ভাড়াটিয়া পর্ব ১৮
সুইটি অনেকটা সময় ধরে বসে আছে একটা চেম্বারে। ছোটো খাটো একটা ঘর। প্রাইভেট চেম্বারের মতো সাজানো গুছানো না।
ঘরটা বেশ পরিস্কার বলা যায়। সরকারি চেম্বারে আসবাবপত্র খুব একটা থাকার কথা না। একটা বড়ো ধরনের টেবিল আর গুটিকয়েক চেয়ার আছে। অন্য ডাক্তারের চেম্বারে একটা বেড থাকে। এখানে কোনো বেড নাই! ডাক্তার মনে হয় এ ঘরে রোগী টুগী দেখেন না।
একটা লম্বা সময় কাটিয়ে চেম্বারে ঢুকলেন মুখলেছুর রহমান। সুইটি জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে।
ডাক্তার ঘরে ঢুকেছেন সুইটি টের পায়নি। ডাক্তার ঢুকে নিজের চেয়ারে বসলেন। সুইটি তখন বাইরে তাকিয়ে আছে।
“কী খবর সুইটি?”
শব্দ শুনে প্রথমে একটু থতমত খেয়ে গেল সুইটি। অপ্রস্তুত হয়ে তাকাল ডাক্তারের দিকে। হালকা একটু হাসি দিয়ে বলল, “ভালো। ” ভালো বললেও সুইটি অবশ্য ভালো নেই! “আপনি?”
“আছি ভালোই। তোমার কোনো খবর নেই কেন?”
“কয়েকদিন আগে তো একবার এসেছিলাম স্যার।”
“হ্যাঁ, মনে পড়েছে।”
“টাকাটা আমি জোগাড় করে ফেলেছি স্যার।”
“এখন তো আর টাকার দরকার নেই সুইটি।”
ডাক্তারের কথায় সুইটির বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। তবে কি? মা আর নেই! চোখে কেমন ঝাপসা দেখতে লাগল সুইটি! ডাক্তারটা খুব ভালো মানুষ। সুইটির জন্য অনেক কিছু করেছে। অনেক করে বলেছিল টাকাটা দ্রুত জোগাড় করতে। সুইটি টাকাটা জোগাড় করেছে। এখন সব শেষ হয়ে গেল!
সুইটির দিকে তাকিয়ে ডাক্তার বললেন,” ঘাবড়ানোর কিছু নেই! তোমার মায়ের অপারেশন হয়ে গেছে। তাই টাকার আর প্রয়োজন নেই।”
সুইটি কিছুটা সময় কথাই বলতে পারল না। কত কী করে ও টাকা জোগাড় করল।
“কী করে জোগাড় হলো?”
“তুমি জানো না! তোমার বাবাই তো টাকাটা জমা করে দিয়েছেন। তোমার মায়ের অপারেশন হয়ে গেছে সুইটি। এখন উনি ভালোই আছেন।”
সুইটি অবকা হয়ে তাকিয়ে আছে ডাক্তারের দিকে। বাবা টাকা জমা দিয়েছে! যে বাবা কোনোদিন ওদের খবর নেয়নি! ওরা বেঁচে আছে না মরে গেছে। সেই বাবা ওর মায়ের অপারেশনের জন্য ত্রিশ লাখ টাকা দিয়েছে। এটা বিশ্বাস করা যায়। সুইটিদের খবরই বা জানল কী করে? ওনার সাথে তো বহুবছর ধরে কোনো যোগাযোগ হয়নি। সুইটি ঠিক হিসাব মিলাতে পারছে না! বাবার কথা ওর খুব একটা মনে নেই। মা যখন ও বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিল তখন সুইটির বয়স কত হবে? পাঁচ ছয় বছর। এতটা বছরে একবারও যে বাবা খবর নেয়নি! সেই বাবা কোথা থেকে এসে এত টাকা দিলো?
সুমি ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হয়ে গেল। মা কে দেখতে হবে। কাঁচেঘেরা একটা ঘরে মা কে রাখা হয়েছে। সারা মাথা ব্যান্ডেজ করা। মায়ের কাছে যাওয়া যাবে না।
অনেকটা সময় কাঁচের সামনে দাঁড়িয়ে রইল সুইটি। মায়ের এই অপারেশনটা করানোর জন্য কত কী করল সুইটি! শেষমেশ কি না টাকাটা এমনি এসে গেল!
হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে পড়ল সুইটি। মাথায় শুধু ঘুরপাক খাচ্ছে। বাবার কথা। বাবা কি ভালো হয়ে গেল? অমন মানুষ কখনো ভালো হয়!
মানুষের টাকা দিয়ে এখন সুইটি কী করবে? মায়ের জন্যই তো সে টাকা জোগাড় করেছে। মায়ের যেহেতু টাকাটা লাগল না। এখন কী টাকাটা ফেরত দিবে? সব টাকা অবশ্য নেই। বেশ কিছু খরচ হয়ে গেছে। ওরা দুইজনও তো টাকা নিয়েছে। ওর কাছে থাকা টাকাটা ফেরত দেয়া যায়।
মিলন খন্দকার বসে আছেন শাহিন সাহেবের সামনে। ওনার মুখে একটা বিরক্তির ছাপ। শাহিন সাহেব হালকা হেসে বললেন, ” কী খাবা বলো?”
“খাওয়া টাওয়া পরে হবে আগে তোমার প্লান বলো?”
“আগে চা টা খাও। মাথা ঠান্ডা করো। পুলিশের মাথা গরম থাকা ভালো না!”
মিলন খন্দকার আলগা হাসি দিলেন। বুঝতে পারছেন। শাহিন সহজে ছাড়বে না।
শাহিন সাহেব টেবিলের ওপরের বেলটা চাপ দিলেন। সাথে সাথে অফিসের পিয়নটা ছুটে এলো।
শাহিন সাহেব বললেন, “দুই কাপ কফি দাও। আর শোন, নীচের করিমের দোকান থেকে গরম গরম সিঙ্গারা নিয়ে এসো তো।”
পিয়নটা ছুটে গেল।
মিলন খন্দকার বন্ধুর দিকে আড় চোখে তাকিয়ে বললেন,” এখন আবার সিঙ্গারা কেন! এখন এ সব খাওয়া বাদ দাও।”
“আরে খাও, খাও। করিম সিঙ্গারাটা ভালো বানায় বুঝলা। “
“মেয়েটাকে কী করা যায় সেটা বলো?”
“আঃ! তোমাকে তো বলেছি তোমার ডিপার্টমেন্টের কাজ আপাতত তো বন্ধ রাখ। আমি একটা পরীক্ষা করেনি। তারপর তোমাকে বলব।”
“কী করবা সেটাই তো জানতে চাচ্ছি। “
“করার পরে সব বলব। এখন তোমারা শুধু নজরে রাখ ব্যস।”
“সে না হয় রাখলাম। কিন্তু তোমার বউমা কে কিন্তু সহজে ছাড়া যাবে না! সে তো শুধু তোমার সাথেই এমন করেছে তা না। আর কয়েকটা পরিবারের সাথে একই কাজ করেছে!”
“সাজা হলে সে তো সাজা পাবেই। সেখানে আমাদের কী করার আছে। তবে মামুন ছেলেটা কে একটা ধন্যবাদ দিতে হয়। কত দ্রুত এদের বের করে ফেলল।”
“হ্যাঁ, মামুন খুব কাজের ছেলে। ছেলেটা কে আমার খুব পছন্দ। “
পিয়ন একটা ট্রেতে ছোটো ছোটো সিঙ্গরা এনে টেবিলে রাখল। একটা কাঁচের জগে পানি। আর দুইটা গ্লাস টেবিলে রাখল। “কফি কি এখন দিবো স্যার?”
শাহিন সাহেব বললেন,” একটু পরে দাও।”
কিছু না বলে চলে গেল।
শাহিন সাহেব মিলনের দিকে ইশারা করে বললেন,” নাও।”
শাহিন সাহেব বাসায় ফিরলেন বিকালের দিকে। এমনিতে সন্ধ্যায় ফিরেন আজ একটু আগেই ফিরলেন। শাহিন সাহেব ফাতেমা ডাকলেন।
ফাতেমা ছুটে এসে বলল, “কী খবর বাবা?”
“কী করিস রে মা?”
“কিছু করি না বাবা।”
” তোর পরীক্ষা কেমন হলো রে মা?” উনি চেয়েছিলেন মেয়েটা কে পরীক্ষার সময় নিয়ে যেতে। রায়হান বলল,’ তোমার যাওয়ার দরকার নেই বাবা আমি যাচ্ছি। ‘
“ভালোই হয়েছে বাবা।”
“খুব ভালো। তা রায়হান কোথায়?”
“ঘরে শুয়ে আছে।”
শাহিন সাহেব বারান্দায় বসে আছেন। সুইটি কে খুঁজে পাওয়ার কথাটা এখনো বাসার কাউকে জানান হয়নি। আনোয়ার কে এখন বলা যায়। ক্ষেপে যাবে কি না কে জানে? আনোয়ারা কি পারবে মেয়েটা কে ক্ষমা করে দিতে?
আনোয়ারা বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে হাতে একটা ট্রে। শাহিন সাহেব বললেন, “এখন আবার কি আনলে?”
আনোয়ারা আলগা হাসি দিলো। শাহিন সাহেবের পছন্দের পিঠা বানান হয়েছে।
পিঠা দেখে শাহিদা সাহেব হালকা হাসি দিলেন। আনোয়ার শাহিন সাহেবের পাশের চেয়ারে বসলেন।
আনোয়ারা বললেন, “সুইটি মেয়েটার কোনো খোঁজ পাওয়া গেছে?”
শাহিন সাহেব একটু অবাক হলেন। আজ হঠাৎ আনোয়ারা মেয়েটার কথা জানতে চাইল কেন? আনোয়ারা কিছু জানতে পেরেছে?
এ সময় ফাতেমা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো বারান্দায়। এসে হাঁপাচ্ছে।
আনোয়ারা জিজ্ঞেস করলেন, ” কী হয়েছে রে? “
“মা, মা সুইটি মেয়েটা এসেছে! “
দুইজনই বিস্মিত হয়ে ফাতেমার দিকে তাকিয়ে রইল।
চলবে–
Nabil Mahmud