#অন্যরকম তুমি
পর্ব ৪৭
#তানিশা সুলতানা
সিঁড়ি বেয়ে উপরে গিয়ে ডানপাশের রুমের ওপরে সাদমান চৌধুরী নামটা দেখতে পায় ছোঁয়া। বুঝে যায় এটাই সাদির কেবিন। কেবিনের বাইরে একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে।
লোকটার গায়ে দারোয়ানের পোশাক। কেবিনের বাইরে যে দারোয়ান থাকে এটা জানা ছিলো না ছোঁয়ার।
ছোঁয়া এগিয়ে যায়। কেবিনে দরজায় হাত দিতে যাবে তখনই লোকটা এগিয়ে আসে।
“এক্সকিউজ মি ম্যাম।
ছোঁয়া ভ্রু কুচকে লোকটার দিকে তাকায়। লোকটা মাথা নিচু করে ফেলে।
” স্যার ইমপটেন্ট মিটিং এ আছে। এখন কাউকে ঢুকতে দেওয়া নিষেধ।
কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে বলে লোকটা।
ছোঁয়া সেভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে। ইচ্ছে করছে লোকটার মাথা ফাটাতে। কতবড় সাহস? ছোঁয়াকে আটকে দেয়
“আমি কে জানেন?
বুক হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে শান্ত গলায় বলে ছোঁয়া।
লোকটা এক পলক তাকায় ছোঁয়ার দিকে। তারপর আবার মাথা নিচু করে ফেলে।
” না মানে আপনি হয়ত স্যারের বাড়ির লোক হবেন।
আমতা আমতা করে বলে।
“বাড়ির লোক কি? আমি ওনার একমাত্র বউ।
বুঝলেন আপনি?
ছোঁয়া চিল্লিয়ে বলে ওঠে। লোকটা দুই হাতে কান চেপে ধরে। আশেপাশের মানুষরা এগিয়ে এসেছে। সবাই কানাঘুষা করতে থাকে এটা সাদি স্যার বউ।
” ম্যাম আস্তে কথা বলুন
লোকটা দুই হাত এক জোর করে ফিসফিসে বলে।
“কেনো আস্তে বলবো? আমার বরের অফিস। আর আপনি আমাকে ঢুকতে দিচ্ছেনা? আপনাকে পুলিশে দেওয়া উচিত। নিশ্চয় আপনার কোনো মতলব আছে।
আগুন চোখে তাকিয়ে বলে ছোঁয়া। ততখনে অফিসের মেইন বস চলে এসেছে।
” রহিম কি হয়েছে?
ছোঁয়ার দিকে এক পলক তাকিয়ে বলে। বসকে দেখে যে যার কাজে চলে যায়।
ছোঁয়া বসের দিকে এগিয়ে আসে।
“এটা আমার বরের কেবিন। আমি ঢুকতে গেছি উনি আমাকে ঢুকতে দেয় নি।
ছোঁয়া রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলে। বস হেসে ফেলে।
” নাম কি তোমার.?
ছোঁয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে।
“মিসেস সাদমান চৌধুরী।
গাল ফুলিয়ে বলে ছোঁয়া।
” ওহহ আচ্ছা।
তো আমি তোমাকে কি বলে ডাকবো?
মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করে উনি। ছোঁয়া লোকটাকে দেখে। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি হবে। চুল গুলো অধপাকা, ধবধবে ফর্সা। সুট কোট পড়ায় বোঝায় যাচ্ছে ভদ্রলোক। অফিসের বস বস একটা গন্ধ আসছে ওনার থেকে।
“ছোঁয়া বলে ডাকবেন।
মুচকি হেসে বলে ছোঁয়া।
” বাহহহ দারুণ তো নামটা।
বস ছোঁয়াকে দেখে। মেয়েটাকে সুন্দরী বলা চলে না। মায়াবতী বলা যায়। চোখে মুখে কি মায়া। সাদমান কি সাধে পাগল হয়েছে?
কিন্তু বয়সটা খুশই কম। নিসন্দেহে এই মেয়ের সাথে সাদমানের যায় না।
কিন্তু তবুও মানতে হবে। কারণ এই পিচ্চি মেয়েটার সাদমানের বউ।
দীর্ঘ শ্বাস ফেলেন উনি।
রহিম তুমি এখানে কি করছো?
রহিম নামের লোকটা ঘাবড়ে যায়। দরদর করে ঘামতে থাকে।
“না মানে স্যার
আমতা আমতা করে বলতে যায়।
” আচ্ছা ঠিক আছে। আমার কেবিনে এসো তুমি। অনেক হিসেব করার আছে।
রহিমকে উদ্দেশ্য করে বলে। রহিমের গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। ভয়ে হাত পা থরথর করে কাঁপছে।
“তুমি যাও
ছোঁয়া বসের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসে। বসও ছোঁয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। ছোঁয়ার মুখটা দেখে প্রাণ জুড়িয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে ইসসস এই মেয়েটা যদি আমার মেয়ে হতো?
রহিমকে ভেংচি কেটে সাদির কেবিনের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় ছোঁয়া।
আস্তে করে ধাক্কা দেয়। খুলে না
তারপর সবটুকু শক্তি দিয়ে জোরে ধাক্কা দেয়। সাথে সাথে খুলে যায়। আর ছোঁয়াও হুরমুর করে ঢুকে পড়ে।
এভাবে রুমে ঢোকাতে সাদি আর মেঘার নজর পড়ে ছোঁয়ার দিকে। চমকে ওঠে দুজনই।
ছোঁয়া সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে মেঘার দিকে তাকিয়ে আছে। সাদির পাশেই চেয়ার টেনে বসেছিলো মেঘা। পরনে হাতা কাটা হাঁটু ওবদি কালো ফ্রক। চুল গুলো উঁচু করে ঝুঁটি বাঁধা। গলা বড়।
সাদিও কালো শার্ট পড়েছে। ছোঁয়া চোয়াল শক্ত করে ফেলে।
“ততুমি এখানে?
সাদি শুকনো ঢোক গিলে বলে।
ছোঁয়া পার্স থেকে ফোন বের করে ভিডিও করতে থাকে সাদি আর মেঘাকে। এটা দেখে মেঘা আরও একটু চিপে দাঁড়িয়ে। সাদির কয়েক সেকেন্ড সময় লাগে বুঝতে ছোঁয়া ঠিক কি করছে। যখন বুঝতে পারে তখন এক লাফে সরে দাঁড়ায়। ছোঁয়া ফোনটা আবার পার্সে ঢোকায়।
-এখানে নিকনিক চলছে বলে বাইরে পাহারা দেওয়ার জন্য লোক ফিট করে রেখেছিলেন তাই না?
ছোঁয়া শান্ত গলায় বলে। সাদি কপালে তিনটে ভাজ ফেলে। মেঘা মিটমিট করে হাসতে থাকে।
“তুমি এখানে কিভাবে আসলে?
সাদি জিজ্ঞেস করে।
” আমাকে নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না।
অভিমানি কন্ঠে বলে ছোঁয়া।
চোখ দুটো টিকটিক করছে। গলা কাঁপছে।
“এই জন্যই আমাকে বেবি দিতে চান না আপনি। বেবি এসে গেলে তো আর নিকনিক করতে পারবেন না।
বলেই ছোঁয়া বেরতে নেয়। সাদি ছোঁয়ার হাত টেনে ধরে।
” শোনো আমার কথা।
ছোঁয়া তাকায় না সাদির দিকে।
“কালকে আমাদের প্রেজেন্টেশন। পুরোটা আমি আর মেঘা করেছি। সেটা নিয়েই ডিসকাসড করছিলাম।
সাদি বলে।
” তার জন্য আমার ফোন রিসিভ করছিলেন না?
ছোঁয়া কান্না আটকে বলে।
সাদি মুচকি হাসে। ছোঁয়াকে সামনে এনে দাঁড় করায়। ছোঁয়া মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। দুই চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে।
“একা এসেছো?
সাদি ছোঁয়ার থুতনিতে হাত দিয়ে মুখটা উঁচু করে বলে। ছোঁয়া উওর দেয় না।
” স্যার আমাদের এখনো কাজটা কম্পিলিট হয় নি। নেকামি ছাড়ুন আর নিজের জায়গায় এসে বসুন৷
মেঘা বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে বলে।
সাদি দাঁতে দাঁত চেপে তাকায় মেঘার দিকে।
“তুমি এখন আসতে পারো। বাকিটুকু আমি একাই করে নিতে পারবো।
বলে সাদি। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ফেলে মেঘা।
” চলো তোমাকে দেখায় আমরা কি বানিয়েছি।
সাদি ছোঁয়ার হাত ধরে টেনে ল্যাপটপের সামনে নিয়ে যায়। চেয়ার টেনে দেয় ছোঁয়াকে বসার জন্য। ছোঁয়া বসে না ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। সাদি বসে যায়। ছোঁয়াকে দেখাতে থাকে স্বপ্নের বাড়িটা।
ছোঁয়ার সেদিকে মন নেই। মনটা পুরোপুরি মেঘার ড্রেসআপের দিকে। এই ড্রেস দেখিয়ে পাগল বানাতে চাইছে সাদিকে। এখন পাগল বানাবে তো ছোঁয়া।
বাঁকা হাসে ছোঁয়া।
“আমি আপনার কে হই?
বা হাতের উল্টো পিঠে চোখের পানি মুছে নাক টেনে প্রশ্ন করে ছোঁয়া। সাদি ভরকে যায়। মেঘা পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায় ছোঁয়ার দিকে।
” বলুন?
সাদির উওর দিতে দেরি হচ্ছে বলে আবারও প্রশ্ন করে ছোঁয়া।
“ববউ হও
সাদি বলে।
“ইয়েস,
আমি আপনার বউ হই। সাত মাস হয়ে গেছে আপনার আর আমার বিয়ের।
তাই না?
এক গাল হেসে বলে ছোঁয়া।
সাদি ভেবলার মতো তাকিয়ে মাথা নারায়।
” তো আমি আপনাকে দুটো অপশন দিচ্ছি। ওকে?
১. আমাকে আজকেই ডিভোর্স দিতে হবো
২. নাহলে পুরো অফিসের সবাই মিষ্টি হওয়াতে হবে, আর সবাইকে বলতে হবে আমি আপনার বউ।
বলুন কোনটা করবেন?
ঘরে বউ রেখে বাইরে নিকনিক করতে আমি একদমই দেবো না।
সাদি মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে।
“ডিভোর্স দিয়ে দেবে।
মেঘা বলে।
” আপনি চুপ থাকুন
ছোঁয়া দাঁতে দাঁত চেপে বলে।
“আমি চুপ থাকবো না।
মেঘা বলে।
” তাহলে আমি চুপ করিয়ে দিচ্ছি।
ডেস্কের ওপর থেকে পানি গ্লাসটা নিয়ে মেঘনার মুখে ছুঁড়ে মারে। হতদম্ভ হয়ে যায় মেঘা। সাদি বড়বড় চোখ করে তাকায়।
তারপর টিস্যু নিয়ে মেঘার মুখ ঘসতে থাকে ছোঁয়া। মেঘা ছোঁয়াকে ছাড়াতে না পেরে ধাক্কা দেয়। সাদির ওপর এসে পড়ে ছোঁয়া। সাদি দুহাতে আগলে নেয়। ছোঁয়া আরামছে সাদির কোলে বসে।
কড়া মেকাপ উঠে গেছে। কাজল লেপ্টে গিয়ে ভুতের মতো হয়ে গেছে৷ লিপস্টিক ঠোঁটের চারপাশে লেগে গেছে। চুল গুলো এলোমেলো। পারফেক্ট ভুত লাগছে মেঘাকে।
ছোঁয়া খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। সাদিও মুচকি হাসে।
মেঘা দাঁত কটমট করে ছোঁয়ার দিকে তাকিয়ে রাগে গজগজ করতে করতে বেরিয়ে যায়।
মেঘা বেরিয়ে যেতেই ছোঁয়া সাদির দিকে ঘুরে বসে। দুই হাতে মুঠো করে ধরে সাদির চুল গুলো।
সাদি ছোঁয়ার হাত দুটো মুঠো করে ধরে।
নিজের মেয়ের সাথে এতকিছু হয়ে গেলো অথচ বাবা মা টেরই পেলো না?
নাজমা বেগম আঁচলে মুখ গুঁজে কাঁদছে। শফিকুল রহমান সিমির দিকে তাকিয়ে আছে। সিমি শক্ত করে পরিকে দরে মাথা নিচু করে বসে আছে।
সাবিনা বেগম তনু তনুর বাবা কাকিমা সাগর সবাই মাথা নিচু করে বসে আছে।
“সিমি চল মা।
শফিকুল রহমান দাঁড়িয়ে বলে।
চমকে ওঠে সবাই।
” আমার ছেলে ভুল করেছে। আমি আপনার কাছে সমাধান চেয়েছি।
সোহেল চৌধুরী শফিকুলের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলে।
“ভুল বলবেন না। এটা ভুল না। অন্যায় করেছে। আমি আমার মেয়েকে আর নাতনিকে নিয়ে যাবো। আশা করি আপনারা কখনো অধিকার নিয়ে যাবেন না।
তাহলে আমি পুলিশের সাহায্য নিতে বাধ্য হবো।
আপনাদের বিশ্বাস করতে পারছি না আমি। ছোঁয়া আসলে ওকেও নিয়ে যাবো আমি।
কোনো সম্পর্ক রাখতে চাই না আপনাদের সাথে।
কর্কশ গলায় বলেন উনি।
চলবে……..
পর্ব ৪৮- শেষ