বালিশ জড়িয়ে বসে ছিলো। মেয়েকে ছাড়া থাকতে পারছে না একদম। ইচ্ছে করছে এখনি ছুটে চলে যেতে। কিন্তু পারছে না। ছটফট করে মরে যাচ্ছে ভেতরে ভেতরে।
ফোন বেজে উঠতেই তারাহুরো করে ফোনটা হাতে নেয় সিমি। সিফাতের নাম্বার দেখে খুশি হয়ে যায়। নিশ্চয় পরি বায়না ধরে ছিলো বলেই সিফাত কল করেছে। এখন মেয়ের সাথে কথা বলতে পারবে।
“হ্যালো
সিমি বলে৷ ওপাশ থেকে দীর্ঘ শ্বাস ফেলার শব্দ আসে। সিমির হাসি মুখটা চুপসে যায়।
” সিমি ফিরে আসবে? শেষ বারের মতো হ্মমা করে দেবে আমায়?
সিফাতের কন্ঠে অনুরোধ। চোখ মুখ শক্ত করে ফেলে সিমি।
“আমার মেয়ে কি করছে?
গম্ভীর গলায় বলে। সিফাত ফোঁস করে শ্বাস টানে।
” ঘুমিয়েছে। গা গরম। জ্বর আসবে বোধহয়।
ক্লান্ত গলায় বলে সিফাত।
“খেয়েছে?
” আমার সাথে কখনো খাওয়া নিয়ে বায়না করে না।
সিফাত মুচকি হেসে বলে। দুজনের মধ্যে চলে পিনপিন নিরবতা।
কিছুখন নিরবতা পালন করে সিফাত বলে ওঠে।
“আমি তোমার সাথে অন্যায় করেছি। মাফ চাইছি। তুমি বললে পায়েও ধরতে রাজি। ভুল তো মানুষই করে। আমিও করেছি। এখন কি বলো তুমি আমি মরে গেলে শান্তি পাবে?
বা এভাবেই কয়দিন চলবে? মেয়ে বড় হচ্ছে আমার। বাবা মা থাকতেও কেনো এতিমের মতো বড় হবে ও?
তুমি একটা সিদ্ধান্ত জানিয়ে দাও। হয় ফিরে এসো। আমার কাছে না। নিজের মেয়ের কাছে। বাবা মায়ের সাথে বড় হোক মেয়েটা।
সিমি কল কেটে দেয়। এসব কথা শোনার ইচ্ছে বা সময় কোনোটাই নেই ওর। কিন্তু একটা কথা সত্যি। পরি বাবাকে ছাড়া ভালো থাকবে না। আর সিমি মেয়েকে ছাড়া ভালো থাকবে না। এখন কি করা উচিৎ ওর? কি করবে এই সমস্যার সমাধান?
দীর্ঘ শ্বাস ফেলে সিমি।
বালিশে মুখ গুঁজে ডুকরে কেঁদে ওঠে।
চলবে..